চারতলা এই বিরাট বাড়িটায় স্বামী-স্ত্রী ছাড়া ঠাকুর-চাকর-আয়া জনা পাঁচেক ছিল। চাকরবাকরেরা নিচের তলাতেই কিছুটা অংশ অধিকার করে আছে। তাছাড়া নিচের তলায় বিরাট। একটা হলঘরের মত—তার এক পাশ দিয়েই চারতলা পর্যন্ত সিঁড়িটা উঠে গিয়েছে, হলঘরটার মধ্যে ঢুকলেই চারপাশে চোখে পড়ে স্টাফ করা কতকগুলো জন্তুজানোয়ার—বাঘ, রয়েল বেঙ্গল, চিতা আর শিংওয়ালা হরিণ। অরিন্দম বক্সীর শিকারের সখ যেমন ছিল, রাইফেল চালাতেও তেমনি ছিলেন তিনি সুদক্ষ। জীবনে অনেক শিকার করেছেন তিনি। আর তারই স্মৃতিচিহ্ন ঐ বাড়িটার মধ্যে চারিদিকে ছড়ানো। হঠাৎ ঐ হলঘরে, বিশেষ করে রাত্রিবেলা প্রবেশ করলে গা যেন কেমন ছমছম করে ওঠে। বিরাট বিরাট জানালাগুলো সব সময়ই প্রায় বন্ধ থাকায় দিনের বেলাতেও সেখানে একটা আলোছায়ার লুকোচুরি চলে যেন। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলে একটা চওড়া বারান্দা—তার সংলগ্ন পাশাপাশি খানচারেক বড় সাইজের ঘর এবং মধ্যে একটি হলঘর। ঐ দোতলার হলঘরটিই অরিন্দম বক্সীর পারলার ছিল। সেকেলে মেহগনি পালিশ সেগুন কাঠের ভারী ভারী সব ফার্নিচার বিরাট একটি টেবিল ডিম্বাকৃতি, ভারী ভারী খানকয়েক সেকেলে চেয়ার গদীমোড়া। তারই একপাশে অনন্য বক্সীর বাবা অনিন্দ্য বক্সী বার কাউন্টার তৈরি করেছিলেন। কাউন্টারের দুপাশে কাঁচের আলমারিতে এখনও কিছু বোতল সাজানো আছে—হুইস্কি, ব্র্যান্ডি, শেরি, বার্গন্ডি।

অনিন্দ্য বক্সীকে রাঁচী মেনটাল হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার পর থেকে ঐ আলমারি দুটো আর খোলা হয় না-চাবি দেওয়াই আছে। মেঝেতে পুরু কার্পেট বিছানো। অনন্য ঐ ঘরে বড় একটা ঢোকে না—ঢোকবার তার প্রয়োজনও হয় না। পুরাতন ভৃত্য পরেশ প্রত্যহ ঐ ঘরটা ও ফার্নিচারগুলো ঝাড়পোঁচ করে, তাই সব ঝকঝক করে। অনন্য ও বিপাশার পিছনে পিছনে। পরেশও সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে আসে। দোতলায় খান-দুই ঘর নিয়ে স্বামী-স্ত্রী থাকে। একটা বেডরুম, অন্যটা তাদের সিটিংরুম। সিটিংরুমটা অনন্য আধুনিক কিছু ফার্নিচার কিনে সাজিয়ে নিয়েছিল। অন্য একটি ঘরে অনিন্দ্য লাইব্রেরি করেছিলেন। আলমারি ভর্তি সব দেশী-বিলাতী লেখকদের বই আর অনিন্দ্যর আইনের বই। ঐ লাইব্রেরি ঘরটাও বন্ধ থাকে সর্বদা। অন্য ঘরটিকে অনন্য ডাইনিংরুম করেছিল। তিনতলা ও চারতলার ঘরগুলো সবর্দা তালাবন্ধই থাকে। বিপাশা এ বাড়িতে আসবার পর মধ্যে মধ্যে ঘরগুলো খুলে ঝেড়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করে রাখে পরেশকে দিয়ে। বাড়ির পশ্চাৎদিকে কিছুটা জমি আছে নানা গাছগাছালি আছে সেখানে। সামনের অংশে ছোট্ট একটি লন মত। সেখানেও কিছু ফুলের গাছ আছে—মালী নিতাই সব দেখাশুনা করে।

অনন্য ও বিপাশা এসে তাদের ঘরে ঢুকল।

পরেশ বললে, মা, গরম জল দেব কি বাবুর বাথরুমে?

বিপাশা বললে, হ্যাঁ, দাও।

ঐদিনই রাত্রির আহার শেষ করে অনন্য গিয়ে শয়নঘরের সংলগ্ন ব্যালকনিতে বসে ছিল একটা বেতের চেয়ারে। বিপাশা শাড়ি বদল করে সেখানে এসে স্বামীর পাশে দাঁড়াল। মেন গেটের বাইরে সামনের রাস্তাটা ঐ ব্যালকনি থেকে অনেকটা চোখে পড়ে। রাত দশটা মত হবে—রাস্তার ইলেকট্রিক আললাগুলো দেখা যাচ্ছে। মধ্যে মধ্যে একটা-আধটা গাড়ি এদিক থেকে ওদিকে ছুটে যাচ্ছে।

অনন্য অন্যমনে রাস্তার দিকে চেয়ে ছিল।

বিপাশা এসে স্বামীর কাঁধের উপর একখানি হাত রাখল।

বিপাশা!

শোবে না? বিপাশা শুধাল।

হ্যাঁ শোব, কিন্তু—

চল ওষুধটা খেয়ে শুয়ে পড়বে চল।

আর একটু বসি। বোস না ঐ চেয়ারটায়।

বিপাশা স্বামীর পাশে বসল চেয়ারটা টেনে নিয়ে।

আচ্ছা বিপাশা, কে এসেছিল বল তো? অনন্য বলল হঠাৎ।

হয়ত তোমার চেনাশোনা কোন বন্ধু হবে—

বন্ধু বলতে তেমন আমার কেউ নেই, তুমি তো জান বিপাশা। আমি ভাবছি, তোমার কোন পরিচিত কেউ আসেনি তো!

আমার?

হ্যাঁ, তোমার—

আমারই বা তেমন কে আছে?

আচ্ছা বিপাশা–

কি?

বিয়ের আগে তোমার আমার সঙ্গে ছাড়া কারও সঙ্গে আলাপ ছিল না?

অন্ধকারে বিপাশা স্বামীর মুখের দিকে তাকাল, কি যেন মুহূর্তকাল ভাবল, তারপর বললে, সেরকম কেউ থাকলে কি তুমি জানতে না অনন্য?

বাঃ, সব কিছুই তোমার আমি জানি নাকি!

জান না?

না—আর তাই কি সম্ভব! তোমাদের বাড়ি ছিল ভবানীপুরে আর আমি থাকতাম এখানে এই বালীগঞ্জ সারকুলার রোডের বাড়িতে। তাছাড়া রোজ রোজ তোমার ওখানে যেতামও না। তোমাদের কলেজ ছিল কো-এড়ুকেশন—ছেলে-মেয়েরা সব একসঙ্গে পড়তে তোমরা কলেজলাইফে কারও সঙ্গে তোমার আলাপ পরিচয় হয়নি?

তা হবে না কেন!

তবে?

তবে সেরকম ঘনিষ্ঠতা একমাত্র তুমি ছাড়া কারও সঙ্গেই আমার হয়নি।

হয়নি না? ওঃ! অনন্য হঠাৎ চুপ করে যায়।

আশ্চর্য, অনন্য একটা কথা আজও বিপাশাকে বলতে পারেনি করতে পারেনি বিশেষ একটি প্রশ্ন—যে প্রশ্নটা বিবাহের পর থেকেই তার মনের মধ্যে উঁকি দিতে শুরু করেছে তার সঙ্গে বিপাশার যেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল, আর কারোর সঙ্গেই কি তেমনি ছিল না?

কলেজে লেখাপড়া করেছে বিপাশা আর তাদের বাড়িটাও ছিল রীতিমত আধুনিকভাবাপন্ন ছেলেমেয়েদের মেলামেশার অবাধ অধিকার ছিল। সেক্ষেত্রে আর কারও সঙ্গে বিপাশার আলাপ থাকাটাও খুব বিচিত্র নয়।

বিপাশাকে প্রশ্নটা করতে অনন্যর যেন কেমন সংকোচ হয়েছে। তাছাড়া মনের মধ্যে যে কথাটা আনাগোনা করছে—হঠাৎ ঐ ধরনের প্রশ্নটা তার মনের মধ্যে জাগছেই বা কেন ইদানীং? বিপাশাকে কি সে চেনে না, বিয়ের আগে ঐ প্রশ্নটা কোন দিনই তার মনে জাগেনিহঠাৎ বিয়ের কিছুদিন পর থেকে সে প্রশ্নটা তার মনের মধ্যে আসছেই বা কেন? বিব্রত বোধ করে অনন্য। রীতিমত যেন বিব্রত বোধ করে মধ্যে মধ্যে। অথচ ঐ চিন্তাটার হাত থেকে সে যেন নিষ্কৃতি পায় না—পাচ্ছে না কিছুতেই।

অনন্য!

বিপাশার ডাকে অনন্য ওর মুখের দিকে তাকাল।

গতমাসেও তুমি রাঁচী গেলে না, এ মাসেও এখন পর্যন্ত গেলে না একটিবার বাবাকে দেখতে–

ভাল আছেন খবর তো পেয়েছি, অনন্য বললে।

তাহলেও একটিবার যাওয়া তো উচিত!

জানি, কিন্তু–

কি?

ওখানে গেলে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই কেমন যেন একটা ভয়—

ভয় কিসের ভয়?

জানি না, কেমন যেন একটা ভয় একটা ক্লেদাক্ত ঠাণ্ডা সরীসৃপের মত আমার সর্বাঙ্গকে বেষ্টন করে ধরে

এসব কি বলছ তুমি অনন্য?

হ্যাঁ, তুমি জানতোমাকে কখনও আমি বলিনি–বাবার চোখ দুটো যেন মনে হয় সাপের চোখ, এমনভাবে উনি আমার দিকে চেয়ে থাকেন—আমি যেন কেমন সম্মোহিত হয়ে পড়ি।

কি যে তুমি আবোল-তাবোল বল না অনন্য!

অনন্য বিপাশার কথার কোন জবাব দেয় না।

তুমি বড্ড আজেবাজে চিন্তা কর অনন্য। ডাঃ দাশগুপ্ত বলছিলেন, শুনলে তোঐসব চিন্তা থেকেই তোমার মনে ঐসব জাগে!

জান বিপাশা–

কি?

কুয়াশার মধ্যে যে চাপা ফিস ফিস কণ্ঠস্বর আমি শুনতে পাই, ঠিক যেন মনে হয় বাবার গলার মত–

থাক ওসব বাজে কথা—

বাজে নয় বিপাশা, সত্যি মনে হয় যেন ঠিক বাবারই গলা শুনছি—তিনিই কথা বলছেন—

চল অনেক রাত হল, এবারে শোবে চল।

হ্যাঁ  চল, অসম্ভব ঘুম পাচ্ছে—

দুজনে এসে ঘরের মধ্যে ঢুকল। বিপাশা ড্রয়ার খুলে একটা লাল রংয়ের ক্যাপসুল ও এক গ্লাস জল এনে দিল। বললে, নাও এটা খেয়ে শুয়ে পড় এবার।

হাত বাড়িয়ে ক্যাপসুলটা নিয়ে সেটা মুখে দিয়ে জল খেল অনন্য।

যাও এবারে শুয়ে পড়।

তুমি শোবে না?

আমার একটু কাজ আছে।

কি কাজ আবার তোমার এত রাত্রে?

বাঃ, তুমি জান না বুঝি—আমি রাত্রে শোবার আগে স্নান করি না!

স্নান?

হ্যাঁ।

রোজ স্নান কর?

করি তো।

অনন্য কিছুক্ষণ কেমন যেন চেয়ে থাকে বিপাশার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে।

কি দেখছ অমন করে আমার মুখের দিক চেয়ে?

কিছু না।

অনন্য এগিয়ে গিয়ে শয্যায় শুয়ে পড়ল।

ঘরের উজ্জ্বল আলোটা নিভিয়ে কম পাওয়ারের নীলাভ আলোটা জ্বেলে দিল বিপাশা। ঘরের মধ্যে যেন একটা নীলাভ প্রশান্তি নেমে আসে।

বিপাশা ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের মধ্যে গিয়ে ঢুকল দরজাটা ভেজিয়ে দিল মাত্র ভিতর থেকে।

সত্যি রাত্রে শয়নের পূর্বে স্নান না করলে বিপাশার ঘুম আসে না। জামা কাপড় খুলে বিপাশা শাওয়ারের নিচে এসে দাঁড়াল।

অন্যমনস্ক ভাবে বিপাশা অনন্যর কথাই ভাবছিল তখনও।

আজ ঐ কথাগুলো বলল কেন অনন্য!

ঐ ধরনের কথা তো ইতিপূর্বে কখনও সে বলেনি! মনে হচ্ছিল অনন্যর কথাগুলো শুনে, তার মনের মধ্যে কোথায় যেন কিসের একটা সংশয় আছে, একটা সন্দেহ আছে। অনন্য কি তাকে সন্দেহ করে? আজ এত বছর এত ঘনিষ্ঠতার পর তার মনের মধ্যে সন্দেহ জাগল? অনন্য কি জানে না তার সমস্ত মন জুড়ে রয়েছে একজনই আর সে অনন্য। হ্যাঁ—অনেকের সঙ্গে হলেও কয়েকজনের সঙ্গে সে মিশেছে, তারা তাদের ভবানীপুরের বাড়িতে আসতও। বিশেষ করে একজন—রজতশুভ্র। মনের মধ্যে হাতড়াতে থাকে বিপাশা, রাজতশুভ্রের প্রতি তার কি। কোন দুর্বলতা ছিল কোন দিন? কই, মনে তো পড়ছে না। অবিশ্যি তার ওপরে রজতশুভ্রর যে দুর্বলতা ছিল সেটা সে বুঝতে পেরেছিল।

রজতশুভ্রর হাবভাবে কথায় বার্তায় সব সময়েই সেটা প্রকাশ হয়েই পড়ত—কিন্তু সতর্ক থাকত বিপাশা সর্বদা, রজতকে কখনও এতটুকু প্রশ্রয় দেয়নি। কথাটা কখনও তার মনেও হয়নি। রজতকেও সে-কথাটা জানিয়ে দিয়েছিল বিপাশা—অনন্যকে ভালবাসে সে, একদিন তাদের বিয়ে হবে। বিপাশার বাবা নিবারণ চক্রবর্তী ছিলেন অনিন্দ্য বক্সীর দীর্ঘকালের বন্ধু—সেই সূত্রেই দুই বাড়ির লোকেদের মধ্যে যাতায়াত ছিল। বিপাশার সঙ্গে ক্রমশ অনন্যর ঘনিষ্ঠতা যখন বেড়ে উঠতে থাকে—নিবারণ চক্রবর্তী কিন্তু একদিন মেয়েকে ডেকে একটা কথা বলেছিলেন। সেদিনের সেই কথাতেই বিপাশা বুঝতে পেরেছিল, অনন্যর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা নিবারণ চক্রবর্তী ঠিক পছন্দ করেন না।

খুকী, একটা কথা অনেকদিন থেকেই তোকে বলব বলব ভাবছি—

কি কথা বাবা?

তুই কি তোর মনস্থির করে ফেলেছিস?

কি বিষয়ে?

অনন্য সম্পর্কে?

হ্যাঁ, আমরা বিয়ে করব।

ঠিকই করে ফেলেছিস যখন—

কি তুমি বলতে চাও বল না বাবা?

না, থাক—

থাকবে কেন, বল?

ওর বাবা কেন পাগল হয়ে গেলেন জানিস?

না, ও কখনও বলেনি সেকথা আর আমিও জিজ্ঞাসা করি না।

জিজ্ঞাসা যখন করিস নি, থাক গে সেকথা—

বাবা!

কি রে?

তোমার কি ইচ্ছা নয় ওর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়?

ছেলের মত ছেলে ও, সব দিক দিয়েই সুপাত্র—

তবে?

নিবারণ চক্রবর্তী আর কোন কথা বলেন নি।

কথাটার ঐখানেই সমাপ্তি ঘটেছিল।

আজ মনে পড়ছে বিপাশার, বিয়ের আগে অনন্য তার মায়ের মৃত্যুর কথাটা বলেছিল এবং বলেছিল একদিন কি, এক দুর্ঘটনায় নাকি তার মৃত্যু হয় তার বেশী সেও কিছু বলেনি, ও নিজেও জিজ্ঞাসা করেনি জিজ্ঞাসা করবার কথাও তার মনে হয়নি। কিন্তু আজ ডাঃ দাশগুপ্ত কথাটা জিজ্ঞাসা করেছিলেন কি দুর্ঘটনা। ডাঃ দাশগুপ্তের চেম্বার থেকে ফিরে আসা অবধি সেই কথাটাই কেন না জানি মনে হচ্ছে বিপাশার। কি এমন দুর্ঘটনায় তার শাশুড়ির মৃত্যু হয় আর কেনই বা স্ত্রীর মৃত্যুর কিছুদিন পরেই অনিন্দ্য বক্সী—তার শ্বশুরের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটল? অনন্য তাকে একদিন কথায় কথায় বলেছিল, বাবা তার মাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন—সেরকম ভালবাসা নাকি সচরাচর বড় একটা দেখা যায় না, তাই তিনি স্ত্রীর অকালমৃত্যুর আঘাতটা সহ্য করতে পারেন নি এবং তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে!

অবিশ্বাস করবার মত কিছু নেই কথাটার মধ্যে–হতেও পারে অমন।

অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে বিপাশার যেন কেমন শীত-শীত বোধ হয়। বাথরুমে থেকে বের হয়ে এল বড় ভোয়ালেটা গায়ে জড়িয়ে। ঐ অবস্থাতেই শয্যার পাশে গিয়ে স্বামীকে লক্ষ্য করল—অনন্য ঘুমিয়ে পড়েছে। আসলে কোন নতুন ঘুমের ওষুধ দেয়নি বিপাশা অনন্যকে, লিপাটন ক্যাপসুল একটা দিয়েছিল—ডাঃ দাশগুপ্তর পরামর্শ মতই ওষুধের নামটা বলেনি ওকে–ডাঃ দাশগুপ্ত যেমন বলে দিয়েছেন তেমনি বলেছে বিপাশা।

শাড়ি ব্লাউজ পরে বিপাশা এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল। আবছা নীল আলোতেই সে চিরুনি দিয়ে চুলটা আঁচড়ায়, গায়ে একটু স্প্রে দিল।

ইদানীং রাত্রে বড় একটা ঘুমায় না বিপাশা। রাত দুটোর পরে ঠিক জেগে ওঠে, অনন্য–কয়েকদিন ঘুম-ঘুম চোখেই শয্যা থেকে নেমে সিঁড়ি দিয়ে অনন্য ছাতে উঠে গিয়েছিল। ঐ সময়টা সম্পূর্ণ জ্ঞান থাকে না ওর, তাই ডাক্তারের নির্দেশ ছিল বিপাশা যেন তার স্বামীকে যথাসম্ভব চোখে চোখে রাখে। ঘরের দরজা ভিতর থেকে ওরা বন্ধ করেই শুত।

প্রথম যে-রাত্রে বিপাশা ব্যাপারটা জানতে পারে—হঠাৎ ওর ঘুমটা দরজার লক খোলার শব্দেই ভেঙে গিয়েছিল, ও দেখতে পায় অনন্য শয্যা থেকে নেমে দরজার দিয়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলছে; দরজা খুলতে দেখে ও প্রশ্ন করে, দরজা খুলে কোথায় যাচ্ছ অনন্য এত রাত্রে?

স্বামীর দিক থেকে কোন সাড়া এল না।

আবার ও বলে, কি হল, দরজা খুলছ কেন এত রাত্রে?

দ্বিতীয়বারেও স্বামীর দিক থেকে কোন সাড়া না পেয়ে ও সঙ্গে সঙ্গে শয্যা থেকে উঠে পড়ে, অনন্য ততক্ষণ দরজা খুলে বের হয়ে গিয়েছে ঘর থেকে।

বিপাশা রীতিমত বিস্মিত হয়। স্বামীর পিছনে পিছনে বিপাশাও ঘর থেকে বের হয়ে আসে।

হাত পাঁচেক দূরে অনন্য।

অনন্য সিঁড়ির দিকে চলেছে এগিয়ে পায়ে পায়ে। কেমন যেন শ্লথ মন্থর গতি চলার। পা যেন ঠিক সমতালে পড়ছে না।

পিছন থেকে আবারও ডাকে বিপাশা, অনন্য-অনন্য!

অনন্য সাড়া দেয় না। অনন্য সোজা সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠতে থাকে।

এত রাত্রে তিনতলায় কি করতে যাচ্ছে অনন্য? নিঃশব্দে অনুসরণ করে বিপাশা অনন্যকে।

অনন্য একটার পর একটা সিঁড়ি ভেঙেই চলেছে উপরের দিকে তিনতলা থেকে চারতলা তারপর ছাত। ছাতে পৌঁছে অনন্য সোজা রেলিংয়ের দিকে এগিয়ে চলে।

রেলিংয়ের উপরে ভর দিয়ে অনন্য নিচের দিকে ঝুঁকে পড়তেই বিপাশা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে অনন্যকে দুহাতে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে, অনন্য?

অনন্যর শরীরে তখন যেন মত্ত হাতির শক্তি। দুহাতে প্রাণপণে বুকের ওপরে জাপটে ধরে বিপাশা চেঁচায়, অনন্য—অনন্য? কি–কি করছ–কি হয়েছে?

কে?

আমি—আমি বিপাশা।

বিপাশা!

হ্যাঁ!

ছাতে কেন?

তুমিই তো এলে। চল নিচে।

চল—

নিচে চলে আসে দুজনে।

খাটের ওপর বসে অনন্য। বলে, জল দাও।

এক গ্লাস জল পান করে একচুমুকে অনন্য যেন কতকটা সুস্থ হয়।

কি হয়েছিল—উপরে ছাতে গিয়েছিল কেন?

সেই কুয়াশাটা— কুয়াশা!

হ্যাঁ, সেই কুয়াশাটা যেন আমাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছিল—সেই দড়ির ফাঁসটা যেন আমার গলায় চেপে বসেছিল আর—সেই কণ্ঠস্বর আমাকে আমাকে বোধ হয় শেষ পর্যন্ত গলায় ফাঁস দিয়েই মরতে হবে বিপাশা–

সহসা দুহাতে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে বিপাশা না, না—ওগো না।

Nihar Ranjan Gupta ।। নীহাররঞ্জন গুপ্ত