আঁধার রাতের পাগল

সুব্রত শংকরবাবুর সঙ্গে গোপন পরামর্শ করে অলক্ষ্যে চানকের ওপরে দুজন সাঁওতালকে সর্বক্ষণ পাহারা দেবার জন্য নিযুক্ত করল।

বিকালের দিকে সুধাময়বাবুর সেক্রেটারী কলকাতা থেকে তার করে জবাব দিলেনঃ কর্তা বর্তমানে কলকাতায় নেই। তিনি যা ভাল বোঝেন তাই করুন। কর্তা কলকাতায় ফিরে এলেই তাঁকে সংবাদ দেওয়া হবে। তবে কর্তার হুকুম আছে কোন কারণেই যেন, যত গুরুতরই হোক খনির কাজ না বন্ধ রাখা হয়।

রাতে শংকর সুব্রতকে জিজ্ঞাসা করল, কী করা যায় বলুন, সুব্রতবাবু। কাল থেকে তা হলে আবার খনির কাজ শুরু করে দিই?

হ্যাঁ দিন। দুচার দিনের মধ্যে আমার তো মনে হয়। আর খুনটুন হবে না।

শংকর হাসতে হাসতে বললে, আপনি গুণতে পারেন নাকি সুব্রতবাবু?

না, গুণতে ফুনতে জানি না মশাই। তবে চারিদিককার হাবভাব দেখে যা মনে হচ্ছে তাই বলছি মাত্র। বলতে পারেন স্রেফ অনুমান।

যাহোক, শংকর খনির কাজ আবার পরদিন থেকে শুরু করাই ঠিক করলে এবং বিমলবাবুকে ডেকে যাতে আগামী কাল ঠিক সময় থেকেই নিত্যকার মত খনির কাজ শুরু হয়। সেই আদেশ দিয়ে দিল।

বিমলবাবুকঁচুমাচু ভাবে বললে,আবার ঐ ভূতপ্ৰেতগুলোকে চটাবেন স্যার। আমি আপনার most obedient servant, যা দেবেন, with life তাই করবো। তবে আমার মতে এ খনির কাজ চিরদিনের মতো একেবারে বন্ধ করে দেওয়াই কিন্তু ভাল ছিল স্যার। ভূতপ্রেতের ব্যাপার। কখন কি ঘটে যায়।

শংকর হাসতে হাসতে উত্তর দিল, ভূতেরও ওঝা আছে বিমলবাবু। অতএব মা ভৈষী। এখন যান সব ব্যবস্থা করুনগে যাতে কাল থেকে আবার কাজ শুরু করতে পারে।

কিন্তু স্যার।

যান যান রাত্রি হয়েছে। সারারাত কাল ঘুমুতে পারিনি।

বেশ। তবে তাই হবে। আমার আর কী বলুন? আমি আপনাদের most obedient and humble servant বইত নয়।

বিমলবাবু চলে গেলেন।

বাইরে শীতের সন্ধ্যা আসন্ন হয়ে এসেছে। সুব্রত কোমরে রিভলভারটা গুঁজে গায়ে একটা কালো রঙের ফারের ওভারকেট চাপিয়ে পকেটে একটা টর্চ নিয়ে বাংলোর বাইরে এসে দাঁড়াল।

পায়ে চলা লাল সুরকির রাস্তাটা কয়লা গুড়োয় কালচে হয়ে ধাওড়ার দিকে বরাবর চলে গেছে।

সুব্রত এগিয়ে চলে, পথের দুপাশে অন্ধকারের মধ্যে বড় বড় শাল ও মহুয়ার গাছগুলো প্রেতিমূর্তির মত নিঝুম হয়ে যেন শিকারের আশায় দাঁড়িয়ে আছে। পাতায় পাতায় জোনাকির আলো, জ্বলে আর নিভে, নিভে আর জ্বলে। গাছের পাতা দুলিয়ে দূর প্রান্তর থেকে শীতের হিমের হাওয়া হিল হিল করে বহে যায়।

সর্বাঙ্গ শির শির করে ওঠে।

কোথায় একটা কুকুর শীতের রাত্রির স্তব্ধতা ছিন্ন ভিন্ন করে মাঝে মাঝে ডেকে ওঠে।

সুব্ৰত এগিয়ে চলে।

অদূরে পাঁচ নম্বর কুলি-ধাওড়ার সামনে সাঁওতাল পুরুষ ও রমণীরা একটা কয়লার অগ্নিকুণ্ড জেলে চারিদিকে গোলাকার হয়ে ঘিরে বসে কী সব শলা পরামর্শ করছে। আগুনের লাল আভা সাঁওতাল পুরুষগুলোর খোদাই করা কালো পাথরের মত দেহের ওপরে প্রতিফলিত হয়ে দানবীয় বিভীষিকায় যেন রূপায়িত হয়ে উঠেছে।

তারও ওদিকে একটা বহু পুরাতন নীল-কুঠির ভগ্নাবশেষ শীতের ধুম্রােচ্ছন্ন অন্ধকারে কেমন ভৌতিক ছায়ার মতই অস্পষ্ট মনে হয়।

চারিদিকে বোয়ান গাছের জঙ্গল, তারই পাশ দিয়ে শীর্ণকায় একটি পাহাড়ী ক্ষুদ্র নদী, তার শুষ্কপ্রায় শুভ্র বালু-রাশির উপর দিয়ে একটুখানি নির্মল জলপ্রবাহ শীতের অন্ধকার রাতে এঁকে বেঁকে আপনি খেয়াল খুশিতে অদূরবর্তী পলাশ বনের ভিতর দিয়ে বির বির করে কোথায় বহে চলেছে কে জানে?

পলাশ বনের উত্তর দিকে ৬ ও ৭ নম্বর কুলি ধাওড়া। সেখান থেকে মাদল ও বাঁশীর আওয়াজ শোনা যায়।

সহসা অদূরবর্তী মহুয়া গাছগুলির তলায় ঝরা পাতার ওপরে একটা যেন সজাগ সতর্ক পায়ে চলার খস-সি শব্দ পেয়ে সুব্রত থমকে দাঁড়িয়ে গেল।

বুকের ভিতরকার হৃদপিণ্ডটা যেন সহসা প্রবল এক ধাক্কা খেয়ে থমকে থেমে গেল।

পকেটে হাত দিয়ে সুব্রত টাৰ্চটা টেনে বের করল।

যে দিক থেকে শব্দটা আসছিল ফস করে সেই দিকে আলোটা ধরেই বোতাম টিপে দিল।

অন্ধকারের বুকে টর্চের উজ্জ্বল আলোর রক্তিম আভা মুহূর্তে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে অট্টহাসি হেসে ওঠে।

কিন্তু ও কে?…অন্ধকারে পলাশ গাছগুলোর তলায় বসে অন্ধকারে কী যেন গভীর মনোযোগের সঙ্গে খুঁজছে।

আশ্চর্য। এই অন্ধকারে পলাশ বনের মধ্যে আমন করে লোকটা কী খুঁজছে?

সুব্ৰত এগিয়ে গেল। লোকটা বোধ করি পাগল হবে।

এক মাথা বঁকড়া বঁকড়া এলোমেলো বিস্রস্ত জট পাকান চুল। মুখ, ধূলো বালিতে ময়লা হয়ে গেছে এবং মুখে বিশ্ৰী দাড়ি। গায়ে একটা বহু পুরাতন ওভারকেট, শতছিন্ন ও শত জায়গায় তালি দেওয়া। পিঠে একটা ন্যাকড়ার ঝুলি, পরনেও একটা মলিন প্যান্ট।

সুব্রত টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে লোকটার দিকে এগিয়ে যায়।

এই, তুই কে রে? সুব্রত জিজ্ঞাসা করে।

কিন্তু লোকটা কোন জবাবই দেয় না। সুব্রতর কথায় শুকনো ঝরে পড়া শালপাতাগুলো একটা ছোট লাঠির সাহায্যে সরাতে সরাতে কী যেন আপন মনে খুঁজে বেড়ায়।

এই তুই কে?

সুব্রত টর্চের আলোটা লোকটার মুখের উপর ফেলে। সহসা লোকটা চোখ দুটো বুজিয়ে চকচকে দুপাটি দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে শুরু করল।

লোকটা কেবল হাসে।

হাসি যেন আর থামতেই চায় না। হাসছে তো হাসছেই। সুব্রতও সেই হাসিভরা মুখটার ওপরে আলো ফেলে দাঁড়িয়ে থাকে নিতান্ত বোকার মতই চুপ করে।

সুব্রত আলোটা নিভিয়ে দিল।

সহসা লোকটা ভাঙ্গা গলায় বলে ওঠে, তু কি চাস বটে রে বাবু!

সুব্ৰত বোঝে লোকটা সাঁওতাল, বোধ হয় পাগল হয়ে গেছে।

তোর নাম কি? কোথায় থাকিস?

আমার নাম রাজা বটে …থাকি উই-যেথা মারাংবরু রইছে।

এখানে এই অন্ধকারে কি করছিস?

তাতে তুর দরকারডা কী? যা ভাগ।

সুব্রত দেখলে সরে পড়াই ভাল। পাগল। বলা তো যায় না। সুব্ৰত সেখান থেকে চলে এল।

পলাশ বন ছাড়ালেই ৬ নং কুলীর ধাওড়া।

রতন মাঝি সেখানেই থাকে।

পলাশ ও শালবনের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় কুলিধাওড়ার সামনে প্ৰজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের লাল রক্ত আভাস।

মাদলের শব্দ কানে এসে বাজে, ধিতাং! ধিতাং!

সঙ্গে সঙ্গে বাঁশীতে সাঁওতালী সুর।

সারাদিন খাদে ছুটি গেছে, সব আনন্দ উৎসবে মত্ত হয়ে উঠেছে।

ধাওড়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা কালো কুকুর ঘেউ-উ-উ করে ডাকতে ডাকতে তেড়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি সাঁওতাল যুবক এগিয়ে এল, কে বটে। রে? আঁধারে ঠাওর করতে লারছি। রা করিস না কেনে?

রতন মাঝি আছে? সুব্রত কথা বলে।

আরে বাবু। ও পিনটু, বাবুকে বসবার জায়গা দে। বসেন আইজ্ঞ। রতন মাঝি সুব্রতর সামনে এগিয়ে আসে।

আধো আলো আধো আঁধারে মাঝির পেশল কলো দেহটা একটা যেন প্রেতের মতই মনে হয়।

কিছু সংবাদ আছে মাঝি?

না বাবু। সারাটি দিনমানই রইলাম বটে।

সুব্রত আরো কিছুক্ষণ রতন মাঝির সঙ্গে দুচারটা আবশ্যকীয় কথা বলে ফিরল।

Nihar Ranjan Gupta ।। নীহাররঞ্জন গুপ্ত