রাত্রি ভোরবেলাতেই চলে এসেছে।

সুরমা রান্নাঘরে ছিলেন। সে চলে গেল রান্নাঘরে। সুরমা মেয়েকে দেখে বিস্মিত হলেন। এ কি চেহারা হয়েছে মেয়ের! মুখ শুকিয়ে কেমন অন্য রকম দেখাচ্ছে। চোখ লাল।

তোর কী হয়েছে?

কিছু হয়নি।

ঠিক করে বল কি হয়েছে?

রাতে ঘুম হয়নি মা। সারারাত জেগে ছিলাম।

সুরমা আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। রুটি বেলতে লাগলেন। বিন্তি রুটি সেঁকছে এবং নিজের মনেই হাসছে। রাত্রি হালকা গলায় বলল, আজ কি নাশতা মা?

সুরমা কঠিন গলায় বললেন–দেখতেই পাচ্ছিস কি! জিজ্ঞেস করছিস কেন?

রাত্রি মৃদু স্বরে বলল, আমার ওপর কেন তুমি রেগে যাচ্ছ মা? আমি কী কখনো তোমাকে রাগানোর জন্যে কিছু করেছি?

সুরমা উত্তর দিলেন না। রাত্রি আবার বলল, চুপ করে থাকবে না। বল তুমি, কখনো কী তোমাকে রাগানোর মত কোনো কারণ ঘটিয়েছি?

সুরমা দেখলেন রাত্রির চোখে জল টলমল করছে। যেন এক্ষুণি সে কেঁদে ফেলবে। তাঁর নিজেরো কান্না পেয়ে গেল। তিনি মনে মনে বললেন, কেউ যেন আমার এই মেয়েটির মনে কষ্ট না দেয়। বড় ভাল মেয়ে। বড় ভাল।

রাত্ৰি।

কি মা। আলমের ঘুম ভেঙেছে কিনা দেখে আয়।

বলেই সুরমা পাংশুবৰ্ণ হয়ে গেলেন। কেন রাত্রিকে এই কথা বললেন? তিনি ভালই জানেন আলম জেগে আছে। কিছুক্ষণ আগেই তিনি তাকে চা দিয়ে এসেছেন। রাত্রিকে এ কথা বলার উদ্দেশ্য কি এই যে তিনি তাকে খুশি করতে চেয়েছেন? কী ভয়ানক কথা! রাত্রি কি তার এই উদ্দেশ্য ধরতে পেরেছে? নিশ্চয়ই পেরেছে। সে বোকা মেয়ে নয়। নিজেকে সামলানোর জন্য তিনি থেমে থেমে  বললেন–

আজ চলে যাবে। একটু যত্ন-টত্ন করা দরকার।

আজ চলে যাবেন নাকি?

হ্যাঁ। এক সপ্তাহ থাকার জন্যে এসেছিল। এক সপ্তাহ তো হয়ে গেল।

তিনি কি বলছেন। আজ চলে যাবেন?

হ্যাঁ বলেছেন।

রাত্ৰি হালকা পায়ে ঘর ছেড়ে গেল। তার গায়ে একটা ধবধবে সাদা সিল্কের শাড়ি। শাড়িতে বেগুনি ফুল। কি চমৎকার লাগছে রাত্রিকে। তাঁর মনে হল শুধুমাত্র মেয়েরাই সৌন্দর্য বুঝতে পারে। পুরুষরা পারে না। ওদের নজর থাকে শরীরের দিকে। সৌন্দর্য দেখবার সময় কোথায় ওদের।

আলম পা ঝুলিয়ে খাটে বসে আছে। তার কোলের উপর একটি বই। সে পা দুলাচ্ছে। রাত্রিকে ঢুকতে দেখে সে অল্প হাসল।

কখন এসেছেন?

এই তো কিছুক্ষণ আগে।

কী বই পড়ছেন এত মন দিয়ে?

আলম একটু উঁচু করে দেখাল ‘দত্তা’। রাত্ৰি হাসিমুখে বলল, অপালা এই বইটা মুখস্থ বলতে পারে। পাঁচ ছদিন পর পর এই বইটা সে একবার পড়ে ফেলে।

আলম বলল, আপনি কি অসুস্থ? কেমন যেন অন্য রকম লাগছে।

না, অসুস্থ না। আমি বেশ ভাল। দেখতে এসেছি আপনি কেমন আছেন। কাল সন্ধ্যাবেলা যা ভয় পেয়েছিলাম। কেন জানি মনে হচ্ছিল কিছু একটা হয়েছে আপনার। কি যে কষ্ট হচ্ছিল। আপনি কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবেন না।

আলমের অস্বস্তি লাগছে। এসব কি বলছে এই মেয়ে? কিন্তু এ তো সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলছে। আলম কথা ঘুরাবার জন্য বলল, কাল কি হয়েছে শুনতে চান?

না শুনতে চাই না। যুদ্ধ-টুদ্ধ আমার ভাল লাগে না।

কারোরই ভাল লাগে না।

রাত্রি খাটে আলমের মত পা ঝুলিয়ে বসল। মিষ্টি একটা গন্ধ বাতাসে ভাসছে। সৌরভ। কি মানুষের মনে বিষাদ জাগিয়ে তুলে? তুলে বোধ হয়। আলমের কেমন জানি মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

রাত্রি বলল, আপনি নাকি আজ চলে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

কখন যাবেন?

বিকালে।

আপনি কি ঢাকাতেই থাকবেন, না চলে যাবেন অন্য কোথাও?

ঢাকাতেই থাকব।

আর আসবেন না আমাদের এখানে?

আসব না কেন, আসব।

আমার মনে হচ্ছে আপনি আর আসবেন না।

এ রকম মনে হচ্ছে কেন?

কেউ কথা রাখে না।

রাত্রি হঠাৎ উঠে চলে গেল। কারণ তার চোখ চলে ভরে আসছে। এই জল একান্তই নিজের, লুকিয়ে রাখার জিনিস। সে চলে গেল তার নিজের ঘরে।

অপালা সেখানে বসে আছে। তার হাতে একটা গল্পের বই। সে বই নামিয়ে বলল, কাদছ কেন আপা?

মাথা ধরেছে।

অপালা চোখ নামিয়ে নিল বইয়ে। সে নিজেও কাঁদছে। কারণ এই মুহূর্তে সে খুবই দুঃখের একটা ব্যাপার পড়ছে। নায়িকা সিঁড়ি থেকে পিছলে পড়েছে এবং চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। সে আর্তস্বরে চিৎকার করছে।–অরুণ! অরুণ! সে ডাক শুনেও নির্বিকার ভঙ্গিতে নেমে যাচ্ছে।

সুরমা নাস্তা টেবিলে দিয়ে আলমকে ডাকতে এলেন। আলম জুতো পরছে।

কোথাও বেরুচ্ছ?

জি।

কখন ফিরবে?

বিকেলে এসে বিদায় নিয়ে যাব।

সুরমা একবার ভাবলেন বলেন, মাঝে মাঝে এসো। কিন্তু বলতে পারলেন না। যেসব কথা আমরা বলতে চাই তার বেশির ভাগই আমরা বলতে পারি না।

নাশতা খেতে আস বাবা।

আসছি।

 

মতিন সাহেব ঢাকা রেডিও খুলে বসেছিলেন। বাচ্চাদের একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। কিচিরমিচির করছে একদল বাচা।

আপা, আমি একটা ছড়া বলব। আমার নাম রুমান ময়না। ময়না কোন কথা কয় না…

বাহ বাহ বেশ হয়েছে। এবার তুমি আস। পরিষ্কার করে নাম বল।

আপা, আমার নাম সুমন, আমি একটা গান গাইব। রচনা বিদ্রোহী কবি নজরুল– কাবেরী নদীজলে কে গো বালিকা…

চমৎকার হয়েছে। এবার তুমি আস।

মতিন সাহেব বিড়বিড় করে বললেন… এদের ধরে চাবকান উচিত। এ সময় গান গাচ্ছে, ছড়া বলছে, কতবড় স্পর্ধা!

সুরমা এসে বললেন, নাশতা দেয়া হয়েছে। খেতে আস।

মতিন সাহেব শিশুর মত রেগে গেলেন।

যাও, আমি খাব না কিছু। যত ইডিয়টের দল। গান গাইছে, ছড়া বলছে। চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিতে হয়।

শরীফ সাহেব আলমকে দেখে মোটেই অবাক হলেন না। তার ভঙ্গি দেখে মনে হল তিনি যেন মনে মনে তার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন।

মামা কি খবর তোমার?

ভাল। তুই এখনো বেঁচে আছিস?

আছি।

কাল রাতে স্বপ্নে দেখলাম গুলি খেয়েছিস; তখনি বুঝলাম তুই ভাল আছিস। আমার স্বপ্ন সব সময় উল্টো হয়।

শরীফ সাহেব কোমরের লুঙ্গি আঁট করতে করতে উঠে দাঁড়ালেন। নটা বাজে। অফিসে যাবার জন্য তৈরি হতে হয়। কিন্তু কেন যেন অফিসে যেতে ইচ্ছা করছে না। লুঙ্গিী বদলে প্যান্ট পরতে হবে ভাবতেই খারাপ লাগছে।

চা খাবি?

না।

কফি। কফি খাবি? একটা ইনসটেন্ট কফি কিনেছি। চা বানানোর মহা হাঙ্গামা। কাজের ছেলেটা আমার একটা সুটকেস নিয়ে পালিয়ে গেছে।

বলতে বলতে তাঁর হাসি পেয়ে গেল। কারণ সুটকেসটিতে কিছু পুরনো ম্যাগাজিন ছাড়া কিছু ছিল না। ছাত্র জীবনে কিছু গল্প কবিতা লিখতেন। তার কয়েকটি ছাপাও হয়েছিল। সুটকেস বোঝাই সেই সব ম্যাগাজিনে। ·

হাসছ কেন?

ব্যাটা খুব ঠক খেয়েছে। সুটকেস খুলে হাউমাই করে কাঁদবে।

আলমের মনে হল, তার মামার হাসির ভঙ্গিটি কেমন যেন অস্বভাবিক। সুস্থ মানুষের হাসি নয়। অসুস্থ মানুষের হাসি।

আলম।

বল।

তোর চিঠি তোর মাকে পৌঁছে দিয়েছি।

মা ভাল আছেন?

জানি না।

জানি না মানে?

দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি।

ভাল করেছ। ভাবছি নিজেও চলে যাব। রাতে ঘুম হয় না।

যাও, চলে যাও।

কিন্তু ওরা খুঁজে বের করে ফেলবে। ফখরুদ্দীন সাহেব পালিয়ে গিয়েছিলেন। মানিকগঞ্জ তার শ্বশুরবাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসেছে। এখন বোধ হয় মেরেই ফেলেছে। খাবি তুই কফি?

দাও।

ফার্মগেটের অপারেশনে তুই ছিলি?

হুঁ।

ভালই দেখিয়েছিস।

আলম হাসল। হাসিমুখে বলল, তোমার সামনে সিগারেট খেলে তুমি রাগ করবে?

খেতে ইচ্ছা হলে খা। লায়েক হয়ে গেছিস, এখন তো খাবিই।

কফি ভাল হল না। অতিরিক্ত কড়া হয়ে গেল। হালকা করার জন্য দুধ ও গরম পানি মেশানোর পর তার স্বাদ হল আরো কুৎসিত। শরীফ সাহেব খুব বিকৃত করে বললেন, পেচ্ছাবের মত লাগছে। ফেলে দে। আবার বানাব।

আর বানাতে হবে না। মামা একটা কথা শোন।

বল, শুনছি।

আমি যদি তোমার এখানে থাকি কয়েকদিন তোমার অসুবিধা হবে?

না। আগে যেখানে ছিলি সেখানে কি অবস্থা? জানাজানি হয়ে গেছে?

তা না। ভদ্রমহিলা একটু ভয় পাচ্ছেন। তাছাড়া আমি বলেছিলাম এক সপ্তাহ থাকিব। এক সপ্তাহ হয়ে গেছে।

কখন আসবি?

বিকেলে। আমাকে একটা চাবি দাও।

শরীফ সাহেব চাবি বের করে দিলেন। এবং দ্রুত কাপড় পরতে শুরু করলেন। আলম এখানে থাকলে অফিস মিস করা উচিত হবে না।

আলম।

বল মামা।

একটা সাকসেসফুল অপারেশনের পর ওভার কনফিডেন্ট হবার একটা সম্ভাবনা থাকে। খুব সাবধান। এরা এখন পাগলা কুত্তার মত। দারুণ সতর্ক। পাগলা কুত্তারা খুব সতর্ক হয় জানিস তো?

আমরাও সতর্ক।

স্বপ্ন দেখে মনটা একটু ইয়ে হয়ে গেল। যদিও জানি আমার স্বপ্ন সব সময় উল্টো হয়। প্রমোশন পাওয়ার একটা স্বপ্ন দেখলাম একবার, হয়ে গেল ডিমোশন। অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি বানিয়ে বেইজ্জত করল।

শরীফ সাহেব। আবার হাসতে শুরু করলেন। অন্য রকম হাসি। অসুস্থ মানুষের হাসি।

বুঝলি আলম, এই যুদ্ধ দীর্ঘদিন চলবে। মে বি ফর ইয়ারস। চায়না কেমন চুপ মেরে আছে দেখছিস না? অন্য দেশগুলি চুপ করে আছে আমি মাইন্ড করছি না, কিন্তু চায়না পাকিস্তান সমর্থন করবে। কেন? হোয়াই? মানুষের জন্য মমতা নেই চায়নার এটা ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। হোয়াই চায়না? হোয়াই?

অফিসে যাবে না। মামা?

না ইচ্ছা করছে না। শুয়ে থাকব। সিক রিপোর্ট করব। আসলেই সিক সিক লাগছে। দেখ তো কপালে জ্বর আছে কিনা।

জ্বর নেই।

না থাকলেও হবে। জ্বর হবে, সর্দি হবে, কাশি হবে। ডায়েরিয়া হবে।

শরীফ সাহেব শব্দ করে হাসতে লাগলেন। গা দুলিয়ে হাসি।

 

ঝিকাতলার একটি বাসায় সবাই একত্র হয়েছে। রহমানও আছে। সে এখন মোটামুটি সুস্থ। জ্বর নেমে গেছে। দাড়ি-গোঁফ কামানোয় তাকে বালক-বালক লাগছে। পরবর্তী অপারেশন নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। নতুন মানুষের ভেতর মিনহাজ উদ্দিনকে দেখা যাচ্ছে। তার কাছ থেকেই জানা গেল। আরো কিছু ছোট ছোট গ্রুপ শহরে ঢুকেছে। এরা পাওয়ার স্টেশন নষ্ট করতে চেষ্টা করবে। ট্রান্সফরমার উড়িয়ে দেয়ার কাজটা বাইরে থেকে বোমা মেরে করা যাবে না। সাহায্য আসতে হবে ভেতর থেকে। প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে।

সাহায্য করতে সবাই আগ্রহী। কিন্তু সবাইকে দিয়ে এ কাজ হবে বা। ঠিক লোকটিকে বেছে নিতে হবে। সাহসী এবং বুদ্ধিমান একজন মানুষ। মুশকিল হচ্ছে–এই দু’টি জিনিস খুব কম সময়ই একত্রে পাওয়া যায়। সাধারণত সাহসী লোকদের বুদ্ধি কম থাকে। মিনহাজ সাহেব বললেন, আলম সাহেব, আপনারা যা করছেন এটা হচ্ছে হিরোইজম। ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের বীরত্বের দরকার নেই; আমরা এখন চাই ওদের বিরক্ত করতে। বোমা ফাটিয়ে, গ্রেনেড ফাটিয়ে নার্ভাস করে ফেলতে। বুঝতে পারছেন?

পারছি।

কথাগুলি কিন্তু আমার না। কমান্ড কাউন্সিলের।

তাও জানি।

এমন সব জায়গায় যান। যেখানে মিলিটারি নেই। সরাসরি সংঘর্ষের সম্ভাবনা নেই। যেমন ধরুন, পেট্রল পাম্প। পেট্রল পাম্প উড়িয়ে দিন। দর্শনীয় ব্যাপার হবে।

আলম হাই তুলল। মিনহাজ সাহেব একজন বিরক্তিকর মানুষ। কথা বলে মাথার পোকা নড়িয়ে দেয়। একই কথা একশ বার বলে।

আলম সাহেব।

বলুন শুনছি।

আজ আপনাদের কি প্রোগ্রাম?

আছে কিছু।

বলুন শুনি।

বলার মত কিছু না।

মিনহাজ সাহেব মুখ কালো কবে ফেললেন। এত অল্পতে মানুষ এমন আহত হয় কেন আলম ভেবে পেল না। মিনহাজ সাহেবেব অন্য দল; তাদের সঙ্গে এ দলের কাজকর্মের আলোচনার কি তেমন কোনো দরকার আছে? কোন দরকার নেই।

আশফাক তার পিকআপ নিয়ে উপস্থিত হল দুটার সময়। তার সঙ্গে সাদেক।

আশফাক দাঁত বের করে বলল, নিজের গাড়িই আনলাম। নিজের জিনিস ছাড়া কনফিডেন্স পাওয়া যায় না।

আলম বিরক্ত হয়ে বলল, একই গাড়ি নিয়ে দিতীয়বার বের হতে চাই না।

সাদেক নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ঢাকা শহরে এ রকম পিক-আপ পাঁচ হাজার আছে। তুই ভ্যাজর ভ্যাজর করিস না, উঠে আয়। রোজ একটা করে নতুন গাড়ি পাব কোথায়? ছোট কাজ চট করে সেরে চলে আসব। সবার যাওয়ার দরকার নেই।

গাড়িতে উঠল তিনজন। ড্রাইভারের পাশে আলম। পেছনের সিটে নুরু এবং সাদেক। তারা চলে গেল মগবাজারের একটা পেট্রল পাম্পে। জায়গাটা খারাপ না। ওয়ারলেস স্টেশনের কাছে। ঠিকমত বিস্ফোরণ ঘটাতে পারলে পাকিস্তানিদের বড় ধরনের একটা চমক দেওয়া যাবে।

সবাই বসে রইল পিক-আপে। লম্বা লম্বা পা ফেলে নেমে গোল সাদেক। যেতে যেতে শীস দিচ্ছে।

কাচের ঘরের ভেতর যে গোলগাল লোকটি বসে ছিল, তাকে হাসিমুখে বলল, মন দিয়ে শুনেন কি বলছি। আমরা আপনার এই পেট্রল পাম্পটা উড়িয়ে দেব। আপনি লোকজন নিয়ে সরে পড়ুন। কুইক।

লোকটি চোখের পাতা পর্যন্ত ফেলতে ভুলে গেল। তাকিয়ে রইল মাছের মত। সাদেক বলল, আমার কথা বুঝতে পারছেন তো?

জি পারছি।

তাহলে দেরি করছেন কেন?

আপনারা মুক্তিবাহিনী?

হ্যাঁ!

লোকটি হাসের মত ফ্যাসফ্যাস গলায় ডাকতে লাগল হিসামুদ্দিন, হিসামুদ্দিন ও হিসামুদ্দিন!

 

বিস্ফোরণ হল ভয়াবহ। বিশাল আগুন দাউদাউ করে আকাশ স্পর্শ করল। বিকট শব্দ হতে থাকল। কুণ্ডুলী পাকিয়ে উঠছে কালো ধোঁয়া। অসংখ্য লোকজন ছোটাছুটি করছে। চিৎকার। হৈচৈ। হিসহিস শব্দ হচ্ছে। ভয়াবহ ব্যাপার!

আশফাকের পিকআপ ছুটে চলছে। নূরু ফিসফিস করে বলল, পেট্রল পাম্পে গ্রেনেড না ছোড়াই ভাল। এই অবস্থা হবে কে জানত।

ঘণ্টা বাজিয়ে চারদিক থেকে ফায়ার ব্রিগেড আসছে। বিস্ফোরণে যারা ভয় পায়নি তারা এবার ভয় পাবে। ফায়ার ব্রিগেডের ঘণ্টা অতি সাহসী মানুষের মনেও আতংক ধরিয়ে দেয়।

আলম হঠাৎ করে লক্ষ্য করল পেছন থেকে দৈত্যাকৃতি একটি ট্রাক দুটে আসছে। অনুসন্ধানী ট্রাক। বিস্ফোরণের রহস্যের সন্ধান করছে নিশ্চয়ই। ট্রাকের মাথায় দু’টি মেশিনগান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন গানার। এরা কি তাদের পিক-আপ থামাবে এবং বলবে–তোমরা কারা? কোথায় যাচছ? বের হয়ে আস। হাত মাথার উপর তোল।

আলমের মাথা ঝিমঝিম করছে। পেটের ভেতর কি জানি পাক খাচ্ছে। এই ট্রাক ওদের থামাবে। নিশ্চয়ই থামাবে। বোঝা যায়। কিছু কিছু জিনিস টের পাওয়া যায়। বিশেষ বিশেষ সময়ে দুষ্ক সেন্স কাজ করে। আলম ফিসফিস করে বলল আশফাক সাইড দাও। মাথা ঠাণ্ডা রাখ সবাই।

আশফাক গাড়ি প্রায় ফুটপাতের উপর তুলে ফেলল। ট্রাক থামল না। গানার দু’জন পলকের জন্যে তাকাল তাদের দিকে। ওদের চোখ কাচের মত ঠাণ্ডা।

সাদেক কপালের ঘাম মুছে বলল, একটা বড় ফাঁড়া কাটা গেছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল এরা আমাদের জন্যেই এসেছে। আলম, তোর কি এরকম মনে হয়েছে?

আলম জবাব দিল না। সাদেক বলল, কেন জানি দারুণ একটা ভয় লেগে গেল। আমার কখনো এ রকম হয় না। মরার ভয় আমার নেই।

আশফাক সিগারেট ধরিয়েছে। সে বেশ সহজ স্বাভাবিক। সিগারেটে টান দিয়ে একসিলেটরে চাপ দিয়ে হালকা গলায় বলল, চলেন ঘরে ফিরে যাই।

নিউ ইস্কাটনের কাছে এসে তাদের বিস্ময়ের সীমা রইল না। সেই ট্রাকটি দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে তাদের দিকে মুখ করে। গানার দু’জন মেশিনগান তাক করে আছে। কিছু সৈন্য নেমে এসেছে রাস্তায়। তাদের একজন মাঝ রাস্তায় চলে এসেছে। বাঁশি বাজাচ্ছে এবং গাড়ি থামাতে বলছে। এর মানে কি?

আলম ফিসফিস করে বলল, আশফাক, কেটে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করা। নূরু, দেখ কিছু করতে পার কিনা।

ওরা বন্দুক তাক করছে। বুঝে ফেলেছে। এ গাড়ি থামবে না। সাদেক স্টেনগানের মুখ গাড়ির জানালায় রাখল। নূরু দু’টি গ্রেনেডের পিন খুলে হাত নিয়ে বসে আছে। সাত সেকেন্ড সময় আছে। সাত সেকেন্ড অনেক সময়। কিছুক্ষণ হাতে নিয়ে বসে থাকা যায়।

আশফাকের গাড়ি লাফিয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে উড়ে চলে যাবে। নূরু দু’টি গ্রেনেডই ছুড়েছে। বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়ার আগেই ওদের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসে পড়ল। আলম নিজের স্টেনগানের উপর ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বলল–মাথা ঠাণ্ডা রাখ, মাথা ঠাণ্ডা।

 

শরীফ সাহেব বাড়ি ফিরবার জন্যে তৈরি হচ্ছিলেন। তখন খবরটা পেলেন। মিলিটারিদের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ হয়েছে গেরিলাদের। গেরিলাদের কিছুই হয়নি। কিন্তু মিলিটারিদের একটা ট্রাক উড়ে গেছে। এ জাতীয় খবর কখনো পুরোপুরি সত্যি হয় না। উইসফুল থিংকিংয়ের একটা ব্যাপার আছে। বাস্তবে নিশ্চয়ই অন্যরকম কিছু হয়েছে। গেরিলাদের গায়ে আঁচড়ও পড়বে না তা কি হয়!

শরীফ সাহেব খুব আশা করতে লাগলেন যেন সংঘর্ষের খবরটা সত্যি না হয়। সত্যি না হবার কথা। দিনে দুপুরে ওরা কি মিলিটারিদের ওপর ঝাপিয়ে পড়বে? অবশ্যি পড়তেও পারে। রোমান্টিসিজম! ওদের যা বয়স তাতে রোমান্টিসিজমই প্ৰাধান্য পাবে। এ জাতীয় অপারেশনে আসা উচিত মধ্য বয়স্কদের। যারা সাবধানী।

তিনি বাড়ি ফিরে কাপড় না ছেড়েই বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে রইলেন। আলমের জন্যে অপেক্ষা। সে আসছে না; দেরি করছে কেন? খোঁজখবর নেবারও কোনো উপায় নেই। কে কোথায় থাকে তার জানা নেই। সাবধানতা! যেখানে ওদের সাবধানী হওয়া উচিত। সেখানে না হয়ে অন্য জায়গায়। কোন মানে হয়?

দুপুর তিনটায় নিয়ামত সাহেব টেলিফোন করলেন।

খবর শুনছেন? ভেরি অথেনটিক।

কি খবর?

গেরিলাদের একটা পিকআপ ধরা পড়েছে। দুজনের ডেড বডি পাওয়া গেছে।

কে বলেছে আপনাকে? যত উড়ো খবর। এইসব খবরে কান দেবেন না। এবং টেলিফোনে এসব ডিসকাসও করবেন না।

শরীফ সাহেব টেলিফোন নামিয়ে আবার বারান্দায় এসে বসলেন।

মতিন সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন একটা বেবি টেক্সি এসে তার বাড়ির সামনে থেমেছে। বেবি টেক্সি ড্রাইভার এবং একটি অচেনা লোক আলমকে ধরাধরি করে নামাচ্ছে। তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন, কি হয়েছে? অপরিচিত লম্বা ছেলেটি বলল, গুলি লেগেছে। আপনারা রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করুন। আমি ডাক্তার নিয়ে আসব। আমার নাম আশফাক। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। এসে ধরুন।

তারা বসার ঘরে ঢুকল। আলমের জ্ঞান আছে। সে হাত দিয়ে বাঁ কাঁধ চেপে ধরে আছে। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে সেখান থেকে।

রাত্রি এসে দাঁড়িয়েছে। দরজার পাশে। তার মুখ রক্তশূন্য। সে একটি কথাও বলছে না। মতিন সাহেব ভাঙা গলায় বললেন, মা একে ধর। রাত্রি নড়ল না। যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।

ভেতর থেকে সেলাই মেশিনের শব্দ হচ্ছে। আশফাক শান্ত স্বরে বলল, আলম ভাই, আপনি কোনো রকম চিন্তা করবেন না। কারফিউয়ের আগেই আমি ডাক্তারের ব্যবস্থা করব। যেভাবেই হোক।

বেবিটেক্সির বুড়ো ড্রাইভারটির মুখ ভাবলেশহীন। যেন এ জাতীয় ঘটনা সে জীবনে বহু দেখেছে।

আশফাক তার ঘরে পৌঁছল পাঁচটায়। এখান থেকে সে যাবে ঝিকাতলা। ওদের খবর দিয়ে ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে হবে। কাৰ্য্য শুরু হয়ে যাবে সাড়ে ছটায়। হাতে অনেকখানি সময়।

সে গেঞ্জি বদলে একটা শার্ট পরল। অভ্যাস বসে চুল আচড়াল, নিচে নামল। গালে ক্রিম দিল। মুখের চামড়া টানছে। এসব শীতকালে হয়। চামড়া শুকিয়ে যায়। কিন্তু তার এখন হচ্ছে কেন? বড়ড ক্লান্ত লাগছে। নিচে নামতে গিয়ে পা কাপছে। কেন এ রকম হচ্ছে? সে এখনো বেঁচে আছে। বিরাট ঘটনা। আনন্দে চিৎকার করা উচিত। কিন্তু আনন্দ হচ্ছে না। কেমন যেন ঘুম ाgbछ।

তার জন্যে কালো রঙের জিপ নিয়ে আমি ইন্টেলিজেন্সের লোকজন অপেক্ষা করছে।

আশফাক তোমার নাম?

হ্যাঁ!

চল আমাদের সঙ্গে; তোমার জন্য গত এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ