ফরিদা অনেক রাত পর্যন্ত তার ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। ভাইজান তাকে ফেলে চলে গিয়েছে এ জন্যে তার শুরুতে খুব মন খারাপ হয়েছিল। মন খারাপ ভাবটা অতি দ্রুত চলে গেল। তার কাছে মনে হল–আহারে বেচারা। বোনকে ফেলে চলে যেতে হচ্ছে এরচে কষ্টের আর কি আছে। এই লজ্জা বেচারাকে সারাজীবন বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। হয়তো বোনের বাসায় সে আর কোনোদিন আসবেও না। বেচারা এটা সেটা খাবার শখ। যখনই কিছু খেতে ইচ্ছা হয় বাজার করে নিয়ে আসে। এমন একটা ভাব করে যেন বাজারটা সে করেছে তার বোনের জন্যে। সপ্তায় তিনদিন সে আসবেই। এসে যে গল্প গুজব করবে তা-না। চুপচাপ বসে থাকবে। খবরের কাগজ পড়বে। দুদিন আগের খবরের কাগজ দিলেও সমস্যা নেই। গভীর মনযোগে সেটাই পড়ছে। কারোর সম্পর্কে কোনো অভিযোগ নেই। এ রকম মানুষ কয়টা হয়? নিজের জন্যে না, ফরিদার কষ্ট হতে লাগল তার ভাইজানের জন্যে।

ফরিদার পানির পিপাসা খুব বেড়েছে। নিজের বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিয়ে একবার কি সে বলবে–পানি খাব। ঘরে ঢুকব না। বারান্দায় দাঁড়িয়েই খাব।

অতি পাষণ্ডও তৃষ্ণার্ত মানুষকে পানি দেয়। জহির নিশ্চয়ই এত পাষণ্ড না। ফরিদা সাহস পাচ্ছেই না। ঘরের ভেতর তাস খেলা হচ্ছে। জহিরের বন্ধু-বান্ধব চলে এসেছে। মাঝে মাঝে হাসির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। হাসির ধরন থেকে বোঝা মাছে মদ খাওয়া হচ্ছে। মাতাল মানুষ এখন কি করে বসে তার ঠিক নেই। হয়তো বন্ধুদের সামনেই চড় বসিয়ে দিবে। চড় থাপ্পড় দেয়ার অভ্যাস এই মানুষটার আছে। রেগে গেলে তো হুঁশ থাকে না।

ফরিদার মনে হল তার উচিত রাগ পড়ার সুযোগ দেয়া। তাস টাস খেলে মনটা ভালো হোক। রাতে আরাম করে ঘুমাক। সকালবেলা ঘরে ঢোকার আনেকটা চেষ্টা করা যাবে। শুরুতে ফরিদার মনে হচ্ছিল রাত কাটানোটা খুব সমস্যা হবে। তার মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি এসেছে। ছাদে গিয়ে বসে থাকলেই হয়। এত রাতে কারোরই ছাদে আসার সম্ভাবনা নেই। তারপরেও কেউ যদি আসে সে বলবে–খুব গরম পড়ছে, ঘরে ঘুম আসছে না। তাই ছাদে হাঁটছি।

তবে রাতে বৃষ্টি নামতে পারে। বৃষ্টি নামলেও সমস্যা নেই, ছাদের সিঁড়ি ঘরে সে থাকবে। ফরিদা ছাদে উঠে গেল। ফ্ল্যাট বাড়ির ছাদ সুন্দর থাকে না। কাপড় শুকানোর জন্যে একেক ফ্ল্যাটের মালিক একেক জায়গায় দড়ি টানায়। ছাদটা হয়ে থাকে জালের মতো। ছাদে উঠে ফরিদার ভালো লাগল। একটু করে এগুচ্ছে একটা দড়ি হাত দিয়ে ছুঁচ্ছে। এক ধরনের খেলা। ছাদের রেলিং ধরে সে নিচে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা ঘুরে উঠল। কি ভয়ঙ্কর। তার হাইট ফোবিয়া আছে। দোতলার বারান্দা থেকে সে নিচে তাকাতে পারে না আর এখন সে দাঁড়িয়ে আছে–পাঁচ তলা বাড়ির ছাদে।

এত উঁচু থেকে নিচে তাকানোর মলে আরো একটা ঘটনা ঘটল–ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে তার ভালো লাগাটা বাড়ল। সে এখন যে কোনো সময় ছাদ থেকে লাফ দিতে পারে। এই জীবনের সমস্ত সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে সমাধান। কারোর যদি বড় ধরনের কোনো অসুখ হয় এবং সেই অসুখের ওষুধ হাতে থাকে তাহলে তৃপ্তির যে ভাবটা হয় ফরিদার তাই হচ্ছে। তার জীবনে অনেক সমস্যা, সেই সমস্যার সমাধান এখন তার হাতে আছে। সমাধান হাতে নিয়ে সে ঘুরছে। বাহ কি আনন্দ! রাত ভোর হওয়া পর্যন্ত সময় আছে। যা করার সে ভোর রাতে করবে। ভোর না হওয়া পর্যন্ত সে ছাদে হাঁটাহাটি করবে।

যদি ছাদ থেকে লাফ দেয়ার সিদ্ধান্তু শেষ পর্যন্ত সে নিয়ে ফেলে তাহলে অবশ্যই কয়েকটা চিঠি লিখে যেতে হবে। চিঠিগুলি পলিথিন মুড়ে সঙ্গে রাখতে হবে। ছাদ থেকে লাফ দেয়ার ফলে শরীর থেতলে রক্ত বের হবে। চিঠিগুলি পলিথিনে মোড়া না থাকলে রক্ত মেখে মাখামাখি হবে। কেউ পড়তেই পারবে না। সে একটা চিঠি লিখবে বাবুকে, একটা লিখবে চিত্রাকে এবং সব শেষ চিঠিটা জহিরকে।

বাবুর চিঠিটা সবচে ছোট। সেখানে লেখা থাকবে–

বাবু টিনটিন
বাবু রিনঝিন
যায়রে
বাবু ফিরে ফিরে চায়রে।

এই ছড়াটা ফরিদার নিজের বানানো। বাবু যখন ছোট ছিল তখন ফরিদা বানিয়েছে। ছোটবেলায় এই ছড়া বলে বাবুর গায়ে কাতুকুতু দিলে সে খুব হাসত। এখন বাবু বড় হয়েছে গম্ভীর ভঙ্গিতে স্কুলে যায়, তারপরেও এই ছড়াটা ফরিদা যখনই বলে বাবু শত গাম্ভীর্যের মধ্যেও ফিক করে হেসে ফেলে। বাবু নিশ্চয়ই তার মার লিখে যাওয়া শেষ ছড়াটা যত্ন করে রেখে দেবে। সে যখন বড় হয়ে চাকরি বাকরি করবে তখন দামি একটা ফ্রেমে ছড়াটা সাজিয়ে দেয়ালে টানিয়ে রাখবে। তার একদিন বিয়ে হবে, বউ আসবে সংসারে। নতুন বৌ আগ্রহ নিয়ে বলবে এটা কি টানিয়ে রেখেছ? ছড়া না? ছড়া বাঁধিয়ে রেখেছ কেন? বাবু গম্ভীর গলায় বলবে— তুমি বুঝবে না। খবর্দার ওখানে হাত দেবে না। মার কথা সে নিশ্চয়ই প্রথম দিনেই নতুন বউকে বলবে না। আমার মা পাঁচতলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে গিয়েছিলেন এই কথা নতুন বউয়ের সঙ্গে প্রথম দিনেই আলাপ করা যায় না।

দ্বিতীয় টিঠিটা সে লিখবে চিলাকে। চিত্রা মেয়েটা তার খুব পছন্দের। চিত্রা এই পছন্দের ব্যাপারটা জানে না। পছন্দের ব্যাপার গোপন থাকাই ভালো। সে চিত্রাকে লিখবে–

মা চিত্রা, আজ তোর এনগেজমেন্ট। কি শুভ একটা দিন। এই শুভদিনে অশুভ সংবাদ আসা ঠিক না। কিন্তু মা, কি করব বল— আমার কোনো উপায় ছিল না। এনগেজমেন্ট উপলক্ষে তোর জন্যে একটা শাড়ি কিনেছিলাম। শাড়িটা তোদের বাসায় রেখে এসেছি। কোনো এক সময় পরবি। কেমন মা? তোর বিয়েতে উপহার দেবার জন্যে কানের দুল কিনেছি। সেটা রাখা আছে আমার শোবার ঘরের ড্রেসিং টেবিলের সবচে নিচের ড্রয়ারে। ড্রয়ারে তালা দেয়া। তালা চাবিটা আমার বিছানার তোষকের নিচে। তোষক অল্প একটু তুললে কিন্ত পাবি না। অনেকটা তুলতে হবে। ভেতরে দিকে রেখেছি।

মারে মাছের তেলে মাছ ভাজা বলে যে ব্যাপারটা আছে, তোর উপহার কেনার মধ্যে এই ব্যাপারটা আছে। অনেক আগে তোর মার একটা গয়না আমি চুরি করেছিলাম। এটা বিক্রি করেই তোর শাড়ি, কানের দুল কেনা হয়েছে। তোর একটা মাত্র ফুপু সে আবার মিসেস চুরনি। তোর নিশ্চয়ই খুব খারাপ লাগছে। মারে অভাবে পড়ে আমার এই বিশ্রী অভ্যাস হয়েছে। সোনার দোকানে নিজের গয়না বিক্রি করতে যেতাম। সেখানেই অন্য গয়না দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা সরিয়ে ফেলতাম। অভাব খুব খারাপ জিনিস মা।

তুই তোর বাবার দিকে একটু লক্ষ্য রাখিস। আমার ধারণা আমি না বললেও তুই রাখবি। বিয়ের আগে মেয়েরা লক্ষ্য রাখে তার মার দিকে। বাবার দিকে চোখ পড়ে না। বিয়ের পর সে যখন একজন পুরুষের সঙ্গে বাস করতে যায় তখন তার বাবার কথা মনে পড়ে। চিত্রা মা যতই দিন যাচ্ছে তোর বাবা কেমন যেন আউলা ঝাউলা হয়ে যাচ্ছে। এমনভাবে সে তাকায় যেন তার কিছুই নেই। তুই অবশ্যই মাঝে মাঝে আদর করে তাকে দুএকটা কথা বললি। এটা সেটা রান্না করে খাওয়াবি। এতেই দেখবি মানুষটা কত খুশি হবে। কিছু কিছু মানুষ আছে অল্পতে খুশি হয় কোনো কিছু না পেয়েই খুশি হয়। তোর বাবা সে রকম একজন মানুষ। মানুষটা ডুবে যাচ্ছে। তুই অবশ্য তাকে টেনে তুলবি।

শেষ চিঠিটা লিখতে হবে জহিরকে। এইখানে ফরিদা একটা কায়দা করবে। আমার মৃত্যুর জন্যে তুমি দায়ী এইসব কিছুই লিখবে না। উল্টো ভালো ভালো কথা, মিষ্টি মিষ্টি কথা লিখবে। যাতে চিঠি পড়ে সে একটা ধাক্কার মতো খায়। অন্তত একবার হলেও নিজের মন থেকে বলে–আহারে! মন থেকে কেউ আহারে বললে–সেই আহারে মনের ভেতর ঢুকে যায়। কিছু দিন পর পর সেই আহারে মনের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে–ফিসফিস করে বলে–আহারে। আহারে! আহারে!

জহিরকে সে লিখবে–

তুমি নিশ্চয়ই আমার ওপর খুব রাগ করছ। আমার মাথাটা ঠিক নেই তো এই জন্যে বোকার মতো এই কাজটা করলাম। তোমাকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে এই কষ্টটা আমি নিতে পারছি না। এ জীবনে আমি যে কটি ভালো মানুষ দেখেছি তুমি তাদের মধ্যে একজন। অনেক পূণ্য বলে আমি তোমার মতো স্বামী পেয়েছি। কিন্তু সম্পূর্ণই আমার নিজের দোষে তোমার সঙ্গে থাকতে পারছি না। এই কষ্ট কোথায় রাখি? তুমি ভালো থেকো। শরীরের যত্ন নিও। বাবুকে দেখো। দেখে শুনে দুঃখী দুঃখী টাইপ একটা মেয়েকে বিয়ে করো। যাতে সে বাবুকে ভালোবাসে। যাই কেমন?

ইতি
তোমার অতি আদরের ফরিদা

 

ফরিদা নিয়ে মনে কিছুক্ষণ হাসল। এই চিঠি পড়ে জহিরের মুখের ভাব কি হবে ভেবেই মজা লাগছে। এখন চিঠিগুলি লিখে ফেলতে হবে। অন্ধকারে চিঠি লেখা যায় না। চিলেকোঠার ঘরে বাতি জ্বলছে, কাজেই আলোর সমস্যা নেই। চিঠি লেখার জন্যে বল পয়েন্ট তার হ্যান্ড ব্যাগেই আছে। বাজারের ফর্দ লেখার জন্যে একটা ছোট্ট প্যাডও আছে। প্যাডটা সে কিনেছে ধানমন্ডির হলমার্কের দোকান থেকে। প্যাডের কভারে মীন রাশির ছবি। ফরিদার মীন রাশি বলেই সে এই প্যাড কিনেছিল। প্যাডটা এত সুন্দর যে কিছু লেখা হয় নি। মনে হয়েছে কিছু লেখা মানেই প্যাডটা নোংরা করা। চিঠি লেখার সব কিছুই তার কাছে আছে। শুধু পলিথিন নেই। তার প্রয়োজনও নেই। চিঠিগুলি হ্যান্ড ব্যাগে রেখে ব্যাগের মুখ শক্ত করে বন্ধ করে দিলেই হবে। তাহলেই আর ব্যাগের ভেতর রক্ত ঢুকবে না।

ফরিদার তৃষ্ণা খুব বেড়েছে। বুক ভর্তি তৃষ্ণা নিয়ে ছাদ থেকে লাফ দেয়ার কোনো অর্থ হয় না। ঝাঁপ দেবার আগে দু গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেয়ে নেয়া দরকার। আরেকবার তার নিজের ফ্ল্যাটে গেলে কেমন হয়? জহিরকে সে বললে দু গ্লাস পানি দিতে।

ফরিদা তার ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্ল্যাটের বাতি জ্বলছে না, হৈচৈও শোনা যাচ্ছে না। খেলা বন্ধ করে লোকজন চলে গেছে। জহির হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। কলিং বেল টিপে তার ঘুম ভাঙানো ঠিক হবে কি না ফরিদা বুঝতে পারছে না। কাঁচা ঘুম ভাঙলে জহির খুব রেগে যায়। উল্টাটাও হতে পারে— হঠাৎ ঘুম ভাঙলে মানুষ ঘোরের মধ্যে থাকে। আগের কোনো কিছুই মনে থাকে না। এই অবস্থায় দরজা খুলে জহির তাকে দেখে হয়তো কিছুই বলবে না। যদি স্বাভাবিকভাবে ঘরে ঢুকতে পারবে। ঘরে ঢুকে সে যা করবে তা হচ্ছে পানি গরম করতে দেবে। গরম পানি দিয়ে আরাম করে গোসল। গোসলের পর এক কাপ গরম চা। তারপর বিছানায় শুয়ে পড়া। এর মধ্যে যদি জহিরের ঘুম পুরোপুরি ভেঙে যায় এবং সে যদি বিশেষ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায় তাহলে জহিরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুতে যাবে। শরীরের ভালোবাসা তুচ্ছ করার বিষয় না। শরীর বেশির ভাগ সময় মনের সমস্যা ভুলিয়ে দেয়।

ফরিদা কলিং বেল টিপল। সে ঠিক করে রেখেছিল পর পর পাঁচবার কলিং বেল টিপবে। এই পাঁচবারে যদি দরজা না খুলে তাহলে সে ছাদে চলে যাবে। চারবারের বার দরজা খুলে গেল। জহির তার দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলল, চাস কি?

ফরিদা বলল, কিছু চাই না।

জহির চাপা গলায় বলল, চলে যেতে বলেছি— চলে যা।

কোথায় যাব?

যেখানে ইচ্ছা যা। কোনো পার্কে চলে যা। ব্যবসা কর। রিকশাওয়ালা ঠেলাওয়ালারা আছে এর পাঁচ টাকা দশ টাকা করে দিবে।

তুমি এইসব কি বলছ?

যা বলছি ঠিকই বলছি।

মদ খেয়ে তোমার মাথা ঠিক নেই। তুমি কি বলছ নিজেই জান না।

জহির শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিল। ফরিদার তেমন কষ্ট হল না। অদ্ভুত কারণে তার পানির তৃষ্ণাটা চলে গেছে। সে আবার ছাদে উঠে গেল। আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। হাতে সময় বেশি নেই। চিঠিগুলি লিখে ফেলা দরকার।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ