৪. চক্ষু মেলিয়া

ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিলাম । এবার পলাইতে হইবে । রাত্রিবাস করিতে হইলে সত্যই বন্দী হইব ।  আমি বলিলাম, মাতাজি এবার আমাকে যাইতে হইবে । বলিয়াই, নির্ণয় লইলাম, নির্মলের গৃহ বাঙালিটোলা বলিব না । আমাকে যদি পরে আবার সেথায় খোঁজ করিতে যায়, হয়ত পুনরায় ধরিয়া আনিবে ।

প্রৌঢ়া জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় যাইবেন ভগবানজি মহারাজ ? আমি বলিলাম, সংকটমোচন যাইব । তথায় পূন্যার্থীদের ভিড়ে মিশিয়া, কিয়ৎসময় অতিবাহিত করিয়া , নির্মল রক্ষিতের আস্তানার উদ্দেশ্যে রিকশায় যাত্রা করিব ।

মহিলা হাঁক পাড়িয়া  ভূষণ নামক কোনো ব্যক্তিকে ডাকিলে, জনৈক ভৃত্য রৌপ্যের ট্রেতে করিয়া এক গ্লাস জল আনিল । তৃষ্ণা ছিলই । পান করিয়া কেওড়ার সুগন্ধ পাইলাম ।

ভূষণকে প্রৌঢ়া নির্দেশ করিল আমার জামা-গেঞ্জি ইত্যাদি গাড়িতে রাখিয়া দিতে, এবং জানকীরামকে বলিতে ভগবানজিসংকটমোচন মন্দিরে যাইবেন ; তজ্জন্য গ্যারাজ হইতে গাড়ি বাহির করিতে ।

ভূষণ জানাইল, জানকীরাম তাহা করিয়া রাখিয়াছে, ভগবানজি মহারাজের জামা ইত্যাদি গাড়িতে রক্ষিত হইয়াছে এবং বড় ও ছোট মালকিন অঙ্গবস্ত্র লইয়া অপেক্ষা করিতেছেন ।

অঙ্গবস্ত্র শব্দটিশুনিয়া অস্বস্তি বোধ করিলাম । প্যান্টও খুলিয়া লইবে নাকি ইহারা ! অঙ্গবস্ত্রটি যে সিল্কের মহার্ঘ উত্তরীয় তাহা পরে বুঝিলাম, যখন প্রৌঢ়া ও ভূষণ আমাকে  আলোগোছে ধরিয়া সদর পর্যন্ত লইয়া গেল, এবং বধুদ্বয় আমার দেহে অঙ্গবস্ত্রটি জড়াইয়া গাড়ির পিছনের সিটে বসাইয়া দিল ।

গাড়ির দরজা বন্ধ হইতে, এবং জানকীরাম গাড়ি স্টার্ট করিলে, আশ্বস্ত হইলাম , যাক কেহ সঙ্গে যাইতেছে না । কিন্তু গাড়িটি স্টাটফ দিতেই বৃদ্ধ ব্যক্তিটি ও প্রৌঢ়া উচ্চকন্ঠে ক্রন্দন আরম্ভ করিল । তাহাদের দেখাদেখি অন্যান্য সদস্যগণও কাঁদিতে লাগিল ।

আমি স্তম্ভিত । উন্মাদনার কোন শিকড় আমার উপস্হিতি হইতে জীবনরস সংগ্রহ করিতেছে ? যত দ্রুত এই ভুতগ্রস্ত অট্টালিকা হইতে পলায়ন করা যায় ততই মঙ্গল । মনে হইতেছে, পাশে রাখা পুঁটুলির আকার চৌকো ; হয়ত জামাটি ইস্ত্রি করা হইয়াছে । জানকীরাম নামাইয়া দিয়া চলিয়া গেলে পথের এক কোনে দাঁড়াইয়া পরিয়া লইব ।

সংকটমোচন মন্দিরের নিকট নামিলাম । জামার পুঁটুলিটি আমাকে দিয়া জানকীরাম আমার হাঁতুতে মাথা ঠেকাইল এবং কাঁদিতে-কাঁদিতে গাড়ি চালাইয়া চলিয়া গেল । গাড়িচালকটিও কোন বশীকরণ মন্ত্রে এই পরিবারের মস্তিষ্কবিকৃতির অংশভাক হইয়াছে তাহার রহস্যসূত্র আঁচ করিতে পারিলাম না । জানকীরাম বেশ কিছুদূর চলিয়া গেলে , মন্দিরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, উঠানটিতে তবলা হারমোনিয়াম বাজাইয়া তারস্বরে কীর্তন চলিতেছে ।

যাহারা কীর্তনের সহিত গলা মিলাইতেছে, বা হাততালি দিতেছে, তাহাদের মাঝে জনাকয় হিপিনি-অর্ধহিপিনি জনরে পড়িল । প্রত্যেককে বিশেষ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করিলাম । না, ইহারা কেহই ম্যাডেলিন করিয়েটের নয়ায় পৃথুলা বা আকর্ষণীয়া মাংসল নহে , ত্বকে সে চনমনে তেজোময়তা নাই, রোদেলা ঔজ্জ্বল্য নাই ; রৌদ্রে পুড়িয়া এই শ্বেতাঙ্গিনীগণ পীতাভ-গোলাপি রঙ হারাইয়া ফেলিয়াছে ।

পুঁটুলি হইতে জামা-গেঞ্জি লইয়া পরিব, এবং অঙ্গবস্ত্রটি উহার ভিতর বাঁধিয়া রাখিব মনস্হ করিয়া গিঁট খুলিতেই, দেখিলাম, আমার আকাশি বুশ শার্ট-গেঞ্জি নাই । তাহার পরিবর্তে হালকা বেগুনি রঙের নূতন বুশশার্ট ও নূতন গেঞ্জি । জামার ভাঁজ খুলিতে, আমার চশমাসহ আমাকে উৎসর্গীকৃত অথবা প্রণামী রৌপ্যমুদ্রাগুলি ও একশোটাকার বেশ কয়েকটি নোট মাটিতে পড়িলেও , কীর্তনের জগঝম্পে কাহারও দৃষ্টি আকর্ষণ করিল না ।

অতুলের পোস্টকার্ডটি নূত বুশশার্টের পকেটে রক্ষিত দেখিয়া দুশ্চিন্তা দূর হইল । পরিবারে কেহ যে বাংলা পড়িতে পারে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত । রৌপ্যমুদ্রাগুলি চাদরের সহিত পুঁটুলিতে বাঁধিয়া , টাকাগুলি বুকপকেটে রাখিলাম, এবং রিকশায় চাপিয়া নিকটবর্তী জুতার দোকানের উদ্দেশ্যে চলিলাম । চশমাও পরিয়া নিয়াছি ।

বাটার দোকানে নামিয়া একজোড়া চটি কিনিয়া মনে হইল জামার সহিত ধুলামাখা নোংরা প্যান্ট খাপ খাইতেছে না । রাস্তার অপরদিকে রেডিমেড জামাকাপড়ের দোকান নজরে পড়িল । তথা হইতে কালো রঙের কর্ডুরয়ের নূতন একটি প্যান্ট কিনিয়া পরিলাম । দোকানটিতে আমার মাপের এই একটিই ফুলপ্যান্ট ছিল । পুরাতন প্যান্টের ওয়াচপকেট ও পাশপকেট হইতে টাকাগুলি নূতন প্যান্টে স্হানান্তরিত করিলাম ।

প্রণামীর দুটি একশত টাকার ও কয়েকটি দশ টাকার নোট তবু অবশিষ্ট রহিল । রিকশঅলাকে বলিলাম, মদ্যের বোতল কিনিব, নিকটে দোকান থাকিলে লইয়া চল । রিকশঅলা জানিতে চাহিল যে বিলাতি মদ্য নাকি দেশি মদ্য।  বলিলাম বিলাতি, দেশিও চলিত কিন্তু হাতে যখন টাকা রহিয়াছে তখন ভালো মদ্যই পান করি । রাত্রে আর কোথায় যাইব, ওয়াইন গিলিয়া শুইয়া পড়িব । রিকশঅলা জিজ্ঞাসিল, মদ্যের দোকানের নিকটে তন্দুরি মুর্গি ও রুমালি রুটির ঢাবা আছে, তথায়ও যাইব কি ? আমি উহার প্রেরণাদায়ী অনুরোধ মঞ্জুর করিলাম । পানীয় ও খাদ্যবস্তুগুলি লইয়া নির্মলের গৃহে পোঁছাইলে, দক্ষিণার দশ টাকাগুলি ও খুচরা মুদ্রা রিকশঅলার হস্তে অর্পণ করিয়া বলিলাম, যাও, আর আজিকে খাটিও না , তুমিও অদ্য সপরিবারে আয়েস করো । রিকশঅলা কহিল, পরিবার গ্রামে থাকে হুজুর; আপনার দেয়া মজুরি লইয়া গ্রামে ঘুরিয়া আসিব, ঈশ্বর আপনাকে শত সন্তান দিন ।

দরজা খুলিয়া দিয়া নির্মলের ভৃত্য কহিল, আপনাদিগের সহিত নির্মলবাবু গিয়াছিলএন, কিন্তু দ্বিপ্রহরের খাবার খাইতে আসেন নাই , এবং কোনো খবরও পাঠান নাই ; মা বেশ চিন্তিত । আরও অনেকে খোঁজ করিয়া গিয়াছেন ।

আমি বলিলাম, মাকে জানাইতে যে এগারো বা বারোটা পর্যন্ত নির্মল ও প্রণব প্রমুখ চিত্রকরগণ ছিল আমার সহিত । তারপর জানিতে চাহিলাম, নির্মলের ভাইবোন কেহ আছে কি ? ভৃত্য কহিল, নির্মলের মাতাই কেবল আছেন । পার্টিশান করিয়া গৃহের অন্য অংশে সপরিবারে নির্মলের কাকা থাকেন, কিন্তু তাঁহাদের সহিত সদ্ভাব নাই ।

ভৃত্য প্যাসেজের আলো জ্বালিয়া দিলে, হলঘরে প্রবেশ করিলাম । হলঘরটি অন্ধকার, কোথায় যে সুইচ তাহা জানি না । প্যাসেজে আসিয়া দেখিলাম সদর বন্ধ করিয়া ভৃত্য চলিয়া গিয়াছে । পুনরায় হলঘরে প্রবেশ করিয়া, নানা আসবাব ও তাহার উপর রাখা সমাপ্ত-অসমাপ্ত তৈলচিত্র এবং ফ্রেমে বাঁধা আনকোরা ক্যানভাস ইত্যাদির পাঁজা আন্দাজমতন ঠাহর করিয়ে গেস্টরুমের দ্বারে পৌঁছাইলাম । অদ্ভুত লাগিতেছিল, শিল্পীর পৃথিবীতে প্রাকৃতিক অন্ধকারে হাতড়াইতেছি অথচ শিল্পী কত কি আঁকিয়া চতুর্দিকে ছড়াইয়া রাখিয়াছেন।

দরজাটি ঠেলিয়া টের পাইলাম তাহা বন্ধ । নির্মল ফেরে নাই। আমিও বন্ধ করিয়া যাই নাই । তালা দেয়া নহে,  তালাটি আঙটায় ঝুলিতেছে, হাত দিয়া অনুমান করিলাম । পুরানো আমলের দরজা জ্যাম হইয়া গিয়া থাকিবে ; বিরক্ত লাগিল, ক্লান্তিতে অবসন্ন বোধ করিতেছিলাম । কোথায় সামান্য মদ্য পান করিয়া ঠ্যাং ছড়াইয়া আরাম করিব, এখন দরজা বন্ধের ঝক্কি । পুঁটুলি ও বোতল মেঝেয় রাখিয়া দুই আংটা ধরিয়া ঠেলিলাম , খুলিল না । আটকাইয়া গিয়াছে অনুমান করিয়া কাঁধ দিয়া ধাক্কা দিতেই খুলিয়া গেল ।

মুখ থুবড়াইয়া পড়িতাম । কিন্তু ঘরের ভিতরে লুক্কায়িত আগন্তুক, যাহার দেহে আমার তুলনায় অধিকতর শক্তি বলিয়া প্রতিভাত হইল, অক্টোপাসের ন্যায় আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়াইয়া বিছানায় পটকাইয়া, উরুর উপর বসিয়া আমার গলা টিপিয়া ধরিল । আন্দাজ করিলাম, চশমাটি কোথাও ছিটকাইয়া পড়িল । ভয়ে আমার কন্ঠ শুকাইয়া গেল । আমার দেহে শক্তি কম নাই, আমি বেশ স্বাস্হ্যবান, কিন্তু আগন্তুক চোর বা ডাকাত আমার চেয়ে বলশালী বলিয়া তাহাকে কাবু করিতে পারিলাম না ।  অন্য কাহাকেও আক্রমণ করিবার পরিবর্তে আততায়ী ভুলবশত আমায় নিশানা বানাইয়া থাকিবে । হয়ত নির্মলের কাকা নির্মলকে শিক্ষা দিবার উদ্দেশ্যে কোনো ভাড়াটে গুন্ডা লেলাইয়া দিয়াছেন । কন্ঠ হইতে হাত দুইটা সরাইবার প্রয়াস করিতে, আততায়ী তাহা সরাইয়া আমার দুই গাল চাটিয়া দিল, এবং বেড সুইচ জ্বালাইয়া ঘর আলোকিত করিল ।

হতবাক হইয়া দেখিলাম ম্যাডেলিন করিয়েট , আমার উরুর উপরে বসিয়া, আমার মুখের উপর ঝুঁকিয়া, ভয় ও আশাপূর্তি মিশ্রিত আমার মুখের অভিব্যক্তি উপভোগ করিতেছে , ও খিলখিল করিয়া হাসিতেছে, ঝাঁকাইতেছে সোনালি চুল । অবিশ্বাস্য পরিস্হিতিতে আমার কন্ঠ হইতে কথা নির্গত হইল না ।

খাট হইতে লাফাইয়া নামিল ম্যাডেলিন । হ্যাঁচকা মারিয়া আমাকেও নামাইল, হলঘরে প্রবেশের মুখে, গেস্টরুমের পাশের দেয়ালগাত্রের সুইচ টিপিয়া আলো জ্বালাইল , এবং হিড়হিড় করিয়া আমাকে লইয়া চলিল সেই  অংশটিতে যেখানে দাঁড়াইয়া নির্মল তৈলচিত্র আঁকে । অনুমান করিলাম, ম্যাডেলিনের ছবির অবয়বে নির্মল জীবন্ত রঙ ভরিয়া ফেলিয়াছে, তাহাই দেখাইতে লইয়া যাইতেছে ।

দেয়ালে ঠেসান দেয়া একাধিক আঁকা তৈলচিত্রের পাঁজার প্রতি নির্দেশ করিয়া ম্যাডেলিন কহিল, ভালো করিয়া লক্ষ্য করো, ওইটি আয়নার কাঁচে অঙ্কিত, এবং এমনভাবে রক্ষিত যে, না-আঁকা অংশে আলো প্রতিফলিত হয় । পিছনে কী ঘটিতেছে, কে ঘরে প্রবেশ করিল ইত্যাদি ওই ফ্রেমটিতে দেখিয়া নির্মল জানিতে পারে । নির্মল যখন কহিল তুমি স্ট্যাচুর ন্যায় অন্ধকারে ঠায় বসিয়া আমার নগ্নদেহ দেখিতেছিলে, আমি তাহাকে জানাইলাম ঘটনাটি আমি বিলক্ষণ জানি, আমিও তোমায় আবছাভাবে নড়িতে দেখিয়াছিলাম । আমার দেহের প্রতি কেহ যে মুগ্ধ হইতে পারে তাহা অবহেলা করা আমার পক্ষে অসম্ভব ।  সেই দ্বিপ্রহর হইতে তোমার জন্য অপেক্ষা করিতেছি ।

স্বগতসংলাপের নিঃশব্দ প্রাগলভ্য ভেদ করিয়া আমার কন্ঠ হইতে এই কটি কথা নির্গত হহিল, আমার মধ্যে তুমি কী দেখিলে ? প্রশ্ন করাকালে মনের ভিতর দ্বিপ্রহরের দৈবত্বের কথা উঁকি দিল, সত্যই কি আমার ভিতর দৈবত্ব সঞ্চারিত হইয়াছে ! ম্যাডেলিন কোমর হইতে পা পর্যন্ত লাল-কালো বেড় দেয়া, কাঁচ বা প্লাসটিক বসানো রাজস্হানি ঘাগরা পরিয়া আছে, ঊর্ধ্বাংশে পুরুষালি পাঞ্জাবি, খাদির, যাহার কোমরের তলার অংশটি ছিঁড়িয়া ফেলা হইয়াছে । কোমরে পাসপোর্ট টাকা ইত্যাদি রাখার বেল্ট । পাঁচ ফিট আট-নয় ইঞ্চ তো হইবেই উচ্চতা ।

ম্যাডেলিন পাল্টা প্রশ্ন তুলিল, তুমি দীর্ঘ সময় লুকাইয়া আমার প্রতি তাকাইয়া থাকিবার মতো কী সৌন্দর্য দেখিলে ? আমার মুখ সুন্দর নহে । আমি চিত্রশিল্পীর নগ্নিকা মডেল হইবার অনুপযুক্ত, কেননা আমার দেহের সবকিছুরই পরিমাপ তুলনামূলকভাবে বেশি, নারীর বর্তমান মাপদণ্ডের অনুকূল নহে । হাত ও বাহুদুটি নিরীক্ষণ করো, পুরুষের ন্যায় চওড়া । নির্মল বলিয়াছে, সে আমার ত্বকের রঙে আগ্রহী । এই প্রকার রঙ প্রকাশ করা নাকি চিত্রশিল্পীর নিকট দুঃসাধ্য, প্যারি শহরে থাকাকালেও সে আমার রঙের তরুণীর দেখা পায় নাই । তাহার নিকট আমার আর প্রয়োজন নাই— আমি পরিত্যক্ত হওয়া সহ্য করিতে পারিনা, ভীষণ ক্রোধ হয় ; এই পটভূমিতে তুমি উপশমের কাজ করিয়াছ । নির্মল বলিয়াছে বিষয়বস্তুকে একবার দেখিলে সে স্মৃতিতে সম্পূর্ণ তুলিয়া লয় । কিন্তু তুমি একজন প্রথিতযশা শিল্পী হইয়াও কী কারণে আকৃষ্ট হইলে ?

আমি ম্যাডেলিনের চোখে চোখ রাখিয়া বলিলাম, এত দ্রুত ইংরাজিতে কথা বলিও না, দ্রুত বলিলে দুইবার করিয়া বলিবে ; সত্য কথাটি হইল, আমি ইতোপূর্বে নগ্ন শ্বেতাঙ্গিনী দেখি নাই ; দ্বিতীয়ত, তোমার দেহটি ক্লাসিকাল, অকেকাংশে খাজুরাহো কোনারকের নারীগণের মতন, বা প্রাচীন রোম ও গ্রীসের নারীপ্রতিমার ন্যায় মাংসল ; আমি একজন মাংসাশী শিল্পী ; সর্বোপরি, নির্মল ঠিকই কহিয়াছে যে তোমার দেহ দ্যুতিময়, ওই দেহের তেজোময়তায় আমি সমগ্র দিন আচ্ছন্ন রহিয়াছি , চক্ষু মুদিত করিলেই তোমার নগ্ন, জ্যোতিবিকিরণকারী দেহ, সোফায় অর্ধশয়ান অবস্হায় দেখিয়াছি । তোমার উরুদ্বয়ের আভায় যে মসৃণতা দেখিয়াছি তাহা তুলনাহীন । দেখিতে-দেখিতে তোমাকে খাইয়া ফেলিতে ইচ্ছা হইতেছিল ।

প্রখর দৃষ্টি মেলিয়া আমার বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করিবার প্রয়াস করিল ম্যাডেলিন, এবং কহিল, ভারতীয়গণ,  বিশেষত যাহারা শ্বেতাঙ্গিনীর বিছানায় প্রবেশ করিতে চায়, তাহারা সচরাচর মিথ্যাবাদী, কেহ-কেহ বিশ্বাসঘাতক ।

হ্যাঁ, তুমি অনুমতি দিলে, আমি তোমার বিছানায় প্রবেশ করিব, চোখে চোখ রাখিয়াই বলিলাম, আপ্রাণ চেষ্টা করিলাম যাহাতে উহার বুকের দিকে দৃষ্টি না যায় । বক্ষ দুটি সকালেই  দেখিয়াছি , অতীব মনোলোভা ; তাহার উপর মাথা পাতিয়া শুইতে ডাক দিতেছিল অর্ধশয়ান যুবতীটি ।

তাহা হইলে আমার ঘরে চল , আমি কেবল এক সপ্তাহ থাকিব, একমাসের ভাড়া বাড়ির মালিককে অগ্রিম প্রদান করিয়াছি , আমি যাইবার পর তুমি থাকিতে পারিবে ; নির্মল কহিতেছিল, তুমি এক মাসের জন্য আস্তানা খুঁজিতেছ । আমার প্রস্তাব বুঝিতে পারিয়াছ নাকি পুনর্বার বলিব ? কাঁধ পর্যন্ত সোনালি চুল দুই হাতে পিছনে বিলি কাটিয়া শুধাইল ম্যাডেলিন ।

দ্রুত কথা বলার পরিবর্তে ম্যাডেলিন আমার পক্ষে বোধগম্য করিয়া বলিতেছিল । কিন্তু উহার প্রতিটি বাক্য ফাক, শিট. আসহোল, ব্যাস্টার্ড, সান অব আ বিচ ইত্যাদি শব্দের অলংকারে ভূষিত । আমি সেগুলির বঙ্গানুবাদ করিতে অক্ষম বলিয়া বর্জন করিতেছি । তদ্ব্যাতীত, বাংলায় শব্দগুলিকে অব্যর্থ প্রতীয়মান হয় না ।

আমি বলিলাম, মূর্খ হইলেও বিশ্বের কোনো যুবক এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করিবে না । কিন্তু অদ্যরাত্রে গেরিলা পেইনটার্স গোষ্ঠীর হ্যাপেনিং নামক অনুষ্ঠান এই হলঘরে হইবার কথা আছে যে !

না না, তাহা বাতিল করা হইয়াছে , গম্ভীর মুখে ম্যাডেলিন কহিল । তাহার পর যোগ করিল, উল্লাসের গৃহে কলিকাতা হইতে কয়েকজন তরুণ বিপ্লবী আসিয়া দশবারো দিন লুকাইয়াছিল, উহাদের পুলিশ ধরিয়া লইয়া গিয়াছে । শুনিলাম, পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ কিয়া পুলিশ উহাদের হত্যা করিয়া যত্রতত্র দেহ ফেলিয়া দিবে । তাহা যাহাতে না ঘটে সেহেতু গেরিলা পেইনটার্সের সদস্যগণ বিভিন্ন সংবাদপত্রের বেনারসস্হিত প্রতিনিধিদের ধরাধরি করিতেছে ।

উহারা নকশালপন্হী,  মার্কসবাদী বিপ্লবী, আমি বলিলাম ।

আমার বগলের তলা হইতে নিজের দক্ষিণ হস্ত গলাইয়া, রেস্টরুমের দিকে হাঁটিতে-হাঁটিতে ম্যাডেলিন প্রশ্ন করিল, তোমাদিগের দেশেও এডগার হুভারের ন্যায় গুমখুনকারী প্রশাসক আছে নাকি ? সাম্যবাদ প্রতিরোধের নামে হুভার বহু মানুষকে লোপাট করিয়া দিয়াছে ।

আমি বলিলাম, তুমি এক কপি রামায়ণ ক্রয় করিও । ইংরাজিতে পাওয়া যায় । উহাতে বিভীষণ নামক একটি বাঙালি চরিত্র আছে ।

মাথা নাড়াইতে ম্যাডেলিনের সোনালি চুল দুই দিকে নাচিয়া উঠিল । কহিল, পড়াশুনা আমার একেবারে ভাল লাগে না । উহা জীবনকে উপভোগে ব্যাঘাত ঘটায় ।বহু গ্রন্হ পড়িবার পরও কত মানুষকে দেখিয়াছি, একেবারে মনুষ্যত্বহীন রহিয়া গিয়াছে ; অনেকে বোধহয় গ্রন্হ পড়িয়া দানবিক আকার লাভ করে, গ্রন্হ তাহাদের মাথায় অজগরের ন্যায় পাক খাইতে থাকে সারাটা জীবন ।

কিন্তু সকালে নির্মল পরিচয় করাইবার সময়ে যে বলিল তুমি তোমার পূর্বপুরুষ টমাস করিয়েট সম্পর্কে গবেষণা করিতে ভারতে আসিয়াছ ? মেঝে হইতে পুঁটুলি ও বোতল তুলিয়া প্রস্ন করিলাম । ঘরে প্রবেশ করিয়া ভাঙা চশমা মাড়াইয়া চূর্ণবিচূর্ণ করিলাম ।

ডাহা মিথ্যা, ঝুঁকিয়া উচ্চহাস্যে বলিল ম্যাডেলিন , ইমপ্রেস করিবার জন্য বলিয়াছিলাম । যে যুবক আমাকে বেনারসে আনিয়া অন্য এক ব্রিটিশ তরুণির সহিত আগ্রা বা দিল্লি পলাইয়াছে, সে ওই বিষয়ে গবেষণা করিতেছে । টমাস করিয়েটের পূর্বপুরুষগণ ভাইকিং যোদ্ধা ছিলেন । আমার দেহে ভাইকিংগণের রক্ত আছে । সেকারণেই তো দেহের কাঠামো ও রঙ এই প্রকার । দেহের চাহিদাও ভাইকিংগণের মতন ।

আমার চামড়ার স্যুটকেসে পুরানো প্যান্টটি রাখিয়া রেশমের চাদরটি ম্যাডেলিনের স্কন্ধে জড়াইয়া দিলাম । ছয়টি রৌপ্যমুদ্রা ছিল ; ম্যাডেলিনের হাতে দিয়া বলিলাম, মেমেন্টো, ফুটা করিয়া নেকলেস বানাইও । বোতল ও স্যুটকেস তুলিয়া লইতে, রৌপ্যমুদ্রাগুলি কোমরের ব্যাগে রাখিয়া ম্যাডেলিন কহিল, শুইবে বলিয়া অগ্রিম পাওনা মিটাইতেছ ! তাহার পর আমার হাত হইতে স্যুটকেসটি কাড়িয়া যোগ করিল, তোমার চেয়ে আমার দেহে বেশি শক্তি আছে । দৈঘ্যেও আমি তোমার চেয়ে তিন-চার ইঞ্চ লম্বা ।

রিকশয় বসিয়া আমার দিকে দৃষ্টি হানিয়া ম্যাডেলিন কহিল, তুমি ফোরপ্লে জানো ? উহাও শিল্প ! ভাইকিং রমণী ফোরপ্লের বৈভিন্নে জাগ্রত হয় ।

বলিলাম, ভয় দেখাইও না । কোনারক-খাজুরাহো ইউরোপ-আমেরিকায় অবস্হিত নহে । চুম্বন জিনিসটিও আমাদের দেশ হইতে বিভিন্ন দেশে গিয়াছে । আশ্চর্য, পথিমধ্যেই, ম্যাডেলিন পট করিয়া আমার ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকাইল । মাথা ঘুরাইয়া দেখিলাম, আমাদের সম্পর্কর পথচারীগণ উদাসীন । সকলে নিজ-নিজ কর্মে  ব্যাপৃত । ভিয়েতনামের যুদ্ধ হইতে জন্ম লইয়াছে দেশ-পলাতক এই হিপিগণ এবং বেনারসের মতো তীর্থ ক্ষেত্রে দলে-দলে আগমন করিয়া স্হানীয় আচরণে ও দৈনিক সংস্কৃতিতে তুমূল পরিবর্তন ঘটাইয়া দিয়াছে । রক্ষণশীলতা বর্জন করিতে হইয়াছে ইহাদের ডলারের চাপে ।

ম্যাডেলিনের উৎসবমুখর নীলাভ চক্ষে চাউনি ফেলিয়া বুঝিলাম যে আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে নিঃশব্দ হইচই বাধাইয়াও সে বেশ নির্লিপ্ত । সে শুধাইল, তুমি দেহে পারফিউম লাগাও , অদ্ভুত এক সুগন্ধ সেই তখন হইতে পাইতেছি , যখন অন্ধকারে তোমার লবণাক্ত গাল লেহন করিয়াছিলাম ।

তুমি যেরূপ ভাইকিং বংশের, আমি তাহার চেয়েও প্রাচীন এক ঋষির বংশধর, যাঁহার মন্ত্রবলে আমাদের নাভি হইতে হরিণের ন্যায় মায়াগন্ধ বিচ্ছুরিত হয় ।

আমার কথাগুলি বিশ্বাস করিবে কিনা সে চিন্তা মুহূর্তের জন্য ম্যাডেলিনের চোখেমুখে ভাসিয়া উঠিল । আমাকে আলিঙ্গন করিয়া, ছাড়িয়া দিয়া কহিল, মিথ্যাবাদী, কিশোর প্রেমিকের ন্যায় মিথ্যাকথা বলিতেছ ।

চুম্বন, জড়াজড়ি ইত্যাদির সহিত আমি চার দেয়ালের ভিতরই পরিচিত । পথচলতি এইরূপ ব্যবহারে কিঞ্চিৎ বিব্রত হইতেছিলাম বলিয়া, একটি বৃহৎ মণিহারি দোকান দেখিয়া রিকশ থামাইয়া ম্যাডেলিনকে আহ্বান করিলাম, এসো, ফোরপ্লের জন্য ঋষিগণের আবিষ্কৃত দুই প্রকার তরল ক্রয় করি ।

ক্রয় করিয়া, রিকশয় বসিয়া বলিলাম, এই ছয়টি শিশির নাম অগরু, উহার প্রলেপ সূর্যাস্তের পর তোমার সমগ্র দেহে লাগাইয়া ফোরপ্লে করিতে হইবে । এই ছয়টি মন্ত্রপূত শিশির নাম কান্তা ; উহার প্রলেপ সূর্যোদয় পরবর্তী ফোরপ্লের জন্য ।

হ্যাঁ, সে কহিল, বোকা প্রেমিকের আচ্ছন্নতা হইতে মুক্ত অভিজ্ঞ যুবকের ন্যায় এখন সত্য কথা বলিতেছ ।

রিকশঅলাকে কী নির্দেশ ম্যাডেলিন দিয়াছিল, ভাইকিং রমণীটির দেহৈশ্বর্য দেখিতে মগ্ন ছিলাম বলিয়া কানে যায় নাই । যে অঞ্চলে থামিল, তাহা মনে হহিল গোধোলিয়ার নিকটবর্তী । ম্যাডেলিন স্যুটকেস লইয়া নামিতে, আমি রিকশ ভাড়া মিটাইলাম , এবং অনুসরণ করিয়া শতবৎসরের পুরাতন চুনকামহীন একটি তিনতলা গৃহের প্রায়ান্ধকার প্যাসেজে প্রবেশ করিলাম ।

প্যাসেরজের দুইপাশে ঘরগুলির দরজা খোলা বা অর্ধেক-খোলা বা বন্ধ ; একা শ্বেতাঙ্গ যুবক বা যুবতী, যুবক-যুবতী জোড়া, যুবক জোড়া, যুবতী জোড়া দেখিয়া অনুমান করিলাম, বাড়িটি বিদেশিগণের প্রিয়, এবং গৃহকর্তা উহাদেরই ঘর ভাড়া দিয়া থাকেন । ধোঁয়ার সুবাসে প্রতিভাত যে মাদকের সন্ধ্যাহ্ণিক চলিতেছে । কোনো হর্ষকোলাহল নাই, কথপোকথন নাই, গুঞ্জরণ নাই; যে যার ব্যক্তিগত মায়াস্বপ্নের আলোকমালায় ডানা মেলিয়া বিহার করিতেছে ।

দ্বিতলে যাইবার সিঁড়িতে হলুদ টিমটিমে বাল্ব, ক্ষয়িত ধাপগুলি তুলনামূলকভাবে উঁচু । পুনরায় প্যাসেজ । প্রথম তলার ন্যায় ভাড়াটে ও ধোঁয়া । একটি ঘরে জনৈক ভারতীয় যুবক, কাঁধ পর্যন্ত দীর্ঘ চুল, দাড়িগোঁফ নাই, জিনস ও সবুজ টিশার্ট পরিহিত , গিটারে কোনো পাশ্চাত্য সুর তাহার শ্বেতাঙ্গিনী শ্রোতাকে শুনাইতেছে , যাহার সোনালি ঝাঁকড়া চুল-মাথা ঢলিয়া আছে গিটারবাদকের স্কন্ধে ।

হয়ত প্রয়োজন নাই বলিয়া ত্রিতলে যাইবার সিঁড়িতে বিজলি বাতির বালাই নাই । ছাদে উঠিয়া হাঁফ ছাড়িলাম । ফাল্গুনের আকাশে একটি-দুটি তারা আমাদের বেঢপ রাধাকৃষ্ণ জুটিকে দেখিবার জন্য উঁকি-ঝুঁকি মারিতেছে । পশ্চিম কোণে একটিই ঘর তৎসংলগ্ন, সম্ভবত, টয়লেট । পূর্বকোণে সিমেন্ট নির্মিত জলের ট্যাংক ।

তালা খুলিয়া বিজলিবাতি জ্বালাইল , এবং ঘরে প্রবেশ করিয়াই ঘাগরা ও কুর্তা ফেলিয়া দিল ম্যাডেলিন । আমি অপার আনন্দের রক্তসঞ্চালনজনিত ঠাণ্ডা ও দমিত উত্তেজনায় হতবাক । এই প্রকার অন্তর্বাসহীন পোশাকেই থাকো নাকি, প্রস্ন করিতে, বিস্ময়ে প্রীত আমার মুখের দিকে তাকাইয়া, ভাইকিং রমণী উত্তর দিল, অন্তর্বাস কাচিবে কে ? এই ঘর এই ছাদ সম্পূর্ণ আমার ; ছাদের দরজায় তালা দিয়া নগ্নই থাকি ।

টেবলফ্যানটি রিভলভিং করিয়া চালাইয়া দিলে, আমি কহিলাম, তোমার ত্বকের দ্যুতিতে এই কয়দিনে আমি অন্ধ হইয়া যাইব ; ইতিমধ্যেই আমার দেহে রসায়নের নদীগুলি বেচাল হইয়া সমুদ্র খুঁজিতে ছুটিতেছে ।

চতুর্দিকে চাহিয়া ঘরের যা অবস্হা প্রতিভাত হইল, অনুমান করিলাম, বড়ই অগোছালো মেয়েটি ; পোশাক হয়ত এক-দুইবার পরিয়াই ফেলিয়া দিয়াছে, পাউরুটি-বান পড়িয়া আছে অর্ধভূক্ত, জলের পরিবর্তে বিয়ার পান করিয়া বোতলের পাহাড় এককোণে গড়িয়াছে , অ্যাশট্রেতে গুঁজিয়া রাখিয়াছে সিগারেট অথবা ফ্যাগের শেষাংশ । নানা মাপের পকেটযুক্ত ঢাউস রাকস্যাক এক কোণায় ।

জাল লাগানো তিন দিকের জানালা খুলিয়া দরজা বন্ধ করিল মভাদেলিন এবং আমাকে হুকুম করিল, নাও, দ্রুত ওই পোশাক দেহ হইতে নামাও ; সূর্যাস্ত-পরবর্তী মন্ত্রপূত তরল লইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হও । বিছানায় উঠিয়া চিৎ হইয়া শুইয়া পড়িল । একটি ট্যাবলেট, খাইল না, গর্ভদ্বারে ঠেলিয়া দিল ।

যদিও আমার শরীরের অকুস্হলে, মস্তিষ্কে ও হৃ৭পিণ্ডে রঙ্গনাট্য, ম্যাডেলিন ঘাগরা ছাড়িবামাত্র, অভিনীত হইতেছিল, অপেক্ষা করিতেছিলাম যে প্রথম আহ্বানটি সে-ই করুক । নির্মলের স্টুডিওয় বিশেষ দৃষ্টি-উন্মত্ত থাকার কারণে লক্ষ্য করি নাই যে তাহার গোপনাঙ্গে ও বাহুমূলেও সোনালি চুল রহিয়াছে । কখনও ভাবি নাই যে  নারীদেহের এই  অঞ্চলগুলোতেও সোনালি চুল থাকিতে পারে !

পোশাক ত্যাগ করিয়া, ঘরে রাখা মগের জলে অগরু শিশিটি উপুড় করিয়া আমার রুমালটি ভিজাইলাম, এবং পা হইতে কপাল পর্যন্ত বহুক্ষণ ধরিয়া প্রলেপ দিলাম । উপুড় করিয়া গলা ও কাঁধ হইতে একইভাবে প্রলেপ দিলাম । নিজের ভারসাম্য গড়িতে এইপ্রকার বিলম্ব জরুরি । প্রলেপ দিবার সময় ত্বকের গন্ধ হইতে আন্দাজ করিলাম যে ম্যাডেলিন প্রতিদিন স্নান করে না । স্নান না করিয়া ত্বক কী ভাবে এত আলোকময় রাখিয়াছে তাহাই বিস্ময়কর ।

ম্যাডেলিন অকস্মাৎ কাঁপিতে লাগিল । ত্রিশ-চল্লিশ মিনিটের সুখদায়ী প্রলেপ স্পর্শেই কি উহার উত্তেজনার পারদ শীর্ষে চলিয়া গেল ? সেশয় দূরীভূত হইল যখন সে চিৎ হইয়া মুখ ঢাকিয়া লইল । কাঁদিতে-কাঁদিতে বলিল, পুরুষ যে এইভাবে আদরের গোপনীয় বাল্যকালীন আকাঙ্খাকে নারীহৃদয়ে জাগাইয়া তোলপাড় ঘটাইতে পারে, এ অভিজ্ঞতা আমার ছিল না শিশির । আমাকে নিজের উপর টানিয়া অর্ধস্ফূটে ফোঁপানিমিশ্রিত কন্ঠে কহিল, অদ্য ফোরপ্লের প্রয়োজন নাই, আমার মন তৃপ্ত হইয়া গিয়াছে ; তুমি তোমার দেহ তৃপ্ত করিয়া লও ।

সংসর্গকে স্বচ্ছন্দ ও সুষম করিবার নিমিত্ত, তৎসত্ত্বেও, আমি মুখ ও করসেবা প্রয়োগ করিলাম , এবং নিজের দেহ ও মনকে তৃপ্ত করিলাম । ঘর্মাক্ত জাপটে আমাকে ভাইকিং বাহুদ্বারা পিষ্ট করিয়া ম্যাডেলিন কহিল, আমার দেহও তৃপ্ত হহিয়াছে । কিয়ৎক্ষণ ঘুমাইয়া পড় ।

পাশে শুইয়া, মিনিট কুড়ি পরই নাক ডাকার শব্দে বুঝিলাম ম্যাডেলিন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে । আমার ঘুম আসিল না । চোখ বুজিয়াই হয়ত দেখিব, ম্যাডেলিন নাই, স্বপ্ন দেখিতেছিলাম । এই ভাইকিং রমণী স্বদেশে ফিরিয়া যাইবার পূর্বে, যতবার সংসর্গ সম্ভব হইবে, করিব ।

যানবাহনের শব্দ থামিলে অনুমান করিলাম বেশ গভীর হইয়াছে রাত্রি । জাগাইলাম ম্যাডেলিনকে । বলিলাম খাইয়া লও, ওয়াইন, চিকেন ও রুমালি রুটি আছে, হয়ত ঠান্ডা হইয়া গিয়াছে, কিন্তু পেট ভরিবে ।

মেঝেয় নামিয়া দুইজনে, আদিম মানব মানবীর ন্যায় পোশাকহীন, রুটি-মদ্য-মাংস খাইলাম । লঙ্কা দেয় নাই বলিয়া, মাংস, যদিও নরম, ছিঁড়িয়া-ছিঁড়িয়া খাইল ম্যাডেলিন , ছাড়া কাপড় টানিয়া হাত-মুখ পুঁছিল । ওই একই পরিত্যক্ত পোশাকে আমিও হাত-মুখ পুঁছিলাম । বলিল, মারিহুয়ানা ফুঁকিবে ? আমি বলিলাম, তখন প্রস্তাবটি ছিল তোমার ; আমার দেহ-মন এখনও তৃপ্ত হয় নাই । তোমাকে কি পুনরায় ট্যাবলেট প্রবিষ্ট করাইতে হইবে ?

আমাকে দুই হাতে জড়াইয়া, মেঝের উপরই শুইয়া পড়িয়া ম্যাডেলিন কহিল, এসো, ওই ট্যাবলেটের প্রভাব বাহাত্তর ঘন্টা পর্যন্ত থাকে ; আমাকে ম্যাডে বলিয়া ডাকিবে । এবার দীর্ঘস্হায়ী ফোরপ্লের সূত্রপাত ঘটাঈয়া আমি বলিলাম, আমাকে শিশু বলিয়া ডাকিবে।  ওঃ ,শিশ ইউ , বলিয়া উঠিল ম্যাডেলিন । আমাকে সে শিশ ইউ বলিয়াই ডাকিত । বলিয়াছিল, শিশ ইউ অনেকটা ফাক ইউ-এর বিপরীত ।

কার্যান্তে মেঝেতেই শুইয়া রহিলাম দুইজনে । ম্যাডেলিন ঘুমাইয়া পড়িলে, আমিও ঘুমাইবার প্রয়াস করিলাম , কিন্তু উহার মাংসল দ্যুতিময় বাহু আঁকড়াইয়া রহিলাম ।

সকালে আমার ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছিল । ভাইকিং রমণীর ঘুম দুই ঘন্টার পর ভাঙিতেই আমি বলিলাম, বাহাত্তর ঘন্টা সমাপ্ত হইতে বাকি আছে, একদম উঠিবে না । বলিয়া সূত্রপাত করিবার উপক্রম করিয়াছিলাম । উচ্চস্বরে হাসিতে-হাসিতে ম্যাডেলিন কহিল, বেশ, সূর্যোদয়ের মন্ত্রপূত শিশিটির প্রলেপ দাও । দাঁড়াও, ছাদের দরজায় তালা দিয়া টয়লেট হইয়া আসি । আগের দিনের ঘাগরা গলা-কাঁধে পরিয়া আধঘণ্টা পরে ফিরিল ম্যাডেলিন ।

প্রাতঃকৃত্য সারিবার নিমিত্ত, স্যুটকেস হইতে তোয়ালে ও গায়ে মাখিবার সাবান লইয়া টয়লেটে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম বক্ষের ও নিম্নাঙ্গের কয়েকটি অন্তর্বাস, শুকাইয়া-যাওয়া এক্সট্রা লার্জ স্যানিটারি প্যাড, ব্যবহৃত টয়লেট পেপার যত্রতত্র, যাহা, কোণে রক্ষিত নারিকেল ঝাড়ু দ্বারা একপাশে সরাইয়া স্নান করিলাম । মনে হইল, পুনরায় তরতাজা ও যুদ্ধক্ষেত্রে নামিবার জন্য আমার দেহশক্তি নবীকৃত । গা মুছিয়া, তোয়ালে সম্পূর্ণ সিক্ত করিলাম বালতিতে ডুবাইয়া ।

ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম খাট হইতে তোষক টানিয়া মেঝেয় বিছাইয়াছে ম্যাডেলিন, ফ্যান শিয়রে টানিয়া আনিয়াছে এবং তোষকের উপর ছয়টি কলা, দুটি আপেল, চারটি ডোনাট, যেগুলি ঘরে  কোথাও চাপা পড়িয়াছিল, লইয়া বসিয়া আছে , পোশাকহীন ; পাশে অ্যাশট্রৈ এবং দুই বোতল বিয়ার ।

সিক্ত তোয়ালেতে কান্তা সুগন্ধী ছিটাইয়া ভালোভাবে পুঁছিলাম ম্যাডেলিনের দেহ । চোখ বুজিয়া শীতল স্পর্শের আরাম লইতে-লইতে বলিল, ব্রেকফাস্ট করিয়া, একটি অটুলস ফ্যাগ ফুঁকিয়া পরস্পরকে চতুষ্পদের মত রেপ করিবার লড়াই করিব, কী বল ?

অটুলস ফ্যাগ ? তুমি অতুলকে চেনো নাকি ? আমার স্বরযন্ত্র হইতে অতিসতর্ক প্রস্ন নির্গত হইল ।

অটুলকে চিনি না ; গৃহকর্তা মিস্টার গুপ্টা প্রতিটি ভাড়াটিয়াকে বিক্রয় করিবার জন্য সপ্তাহান্তে একবার আসেন । কত দাম জানো ? চার ডলার । আমার এই ঘরের ভাড়াও চার ডলার, সংলগ্ন টয়লেট এবং খোলা ছাদ কেবল আমার বলিয়া । দ্বিতলের ভাড়া ঘরপ্রতি আড়াই ডলার দেড় ডলার, প্রতি তলায় দুইটি মাত্র টয়লেট । তবু প্রত্যেকে অটুলস ফ্যাগের  ভক্ত , কারণ উহা লাইসার্জিক অ্যাসিডের চেয়েও মনোমুগ্ধকর, মাথা ও দেহকে ক্লান্ত করে না, প্রাতঃকালে ফুঁকিলে বিকাল পর্যন্ত এক ভিন্ন জগতে গিয়া স্বগীয় সুখ পাওয়া যায় । বেনারসে আসা কেন ? নেশার জন্যই তো । এই শহরের জনগণ সবাইকে গ্রহণ করিয়া লয়, তাহাদের কার্যকলাপকে অসামাজিক মনে করে না ; পথের ধারে বসিয়াও তুমি যথেচ্ছ ধোঁয়া ফুঁকিতে পারো । ম্যাডেলিনের দীর্ঘ ব্যাখ্যায় আশ্বস্ত হইলাম, যে, যাক, অতুলের সহিত উহার পরিচয় নাই ।

তোয়ালে উহার কপালে-চুলে জড়াইয়া দিয়া তোষকে বসিতে-বসিতে বলিলাম, তোমার ফুঁকিবার হয় ফুঁকিতে পারো, আমি পরে ফুঁকিব ; আমি সজ্ঞানে ম্যাড করিয়েটকে আলিঙ্গনে চাই । সংসর্গের সময় নেশাচ্ছন্ন হইয়া ভিন্ন জগতে বিচরণ করিব, তাহা চিন্তা করাও আমার পক্ষে অসম্ভব । প্রিয় ভাইকিং রমণী, দীর্ঘস্হায়ী নেশার নীহারিকায় প্রবেশের পূর্বে পেট ভরিয়া খাইয়া লও । তুমি ঢলিয়া পড়িবার পর আমি চার দিনের খাবার লইয়া আসিব ।

একটি কলা, একটি আপেল, একটি ডোনাট আমি খাইলাম । বাকিগুলি ম্যাডেলিন খাইল । তাহার ভোজন-আগ্রহে বুঝিলাম সে কেন অমন মাংসলতামায় আকর্ষণীয়া । বিয়ারের যে বোতলটি সে খুলিল, আমি এক ঢোঁক লইয়া কেবল গলা ভিজাইলাম । রাকস্যাকের পকেট হইতে একটি অটুলস ফ্যাগের কয়েকটান ধোঁয়া গিলিয়া আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলিয়া বলিল, আমার প্রেমে পড়িয়াছ মনে হইতেছে ; প্রেমে পড়িও না , প্রেম জিনিসটি তামাদি হইয়া গিয়াছে । দুটি দেহের মাঝে মনকে আনিও না ; মানসিক বিপর্যয় ও শোকে আক্রান্ত হইবে । কোনারক-খাজুরাহোর ভাস্করগণ ওই বিপর্যয়ে পড়িলে অমর কীর্তী গড়িতে পারিতেন না ।

আমি আপাতত নিজেকে বুঝিতে অক্ষঞ ল কিন্তু কোনো অর্থেই আমি জ্ঞান খোয়াইয়া তুরীয় অবস্হায়, মন যতক্ষণ না ভরিতেছে, সংসর্গ করিব না । পাল্টা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলিয়া উত্তর দিলাম ।

কয়েকটি দীর্ঘ সুখটান দিয়া ম্যাডেলিন অকস্মাৎ শুধাইল, তুমি আমার সহিত নিউইয়র্ক চলো, চারঘরের অ্যাপার্টমেন্টে একা থাকি । বাবা-মা পুনরায় বিবাহ করিয়া অন্যত্র থাকেন । কিন্তু আমার নামে যে নিবেশ আছে, কিছুই করিতে হইবে না সারাজীবন । চলো, আমি ভাড়া দিয়া লইয়া যাইব । পরস্পরের যৌন ক্রীতদাস রূপে অষ্টপ্রহর আনন্দ করিব, ঘরে, বারান্দায়, য়াকুজিতে, সন্ধ্যার সময়ে পার্কে, সমুদ্রতীরে, যত্রতত্র ।

আমি বলিলাম, তারপর কোনো দীর্ঘদেহী ভাইকিং একদিন তোমার বিছানায় প্রবেশ করিবে, এবং তুমি আমাকে লাথি মারিয়া খাট হইতে ফেলিয়া দিবে ।

কিয়ৎক্ষণ আত্মচিন্তায় মগ্ন থাকিবার পর ম্যাডেলিন কহিল, আমি কম বয়সে এইরূপ পৃথুলা ছিলাম না । তুমি মুলাঁ রুজ বা রেড উইন্ড মিল ক্যাবারের কথা শুনিয়াছ ?  কুড়ি বৎসর বয়সে আমি প্যারি গিয়াছিলাম মুলাঁ রুজের অডিশানের জন্য । উহারা .উনিশ শতকের ক্যান ক্যান নৃত্যের জন্য জগদ্বিখ্যাত । প্রায় একশটি তরুণী অডিশানের জন্য একত্রিত হইয়াছিল । আমাদের প্রত্যেককে একটি নৃত্যের ভঙ্গী দেখাইয়া বলা হইল, অভ্যাস করিয়া পাঁচ মিনিট পর আইস । ওই কঠিন নৃত্য কেহ কি পাঁচ মিনিটে শিখিয়া লইতে পারে ? অডিশানে বিফল হইলাম ; জীবনের একমাত্র আকাঙ্খা চরিতার্থ করিতে না পারিয়া আগ্রহ হারাইয়া দেহকাঠামো বজায় রাখার প্রয়োজন মনে করি নাই । তাই হিপি জীবনটিই আকর্ষনীয় প্রতিভাত হইয়াছে । যাহা ইচ্ছা করি, যে দেশে ইচ্ছা যাই, যাহাকে ভালো লাগে তাহার সহিত শুই, খাইতে ভালোবাসি বলিয়া প্রতিটি দেশের খাদ্য খাই । কথাগুলি বলিয়া বেশ কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিল ম্যাডেলিন ।

আমি বলিলাম, তুমি তাড়াহুড়া করিলে বলিয়া গিটারটি নির্মলর গৃহেই ফেলিয়া আসিলাম । নতুবা তুমি নৃত্য করিতে আর আমি গিটার বাজাইতাম ।

অকস্মাৎ সিগারেটটী দ্রুত দু-তিন টানে শেষ করিয়া অতর্কিতে আমার উপর ঝাঁপাইয়া ম্যাডেলিন কহিল, গিটারের নিকুচি করিয়াছে, নাচিবার-বাজাইবার সময় আর নাই ।আইস, এখন যাহা করিতে চাহি তাহাই করি ।

আমার  চেয়ে অধিক শক্তি ধরিলেও, আমার দেহে মাত্র একটি অকুস্হল, যখন কিনা উহার  দেহ জুড়িয়া আক্রমণযোগ্য সংবেদনস্হল, আনাচ-কানাচ, ঢেউ-পাটাতন । কাবু করিতে বিলম্ব হইল না । যৎসামান্য ফোরপ্লের পর ম্যাডি হাপরকন্ঠে কহিল, বাদ দাও, বাদ দাও, আমি চতুষ্পদ ঘোটকী হইতেছি, তুমি অশ্বের ন্যায় সংসর্গ করো, হ্রেষাধ্বনিও করো, খুরধ্বনি করো, অশ্বশ্বাসের ঝড় তোলো আমার চতুর্দিকে ।

এই অভিজ্ঞতা ইতিপূর্বে হয় নাই বলিয়া, ঘর্মাক্ত কর্ম সমাধার শেষে কহিলাম, তুমি নেশার ঘুমঘোরে থাকিবে বলিয়া আগেই সতর্ক করিয়া দিতেছি ; দ্বিপ্রহরে তোমাকে মাদি টিকটিকিতে রূপান্তরিত করিব, এবং আমি টিকটিকি-পুরুষ হইয়া তোমার ঘাড়ে কামড় দিয়া সংসর্গ করিব ।

যে রূপে ইচ্ছা ক্রীড়া করিও, কিন্তু যখন যাইবে তখন এই ঘরের শিকল তুলিয়া দিও, নহিলে বানর ঢুকিবে । কথা কয়টি বলিয়া, চক্ষের উপর বাম বাহু তুলিয়া পনেরো-কুড়ি মিনিটে নেশাচ্ছন্ন ঘুমের জগতে ঢুকিয়া পড়িল ম্যাডেলিন । উহার তুলতুলে  ও সুমসৃণ বাহুতে মাথা রাখিয়া মনে হইতেছিল, সংক্ষিপ্ত হইলেও, এইটুকুই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ।

উঠিয়া বসিলাম । উহার সর্বাঙ্গ দেখিতে-দেখিতে ভাবিতেছিলাম যে হয়ত সত্যই এই যুবতী স্ক্যান্ডিনেভীয় মধ্যযুগের নৌযোদ্ধাগণের বংশজ, যাহারা ফ্রান্সের নর্মাণ্ডি, রাশিয়ার নোভগোরড, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডে আক্রমণ চালাইয়া দখল করিয়াছিল । বিজিত নারীগর্ভে বীজবপনের ক্ষুধায় তাহারা পরস্পর অসিযুদ্ধ করিত । রাজা ক্যানিউট তাহাদেরই সন্তান । এই যুবতী আমার চাহিদা মিটাইতে হয়ত সেকারণেই একপা অগ্রে ।

কীই বা করিব এক্ষণে । ঘর গোছাইতে আরম্ভ করিলাম । শুঁকিয়াও বোঝার উপায় নাই কোন পোশাকটি এক বার পরা, কোনটি বহুবার । পোশাকের নিম্নাঙ্গ একপাশে এবং ঊর্ধ্বাঙ্গ আরেকপাশে সাজাইলাম ; তিনটি করিয়া স্তুপ গড়িয়া উঠিল । কোণটি পোশাকমুক্ত হইলে বিদেশি পাউডার, লোমনাশক ও ইলেকট্রিক উনোন চোখে পড়িল । উনোনে বসানো ডেকচির জলে ডিম ডুবিয়া আছে, সম্ভবত সিদ্ধ করিবার সময় বা ইচ্ছা হয় নাই । মেয়েটি ভোজনবিলাসীই কেবল নহে, অলসও প্রতিভাত হইতেছে ।

ম্যাডেলিনের তরঙ্গায়িত নেশাঘুমন্ত দেহে পাউডার মাখাইয়া দিলাম । নারীদেহকে এইরূপে সুগন্ধিত করিয়া আনন্দিত বোধ করিলাম । উহার হুঁশ নাই । গোপনাঙ্গে ও বাহুমূলে লোমনাশক প্রলেপ দিলাম, বাজার হইতে ফিরিয়া পরিষ্কার করিয়া দিব । খালি বিয়ার বোতলের পাহাড় ভাঙিয়া দেয়ালের পাশে সাজাইলাম ; ষাটটি বোতল । পোশাকের নিম্নাঙ্গও ছিল প্রায় ষাটটি । তোষক টানিবার সময় গর্ভনিরোধক ও অন্যান্য ওষধ পড়িয়া গিয়াছিল মেঝেয়, সেগুলি তুলিয়া রাকস্যাকের নিকট রাখিলাম ।  তোষকটির জায়গায়-জায়গায় খাপচা দাগ ; একটি চাদর পাতিয়া দিলে ঢাকা পড়িবে । কতজন হিপি-হিপিনি এই তোষকের উপর তাহাদের প্রেমকাহিনি তরল অক্ষরে লিখয়া গিয়াছে তাহা বানোয়ারি গুপ্তাও জানে না মনে হয় । একদা হিপিগণের ইতিহাস লিখিতে হইলে এই তোষকটির আত্মকথার প্রয়োজন হইবে ।

টিশার্ট-প্যান্ট পরিয়া, পিচবোর্ডের বিয়ারবাক্সে অভুক্ত জিনিসগুলি ও টয়লেটের জঞ্জাল পুরিয়া ঘরে শিকল ও তিনতলার সিঁড়ির দরজায় তালা দিয়া নামিতে-নামিতে দেখিলাম বেনারস আগমনের উদ্দেশ্য পূরণার্থে নানা প্রকারে ধুম্রজাল বোনার কাজে যুবক-যুবতীগণ মগ্ন । পথে নামিয়া দেখিলাম অদূরেই আঁস্তাকুড়, যাহাতে নিক্ষেপ করিলাম বাক্সটি ।

একটি রেস্তরায় ঢুকিয়া রুটি ও মাংস খাইলাম । তাহার পর দুটি থলে কিনিয়া তাহাতে বান, পাঁউরুটি, নুডলস, কলা, আপেল, কমলালেবু, গোলমরিচ গুঁড়া, নুন ও একডজন ডিম লইয়া, পুনরাংয় ভিতর হইতে সিঁড়িতে তালা দিয়া যখন ঘরে প্রবেশ করিলাম, দেখিলাম, একই আঙ্গিকে শুইয়া আছে ভাইকিং রমণী ।

<

Malay Roy Choudhury ।। মলয় রায়চৌধুরী