দাদাকে অন্য রকম দেখাচ্ছে। কেমন যেন কুৎসিত। যেন কিছু একটা তাঁকে ছেড়ে যাচ্ছে। কী সেটা–আত্মা? তিনি আবার আগের মতো টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছেন। চোখ ঘুরিয়ে তাকাচ্ছেন। তাঁর তাকাবার ভঙ্গি দেখে মনে হল কোনো কিছু চিনতে পারছেন না। যেন নিতান্ত অপরিচিত একটি জায়গায় হঠাৎ গিয়ে পড়েছেন। তাঁর চোখে গভীর আতঙ্কের ছাপ। নিদারুণ একটি ভয়। কিসের জন্যে এই ভয়? কাকে ভয়?

ডাক্তার প্রদ্যোত বাবু চেয়ারের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুমের ভঙ্গিটা কুৎসিত। ছোট শিশুদের মতো হা করে ঘুম। জিভটা আবার ক্ষণে ক্ষণে নড়ছে। রমিজ সাহেবকে দেখলাম না। তিনি সম্ভবত অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে গিয়েছেন। বাবা নেমে এসেছেন। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যের প্রতীক হিসেবে হাতে একটা পত্রিকা ধরে রেখেছেন। রোগীর কারণে নয়, বাবার উপস্থিতির জন্যেই সবাই কথা বলছে নিচু গলায়। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই বাবা বললেন, তোমার ছোট ফুফু এখনো আসছেন না কেন খোঁজ নাও। (বাবা কখনো কাউকে তুই বলেন না। এবং যে-কোনো কথা এমনভাবে বলেন, যেন মনে হয় এটিই তাঁর শেষ কথা।)

আমি বললাম, আমাদের টেলিফোন ঠিক নেই।

আমি নিচে নামার আগেই ডাঃ ওয়াদুদকে টেলিফোন করে এসেছি। টেলিফোন ঠিক নেই কথাটা ভুল। না জেনে কিছু বলবে না।

বাবা গম্ভীর মুখে খবরের কাগজ পড়তে লাগলেন, যেন কিছুই হয় নি। আমি পা টিপে টিপে চলে গেলাম তেতলায়। টেলিফোন বাবার শোবার ঘরে থাকে।

হ্যালো-ছোট ফুফু।

কে, টগর?

জ্বি।

বাবার অবস্থা এখন কেমন?

ভালো না। তুমি আসছ না কেন?

আমি তো সেই কখন থেকে কাপড়টাপড় পরে বসে আছি। দু বার টেলিফোন করলাম। রিং হয়, কিন্তু কেউ ধরে না।

আমরা সবাই নিচে, সেজন্যেই কেউ ধরে না। কাপড় পরে বসে আছ, আসছ না কেন?

তোমার ফুফার জন্যে অপেক্ষা করছি। সে এক জন কোরানে হাফেজকে আনতে গেছে। বাবাকে তওবা করাবে, দোয়াটোয়া পড়বে।

তওবা কী জন্যে?

মরবার আগে তওবা করতে হয় না?

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। মরবার আগে যদি তওবা করতে হয়, তাহলে সেটা মৃত্যুর কাছে পরাজয় স্বীকার করার মতো। মৃত্যুপথযাত্রীর জন্যে সেটা নিশ্চয়ই একটা ভয়াবহ ব্যাপার। জেনে ফেলা যে, আর কোনো আশা নেই। এবার যাত্রা শুরু করতে হবে সীমাহীন অন্ধকারের দিকে। যে মারা যাচ্ছে, তার কাছ থেকে শেষ আশার মিটমিটি প্রদীপটি কেড়ে নেয়া খুব অমানবিক কাজ। তাকে দেখাতে হবে যে, আমরা যুদ্ধ করে যাচ্ছি। মৃত্যু নামক হিংস্র পশুর সঙ্গে পশুর মতোই লড়ছি। বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচ্যগ্র মেদিনী। কে যেন সিঁড়ি বেয়ে আসছে।

বড়োফুফু এসে ঢুকলেন। তাঁর মুখ বিরক্তিতে কোঁচকান। গাল ঘামে চকচক করছে–একটা মাত্র ফোন, সেটা আবার তেতলায়। এই বাড়ির লোকদের বুদ্ধিসুদ্ধি আর কোনো কালেই হবে না।

কাকে ফোন করবেন?

বড়োফুপু তার জবাব না দিয়ে ডায়াল ঘোরাতে লাগলেন। কেউ সম্ভবত ধরছে না। তাঁর মুখ আরো কোঁচকাতে লাগল–এত বড়ো বাড়ি, টেলিফোন দুটো রাখা উচিত।

কেউ ধরছে না ফুফু?

নাহ।

মনে হয়। ঘুমিয়ে পড়েছে, রাত একটা বাজে।

আমি বলে এসেছি জেগে বসে থাকতে। নবাবজাদা গিয়ে শুয়ে পড়েছেন।

ফুফু, আবার চেষ্টা করতে লাগলেন। আমি যাবার জন্যে পা বাড়াতেই ইশারায় বললেন অপেক্ষা করতে। আমি চেয়ার টেনে বসলাম। লাইন পাওয়া গেল না। ফুফুর মুখ পাথরের মতো কঠিন হয়ে গেল। মৃদুস্বরে বললাম, আমাকে কিছু বলবেন?

হুঁ। ঐ মেয়েটির সঙ্গে কথা বললাম।

কোন মেয়ে?

নীলু। মেয়েটাকে তো ভালোই মনে হল।

আপনার পছন্দ হয়েছে? পাশ করেছে পরীক্ষায়?

হাইট অবশ্যি কম, পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির মতো হবে। কী বলিস?

হতে পারে। মেপে দেখি নি কখনো।

দুই ইঞ্চি হিল পরলে ধরা যাবে না।

হুঁ।

মেয়েটার আঙুলগুলি একটু মোটা। ওয়ার্কিং ক্লাসের মেয়েদের মতো।

তাই নাকি, আমি লক্ষ করি নি।

বড়োফুফু বললেন, সব মিলিয়ো তো পাওয়া যায় না। এই মেয়েটির একটা অবশ্যই ভালো দিক আছে, ছোট ফ্যামিলির মেয়ে, মাথা নিচু করে থাকবে সব সময়। শব্দটাও করবে না। কী বলিস, ঠিক না?

অন্য রকমও হতে পারে। হয়তো ফোঁস করে উঠবে।

হুঁ।

গরিব আত্মীয়-স্বজনরা রাতদিন ভিড় করবে। স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল পায়ে দিয়ে পাকা কাঁঠাল হাতে আপনার ড্রইগুরুমে এসে বসে থাকবে। পান খেয়ে এ্যাশট্রেতে পিক ফেলবে। নাক ঝাড়বে।

বড়োফুফু দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বললেন, মেয়েটির বাবা কী করে?

জানি না কী করে।

সে কি! তোদের ভাড়াটে, আর তোরা জানিস না কী করে?

ভাড়াটে-ফাড়াটে বোধ হয় না। দাদা থাকতে দিয়েছিলেন, চক্ষুলজ্জায় পড়ে মাসে মাসে কিছু দিত।

বাড়ি কোথায়?

কে জানে কোথায়?

বাড়ি কোথায় সেটাও জানিস না?

উঁহু।

আমি মেয়েটিকে আমার মগবাজারের বাসায় যেতে বলেছি। বেড়াবার জন্যে।

আপনার তাহলে ভালোই পছন্দ হয়েছে।

বাড়ি কোথায়, সেটা না জেনে বেড়াতে যাবার কথা বলা ঠিক হয় নি।

একটি মেয়ে ভালো কি মন্দ, তার সাথে তার বাড়ির কোনো সম্পর্ক নেই।

আমার সাথে বাজে তর্ক করিস না। বাজে তর্ক জীবনে অনেক শুনেছি। তোর কাছ থেকে না শুনলেও চলবে।

বড়োফুফু টেলিফোন নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এবার বোধহয় লাইন পাওয়া গেছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আমি শুনলাম, বড়োফুফু, চেঁচাচ্ছেন, ঘুমিয়ে পড়েছিলি? ফাজলামির জায়গা পাস না। ছোটলোক কোথাকার। এক চড় দিয়ে…

 

চা আনতে গিয়ে কোথায় উধাও হলি?

চায়ের কথা আমার মনেই ছিল না। রাত জেগে শরীর খারাপ লাগছে। এসেছিলাম অন্ধকারে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব ভেবে। বাবুভাই নিজেও দেখলাম শুয়ে আছে। গায়ে পাতলা একটা চাদর। বাবুভাই ক্লান্ত স্বরে ব্রলাল, একটু যেন জ্বর জ্বর লাগছে রে।

বাবুভাই, তুমি উঠে হাতমুখ ধুয়ে নিচে যাও।

নাহ।

না কেন?

কেউ মারা যাচ্ছে, এটা দেখতে ভালো লাগে না। অনেক বার দেখেছি।

আমি চুপ করে রইলাম। বাবুভাই নিচু গলায় বলল, মুখে আমরা অসংখ্য বার বলি মরতে তো হবেই, কিন্তু সত্যি সত্যি মৃত্যু যখন আসে তখন মনটন ভেঙে যায়।

বাবুভাই চাদর গায়ে উঠে বসল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, আমাদের হাতে এক বার বেলুচ রেজিমেন্টের এক নন-কমিশও অফিসার ধরা পড়ে গেল। হাবিলদার মেজর। ব্যাটাকে আমরা এগার মাইল হাঁটিয়ে মেথিকান্দা নিয়ে এলাম। ব্যাটার মনে কোনো ভয়ডর নেই। সিগারেট দিই। ভূসভূস করে টানে। চা দিয়েছি, শেষ করে আরেক কাপ চাইল। ব্যাটার সাহসের তারিফ করি মনে মনে।

নাম কী ছিল?

নাম মনে নেই। নাম দিয়ে দরকার কি?

এমনি জিজ্ঞেস করলাম।

নাম বাহাদুর খাঁ। ঝিলামের এক গাঁয়ে বাড়ি। দুই ছেলে ছিল–এক জন মটর মেকানিক, অন্য জন নেভিতে।

ও।

এইসব আমি মনে করতে চাই না। নামধাম দিয়ে কী হয়?

আমি সিগারেট ধরলাম। ক্ষুধা বোধ হচ্ছে ক্ষুধার সময় সিগারেট ভালো লাগে না। বমি-বমি লাগে। বাবুভাই বলল, মেথিকান্দা পৌঁছেই শুনি নতুন করে মিলিটারি রিইনফোর্সমেন্ট আসছে। আমাদের এক্ষুণি পালাতে হবে। ঠিক করা হল, বাহাদুর খাঁকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হবে না।

মেরে ফেলা হবে?

হুঁ।

তারপর?

ব্যাপারটা বুঝতে পারার পর এত বড়ো একটা সাহসী মানুষ ছরছর করে পেচ্ছাপ করে ফেলল, কথা জড়িয়ে গেল। উল্টা-পাল্টা কথা বলতে লাগল।

তারপর?

এর আবার তারপর কি?

বাবুভাই হঠাৎ রেগে গেল। তার সম্ভবত নেশা হয়েছে।

আমাদের অভ্যেসই হচ্ছে একটা তারপর খোঁজা। মৃত্যুর আবার তারপর কি?

আমি জবাব দিলাম না। বাবুভাই সিগারেটে টান দিয়ে খকখিক করে খুব কাশতে লাগল। কাশি থামলে কড়া গলায় বলল, আমি মরবার সময় এক জন সাহসী মানুষের মতো মরব।

লাভ কি তাতে?

লাভ-লোকসান জানি না। সব কিছুতে লাভ-লোকসান খোজা মানুষের আরেকটি অভ্যাস। বাজে অভ্যাস।

তুমি শুধু শুধু রাগছ, বাবুভাই।

শুধু শুধু রাগছি?

হুঁ।

টগর দেখ, তোকে আমি একটি কথা বলে রাখি–মারবার সময় আমি এক জন সত্যিকার সাহসী মানুষের মতো মরব। আরো এক জন বড়ো ডাক্তার আন, এই বলে হৈ-চৈ শুরু করব না।

ভালো কথা। শুনে খুশি হলাম।

দরজার পাশে খুঁট করে শব্দ হল। বাবুভাই অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কে? কে?

আমি, আমি শাহানা। অন্ধকারে কী করছ?

কিছু করছি না। তুমি কী চাও?

ভেতরে আসব?

না।

শাহনা চাপা স্বরে বলল, ঘর অন্ধকার করে বসে আছ কেন?

তাতে কারো তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।

শাহানা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, নানার জ্ঞান হয়েছে, তোমাকে খুঁজছে।

ঠিক আছে, যাব।

শাহানা কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, ভালো করে হাত-মুখ ধুয়ে গেলে ভালো হয়।

শাহানা নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে। বাবুভাই অস্পষ্ট স্বরে বলল, বেশ তেজী মেয়ে। ঠিক না?

হুঁ।

এক জন মেয়ে-মানুষের মধ্যে এরকম তেজ দেখা যায় না।

হুঁ।

বাবুভাই বিছানা থেকে নামল। ক্লান্তস্বরে বলল, শরীর খারাপ লাগছে। গলায় আঙুল দিয়ে বমি করব।

যা করবার তাড়াতাড়ি কর, দাদা তোমাকে ডাকছে।

তোকে আরেকটা কথা বলতে চাই। বেশ জরুরী।

পরে বলবে।

কথাটা শাহানা প্রসঙ্গে।

দাঁড়িয়ে থাকলেই বাবুভাই কথা বলবে। আমি নিঃশব্দে বের হয়ে এলাম। শাহানা প্রসঙ্গে বাবুভাইয়ের কী বলার থাকতে পারে, তা ঠিক বোঝা গেল না। শাহানা সেই জাতীয় মেয়ে, যাদের প্রসঙ্গে কারো কিছু বলার থাকে না। এদের চোখের দৃষ্টি হয় শীতল, হৃদয়ও থাকে। শীতল। এরা শান্ত ভঙ্গিতে সংসারের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে। আমাদের বুড়ো সম্রাট শাহজাহানের কাছে সারা দুপুর বসে থাকে জাহানারা সেজে। যখনই প্রয়োজন মনে করে, তখনি গলার স্বর অস্বাভাবিক শীতল করে আমাকে উপদেশ দিতে আসে। যেমন দিন সাতেক আগে হঠাৎ আমাকে এসে বলল, গতকাল নীলুর সঙ্গে কী কথা হচ্ছিল তোমার?

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, কেন?

দেখলাম নীলু। খুব হাসছে।

জোক বলছিলাম একটা। মজার গল্প।

কি জোক?

তার দরকারটা কী?

দরকার আছে। একটা কাঁচা বয়সের মেয়ে। ওর সঙ্গে তোমার এত মাখামাখি করা ঠিক না।

অসুবিধাটা কোথায়?

অল্পবয়েসী মেয়েরা অতি সহজেই উইকিনেস গ্রো করিয়ে ফেলে এবং পরে কষ্ট পায়। গরিব-দুঃখী মানুষের মেয়ে, এদের নিয়ে ছেলেখেলা করা ঠিক না।

তাই বুঝি?

হুঁ।

শাহানা আমাকে দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে চলে গেল।

রাগে গা জ্বলতে লাগলো আমার।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ