শরিফা হাঁপাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এক্ষুণি দম বন্ধ হয়ে যাবে। তার কেবলি মনে হচ্ছে ঘরে ফিরে দেখবে মানুষটা লম্বা হয়ে পড়ে আছে। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে। আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। লোকজন জেগে উঠবে। নানান কথা জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু কাউকে কিছু বলা যাবে না। সাপে কাটার ব্যাপারটা জানাজানি হওয়া খুব খারাপ। যতই জানাজানি হবে ততই বিষ উঠবে। ওঝা এসে ঝাড়ফুক করবার পর তোকজন জানুক, তাতে ক্ষতি নেই। শরিফা জলিলের ঘরের দাওয়ায় উঠে এল। জলিল ঘুমুচ্ছিল। ডাকাডাকিতে উঠে এল। অবাক হয়ে বলল, বিষয় কি?

আপনের দোস্তরে সাপে কাটছে।

কও কী? কোন সময়?

শেষ রাইতে।

কী সর্বনাশের কথা। এতক্ষণ করছ কী?

আমারে কিছু কয় নাই।

আচ্ছা ঠিক আছে, বাড়িত যাও। আমি ওঝার কাছে যাইতেছি। তুমি মুখ খুলবা না। কেঊরে একটা কথা কইবা না।

জলিল জামা গায়ে দিল। তার স্ত্রী পোয়াতি। এখন-তখন অবস্থা। সে বিছানা থেকে ক্ষীণ স্বরে বলল, শরিফা ক্যান আইছিল?

এম্নে আইছে।

কইছে কি?

কিচ্ছু কয় নাই।

ঘরে ঢুকল না ক্যান?

আহ্, চুপ।

জলিল রওনা হল ধূপখালির দিকে। নিবারণ ওঝার খুব নামডাক। এখন তাকে পাওয়া গেলে হয়। সাপে কাটার সময় এখন। হয়তো খবর পেয়ে চলে গেছে কোনখানে।

আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। কাক ডাকছে। তাদের কর্কশ শব্দ আজ যেন অন্য দিনের চেয়েও বেশি। সাঁকো-পারে ভোলা মিয়ার সঙ্গে দেখা। সে বিস্মিত হয়ে বলল, দৌড়াও ক্যান? কি হইছে?

কিছু হয় নাই।

জলিল থামল না, আরো দ্রুত পা ফেলতে লাগল। ভোলা মিয়া দ্বিতীয় প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল না। মনে হল সে বুঝতে পেরেছে। এখন গ্রামে গিয়ে উঁচু গলায় বলাবলি নাকরলেই হয়। যতই জানাজানি হবে বিষ ততই চড়তে থাকবে। নিয়মই এই রকম।

 

শরিফা ঘরে ফিরে দেখল–মনিরউদ্দিন ঘরের ভেতর থেকে বারান্দায় এসে বসেছে। বিড়ি টানছে নিজের মনে। শরিফা ক্ষীণ স্বরে বলল, জলিল ভাই ওঝা আনতে গেছে।

গেছে ভালো হইছে। পানি জ্বাল দে। চুলা ধরা।

পানি দিয়া কী করবেন?

আহ্, খালি কথা বাড়ায়।

শরিফা বাধ্য মেয়ের মতো চুলা ধরাতে গেল। তার এখন বেশ শান্তি লাগছে। বিষ বেশি দূর উঠতে পারে নি। বিষ উঠে গেলে কথা জড়িয়ে যেত। সে সাপে-কাটা মানুষ মরতে দেখেছে। গলার স্বর আস্তে-আস্তে ভারি হয়ে যায়। চোখের তারা বড় হতে থাকে। এমনভাবে তাকায় যেন কাউকে চিনতে পারছে না, অথচ ঠিকই চিনতে পারে। ঘন-ঘন পানি খেতে চায়, কিন্তু দু-এক ঢোক খেয়েই বলে, তিতা লাগছে। এক সময় অল্প-অল্প বমি করে।

শরিফা অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচিতে এক ডেকচি ফুটন্ত পানি এনে সামনে রাখল। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

একটা বদনার মধ্যে পানিটা নিয়া আস্তে-আস্তে আমার পায়ে ঢাল্‌।

শরিফা অবাক হয়ে বলল, কোনখানে ঢালমু?

সাপে-কাটা জায়গাটার মইধ্যে ঢাল্‌।

শরিফা আঁতকে উঠে বলল, এইটা কী কনা বলক-দেওয়া পানি। পাও পুইড়া কয়লা হইয়া যাইব।

তোরে যা কইছি করু। কথা বাড়াইস না।

পাও পুইড়া সিদ্ধ হইয়া যাইব।

হউক। খালি কথা বাড়ায়।

শরিফার হাত কাঁপছে। পানি ফেলতে গিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মনিরউদ্দিন স্থির হয়ে বসে আছে। একবার সে শুধু জন্তুর মতো চিৎকার করেই চুপ করে গেল। শরিফা নিজেই কেঁদে ফেলল। এই কষ্ট কেউ ইচ্ছা করে সহ্য করতে পারে। খোদার আলমে এমন মানুষ আছে?

তুই কান্দস ক্যান? তোর তো কিছু হয় নাই।

শরিফা গলা ছেড়ে কেঁদে উঠল। মনিরউদ্দিন তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তাকিয়ে আছে নিজের পায়ের দিকে। শরিফা পানি এক জায়গায় ফেলতে পারে নি। চারদিকে ছড়িয়েছে। ফোস্কা পড়ে গেছে সেসব জায়গায়। অসহ্য যন্ত্রণা! কিন্তু এই যন্ত্রণার ভেতরও একটি ক্ষীণ আশার ব্যাপার আছে। সাপের কামড়ের জায়গাটি থেকে ক্ষীণ একটি রক্তের ধারা নেমে যাচ্ছে। জমাট বিষ বেরিয়ে যাচ্ছে। মনিরউদ্দিন ক্লান্ত গলায়। বলল, একটা পাখা আন্। হাওয়া করু।

প্রয়োজনের সময় কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। তালের পাখা বিছানায় নিয়ে শুয়েছিল, সেটি এখন কোথাও নেই। আশ্চর্যের ব্যাপার। এটা যাবে কোথায়?

শরিফা।

কি?

করতাছস কি?

পাখা খুঁজি।

বাদ দে।

শরিফা দরজা ধরে অপরাধীর ভঙ্গিতে দাঁড়াল। তার গালে পানির দাগ এখনো শুকায় নি।

রোদ উঠে গেছে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু এই বাড়িতেই সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেল।

মনিরউদ্দিন হঠাৎ করেই অসম্ভব নরম গলায় বলল, আমার এক মামি আছিল-চাঁনসোনা নাম। তোর মতো সুন্দর আছিল। বাঞ্জা মাইয়ামানুষ। পুলাপান ছিল না।

শরিফা ভেবে পেল না, হঠাৎ মামির কথা আসছে কেন।

শরিফা।

কি?

মামিটা বড় ভালো আছিল। মজার শিলুক দিত।

হঠাৎ তার কথা কন ক্যান?

কোনো কারণ নাই। এমনে মনে হইল। এক গেলাস পানি দে। তিয়াষ হইতাছে।

শরিফা পানি এনে দিল। মনিরউদ্দিন পানি খেতে পারল না। এক ঢোক খেয়েই বলল, পানি তিতা লাগছে।

রক্তশূন্য হয়ে গেল শরিফার মুখ। কী সর্বনাশের কথা! পানি তিতা লাগবে কেন?

মনিরউদ্দিনের কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। দড়ি দিয়ে বাঁধা পা অনেকখানি ফুলে উঠেছে। সে থেমে-থেমে শ্বাস নিচ্ছে, যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

বড় আদর করত আমারে।

কার কথা কন?

আমার মামি। চাঁনসোনা নাম। আমার জীবনা কষ্টে গেছে, বুঝছস শরিফা। খুব কষ্টে।

শরিফা তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুটি বড়-বড়। সেখানে পানি টলটল করছে। সাদা মোরগটি এগিয়ে আসছে। এর কৌতূহল অন্যদের চেয়ে বেশি।

শরিফা। আমার মামি বড় সুন্দর-সুন্দর কথা কই।

জ্বি।

মনিরউদ্দিনের কথা। জড়িয়ে যাচ্ছে। বিশাল একজন মানুষ কেমন শিশুদের ভঙ্গিতে কথা বলছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ