আলমের ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। আঁধার তখনো কাটেনি। চারদিকে ভোর হবার আগের অদ্ভুত নীরবতা। কিছুক্ষণের ভেতরই সূর্য উঠার মত বিরাট একটা ঘটনা ঘটবে। প্রকৃতি যেন তার জন্যে প্রস্তুতি নিচেছ। আলম নিঃশব্দে বিছানা থেকে নামল। প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই চারদিক থেকে আজানের শব্দ হতে লাগল। ঢাকা শহরে এত মসজিদ আছে? আলম হকচকিয়ে গেল; ভোরবেলায় অদ্ভুত অন্ধকারে চারদিক থেকে ভেসে আসা আজনের শব্দে অন্য রকম কিছু আছে। কেমন যেন ভয়ভয় লাগে। আলমের প্রায় সারাজীবন এই শহরেই কেটেছে কিন্তু সকালবেলার এই ছবিব সঙ্গে তার দেখা হয়নি। সব মানুষই বোধ হয়। অনেক কিছু না জেনে বড় হয়।

সুরমা বারান্দায় বসে অজু করছিলেন। আলমকে বেরুতে দেখে বেশ অবাক হলেন। মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে পরিষ্কার গলায় বললেন, রাতে ঘুম হয়নি? তাঁর গলায় খানিকটা উদ্বেগ ছিল। আলমকে তা স্পর্শ করল। সে হাসিমুখে বলল, ভাল ঘুম হয়েছে। খুব ভাল। আপনি কী রোজ এ সময়ে জাগেন?

হ্যাঁ। নামাজ পড়ি। নামাজ শেষ করে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। তারপর সাতটা সাড়ে সাতটার দিকে রাত্রি ডেকে তোলে।

সুরমা হাসতে লাগলেন। যেন খুব একটা হাসির কথা বলেছেন। ভোরবেলার বাতাসে কিছু একটা বোধ হয় থাকে। মানুষকে তরল করে ফেলে। আলম বলল, আজ আমাদের একটা বিশেষ দিন।

বুঝতে পারছি। তোমার কী ভয় লাগছে?

ভয় না। অন্য রকম লাগছে। আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারব না। মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম ঘণ্টা পড়বার সময় যে রকম লাগে। সে রকম।

কিন্তু এ ধরনের কাজ তো তুমি এর আগেও করেছ।

তা করেছি। অবশ্যি এখানকার অবস্থাটা অন্য রকম।

তুমি কী আল্লাহ বিশ্বাস করা তোমার বয়েসী যুবকরা খানিকটা নাস্তিক ধরনের হয় সেই জন্যে বলছি।

আলম কিছু বলল না। সুরমা তার প্রশ্নের জবাবের জন্যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। জবাব পেলেন না। তিনি হালকা গলায় বললেন, নামাজ শেষ করে এসে আমি একটা দোয়া পড়ে তোমার মাথায় ফুঁ দিতে চাই। তোমার কোনো আপত্তি আছে?

না, আপত্তি থাকবে কেন?

ঠিক আছে, আমি নামাজ শেষ করে আসছি। রাত্রিকে ডেকে দিচ্ছি সে তোমাকে চা বানিয়ে দেবে।

ডাকতে হবে না। আমার এত ঘন ঘন চা খাবার অভ্যেস নেই।

সুরমা রাত্রিকে ডেকে তুললেন। সাধারণত ফজরের নামাজ তিনি চট করে সেরে ফেলেন। কিন্তু আজ অনেক সময় নিলেন। কোথায় যেন পড়েছিলেন নামাজের শেষে পার্থিব কিছু চাইতে নেই। তাতে নামাজ নষ্ট হয়। কিন্তু আজ তিনি পার্থিব জিনিসই চাইলেন। অসংখ্যবার বললেন, এই ছেলেটিকে নিরাপদে রাখা। ভাল রাখ। সে যেন সন্ধ্যাবেলা আবার ঘরে ফিরে আসে। হারিয়ে না। যায়।

বলতে বলতে এক সময় তার চোখে পানি এসে গেল। একবার পানি এসে গেলে খুব মুশকিল। তখন যাবতীয় দুঃখের কথা মনে পড়ে যায়। কিছুতেই আর কান্না থামানো যায় না। সুরমার তার বাবার কথা মনে পড়ল। ক্যানসার হয়ে যিনি অমানুষিক যন্ত্রণা ভোগ করে মারা গেছেন। মৃত্যুর ঠিক আগে আগে পানি খেতে চেয়েছিলেন। চামচে করে পানি খাওয়াতে হয়। কী আশ্চর্য! একটা চামচ সেই সময় খুঁজে পাওয়া গেল না। শেষপর্যন্ত হাতে আঁজলা করে পানি নিয়ে গেলেন সুরমা। সেই পানি মুখ পর্যন্ত নিতে নিতে আঙুল গলে নিচে পড়ে গেল। অতি কষ্টের মধ্যেও এই দৃশ্য দেখে তাঁর বাবা হেসে ফেললেন। তার পানি খাওয়া হল না। কত অদ্ভুত মানুষের জীবন!

রাত্রি ঘরে ঢুকে দেখল, তার মা জায়নামাজে এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছেন। কান্নার জন্যেই শরীর বারবার কোপে উঠছে। সে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল। আলমকে চা দিয়ে আসা হয়েছে। আবার সেখানে যাওয়াটা ভাল দেখায় না। কিন্তু যেতে ইচ্ছা করছে। মাঝে মাঝে অর্থহীন গল্পগুজব করতে ইচ্ছা করে। রাত্ৰি আলমের ঘরে উঁকি দিল।

আবার এলাম। আপনার ঘরে।

আসুন।

চিনি হয়েছে কিনা জানতে এসেছি।

হয়েছে। থ্যাংকস।

রাত্রি খাটে গিয়ে বসল। আলমের কেমন লজ্জা করতে লাগল। রাত্রির গায়ে আলখাল্লা জাতীয় লম্বা পোশাক, সাধারণ নাইটির মত বাহারী কোন জিনিস নয়। এই পোশাকে তাকে অন্য রকম লাগছে। সে পা দুলাতে দুলাতে বলল, আপনি আজ এত ভোরে উঠেছেন কেন?

জানি না কেন। ঘুম ভেঙে গেল।

টেনশন থাকলে ভেঙে যায়।

তা যায়।

আমার উল্টোটা হয়। টেনশনের সময়ে শুধু ঘুম পায়।

একেকজন মানুষ একেক রকম।

তা ঠিক। আমরা সবাই আলাদা।

আলম সিগারেট ধরাল। তার সিগারেটের কোন তৃষ্ণা হয়নি। অস্বস্তি কাটানোর জন্যে ধারানো। তার অস্বস্তির ব্যাপারটা কী মেয়েটি টের পাচ্ছে? পাচ্ছে নিশ্চয়ই। এসব সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলি মেয়েরা সহজেই টের পায়। আলম বলল, আপনি খুব ভোরে উঠেন?

হ্যাঁ উঠি। অন্ধকার থাকতে আমার ঘুম ভাঙে। খুব খারাপ লাগে তখন।

খারাপ লাগে কেন?

সবাই ঘুমুচ্ছে। আমি জেগে আছি এই জন্যে। যখন ছোট ছিলাম তখন গেট খুলে বাইরে যেতাম। একা একা হাঁটতাম। ছোটবেলায় আমি খুব সাহসী ছিলাম।

এখন সাহসী না?

না। ছোটবেলায় আমি একটি কুৎসিত ঘটনা দেখি। তারপর আমার সব সাহস চলে যায়। আমি এখন একটি ভীরু ধরনের মেয়ে।

রাত্রি তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। পা দুলাচ্ছে না, কাঠিন্য চলে এসেছে তার চোখে-মুখে। আলম অবাক হয়ে এই সূক্ষ্ম কিন্তু তীক্ষ্ণ পরির্বতনটি লক্ষ্য করল। রাত্রি বলল, আমি কী দেখেছিলাম তা তো জিজ্ঞেস করলেন না?

জিজ্ঞেস করলে আপনি বলবেন না, তাই জিজ্ঞেস করিনি।

ঠিক করেছেন। আমি বলতাম না, কাউকেই বলিনি। মাকেও বলিনি। যাই কেমন?

রাত্রি উঠে দাঁড়াল। এবং দ্রুত ঘর ছেড়ে চলে গেল।

 

রাত্রির ফুফু, নাসিমার বয়স চল্লিশের উপরে। কিন্তু তাকে দেখে সেটা বোঝাব কোন উপায় নেই। এখনো তাকে পচিশ-ছাব্বিশ বছরের তরুণীর মত লাগে। ভিড়ের মধ্যে লোকজন তার গায়ে হাত দিতে চেষ্টা করে। একবার এরকম একটা ছোকরাকে তিনি হাতেনাতে ধরে ফেললেন এবং হাসিমুখে বললেন, তোমার বয়স কত খোকা? ছেলেটি এ জাতীয় দৃশ্যের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। সে ঘেমে নেয়ে উঠল। নাসিমা ধারাল গলায় বললেন, আমার বড় মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। বুঝতে পারছি?

তাঁর বড় মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে এটা ঠিক না। নাসিমার কোনো ছেলে।পুলে নেই। বড় মেয়ে বলতে তিনি বুঝিয়েছেন রাত্রিকে। বাইরের কেউ যদি জিজ্ঞেস করে আপনার ছেলেমেয়ে কটি? তিনি সহজভাবেই বলেন, আমার কোনো ছেলে নেই। দু’টি মেয়ে রাত্রি এবং অপালা। এটা তিনি যে শুধু বলেন। তাই না, মনেপ্ৰাণে বিশ্বাসও করেন। তাঁর বাড়িতে এদের দুজনের জন্যে দু’টি ঘর আছে। সেই ঘর দু’টি ওদের ইচ্ছামত সাজানো। সপ্তাহে খুব কম হলেও তিনদিন এই ঘর দু’টিতে দুবোনকে থাকতে হয়। নয়ত নাসিমা অস্থির হয়ে যান। তাঁর কিছু বিচিত্র অসুখ দেখা দেয়। হিস্টিরিয়ার সঙ্গে যার কিছু মিল আছে।

নাসিমার স্বামী ইয়াদ সাহেব লোকটি রসকষহীন; চেহারা চালচলন সবই নির্বোধের মত কিন্তু তিনি নির্বোিধ নন। কোন নির্বোধি লোক একা একা একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফাম শুরু কৰে বারো বছরেব মাথায় কোটিপতি হতে পারে না। ইয়াদ সাহেব হয়েছেন। যদিও এই বিত্ত তার জীবনযাপন পদ্ধতির ওপর কোন রকম ছাপ ফেলেনি। তিনি এখনো গায়ে তেল মেখে গোসল করেন। এবং স্ত্রীকে ভয় করেন। অসম্ভব রকম বিত্তবান লোকজনক স্ত্রীদের ঠিক পরোয়া করে না।

ভোর আটটায় নাসিমা ইয়াদ সাহেবকে ডেকে তুললেন। তাঁর ডাকার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল যে ইয়াদ সাহেবের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। তিনি ভয়-পাওয়া গলায় বললেন, কী হয়েছে?

তোমার গাড়ি পাঠালাম রাত্রিদের আনবার জন্যে।

ও আচ্ছা।

ইয়াদ সাহেব। আবার ঘুমুবার আয়োজন করলেন।

তুমি কিন্তু আজ অফিসে-টিফিসে যাবে না।

কেন?

আজ রাত্ৰিকে দেখতে আসবে। তোমার থাকা দরকার।

আমি থেকে কী করব?

কিছু করবে না। থাকবে। আর কী। এসব কাজে ব্যাকগ্রাউন্ডে একজন পুরুষ মানুষ থাকা দরকার।

দরকার হলে থাকব। এখন একটু ঘুমাই, কী বল?

আচ্ছা ঘুমাও।

ইয়াদ সাহেব চোখ বন্ধ করে পাশ ফিবলেন। ছুটে যাওয়া ঘুম ফিরে এল না। কিছুদিন থেকেই তাঁর দিন কাটছে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তায়। মোহাম্মদপুরে তাঁদের মূল বাড়িটি বিহারীদের দখলে। দেশ স্বাধীন না হলে এ বাড়ি ফিরে পাওয়া যাবে না। অসম্ভব। দেশ চট করে স্বাধীন হয়ে যাবে। এ রকম কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। চট করে পৃথিবীর কোনো দেশই স্বাধীন হয়নি। ইংরেজ তাড়াতে কত দিন লেগেছে? এখানেও তাই হবে। বছবের পর বছর লাগবে। তারপর এক সময় বাঙালিরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। এই একটা অদ্ভুত জাতি। নিমিষেব মধ্যে উৎসাহে পাগল হয়ে ওঠে, আবার সে উৎসাহ নিভেও যায়।

ইয়াদ সাহেব উঠে বসলেন। কাজের ছেলেটিকে বেড টি-র কথা বলে চুরুট ধরালেন। তাঁর বমি বমি ভাব হল। তিনি বিছানা থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে বারান্দায় গেলেন। বারান্দার সামনে ঘুপসিমত গলি। মোহাম্মদপুরের বিশাল বাড়ি ছেড়ে তাকে থাকতে হচ্ছে ভাড়া বাড়িতে যার সামনে ঘুপসি গলি। তিনি বেঁচে থাকতে থাকতে কী দেশ স্বাধীন হবে? ফিরে পাওয়া যাবে নিজের বাড়ি? ইয়াদ সাহেব খানিকটা লজ্জিত বোধ করলেন। তিনি দেশের স্বাধীনতা চাইছেন ব্যক্তিগত স্বার্থে–এটা ঠিক হচ্ছে না।

চায়ের পেয়ালা নিয়ে তিনি বাসিমুখে নিজের স্টাডি রুমে ঢুকলেন। তাঁর অফিসের যাবতীয় কাগজপত্র এই ছোট্ট ঘরটিতে আছে। এখানে তিনি দীর্ঘ সময় কাটান। নিজের তৈরি বু, প্রিন্টগুলির দিকে তাকিযে থাকতে তার ভাল লাগে। কিন্তু আজ কিছুই ভাল লাগছে না। আলস্য অনুভব করছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য এখন কিছুই নেই। সব রকম কনসট্রাকশনের কাজ বন্ধ হয়ে আছে। সরকারের কাছে মোটা অংকের টাকা পাওনা। সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। যাবেও না। সন্তাত; সব জলে যাবে। তাঁর মতে বাঙালিদের এই যুদ্ধে সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কনসট্রাকশন ফার্মগুলি। এদেব কোমর ভেঙে গেছে। এই কোমর আর ঠিক হবে না। দেশ স্বাধীন হলেও না। তিনি একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। কলিং বেল বাজছে। মেযে দু’টি এসেছে নিশ্চয়ই। এদের তার ভাল লাগে না। কিন্তু তবু তিনি হাসি মুখে দরজা খুলে বের হলেন। এবং অমায়িক ভঙ্গিতে বললেন রাত্রি মা, কেমন আছ?

ভাল আছি ফুফা।

অপালা মা, মুখটা এমন কালো কেন?

অপালা জবাব দিল না। সে তার ফুফাকে পছন্দ কবে না। একেবাইে না। ইয়াদ সাহেব বললেন, কী গো মা, কথা বলছি না কেন?

কথা বলতে ভাল লাগছে না, তাই বলছি না।

ইয়াদ সাহেব চুপ করে গেলেন।

 

আলম দোকানটির সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত কবতে লাগল। এটিই কী সেই দোকান? নাম অবশ্যি সে রকমই মডার্ন নিওন সাইনস। এখানেই সবাব জড় হবার কথা। কিন্তু দোকানটি সদর রাস্তার উপরে। তাছাড়া ভেতরে যে লোকটি বসে আছে তার চেহারা কেমন বিহারি বিহারি। কার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে বলতে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। কোন বাঙালি ছেলে এই সময়ে এমনভাবে হাসবে না। এটা হাসির সময় না। আলম দোকানে ঢুকে পড়ল।

চেক হাওয়াই শার্ট পাবা ছেলেটির ঠোঁটের উপর সুচালো গোফ। গলায় সোনার চেইন বের হয়ে আছে। রোগা টিঙটিঙে কিন্তু কথা বলার ভঙ্গি কেমন উদ্ধত। ছেলেটি টেলিফোন নামিয়ে রাগী গলায় বলল, কাকে চান?

এটা কি মডার্ন নিওন সাইন?

হ্যাঁ।

আমি আশফাক সাহেবকে খুঁজছি।

আমিই আশফাক। আপনার কী দরকার?

আমার নাম আলম।

ছেলেটির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ হল। কিন্তু কথা বলল নরম গলায়–আপনি ভেতরে ঢুকে যান। সিঁড়ি আছে। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় চলে যান।

আর কেউ এসেছে?

রহমান ভাই এসেছে। যান, আপনি ভেতরে চলে যান।

ভেতরটা অন্ধকার। অসংখ্য নিওন টিউব চারদিকে ছড়ানো। একজন বুড়ো মত লোক এই অন্ধকারেই বসে কী সব নকশা করছে। সে একবার চোখ তুলে আলমকে দেখল। তার কোনো রকম ভাবান্তর হল না। চোখ নামিয়ে নিজের মত কাজ করতে লাগল।

দোতলায় দু’টি ঘর। একটিতে প্রকাণ্ড একটি তালা ঝুলছে। অন্যটি খোলা। রঙিন পর্দা ঝুলছে। রেলিং-এ মেয়েদের কিছু কাপড়। ঘরের ভেতর থেকে ক্যাসেটে গানেব শব্দ আসছে। হাওয়ামে উড়তা যায়ে মেরা লাল দুপাট্টা মলমল। আলম ধাঁধায় পড়ে গেল। সে মৃদু স্বরে ডাকল, রহমান রহমান।

রহমান বেরিয়ে এল। তার গায়ে একটা ভারী জ্যাকেট। মুখ শুকনো। এমনিতেই সে ছোটখাটো মানুষ। এখন তাকে আরো ছোট দেখাচ্ছে। রহমান হাসতে চেষ্টা করল।

আসুন আলম ভাই। তোমার এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে? শরীর খারাপ করে ফেলেছে। জ্বর, সর্দি, কাশি বুড়োদের অসুখ-বিসুখ। একশ দুই। অসুবিধা হবে না। চারটা এ্যাসপিরিন খেয়েছি। জ্বর নেমে যাবে। সকালে একশ তিন ছিল। ভেতরে আসুন আলম ভাই।

ভেতরে কে কে আছে?

কেউ এখনো এসে পৌঁছেনি। আমি ফাস্ট, আপনি সেকেন্ড। এসে পড়বে।

আলম ঘরে ঢুকল। ছোট্ট ঘর। আসবাবপত্রে ঠাসা। বেমানান একটা কাক কাৰ্য করা বিশাল খাট। খাটের সঙ্গে লাগোয়া একটা স্টিলের আলমারি। তার একটু দূবে ড্রেসার। জানালোব কাছে খাটের মতই বিশাল টেবিল। এত ছোট্ট একটা ঘবে এতগুলি আসবাবেব জায়গা হল কী ভাবে কে জানে।

আলম নিচু গলায় বলল, জিনিসপত্র সব কী এখানেই?

সব না। কিছু আছে। বাকিগুলি সাদেকের কাছে। যাত্রাবাড়িতে।

আশফাক ছেলেটি কেমন?

ওয়ান হানড্রেড পারসেন্ট গোল্ড। আপনার কাছে বিহারী বিহারী লাগছিল, তাই না? চুল ছোট করে কাটায় এ রকম লাগছে। গলায় আবার চেইন-টেইন আছে। উর্দু বলে ফুয়েন্ট।

বাড়ি কোথায়?

খুলনার সাতক্ষীরায়।

ফুয়েন্ট উর্দু শিখল কবি কাছে?

সিনেমা দেখে নাকি শিখেছে। নাচে নাগিন বাজে বীণা নামের একটা ছবি নাকি সে নবার দেখেছে। আলম ভাই, পা তুলে বসেন।

আলম ঠিক স্বস্তি বোধ করছিল না। সে থেমে থেমে বলল, জায়গাটা কেমন যেন সেফ মনে হচ্ছে না।

প্রথম কিছুক্ষণ এ রকম মনে হয়। আমারো মনে হচ্ছিল। আশফাকোব সঙ্গে কথার্বােতা বললে বুঝবেন এটা অত্যন্ত সেফ জায়গা।

ছেলেটা একটু বেশি স্মার্ট। বেশি স্মটি ছেলেপুলে কেয়ারলেস হয়। আর জায়গাটা খুব এক্সপোজাড়। মেইন রোডের পাশে।

রহমান শান্ত স্বরে বলল, মেইন রোডের পাশে বলেই সন্দেহটা কম। আইসোলেটেড জায়গাগুলি বেশি সন্দেহজনক।

আমার কেন জানি ভাল লাগছে না।

আপনার আসলে আশফাকের ওপর কনফিডেন্স আসছে না। ও যাচ্ছে আমাদের সাথে।

ও যাচ্চগে মানে?

গাড়ি চালাবে। ওর একটা পিকআপ আছে। সাদেককে তো আপনিই বলেছেন দু’টি গাড়ি থাকবে। পেছনেরটা কভার দেবে। অবশ্যি আপনি নিতে না চাইলে ওকে বাদ দেবেন।

নিচে বসে থাকা বুড়ো লোকটি চা আর ডালপুরি নিয়ে এল। রহমান শুয়ে পড়ল চোখ বন্ধ করে। তার বেশ ঘাম হচ্ছে। জুব ছেড়ে দিচ্ছে বোধ হয়। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, চা খান আলম ভাই।

আলম চা বা ডালপুরিতে কোনো রকম আগ্রহ দেখাল না। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিকে দেখতে লাগল। নায়িকাদের ছবি কেটে কেটে দেয়ালে লাগানো। এর মধ্যে বেশির ভাগ ছবিই অতনু মুক্তিকর। আলম বলল, মেয়েমানুষ কেউ কী থাকে এখানে?

জি না।

রেলিং-এ মেয়েদের কিছু জামা-কাপড় দেখলাম।

আমি লক্ষ্য করিনি। আপনার মনের মধ্যে কিছু-একটা ঢুকে গেছে আলম ভাই।

আলম জবাব দিল না। গুনগুন করতে করতে আশফাক এসে ঢুকল। ফুর্তিবাজের গলায় বললচা-ডালপুরি কেউ খাচ্ছে না, ব্যাপারটা কী? ডালপুরি ফ্রেশ। আলম ভাই, খেয়ে দেখেন একটা। আপনার সঙ্গে পরিচয় করবার জন্যে এলাম।

বসুন।

ড্রাইভার হিসেবে আমাকে দলে নেন। দেখেন কী খেল দেখাই। আমার একটা পংখীরাজ আছে। দেখলে মনে হবে ঘণ্টায় দশ মাইলও যাবে না, কিন্তু আমি আশি মাইল তুলে আপনাকে দেখাব।

আলম শীতল গলায় বলল, আশফাক সাহেব, কিছু মনে করবেন না। এ জায়গাটা আমার সেফ মনে হচ্ছে না।

আশফাক হকচকিয়ে গেল। বিস্মিত গলায় বলল, সেফ মনে হচ্ছে না কেন?

জানি না কেন। ইনট্যুশন বলতে পারেন।

ঢাকা শহরে যে কয়টা সেফ বাড়ি আছে তার মধ্যে এটা একটা। আশপাশের সবাই আমাকে কড়া পাকিস্তানি বলে জানে। মান্বুদ খাঁ বলে এক ইনফেনট্রির মেজরের সঙ্গে আমার খুব খাতির। সে সপ্তাহে অন্তত একদিন আমার ঘরে আসে আড্ডা দেবার জন্যে।

আলম কিছু না বলে সিগারেট ধরাল। আশফাক বলল, এখনো কী আপনার এ বাড়ি আনসেফ মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ হচ্ছে।

তাহলে সবাই আসুক, তারপর আমরা অন্য কোথাও চলে যাব। সবাই চুপ করে গেল। আশফাককে দেখে মনে হচ্ছে সে আহত হয়েছে। হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে সে সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় সিগারেট ধরাল। নিষ্প্রাণ গলায় বলল, রহমান ভাই, আপনার জ্বর কী কমেছে?

বুঝতে পারছি না। ঘরে থার্মোমিটার আছে?

আছে।

থামোমিটার দিয়ে দেখা গেল জ্বর একশ-র অল্প কিছু উপরে কিন্তু রহমানের বেশ খারাপ লাগছে। বমির বেগ হচ্ছে। বমি করতে পারলে হয়ত একটু আরাম হবে। সে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমের দিকে এগুলি। বাথরুমের দরজা খুলেই হড়হড় করে বমি করল। নাড়ীর্ভুড়ি উল্টে আসছে। বলে মনে হচ্ছে। পৃথিবী দুলছে। রহমান ক্লান্ত স্বরে বলল, মাথাটা ধুইয়ে দিন তো আশফাক সাহেব। অবস্থা কাহিল।

আলম চিন্তিত মুখে বলল, তোমার শরীর তো বেশ খারাপ। কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমার চলবেও না। ডেটটা কী পিছিয়ে দেব?

আরে না। আজই সেই দিন। আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। বমি করার পর ভালই লাগছে। ঘণ্টা খানিক থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে।

রহমান চাদর গায়ে বিছানায় এসে শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়ল। নিচে কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। সাদেকের উঁচু গলায় ফুর্তির ছোঁয়া। যেন তারা সবাই মিলে পিকনিকে যাবার মত কোন ব্যাপার নিয়ে আলাপ করবে। রঙ্গ-তামাশা করবে।

মতিন সাহেব আজ অফিসে যায়নি। যাবার জন্যে তৈরি হয়েছিলেন। জামা জুতো পরেছিলেন। দশবার ইয়া মুকাদেমু বলে ঘর থেকেও বেরিয়েছিলেন। পিলখানার তিন নম্বর গেটের কাছে এসে একটি অস্বাভাবিক দৃশ্য দেখে পাথর হয়ে গেলেন। খোলা ট্রাকে করে দু’টি অল্পবয়েসী। ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলে দু’টির হাত পেছন দিকে বাধা। ভাবশূন্য মুখ। একজনের চোখে আঘাত লেগেছে। চোখ এবং মুখের এক অংশ বীভৎসভাবে ফুলে উঠেছে। কালো পোশাকপরা এক দল মিলিশিয়া ওদের ঘিরে আছে। তাদের একজনের হাতে একটি রুমাল। সে রুমাল দিয়ে খেলার ছলে ছেলে দু’টির মাথায় ঝাপটা দিচ্ছে, বাকিরা সবাই হেসে উঠছে। ট্রাক চলছিল। কাজেই দৃশ্যটির স্থায়িত্ব খুব বেশি হলে দেড় মিনিট। এই দেড় মিনিট মতিন সাহেবের কাছে অনন্তকাল বলে মনে হল। সমস্ত ব্যাপারটাতে প্রচণ্ড হৃদয়হীন কিছু আছে। মতিন সাহেবের পা কাঁপতে লাগল। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। ব্যাপারটা যে শুধু তাঁর ক্ষেত্রেই ঘটল তা না। তাঁর আশপাশে যারা ছিল সবাই যেন কেমন হয়ে গেল। মতিন সাহেবের মনে হল ছেলে দু’টিকে ওরা যদি মারতে মারতে নিয়ে যেত তাহলে তাঁর এমন লাগত না। রুমাল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে তামাশা করছে বলেই এমন লাগছে। তিনি বাসায় ফিরে চললেন।

পানওয়ালা ইদ্রিস বলল, অফিসে যান না?

না। শরীরটা ভাল না। দেখি একটা পান দাও।

পান খাওয়ার তার দরকার ছিল না। এ সময়ে সবাই অদরকারি কাজগুলি করে, অপ্রয়োজনীয় কথা বলে। ভয় কাটানোর জন্যেই করে। ভয় তবু কাটে না। যত দিন যায় ততই তা বাড়তে থাকে।

দু’টা ছেলেকে ধরে নিয়ে গেল। দেখলে ইদ্রিস মিয়া?

জি দেখলাম। নেন। পান নেন। মতিন সাহেব পান মুখে দিয়ে নিচু গলায় বললেন, এই অবস্থা বেশি দিন থাকবে না। আজাদহা নেমে গেছে।

বলেই তিনি হকচাকিয়ে গেলেন। একজন পানওয়ালার সঙ্গে এসব কি বলছেন? ইদ্রিস মিয়া হয়ত তার কথা পরিষ্কার শোনেনি। কিংবা শুনলেও অর্থ বুঝতে পারেনি। সে একটি আগরবাতি জ্বালাল। আগেরটি শেষ হয়ে গেছে।

সুরমা একবার জিজ্ঞেসও করলেন না— অফিসে যাওনি কেন? তিনি নিজের মনে কাজ করে যেতে লাগলেন। সাবান পানি দিয়ে ঘরের মেঝে নিজের হাতে মুছলেন। কার্পেট শুকাতে দিলেন। বাথরুমে ঢুকলেন প্রচুর কাপড় নিয়ে। আজ অনেকদিন পর কড়া রোদ উঠেছে। রোদটা ব্যবহার করা উচিত।

মতিন সাহেব কি করবেন ভেবে পেলেন না। কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে রইলেন। তারপরই তার মনে হল অফিসে না গিয়ে তিনি বারান্দায় বসে আছেন এটা লোকজনের চোখে পড়বে। তিনি ভেতরের ঘরে গেলেন। ঝকঝকে মেঝে মাড়িয়ে যেতে খারাপ লাগে। সুরমা কিছু বলছেন না। কিন্তু তাকিয়ে আছেন কড়া চোখে। মতিন সাহেব বাগানে গেলেন। বাগান মানে বারান্দার কাছ ঘেষে এক চিলতে উঠোন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এখানে শাকসব্জি ফলাবার চেষ্টা করছেন। ফলাতে পারেননি। মরা মরা ধরনের কিছু গাছপালা হয়ে কিছুদিন পর আপনা-আপনি শুকিয়ে যায়। সার-টার সব দিয়েও একই অবস্থা। নিজেই একবার মাটি নিয়ে জয়দেবপুর গিয়েছিলেন সয়েল টেস্টিং-এর জন্যে। তারা এক সপ্তাহ পর যেতে বলল। তিনি গেলেন এক সপ্তাহ পর। তিন ঘণ্টা বসে থাকার পর কামিজ পরা অত্যন্ত স্মার্ট একটি মেয়ে এসে বলল, আপনার স্যাম্পল তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি কী কষ্ট করে আরেকবার খানিকটা স্যাম্পল দিয়ে যেতে পারবেন? দু’একদিনের মধ্যে নিয়ে আসুন। তিনি নিয়ে যাননি।

কয়েকদিন ক্রমাগত বৃষ্টির জন্যে বাগানে কাদা হয়েছে। জুতো সুদ্ধ পা অনেকখানি কাদায় ডেবে গেল। তিনি অবশ্যি তা লক্ষ্য করলেন না। কারণ তার চোখ গিয়েছে কাকরুল গাছের দিকে। কাকরুল গাছ যে বাগানে হয়েছে তা তার মনে ছিল না। আজ হঠাৎ দেখলেন একটা সতেজ গাছ। চড়া সবুজ রঙের পাকা চকচক করছে। তার চেয়েও বড় কথা–পাতার ফাকে বড় বড় কাঁকরুল ঝুলছে। কেউ লক্ষ্য করেনি। একটি আবার পেকে হলুদ বর্ণ হয়েছে। মতিন সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন–রাত্রি, রাত্রি। রাত্রি বাসায় নেই। ভোরবেলা তার চোখের সামনে গাড়ি এসে নিয়ে গিয়েছে তা তার মনে রইল না। উত্তেজিত স্বরে তিনি দ্বিতীয়বার ডাকলেন – রাত্রি, রাত্রি।

সুরমা ঘর মোছা বন্ধ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখ বিষন্ন। খানিকটা উদ্বেগ মিশে আছে সেখানে। তিনি বললেন, কি হয়েছে?

সুরমা, কাঁকরুল দেখে যাও। গাছ ভর্তি হয়ে আছে। কেউ এটা লক্ষ্যই করে নাই। কি কাণ্ড! সুরমা সত্যি সত্যি নেমে এলেন। তাঁর যা স্বভাব তাতে নেমে আসার কথা নয়। নোংরা কাদা থিাকথিক বাগানে পা দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

সুরমা, দেখ দেখ, পুঁই গাছটার দিকে দেখ। কেন এসব এতদিন কেউ দেখল না?

মতিন সাহেব গভীর মমতায় গাছের পাতায় হাত বুলাতে লাগলেন।

শুধু পুঁই গাছ নয়। রান্নাঘরের পাশের খানিকটা জায়গায় ডাটা দিয়েছিলেন। লাল লাল পুরুষ্ট ডাটা সেখানে। নিম্বফলা মাটিতে হঠাৎ করে প্রাণ সঞ্চার হল নাকি? আনন্দে মতিন সাহেবের দম বন্ধ হয়ে যাবার মত হল। রাত্রিকে খবর দিতে হবে। ওরা এলে একসঙ্গে সবজি তোলা হবে। তাছাড়া বাগান পরিষ্কার করতে হবে। বড় বড় ঘাস জন্মেছে। এদের টেনে তুলতে হবে। মাটি কুপাতে হবে। ডাটা ক্ষেতে পানি জমেছে, নালা কেটে পানি সরাতে হবে। অনেক কাজ। অফিসে না গিয়ে ভাল হয়েছে। রাত্রিকে খবর দেয়া দরকার। মতিন সাহেব কাদামাখা জুতো নিয়েই শোবার ঘরে ঢুকে পড়লেন। রাত্রিকে টেলিফোন করলেন। সুরমা দেখলেন তার ধোয়া-মোছা মেঝের কি হাল হল। কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না।

রাত্রিকে টেলিফোনে পাওয়া গেল না। নাসিমা বলল, ওর সঙ্গে এখন কথা বলা যাবে না। তুমি ঘণ্টাখানিক পরে রিং করবে।

মতিন সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, এখন সে কি করছে?

একজন ভদ্রমহিলা তাকে দেখতে এসেছেন। সে কথা বলছে তার সঙ্গে।

কেন দেখতে এসেছে রাত্রিকে?

কেন তুমি জান না? তোমাকে তো বলা হয়েছে।

নাসিমা ব্যাপারটা কি খুলে বল তো!

এখন বকবক করতে পারব না। রান্নাবান্না কবছি। উনি খাবেন। এখানে।

কে এখানে খাবেন?

দাদা, পরে তোমাকে সব গুছিয়ে বলব। এখন রেখে দেই। তুমি বরং অপালার সঙ্গে কথা বল। ওকে ডেকে দিচ্ছি।

মতিন সাহেব রিসিভার কানে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। অপালা আসছেই না। কোন একটা গল্পের বই পড়ছে নিশ্চয়ই। গল্পের বই থেকে তাকে উঠিয়ে আনা যাবে না। তিনি যখন টেলিফোন রেখে দেবেন বলে মন ঠিক করে ফেলেছেন তখন অপালার চিকন গলা শোনা গেল।

হ্যাঁলো বাবা।

হুঁ।

কি বলবে তাড়াতাড়ি বল।

মতিন সাহেব উৎকণ্ঠিত স্বরে বললেন, তোদের ওখানে কি হচ্ছে?

আপার বিয়ে হচ্ছে।

কি বললি?

আপার বিয়ে হচ্ছে। বিবাহ। শুভ বিবাহ।

কী বলছিস এসব কিছু বুঝতে পারছি না।

অপালা বিরক্ত স্বরে বলল, বাবা, আমি এখন রেখে দিচ্ছি। সে সত্যি সত্যি টেলিফোন রেখে দিল।

রাত্রি পা বুলিয়ে খাটে বসে আছে। তার সামনে বসে আছেন মিসেস রাবেয়া করিম। রাত্রির ধারণা ছিল একজন বুড়োমত মহিলা আসবেন। তার পরনে থাকবে সাদা শাড়ি। তিনি আড়চোখে রাত্রিকে কয়েকবার দেখে ভাসা ভাসা ধরনের কিছু প্রশ্ন করবেন–বাড়ি কোথায়? ক ভাইবোন? কী পড়? কিন্তু তার সামনে যিনি বসে আছেন তিনি সম্পূর্ণ অন্য রকম মহিলা। রেডক্রস লাগানো কালো একটি মরিস মাইনর গাড়ি নিজে চালিয়ে নিয়ে এসেছেন। মহিলাদের গাড়ি চালানো এমন কিছু অদ্ভুত ব্যাপার নয়। অনেকেই চালাচ্ছে। নাসিমাও চালায় কিন্তু এই সময়ে একজন একা একা গাড়ি করে যাওয়া-আসা করে না।

ভদ্রমহিলা বেশ লম্বা। মাথার চুল কাঁচাপাকা। মুখটি কঠিন হলেও চোখ দু’টি হাসি হাসি। অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী একজন মহিলা। রাত্রিকে দেখে প্রথম যে কথাটি বললেন তা হচ্ছে–তোমার ইন্টারভ্যু নিতে এলাম মা। রাত্রি হকচাকিয়ে গেল।

প্রথমে নিজের পরিচয় দিয়ে নেই। আমি একজন ডাক্তার। মেডিকেল কলেজে গাইনির এসোসিয়েট প্রফেসর। আমার নাম রাবেয়া। তোমার ভাল নামটি কী?

ফারজানা।

তুমি বস এবং বল এত সুন্দর তুমি কি ভাবে হলো? এটা আমার প্রথম প্রশ্ন। খুব কঠিন প্রশ্ন। ভদ্রমহিলা হাসতে লাগলেন। রাত্রি কী বলবে ভেবে পেল না। হঠাৎ করে কেউ সুন্দর হয় না। এর পেছনে জেনেটিক কারণ থাকে। মনের সৌন্দর্য একজন নিজে নিজে ডেভেলপ করাতে পারে। কিন্তু দেহের সৌন্দৰ্য উত্তরাধিকার সূত্রে পেতে হয়। বল, তোমার মা এবং বাবা এদের দুজনের মধ্যে কে সুন্দর?

মা।

শোন রাত্রি, তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। তা কিছুই মিন করে না। তোমার পছন্দ-অপছন্দ আছে। এবং আমার মনে হচ্ছে তুমি খুব খুতখুতে ধরনের মেয়ে। আমি কী ঠিক বলেছি?

ঠিকই বলেছেন।

ভদ্রমহিলা চা খেলেন। অপালার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করলেন এবং এক পর্যায়ে একটি হাসির গল্প বললেন। হাসির গল্পটি একটি ব্যাঙ নিয়ে। পরপর কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ায় ব্যাঙটির সর্দি হয়ে গেছে। ব্যাঙ সমাজে ছিঃ ছিঃ পড়ে গেছে। বেশ লম্বা গল্প। অপালা মুগ্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর পর হাসিতে ভেঙে পড়তে লাগল।

ভদ্রমহিলা এসেই বলেছিলেন আধঘণ্টা থাকবেন। কিন্তু তিনি পুরোপুরি তিন ঘণ্টা থাকলেন। দুপুরের খাবার খেলেন। খাবার শেষ করে রাত্রিকে বারান্দায় ডেকে নিয়ে গেলেন। অস্বাভাবিক নরম গলায় বললেন, মা, তোমাকে কী আমি আমার ছেলের সম্পর্কে দু’একটি কথা বলতে পারি?

রাত্রি লজ্জিত স্বরে বলল, বলুন।

তার সবচে দুর্বল দিকটির কথা আগে বলি। ওর থিংকিং প্রসেসটা একটু স্লো বলে আমার মনে হয়। যখন কেউ কোনো হাসির কথা বলে তখন সে প্রায়ই বুঝতে পারে না। বোকা মানুষদের মত বলে –ঠিক বুঝতে পারলাম না।

রাত্রি অবাক হয়ে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে রইল। তিনি এই কথাটি বলবেন তা বোধ হয়। সে ভাবেনি।

এখন বলি ওর সবচে সবল দিকটির কথা। পুরনো দিনের গল্প-উপন্যাসে এক ধরনের নায়ক আছে যারা জীবনে কোন পরীক্ষাতে সেকেন্ড হয় না; ও সে রকম একটি ছেলে। মা, আমি খুব খুশি হব তুমি যদি খানিকক্ষণ ওর সঙ্গে কথা বল। আমার ধারণা, কিছুক্ষণ কথা বললেই তোমার ওকে পছন্দ হবে। অবশ্যি ও কথা বলবে কিনা জানি না। যা লাজুক ছেলে!

ছেলেটিকে না দেখেই রাত্রির কেমন যেন পছন্দ হল। কথা বলতে ইচ্ছা হল। তার একটু লজ্জা লজ্জাও লাগল। ভদ্রমহিলা বললেন, মা, তুমি কী ওর সঙ্গে কথা বলবে?

হ্যাঁ বলবে।

থ্যাংক য়্যু। যাই কেমন? যাই বলার পরও তিনি আরো কিছুক্ষণ থাকলেন। নাসিমার সঙ্গে গল্প করলেন। অপালাকে আরো একটি হাসির গল্প বললেন। সেই গল্পটি তেমন জমল না। অপালা গম্ভীর হয়ে রইল।

 

ওরা মডার্ন নিওন সাইন থেকে বেরুল দুপুর দুটায়। রহমানকে রেখে যেতে হল। কারণ তার উঠে দাঁড়াবার সামর্থ্য নেই। আলম চেয়েছিল রহমানকে তার জায়গায় রেখে আসতে। দলের সবাই আপত্তি করল। নাড়াচাড়া করার কোনো দরকার নেই। এখানে বিশ্রাম করুক। আশফাক বলল, জহুর মিয়া আছে সে দেখাশোনা করবে। দরকার হলে চেনা একজন ডাক্তার আছে তাকে নিয়ে আসবে। কোনই অসুবিধা নেই।

আলম গম্ভীর হয়ে রইল। রহমানকে বাদ দিয়ে আজকের অপারেশন শুরু করতে তার মন চাইছে না। এবং কেন যেন জায়গাটাকে তার নিরাপদ মনে হচ্ছে না। সারাক্ষণই মনে হচ্ছে কিছুএকটা হবে।

এরকম মনে হবার তেমন কোন কারণ নেই। এই শহরে মিলিটারিরা নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করছে। এরা এখানে শংকিত নয়। আলাদাভাবে কোনো বাড়িঘরের দিকে নজর দেবে না। নজর দেবার কথাও নয়। সাদেক বলল, আলম, তুই এত গান্তীর কেন? ভয় পাচ্ছিস নাকি? আলম বলল, বেরিয়ে পড়া যাক।

তারা উঠে দাঁড়াল। আশফাককে নিয়ে ছজনের একটি দল। আলম বলল, রহমান চললাম। রহমান উত্তর দিল না। তাকিয়ে রইল। তার জ্বর নিশ্চয়ই বেড়েছে। চোখ ঘোলাটে। জুরের জন্য মুখ লাল হয়ে আছে।

তারা রাস্তায় বেরুতেই একটি মিলিশিয়াদের ট্রাক চলে গেল। মিলিশিয়ারা ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে আছে। মনে হয়, অল্প কিছুদিন হল এ দেশে এসেছে। নতুন পরিবেশে নতুন ধরনের জীবনযাত্রায় এখনো অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি।

সাদেক বলল, রওনা হবার আগে পান খেলে কেমন হয়? কেউ পান খাবে?

জবাব পাওয়া গেল না। সাদেক লম্বা লম্বা পা পেলে পান। কিনতে গেল। নূরু বলল, সাদেক ভাইয়ের খুব ফুর্তি লাগছে মনে হয়। হাসতে হাসতে কেমন গল্প জমিয়েছে দেখেন।

সাদেক সত্যি সত্যি হাত-পা নেড়ে কী সব বলছে। সিগারেট কিনে শীস দিতে দিতে আসছে। এই ফুর্তির ভাবটা কতটুকু আন্তরিক বোঝার উপায় নেই। ফুর্তির ব্যাপারটা কারো কারো চরিত্রের মধ্যেই থাকে। হয়ত সাদেকেরও আছে।

আলম আকাশের দিকে তাকাল। নির্মেঘ আকাশ। ঘন নীলবৰ্ণ। বর্ষাকালে আকাশ এত নীল হয় না। আজ এত নীল কেন?

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ