টিম্বার মার্চেন্ট এস আলম অ্যান্ড সন্স এর অফিসে তিনঘণ্টা দশ মিনিট ধরে জয়নাল বসে আছে। এস আলম সাহেবের সঙ্গে জয়নালের দেখা হয়েছে। জয়নাল তাকে খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছে যে তার কিছু টাকা দরকার। সাহায্য না, ঋণ! ছমাসের জন্য সুদমুক্ত ঋণ। আমেরিকায় যাবার টিকিট কেনার জন্যে টাকাটা দরকার। একজনের কাছ থেকে সে পুরো টাকা নেবে তা না। অনেকের কাছ থেকে নেবে এবং ছ মাসের মধ্যে পুরোটা ফেরত পাঠাবে।

এস আলম সাহেব যে জয়নালের অপরিচিত তা না। মুখ চেনা পরিচয় আছে। তিনি জয়নালের বন্ধু সিদ্দিকের খালু। সিদ্দিকের ভাষায় তার এই খালু টাকার কুমীর না, টাকার তিমি মাছ।

ভদ্রলোক জয়নালের কথা মন দিয়ে শুনলেন তারপর বললেন, অপেক্ষা কর। জয়নাল অপেক্ষা শুরু করেছে। অপেক্ষায় অপেক্ষায় তিন ঘণ্টা দশ মিনিট পার হয়ে গেছে। অফিসে চা-এর ব্যবস্থা আছে। ধবধবে ফর্সা, রোগী টিং টিংএ একটা ছেলে তার নাম কান্ন, সে চাওয়া মাত্র চা দিয়ে যাচ্ছে। তিন ঘন্টা দশ মিনিটে জয়নাল এগারো কাপ চা খেয়ে ফেলল, সেই সঙ্গে পাঁচটা নোনতা বিসকিট। এক সময় দেখা গেল এস আলম সাহেব অফিস শেষ করে বাড়ির দিকে রওনা হবার জন্যে বের হলেন। গাড়ি আনতে বললেন। জয়নাল বিস্মিত হয়ে এগিয়ে গিয়ে বলল, স্যার আমার ব্যাপারটা।

এস আলম সাহেব পাঞ্জাবির পকেট থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে জয়নালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, নিয়ে যাও। এটা ফেরত দিতে হবে না।

জয়নাল বলল, সরি আমি পাঁচশ টাকার জন্যে আপনার কাছে আসি নি।

এস আলম সাহেব পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ। নিলে নাও, না নিলে নাই।

জয়ললি বলল, থাক লাগবে না।

এস আলম সাহেব সঙ্গে সঙ্গে টাকা মানিব্যাগে ঢুকিয়ে গাড়ির দিকে রওনা হলেন। জয়নাল মনে মনে বলল–যা কুত্তা।

টিকিটের টাকা জোগাড়ের জন্যে জয়নাল একচল্লিশ জনের একটা তালিকা করেছে। একচল্লিশ জনের মধ্যে তার আত্মীয়স্বজন আছে, বন্ধু-বান্ধব আছে, বন্ধু-বান্ধবের আত্মীয়স্বজন আছে। গত পাঁচ বছরে জয়নাল যে সব ছাত্র-ছাত্রীকে পড়িয়েছে তাদের বাবা-মা আছে। টাকা সংগ্রহ অভিযান যেমন হবে ভাবা। গিয়েছিল তেমন মনে হচ্ছে না। সবাই টিম্বার মার্চেন্ট এস আলমের মতো আচরণ করছে। জয়নালের কয়েকজন ছাত্রের বাবা-মা জয়নালকে চিনতেই পারল না। একজন ছাত্রের মা বলল, আপনি মিঠুকে পড়িয়েছেন? কবে? আশ্চর্য কথা! মিঠু কখনো প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়েছে বলে তো মনে হয় না। আপনার কথাবার্তা খুবই সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। আপনি চলে যাবেন না। মিঠু স্কুল থেকে ফিরুক। আপনাকে আইডেনটিফাই করুক, তারপর যাবে যদি আপনাকে আইডেনটিফাই করতে না পারে তাহলে আমি কিন্তু আপনাকে পুলিশের কাছে হ্যান্ডওভার করে দেব।

জয়নাল চোখ মুখ শুকনা করে ড্রয়িংরুমে বসে মিঠুর আগমনের প্রতীক্ষা করতে লাগল। তার একটা ভয় মিঠু যদি তাকে চিনতে না পারে তাহলে কী হবে! ভিক্ষা চাই না মা কুত্তা সামলাও অবস্থা। মিঠু ফিরল বিকেল পাঁচটায়। সে জয়নালকে দেখেই বলল, স্যার কেমন আছেন? আপনার মাথার সব চুল পড়ে গেছে কেন?

মিঠুর মা বললেন, সরি আপনাকে এতক্ষণ বসিয়ে রেখেছি। আপনি কিছু মনে করবেন না। বাধ্য হয়ে প্রিকশান নিতে হয়েছে। ঢাকা শহর জুয়াচোরে ভর্তি হয়ে গেছে। কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। যাই হোক, আপনাকে আমরা কোনো সাহায্য করতে পারব না। আমাদের নিজেদেরই অর্থনৈতিক ক্রাইসিস যাচ্ছে। জয়নাল সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মনে মনে বলল–দূর মোটা কুত্তি।

উৎসাহজনক কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না–তাতে জয়নাল মোটেই চিন্তিত না। নেত্রকোনায় তাদের যে বসতবাড়ি আছে সেটা জরুরি ভিত্তিতে বিক্রি করার জন্যে সে তার বড় চাচাকে চিঠি দিয়েছে এবং টেলিগ্রাম করেছে। দশ কাঠা জমির উপর বাড়ি। কাঠাল বাগান আছে, আম বাগান আছে। বাড়ির পেছনে ছোট পুকুর আছে। খুব কম করে হলেও জমির দাম পাঁচ লাখ টাকা হওয়া উচিত। পানির দামে বিক্রি করলেও দু লাখ টাকা আসবে। পৈতৃক ভিটা বিক্রি করলে বাবা-মার অভিশাপ লাগে এই ভেবে এত অভাবেও বিক্রির চিন্তা মাথায় আসে নি। এখন বাধ্য হয় চিন্তা করতে হচ্ছে। তাছাড়া জয়নালের ধারণা আমেরিকার মতো দূর দেশে অভিশাপ পেঁৗছবে না। সে ঠিক করে রেখেছে বাড়ি বিক্রির টাকাটা চলে এলে এখানকার সমস্ত ঋণ শোধ করবে। খাসি জবেহ করে বন্ধু-বান্ধবদের একটা পার্টি দেবে। তার বিয়েটা যদি হয়েই যায় সেখানেও কিছু খরচ আছে। হাজার বিশেক টাকা ইতির হাতে ধরিয়ে দিয়ে যেতে হবে। বিয়ের পরেও মেয়ে বাবা-মার হাত থেকে খরচ নেবে সেটা তো হয় না। তবে ইতির যা খরচের হাত মনে হচ্ছে এক সপ্তাহের মধ্যেই টাকা উড়িয়ে দেবে। এরও একটা ভালো দিক আছে–যে সব স্ত্রী খরুচে তাদের স্বামীরা ভালো রোজগার করে। কৃপণ স্ত্রীদের স্বামীরা আয় উন্নতি করতে পারে না। শাস্ত্রের কথা।

জয়নালের বিয়ের ব্যাপারটা কিছু অগ্রগতি হয়েছে। শামসুদ্দিন প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। মেয়েপক্ষ হ্যাঁ না বললেও সরাসরি নাও বলে নি। মেয়ের এক ফুপা অবশ্যি বলেছেন বাপ-মা নেই ছেলে। এটা একটা সমস্যা। মেয়ে কোনোদিন শ্বশুরশাশুড়ির আদর পাবে না।

মেয়ের ফুপা বললেন, এতিম ছেলে দুর্ভাগ্যবান হয়।

শামসুদ্দিন বলেছেন, খুবই ভুল কথা বললেন। আমাদের নবী এ করিম সাল্লালাহু আলায়ে সালাম ছিলেন এতিম। তিনি কি দুর্ভাগ্যবান?

জয়নাল শামসুদ্দিন সাহেবের কথাবার্তায় মুগ্ধ। আলাভোলা টাইপের এই লোক যে এত গুছিয়ে কথা বলবে এটা ভাবাই যায় না। মেয়ের বাবা যখন বললেন, আপনি কি ছেলের আপন চাচা? তখন শামসুদ্দিন সাহেবের জবাব দেবার আগেই জয়নাল বলেছে, জি আপন চাচা। উনিও আমার সঙ্গে আমেরিকা যাচ্ছেন। ভিসা পেয়ে গেছেন। উনি যাচ্ছেন বেড়াতে। উনার আবার দেশ-বিদেশ ঘুরার শখ। অনেক দেশ ঘুরেছেন। আমেরিকাটা বাকি আছে। ইনশাল্লাহ এইবার আমেরিকাও দেখবেন।

মেয়ের বাবা অবাক হয়ে বললেন, বেড়াবার জন্যে আমেরিকা যাচ্ছেন? শামসুদ্দিন সাহেব এবারও জবাব দেবার সুযোগ পেলেন না। জয়নাল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমেরিকার ভেলেভু হাসপাতালে উনি জেনারেল চেকআপ করবেন, তাঁর স্বাস্থ্যটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। হাঁচির সমস্যা হচ্ছে। দেশে ট্রিটমেন্টের যে অবস্থা!

পাত্রীপক্ষ হ্যাঁ না বললেও জয়নাল প্রায় সত্ত্বর ভাগ নিশ্চিত যে বিয়েটা হয়ে যাবে। সে স্বপ্নে দেখেছে তার বিয়ে হচ্ছে। নৌকায় করে বরযাত্রী যাচ্ছে। বরযাত্রীর মধ্যে তার বাবাও আছে। সে বাবাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, আপনি না মারা গেছেন। আপনি এখানে আসলেন কীভাবে? জয়নালের কথায় বিরক্ত হয়ে তার বাবা বললেন, তুই ছোটবেলায় যেমন গাধা ছিলি এখনো দেখি সেরকম গাধাই আছিস। মারা গিয়েছি বলে ছেলের বিয়েতে বরযাত্রী আসব না? এ ধরনের স্বপ্ন দেখার একটাই মানে বিয়ে হবে। বিয়ের জন্যে তৈরি হয়ে যাওয়া উচিত। আংটি কিনতে হবে, শাড়ি কিনতে হবে। বিয়ের পর একদিনের জন্যে হলেও কনেকে স্বামীর বাড়ি যেতে হয়। স্বামীর বাড়িটা কোথায় যে সে যাবে? ইতিকে নিয়ে সে নিশ্চয়ই গ্যারেজের উপরের ঘরে উঠতে পারে না।

সোমবার জয়নালের জন্যে খুব ভালো দিন। তার জীবনে ভালো কিছু ঘটে নি। তারপরেও যা কিছু শুভ তা ঘটেছে সোমবারে। সর্বশেষ আমেরিকান ভিসা এটাও সোমবারে পাওয়া। সোমবার শুধু মাত্র এই কারণে জয়নালের মন ভালো থাকে। ঘুম ভাঙার পর মনে হয়, আহ কী শুভ দিন!

আজ সোমবার। জয়নাল ঠিক করে রেখেছে নিউ মার্কেট থেকে টাটকা একটা চিতল মাছ কিনে ইতিদের বাসায় দিয়ে আসবে। তাকে বলবে তার এক বন্ধুর হাওরে জলমহাল আছে। সেখান থেকে মাছ পাঠিয়েছে। সে একা মানুষ, এত বড় মাছ দিয়ে কী করবে? কাজেই মাছটা দিয়ে গেল। নিজের বুদ্ধিতে জয়নাল নিজেই মুগ্ধ এবং আনন্দিত হলো। আনন্দ স্থায়ী হলো না সোমবার শুভদিনে তার জন্যে এক দুঃসংবাদ এসে উপস্থিত হলো। মেজো চাচা দেশ থেকে কুরিয়ার সার্ভিসে চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে লেখা–

বাবা জয়নাল,

দোয়াগো

তোমার চিঠি এবং টেলিগ্রাম যথা সময়ে পাইয়াছি। চিঠি এবং টেলিগ্রাম পড়িয়া যারপরনাই বিস্মিত হইলাম। ঘটনা কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। তোমাদের বসত বাড়ি বড় ভাইজান জীবিত থাকা অবস্থাতেই উনার নিকট হইতে আমি খরিদ করি।

এই জমির খাজনা আমি নিজের নামে পরিশোধ করিতেছি। তারপরও তোমার মনে যদি কোনো সন্দেহ থাকে তাহা হইলে খাজনা পরিশোধ রসিদ দেখিয়া যাইতে পার।

তুমি আমেরিকা যাইতেছু শুনিয়া আমি এবং তোমার চাচি দুইজনেই অত্যন্ত খুশি হইয়াছি। দোয়া করি আল্লাহ তোমাকে সুখী করুন। আমেরিকা রওনা হইবার পূর্বে অতি অবশ্যই তুমি দেশের বাড়িতে বেড়াইয়া যাইব।

ইতি

তোমার চাচা

ইদরিস আলী

খারাপ সংবাদের নিয়ম হলো, একটা খারাপ সংবাদের পর পর দ্বিতীয় খারাপ সংবাদটা আসে। খারাপ সংবাদ কখনো একা আসতে পারে না। জয়নালের ক্ষেত্রেও তাই হলো–চাচার চিঠি পড়ে হতভম্ব ভাবটা দূর হবার আগেই দোকানে সিগারেটের দাম দিতে গিয়ে লক্ষ করল কোটের পকেটে মানিব্যাগ নেই। জয়নালের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। কারণ মানিব্যাগের সঙ্গেই তার পাসপোর্ট। মানিব্যাগের সঙ্গে পাসপোর্টও নেই। এমন কি হতে পারে সে বাসায় পাসপোর্ট এবং মানিব্যাগ রেখে এসেছে? হে আল্লাহ পাক তাই যেন হয়। যদি তাই হয় আমি এক হাজার রাকাত শুকরানা নামাজ পড়ব।

বেলা দুটা নাগাদ জয়নাল নিশ্চিত হলো তার মানিব্যাগ এবং পাসপোর্ট দুটাই পকেটমার হয়েছে। দুটা থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত সে এক নাগাড়ে রাস্তায় হাঁটুল। উদ্ভ্রান্ত মানুষের হাঁটা। মাথায় কোনো চিন্তা নেই, কোনো উদ্দেশ্য নেই, শুধুই হাঁটা। ফার্মগেটের ওভারব্রিজে উঠে একবার তার মনে হলো, চিৎকার করে বলে আমার দিকে তাকিয়ে দেখুন। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে দেখুন। কেন এ ধরনের চিন্তা মাথায় এলে তাও সে জানে না। সে ওভারব্রিজের রেলিং-এ হাত রেখে ঝুঁকে নিচের দিকে তাকাচ্ছে রাস্তা ভর্তি লোকজন, গাড়ি, ট্রাক, বাস। সবাই কত ব্যস্ত, একমাত্র তার কোনো ব্যস্ততা নেই। সন্ধ্যা না মিলানো পর্যন্ত সে ফার্মগেট ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে রইল।

 

শামসুদ্দিন কিছুক্ষণ আগে মাগরেবের নামাজ শেষ করেছেন। ফরজের পর দুরাকাত সুন্নত পড়বেন এই সময় ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। ঘর নিকষ অন্ধকার হয়ে গেল। পুরোপুরি অন্ধকার ঘরে না-কি নামাজ পড়তে নেই। সামান্য আলো হলেও নাকি থাকতে হবে। শামসুদ্দিন জায়নামাজে বসে রইলেন। ঘরের পরিস্থিতি আজ ভয়াবহ। কিছুক্ষণ আগেও থালা বাসন ভাঙার শব্দ আসছিল। রাহেলী কিছুদিন হলো রাগ দেখানোর নতুন পদ্ধতি হিসেবে থালা বাসন ছুড়ে ছুড়ে মারছে। কোনো একদিন বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। শামসুদ্দিন ঠিক করলেন–আজ রাতে কোনো এক সময় তিনি রাহেলার সঙ্গে কথা বলবেন। শান্তভাবে বোঝানোর চেষ্টা করবেন। রফিকের সঙ্গে কথা বলে আসিয়া মেয়েটাকে বিদায় করার চেষ্টা করবেন।

মোমবাতি জ্বালিয়ে রফিক ঘরে ঢুকল। টেবিলের উপর মোমবাতি বসাতে বসতে বলল, ভাইজানের নামাজ শেষ হয়েছে?

দুরাকাত সুন্নত বাকি আছে।

নামাজ শেষ করুন। আমি চা নিয়ে আসছি। আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে। ভাইজান।

শামসুদ্দিন নামাজ শেষ করলেন কিন্তু বুঝতে পারলেন নামাজ হয় নি। তিনি নামাজে মন দিতে পারেন নি। আত্তাহিয়্যাতু সূরায় দুবার গণ্ডগোল হলো। গোড়া থেকে পড়তে হলো। ঘরের ভেতর থেকে রাহেলার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ফোপানোর সঙ্গে সঙ্গে সে বলছে–তুমি অমির গায়ে হাত তুললে? তুমি এতটা নিচে নমিলে? শামসুদ্দিনের মন খুবই খারাপ হয়েছে। গর্ভবতী কোনো স্ত্রীর গায়ে স্বামী হাত তুলতে পারে? কী অসম্ভব ব্যাপার!

রফিক চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। এক কাপ চা, এক বাটি তেল মরিচ দিয়ে মাখা মুড়ি। শামসুদ্দিন চায়ের কাপ হাতে নিলেন রফিক বলল, ভাইজান, আপনি এত মন খারাপ করে থাকবেন না। আমি রাহেলার গায়ে হাত তুলি নি। এই কাজটা আমার পক্ষে করা সম্ভব না। আমি শুধু বলেছি–এক থাপ্পর লাগাবো। এতেই সে আউলায়ে গেছে। এই কথাটাও আমার বলা উচিত হয় নি। কী করব ভাইজান বলুন, আমি রাগটা সামলাতে পারি নি।

শামসুদ্দীন ক্ষীণ গলায় বললেন, একজন অসুস্থ মানুষ এটা তো রফিক তোমার মাথায় রাখতে হবে।

রফিক হতাশ গলায় বলল, ভাইজান আমি এটা মনে রাখি কিন্তু আমারো তো ধৈর্যের সীমা আছে। আমি তো রোবট না। আমি মানুষ। নিজে নানা সমস্যার মধ্যে থাকি। ব্যবসায়িক অবস্থা খারাপ। সংসার টানতে না পারার লজ্জায় ছোট হয়ে থাকি। এর মধ্যে যদি…

কথা শেষ না করে রফিক সিগারেট ধরাল। শামসুদ্দিন বললেন, সমস্যাটা কি আসিয়া নামের কাজের মেয়েটাকে নিয়ে। তাকে নিয়ে সমস্যা হলে মেয়েটাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে আনলে হয়।

রফিক অবাক হয়ে বলল, আসিয়াকে নিয়ে কী সমস্যা?

শামসুদ্দিন চুপ করে গেলেন। তার কাছে মনে হলো প্রসঙ্গটা তোলাই উচিত হয় নি। রফিক ব্ৰিত গলায় বলল, সমস্যাটা ভাইজান আপনাকে নিয়ে।

শামসুদ্দিন হতভম্ব হয়ে তাকালেন। চা গলায় আটকে বিষম খাওয়ার মতো হলো। রফিক বলল, যে রাতে আপনি জ্বর নিয়ে বাসায় ফিরলেন সেই রাতের ঘটনা। আপনার অবস্থা দেখে রাহেলা শুরু করল কান্না। মরা কান্না বলে যে কথা আছে সেই কান্না। আমি এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বললাম, ভাইজানের জ্বর এসেছে। এমন কোনো সিরিয়াস ব্যাপার তো না। তুমি মরা কান্না শুরু করেছ কেন? এখন তো আশেপাশের ফ্ল্যাট থেকে লোকজন ছুটে আসবে। তখন সে রেগে গিয়ে বলল, কেন কাদছি শুনবে? আমি ভাইজান ডাকলেও উনি আমার ভাই না। তার সঙ্গে ছোটবেলায় আমার বিয়ে হয়েছিল। আমার মা গোপনে মৌলানা ডাকিয়ে কবুল পড়িয়ে আমাদের বিয়ে দিয়েছিলেন। এখন বুঝতে পারছ কেন চিঙ্কার করে কাদছি?

শামসুদ্দিন চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলেন। রফিক নিচু গলায় বলল, ভাইজান, আমি জানি কথাগুলি মিথ্যা। এই নিয়ে আমার মনে কোনো রকম সন্দেহ নাই। রাহেলা অসুস্থ। আপনাকে সে খুবই পছন্দ করে। মানসিক অসুস্থতা, অতিরিক্ত পছন্দ সব মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটা রাহেলার মাথায় জট পাকিয়ে গেছে। ভাইজান, আপনি এইভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমার খুব খারাপ লাগছে। নেন, একটা সিগারেট নেন।

শামসুদ্দিন হাত বাড়িয়ে সিগারেট নিলেন। সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখলেন তিনি সিগারেট ধরাতে পারছেন না। তাঁর হাত কাঁপছে। রফিক বলল, ভাইজান, আমি খুব লজ্জিত যে আপনাকে এত বড় অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছি। রাহেলা এতটা অসুস্থ ছিল না। আপনি আমেরিকা যাবেন এটা শোনার পর থেকে সে পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমি যে কী বিপদে পড়েছি–এক আল্লাহপাক জানেন। আর কেউ জানে না।

আমি যদি অন্য কোথাও চলে যাই তাতে কি সুবিধে হবে?

ভাইজান, আমি বুঝতে পারছি না।

আমি কি বিষয়টা নিয়ে রাহেলার সঙ্গে কথা বলব?

এটাও তো বুঝতে পারছি না।

পৃথুর কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। রফিক উঠে শোবার ঘরের দিকে রওনা হলো। শামসুদ্দিন সিগারেট হাতে মূর্তির মতো বসে রইলেন। তার কাছে মনে হলো তার চারপাশের ঘর-বাড়ি দুলছে। ভূমিকম্প হচ্ছে। এক্ষুণি মাথার উপরের ছাদ ভেঙে নিচে নেমে আসছে।

শোবার ঘরে পৃথু মুখে হাত চাপা দিয়ে দাড়িয়ে আছে। সে হাত চাপা দিয়ে কান্না থামাবার চেষ্টা করছে। থামাতে পারছে না। হাতের ফাক দিয়ে চাপা কান্না বের হয়ে আসছে। রাহেলা ছেলের সামনে দাড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি কঠিন। তার এক হাতে মাছ কাটার বটি। পৃথু এক একবার কেঁদে উঠছে, রাহেলা সঙ্গে সঙ্গে বলছে–খবরদার! শব্দ বের হলে বটি দিয়ে গলা কেটে দুটুকরা করে ফেলব। খবরদার!

রফিক ঘরে ঢুকে বলল, কী হয়েছে?

রাহেলা বলল, তোমাকে বলার মতো কিছু হয় নি।

রফিক বলল, বুটিটা আমার হাতে দাও। প্লিজ দাও। পৃথু ভয় পাচ্ছে। বটিটা দাও।

রাহেলা বটি মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল, আমাকে একটা বেবিটেক্সি ডেকে দাও। আমি তোমাদের সঙ্গে থাকব না।

রাতের বেলা কোথায় যাবে?

কোথায় যাব এটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।

রফিক বলল, রাতটা থাক। সকাল হোক, তুমি যেখানে যেতে চাও আমি দিয়ে আসব।

রাহেলা বলল, ভাইজানের সঙ্গে এতক্ষণ ধরে শুইট করে কী কথা বলেছ?

উনি আমেরিকা কবে যাবেন, টিকিট হয়েছে কিনা এইসব জিজ্ঞেস করছিলাম।

রাহেলা, একসপ্রেসো কফি খাবে? মোড়ে একটা নতুন ফাস্ট ফুডের দোকান হয়েছে, তারা খুব ভালো একসপ্রেসো কফি বানায়। এক কাপ দশ টাকা। খাবে?

রাহেলা কিছু বলল না। রফিক উৎসাহের সঙ্গে বলল, নিয়ে আসি এক কাপ কফি। ভালো না লাগলে ফেলে দিও। পৃথু ব্যাটা, কফি খাবি নাকি?

পৃথু চোখ মুছতে মুছতে বলল, খাব।

তাহলে চল তোকে কফি খাইয়ে আনি আর তোর মার জন্যে কফি নিয়ে আসি। তার আগে একটা কাজ কর বাবা, যা হাত মুখ ধুয়ে আয়। সার্ট পর। জুতা পায়ে দে। তুই কি নিজে নিজে জুতার ফিতা বাঁধতে পারিস?

পারি।

ভেরি গুড। আমার সামনে জুতার ফিতা বাঁধ। ফিতা বাঁধা পরীক্ষা হবে।

পৃথু হেসে ফেলে বাথরুমের দিকে রওনা হলো। একটু আগেই পরিস্থিতি কী ভয়ঙ্কর ছিল। তার মা আরেকটু হলে বটি দিয়ে তাকে কেটেই ফেলত। বাবা এসে ফু মন্ত্র দিয়ে সব ঠিক করে দিল। বাবার মধ্যে পাওয়ার আছে। সুপারম্যান, স্পাইডারম্যানের মতো পাওয়ার। তবে বাবার পাওয়ারটা দেখা যায় না।

রাহেলা খাটে এসে বসেছে। তাকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। রফিক বলল, শরীরটা কি খারাপ লাগছে?

রাহেলা বলল, সামান্য খারাপ লাগছে।

রফিক বলল, রেস্ট নাও। ঠিক হয়ে যাবে।

রাহেলা বলল, ভাইজান হঠাৎ করে আমেরিকা যাবার জন্যে কেন পাগল হয়েছে এটা আমি চিন্তা করে বের করে ফেলেছি।

কেন আমেরিকা যাচ্ছেন?

বীথির সঙ্গে দেখা করার জন্যে।

বীথিটা কে?

ভাইজান এক সময় ব্যাংকে চাকরি করত। বীথি নামের একটা মেয়ে ছিল তাঁর কলিগ। ভাইজানের সঙ্গে বীথির বিয়ে ঠিক হলো। বরযাত্রী নিয়ে ভাইজান বিয়ে করতে গেল নরসিংদি। আমিও ছিলাম বরযাত্রীর দলে। মওলানা এসে বিয়ে পড়াতে গেল। মেয়ে বলল, না। আমি রাজি না! কবুল বলব না।

কেন?

কেন আমি জানি না। কেউ জানে না। ভাইজান ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নানান দুঃখধন্ধের মধ্যে পড়ল। শেষমেষ একটা স্কুল মাস্টারি জোগাড় করল। সারা জীবন বিয়ে করল না।

বীথি মেয়েটা আমেরিকায় থাকে?

হ্যাঁ। বিয়ে করে অনেক দিন আগে চলে গেছে। শোন, যেভাবেই হোক ভাইজানের যাওয়া আটকাতে হবে। তাঁকে ঐ মেয়ের সঙ্গে কিছুতেই দেখা করতে দেওয়া হবে না।

অবশ্যই। রাহেলা চাপা গলায় বলল, ভাইজান আলাভোলা মানুষ। যখন তখন অসুখবিসুখ বাধায়। ভাইজানকে তো আমি কিছুতেই বিদেশের মাটিতে ছাড়ব না।

তাকে ছাড়া উচিতও হবে না।

বাচ্চা হবার সময় আমি বাঁচি না মরি তার মাই ঠিক। তখন যদি ভাইজান কাছে না থাকে তার সঙ্গে তো আমার দেখাই হবে না।

ঐ দিকটা আমি চিন্তা করি নি। আসলেই তো তোমার বাচ্চা হবার আগে কিছুতেই তাকে যেতে দেয়া হবে না। তুমি নিশ্চিত থাক।

পৃথু জুতা পরে এসেছে। সে বাবার সামনে জুতার ফিতা বাঁধার পরীক্ষা দিয়ে বাঁ পায়ের জুতায় ফেল করল। ডান পায়ের জুতায় পাশ করল। রফিক বলল, তুই একশতে পঞ্চাশ পেয়েছিস। এটা খারাপ না। ত্রিশ হলো পাস মার্ক। পাস মার্কের চেয়েও বিশ বেশি পেয়েছিস। চল এবার কফি খেয়ে আসি। রাহেলা তুমিও চল। হাঁটতে হাঁটতে যাই। কাছেই তো।

রাহেলা সঙ্গে সঙ্গে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল। রফিক বলল, এক কাজ করলে কেমন হয়–পৃথু যেহেতু কঠিন একটা পরীক্ষায় ফিফটি পার্সেন্ট মার্ক পেয়েছে সেই উপলক্ষে চাইনিজ খেয়ে ফেললে কেমন হয়? অনেকদিন বাইরে খাওয়া হয় না।

পৃথু বলল, খুব ভালো হয় বাবা।

রাহেলা বলল, ভাইজানকে নিয়ে চল। তাকে ফেলে রেখে আমি চাইনিজ খেতে যাব না।

রফিক বলল, কী বলো তুমি তাকে রেখে যাব না-কি? অবশ্যই তাকে নিয়ে যাব।

শামসুদ্দিন কিছুতেই বাইরে যেতে রাজি হলেন না। শেষে ঠিক হলো তাঁর জন্যে খাবার নিয়ে আসা হবে।

শামসুদ্দিন বাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছেন। হঠাৎ করেই তার শরীর খারাপ করেছে। মাথার দুলুনি প্রবল হয়েছে। বিছানায় শুয়ে থাকলে কম দোলে। উঠে বসলেই চারপাশের জগৎ দুলতে থাকে। মনে হয় তিনি নৌকায় বসে আছেন। নদীতে প্রবল ঢেউ উঠেছে। নৌকা দুলছে। নৌকার সঙ্গে তিনিও দুলছেন।

কলিংবেল বাজছে। রফিকরা গিয়েছে আধঘণ্টাও হয় নি। এত তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে? শামসুদ্দিন দেয়াল ধরে ধরে এগোলেন। দরজা খুললেন। দরজার ওপাশে জয়নাল দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। যেন সে কোনো মানুষ না। প্রেতলোক থেকে ফিরে এসেছে। শামসুদ্দিন বললেন, জয়নাল, তোমার কী হয়েছে?

জয়নাল বিড়বিড় করে বলল, চাচাজি পানি খাব।

ঘরে এসে বসো। পানি এনে দিচ্ছি! তোমার এই অবস্থা কেন? কী হয়েছে।

চাচাজি আমি পাসপোর্টটা হারিয়ে ফেলেছি।

পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেছ?

জি। মানিব্যাগ আর পাসপোর্ট দুটা এক সঙ্গে ছিল। পিক পকেট হয়ে গেছে।

শামসুদ্দিন শান্ত গলায় বললেন, এসো ঘরে এসে বসো। আমি পানি এনে দিচ্ছি। সারা দিন কিছু খাও নি, তাই না?

জয়নাল জবাব দিল না। শামসুদ্দিন হাত ধরে তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। পানি এনে খাওয়ালেন। তারপর গায়ে হাত রেখে বললেন, তুমি তোমার পাসপোর্টটা আমার কাছে রেখে গেছ। এটা ভুলে গেলে কীভাবে?

জয়নাল এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন সে শামসুদ্দিনের কথা বুঝতে পারছে না। শামসুদ্দিন সুটকেস খুলে পাসপোর্ট বের করে জয়নালের হাতে দিলেন। জয়নাল পাতা উল্টে নিজের ছবি দেখে অজ্ঞান হয়ে চেয়ার থেকে মেঝেতে পড়ে গেল। শামসুদ্দিনের চোখে পানি এসে গেল। তিনি পরপর তিনবার বললেন–আহারে! আহারে! আহারে!

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ