কৈ মাছের তরকারিটা খেতে এত ভালো হয়েছে।

মনে হলো গত দশ বছরে তিনি এমন রান্না খান নি। ছোট ছোট আলু দিয়ে রান্না। ধনেপাতার হালকা গন্ধ। কাঁচা মরিচের ঝাল। ঝালটা জিভে লেগে থাকে, কখনো মিলায় না। টমেটোও দেয়া হয়েছে। টমেটো গলে যায় নি। আস্তু আছে। গলে গেলে কৈ মাছে টুক ভাব চলে আসত, সেটা আসে নি। কৈ মাছের সালুনকে অঙ্কের মতো ছাকা নাম্বার দিতে হবে। দশে দশ।

বাটিতে একটাই মাঝারি সাইজের কৈ মাছ। তার আরেকটা মাছ চাইতে ইচ্ছা করছে। অনেক কষ্টে ইচ্ছা দমন করছেন। রাহেলার বাড়িতে সব কিছু হিসাব করা।

রাহেলা তাঁর বোন।

আপন বোন না, খালাতো বোন। শামসুদ্দিনের বড় খালী হামিদা বানুর ছোট মেয়ে। শামসুদ্দিন বড় হয়েছেন হামিদা বানুর কাছে। এই মহিলার অনেকগুলি ছেলেমেয়ে, তারপরেও শামসুদ্দিনের জন্যে তার মমতার কোনো রকম ঘাটতি ছিল না। শামসুদ্দিন বোনের বাড়িতে আছেন চার বছর ধরে। অভাবি সংসার সামলাতে গিয়ে রাহেলা যে পুরোপুরি বিপর্যস্ত এটা তিনি চোখের সামনে দেখছেন কিন্তু কিছু করতে পারছেন না। মাসের দুই তারিখে তিনি রাহেলার হাতে পনেরশ টাকা দেন। রাহেলা হাত পেতে টাকা নিতে নিতে বলে–এ-কী! টাকা দিচ্ছ কেন? তুমি কি আমার বাড়িতে পেইং গেস্ট যে মাসের প্রথমেই খরচ দেবে? আমার দরকার হলে আমি তো চেয়ে নিবই। তোমার কাছ থেকে টাকা নিতে আমার কি কোনো অসুবিধা আছে?

শামসুদ্দিন জানেন সবই কথার কথা। তার পনেরশ টাকা রাহেলা সংসার খরচে ধরে রেখেছে। প্রতিটি টাকাই হিসাবের টাকা। শামসুদ্দিনের প্রায়ই ইচ্ছা করে পাঁচ দশ হাজার টাকা রাহেলার হাতে তুলে দিয়ে বলেন–নে, তুই ইচ্ছামতো খরচ কর। পছন্দ করে শাড়ি কিনে আন, স্যান্ডেল কিনে আন। বাচ্চাদের নিয়ে কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে খেতে যা। এতগুলি টীকা এক সঙ্গে হাতে পেয়ে রাহেলা কী করে এটা তার দেখার ইচ্ছা। কাজটা করা হয় নি। তবে ভবিষ্যতে করবেন। অবশ্যই করবেন। সব মিলিয়ে ব্যাংকে তাঁর আছে তিন লক্ষ পঁচাত্তর হাজার টাকা। আমেরিকার জন্য এক লাখ টাকা ধরা আছে। তার পরেও হাতে থাকবে দুই লাখ পঁচাত্তর।

রাহেলা এসে তাঁর সামনে বসেছে। শামসুদ্দিন তার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হকচকিয়ে গেলেন। রাহেলার মুখ থমথম করছে। রফিকের সঙ্গে বড় ধরনের কোনো ঝগড়াঝাটি নিশ্চয়ই হয়েছে। কিছুদিন পরপর ওরা ঝগড়া করছে। খুব ভুল কাজ হচ্ছে। রাহেলার সন্তান হবে। ছয় মাস চলছে। এই সময় মায়ের মেজাজ খারাপ থাকলে মায়ের পেটের সন্তানের ক্ষতি হয়।

শামসুদ্দিন বললেন, রাহেলা মন খারাপ নাকি?

রাহেলা চাপা গলায় বলল, না।

মুখ এত গম্ভীর করে রেখেছিস কেন? শরীর খারাপ লাগছে? শরীর খারাপ লাগলে রেস্ট নে। শুয়ে থাক। আমার সামনে বসতে হবে না। একা খেয়ে আমার অভ্যাস আছে।

রাহেলা সরাসরি শামসুদ্দিনের চোখের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল, ভাইজান, তুমি নাকি আমেরিকা যাচ্ছ?

শামসুদ্দিন ক্ষীণ গলায় বললেন, হুঁ।

কবে যাচ্ছ?

যাওয়ার তারিখ এখনো ঠিক হয় নি। ভিসা হয়ে গেছে। এখন ইচ্ছা করলে যে-কোনো দিন যেতে পারি। বিমানের টিকিট কাটতে হবে।

টিকিট কাটতে কত লাগবে?

ঠিক জানি না। সত্তুর আশি হাজার টাকা লাগবে।

আমেরিকায় থাকবে কোথায়?

সস্তার হোটেল মোটেল খুঁজে বের করব। আমার কিছু ছাত্র আছে। ওদের ঠিকানা নিয়ে যাব।

আমেরিকায় যাচ্ছ কেন?

এই এমনি আর কী। বেড়াতে যাচ্ছি। এই জীবনে কিছুই তো দেখলাম না। নিজের দেশের দক্ষিণের পুরোটাই সমুদ্র। সেই সমুদ্রও দেখা হলো না।

শুধু বেড়ানোর জন্যে আমেরিকা যাচ্ছ?

শামসুদ্দিন চুপ করে রইলেন। শুধু বেড়ানোর জন্যে আমেরিকা যাচ্ছেন এটা বললে মিথ্যা বলা হবে। সামান্য বিষয় নিয়ে মিথ্যা বলা ঠিক হবে না।

রাহেলা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, তুমি আমেরিকায় যাবে এই খবরটা গোপন করলে কেন?

শামসুদ্দিন ব্ৰিত গলায় বললেন, গোপন করি নি তো। গোপন করব কেন?

অবশ্যই তুমি গোপন করেছ। তুমি যে আমেরিকায় যাবার প্ল্যান করেছ সেটা কাউকে জানাও নি। পাসপোর্ট করেছ, ভিসা করেছ–তাও জানাও নি। আমি জিজ্ঞেস করে জানলাম। এখন বলো কেন আমার কাছে গোপন করলে? আমি তোমার আপন বোন না। অনেক দূরের বোন। এই জন্যে?

বলার সুযোগ হয় নি। ভিসা পাব কী পাব না তারই ঠিক ছিল না।

রাহেলার চোখে পানি এসে গেছে। সে চোখ মুছতে মুছতে বলল, তোমার কি ধারণা তুমি আমেরিকা যাচ্ছ শুনে আমি ঘ্যানঘ্যান শুরু করব–আমাকে সঙ্গে নিয়ে চল? ভুল কথা ভেবেই ভাইজান। আমি স্বামীর সংসারে ঝি-গিরি করার ভাগ্য নিয়ে এসেছি। আমি তোমার সঙ্গে প্লেনে উঠব এরকম কল্পনাও আমার নেই।

শামসুদ্দিন হতাশ গলায় বললেন, তুই শুধু শুধু আমার সঙ্গে রাগ করছিস।

রাহেলা কঠিন গলায় বলল, তুমি ভুল বলছ ভাইজান। আমি তোমার উপর রাগ করব কেন? তুমি কে? তুমি আমার কেউ না–শুধু দূরসম্পর্কের বড় ভাই। বোনের বিয়ে হবার পর আপন ভাই আর অই থাকে না, বাইরের মানুষ হয়ে যায়। তুমি অনেক দুরের ভাই। বাইরের একজন মানুষ।

আমি বাইরের মানুষ?

অবশ্যই বাইরের মানুষ। পনের শ টাকা খরচ দিয়ে খাও দাও ঘুমাও। আমার সংসার কীভাবে চলছে তুমি কিছু জানো? না, জানো না।

তুই খারাপ অবস্থায় আছিস এটা জানব না কেন? রফিকের ব্যবসাপাতি খারাপ যাচ্ছে, সবই জানি।

ভাইজান, তুমি কিছুই জানো না। তোমার জানার দরকারও নাই। বাসায় একটা রঙিন টেলিভিশন ছিল। নষ্ট হয়ে গেছে, ওয়ার্কশপে সারাতে দেয়া হয়েছে। এটা তুমি জাননা, তাই না?

হুঁ।

তুমি আসল ঘটনা জানো না। রঙিন টিভি নষ্ট হয় নাই। সারাতেও দেয়া হয় নাই। বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। আগে তো পেটে ভাত, তারপরে না রঙিন টিভি।

বলিস কী?

এতেই চমকে উঠলে! আরো ঘটনা শুনবে? আচ্ছা বেশ, শোন। বলতে যখন বসেছি সবই বলব। রাখ ঢাক করব না। তোমাকে লজ্জাও করব না। তুমি কে? তুমি কেউ না। তুমি বাইরের একজন পেয়িং গেস্ট। নিজের ভাই হলে তোমাকে লজ্জা করার কথা আসত।

শামসুদ্দিন হতাশ গলায় বললেন, রাহেলা তুই খুবই উত্তেজিত। এই সময় উত্তেজনা ভালো না। আরেকদিন সব শুনব?

রাহেলা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তোমাকে আজই শুনতে হবে। আজ বলতে না পারলে আমি আর কোনো দিনই বলতে পারব না। পৃথুর বাবার সম্পর্কে কথা।

কী কথা?

গত মাসের নয় তারিখ বিষ্যুদবার রাত তিনটার সময় আমার ঘুম ভেঙে গেছে। দেখি বিছানায় পৃথুর বাবা নাই। তার খোঁজে বিছানা থেকে নামলাম, কোথাও সে নাই। তারপর তাকে কোথায় পেলাম জানো? বুয়ার ঘরে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ।

শামসুদ্দিন হতভম্ব গলায় বললেন, সে-কী!

রাহেলা চোখ মুছতে মুছতে বলল, আমি তারপরেও এই বাসায় পড়ে আছি। কারণ আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নাই। আমার মা নাই, বাবা নাই। আমার এক খালাতো ভাই আছে। তারও কোনো মেরুদণ্ড নাই। সে থাকে আমার সাথে। তার মনে মনে ভালো ভালো চিন্তা। সে আমেরিকা যাবে। হাফপ্যান্ট পরা মেমসাহেব দেখবে। মেম সাহেবদের সাদা সাদা পা দেখে তার ফুর্তি হবে।

রাহেলা আমার কথা শোন…।

তোমার তো কোনো কথা নাই ভাইজান। তোমার কথা আমি কী শুনব? তুমি আমার কথা শুনবে। পৃথুর বাবার লজ্জা তো ভেঙে গেছে, এখন কী করে জানো? প্রায় রাতেই বুয়ার ঘরে যায়। আমাকে বলে দিয়েছে এই নিয়ে যদি কোনো কথা বলি তাহলে বাসা থেকে বের করে দিবে। বাসা থেকে বের করে দিলে আমি যাব কোথায়?

দরজায় কলিং বেল বাজছে। রফিক এসেছে। রাহেলা চোখ মুছে উঠে গেল। শামসুদ্দিন ভেবেই পেলেন না রফিকের মতো ভালো একটা ছেলে এমন জঘন্য কাজ কীভাবে করে। রাহেলা ভুল করছে না তো? মেয়েরা এমনিতেই সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত হয়। পেটে সন্তান থাকা অবস্থায় সন্দেহ রোগ অনেকগুণে বেড়ে যায়। হয়তো রফিকের রাতে পানির পিপাসা পেয়েছে। পানি খাবার জন্য সে গিয়েছে রান্না ঘরে আর তাতেই যা ভাবার না রাহেলা তাই ভেবে বসে আছে। কাইক্যা মাছকে ভেবেছে কুমির। রাহেলা যা বলছে তা হতেই পারে না। রফিক এরকম ছেলেই না। তা ছাড়া যে বয়াকে নিয়ে কথা হচ্ছে তাকে নিয়ে কোনো কিছুর ভাবারই অবকাশ নেই। কালো, ঠোঁট, মোটা, মধ্যবয়স্ক মহিলা। মুখ ভর্তি বসন্তের দাগের মতো দাগ।

রাতের খাবার শেষ করে ঘণ্টাখানিকের মধ্যেই শামসুদ্দিন শুয়ে পড়েন। রফিকের সঙ্গে তার দেখাই হয় না। সে কখনো রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটার আগে বাসায় ফিরে না। যেদিন সকাল সকাল বাড়ি ফেরে সেদিন রফিক অবশ্যই একবার শামসুদ্দিনের ঘরে আসে। বিছানায় পা তুলে বসে জমিয়ে গল্প করে। পান সিগারেট খায়। সময়টা শামসুদ্দিন সাহেবের ভালো কাটে। রফিক মাঝে মাঝে এমন সব হাসির গল্প বলে যে হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা শুরু হয়।

শামসুদ্দিন ঘড়ি দেখলেন। দশটা চল্লিশ। রফিক আজ সকাল সকাল ফিরেছে। কাজেই একবার নিশ্চয়ই তার ঘরে আসবে। যদি আসে তাহলে কি তিনি তার সঙ্গে সহজভাবে কথা বলতে পারবেন? তিনি খুবই অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। সবচে ভালো হয় তিনি যদি বাতি নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েন। রফিক নিশ্চয়ই গল্প করার জন্যে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলবে না। পরপর কয়েকদিন দেখা না হলে খুব ভালো হয়। এর মধ্যে রাহেলা তার ভুল বুঝতে পারবে। কাজের মেয়েটাকে বিদায় করার একটা ব্যবস্থাও করতে হবে।

ভাইজান জেগে আছেন?

বলতে বলতে রফিক হাসি মুখে ঢুকল। তার মুখ ভর্তি পান। মুখ থেকে জর্দার গন্ধ আসছে। হাতে দুটা সিগারেট। শামসুদ্দিনের দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিতে দিতে রফিক বলল, বিয়ে খেয়ে এসেছি। এলাহী ব্যবস্থা। বিয়ের খাওয়ার পর চা কফি আছে, পান আছে। দুটা বাচ্চা মেয়ে আবার ট্রে ভর্তি সিগারেট নিয়ে ঘুরছে। যার ইচ্ছা সিগারেট নিচ্ছে। আমার ইচ্ছা ছিল এক সঙ্গে চারপাঁচটা নেই। শেষে লজ্জা লাগল, দুটা নিলাম। ডানহিল সিগারেট। দুটাই রেখে দিয়েছি আপনার সঙ্গে খাব বলে।

শামসুদ্দিন ক্ষীণ গলায় বললেন, কার বিয়ে?

আমার এক বন্ধুর শালার বিয়ে। ট্রাকের ব্যবসা করে দুহাতে মাল কামিয়েছে। শরীর থেকে কাঁচা টাকার গন্ধ আসছে। ভাইজান, আপনি নাকি আমেরিকা যাচ্ছেন? রাহেলার কাছে শুনলাম। সত্যি নাকি?

হুঁ।

খুব ভালো। ভিসা হয়েছে?

হুঁ।

তাহলে ভাইজান আমার একটা উপদেশ শোনেন। আমেরিকার মাটি কামড়ে পড়ে থাকবেন। দেশে আসার নামও করবেন না।

তা কী করে হয়! ঐ দেশে আমি করব কী?

কিছুই করতে হবে না। মাটি কামড় দিয়ে পড়ে থাকবেন। যদি দেখেন কিছুই হচ্ছে না, না খেয়ে আছেন তাহলে কোনো এক আমেরিকান মহিলাকে সবার সামনে চড় লাগাবেন, মুখে থুথু দিয়ে দেবেন।

কেন?

এতে লাভ আছে। পুলিশ এসে আপনাকে ধরে নিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দেবে। আরামে জেলে থাকবেন। ওদের জেলখানাও আমাদের থ্রি স্টার হোটেলের মতো। এলাহি কারবার। সকালে ব্যবস্থা আছে। সপ্তাহে তিনটা মুভি দেখায়। প্রতিদিন বিকেলে খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে। খাবার খুবই ভালো।

তুমি ওদের জেলের ব্যাপার জানলে কীভাবে?

ছবিতে দেখেছি। কমনসেন্স সে-রকমই বলে। বেহেশতে যদি জেলখানা থাকে সেই জেলখানাও তো বেহেশতের মতোই হবে।

আমেরিকা বেহেশত নাকি?

অবশ্যই বেহেশত।

শামসুদ্দিন রফিকের দিকে অবাক হয়েই তাকিয়ে আছেন। কী সুন্দর রাজপুত্রের মতো চেহারা। কী সুন্দর হাসিখুশি স্বভাব। রাহেলা ভুল করছে। অভাবে স্বভাব নষ্ট যে বলে তাই হয়েছে। রাহেলার স্বভাব নষ্ট হয়ে গেছে। মন হয়েছে ছোট। যা দেখছে সবই ছোট চোখে দেখছে।

ভাইজান।

হুঁ।

আপনাকে চিন্তিত লাগছে কেন?

চিন্তিত না তো।

অবশ্যই আপনি চিন্তিত। দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করতে হবে ভাইজান। আমাদের সকল সমস্যার মূলে আছে দুশ্চিন্তা। ব্লাড প্রেসার, হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস… শুরুটা দুশ্চিন্তায়।

তোমার ব্যবসা বাণিজ্যের অবস্থা কী?

ভালো না! লাক ফেভার করছে না। এক জ্যোতিষীকে হাত দেখিয়েছিলাম; সে বলল, আরো দুই বছর এই অবস্থা যাবে। তৃতীয় বছর থেকে পালে বাতাস লাগবে। দুটা বছর পার করাই সমস্যা। আপনাকে দেখে ভাইজান হিংসা হয়–একা মানুষ, নিজেই সরকার প্রধান, নিজেই বিরোধী দলের প্রধান। যখন যা ইচ্ছা করতে পারেন। ঐ গানটা শুনেছেন। স্ত্রী হইল হাতের বেড়ি পুত্র ঘরের খিল?

না।

খুবই বাস্তব গান। আপনি গানের মর্ম বুঝবেন না, কারণ আপনার স্ত্রী পুত্রের কারবারই নাই। আমারা যারা বিবাহিত তারা এই গানের মর্ম হাড়ে হাড়ে বুঝি।

অসুখী বিবাহিত পুরুষ হয়তো বুঝে। সুখী যারা তাদের বোঝার কথা না। তাদের কাছে সংসার অতি আনন্দের ব্যাপার।

রফিক খাট থেকে নামতে নামতে বলল, সংসার কোনো আনন্দের ব্যাপার

ভাইজান। খুবই নিরানন্দের ব্যাপার। সংসার মানেই দ্বীপান্তর। যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। যাই, আপনি ঘুমিয়ে পড়েন।

শামসুদ্দীন মুবার আয়োজন করলেন। মশারির ভেতর তিনি ঘুমাতে পারেন না। বাধ্য হয়ে কিছুদিন ধরে মশারির ভেতর ঘুমাতে হচ্ছে। খুব মশার উপদ্রব। তিনি মশারি ফেলে মশারির ভেতর ঢুকে পড়লেন। বালিশের কাছে এক বোতল পানি রাখলেন। দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙলেই তার পানির পিপাশা হয়। সঙ্গে সঙ্গে পানি না খেলে মনে হয় বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। দুঃস্বপ্ন ইদানীং ঘন ঘন দেখছেন। একটাই দুঃস্বপ্ন–তিনি ট্রেন লাইন দিয়ে হাঁটছেন, পেছনে ট্রেন ছুটে আসছে। তিনি দৌড়াতে শুরু করেছেন। ট্রেন লাইন থেকে নেমে গেলে হয়। তিনি নামছেন না, লাইন বরাবর দৌড়াচ্ছেন। পেছন থেকে আসছে আন্তঃনগর ট্রেন। এই স্বপ্নটাই নানান ভাবে নানান ভঙ্গিমায় দেখছেন। কখনো তিনি একা। কখনো তার হাত ধরে থাকে বাচ্চা একটা ছেলে। কখনো বা দেখেন তিনি রেল লাইনের স্লিপারে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন।

রাত প্রায় বারোটা। তিনি এখনো জেগে আছেন। তার সামান্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে। যদি রাত একটার ভেতর ঘুম না আসে তাহলে বাকি রাত আর ঘুম হবে না। এই বয়সে অদ্রিা রোগ হয়। এটা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না, বরং একদিক দিয়ে ভালো–নানান বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করা যায়। তার চিন্তা করতে খারাপ লাগে না তবে তার সমস্যা হলে ছোট্ট ঘরটার ভেতর বসে থাকতে হয়। তার ঘরটা মৃল বাসার সঙ্গে যুক্ত না। আলাদা। মূল দরজা বন্ধ করে দিলে তাকে তার ঘরেই বসে থাকতে হয়। বারান্দাও নেই যে বারান্দায় গিয়ে দাড়াবেন। তাঁর ঘরটা যদি মূল বাড়ির অংশ হতো তাহলে অনিদ্রা রোগে কোনো সমস্যা হতো না। হাঁটাহাঁটি করতে পারতেন। চা খেতে ইচ্ছা হলে রান্নাঘরে চুপি চুপি চলে যেতেন। নিঃশব্দে চা বানিয়ে বসার ঘরের বেতের সোফায় বসে থাকতেন। তাঁর নিজের একটা ছোটখাটো টিভি থাকলে ভালো হতো। টিভিটা মশারির ভেতর নিয়ে খাটে আধশোয়া হয়ে টিভি দেখতেন। আজকাল নানান চ্যানেল হয়েছে। সারারাতই না-কি টিভি চলে।

একটা বেজে গেছে। ঘুম আর হবে না। শামসুদ্দিন খটি থেকে নামলেন। বাতি জ্বালালেন। আবার এসে মশারির ভেতর ঢুকে পড়লেন। অদ্রিার রোগী কখনো অন্ধকারে খাকতে পারে না।

কোনো একটা বিষয় নিয়ে এখন আয়োজন করে চিন্তা শুরু করা যেতে পারে। চৈতার বাপ নিয়েই চিন্তা করা যায়। আচ্ছা, আদর করে কেউ কখনো নিজের ছেলেকে চৈতার বাপ ডাকে? চৈতাটা কে? কোনো মানুষের নাম, নাকি চৈত্র মাস থেকে চৈতা? তার জন্য তো চৈত্র মাসে হয় নি। জন্ম হয়েছে আষাঢ় মাসে। তাহলে নাম চৈতার বাপ কেন? তার মন খারাপ লাগছে বাবাকে এই প্রশ্নটা করা হয় নাই।

খট করে শব্দ হলো। কে যেন সদর দরজা খুলল। খালি পায়ে এগিয়ে আসছে। কে হতে পারে? শামসুদ্দিন সাহেব কান খাড়া করলেন। তার ঘরের দরজায় কে যেন হাত রাখল। শামসুদ্দিন বললেন, কে?

রাহেলা বলল, ভাইজান আমি। দরজা খুলুন।

শামসুদ্দিন দরজা খুললেন। রাহেলা বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। শামসুদ্দিন বললেন, কী হয়েছে? রাহেলা বলল, আমার কিছু হয় নি। তোমার কী হয়েছে বলো। রাত দুটা বাজে, বাতি জ্বালিয়ে রেখেছ কেন?

ঘুম আসছে না।

বাতি জ্বালিয়ে রাখলে ঘুম আসবে কেন? বাতি নিভিয়ে শুয়ে থাকলেই না ঘুম আসবে।

রাহেলা ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, তোমার আমেরিকা যাবার তারিখ কি ঠিক হয়েছে?

না।

মনে করে তুমি ভোমার হাঁচি রোগের চিকিৎসা করে আসবে। ওদের চিকিৎসা নিশ্চয়ই ভালো।

চিকিৎসা ভালো হলেও খুবই খরচান্ত ব্যাপার। আর হাঁচি রোগ এমন না যে চিকিৎসা না হলে মারা যাব।

এক নাগাড়ে একশ হাঁচি দাও–এই রোগ খারাপ না তো কোন রোগ খারাপ? ভাগ্যিস তুমি বিয়ে কর নি।

বিয়ে করলে সমস্যা কী হতো?

বাসর রাতে একশ দেড়শ ঘঁচি দিতে। হাঁচি শুনে বউ-এর কলজে শুকিয়ে যেত।

শামসুদ্দিন কিছু বললেন না। রাহেলার গোলগাল মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বড় বড় চোখ। গোলগাল মুখ। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল। তার মুখে শিশুসুলভ সরলতা আছে। মানুষের চিন্তা চেতনা থেকে সারল্য চলে যায় কিন্তু তারা তা চেহারায় ধরে রাখে। রাহেলা তার চেহারায় ধরে রেখেছে।

ভাইজান, আমার প্রায়ই কি মনে হয় জানো? আমার মনে হয় মার কথাটা আমার শোনা উচিত ছিল। মার কথা না শুনে বিরাট ভুল করেছি।

উনার কোন কথা?

রাহেলা মাথা নিচু করে অস্পষ্ট স্বরে বলল, মারা যাবার আগে আগে মা আমাকে বলল তুই শামসুকে বিয়ে করিস। সে আলভুলা মানুষ। তোর হাতে থাকলে ঠিক থাকবে।

শামসুদ্দিন চুপ করে গেল। খুবই অস্বস্তিকর একটা প্রসঙ্গ। রাহেলা এই প্রসঙ্গ মাঝে মাঝেই তুলে।

রাহেলা বিড়বিড় করে বলল, তুমি বয়সে আমার অনেক বড়, তারপরেও আমার কোনো আপত্তি ছিল না। মা মরার সময় একটা কথা বলে গেছে আমি আপত্তি করব কেন? কিন্তু মা যে এই কথা আমাকে বলে গেছে এই কথাটাই কেউ বিশ্বাস করল না। সবাই ভাবল আমার মধ্যে কোনো সমস্যা আছে। এই জন্যেই বানিয়ে বানিয়ে এই ধরনের কথা বলেছি। আমাকে নিয়ে সবার কী হাসাহাসি!

শামসুদ্দিন বললেন, রাহেলা ঘুমুতে যা, রাত অনেক হয়েছে।

রাহেলা বলল, ভাইজান রাত জাগলে ক্ষিধে পায়। তোমার কি ক্ষিধে পেয়েছে?

না।

রাতে ভালোমতো খেতেও পার নি। আমার উল্টাপাল্টা কথা শুনে তোমার খাওয়া হয়ে গেল বন্ধ।

ঠিকমতোই খেয়েছি। কৈ মাছের ঝোল খুব ভালো হয়েছিল।

এক পিস কৈ মাছ এখনো আছে। ভাত গরম করে আনি, খাও।

আরে না! তুই পাগল না-কি! এক রাতে কয়বার খাব?

যতবার ক্ষিধে লাগবে ততবার খাবে। আমার যখন ঘুম হয় না তখন রাতে ক্ষিধে লাগে। আমি ভাত গরম করে ডিম ভেজে খেয়ে নেই।

তোরও কি অনিদ্রা রোগ আছে?

রাহেলা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, যে মানুষের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে অনিদ্রা রোগ তো হবেই। এখন আমি পৃথুর বাবাকে পাহারা দেবার জন্যে জেগে থাকি। ভান করি যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। আসলে জেগে থাকি।

এরকম করলে তো তার শরীর খারাপ করবে। এই সময়ে শরীর খারাপ করা ঠিক না।

রাহেলা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, আমি চাই শরীর খারাপ হোক। আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে না ভাইজান। অনেক দিন থেকেই করে না। কতজনের কাছে শুনি পোয়াতি অবস্থায় বাথরুমে পা পিছলে পড়েছে। এবরশন হয়ে গেছে। রক্ত যেতে যেতে মৃত্যু। আমি আমার বাথরুমটা ইচ্ছা করে পানি দিয়ে সারাক্ষণ ভিজিয়ে রাখি। পৃথুর বাবা দুদিন পা পিছলে পড়ে ব্যথা পেয়েছে। আমার এখন পর্যন্ত কিছু হয় নি।

এই ধরনের উদ্ভট চিন্তা করিস না।

বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়। বাতি জ্বালানো থাকলে কোনোদিনই ঘুম আসবে না। আমার কাছে ঘুমের ওষুধ আছে। ঘুমের ওষুধ দেব?

না।

রাহেলা শামসুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, ভাইজনি শোন, তোমাকে গোপন একটা কথা বলি–আমার কাছে সাতচল্লিশটা ঘুমের ট্যাবলেট আছে।

শামসুদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?

রাহেলা বলল, ঘুমের ওষুধ মানুষ কী জন্যে রাখে? ঘুমাবার জন্যে। আমি ঠিক করে রেখেছি আমার পেটে যে যন্ত্রণাটা আছে সেই যন্ত্রণা খালীস হবার পর আমি শান্তিমতো ঘুমাব। দুই তিনটা ট্যাবলেটে শান্তির ঘুম হবে না। ঘুম ভেঙে যাবে। ঘুম যাতে না ভাঙে সেই ব্যবস্থা নিয়ে ঘুমাব।

তোর মাথা আসলেই খারাপ হয়েছে।

মাথা খারাপ হয় নাই ভাইজান। মাথা খারাপ মানুষ ঘুম-অঘুম নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাদের কাছে ঘুমও যা জেগে থাকাও তা। সুস্থ মানুষই ঘুম-অঘুম নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে। আমি খুবই সুস্থ মানুষ। ভাইজান, বাতি নিভিয়ে ঘুমাতে যাও।

রাহেলা তার ঘরে ঢুকল। সেখানেও বাতি জ্বলছে। খাটে পা ঝুলিয়ে রফিক বসে আছে। রফিকের গা ঘেঁসে পৃথু বসে আছে। সে গম্ভীর ভঙ্গিতে পা দোলাচ্ছে। মাকে দেখে সে পা দোলানো বন্ধ করল। ভীত চোখে তাকিয়ে রইল মার দিকে। পৃথুর বয়স সাত বছর। সে মাকে খুবই ভয় পায়।

রফিক বলল, বিরাট দুর্ঘটনা ঘটেছে। পৃথু বিছানা ভিজিয়ে ফেলেছে। ভেজা বিছানায় তো আর শোয়া সম্ভব না কাজেই তাকে আমাদের বিছানায় নিয়ে এসেছি। সে আমাদের দুজনের মাঝখানে হাইফেন হয়ে শুয়ে থাকবে। কী রে বাবা, পারবি না?

পৃথু প্রবল বেগে মাথা নেড়ে জানাল যে সে পারবে। রাহেলা কঠিন গলায় বলল, গরমের মধ্যে চাপাচাপি করে তিন জন ঘুমাতে পারব না। পথু তার নিজের ঘরেই ঘুমাবে। ভেজা বিছানাতে শুয়ে থাকবে। এটা তার বিছানা ভেজাননার শাস্তি। এত বড় ছেলে হয়েছে এখনো বিছানা ভেজানো? তাকে তো কানে ধরে চাবকানো দরকার।

রফিক বলল, ইচ্ছা করে তো বিছানা ভেজায় না। রাহেলা শোন, ও একা। ঘুমুতে ভয় পাচ্ছে, আমি ওর সঙ্গে গিয়ে ঘুমাই।

রাহেলা কঠিন গলায় বলল, তুমি আমার সঙ্গে এই ঘরে থাকবে।

নো প্রবলেম। এক কাজ করলে কেমন হয় তোমরা দুজন খাটে শোঁও, আমি মেঝেতে কম্বল পেতে শুয়ে পড়ি।

রাহেলা জবাব দিল না। রফিক আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, এত রাতে ভাইজানের সঙ্গে কী নিয়ে আলাপ করছিলে?

রাহেলা বলল, ভয় নাই, কোনো ষড়যন্ত্র করছিলাম না। ভাইজান ষড়যন্ত্রের মানুষ না।

রফিক বলল, কী বলছ! ষড়যন্ত্রের কথা আসছে কেন?

যে যে-রকম, অন্যকে সে সে-রকমই ভাবে। এই জন্যেই ষড়যন্ত্রের কথা আসছে। তুমি যে আমাকে আর ভাইজানকে নিয়ে সন্দেহ কর এটাও আমি জানি।

রফিক বিস্মিত হয়ে বলল, সন্দেহ কেন করব? ছিঃ ছিঃ।

কথায় কথায় ছিঃ ছিঃ করবে না। তোমার মন যে কত ছোট সেটা আর কেউ জানলেও আমি জানি।

রফিক চুপ করে গেল। পৃথু আবার পা দোলাতে শুরু করেছে। তাকে একা একা আলাদা একটা ঘরে ঘুমুতে হবে না এই আনন্দেই সে আনন্দিত। মেঝেতে যখন বিছানা হচ্ছে তখন এই বিষয়টা নিশ্চিতই হচ্ছে। পৃথুর ইচ্ছা করছে বাবার সঙ্গে ঘুমুতে। মেঝের বিছানাটা বেশ ভালো হচ্ছে। তাছাড়া বাবার সঙ্গে ঘুমানোর আনন্দ আছে। বাবার উপর পা তুলে দিলে ৰাৰা কিছুই বলে না। মায়ের গায়ে পা তোলা যায় না। মা ধমক দিয়ে বলেন–গাদা পা সরা। গাবদা পা জিনিসটা কী পৃথু জানে না। তারপরেও সে নিশ্চিত যে তার পা গাবদা না। পৃথুর পা মোটেই গাবদা না।

রাহেলা বাথরুমে ঢুকে গেছে। কল ছেড়ে দিয়ে ক্রমাগত মুখে পানি ঢালছে। প্রায়ই তার শরীর জ্বালা করে। এই সময় মুখে পানি দিতে হয়।

কলের পানির শব্দটা পৃথুর ভালো লাগছে। বাবার সঙ্গে এখন ফিস ফিস করে কথা বললে মা শুনতে পাবে না। পৃথু চাপা গলায় ডাকল, বাবা।

রফিক ছেলের দিকে তাকিয়ে পৃথুর মতোই গলা চাপা করে বলল, কী?

আমি তোমার সঙ্গে ঘুমুব।

খুবই ভালো কথা। আমাকে ভিজিয়ে দিবি না তো?

না। বাবা, গাবদা পা মানে কী?

গাবদা পা মানে হলো গাধার পা।

আমার পা কি গাবদা?

তুই যদি গাধা হোস তাহলে তোর পা গাবদা। তোর হাত তাহলে হবে গাবহা। আর মুখ হবে গাবমু।

পৃথু শব্দ করে হেসে উঠল। বাবা এমন মজার মানুষ। বাবার মতো মানুষ। পৃথিবীতে আর তৈরি হয় নি। কোনোদিন হবেও না।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ