রুস্তমের মায়ের তালাবদ্ধ ঘর অনেক দিন পর খোলা হয়েছে। ঝাড়গোছ করা হচ্ছে। ঘরের দরজা-জানালা সবই বন্ধ ছিল, তারপরও এত ধুলা জমল কিভাবে কে বলবে! বদ্ধঘরে বাসি খাবারের গন্ধ পাওয়া যায়, এই ঘরে ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধ। এই গন্ধ আসছে বন্ধ আলমারি থেকে। রুস্তমের মা আসমা কাপড়ে প্রচুর ন্যাপথলিন দিয়ে রাখতে ভালোবাসতেন। এই গন্ধের প্রতি তার দুর্বলতাও ছিল। প্রায়ই দেখা যেত, হাতভর্তি ন্যাপথলিন নিয়ে আসমা বসে আছেন। মাঝে মাঝে শুকছেন।

ঘর পরিষ্কার করা হচ্ছে আমিনের উপস্থিতিতে। এই কাজের জন্য তিনি তার নিজের লোক নিয়ে এসেছেন। নাকে রুমাল চেপে আমিন বসে আছেন। একে একে নির্দেশ জারি হচ্ছে। নাক-মুখ রুমালে বন্ধ বলে তার নির্দেশ কেউ পরিষ্কার বুঝতে পারছে না।

পুরো ঘর সিলিংসুদ্ধ পরিষ্কার করবে। তারপর ভিক্সল দিয়ে মেঝে মুছবে। ফাইনাল স্টেজে স্যাভলন মেশানো পানি ব্যবহার করবে। গাবদা খাটটা সরাও, আমি সিঙ্গেল খাট রাখব। আলমারি, ড্রেসিং টেবিল সব ক্লিয়ার। ঘরের মধ্যে খোলামেলা ভাব আমার পছন্দ। এই সিলিং ফ্যান, থাকবে না। নতুন সিলিং ফ্যান বসবে। মিস্ত্রি খবর দিয়েছি। মিস্ত্রি এসে এসি লাগাবে। সন্ধ্যার মধ্যে কাজ কমপ্লিট হতে হবে। সাতটায় আমি এই ঘরে উঠব। দুরাকাত নফল নামাজ পড়ে দাখিল হবো। যা বলেছি অল ক্লিয়ার?

কেউ জবাব দিল না। সবাই নিজের মতো কাজ করছে। রুস্তম এসে বলল, দুলাভাই আপনি ধুলাবালির মধ্যে বসে আছেন কেন?

আমিন বললেন, কাজ দেখছি। কাজ দেখতে আমার ভালো লাগে।

চা-কফি কিছু খাবেন?

 

ফার্স্ট ফেজ ক্লিনিংয়ের পর চা খাব। ধুলা একটু কমুক। তোমার বাড়িতে নানান অপরিচিত লোকজন দেখছি। এরা কারা?

ঠিক জানি না এরা কারা।

একজনকে দেখলাম হাফ নেংটা হয়ে বারান্দায় বসা। এ কে?

উনার নাম চণ্ডিবাবু। উনি কে জানি না।

অদ্ভুত কথা শুনলাম। তোমার বাড়িতে বাস করে আর তুমি জানো না এ কে? মুনিয়া মেয়েটাকে দেখলাম ঘুরঘুর করছে, সে এখানে কেন?

মুনিয়াকে চিনেন?

ফাজিল মেয়ে। চিনব না কেন? আরোগ্য ক্লিনিকের ঝি। তোমার কেবিনে সর্বক্ষণ উঁকিঝুঁকি দিত। শেষ পর্যন্ত ক্লিনিকের এমডির কাছে কমপ্লেইন করতে হলো। ঝি এখানে কী চায়?

ঝি না দুলাভাই। নার্সের অ্যাসিসট্যান্ট। আমিই তাকে নিয়ে এসেছ।

কেন?

জানি না কেন। ওই সময়ের ঘটনা আমার পরিষ্কার মনে নেই।

ঝাঁটাপেটা করে ঝি বিদায় করো। তোমার অস্বস্তি লাগলে বিদায়ের কাজ আমি করব। হাতে দুই হাজার টাকা ধরিয়ে রিকশায় উঠিয়ে দিতে হবে।

জি আচ্ছা।

একে বলে ফুড ফর ওয়ার্ক। তোমার এখানে থাকব-খাব, বিনিময়ে কিছু কাজ করে দেব না? নিচে আরেকজনের সঙ্গে দেখা হলো। হানড্রেড পারসেন্ট ইংলিশ সাহেব। গলায় টাই, চকচকে জুতা। আমি বললাম, নাম কী? নাম বলল, ইমন আহমেদ। আমি বললাম, আপনি করেন কী? সে বলল, চাকরির সন্ধানে আছি। বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারভু দিচ্ছি। আমি বললাম, চাকরির সন্ধানে আছ ভালো কথা। এখানে কেন? সে বলল, স্যার আমাকে এ বাড়িতে থেকে চাকরি খুঁজতে বলেছেন। চাকরি পেলে চলে যাব। রুস্তম তুমি কি তাই বলেছ?

বলতে পারি। মনে হয় আমার অসুখের সময় ঘটনা ঘটেছে। অসুখের সময়ের অনেক কথা আমার মনে নেই।

আমিন বললেন, সাত দিন সময়। সাত দিনের মাথায় তাকে চলে যেতে হবে। আমিই ব্যবস্থা করব। তোমাকে কিছুই করতে হবে না। তুমি শুধু দেখবে। তুমি অবজারভার। আবর্জনা পরিষ্কারের দায়িত্ব আমার। আমি মর্জিনা।

মর্জিনা কে?

আলি বাবা চল্লিশ চোরের মর্জিনা। সে ঘর ঝাঁট দিত আর কোমর দুলিয়ে গান করত, ছিঃ ছিঃ ঘরমে এত্তা জঞ্জাল।

ও আচ্ছা।

পাশের ঘরে একজনের সঙ্গে দেখা হলো। শুনলাম সে নাকি তোমার আর্ট টিচার।

জি, হোসেন মিয়া। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। রাষ্ট্রপতি গোল্ড মেডেল পাওয়া।

তার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি, ঘর অন্ধকার করে খাটে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। হাতে কোকের গ্লাস। আমি বললাম, কী খাচ্ছেন? সে বলল, রাম খাচ্ছি।

আমি বললাম, রাম জিনিসটা কী?

সে বলল, এক ধরনের অ্যালকোহল। মোলাসিস বা চিটাগুড় থেকে তৈরি হয়। খেতে মিষ্টি। এমনভাবে বলল, যেন দিনে-দুপুরে মদ খাওয়া কোনো ব্যাপারই না। একেও বের করে দিতে হবে, তবে অন্যরা যেমন নরম্যালি বের হবে সে সেভাবে বের হবে না। একে কানে ধরে বের করে দিতে হবে। কত বড় সাহস, দিনে-দুপুরে এম খায়! দুদিন পর লক্ষ্মণ খাবে, ভারত খাবে, সীতা খাবে। বদমাইশ।

রুস্তম বলল, তার সঙ্গে এভাবে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না দুলাভাই। উনি আমার টিচার।

টিচার মদ খাবে আর সেটা দেখে ছাত্র শিখবে? এটা আমি হতে দেব না।

 

ঘটনা কাকতালীয় হলেও একই সময়ে আমিনের স্ত্রীও রাম খাচ্ছিল। রাম দিয়ে বানানো ককটেল। পানীয়ের রং হালকা সবুজ। গ্লাসের এক কোনায় লেবু। সে বসেছে রুলেট টেবিলে। তার পাশে বিরস মুখে আফতাব চৌধুরী বসা। রুলেটে সামিনার প্রচুর টাকা যাচ্ছে। টাকার জোগান দিতে হচ্ছে আফটাবকে। সামিনা কালো শাড়ির সঙ্গে রুপার গয়না পরেছে। তাকে ইন্দ্রানীর মতো দেখাচ্ছে। অনেকেই তাকাচ্ছে সামিনার দিকে। আফতাব চৌধুরীকে দেখাচ্ছে মিয়ানো মুড়ির মতো। তার চোখে কালি পড়েছে। গতকাল থেকে দাঁতে যন্ত্রণা হচ্ছে। ওষুধে কাজ হচ্ছে না। বাম গাল ফুলে আছে।

আফতাব বলল, আজকের মতো থাক। সামিনা বলল, লাস্ট একটা ডিল খেলব। পনেরো নাম্বারে রব। পনেরো হলো আমার জন্ম তারিখ। জন্ম তারিখ সবার জন্য লাকি হয়। দুইশ ডলার দাও।

দুইশ ডলার ধরবে?

শেষ দান বড় করে ধরাই তো উচিত।

পুরো টাকাটাই হারবে।

অসম্ভব। প্রথমত পনেরো আমার জন্ম তারিখ। এই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছয়। ছয় আমার আরেক লাকি নাম্বার।

ছয় পেলে কোথায়?

পনেরো বার এক এবং পাঁচ যোগ করলে হয় ছয়। একে বলে নিউমোরলজি। দুইশ ডলার না, ছয়শ ডলার দাও।

ছয়শ?

হ্যাঁ ছয়শ। দেখো কী ঘটনা ঘটে। আমি জিতলে পাব ৩৬ গুণ অর্থাৎ উনিশ হাজার দুইশ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় তের লাখ টাকারও বেশি। ডলার ৭০ টাকা ধরলে তের লাখ চৌচল্লিশ হাজার টাকা।

আফতাব নিতান্ত অনিচ্ছায় ছয়শ ডলার দিল। সামিনা সঙ্গে সঙ্গেই টাকাটা হারল। আফতাব বিরস গলায় বলল, চলো ঘুমুতে যাই।

সামিনা বলল, আমি আরেকটা ককটেল খাব। ককটেল শেষ না হওয়া পর্যন্ত রুলেট খেলব।

আমি কিন্তু তোমাকে আর টাকা দেব না।

তোমাকে দিতে হবে কেন? আমি আমার টাকায় খেলব। এইবার ধরব দশ নাম্বারে। তোমার বন্ধু আমিনের জন্মদিন হলো দশ। আমি বড় দান 1991

বড় দানটা কত?

একসঙ্গে এক হাজার ডলার।

তোমার নেশা হয়ে গেছে।

তা হয়েছে। মদ খেয়ে অভ্যাস নেই, প্রথম খাচ্ছি। সামিনা পকেট থেকে ক্রেডিট কার্ড বের করল। আফতাব অবাক হয়ে দেখল বল ১০-এর ঘরে। সামিনা খুব সহজ ভঙ্গিতে বাংলাদেশি টাকায় পঁচিশ লাখ টাকার কিছু বেশি নিয়ে উঠে দাঁড়াল। আফতাবকে বলল, চলো ডেকের ভোলা হাওয়ায় বসি। লাস্ট ককটেল ডেকে বসে খাব।

জাহাজের ডেক চারতলায়। মাথার ওপর ছাদ আছে। ছাদ থেকে আলো আসছে। হালকা আলো। এই আলোয় কোনো কিছুই পরিষ্কার দেখা যায় না। পরিষ্কার না দেখাই ভালো। বৃদ্ধ কিছু আমেরিকান ব্যাংকক থেকে ভাড়া করে তরুণী বান্ধবী নিয়ে এসেছে। বৃদ্ধগুলোর একমাত্র চিন্তা বান্ধবীদের পেছনে যে ডলার খরচ হয়েছে সেটা যেন উসুল হয়। বান্ধবীরাও সার্ভিস দিতে কার্পণ্য করছে না।

এক কোনায় বার আছে। দুটি মেয়ে টেবিলে টেবিলে ড্রিংক সার্ভ করছে। এরা পরেছে গোলাপি পোশাক।

আফতাব এবং সামিনা বসেছে সামনের দিকে। হুহু করে বাতাস আসছে। বাতাসে সামিনার চুল উড়ছে। তাকে এখন আরও সুন্দর লাগছে। সামিনাকে ককটেল দেওয়া হয়েছে। চুকচুক করে খাচ্ছে।

আফতাব বলল, তুমি অদ্ভুত মেয়ে।

সামিনা বলল, আমি অদ্ভুত না। আমার ভাই অদ্ভুত। ভাইয়ের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব, তখন বুঝবে অদ্ভুত কাহাকে বলে। এই আমার একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। একটা সিগারেট দাও।

তুমি এখন সিগারেট খাবে?

ইয়েস স্যার।

তুমি এখন নেশার ঝেকে আছ। তোমাকে আমার কিছু সিরিয়াস কথা বলা দরকার।

বলো।

এখন বললে তো অর্ধেক কথাই মাথায় ঢুকবে না।

অর্ধেক তো ঢুকবে। সেই অর্ধেকেই কাজ হবে।

তুমি তোমার স্বামীকে ছেড়ে পুরোপুরি চলে এসেছ, এটা তো ঠিক?

তাকে পুরোপুরি ছেড়ে তোমার কাছে চলে আসব কোন দুঃখে? পুরোপুরি চলে এলে রাতে তোমার কেবিনেই থাকতাম। আমি আলাদা কেবিনে থাকি। তোমাকে আমার ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেই না। ঠিক করে বলো, এখন পর্যন্ত আমার হাত ধরতে পেরেছ?

আফতাব বলল, তোমার ব্যাপার আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

সামিনা বলল, একটা লোকের গায়ে ঘামের গন্ধ বলে তাকে ছেড়ে আমি চলে আসব? মানুষের গায়ে ঘামের গন্ধ থাকে। নিম সাবান দিয়ে গোসল করলে ঘামের গন্ধ চলে যায়।

তাহলে আমার সঙ্গে এসেছ কেন?

তোমার বন্ধুকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ২২ ঘণ্টা সে ব্যবসার চিন্তায় থাকে। ঘুমের মধ্যেও সে ব্যবসার স্বপ্ন দেখে। এখন আর দেখবে না। যখন ফিরে যাব, সে নলের মতো সোজা হয়ে থাকবে।

একটা লোককে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তুমি আমার সঙ্গে চলে এসেছ?

হ্যাঁ। যে লোক তার প্রেগনেন্ট স্ত্রীর দিকে ফিরে তাকায় না, তার শিক্ষার প্রয়োজন আছে।

তুমি প্রেগনেন্ট?

হ্যাঁ, চৌদ্দ সপ্তাহ চলছে। এর মধ্যে বাচ্চাটার অবস্থা কী শোনো। আমি বেবি সেন্টারের সদস্য। তারা প্রতি সপ্তাহে বেবির একটা আপডেট পাঠায়। দাঁড়াও তোমাকে ১৪ সপ্তাহেরটা পড়ে শোনাচ্ছি।

আফতাব হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে। সামিনা তার আইফোন টেপাটিপি করতে করতে বলল, পড়ে শোনাচ্ছি। মন দিয়ে শোনো।

The baby is now about 12.5 cm or 4.92 Inches. He/she is now producing urine and actually urinating into the amniotic flui at this week your baby is a regular wiggler but because of his/her small size you probly wont feel it yet.

তুমি তোমার স্বামীর কাছে ফিরে যাবে?

অবশ্যই। ও মালয়েশিয়ায় আসবে। ওকে নিয়ে ঘুরব। তারপর দেশে ফিরব।

আমার অবস্থা কী হবে?

তোমার কপালে দুঃখ আছে। আমিও তোমাকে ছাড়ব না। ভাড়াটে গুণ্ডা দিয়ে খুন করালেও আমি অবাক হবে না। আমাদের পরিবারে খুন-খারাবি কোনো ব্যাপারই না। আমার বাবা খুনের দায়ে জেলে আছেন, তোমাকে বলেছি না?

আফতাব চাপা গলায় বলল, you bitch এখন তুমি এইসব কী বলছ?

সামিনা হাসতে হাসতে বলল, ঘেউ ঘেউ।

ঘেউ ঘেউ করছ কেন?

সামিনা বলল, আমি bitch। তাই ঘেউ ঘেউ করছি। ঘেউ ঘেউ ঘেউ!

 

রুস্তমের মার ঘর সন্ধ্যার মধ্যে পরিষ্কার হওয়ার কথা। পরিষ্কার করা গেল না। তিনটা আলমারির কোনোটিই ঘর থেকে বের করা যাচ্ছে না। আমিন ভেবে পাচ্ছে না এই আলমারি ঘরে ঢুকানো হয়েছিল কিভাবে? মিস্ত্রি কি ঘরের ভেতর বসে আলমারি বানিয়েছে?

রুস্তম বলল, দরজা ভেঙে বের করলে কেমন হয়?

আমিন বলল, এটা আমার লাস্ট অপশন।

রুস্তম বলল, আলমারিগুলো ভেঙে ফেললেও হয়। আলমারির তো তেমন প্রয়োজনও নাই। আলমারি ভেঙে পার্ট বাই পার্ট বের করুক।

আমিন বলল, আজকের রাতটা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করি, কাল ডিসিশন নেব।

রাতে কোথায় থাকবেন?

নিজের ফ্ল্যাটেই থাকব।

রাতে খাবেন না?

না। আজ রাতটা উপাস দেব। মেজাজ অতিরিক্ত খারাপ হয়েছে। মেজাজ খারাপের কারণে নিরম্বু উপবাস।

উপাস দিলে কি মেজাজ ঠিক হয়?

হয়।

আমিন উঠে চলে গেল।

 

রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রুস্তম উপন্যাস নিয়ে বসেছে, তখন হাসিমুখে মুনিয়া উপস্থিত হয়ে বলল, ভালো খবর আছে স্যার। আলমারি তিনটা বের হয়েছে।

কিভাবে বের হলো?

নিচে যে থাকেন, সবসময় সুট-টাই পরা, উনি সব শুনে নিজে দায়িত্ব নিয়েছেন। কাল দুপুরের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।

ভালো তো।

স্যার আপনি উনাকে কখনো ছাড়বেন না। উনি খুবই কাজের মানুষ। আপনার আশপাশে কাজ জানা লোক থাকা দরকার।

আচ্ছা ঠিক আছে। এখন যাও।

আজকেও কি অনেক রাত পর্যন্ত লিখবেন?

হ্যাঁ। আমি এ উপন্যাসটা একটু অন্যভাবে লিখছি। ধারাবাহিকভাবে লিখছি না। ঘটনাগুলো আলাদা আলাদা করে লিখছি। পরে একত্র করে দেব। কেমন হবে?

খুবই ভালো হবে। ফ্লাস্কে করে চা এনে আপনার টেবিলে রাখব?

না। লেখার সময় আমার চা-কফি কিছু লাগে না।

আমি যদি আপনার পেছনে বসে থাকি, আপনার কি সমস্যা হবে? আমি কোনো শব্দ করব না। নিঃশ্বাসও ফেলব খুব সাবধানে।

শব্দ না করলে বসে থাকো।

স্যার, থ্যাংক ইউ।

ময়ুরী, একটা অদ্ভুত কথা শুনবে?

অবশ্যই শুনব। স্যার আপনি যে কথাই বলেন আমার কাছে এত অদ্ভুত লাগে! অদ্ভুত কথাটা কী?

উপন্যাসের নাম ঝিঁঝি রাখার পর থেকে প্রায়ই আমি মাথার ভেতর ঝিঁঝির ডাক শুনি।

স্যার একটা কথা বলি?

বলো।

উপন্যাসের নাম বদলে পাখি রেখে দেখুন মাথায় পাখির ডাক শোনেন কি না।

নাম চেঞ্জ করা যাবে না। তবে বুদ্ধিটা ভালো। একদম শব্দ করবে না।

চুপ করে বসে থাকো।

মুনিয়া চুপ করে বসে আছে। রুস্তম প্রণাশের মৃত্যু অংশটি লিখছে। উপন্যাস একত্র করার সুবিধার জন্য প্রতিটি অংশের আলাদা শিরোনাম দেওয়া। মূল উপন্যাসে শিরোনাম থাকবে না।

 

প্রণাশের মৃত্যু

ইলিশ মাছটা এত ফ্রেশ ছিল তা আগে বোঝা যায়নি। সরিষার ঝুঁজটা চোখে-মুখে লাগছে। প্রণাশ বলল, অসাধারণ রান্না হয়েছে খুকি। প্রণাশ যখন খুব আনন্দে থাকে তখন তার স্ত্রীকে খুকি ডাকে।

প্রণাশের স্ত্রী সীতা নাকে-মুখে শাড়ির আঁচল চেপে বসে আছে। ইলিশ মাছের গন্ধ সে সহ্য করতে পারে না। তার বমি আসে।

প্রণাশ বলল, আমরা ইলিশ মাছ খাই তার গন্ধের জন্য। তোমার উচিত, সাহেবদের মতো ভেটকি মাছ খাওয়া। ভেটকি মাছে গন্ধ নাই, কাঁটা নাই, কিছুই নাই। স্বাদ হলো আলুর মতো। বুঝেছ?

সীতা বলল, বুঝেছি।

প্রণাশ বলল, তোমার পুত্র কোথায়?

ঘুমিয়ে পড়েছে।

ইলিশ মাছ খেয়েছিল?

না।

না খেয়ে ঘুমিয়েছে?

হুঁ। বাজার এনেছ দেরিতে। রান্না শেষ করে দেখি ঘুমাচ্ছে।

যাও ডেকে তোলো। পিতা-পুত্র একসঙ্গে ইলিশ মাছ খাব। খাবার সময় আমার মোবাইল ফোনে একটা ছবি তুলে রাখবে।

মোবাইল ফোনে কিভাবে ছবি তুলতে হয় আমি জানি না।

camera option-এ যেতে হবে। যাও ছেলেকে ডেকে আনে।

সীতা অনেক কষ্টে ছেলের ঘুম ভাঙিয়ে কোলে করে খাবার ঘরে এসে দেখে, প্রণাশ মরে পড়ে আছে।

 

লেখা বন্ধ করে রুস্তম ভুরু কুঁচকে খাতার দিকে তাকিয়ে আছে। মুনিয়া বলল, কোনো সমস্যা হয়েছে স্যার?

রুস্তম বলল, হয়েছে।

কী সমস্যা?

মৃত্যুদৃশ্যটা আমার পছন্দ হয়নি। একটা মানুষ একা একা কেন মারা যাবে? মৃত্যুর সময় তার প্রিয়জন কেউ থাকবে না?

থাকা উচিত। স্যার আপনি নতুন করে লিখুন।

তাই করা উচিত। প্রণাশ খাওয়া-দাওয়া শেষ করে খাটে বসে পান চিবুচ্ছে। পাশে তার স্ত্রী। এই সময় মৃত্যু। কেমন হয়?

খুব ভালো হয়।

রুস্তম আবার লেখা শুরু করল।

 

প্রণাশের মৃত্যু
(version two)

প্রণাশ বলল, সীতা একটা পান খাওয়াতে পারবে? সীতা বলল, ঘরে পান নেই। কোনোদিন পান খাও না, আজ হঠাৎ পান খেতে চাচ্ছ কেন?

পান খেতে ইচ্ছা করছে। তোমার বুয়া তো পান খায়, তার কাছ থেকে একটা পান এনে দাও না।

শুধু পান? না সঙ্গে জর্দাও লাগবে?

খাব যখন ভালো করেই খাব। জর্দা, এলাচ, লবঙ্গ…

মুনিয়া বলল, স্যার আপনাকে ডাকে।

কে ডাকে?

আপনার আর্ট টিচার হোসেন সাহেব।

রুস্তম ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, হোসেন দরজার বাইরে পায়চারি করছে। তার জিভ মুখ থেকে বের হয়ে আছে। মনে হচ্ছে রাগ কমানোর চেষ্টায় আছে। রুস্তমের চোখে চোখ পড়া মাত্র হোসেন বলল, আপনার সঙ্গে আমার অত্যন্ত জরুরি কিছু কথা আছে। কাইন্ডলি কাম টু মাই রুম।

একটা জরুরি কাজ করছি। উপন্যাসে হাত দিয়েছি।

খামাখা সময় নষ্ট। উপন্যাসে হাত দিয়ে কিছু হবে না, পা দিয়েও কিছু হবে না। আমার অত্যন্ত জরুরি কথা আছে। come to my room.

 

হোসেন মিয়ার ঘর সিগারেট এবং গাঁজার ধোয়ায় বিষাক্ত হয়ে আছে। তার্পিনের গন্ধেও বাতাস ভারী। রুস্তম চেয়ারে বসতে বসতে বলল, বলুন আপনার জরুরি কথা।

জরুরি কথা মুনিয়া মেয়েটির প্রসঙ্গে। অতি ফাজিল, অতি বদ একটি মেয়ে। একদিন শুধু সিটিং দিয়েছে। এক ঘণ্টা বসার কথা। ছাব্বিশ মিনিট বসেই বলেছে, এক কাপ চা খেয়ে আসি। তারপর আর তার খোঁজ নাই। আমি শুধু আউট লাইনটা আঁকতে পেরেছি।

ও আচ্ছা।

ও আচ্ছা বললে তো হবে না। আপনাকেই কিছু একটা করতে হবে। আমার নিজের মাথায়ও একটা সুদ্ধি এসেছে। আমি সেটা নিয়েও আপনার সঙ্গে ডিসকাস করতে চাই। অবশ্যি আপনার সঙ্গে ডিসকাস করা না করা একই। আপনি ভেজিটেবলের কাছাকাছি একজন মানুষ। তারপরও শুনুন, আমি ঠিক করেছি মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেলব। বিয়ের পর তো তাকে আমার কথা শুনতে হবে। সিটিং দিতে হবে। এটা কি বুঝতে পারছেন?

পারছি।

বিয়ের পর কিছুদিন আমরা আপনার এখানেই থাকব। অসুবিধা আছে?

না।

বিয়ের খরচ হিসাবে কিছু টাকা আপনাকে দিতে হবে। বেশি না। বিয়ের শাড়ি কিনব। আমার আর্টিস্ট বন্ধুদের পার্টি দেব। হোটেল ভাড়া করে পার্টি না, আপনার বাড়ির ছাদে। আইডিয়া কেমন লাগছে?

ভালো।

যেহেতু ড্রিংকস থাকবে, ফুড তেমন না থাকলেও হবে। ওয়ান আইটেম। মোরগ পোলাও।

আপনার ইতালি যাওয়ার কী হলো?

সব গুছিয়ে নিয়ে এসেছিলাম, এখন আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। মুনিয়াকে সঙ্গে নিয়ে যাব। যুবতী স্ত্রী ফেলে রেখে যাওয়া আর শুকনা বারুদ ফেলে রাখা একই। যে কোনো সময় দপ করে জ্বলে উঠবে। এখন বলুন আমার আইডিয়া কেমন?

ভালো।

তাহলে মুনিয়াকে আপনি আমার ঘরে পাঠান। আজই সেটল হবে। বিয়ের প্রপোজাল পাওয়ার পর তার আনন্দটা কী রকম হবে ভেবেই ভালো লাগছে। Have not ফ্যামিলির দরিদ্র মেয়ে, ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরবে, ডিসকো ফ্লোরে নাচানাচি করবে, ভাবাই যায় না। আপনি কাইন্ডলি মুনিয়াকে পাঠান। এক্ষুনি পাঠান। শুভস্য শীঘ্রম।

 

মুনিয়া চুপচাপ বসে আছে। তার চোখে আগ্রহ নেই, কৌতূহলও নেই। হোসেন বলল, তোমাকে কী জন্য ডেকেছি শুনলে আকাশ থেকে পড়বে। প্রথমে তোমার জন্য একটা উপহার। এই মেডেলটা রাখো, তোমাকে দিলাম।

কিসের মেডেল?

রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক। পঞ্চম এশীয় আর্ট একজিবিশনে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিলাম। কী ছবি এঁকেছিলাম শুনতে চাও?

শুনতে চাই না, বলতে চাইলে বলেন।

ছবিটা ছিল গ্রামের একটা এঁদো পুকুরের। চারদিকে জঙ্গল। মাঝখানে টলটলা পানি। পানিতে শাপলা ফুল ফুটেছে। গরুর ধবধবে সাদা একটা বাচ্চা পানি খেতে এসে অবাক হয়ে শাপলা ফুল দেখছে।

ও আচ্ছা।

ছবিটা এখন আছে ডেনমার্কের রাষ্ট্রপতির কাছে। উনি পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন।

খারাপ কি?

তোমাকে যে মেডেলটা দিয়েছি তার ওজন দেড় ভরি। বর্তমান টাকায় এর দাম পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা। খুশি হয়েছ?

হুঁ।

তোমার মুখ দেখে তো মনে হয় না খুশি হয়েছ। যাই হোক, আমি তোমাকে বিয়ে করব বলে ঠিক করেছি। বিয়ের পর আমরা চলে যাব ইতালি। সেখান থেকে ফ্রান্সে।

মুনিয়া হাই তুলতে তুলতে বলল, আপনি এটা ঠিক করলে তো হবে। আমার নিজেরও ঠিক করতে হবে।

তুমি রাজি না?

অবশ্যই না। এখন যাই।

সবকিছু চিন্তা করে না বহো। হুট করে না বলছ কেন? আমাকে বিয়ে করতে তোমার অসুবিধাটা কী?

দুই দিন পরে আপনি আমাকে দিবেন ছেড়ে। তখন আমি যাব কই?

ছেড়ে দেব কেন?

আমার ঘটনা শুনলে তো ছাড়বেনই।

তোমার আবার স্ত্রী ঘটনা?

রাতে আমি ঘুমাই স্যারের সঙ্গে। এটা শুনলে আপনি আমাকে বিয়ে করবেন। আছে আপনার এত সাহস?

রাতে তুমি রুস্তম সাহেবের সঙ্গে ঘুমাও?

Yes, আমার কথা বিশ্বাস না হলে স্যারকে জিজ্ঞেস করেন। উনি মিথ্যা বলার মানুষ না।

মুনিয়া উঠে দাঁড়িয়েছে। হোসেন বলল, মেডেল রেখে যাও। মেডেল নিয়ে যাচ্ছ কেন?

আদর করে আপনি আমারে একটা জিনিস দিয়েছেন, আমি নেব না? কী বলেন আপনি! মুনিয়া ঘর খেকে বের হয়ে গেল।

খাটে পা ঝুলিয়ে হতভম্ব হয়ে বসে থাকল হোসেন মিয়া।

 

রুস্তম প্রণাশ বাবুর মৃত্যুর তৃতীয় ভার্সান লিখছে। তার সমস্ত চিন্তা এবং চেতনা এই মুহূর্তে প্রণাশ বাবুর মৃত্যুতে। আশপাশে কী ঘটছে সে জানে না। মুনিয়া পাটি নিয়ে ঢুকছে। শুয়ে পড়েছে। তার গায়ের শাড়ি আগের মতোই এলোমেলো। রুস্তম এই বিষয়ে কিছুই জানে না।

 

প্রণাশ বাবুর মৃত্যু
(Third version)

প্রণাশ আট দিন জ্বরে ভুগল। ভাইরাসের জ্বর পাঁচ দিনের বেশি থাকে। তার বেলায় আট দিন। নতুন ধরনের কোনো ভাইরাস হবে।

আজ জ্বর কম। থার্মোমিটার ৯৯, প্রণাশ একটু ভালো বোধ করছে। সে বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছে। তার হাতে খবরের কাগজ। এই কদিন সে কাগজ পড়েনি। পড়তে ইচ্ছা করেনি। আজও যে খুব ইচ্ছা করছে তা না।

সীতা বলল, শরীরটা কি একটু ভালো লাগছে?

প্রণাশ বলল, হুঁ।

লেবু চা করে দেব, খাবে?

না।

পাকা পেঁপে এনে রেখেছি। কেটে দেই খাও।

না।

জোর করে খাও, শরীরে বল পাবে…

 

এই পর্যন্ত লিখে রুস্তমকে থামতে হলো। মোবাইল ফোন ক্রমাগত বাজছে। মোবাইল ফোন শিশুদের মতো। শিশুরা কাঁদতে থাকলে কোলে নিয়ে কান্না থামাতে ইচ্ছা করে। মোবাইল কাঁদতে শুরু করলেও কান্না থামাতে ইচ্ছা করে।

রুস্তম বলল, হ্যালো।

আমিন বললেন, রুস্তম জেগে আছ?

হ্যাঁ।

আমি ভেবেছিলাম ঘুমাচ্ছ। তারপরও টেলিফোন করলাম কারণ আমার উপায় ছিল না।

নতুন কিছু ঘটেছে?

তোমার বোন মালয়েশিয়া থেকে টেলিফোন করেছে। রোমিং ফোন নিয়ে গেছে। দেখেই আমি চিনেছি। আমি বললাম, হ্যালো। সে তার উত্তরে বলল, ঘেউ ঘেউ।

কী বলল?

কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করল।

বলেন কী?

আমি ভাবলাম হয়তো ভুল শুনেছি। আমি আবার বললাম, কে সামিনা! সামিনা বলল, ঘেউ ঘেউ ঘেউ! আগে দুবার ঘেউ বলেছে, এখন বলল তিনবার।

আপনি টেলিফোন রেখে দিয়েছেন?

হ্যাঁ।

আরেকবার করে দেখুন। এমন হতে পারে যে বুবু ঠিকই আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। আপনি তাকে অপছন্দ করবেন বলে ঘেউ ঘেউ শুনছেন। ডক্টর রেণুবালা দে হলে তাই বলতেন। মস্তিষ্ক আমাদের তাই শোনায় যা আমরা প্রবলভাবে শুনতে চাই। দুলাভাই রাখি।

রুস্তম প্রণাশ বাবুর মৃত্যুর তৃতীয় ভার্সান পড়ল। তার পছন্দ হলো না। একটা মানুষ আগেই আধমরা হয়ে আছে। তার মৃত্যু কারও মনে দাগ কাটবে না। জলজ্যান্ত একজন মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মনে দাগ কাটবে। সে চতুর্থ ভার্সান নিয়ে ভাবতে বসল। এই ভার্সনে প্রণাশ বাবু তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্টার সিনেপ্লেক্সে অবতার ছবিটা দেখতে গেছেন। ছেলেকে আইসক্রিম কিনে দিয়েছেন। তিনি পপকর্ন নিয়েছেন। ছবি শুরু হওয়া মাত্র তিনি স্ত্রীর কানে কানে বললেন, বুকে ব্যথা করছে। সীতা গভীর মনোযোগ দিয়ে ছবি দেখছে বলে স্বামীর কথা শুনতে পেল না।

মোবাইল ফোন আবারও বাজছে। রুস্তম বলল, হ্যালো।

ওপাশ থেকে আমিন বললেন, তোমার কথামতো আবারও টেলিফোন করেছিলাম। সামিনা আবারও বলল ঘেউ ঘেউ। কী করি বলো তো?

রুস্তম বলল, আমি তো কিছু বলতে পারছি না। তবে এমনও হতে পারে যে বুবু কুকুর হয়ে গেছে।

কুকুর হয়ে গেছে! কুকুর হয়ে গেছে মানে?

মানসিকভাবে কুকুর হয়ে গেছে। সে নিজেকে কুকুর ভাবছে। ডক্টর রেণুবালাকে জিজ্ঞেস করে আমি জেনে নেব।

তোমাকে কিছু জানতে হবে না। তুমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাও।

জি আচ্ছা।

সকাল সকাল উঠবে। তোমাকে নিয়ে ভাই পীরের কাছে যাব। আজ যেভাবেই হোক উনার কাছ থেকে তাবিজ নিয়ে আসতে হবে। আমি ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখছি। ছটায় ঘুম থেকে উঠে নাশতা খেয়েই রওনা। তোমাকে আমি ডেকে তুলব। ঠিক আছে?

ঠিক আছে।

রুস্তম লেখা নিয়ে বসল। স্টার সিনে কমপ্লেক্সে এক গাদা মানুষের মধ্যে প্রণাশের মৃত্যু হওয়া ঠিক হবে না। মৃত্যু হবে পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে।

 

প্রণাশের মৃত্যু
(Final version)

নেত্রকোনা থেকে প্রণাশের বাবা অবিনাশ বাবু এসেছেন। ছেলেকে নিয়ে তিনি দুঃস্বপ্ন দেখেছেন বলেই ঢাকায় আসা। দুঃস্বপ্নটা ভয়ঙ্কর। কালো রঙের একটা কুকুর এসে কামড়ে কামড়ে প্রণাশকে খাচ্ছে। প্রণাশ চিৎকার বা কান্নাকাটি করছে না। প্রণাশ চেয়ারে বসে তার ছেলের হোম ওয়ার্ক দেখছিল। কুকুর তার বাঁ পাটা হাঁটু পর্যন্ত খেয়ে ফেলার পর সে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ডান পা এগিয়ে দিল।

এই পর্যন্ত লিখেই রুস্তমকে লেখা বন্ধ করতে হলো। কারণ মুনিয়া ফুপিয়ে কাঁদছে। রুস্তম অবাক হয়ে বলল, কি হয়েছে?

স্যার পিঁপড়ায় কামড়াচ্ছে। মেঝে ভর্তি লাল পিঁপড়া।

নিজের ঘরে চলে যাও। ঘরে গিয়ে আরাম করে ঘুমাও।

আমার ঘরে আরও বেশি পিঁপড়া। বিছানাতেও পিঁপড়া।

ভালো সমস্যা হলো তো।

স্যার আমি আপনার খাটের এক কোনায় পড়ে থাকি। আপনার খাটটা অনেক বড়। আপনি টেরও পাবেন না খাটে আর কেউ আছে। স্যার খাটে শোব?

আচ্ছা।

মুনিয়া খাটে উঠে এলো। রুস্তম প্রণাশের মৃত্যুর ফাইনাল ভার্সান লিখতে লাগল।

স্যার একটা কথা বলব?

কাজ করছি মুনিয়া, এখন কথা বন্ধ।

বেশিক্ষণ কথা বলব না। এক মিনিট। আপনাকে যে শিল্পকটা দিয়েছিলাম ভাঙাতে পারেন নাই। তাই না?

কোন শিল্লুক?

ঐ যে, আমি থাকি জলে আর তুমি থাকো স্থলে…।

না।

সহজ দেখে একটা দেব স্যার। শিল্লুকটা ভাঙালেই আপনি জানতে পারবেন আমি কাকে বিয়ে করেছি।

মুনিয়া শোনো, আমার জানতে ইচ্ছা করছে না। গোপন বিষয় গোপন থাকা ভালো।

স্যার আমার খুব বলতে ইচ্ছা করছে। তাহলে বলল।

বাতি জ্বালা থাকা অবস্থায় আমি বলতে পারব না স্যার। আমার লজ্জা লাগবে। আপনি বাতিটা নেভান আমি বলছি।

তাহলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। আমি লেখা শেষ করে বাতি নেভাব তারপর বলবে।

জি আচ্ছা। আমি জেগে থাকব।

একটা শব্দ করতে পারবে না। খুব মন দিয়ে লিখি তো, সামান্য শব্দতেও কনসানট্রেশান এলোমেলো হয়ে যায়।

আমি কোনো শব্দ করব না। নিঃশ্বাসও ফেলব সাবধানে। আপনি বললে নিঃশ্বাসও ফেলব না।

রাত তিনটায় রুস্তম লেখার টেবিল থেকে উঠল। অপেক্ষা করতে করতে মুনিয়া ঘুমিয়ে গেছে। রুস্তম দুটা ঘুমের ট্যাবলেট খেল। রেণুবালা বলে দিয়েছেন ওষুধ খাবার আধঘণ্টা পর বিছানায় যেতে। আধঘণ্টা চুপচাপ অপেক্ষা করা।

বাথরুমের বেসিনে শব্দ হচ্ছে। রুস্তম বলল, কে?

বাথরুম থেকে গম্ভীর গলায় জবাব এলো, জনাব আমি।

আপনি কে?

আমি হাজি আসমত উল্লাহ। আপনার কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছিলাম।

এখানে কি করেন?

অজু করছি জনাব। অজু করে তাহজুতের নামাজ পড়ব।

রুস্তম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। আধঘণ্টা অপেক্ষা না করে তার উচিত এখনই বিছানায় যাওয়া।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ