দুঃস্বপ্ন দেখে জয়নালের ঘুম ভেঙেছে। সে বিছানায় জবুথবু হয়ে বসে আছে। টিনের চালে ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টিভেজা ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। ব্যাঙ ডাকছে। রীতিমতো বর্ষা-পরিবেশ।

জয়নাল ঘড়ি দেখল, তিনটা সাত বাজে। পানি খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়া যায়। গায়ে চাদর দিয়ে শুয়ে পড়লে আরামের ঘুম হবে। তার ঘুমোতে যেতে ইচ্ছা করছে না। বরং বৃষ্টির শব্দ শুনতে ইচ্ছা করছে। আমেরিকায় টিনের চালের বৃষ্টি, বৃষ্টির সঙ্গে ব্যাঙের ডাক শোনা যাবে না। একেকটা দেশ একেক রকম। বাংলাদেশ বৃষ্টির দেশ। সকালের বৃষ্টি এক রকম, দুপুরের বৃষ্টি আরেক রকম, আবার নিশিরাতের বৃষ্টি সম্পূর্ণ অন্যরকম। একটা ক্যাসেটে বৃষ্টির শব্দ রেকর্ড করে নিয়ে গেলে কেমন হয়? আমেরিকায় পৌছানোর পর দেশের জন্যে যদি খুব মন খারাপ লাগে তাহলে ক্যাসেট বাজিয়ে শোনা হবে। ঘটনাটা হয়তো এরকম ঘটবে–সে এবং ইতি ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে রকিং চেয়ারে দোল খাচ্ছে। দুজনের হাতেই কফির মগ। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কারণ বাইরে প্রচণ্ড তুষারপতি হচ্ছে। তাপমাত্রা নেমে গেছে শূন্যের অনেক নিচে। তবে ঘরের ভেতরে ফায়ারপ্লেসের কারণে আরামদায়ক উষ্ণতা? সেই উষ্ণতায় আরামে হাত-পা ছেড়ে তারা দুজন শুনছে বাংলাদেশের বৃষ্টির ক্যাসেট-করা শব্দ। জয়নাল ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। শেষ পর্যন্ত আমেরিকা যাওয়া হবে তো?

দুঃস্বপ্নটা না যাওয়া বিষয়ক। স্বপ্নের শুরুটা ছিল সুন্দর। শুরুটা সুখ-স্বপ্নের। কিছুদূর গিয়েই সুখ-স্বপ্নটা হঠাৎ এবাউট টার্ন করে দুঃস্বপ্ন হয়ে যায়। স্বপ্নের শুরুতে দেখা যায় তারা তিনজন আমেরিকায় যাবার জন্যে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হয়েছে। সে, শামসুদ্দিন সাহেব এবং ইতি। মালপত্র মাইক্রোবাসে তোলা হচ্ছে। শামসুদ্দিন সাহেব ইতিকে বৌমা বৌমা বলে ডাকছেন। মাইক্রোবাসে উঠে শামসুদ্দিন সাহেব বললেন, বৌমা, একটা পান খাওয়াও তো দেখি, বাংলাদেশে শেষ পানটা খেয়ে যাই। ইতি তাকে একটা পান দিল। তখন জয়নাল বলল, দেখি আমাকেও একটা পান দাও। ইতি পান বানিয়ে জয়নালের হাতে না দিয়ে সরাসরি মুখে ঢুকিয়ে দিল। খুবই অস্বস্তিকর ব্যাপার। শামসুদ্দিন সাহেব আড়চোখে ঘটনাটা দেখলেন। মাইক্রোবাসের ড্রাইভারও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। স্বপ্নটা এই পর্যন্ত সুখ-স্বপ্ন। এয়ারপোর্ট পৌঁছেই স্বপ্নটা হয়ে গেল দুঃস্বপ্ন। ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। শামসুদ্দিন সাহেব এবং ইতি ইমিগ্রেশন পার হয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। ইমিগ্রেশনের লোকজন জয়নালকে আটকে রাখল। দাড়িওয়ালা একজন ইমিগ্রেশন অফিসার (যার মুখটা জয়নালের খুবই পরিচিত, কিন্তু পরিচয়টা কিছুতেই মনে আসছে না) বারবার জয়নালের পাসপোর্টের পাতা উল্টাচ্ছেন আর জয়নালের দিকে কঠিন চোখে তাকাচ্ছেন। সব যাত্রী পার হয়ে যাচ্ছে। বিমান থেকে বারবার প্লেনে উঠার তাগিদ দেয়া হচ্ছে। অধৈর্য হয়ে জয়নাল বলল, স্যার, একটু তাড়াতাড়ি করুন। প্লেন ছেড়ে দিচ্ছে। ইমিগ্রেশন অফিসার বললেন, তাড়াতাড়ি করব কীভাবে, আপনার পাসপোর্টে তো ভিসার সিল নেই। জয়নাল বলল, এটা আপনি কী বলছেন? দেখি পাসপোর্টটা! ইমিগ্রেশন অফিসার পাসপোর্টটা জয়নালের হাতে দিলেন। জয়নাল পাতা উল্টিয়ে দেখে পাসপোর্টের সবগুলো পাতা খালি, কোথাও কোনো লেখা নেই। শুধু শেষ পাতায় canceled সিল মারা।

দুঃস্বপ্নের এই জায়গায় জয়নালের ঘুম ভাঙল। ঘুম ভাঙার পরপরই দাড়িওয়ালা ইমিগ্রেশন অফিসারকে সে চিনতে পারল। ভদ্রলোেক তার ছোটচাচা। দুঃস্বপ্নে তিনি ইমিগ্রেশন অফিসার হয়ে ধরা দিয়েছেন। ইতির উপদেশমতো কাজ করায় কিছুটা লাভ হয়েছে। ছোটচাচা আট হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। এবং লিখে পাঠিয়েছেন তাঁর হাত একেবারেই খালি। এই টাকাটা তিনি হাওলাত করে পাঠিয়েছেন।

জয়নালের এখন সম্বল হলে সর্বমোট সাড়ে তেরো হাজার টাকা। এই টাকার অনেকটাই এনগেজমেন্টের জিনিসপত্র কেনায় খরচ হয়েছে।

শাড়ি (হালকা সবুজ) – ২,১০০ টাকা (জামদানি)

শাড়ি (সুতি) – ৪০০ টাকা

আংটি – ২,০০০ টাকা

মিষ্টি (এখনো কেনা হয় নি) – ৫০০ টাকা (৪ কেজি)

মোট ৫,০০০ টাকা

বকেয়া তিন মাসের বাড়িভাড়া বাবদ দিতে হবে চার হাজার পাচশ টাকা। নয় হাজার পাঁচশ চলে গেল। হাতে থাকল চার হাজার। এনগেজমেন্টের দিনে যদি সত্যি সত্যিই বিয়ে হয়ে যায় তাহলে বাড়তি টাকা কিছু তো লাগবেই।

টিকিটের টাকা পুরোটাই বাকি। শুধু একটা টিকিট হাতে নিয়ে তো আমেরিকায় যাওয়া যায় না। অন্তত এক মাস নিজে নিজে চলার মতো ব্যবস্থা থাকা দরকার। জয়নালের কিছু বন্ধুবান্ধব বিদেশে চলে গেছে। তাদের কারোর ঠিকানা-ই জয়নালের কাছে নেই। ঠিকানা থাকলে তাদেরকে লেখা যেত। তার ছোটবেলার বন্ধু বরকতু ছিল মালয়েশিয়াতে। সেখানে কাগজপত্র না থাকায় কিছুদিন জেলও খেটেছে। জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে এই খবর জয়নালের কাছে আছে। জেল থেকে ছাড়া পাবার পর সে কোথায়, কেউ জানে না। উড়া খবর সে এখন জাপানে। ইমরান আছে জার্মানিতে। ইমরানকে জয়নাল চিঠি দিয়েছে। সেই চিঠি ইমরানের কাছে নিশ্চয়ই পৌছায় নি। পুলিশের ভয়ে ইমরান দুদিন পরপর ঠিকানা বদলায়। ভালো ভালো ছেলে বিদেশে গিয়ে চোরের জীবন যাপন করছে। কী আফসোস!

ব্যাংক কি এই ব্যাপারে লোন দেবে? ব্যাংকের তো উচিত লোন দেয়া। নানান দুঃখ ধান্দা করে ছেলেরা বিদেশে যাচ্ছে- এদেরকে কি একটু সাহায্য করা উচিত না? এই ছেলেরাই তো বিদেশ থেকে এক সময় অতি মূল্যবান ফরেন কারেন্সি পাঠাতে শুরু করবে। দেশেরই তাতে লাভ।

দেশে অনেক পয়সাওয়ালা লোক আছে। এরা স্কুল-কলেজ বানায়, মাদ্রাসা বানায়, এতিমখানা খোলে। তাদের কাছে কি সাহায্য চাওয়া যায় না?

বৃষ্টি থেমে গেছে। জয়নাল বিছানা থেকে নেমে কেরোসিনের চুলা ধরাল। চায়ের পিপাসা পেয়েছে। সিগারেট দিয়ে গরম এক কাপ চা খাবে। মন থেকে সব দুশ্চিন্তা আপাতত ঝেড়ে ফেলতে হবে। আগামীকাল সকাল থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত সে কোনো দুশ্চিন্তা করবে না। আগামীকাল রাতে তার এনগেজমেন্ট। ইতি যেভাবে বলেছে তাতে মনে হয় এনগেজমেন্টের সঙ্গে সঙ্গে কাজি ডাকিয়ে বিয়েও পড়ানো হয়ে যাবে। সেরকম কিছু হলে আগামীকাল তার বিয়ে। জীবনের তিনটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিনের একটি। একটা মোবাইল টেলিফোন যদি তার কাছে থাকত ভালো হতো। টেলিফোনে ইতির সঙ্গে কথা বলা যেত।

ইতি ঘুম-ঘুম চোখে টেলিফোন ধরে বলত–কে? জয়নাল বলত, আমি এক টেকো-মাথা অধম। তুমি কেমন আছ গো জানপাখি পুটুস-পুটুস?

উফ্, কী যে আপনার কথা! নাইন টেনে পড়া ছেলেরাও এরকম করে কথা বলে না। পুটুস-পুটুস আবার কী?

তোমার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আনন্দে হৃৎপিণ্ডে পুটুস-পুটুস শব্দ হচ্ছে, এই জন্যে বলছি পুটুস-পুটুস। কেমন আছ গো পিন-পিন?

আপনার পায়ে পড়ি, এরকম করে কথা বলবেন না।

তোমার পায়ে পড়ি, তুমি আমাকে আপনি করে বলো না। আমাকে যখন আপনি করে বললা তখন নিজেকে অনেক দূরের মানুষ মনে হয়।

আপনি তো দূরেরই মানুষ। যখন কাছের হবেন তখন তুমি বলব। ভালো কথা, কাল যে আমাদের পানচিনি, মনে আছে?

মনে আছে গো ইটি-মিটি।

অনুষ্ঠানটা হবে পানচিনির। সেই অনুষ্ঠানকে বিয়ের অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হবে। এটা মনে আছে?

মনে আছে গো টুন-টুনাং।

উফরে আল্লাহ! আপনি কি দয়া করে অং-বং বলা বন্ধ করে স্বাভাবিকভাবে কথা বলবেন? স্বাভাবিকভাবে কথা না বললে আমি কিন্তু এখন টেলিফোন রেখে দেব।

আচ্ছা যাও, স্বাভাবিকভাবে কথা বলব।

বিয়ের পর আমি যে আপনার গুহায় থাকতে যাব সেটা কি মনে আছে? খাইছে রে আমারে!

খাইছে রে আমারে আবার কী ধরনের ভাষা! দয়া করে এই ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। আপনি রিকশাওয়ালা না, আর আমিও মাতারী না।

আচ্ছা যাও, আর বলব না। তবে শোন, বিয়ের পর আমার সঙ্গে গুহায় থাকতে আসা ঠিক হবে না। বাথরুম সমস্যা। রাতে বাথরুম পেলে তুমি নিশ্চয়ই দারোয়ানদের বাথরুমে যাবে না?

সেটা আপনি দেখবেন। আমি আমার ইচ্ছার কথা জানালাম। আমি দেখে এসেছি আপনার বিছানার চাদর নোংরা। চাদর ধুইয়ে ইস্ত্রি করিয়ে আনবেন।

ইয়েস ম্যাডাম।

ঘর ফিনাইল দিয়ে মুছবেন।

ওকি-ডকি!

ওকি-ভকি আবার কী?

আমেরিকান স্ল্যাং। আমরা যেমন বলি Ok, আমেরিকানরা বলে ওকি-ডকি।

আমার সঙ্গে আমেরিকান স্ল্যাং বলবেন না।

ইয়েস ম্যাডাম।

আমাকে ম্যাডামও ডাকবেন না।

ইয়েস ইতি।

আমার সঙ্গে আহ্লাদীও করবেন না। বিয়ের আগে আহ্লাদী করা যায়। বিয়ের পর না।

ই ই।

ই ই টা আবার কী?

ই ই হলো ইয়েস ইতি।

বানিয়ে বানিয়ে ইতির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে খুব মজা লাগছে। চা-টা খেতে ভালো হয়েছে। আজ একটা বিশেষ রাত – হয়তো বা শেষ ব্যাচেলর রাত। আমেরিকায় এই রতি বিশেষভাবে পালন করা হয়। সারারাত গান বাজনা হৈচৈ ফুর্তি চলে। ওরা ফুর্তিবাজ জাতি। ওদের কাণ্ডকারখানাই অন্যরকম।

 

দিনটা সুন্দরভাবে শুরু হয়েছে। আকাশে ঝকঝকে রোদ। বাতাস মধুর শীতল। রাতে বৃষ্টি পাওয়ায় গাছপালার পাতা চকচক করছে। ধূলি-শূন্য শহর। জয়নাল ঠিক করে রেখেছে মন খারাপ হবার সামান্যতম সম্ভাবনা আছে এরকম কোনো কাজ সে করবে না। আজ তার জীবনের একটি বিশেষ দিন। ইতি নামের অসাধারণ একটি মেয়ের সঙ্গে তার এনগেজমেন্ট। বিয়ে হয়ে যাবার সম্ভাবনাও আছে। মন খারাপ হতে পারে এমন কোনো ঘটনা ঘটিয়ে আজকের দিনটা সে নষ্ট হতে দিতে পারে না।

দুপুর পর্যন্ত জয়নাল নিজের ঘরে বসে রইল। বিয়ের দিন বর-কনে দুজনকেই ঘরে বন্দি থাকতে হয়। রাস্তায় বের হওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রাস্তায় বের হলে একসিডেন্ট হতে পারে। কোনোরকম রিস্ক নেওয়া যাবে না।

ডাকে তিনটা চিঠি এসেছে। জয়নাল চিঠিগুলো পড়ল না। চিঠিতে মন খারাপ হবার মতো কিছু থাকতে পারে। মন ভালো হয়ে যেতে পারে এমন চিঠি জয়নালকে অনেকদিন কেউ লিখে নি। বেছে বেছে আজকের দিনে লিখবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। চিঠি মানেই দুঃসংবাদ। আজকের দিনটা থাকুক দুঃসংবাদের ঊর্ধ্বে।

দুপরে জয়নাল হোটেল থেকে খাবার এনে খেল। চুলা ধরিয়ে নিজে বান্নী করল না। বিয়ের আগের দিন মেয়েদের রান্না করতে দেয়া হয় না। মেয়েদের জন্য যে নিয়ম ছেলেদের জন্যেও তো সেই নিয়মই হওয়া উচিত।

ইতিদের বাড়িতে যাবার কথা সন্ধ্যাবেলা। মাগরেবের পর। শামসুদ্দিন সাহেবকে খবর দেয়া আছে। সন্ধ্যা ছটার সময় সে শামসুদ্দিন সাহেবের বাসায় চলে যাবে। সাড়ে ছটার দিকে বের হবে। সঙ্গে গাড়ি থাকলে ভালো হতো। কনের বাড়িতে বর যাবে বেবিটেক্সিতে, ভাবতেই যেন কেমন লাগে। যে মেয়েটির বিয়ে হচ্ছে তারও মানসম্মানের ব্যাপার আছে। জয়নাল ভেবেছিল তিন-চার ঘণ্টার জন্যে একটা প্রাইভেট কার বা মাইক্রোবাস ভাড়া করবে। সেটা সম্ভব হয় নি। দুহাজার টাকা ভাড়া চায়। বেবিটেক্সিতে করে গেলে যেতে আসতে লাগবে আশি টাকা। কোথায় আশি টাকা আর কোথায় দুহাজার টাকা। কোনো মানে হয় না।

জয়নাল ঘর থেকে বের হলো বিকেল তিনটায়। এত আগে বের হওয়া খুবই বোকামি হয়েছে। একা ঘরে বসে থাকতে মন চাইছে না। এখন সমস্যা হয়েছে সময় কাটানো। শামসুদ্দিন সাহেবের কাছে বিকেল তিনটা থেকে বসে থাকতে লজ্জা লাগছে। তিনি হয়তো মনে মনে ভাববেন ব্যাটার দেরি সহ্য হচ্ছে না। যাবে মাগরেবের পর সে এসে বসে আছে দুপুর থেকে।

সময় কাটানোর জন্যে জয়নাল ঢুকে পড়ল কার হেভেন নামের এক গাড়ির দোকানে। সুন্দর সুন্দর ঝকঝকে গাড়ি পড়ে আছে। গাড়িগুলো দেখার মধ্যেও অনিন্দ। জয়নাল এমন ভাব করল যেন সে গাড়ি কিনতে এসেছে। আজ ব্যাপারটা খুব হাস্যকর লাগলেও একদিন সে নিশ্চয়ই গাড়ি কিনবে। দোকানের একজন কর্মচারী চোখ সরু করে তাকাচ্ছে। এমন সরু চোখে তাকানোর কিছু নেই। তোমরা গাড়ি সাজিয়ে রেখেছ মানুষকে দেখানোর জন্যেই। জয়নাল প্রাণপণ চেষ্টা করছে এমন একটা ভঙ্গি করতে যেন সে গাড়ি কিনতেই এসেছে। যারা গাড়ি কিনতে আসে তারা নিশ্চয়ই বিশেষ ধরনের কোনো কাপড় পরে আসে না। তার মতোই শার্ট প্যান্ট পরে আসে। কথাও নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষের মতোই বলে।

আপনি কী চান?

কর্মচারীর কথা শুনেই জয়নালের গা জ্বলে গেল। কথা বলার ধরন কী? আপনি কী চান?

জয়নাল গম্ভীর গলায় বলল, কিছু চাই না। গাড়ি দেখছি। জীবনে কখনো কাছ থেকে গাড়ি দেখি নি। এখন কাছ থেকে দেখছি। দুএকটা গাড়ি হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখব। কোনো সমস্যা আছে? সমস্যা থাকলে বলুন অন্য কোনো গাড়ির শো-রুমে যাই।

কর্মচারী হকচকিয়ে গেল। সে সঙ্গে সঙ্গে বিনীত সুর বের করে বলল, স্যার বলুন কী গাড়ি দেখবেন?

আপনাদের কি সবই রি-কন্ডিশন্ড গাড়ি?

জি স্যার।

নাইনটি নাইন মডেলের নোয়া আছে?

একটা আছে।

দাম কত?

পনেরো লাখ।

নাইনটি নাইন মডেলের নোয়ার দাম তেরো লাখের বেশি হবার পেছনে কোনো যুক্তি আছে?

গাড়িতে ভিসিডি প্লেয়ার আছে। সিডি আছে। সান রুফ আছে, মুন রুফ আছে। পেছনে সিঁড়ি আছে। সিঁড়িটার দামই স্যার পড়ে পঞ্চাশ হাজার।

সিঁড়ি তো কোনো কাজের সিঁড়ি না। শো পিস।

জি স্যার, শো পিস।

লুসিডা আছে?

একটা আছে নীল।

কোন মডেল?

৯৮ মডেল।

দাম বলুন।

এগারো লাখ।

আপনি তো এখানকার কর্মচারী?

জি স্যার।

মালিকপক্ষের কেউ কি আছে?

জি স্যার, আছে, আমি নিয়ে আসি। আপনি কি চা কফি কিছু খাবেন?

চা কফি কিছুই খাব না। মালিকপক্ষের কেউ থাকলে তাকে ডাকুন।

কার হেভেনের মালিক আব্দুর রহমানের সঙ্গে খুবই সহজ ভঙ্গিতে জয়নাল কথা বলল। নিজের কথায় জয়নাল নিজেই মুগ্ধ। এক সময় তার মনে হতে লাগল আসিলেই সে গাড়ি কিনতে এসেছে।

আব্দুর রহমান সাহেব, আপনাকে আসল কথা বলি–আগামী মাসের ১১ তারিখ আমার স্ত্রীর জন্মদিন। অনেক আগে তাকে প্রমিজ করেছিলাম তার জন্মদিনে একটা ব্র্যান্ড নিউ লাক্সারি মাইক্রোবাস দেব। ব্র্যান্ড নিউ লাক্সারি মাইক্রোবাস আমি কিনতে চাচ্ছি না। রি-কন্ডিশন গাড়িই কিনব। কিন্তু গাড়ির লুক ভালো হতে হবে। গাড়িতে সান রুফ মুন রুফ আমার কাছে খুবই হাস্যকর লাগে। কিন্তু আমার স্ত্রীর আবার এইসব পছন্দ। এখন আপনাকে আমি খোলাখুলি কয়েকটা ব্যাপার বলি–আমার স্ত্রী গেজেটের ভক্ত। গাড়িতে যত বেশি গেজেটস থাকবে তত সে খুশি। তার প্রিয় রঙ নীল। আমার বাজেটটাও বলি। বাজেট দশ লাখ। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ফি-ও তার মধ্যে ইনক্লুডেড।

কিছু কি বাড়ানো যায়? আরো দুই?

না।

স্যার, আসুন, কফি খেতে খেতে কথা বলি।

কথা বলতে পারি, তবে কফি খাব না।

চা?

চা এক কাপ খাওয়া যেতে পারে।

আপনার মিসেসকে নিয়ে এলে ভালো হতো। উনি নিজে পছন্দ করতে পারতেন। মেয়েদের শাড়ি-গাড়ির ব্যাপারে নানা খুঁত-খুঁতানি থাকে।

গাড়িটা তাকে দিতে চাচ্ছি সারপ্রাইজ হিসেবে, আগে দেখে ফেললে তো সারপ্রাইজ এলিমেন্ট নষ্ট হয়ে যায়।

তা ঠিক।

আব্দুর রহমান সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিল। জয়নাল সিগারেট নিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে টান দিচ্ছে। তার খুবই মজা লাগছে। মনে হচ্ছে সে সত্যি সত্যিই গাড়ি কিনতে এসেছে।

আচ্ছা এরকম দিন কি তার আসবে না? কেন আসবে না? আসতেও তো পারে। পথের ফকির থেকে মানুষ কোটিপতি হয়। আবার কোটিপতি থেকে কেউ কেউ হয় শুনাপতি। সবই ভাগ্যের খেলা। তার বন্ধু বরকত কোরান শরীফের একটা আয়াত সব সময় বলত–সূরা বনি ইসরাইলে আল্লাহপাক বলছেন—

আমি প্রত্যেক মানুষের ভাগ্য তার গলায় হারের
মতো পরিয়ে দিয়েছি।

আমরা সবাই গলায় অদৃশ্য হার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কার হার কেমন কেউ জানে না।

 

সাড়ে ছটার সময় জয়নাল শামসুদ্দিন সাহেবকে নিয়ে ইতিদের বাসায় উপস্থিত হলো। ড্রয়িং রুমে ঢোকার মুখেই দুর্ঘটনা। দরজায় ধাক্কা লেগে জয়নালের হাতে ধরা মিষ্টির হাঁড়ি ভেঙে রসগোল্লা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। রসগোল্লার রসে জয়নালের প্যান্ট মাখামাখি হয়ে গেল। মিষ্টির হাঁড়ি ভেঙে যাওয়া বড় কিছু না, দুই কেজি রসগোল্লার দাম একশ আশি টাকা, কিন্তু লক্ষণ অশুভ। শুভদিনে দুর্ঘটনা ঘটা মানেই অশুভ কিছু আছে। জয়নালের বুক টিপটিপ করছে। বোঝাই যাচ্ছে গণ্ডগোল একটা লাগবেই।

ইতিদের বসার ঘরে এক গাদা মানুষ। হাঁড়ি ভাঙা রসগোল্লার কয়েকটা বসার ঘরেও ঢুকেছে। তারা সবাই তাকিয়ে আছে সেই দিকে। সবার মুখই গম্ভীর। ইতির খালু সাহেব শুকনা গলায় বললেন, সাবধানে আসুন। মিষ্টিতে পা পড়লে আছাড় খাবেন। অতিরিক্ত সাবধান হতে গিয়েই জয়নাল মিষ্টির রসে পা দিল। উল্টে পড়তে পড়তে শামসুদ্দিন সাহেবকে ধরে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল। এই প্রক্রিয়ায় লাভের মধ্যে লাভ হলো জয়নালের হাতে ধরা অন্য হাড়িগুলিও মেঝেতে ছিটকে পড়ল। দুর্ঘটনা একটার পর একটা ঘটতে শুরু করেছে–এরপরে কপালে কী আছে? জয়নালের কেমন যেন বমি বমি আসছে। পেটের ভেতর মোড় দিচ্ছে। ঘর-বাড়ি দুলছে। সবার সামনে সে বমি করে দেবে না তো? হয়তো দেখা যাবে বিয়ের আলাপের এক পর্যায়ে সে হড়হড় করে ইতির আলুর গায়ে বমি করে দিল। বিয়ের আলাপ-আলোচনা এখানেই সমাপ্তি।

জয়নালের শুধু যে বমি পাচ্ছে তা না, বাথরুমও পেয়ে গেছে। তার যে এত প্রবল বাথরুম পেয়েছিল তা আগে বোঝা যায় নি। আগে বুঝতে পারলে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে হালকা হয়ে আসত। এখন বোঝা যাচ্ছে। তলপেট টনটন করছে। এই মুহুর্তেই বাথরুমে যাওয়া দরকার। বাথরুমে যেতে পারলে বমির কাজটাও সেরে ফেলা যেত। সবচে ভালো হতো একটী গোসল দিতে পারলে। মাথা গরম হয়ে আছে। মাথায় পানি ঢালতে হবে। বিশ-পঁচিশ মিনিট পানি ঢাললে মাথাটা ঠাণ্ডা হতো।

ইতির বাবা জয়নালের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ?

জয়নাল বলল, জি স্যার শরীর খারাপ। আমার বাথরুমে যাওয়া দরকার। বাথরুমটা কোন দিকে?

জয়নালকে বাথরুম দেখিয়ে দেয়া হয়েছে। সে হেলতে দুলতে বাথরুমের দিকে যাচ্ছে। নতুন চশমা পরলে মেঝে যেমন উঁচু নিচু লাগে তার কাছেও এখন সে-রকম লাগছে। মাথা ঘুরাটা অনেকখানি বেড়ে গেছে। দেয়াল ধরে ধরে এগুতে পারলে ভালো হতো। সেটা ঠিক হবে না। ইতিদের বসার ঘরের সবাই ভাববে জামাই দেয়াল ধরে ধরে যাচ্ছে কেন? সে কি কোনোখান থেকে মাল টেনে এসেছে? ইতির বাবাকে স্যার ডাকাও ঠিক হয় নি। সবই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আরো এলোমেলো হবে। এতটা সময় পার হয়েছে এখনো একবার আল্লাহ-খোদার নাম নেয়া হয় নি। আল্লাহর নিরানব্বইটা নামের মধ্যে একটা নাম আছে যা বারবার জপ করলে সমুদয় বিপদ কেটে যায়। কত অসংখ্যবার এই নাম জয়নাল জপ করেছে, আজ কিছুতেই নামটা মনে পড়ছে না। আল্লাহরই ইচ্ছা নেই সে বিপদ থেকে পার হয়। আল্লাহর ইচ্ছা থাকলে তার নাম মনে পড়ত। নামটা ম দিয়ে এইটুকু শুধু মনে পড়ছে।

বিয়ের আলাপ-আলোচনার শুরুতেই গণ্ডগোল লেগে গেল। মেয়ের বাবা শামসুদ্দিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি ছেলের আপন চাচা?

শামসুদ্দিন বললেন, জি না।

মেয়ের বাবা বললেন, জয়নাল তো বলেছিল আপনি তার আপন চাচা। তার মানে কী? জয়নাল মিথ্যা কথা বলেছে? এমন মিথ্যাবাদী ছেলের সঙ্গে তো আমি মেয়ে বিয়ে দেব না। অসম্ভব।

এরকম কঠিন কথার পর বিয়ের আলোচনা অগ্রসর হবার কোনো কারণ থাকে না। আলোচনা থেমে গেল। সবাই চুপচাপ বসে রইল। নীরবতা ভঙ্গ করে শাসুদ্দিন বললেন, অনেক দূরের মানুষও মাঝে মাঝে খুব আপন হয়। সেই অর্থে সে আপন বলেছে। মিথ্যা বলে নাই।

মেয়ের বাবা বললেন, মিথ্যা বলে নাই?

শামসুদ্দিন বললেন, জি না। তার বিষয়ে সে কোনো কিছুই আপনাদের কাছে গোপন করে নাই। সে বলে নাই যে তার দেশের বাড়িতে বিরাট বিষয়-সম্পত্তি আছে। বড় বড় আত্মীয়স্বজন আছে। সে যা তাই বলেছে। বিয়ের আলাপআলোচনায় সে নিশ্চয়ই কারো না কারো কাছ থেকে একটা গাড়ি জোগাড় করে সেই গাড়িতে করে আসতে পারত। তা না করে সে আমাকে নিয়ে বেবিটেক্সিতে করে এসেছে। তার স্বভাবের মধ্যে যদি মিথ্যা থাকত, ভান থাকত তাহলে অনেক কায়দা দেখাবার চেষ্টা সে করত। সে আমাকে আপন চাচা বলেছে কারণ সে মন থেকে এই ব্যাপারটা বিশ্বাস করে বলেই বলেছে। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন সে কিন্তু তার কোনো আত্মীয়স্বজনকে অনে নি। আমাকে নিয়ে এসেছে।

জয়নাল মুগ্ধ চোখে শামসুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে কয়েকবার বলে ফেলেছে মারাত্মক ব্যাটিং করেছেন চাচাজি। এক ওভারে পাঁচটা ছক্কা মেরেছেন। আর দরকার নেই।

রাত আটটার ভেতর বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল। বিয়ের তারিখ হয়ে গেল সামনের পঁচিশ তারিখ। দেনমোহর ঠিক হলো পাঁচ লক্ষ এক টাকা, এর মধ্যে গয়নাতে একলক্ষ টাকা উসুল। শামসুদ্দিন ইতির হাতে আংটি পরিয়ে দিতে দিতে বললেন, মাগো, অতি ভালো একটা ছেলে পেয়েছ। তোমার শাড়ির আঁচল দিয়ে ছেলেটাকে এমনভাবে ঢেকে ঢুকে রাখবে যেন বাইরের কোনো ধুলা ময়লা তার গায়ে না লাগে। দামি রত্ন, যত্ন করে রাখতে হয় গো মা।

শামসুদ্দিন সাহেবের কথা শুনে জয়নালের চোখে পানি এসে গেল। চোখের পানি আটকে রাখার সে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল। জয়নাল ঠিক করে ফেলল–তার নিজের সংসার যেদিন হবে সেদিন থেকেই এই বুড়োকে সে নিজের সংসারে এনে রাখবে। শুধু দুজনের সংসার ভালো হয় না। সংসারে মুরুব্বিদের কেউ থাকতে হয়।

বিয়ের আলাপ-আলোচনার শেষে সবাই চা খাচ্ছে। জয়নালের মাথা ঘোরাটা কমে গেছে। তার কেমন শান্তি শান্তি লাগছে। প্রচণ্ড ঘুমও পাচ্ছে। সে ঠিক করে ফেলেছে আজ রাতে আর খাওয়া-দাওয়া করবে না। বাসায় ফিরেই লম্বা ঘুম দেবে।

চা খাওয়া শেষ হবার পর ইতির খালু হঠাৎ বললেন, আমার একটা প্রস্তাব আছে। সব যখন ঠিক ঠাক হয়েই গেল বিয়েটা পিছিয়ে রেখে লাভ কী! একজন কাজি ডেকে বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হোক। শুভ কাজ ফেলে রাখতে হয় না।

সবাই চুপ করে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। জয়নালের মাথা ঘোরা রোগ আবার শুরু হয়েছে। ইতি যে-রকম বলেছিল সে-রকমটা দেখি হচ্ছে। ইতি দেখি ডেনজারাস মেয়ে।

রাত দশটা বাজার আগেই জয়নালের বিয়ে হয়ে গেল।

 

জয়নাল তার গুহায় ফিরে এসেছে। তার কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগছে। এখনো চারপাশের সব কিছু দুলছে। তবে এই দুলুনি আরামদায়ক দুলুনি। সে যেন বিরাট কোনো এক বজরার ছাদে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে ঢেউয়ের ধাক্কায় বজরা দুলছে। আরামে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।

ইতিদের বাসায় রাতে খাবারের আয়োজন ছিল। তারা হোটেল থেকে খাবার আনিয়েছিল। জয়নালের শরীর খারাপ লাগছিল বলে কিছু খেতে পারে নি। এখন ক্ষিধে লেগেছে। ঘরে চাল-ডাল আছে। খিচুড়ির মতো রান্না করা যায়। সে ইচ্ছাটাও করছে না। জয়নাল বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, তারপরেও সে কষ্ট করে জেগে আছে। আজকের অদ্ভুত দিনটা নিয়ে চিন্তা করতে তার ভালো লাগছে। ঘুমিয়ে পড়লে তো আর চিন্তা করা যাবে না।

দুপুরের ডাকে আসা চিঠিগুলি পড়া হয় নি। এখন পড়া যেতে পারে। আজ চিঠির কোনো দুঃসংবাদই তার কাছে দুঃসংবাদ বলে মনে হবে না। জয়নালের ধারণা ভয়ঙ্কর কোনো দুঃসংবাদ নিয়ে আসা চিঠি পড়লেও তার ভালো লাগবে।

প্রথম যে চিঠি জয়নাল পড়ল সেটা লিখেছে বরকত। বরকতের চিঠি এসেছে এটা জানলে সে আগেই পড়ত। পৃথিবীর সবচে খারাপ হাতের লেখা বরকতের। বরকতের হাতের লেখা পড়ে অর্থ বের করা অত্যন্ত কঠিন। বরকত লিখেছে—

জয়নাল,

তোর সঙ্গে অনেকদিন কোনো যোগাযোগ নেই। এদিকে জেল-টেল খেটে আমি অস্থির। হাঁপানি রোগে ধরেছে। দুঃখধান্ধায় মাথার চুল পেকে বুড়ো হয়ে গেছি। এখন আমাকে দেখলে তুই চিনতে পারবি না। তোর মন খারাপ হয়ে যাবে।

জয়নাল শোন, আমি খবর পেয়েছি তুই সবার কাছে আমেরিকা যাবার টিকিটের টাকার জন্যে ধাধরি করছিস। তোর অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি। আমি নিজেও এর ভেতর দিয়ে গিয়েছি। সেই সময় তুই আমার জন্যে যে ছোটাছুটি করেছিস তা আমার মনে আছে রে দোস্ত। তোর ভালোবাসার ঋণ আমার পক্ষে কোনো দিন শোধ করা সম্ভব না। আমি সেই চেষ্টাও করব না। যাই হোক, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ঢাকাআমেরিকা-ঢাকা একটা ওপেন টিকিট তোর জন্যে পাঠালাম। দোস্ত রে এত দুশ্চিন্তা করিস না। আমি আছি না?

শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। বেশিদিন বাঁচব বলে মনে হয় না। জীবনটা দুঃখ-ধান্ধায় কেটে গেল এই আফসোস।

তুই ভালো থাকিস।

ইতি—বরকত

বৃষ্টি পড়ছে। টিনের চালে বৃষ্টির কী সুন্দর শব্দ! জয়নাল বিছানায় শুয়ে আছে। বরকতের মুখ মনে করার চেষ্টা করছে। কিছুতেই মনে পড়ছে না। মানুষের মস্তিষ্কের এই এক আশ্চর্য ব্যাপার মানব মস্তিষ্ক অতি প্রিয়জনদের চেহারা কখনোই হুবহু মনে করতে পারে না। কল্পনায় আবহু ধোয়াটে ছবি ফুটে উঠে–যে ছবি কখনোই স্পষ্ট হয় না।

বৃষ্টি পড়ছে। আহ কী মিষ্টি ঝুনঝুন শব্দ! এই শব্দটা না হলেই ভালো হতো। ঘুমপাড়ানি গানের মতো শব্দটা ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। জয়নাল ঘুমুতে চায় না। সে জেগে থাকতে চায়। আজ সারা রাত সে জেগে থেকে আনন্দ করবে। মনে মনে কথা বলবে ইতির সঙ্গে। আজ তার জীবনের বিশেষ একটি রাত। বিয়ের রাত। বাসর হচ্ছে না, তাতে কী? গুহার ভেতরে সে নিশ্চয়ই ইতিকে নিয়ে বাসর সাজাবে না। ইতিও কি জেগে আছে? হয়তো জেগে আছে। তার বান্ধবীরা চলে

এসেছে। সবাই মিলে গুটুর গুটুর করে গল্প করছে।

দরজার কড়া নড়ছে। কে আসবে এত রাতে? জয়নাল দরজা খুলল। দশএগারো বছরের একটা অপরিচিত মেয়ে বড় একটা স্যুটকেস হাতে দাঁড়িয়ে আছে। জয়নাল বিস্মিত হয়ে বলল, তুমি কে?

মেয়েটা বলল, আমার নাম ফুলি।

আমার কাছে কী?

আফা আসছে।

আফা আসছে মানে কী? আফা কে?

গেটের কাছে একটা জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি থেকে ইতি নামছে। ইতির মাথায় ছাতা ধরে আছেন ইতির খালু। ইতি মাথা উঁচু করে জয়নালকে দেখে তার খালুর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে আসতে হবে না। আপনি থাকুন। আমি ফুলিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

পুরো ব্যাপারটা কি স্বপ্নে ঘটছে? ইতির তো এখানে আসার কথা না। নাকি কোনো ঝামেলা হয়েছে? বিয়ে যেটা হয়েছিল সেটা বাতিল। কিন্তু বাতিল হলে তো সুটকেস নিয়ে কাজের মেয়ের আসার কথা না। কী ঘটছে চারদিকে!

ইতি খুব স্বাভাবিকভাবে ঘরে ঢুকে বলল, তোমাকে বলেছিলাম না, আমি এখানে থাকব। থাকতে এসেছি।

জয়নাল বলল, ও।

ইতি বলল, তোমার এখানে রাতে থাকতে আসব শুনে বাসায় খুব হৈচৈ হচ্ছে। বাবা ভয়ঙ্কর রাগ করেছেন। মা রাগ করেছেন। সবাই আমাকে বেহায়া ডাকছে। শুধু একজন আমাকে সাপোর্ট দিয়েছে। সেই একজন কে বলো তো? আমার দাদি। এরকম অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছ কেন?

জয়নাল বলল, তুমি যে সত্যি সত্যি এসেছ এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।

ইতি বলল, বিশ্বাস না হলে কী আর করা! বিছানা থেকে চাদরটা সরাও। বালিশের ওয়ার খোল। আমি নতুন চাদর আর বালিশের ওয়ার নিয়ে এসেছি। আচ্ছা শোন, আজ তুমি যখন মিষ্টির হাঁড়ি ভেঙে চারদিকে রসগোল্লা ছড়িয়ে দিলে তখন কে সবচে বেশি খুশি হয়েছিল জানো? আমার দাদিজান।

এতে খুশি হবার কী আছে?

বিয়ের আলাপের সময় মিষ্টির হাঁড়ি ভেঙে যাওয়া নাকি খুবই শুভ লক্ষণ। দৈএর হাঁড়ি ভাঙাও শুভ। তুমি তো মিষ্টির সঙ্গে দৈও এনেছিলে। দৈ-এর হাঁড়িটা ভাঙতে পারলে না?

ইতি খিলখিল করে হাসছে। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে হাসির শব্দ এমন সুন্দর করে মিশে গেছে। জয়নালের মনে হলো- আকাশ, বাতাস এবং পাতালে এক সঙ্গে জলতরঙ্গ বজিছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ