আজ নিয়ে আঠারো দিন পার হলো মনজু মায়া লজের এক তলায় বাস করছে। আঠারো দিনে তার কোনো ডিউটি পড়ে নি। ছোট সাহেব বাড়ি থেকে বের হন নি। সেও আটকা পড়ে আছে। তার কোথাও যাবার কোনো উপায় নেই। কখন ডাক পড়ে! মায়া লজের সামনের রাস্তার পাশে চায়ের দোকান পর্যন্ত সে যেতে পারে। ডিউটির ডাক পড়লে দারোয়ান এসে ডেকে নিয়ে যাবে। চায়ের দোকানে তো। সারাদিন বসে থাকা যায় না।

গত আঠারো দিনে তিনবার তার মনে হয়েছে– ধুত্ত্বরি! চাকরিতে পিসাব করি। আমি চললাম। যেটা মনে হয় সেটা করা কখনোই সম্ভব হয় না। চাকরিটা তার খুবই দরকার। যদিও সে সবাইকে বলে বেড়ায় বাবা-মা কেউ নেই, সেটা ঠিক না। বাবা মারা গেছেন ঠিকই। মা আছেন এবং মার ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতন আছে। সৎবাবা। সৎবাবার কোনো কাজ-কর্ম নাই। তবে নানাবিধ কু-নেশা আছে। তাকে নিয়মিত গাজা খেতে হয়। গাজা খেলে শরীর ঠিক রাখার জন্যে দুধ খেতে হয়। বলকারক খাওয়া-দাওয়াও খেতে হয়। মনজুর মা রহিমা বেগম এইসব বলকারক খাওয়া এবং নেশার জোগান দেয়ার জন্যে অতি ব্যস্ত থাকেন। নিম্নশ্রেণীর এই মানুষটির প্রতি তার মার সীমাহীন মমতার (কিংবা প্ৰেম) কোনো কারণ মনজু জানে না।

মনজুর দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। সবচে ভালো বিয়ে যার হয়েছে, তার স্বামী ইতালিতে জুতার দোকানে কাজ করত। যখন সব ঠিকঠাক সে তার স্ত্রী এবং দুই পুত্রকে ইতালিতে নিয়ে যাবে, তখনই খবর পাওয়া গেল বাবাজি জনৈকা স্প্যানিশ কন্যা বিয়ে করে ফেলেছে।

মনজুর সেই বোন এখন দুই বাচ্চা নিয়ে তার মার কাছে উঠে এসেছে। মনজুর সৎবাবা ইসমাইল সর্দার প্রথম কিছু দিন খুব লাফালাফি ঝাপঝাঁপি করেছেন— তালাক না দিয়ে দ্বিতীয় বিবাহ? আমারে তুমি চিন না? তোমারে আমি ইতালির কুত্তার গু চেটে খাওয়াব। এম্বেসির মাধ্যমে যখন মামলা শুরু হবে, তখন পাতলা পায়খানা করতে করতে তোমার জীবন যাবে। স্ত্রীর পায়ে তো ধরবোই, দুই শিশুপুত্রের পায়ে ধরেও মাফ চাইতে হবে। ইসমাইল সর্দারের ঝাপঝাপি লাফালাফি দুই-তিনের মধ্যেই স্তিমিত হয়ে পড়ল। তার সময় কাটতে লাগল স্বামী-পরিত্যক্ত অনজুর দুই যমজ পুত্রের সঙ্গে চিৎকার চেঁচামেচি করে। এদের সর্বশেষ খবর মনজু তার মার চিঠিতে পেয়েছে। মা লিখেছেন—

মনজু
দোয়াগো।
বাপজান, পর সংবাদ তোমার চাকরিপ্রাপ্তির সংবাদ শুনিয়া অত্যন্ত খুশি হইয়াছি। আল্লাহপাকের দরবারে লাখো শুকরিয়া। তুমি যে ভালো চাকরি পাইবে, ইহা তোমার সৎবাবা আগেই খোয়াবে পাইয়াছেন। তিনি শেষরাত্রে স্বপ্নে দেখেছিলেন তুমি অতি বৃহৎ একটি কাতল মাছ হাতে নিয়া বাড়ি ফিরিতেছ। তোমার সৎবাবা মানুষটা গাঁজা-ভাঙ যাই খাক, তাহার ভিতরে কিছু পীরাতি আছে। সাক্ষাতে তোমার সৎবাবার পীরীতির কিছু টুকটাক কথা তোমাকে বলিব। তুমি বিস্মিত হইবে।

এখন ঘরের সংবাদ শোন। সংসারের অবস্থা বেহাল। বলা চলে প্রায় উপবাসের সম্মুখীন হইয়াছি। বর্গাদাররা ধানচাল কিছুই ঠিকমতো দিতেছে না। বাড়ির যে এক অংশ জনৈক এনজিও কমীকে ভাড়া দিয়াছি, সেও নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করিতেছে না। প্রতিমাসেই নানান টালবাহানা করে। অন্যজু তার দুই পুত্র নিয়া উপস্থিত হওয়াতে আরো ঝামেলায় পড়িয়াছি। অনঙ্গুর স্বামী ইতালি হইতে তাহার স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়া কাগজপত্র পাঠাইয়াছে। সব কাগজপত্ৰ আমি লুকাইয়া রাখিয়াছি। অন্যজু এখনো আশায় আশায় আছে যে ডিভোর্স হয় নাই। যদি জানে ডিভোর্সের কাগজ চলিয়া আসিয়াছে, তাহা হইলে সে কী করিবে তার নাই ঠিক। গলায় ফাস দেয়া বা বিষ খাওয়া বিচিত্র কিছু না।

তোমার সৎবাবা অনজুর পুত্র দুইটির খোরপোষ আদায়ের জন্যে মামলা করিতে চান। এই বিষয়ে তিনি অনজুর শ্বশুরের সঙ্গেও পরামর্শ করিতে চান। তুমি তো জানো, এইসব বিষয়ে তোমার সৎবাবার চিকন বুদ্ধি। তিনি অবশ্যই খোরপোষের ব্যবস্থা করিতে পরিবেন, তবে তার জন্যও টাকার প্রয়োজন। তুমি অতি শীঘ্রই ব্যবস্থা কর।

উনার শরীরও ভালো যাইতেছে না। এই বয়সে বিছানায় পড়িয়া গেলে আর উঠিতে পারিবে না। আমি কবিরাজের পরামর্শে তার জন্যে ছাগ-দুগ্ধের ব্যবস্থা করিয়াছি। হাত একেবারেই খালি। সমস্ত ব্যবস্থাই ধার-দেনা করিয়া করিতে হইতেছে। তুমি অতি শীঘ্রই ব্যবস্থা কর।

এদিকে অনজুর দুই ছেলে বড় উৎপাত করিতেছে। আমি আমার জীবনে এরকম গুণ্ডাপ্রকৃতির শিশু দেখি নাই। ঘটনা কী হইয়াছে শোন। তোমার সৎবাবার শরীরটা ভালো যাইতেছে না। আগেই বলিয়াছি। গত সোমবার দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর তিনি ঘুমাইতেছিলেন। তখনই এই দুই গুণ্ডা ঘুমের মধ্যেই তাহাকে কামড়াইয়া ধরে। একজন ঘাড়ে কামড় দেয়। অন্যজন ডান পায়ের হাঁটুতে। রক্তারক্তি কাণ্ড। আমি এবং অন্যজু আমরা দুইজনে মিলিয়া এই দুই বজ্জাতকে ছুটাইতে পারি না এমন অবস্থা। উনাকে এটিএস ইনজেকশন দেওয়া হইয়াছে। আমি দুই বজ্জাতকে কিঞ্চিৎ শাসন করিয়াছি বলিয়া অনজু আমার সহিত বাক্যালাপ বন্ধ করিয়া দিয়াছে। আমার হইয়াছে উভয়সংকট।

যাই হোক বাবা, সংসারের এইসব টুকিটাকি নিয়া তুমি উদ্বিগ্ন থাকিও না। মন লােগাইয়া কাজ করা যেন মালিক সন্তুষ্ট থাকেন।

নিশ্চয়ই এক তারিখে তোমার বেতন হইবে। বেতন হওয়া মাত্র তোমার পক্ষে যতটা পাঠানো সম্ভব ততটা পাঠাইবে। সংসারের অবস্থা ভয়াবহ। সব কথা খুলিয়া বলা যাইতেছে না। এই বিষয়ে আরেকটি জরুরি কথা বলি। পোস্ট অফিসে ইদানীং টাকা মারা যাইতেছে। মনিঅৰ্ডার ঠিকমতো পৌঁছিতেছে না। তোমার সৎবাবা একটি ভালো বুদ্ধি দিয়াছেন। উনি বলিয়াছেন প্রতি মাসের এক তারিখে ঢাকা গিয়া তোমার নিকট হইতে টাকা নিয়া আসিবেন। তাহার আসা-যাওয়াতে কিছু বাড়তি খরচ হইলেও টাকা মার যাইবে না। এসব বিষয়ে উনার বুদ্ধি অতি পরিষ্কার। তুমি কী বলো? উনার নিজের জন্যেও ঘোরাঘুরির কিছু প্রয়োজন আছে। একটা মানুষ তো আর দিনরাত ঘরে বসিয়া থাকিতে পারে না। বেচারার এমিতেও ভ্রমণের শখ। বয়সকালে দার্জিলিং বোম্বাই এইসব জায়গায় বেড়াইয়াছে। এখন টাকাপয়সার অভাবে গৃহবন্দি।

কাগজ শেষ হইয়া গিয়াছে বলিয়া আর কিছু লিখিতে পারিতেছি না। সংসারের এমন হাল যে চিঠি লেখার কাগজ পর্যন্ত নাই। সবই আল্লাহপাকের পরীক্ষা। উনি দুঃসময় দেন, আবার উনিই সুসময় দেন। বাবাগো, আল্লাহপাককে সর্বদা স্মরণ রাখিও। শুক্রবারের জুম্মার নামাজ যেন কখনো মিস না হয়। তোমার সৎবাবাকেও দেখি অন্য নামাজ পড়তে পারেন বা না পারেন। জুম্মার নামাজ মিস হয় না।

ইতি
তোমার মা রহিমা বেগম

মার চিঠি মনজু কখনো দ্বিতীয়বার পড়ে না। দ্বিতীয়বার পড়ার মতো কোনো বস্তু চিঠিতে থাকে না। তার সব চিঠি একরকম— অভাবের ঘ্যানঘ্যাননি, প্যানপ্যাননি। মাঝে মাঝে তরকারিতে লবণের মতো ইসমাইল সর্দারের চিকন বুদ্ধির প্রশংসা। মনজু অবশ্যি মায়ের এবারকার চিঠি পাঁচবার পড়ল। ইসমাইল সর্দার কামড় খেয়ে কুপোকাৎ— এই অংশটা পড়ার জন্যেই পাঁচবার পড়া। বাচ্চা দুটার জন্যে অবশ্যই ভালো কোনো উপহার কিনে পাঠাতে হবে। দাঁতের জন্যে আলাদা ভিটামিন। এদের নামও বদলে দিতে হবে। একজনের নাম হবে টুং, আরেকজনের নাম টাং।

মায়ের চিঠির জবাব এখনো লেখা হয় নি। একেক সময় একেক জবাব মাথায় আসছে। যত সময় যাচ্ছে চিঠির জবাবের ভাষা পাল্টে যাচ্ছে। ভাষা নরম হয়ে আসছে। চিঠি পড়ার পর পর যে জবাবটা মাথায় এসেছিল সেটা এক লাইনের জবাব এবং ইংরেজিতে—

Everybody go to hell.

পরদিন মাথায় জবাবটা এলো বাংলায়। ভাষা এত কঠিন না। তবে নরমও না। মাঝামাঝি।

মা শোন, তোমার ইসমাইল সর্দারের প্যানপ্যাননি বন্ধ করবে? অবশ্যই তুমি তাকে আমার কাছে পাঠাবে না। চিকন বুদ্ধির লোক আমার পছন্দ না। তার চিকন বুদ্ধি তোমার জন্য তোলা থাকুক। আমার দুই ভাগ্নেকে আদর ও দোয়া দিবে। তারা উত্তমকর্ম করেছে। এবং শরীর ভালো কয়ারর জন্যে তাদেরকে এই পরামর্শ দিবে। এবং শরীর ভালো করার জন্যে তাদেরকেও ছাগ-দুগ্ধ খাওয়াবে। আরেকটা কথা, আমি কোনো টাকা-পয়সা পাঠাতে পারব না। আমার চাকরির কোনো ঠিক নেই। যে-কোনো মুহুর্তে চাকরি চলে যাবে। আর যদি নাও যায়, আমি নিজেই ছেড়ে দেব।

চাকরি ছেড়ে দিব কারণ এই চাকরি আমি করতে পারছি না। আমার কাজ কী জানো? আমার কাজ- চব্বিশ ঘণ্টা ঘরে বসে থাকা। যদি ডিউটিতে ডাক পড়ে তাহলে ডিউটিতে যাব। ডিউটির ডাকের জন্যে অপেক্ষা— কী যে কষ্টের ব্যাপার তুমি বুঝবে না। যাদের যাবজীবন হয়েছে, আমার মনে হয় তারাও আমার চেয়ে সুখী…।

এই চিঠিও শেষপর্যন্ত লেখা হয় নি এবং পাঠানো হয় নি। মনজুর আসলে কোনো কিছুতেই মন বসছে না। দিন কাটছে না। প্রতিদিন একই রুটিন— সকালে নাস্তা (নাস্তাও এক রকম, খিচুড়ি ডিম ভাজি), নাস্তার পর ঘরের সামনে সকাল এগারোটা পর্যন্ত বসে থাকা।

এগারোটার পর শুরু হয় ড্রাইভারদের ক্যারাম খেলা। ঘণ্টা দুই ক্যারাম খেলা দেখা। সবচে ভালো খেলে চশমা পরা দারোয়ান। সে আবার সিঙ্গেল খেলে না। বাজি ছাড়াও খেলে না। দশ টাকা বাজি রেখে তার সাথে খেলতে হয়। দুপুরের খাওয়ার পর ঘুম। ঘুম থেকে উঠে বাড়ির সামনের চায়ের দোকানে ঘণ্টা দুএক বসে থাকা। রাত দশটা থেকে শুরু হয় ড্রাইভারদের তাস খেলা। খেলার নাম কাচু। ঘণ্টা দুই খেলা দেখে ঘুমাতে যাওয়া।

বাড়ির কেয়ারটেকার রহমতুল্লাহ সাহেবের ঘরে টেলিভিশন আছে। কোনো কোনো রাতে নাটক থাকলে নাটক দেখা। এক জোড়া নায়ক-নায়িকা প্ৰেম করে। কেন করে তারা জানে না। তাদের মধ্যে মিলন হয়। কেন হয় কে জানে! আবার মাঝে মাঝে বিরহ হয়। কী জন্যে হয় তাও বোঝা যায় না।

রহমতুল্লাহ সাহেবের ঘরে টিভি দেখতে যাওয়াও শাস্তির মতো। তিনি সারাক্ষণ শরীর চুলকান এবং কথা বলেন। তার কথাও টিভির নাটকের মতো। কেন বলেন, কী জন্যে বলেন, তিনি জানেন না। তার কমন ডায়ালগ হচ্ছে— মন দিয়ে কাজ কর। কাজে দিবে মন মিলিবে ধন। বাঙালির কোনো আয়-উন্নতি নাই কারণ তাদের কাজে মন নাই। তাদের মন কোথায়? তাদের মন অজুহাতে। কাজ না করার অজুহাত। বাঙালির তিন হাত। ডানহাত, বামহাত আর অজুহাত। তিনটা হাতের মধ্যে সে ডানহাত-বামহাত কোনোটাই ব্যবহার করে না। ব্যবহার করে শুধু অজুহাতটা।

বুড়ো যখন বকবক করতে থাকে, তখন মনজু এমন ভাব করে যেন সে বুড়োর প্রতিটা কথা গিলে খাচ্ছে। আসলে সে তখন মনে মনে বলে, এই বুড়া, চুপ করবি? চুপ না করলে টান দিয়ে তোর জিব ছিড়ে ফেলব। তুই যখন কথা বলিস, তখন তোর মুখ দিয়ে থুথু বের হয় এটা জানিস? তোর থুথু খাওয়ার জন্যে বসেছি?

রহমতুল্লাহ আবার হঠাৎ হঠাৎ কোথেকে মদ খেয়ে আসে। এই সময় তার।্যবহার হয় অতি মধুর। হাসি ছাড়া মুখে কথা নেই। কথা বলবে গায়ে হাত দিয়ে। মাতালের নেশা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে— এই বুড়োর উল্টো নিয়ম। রাত যতই গভীর হয়, তার নেশা ততই বাড়ে। এক পর্যায়ে শুরু হয় কেচ্ছা কাহিনী। সব কেচ্ছা কাহিনীই মায়া লজ কেন্দ্ৰিক।

এই যে মনজুমিয়া, এই বাড়িতে ভূত আছে জানো? ভূত ঠিক না, পেত্নী। অনেকেই দেখেছে। আমি নিজে দেখেছি দুইবার। প্রথমবার দেখি চৈত্র মাসে। হয়েছে কী, সেবার গরম পড়েছে বেজায়। ফ্যানের বাতাসে কোনো কাজ হয় না। উল্টা শরীর জ্বালাপোড়া করে। রােত তখন দুটা-আড়াইটা বাজে। আমি ভাবলাম বাগানে গিয়া বসি। শরীরটা ঠাণ্ডা করে আসি। রওনা হয়েছি বাগানের দিকে, কিছুদূর যাবার পরে দেখি, দোলনায় একটা মেয়েছেলে আপন মনে দোল খাচ্ছে। আমি থমকে দাঁড়ালাম। প্রথমে মনে হলো ছোট সাহেবের মা। উনি এত রাতে দোলনায় বসে আছেন কেন— এটা বুঝলাম না। বাগানে উনার আসার কথা না। উনি কুত্তা ভয় পান। তাহলে কি কাজের মেয়েদের কেউ? কাজের মেয়েদের এত সাহস হবার কথা না। আমি ধান্ধায় পড়ে গেলাম। তখন দেখি, দোলনায় বসা মেয়ে হাত ইশারায় আমাকে ডাকল। আমি আগায়ে গিয়েছি। রাত দুটার সময় দোলনায় বসে থাকে, হাত ইশারায় আমাকে ডাকে, মেয়েটা কে আমার দেখা দরকার। আমার সন্দেহ হলো, ড্রাইভার-দারোয়ান এদের কেউ বাজারের মেয়ে ভিতরে পাচার করেছে কি-না। আগে একবার এইরকম ঘটনা ঘটেছিল, তাতে তিনজনের চাকরি চলে যায়। তবে দোলনায় বসা মেয়েটাকে বাজারের মেয়ের মতো মনে হচ্ছে না। মাথায় ঘোমটা দিয়ে শাড়ি পরেছে। নিজেকে ঢেকে-ঢুকে খুবই ভদ্রভাবে বসেছে। চুল খোঁপা করা। বাজারের মেয়েরা চুল খোঁপা করে না। ছেড়ে রাখে।

আমি আরো কয়েক কদম আগায়েছি। হাসির শব্দ শুনলাম। মানুষের হাসি না। জন্তু-জানোয়ারের হাসি। ভকভক শব্দ। মেয়েটা হাসছে নাকি? এটা কী রকম হাসি? আমি বললাম, তুমি কে? বলে তাকিয়েছি, দেখি মেয়েটা ঠিকই দোলনায় বসে আছে, তবে তার গায়ে একটা সুতা নাই। ঘটনা এইখানে শেষ না। মেয়েটা তখন কথা বলা শুরু করল। মিষ্টি গলার স্বর। আমাকে বলল, গরম বেশি বলে কাপড়-চোপড় খুলে ফেললাম। তুই মনে কিছু নিস না। তুই আমার ছেলের মতো। ছেলের সামনে মায়ের আবার লজ্জা কী? আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। আমার জ্ঞান ফিরল পরদিন সকালে।… আমার কথা তোমার বিশ্বাস হয় না? যদি আমি একটা শব্দ মিথ্যা বলি, তাহলে আমি সতী মায়ের গর্ভের সন্তান না। আমি জারজ, আমার পিতা জারজ। এখন বিশ্বাস হয়?

নতুন চাকরি করতে এসেছি। মনে অনেক রঙ ঢঙে। শোন মজনু মিয়া, এই বাড়ি কোনো সহজ বাড়ি না। এই বাড়ি জটিল বাড়ি। এই বাড়ির হিসােব জটিল হিসাব। তুমি ভাবতেছ। আমি এক মাতাল লোক। মাতালের কথার হিসাব নাই। ভুল ভাবতেছ। বেহিসেবি কথা কয় সুস্থ মানুষ। মাতাল বলে হিসাবের কথা। সমস্যা একটাই, তোমাদের মুখে ছাকনি আছে। মাতালের মুখে ছাকনি নাই।

এই বাড়ির আরেকটা হিসাব একটু বিবেচনা কর— ছোট সাহেবরে তো দেখেছ, তোমার শুভ্ৰ ভাইজান। তার মতো সুন্দর চেহারার যুবক দেখেছ? দেখ নাই। দেখার উপায় নাই। তার মতো সুন্দর আরেকটা পুরুষ জন্মেছিল। তার নাম জানো? হাদিস-কোরান পড়বা না, নাম জানিবা কীভাবে? তিনিও একজন নবী। তার নাম ইউসুফ। যার প্রেমে পাগল হয়েছিলেন জুলেখা বিবি। এখন কথা হলো, আমাদের ছোট সাহেবের চেহারা রূপকথার রাজপুত্রের চেয়েও সুন্দর। তার পিতার চেহারা ছবি কী? পোড়া কাঠ। লঙ্কার হনুমান। আর মার চেহারা কী? বিড়ালমুখি। দেখলে মনে হয় সাদা হুতা বিড়াল। Cat women। এত সুন্দর একটা ছেলে যে তাদের হয়েছে হিসাবটা কী? মাঝে-মধ্যে চিন্তা করব। চিন্তার খোরা দিয়া দিলাম। Food for thought.

চিন্তায় মিলে বস্তু, না চিন্তায় নাই। জাগরণে দেখি না যারে, নিদ্রায় পাই।

তোমারে পছন্দ হয়েছে বলেই ভিতরের দুএকটা কথা বললাম। আরো যদি পছন্দ হয় আরো বলব। বুঝেছি? এখন আর কথা বলতে পারতেছি না। বমি চাপাচ্ছে। আমাকে বাথরুমে নিয়ে যাও। বমি করব। পিছন দিক দিয়া ধর। সামনে থাকবা না। সামনে থাকলে তোমার শরীরে বমি করতে পারি। বমির পরে আমার হাত-মুখ ধোয়াইয়া বিছানায় শোয়ায়ে দিবা। এবং দুই পায়ের চিপায় দিবা কোলবালিশ।

আমি তোমারে পুত্রের মতো দেখি, তুমি আমারে দেখবা পিতার মতো। এটাই হলো হিসাবের কথা। জগৎ চলে হিসাবে। যিনি জগৎ চালান, আমরা যাকে বলি আল্লাহ, খ্রিষ্টানের পুতরা বলে God, মালাউনরা বলে ঈশ্বর, তিনি অংকে বড়ই পাকা। সবসময় দশে দশ। বুঝেছি? জ্ঞানের কথা বললাম। সব সময় বলি না। তোমাকে স্নেহ করি বলে বলেছি। ওয়াক ওয়াক ওয়াক! শালার বমি। তুই থাকাস কই?

 

মায়া লজের স্টাফদের বেতন হয় মাস পুরা হবার একদিন আগে। ত্ৰিশ মাস হলে ত্ৰিশ তারিখে, একত্ৰিশ মাস হলে একত্রিশ তারিখে। বেতন দেন রহমতুল্লাহ। রেভিনিউ স্ট্যাম্পে সই করে বেতন নিতে হয়। মনজু তার জীবনের প্রথম বেতন নিল। ছয় হাজার টাকা অ্যাডভান্সের কিছু বেতন থেকে কাটার কথা। দেখা গেল বেতন কাটা হয় নি। রহমতুল্লাহ বললেন, বেতন আসে হেড অফিস থেকে। তারা কাটে নাই। হেড অফিস কোনোদিন ভুল করবে না। তোমাকে যে অ্যাডভান্স দেয়া ওয়েছিল সেটা মাফ হয়ে গেছে। মনজু বলল, মাফ হবে কেন?

রহমতুল্লাহ বললেন, কোম্পানিতে যারা চাকরিতে ঢুকে, তাদের সবাইকে প্রথমে এক মাসের বেতন লোন হিসেবে দেওয়া হয়। মাসে মাসে কাটা হবে। এরকম বলা থাকে। শেষপর্যন্ত কাটা হয় না। এই কোম্পানিতে চাকরির এটা এক সুবিধা।

মনজু আনন্দিত গলায় বলল, বলেন কী? রহমতউল্লাহ বললেন, অত খুশির কিছু নাই। সুবিধা যেমন আছে অসুবিধাও আছে।

মনজু বলল, অসুবিধা কী?

রহমতউল্লাহ বললেন, এত প্যাচাল তোমার সঙ্গে পারতে পারব না। সুবিধাঅসুবিধা নিজেই জানবা।

মনজু বলল, চাচাজি, আমি কি ঘণ্টা দুই তিনের জন্যে ছুটি পাব? এতদিন ধরে এক জায়গায় পড়ে আছি, দম বন্ধ হয়ে আসছে।

রহমতউল্লাহ বললেন, চাকরির অসুবিধার কথা জানতে চেয়েছিলা। এই হলো এক অসুবিধা। দম বন্ধ হয়ে আসে। দম ফেলার জন্যে যেখানে যাবে দেখবে সেখানেও দম বন্ধ। ঘর বাহির সমান। খবর পেয়েছি ছোট সাহেবের শরীর খারাপ, তাকে দেখতে ডাক্তার এসেছে। কাজেই যেখানে ইচ্ছা যাও। রাত এগারোটার আগে ফিরব। এগারোটায় গোট বন্ধ।

 

রুনু সবসময় লক্ষ করেছে সে যখন খুব মন দিয়ে কিছু করে তখনি কলিংবেল বাজতে থাকে। সেই কলিংবেলের শব্দ বাড়ির আর কেউ শোনে না। শুধু সে একা শুনতে পায়।

রুনু তার বান্ধবীর নোট কপি করছিল। একগাদা নোট সকালে ফেরত দিতে হবে। এই সময। কলিংবেল বাজছে। বাসায় বাবা আছে, মা আছে, একটা কাজের মেয়ে আছে। কলিংবেলের শব্দ কেউ শুনছে না। রুনু ঠিক করল, কলিংবেল বাজতে থাকুক, সে দরজা খুলবে না। বাসায় দরজা খোলার দায়িত্ব শুধু তার একার কেন হবে? বাড়ির অন্য সদস্যরা যদি সময় সময় বধির হতে পারে, তাহলে সেও পারে।

শেষপর্যন্ত রুনুকেই উঠতে হলো। মহাবিরক্ত হয়ে সে দরজা খুলল। দুই হাতে দুই বাজারের ব্যাগ নিয়ে মনজু দাঁড়িয়ে আছে। রুনু বলল, একী!

মনজু বলল, রুনু, ভালো আছ?

রুনু চিৎকার দিয়ে বলল, মা, মনজু ভাই এসেছে।

চিৎকার দিয়ে সে নিজে খুবই লজ্জিত হয়ে পড়ল। সে ভেবেই পাচ্ছে না। এত জোরে সে চিৎকারটা কেন দিল! মনজু ভাই কি এমন কেউ যে তাকে দেখে কানের পর্দা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে হবে?

শায়লা রান্নাঘরে মাছ কুটছিলেন, তিনি সেখান থেকে ছুটে এলেন। ইকবাল সাহেব ভেতরের বারান্দায় খবরের কাগজ পড়ছিলেন। তিনি চলে এলেন কাগজ হাতে। সবার ব্যস্ততা এমন যে এই বাড়ির অতি প্রিয় একজন দীর্ঘ নিরুদ্দেশের পর ফিরে এসেছে। শায়লা বললেন, বাবা, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? আমাদের একটা খোঁজ দিবে না?

ইকবাল সাহেব বললেন, একটা ফরওয়ার্ডিং অ্যাড্রেস রেখে গেলে আমিই খুঁজে বের করতাম। কিছুই রেখে যাও নাই। তোমার তো দেখি কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছু নাই।

রুনু বলল, ব্যাগে করে কী এনেছেন বের করেন।

মনজু বলল, সামান্য কাচাবাজার। মাছ-মাংস।

রুনু বলল, লোকজন আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে এলে মিষ্টি আনে, দই আনে। আপনি আনেন কাচাবাজার। আপনার এই অদ্ভুত অভ্যাস কেন?

মনজু বলল, মাকে খুশি করার জন্যে কাঁচাবাজার আনি। পৃথিবীর সমস্ত মায়েরা কাচাবাজার দেখলে খুশি হয়।

রুনু বলল, পৃথিবীর সমস্ত মায়েদের খবর আপনি জেনে গেছেন? আপনি কাচাবাজার আনেন। কারণ আপনি পেটুক মানুষ, খেতে পছন্দ করেন।

মনজু ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করছে। সবাই আগ্রহ করে দেখছে। প্রথমে বের হলো মাঝারি সাইজের একটা কাতল মাছ। ইকবাল সাহেব বললেন, মাছটা ফেস আছে। বিলের কাতল। টেস্ট ভালো।

তারপর বের হলো একটা ইলিশ মাছ। মোটামুটি বড় সাইজের গলদা চিংড়ি। বড় বড় শিং, মাছ। কিছু মলা মাছ। খাসির একটা আস্ত পা।

শায়লা আনন্দিত গলায় বললেন, এত কিছু এনেছ কেন? তোমার কি মাথাটা খারাপ হয়েছে? রাতে কী খাবে বলো? রাতে কী রান্না করব?

মনজু বলল, ঝাল দিয়ে শিং মাছের ঝোল রান্না করেন। শিং মাছের ঝোল খেতে ইচ্ছা করছে।

আর কী খাবে? ভাপে ইলিশ করব?

করেন।

তোমার মামা এনেছে পাবদা মাছ। আজ তিন রকম মাছ থাকুক।

রুনু বলল, ভাপে ইলিশ আমি রান্না করব মা।

শায়লা বললেন, তোর রান্না করতে হবে না। তুই মনজুর সঙ্গে গল্প কর।

রুনু বলল, দুই দিন পরে আমার পরীক্ষা, এখন আমি উনার সঙ্গে গল্প করব? তোমার ছেলে তুমি গল্প কর। আমার এত গল্প করার শখ নাই।

 

শায়লা রান্না বসিয়েছেন। ইকবাল সাহেব মোড়া পেতে রান্নাঘরে বসে আছেন। আয়োজনের রান্না-বান্না দেখতে তার ভালো লাগে। তার হাতে চায়ের কাপ। খুবই আরাম করে তিনি চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। শায়লা বললেন, আমি একটা বিষয়ে মনস্থির করেছি। তুমি কোনো আপত্তি করতে পারবে না।

ইকবাল সাহেব বললেন, কোন বিষয়ে?

শায়লা বললেন, কোন বিষয় তা তুমি অনুমান করতে পারছি। পারছি না?

হুঁ।

তোমার কিছু বলার আছে? ইকবাল সাহেব বললেন, ছেলে খুবই ভালো কিন্তু মেয়ের মতামতের একটা বিষয় আছে।

শায়লা বললেন, তার আবার কিসের মতামত?

ইকবাল সাহেব বললেন, আমার অবশ্য ধারণা মেয়ে ছেলেটাকে খুব পছন্দ করে। যে চিৎকার দিয়েছিল এখনো কানে তালা লেগে আছে। তবে সমস্যা একটা আছে।

কী সমস্যা?

ইকবাল সাহেব বললেন, ছেলের মা নাই বাবা নাই— অনাথ ছেলে। শায়লা বললেন, ছেলের মা-বাবা থাকবে না। কী জন্যে? আমি মা-না? তুমি এই বিষয়ে কোনো উল্টা কথা বলব না। অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলতে চাও বলো। এই বিষয়ে না।

ইকবাল সাহেব প্রসঙ্গ পাল্টালেন। খুশি খুশি গলায় বললেন, এক কাজ করি, খাসির মাংসটা আমি রান্না করে ফেলি। টাটকা টাটকা খাওয়ার একটা আলাদা আনন্দ আছে।

শায়লা বললেন, তুমি রাঁধতে চাইলে রাধ। কাটা মসলার মাংস করা। এটা তোমার ভালো হয়। মাংস রাঁধতে হলে কিন্তু আদা-পেঁয়াজ আনতে হবে। ঘরে আদা-পেঁয়াজ নেই।

রান্নাবান্নায় এই ভদ্রলোকের খুবই শখ। মাঝে-মধ্যেই এটা-সেটা রান্না করেন। তিনি খুবই আগ্রহ নিয়ে আদা-পেঁয়াজ আনতে রওনা হলেন।

রুনু অতি মনযোগে বান্ধবীর নোটবুক কপি করছে। তার সামনেই মনজু বসে আছে। মনজুর সঙ্গে তার কোনো কথা হচ্ছে না। মনজুর দিকে না তাকিয়েও সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে, মনজু তাকিয়ে আছে তার দিকে। কোনো পুরুষমানুষ তার দিকে তাকিয়ে থাকলে তার একেবারেই ভালো লাগে না। গা ঘিনঘিন করে। এখন করছে না। বরং ভালো লাগছে। লাজ্জাও লাগছে। এই লজ্জার মধ্যেও আনন্দ মিশে আছে।

রুনু বলল, আপনি চুপচাপ বসে আছেন কেন?

মনজু বলল, তুমি কাজ করছ, চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আমার গতি কী!

আপনার অফিস কেমন চলছে?

ভালো, তবে খুবই কাজের চাপ। এতদিন আসতে পার নি কাজের চাপে। আমার যে ইমিডিয়েট বাস উনি হঠাৎ ছুটিতে গেলেন। স্ত্রীর ক্যানসার হয়েছে, স্ত্রীকে নিয়ে তাকে যেতে হলো সিঙ্গাপুর। তার সমস্ত কাজ এসে পড়ল আমার ঘাড়ে। আমি নতুন মানুষ, আমি কি এতসব জানি? পনেরো দিনে একবার গেলাম চিটাগাং। আর ছবার গেলাম খুলনায়। বিমানে যাতায়াত করেছি, তারপরেও ধকল কম না।

রুনু বলল, মনজু ভাই, আপনার কথা বলার মধ্যে মনে হয় কোনো সমস্যা আছে। আপনি যখন কথা বলেন তখন মনে হয় মিথ্যা বলছেন।

কী বলো?

আসলেই তাই। আপনার প্রতিটি কথা মিথ্যার মতো শোনাচ্ছে। যদিও আমি জানি আপনি মিথ্যা বলছেন না। আগেও এরকম মনে হয়েছিল। চাকরি নিয়ে কথা বলেছিলেন, আমার কাছে মনে হয়েছিল মিথ্যা। পরে দেখা গেল সত্যি।

মনজু চিন্তিত গলায় বলল, এরকম কেন হয় বলো তো?

রুনু বলল, জানি না কেন হয়। মনে হচ্ছে আপনার কথা বলার ভঙ্গির মধ্যে কোনো সমস্যা আছে। আপনি একটা কাজ করুন— ভয়ঙ্কর কোনো মিথ্যা বলুন, দেখি মিথ্যাটা সত্যির মতো মনে হয় কি-না।

মিথ্যা বলব?

হুঁ।

বেশ তাহলে শোন, আগে বলেছিলাম না। আমার মা মারা গেছেন? আসলে মা বেঁচে আছেন। ভালো মতো বেঁচে আছেন। ইসমাইল সর্দার নামে অতি বদলোককে বিয়ে করেছেন। এই স্বামীর প্রতিভায় আমার মা মুগ্ধ।

রুনু বলল, আপনার মিথ্যাগুলি আমার কাছে সত্যি মনে হচ্ছে। আশ্চর্য ব্যাপার তো!

মনজু চিন্তিত গলায় বলল, আশ্চর্য তো বটেই।

রাতে মনজু চলে যাবে। এগারোটায় গোট বন্ধ হয়। তার আগেই যেতে হবে। শােয়লা বললেন, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, এই বৃষ্টির মধ্যে তোমাকে আমি ছাড়ব না। মনজু বলল, রাত এগারোটার মধ্যে উপস্থিত না হলে আমার চাকরি চলে যাবে মা।

রুনু বলল, চাকরি চলে গেলে চলে যাবে, আপনি যেতে পারবেন না।

মনজু বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, থাকব।

শায়লা স্বামীর দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হাসলেন। তাকে তখন মনে হচ্ছিল তিনি এই পৃথিবীর সুখী মাদের একজন।

 

ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। মনজুকে বিছানা করে দেয়া হয়েছে বসার ঘরের সোফায়। সে বেশ আয়েশ করে শুয়েছে। পায়ের কাছের জানালা খোলা। জানালা দিয়ে ঠাণ্ড বাতাস আসছে। মাঝে মাঝে বৃষ্টির ছাট আসছে। মনজুর ভালো লাগছে। ঘুম ঘুম লাগছে, আবার ঘুম আসছে না- এমন অবস্থা।

মনজু ভাই, পান খাবেন?

রুনু হাতে পানের খিলি নিয়ে ঢুকেছে। তার মুখেও পান। পানের লাল রঙ ঠোট বেয়ে নেমে এসেছে। দেখতে খুব ভালো লাগছে। মনজুর মনে হলো এই মেয়েটা যদি তার স্ত্রী হতো তাহলে সে অবশ্যই হাত দিয়ে ঠোঁটের লাল রঙ মুছিয়ে দিত।

মনজু বলল, রুনু বস।

রুনু বলল, বসব কেন? আপনি কি ভেবেছেন আমি পান হাতে নিয়ে আপনার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি। আমি এক্ষুণি পড়তে বসবা। আজ রাত তিনটা পর্যন্ত আমার পড়ার প্ল্যান।

মনজু বলল, সবসময় কি আর প্ল্যান মতো কাজ হয়?

রুনু বলল, অন্যদের হয় না। আমার হয়।

বলতে বলতে রুনু সোফায় বসল। মনজুর হাতে পান দিতে দিতে মাথা ঘুরিয়ে খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে হাসল।

মনজু বলল, হাসছ কেন?

রুনু বলল, বাবা মা আমাকে হঠাৎ বিয়ে দেবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। পাত্রও খুঁজতে হয় নি। পাত্র নিজেই এসে ধরা দিয়েছে। এই জন্যে হাসছি।

মনজু বিস্মিত গলায় বলল, পাত্র কে?

রুনু শব্দ করে হেসে ফেলে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, পাত্র আমার পাশে বসে পান খাচ্ছে।

মনজু অবাক হয়ে বলল, বলো কী?

রুনু বলল, এত খুশি হবেন না। সব নির্ভর করছে আমার উপর। পাত্র আমার পছন্দ হতে হবে।

মনজু অবাক হয়ে ভাবছে মেয়েটা কী সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছে। কোনো দ্বিধা নেই, কোনো সংকোচ নেই। মনজু বলল, পাত্র তোমার পছন্দ না?

রুনু বলল, না।

মনজু বলল, আমি অবশ্যি পছন্দ করার মতো কেউ না। চেহারা ভালো না। সর্ট। গায়ের রঙও ময়লা।

রুনু বলল, আপনার চেহারা ঠিকই আছে। আপনার যেটার অভাব তার নাম বুদ্ধি।

তোমার ধারণা আমার বুদ্ধি কম?

হ্যাঁ। আমি সারাজীবন কল্পনা করেছি। আমি যাকে বিয়ে করব তার খুব বুদ্ধি থাকবে। চেহারা হবে রাজপুত্রের মতো।

মনজু বলল, কল্পনার মানুষ কল্পনাতেই থাকে, বাস্তবে তাদের পাওয়া যায় না।

রুনু সঙ্গে সঙ্গে বলল, তা ঠিক। তাছাড়া আমার ভাগ্য এরকম যখন যেটা চেয়েছি তার উল্টোটা হয়েছে। আমি জানি আমার বিয়ে আপনার মতো একজন কারোর সঙ্গে হবে। কে জানে হয়তো আপনার সঙ্গেই হবে।

রুনু খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে। মনজুর শরীর ঝিমঝিম করছে। মাথা সামান্য দুলছে। তার মনে হচ্ছে- সে যা দেখছে সেটা স্বপ্ন। সে আসলে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সোফায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন সে আরাম করে ঘুমাচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা স্বপ্নের ফাজলামি। স্বপ্ন তাকে নিয়ে ফাজলামি করছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ