বনলতার বাবা নসিরাম তামাক খাওয়া শেষ করে কোটি রেখে প্রাতঃকৃত্যাদি শেষ করার জন্য উঠে দাঁড়াল। বৃদ্ধ হয়েছে নসিরাম। কোমর খানিকটা বেঁকে গিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে শরীরটা। একগলা কষ্ঠির মালা তেলে আর জলে কালো হয়ে উঠেছে। কপালে গায়ে কুঞ্চিত চামড়ায় বাসি তিলকের দাগ।

আগে নসিরাম খুব শান্ত ধীর ছিল। হাসিখুশি গান কথকতা সমস্ত কিছুতে সৌম্য। কিন্তু আজকাল তার মেজাজ সর্বদাই খানিকটা ক্ষিপ্ত। কথা বলে অল্প, হাসে না মোটেই। বেশি গোলমাল সইতে পারে না। একমাত্র গানের সময় যা একটু প্রফুল্ল থাকে সে। ইদানীং তার সাধনার রূপসটা কেটে গিয়ে কঠোর হয়েছে বলা চলে।

তার প্রৌঢ়া সেবাদাসী হরিমতী উঠোন নিকোচ্ছে। হরিমতীর বালিকা মেয়ে স্নান করে ঠাকুরঘরের দাওয়ায় বসে গাঁথছে ফুলের মালা। যামাকা বৈরাগী প্রাণেশ সমস্ত দেহটি তেলে ড়ুবিয়ে এবার শুরু করেছে মর্দন। আর মাঝে মাঝে হরিমতীর মেয়ে রাধার দিকে চোরা চোখে দেখছিল। রাধা অশ্য মাত্র বালিকা, তবু প্রাণেশের চোখের মধ্যে প্রচ্ছন্ন রাখার চেষ্টার মধ্যেও যেটুকু ফুটে উঠেছিল—সে ভাবগতিকটুকু রসের। আর এও সে জানে রাধাকে দেখে তার বুকে এ রসের সঞ্চার টের পেলে কেউ রক্ষা রাখবে না আর। বিশেষ করে হরিমতী যদি টের পায়, আর হরিমতীর খাণ্ডার বলে যা সুনাম আছে, তাতে কোন না সে একটা পোড়া কাঠ দিয়েই প্রাণেশের এ রসের ভাণ্ড পিটিয়ে ভাঙবে।

তবু এ চোখকে নিয়ে বড় জ্বালা প্রাণেশের। হাজার ফেরাও চোখ, তবু ঠাকুরঘরের এই জলে ধোয়া ধবধবে ফুলটির দিকেই নজর যাবে তার।

সরযু এল স্নান শেষ করে, কাঁখে জল-ভরা কলসি নিয়ে। সরযু প্রায় বনলতারই সমবয়সী, নসিরামের সর্বশেষ সেবাদাসী। এ আখড়ার মধ্যে সে খানিকটা অসামঞ্জস্য সৃষ্টি করেছে তার কথায় ব্যবহারে। বৃদ্ধ নসিরামের সঙ্গে মিল তো তার নেই-ই, তা ছাড়া, আখড়ার ভাবগাম্ভীর্যকে তার তরল হাসিঠাট্টায় বড় ক্ষুন্ন করে সে। কিন্তু বালকৃষ্ণের সেবার দায়িত্বপূর্ণ কাজগুলো প্রায় সবই তাকে করতে হয়। ভোগ রান্না থেকে ঠাকুরের শয়ন পর্যন্ত সরযুর কাজ। এত কাজ তবু এরই ফাঁকে ফাঁকে কথা হাসি গানে ভরপুর।

সরযুকে ঢুকতে দেখেই নসিরামের কোঁচকানো ভ্রূ কুঁচকে উঠল আরও। বলল হরিমতীকে লক্ষ করে, পোহর বেলা না কাটলে কি ঠাকুরের ঘুম ভাঙানো হইবে না? আর কখন খোলা হইবে দরজা ঠাকুরের—শুনি?

সরযু ভেজা কাপড়ে ছপছপ শব্দ করে ঘরে ঢুকে যায়।

রাধার তাড়া পড়ল। এখুনি তাকে কুটনো কুটতে যেতে হবে—ভোগের। প্রাণেশও তেলের বাটি রেখে উঠল লাফ দিয়ে।

হরিমতী সরযুর দিকে তাকিয়ে একবার ঠোঁট বাঁকাল। কিন্তু কাজ থামল না তার।

এমনি সময় কানে গেল বনলতার গুনগুনানি : সো হরি বিনু ইহ রাতিয়া।

সকলেই একটু তাজ্জব হল, তাকাল বনলতার দিকে। কিন্তু কাজ থামল না কারও।

নসিরাম বলল, বাসি কাপড় ধুয়ে এলি, নাইলি না?

–না, শরীরটা কেমন গমগম করছে।

অর্থাৎ গরম গরম ভাব। নসিরাম শঙ্কিত হয়। নিজের বলতে তো তার আর কেউ নেই এক মেয়ে বনলতা ছাড়া। আজকাল এও একটা চিন্তা হয়েছে তার। কেউ-ই তার আপন নয়, সবাই পর। জীবন ভরে সে কৃষ্ণের আরাধনা করেছে, কিন্তু সে কৃষ্ণ সার করেছে গৃহ। শুধু তাই নয়, বুড়ো বয়সে তার ভীমরতিও হয়েছে। বনলতার মায়ের মৃত্যুর পর ধর্ম ও বয়সের ভাঁড়ামোতে সে প্রথমে আনল হরিমতীকে। কিন্তু শেষের দিকে সরযুকে আনতে দেখে বনলতাও ক্ষুব্ধ না হয়ে পারেনি। এটা নসিরামের ধর্মের আড়ে বিকৃত মনের হীন লোভ। সে বোঝে যে, বনলতার তার উপরে যেমন টান নেই তেমনি কোনও টান নেই এ আখড়ার উপর। এ আখড়ার কারও সঙ্গেই প্রায় তার কথাবার্তা নেই। বরং নরহরির প্রতি মেয়ের খানিক টান আছে মনে করে তাকেই সে খানিকটা বিশ্বাস করে, কিন্তু নরহরির হাবভাব আখড়া রক্ষা করবার পক্ষে মোটেই সুবিধাজনক নয়। বনলতার হাতেই এ সমস্ত কিছু একদিন তাকে তুলে দিয়ে যেতে হবে। বনলতা তার একমাত্র সম্বল। বলল :

–তবে আর এত বিহানে উঠলি কেন, খানিক বেলা বিছানায় থাকলেই পারতিস।

—সে মোর সয় না। বলে এক লহমায় চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বনলতা বেরিয়ে যায় আবার ভেজা কৃাপড়টা টাঙানো বাঁশে মেলে দিয়ে। এসে উঠল গোবিন্দদের বাড়িতে।

পিসির তখন নিকানো শেষ হয়েছে। ওদিকে বকবকানির ধ্বনিটাও হয়েছে উচ্চ।

—হায় মোর মরণ নাই, ফ্রম কি কানা গো! এ ঘরে নাকি মানুষ থাকে। না-নোক না জন, এ আখড়াতে মানুষ থাকে কী করে বলো তো? শরীলে নাকি সয় এ ব আর। মরবার দিনেও কাঠ ঠেলতে হবে চুলোয়। কানা যম কানা মিনসে (অর্থাৎ স্বামী) চোখে কি দেখতে পাও না।

বলতে বলতে খেপে উঠল পিসি। দেখলও না বনলতা এসেছে।

—হক করলাম আজ ও ছাই পুঁথিসুথি সব যদি না পুড়িয়ে শেষ করি। ঢং চাষার ছেলে হবে পণ্ডিত, সৃষ্টিছাড়া যত অকাজ কুকাজ। বিয়ে নাই, শাদি নাই, নাই একটা ছওয়াল পাওয়াল, ঘরভ মরণপুঁথি। শ্মশানে-মশানে কালে দুলে মারল বাপটাকে, হায় পোড়াকপাল, এটারও কোন্ দিন যে কী হইবে। মরতে মরতে না জানি কী দেখে যেতে হইবে আমারে। পাপ, পাপ করিয়াছি অনেক এ পিখিমিতে, মরা যম সব শোধ তুলবে। না খাবে আমারে, না খাবে এ চোখজোড়া।

এবার খিলখিল করে হেসে উঠল বনলতা। বলল, কী হল গো। পিসি?

এই এক মেয়ে। জ্বলে যায় দেখলে পিসির সর্বাঙ্গ। বলে কত কথা, ভাল করে দেব তোমার গোবিন্দেরে, ঘরমুখো তবে ছাড়ব তোমার ভাইপোরে। পিসি ভাবে, বলে তোরই সেই মুখ ঘুরিয়ে দিল গোবিন্। হ্যাঁ, পিসিরও আছে আতঙ্ক এই সোয়ামীর পর সোয়ামী খাগীর সম্বন্ধে, বিশ্বাস করে, বজ্র ঝরে ওর নিশ্বাসে, শোষ টান আছে এ ডাইনী হুঁড়িটার, শুষে শুষে খায় ও। তবু পিসি যে ওকে আস্কারা দিয়েছিল, সে খালি হুঁড়ি যদি পারে তার ভাইপোর এ পাথুরে ধর্মজ্ঞানে ফাটল ধরাতে। তারপর ভাইপোরে কেড়ে নিয়ে ঘর জমাতে কতক্ষণ। কিন্তু তা হবার নয়। সবাই হার মেনেছে, মনের আর সে ঢিলে ভাব নেই বনলতার প্রতি, বিশ্বাস করে না আর পিসি তাকে। মুখেই ফুটোফুটি, কথার বেলা দেখা যায় গোবিন্দের একটু দর্শন লাভই যেন ঘুড়িকে পাগল করে।

সময়ে সময়ে গুলিয়েই যায় পিসির কাছে গোবিন্দের মতো বনলতাও। কারওই কোনও ধারা ধরা পড়ে না। সব যেন কেমন।

পিসি জবাব দিল না বনলতার কথায়।

বনলতা জিজ্ঞাস করল, পিসি কোথা চললে?

–যমের দক্ষিণ দোরে।

–ছি ছি, তা কেন যাবে। বলে গম্ভীর গলায়, কিন্তু হাসে মুখ টিপে। আবার বলে, সামনে তোমার সুদিন, ভাইপোর বউ আনবে, শুয়ে বসে খেয়ে আরাম করে মরবে।

বড় খুশি হয় পিসি, বড় আনন্দ পায়। কথাতেই তার আনন্দ, জীবনের এইটুকুই সম্বল। এইটুকুই যে তাকে বনলতা ছাড়া আর কেউ দেয় না। সেই জন্যই তো বনলতার প্রতি পিসি কঠিন হলে নরম হতে দেরি লাগে না বেশি। হতে পারে ডাইনী, কথাগুলো তো ভাল বটে। বলে, ফুলচন্দন পড়ক তোর মুখে, মরবার আগে আমি যেন তাই দেখে যাই; কিন্তু ছোঁড়ার ধনে যেন রোগ, না-সারবার ব্যামো গো। সেই এসে ছোট্টবেলাটি থেকে দেখছি এই ধারা।

কিন্তু বনলতা তো জানে গোবিন্দকে। সাধক গোবিন্দ, নিষ্ঠুর গোবিন্দ, কী এক প্রচণ্ড ঝড়ের বেগে টানছে তাকে। ধর্ম আর জ্ঞান মিলিয়ে সে যে কীসের টানতার হদিস জানে না বনলতা। শুধু বোঝে পিসির আর তার—তাদের সকলের থেকে বহু দূরে—এক দুর্ভেদ্য বর্মে আবৃত গোবিন্দ, যে পাথুরে বমের গায়ে বনলতার উধ্বশ্বাসে ছুটে চলা মাথাটা ঠোক্কা খায় বার বার, ক্ষতবিক্ষত হয় মাথাটা।

তবু পিসির মনগড়া কথাই বলে সে হেসে, তা একটা সোন্দর কন্যে টন্যে কিছু দেখাও না ভাইপোরে?

পিসি অমনি হাতের ন্যাতা ও বালতি রেখে বনলতার কাছে এসে, চোখদুটোকে বড় বড় করে বলে ফিসফিসিয়ে, দেখে এসেছি। টুকটুকে ছোট্ট এক কন্যে, পয়সাও দেবে মেলা, সচ্ছল মানুষের মেয়ে। দিনক্ষণ দেখে একদিন নেমন্তন্ন করব করব ভাবছি। যাঁ, সে মেয়ে পারে বোধ হয় ভোলাতে মোর গোবিনেরে।

—কে গো? বনলতাও তেমনি ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে।

চকিতে সন্দেহের ছায়া ঘনিয়ে এল পিসির চোখে। অমনি মুখখানি ভার করে সরে গিয়ে বলে, ব কথা শুনতে চাওয়া কেন বাপু? সে আমি মরে গেলেও বলব না।

—হ্যাঁ, সেই ভাল পিসি, সব কথা সবাইকে বলতে নাই। আমারই বা কী কাজ বাপু শুনে, অ্যাঁ?

চকিতে কী অদ্ভুতভাবে মুখ টিপে হেসে ন্যাকামোটুকু করে বনলতা, সাধ্য কী পিসির টের পায় একটুও।

—হ্যাঁ, সেই ভাল। বলে পিসি বালতি নিয়ে ডোবার দিকে যেতে যেতে ফিরে বলল, ডোবাটার ধার যা পেছল হইছে সঙ্গে একটু আয় তো লতি।

বনলতা হসল। ডোবার ধারে গেল সে পিসির সঙ্গে। দিব্যি শুকনো খটখটে ডোবার ধার। নীচের ঢালু অংশটুকুও সিঁড়িকাটা।

পিসি বলল, রাজপুরের দয়াল ঘোষকে চিনিস তো? বুড়ো দয়াল?

বনলতা বুঝল এ কীসের ইঙ্গিত। সু সে মাথা নেড়ে চুপ করে রইল।

অনেক দ্বিধা কাটিয়ে পিসি বলল, সেই দয়াল ঘোষের নাতনির সঙ্গে বুঝলি? কথাবার্তা খানিক কয়ে আসছি। বলিস নে যেন কাউকে।

না না। সে তো খুব ভাল কথা গো পিসি। হাসি চেপে বলল বনলতা।

বনলতারও একবার মনে হল, দেখাই যাক না একবার পরীক্ষা করে। গোবিন্দের পরীক্ষা হয়ে যাবে—মেয়েটিকে দেখে সে কী বলে।–গোবিন্দের পরীক্ষা? পরমুহূর্তেই যেন বজ্রাঘাতের মত শক লাগল বনলতার বুকে। ছি ছি, এ কী সে ভাবছে! গোবিন্দের পরীক্ষা। কোন পরীক্ষার বেড়ার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আজও গোবিন্দ? সে তো বহু দুরে উদ্দাম ঝড়ের বেগে ডানা-মেলে দেওয়া পাখি। কোথায় সে থামবে, আর কি নিশ্চয়তা আছে তার নাগাল পাওয়ার?

বাইরে থেকে হরেরামের হাঁক শোনা গেল, কই গো, গোবিনের পিসি কোথা গেল?

—ওই এসেছে মুখপোড়া। বোঝা গেল পিসি এই হকের জন্য প্রতীক্ষা করে দিল। বলল, বস, যাই। বলে—সেটুকটুক করে দ্রুত নেমে গেল ডোবার ধারে।

বনলতা বলল, পেছল যে, অত তাড়াতড়ি যেয়ো না। বলে মুখে কাপড় চেপে হাসে।

–আর পেছল। গেলেই বাঁচি।

সরে এসে প্রাণ ভরে একটু হাসল বনলতা। তারপর বাড়ির সামনে হরেরামের কাছে এসে দাঁড়াল।

হরেরাম একটা কাঁথা মুড়ি দিয়ে, উঠানের একধারে গুটিটি বসেছে। ক্লান্ত থমথমে মুটা বের করে রেখেছে শুধু। কোটরে ঢাকা চোখ দুটো লাল টকটকে।

বনলতা জিজ্ঞেস করল, কী গো অমন করে বসে আছ যে?অসুখ-বিসুখ করেহেনাকি?

–আর বলো কেন দিদি। ধুকে ধুকে বলল হরেরাম, শালার কর আর গড়তে চায় না গো। দুদিন ধরে পেটে নাই কিছু। তার মধ্যে আবার

—তো এলে কেন?

–এলাম, গোবিন বললে কী জন্যে নাকি ডাকহে ওর পিসি। ভ্যালা যা এক হয়েহে মোর, ছাড়তেও পারি না, রাখতেও পারি না। বলে একের তাড়া সয় না, এর আবার–

কথা বলতে আরম্ভ করলে আবার জ্বরের ঘোরে কথা বলতেইই করে হরেরামের।

বনলতা বলল, কী রাখা ছাড়ার কথা বলছ?

-এই তোমার গে-গোবিনের জমি। বিরক্তি দেখা যায় জ্বরে থমথমে মুটায় হরেরামের। বলে, লাভ তো কিছু নাই–কিন্তু কী করব। তবু যা হোক বিচালিটা মাস দুয়েকের খোরাকিটা হয়, কিন্তু সে দেখতে গেলে চলে না। ভাগে খাটি বাবুদের জমিতে, আর দুই পশ্চিম থেকে বোরে পুবে যেতে লাগে গোবিনের মাঠে যেতে। একলা মানুষ পারি না। অথচ কাজের সময় চুপ করে বসে থাকাও তো যায় না। সেই আমার ছুটতেই হয়।

হরেরাম ভাগচাষী আধিয়ার। নিজের জমি নাই তার, ভূমিহীন চাষী। পরম্পরায় এ অবস্থা ছিল না তার। বাপ মরার পরও কিছুদিন ছিল খালের ধারের সাত বিঘা জমি। কিন্তু এই নয়নপুরে আরও বহু চাষীর মতো একদিন দেখা গেল বাবুদের বাড়ির সেই লাল কাপড়ের মলাটের মোটা মোটা রাক্ষুসে খাতাগুলোর পেটে হরেরামের খালের ধারের জমিটুকু লেখা হয়ে গেছে। সে যাওয়া যে কী ভীষণ, কী সাংঘাতিক, তা নয়নপুরের ঘরে ঘরে জানা আছে। আজও জানছে, জানবে ভবিষ্যতে।

গোবিন্দের পিসি প্রথমেই হামলে পড়ে এসে। বলি, দেখা নাই কেন, দেখা নাই কেন তোর আর—অ্যাঁ? কী করলি না কলি, ধান কেমন হল না হল—

বনলতা বলল, ওর যে জ্বর হইছে গো। আসবে কেমন করে?

—ও ঢঙের জ্বর ঢের দেখছি। পিসি গরম হয়েই বলে, গত বছর, ক আঁটি ছুিলি দিয়ে তো নিস্তার পেলি, আর যে বিচুলিগুলান্ রইল, তার কী করলি।

হরেরাম নিস্তেজ গলাতেই বলল, তার কী করব বলল?একলা মানুষ পারি না। দরিদ্দের ঘর, পড়ে রইছে, খরচ হয়ে গেছে তেমনি।

-মরে যাই আর কী? ভেংচে উঠল পিসি।–মোর সোয়ামীও আধিয়ার ছিল রে, মোর সোয়ামীও ছিল। এমন ছ্যাঁচড়া বিত্তি দেখি নাই কভু। বিধেন তো বিধেন। ন্যায়ের কাম করে মানুষটা মরে গেল। দরিদ্দ তো কী, জোচ্চোরি করবে তাই বলে?

হরেরাম চুপ করে রইল। বনলতা বুঝল, হরেরাম গত বছরের বিচুলিটা গোলমালই করে ফেলেছে। তাই অমন অপরাধীর মতো চুপচাপ। কি হয় তো গ্রাহইবরহেনা পিসির কথার।

কিন্তু এ চুপ করে থাকাতে পিসি দমল না। বলল, এবার আমি সেই বিচুলি চাই, নয়তো টাকা মেটাতে হবে। হ্যাঁ, বলে দিলাম। হরেরাম নির্বিকারভাবে বলল, ও নিয়ে আর গোলমাল কেন বাপু। ছেড়ে দাও না। এ বছর তোমার সব কড়ায় গণ্ডায় মেটাব।

—কিছু শুনব না আমি। বলতে বলতে পিসি আবার গোবিন্দের প্রসঙ্গে চলে এল।–সেই হতচ্ছাড়াই তো যত গোলমালের রাজা। দেখল না বলেই তো গেল। বলে চাষার ছেলে, কাস্তে কুড়োল না ধরলে এমনিই হয়। আমি কোনও কথা শুনব না। বজ্জাতেরা মজা পেয়ে খুব লুটছ, না?

হরেরাম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, নেও বাপু অসুখ শরীলে আর গালমন্দ শুনতে পারব না অখন।

—তা পারবি কেন? জমিতে এবার একটুকুন সারও তো দিসনি, না এট্টুখানি পাঁক, না গোবর। তবে কি তোর রূপ দেখে ভাগে দিয়েছি। রাগছিস, গালমন্দ শুনবি না?

–ঘাট হয়েছে বাপু, ঘাট হয়েছে। কাঁথাসুদ্ধ হাত দুটো কপালে ঠেকাল হরেরাম, এই শেষ, আসছে বছর তোমরা অন্য কাউকে দেওগে জমি, ও আমি আর পারব না।

গোঙাতে গোঙাতে চলে গেল হরেরাম। এদিকে তার ওই কটি কথাতেই ঘৃতাহুতি পড়ল আগুনে। পিসি শুরু করল সারা উঠোনময় দাপাদাপি, গালাগালি আর শাপমন্যি। এ শপনি যদি সোজাসুজি যাত্রা করে তবে হরেরাম নিশ্চয়ই এতক্ষণ ঘরে যেতে যেতে পথেই মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মরে গেছে।

আখড়ার খোলকতালের ধ্বনি সঙ্গে নসিমের বৃদ্ধ গলার গান শোনা গেল। …

জাগোহে জাগোহে, সখা, জাগোহে, প্রাণনাথ জাগো হে, বালনীলমণি জাগোহে, জাগাও জগৎ হে, জাগাও জগৎ, মনকৃষ্ণ হে, জাগাও ভক্তহৃদয় হে।

বনলতা ঢুকল গোবিন্দের ঘরে।

ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কতগুলো বই। এলোমলো বিছানা। ময়লা কাঁথা বালিশটার কাছেই নেভানো প্রদীপটা যেন বুড়িয়ে-যাওয়া জীর্ণ কালো তেলের গাদে আর কালিতে ঝুলে পড়েছে। তা সত্বেও ঘরটা অপরিষ্কার মনে হয় না। সমস্ত ঘরটাতেই সাধকের গাম্ভীর্য যেন অবিচলভাবে ফুটে রয়েছে, যেখানে বনলতার প্রবেশ খানিকটা অনধিকার বলে মনে হল। আশ্চর্য, এ ঘরে ফুলের গন্ধও আছে, ঠিক তাদের বালকৃষ্ণের ঘরের মতোই নির্মল আর পবিত্র গন্ধ।

বনলতা অত্যন্ত সংকোচের দু-একটা বইয়ের গায়ে একটু হাত বুলায়, অক্ষর তো সে চেনে না। এ যেন গোবিন্দের সাধনার বস্তুগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে গোবিন্দর মনটাকে স্পর্শ করার বাসনা। সে যেন জানতে চায়, এ ঘরের আত্মাটার সঙ্গে যোগাযোগের পথের নিশানাগুলো কোথায়, তার সাধনা যেন এ ঘরের সঙ্গে একাত্মবোধের সাধনা।

জীবনের এ গতি পালটানোর দিনক্ষণগুলো মনে নেই তার। কিন্তু এটা খানিকটা সে বুঝতে পারছে, জীবনটা তার গতি পালটে অন্য কোনও দিকে চলেছে। বোধ হয়, ঝড়ের বেগে সেই ডানা-মেলে-দেওয়া পাখিটার মতো, সেও অসীম শুন্যে গন্তব্যহীন কোনও একটা পথের শরিক হয়ে পড়েছে। সে জানে না, এ ঝড় তাকে নিয়ে গিয়ে কোথায় ফেলবে, ভেড়াবে কোন্ কিনারায়। অনিশ্চয়তার পাড়ি জমিয়ে আজ আর বুঝি ফিরে যাওয়ার উপায় নেই বনলতার। বুকের অদৃশ্য ঝড়ে ডালপালা কাঁটা অনুক্ষণ ক্ষতবিক্ষত করেছে তাকে, তবুও একেবারেই অপরিতৃপ্ত জীবনের এই যেন শান্তি, এই ঘরের বিক্ষিপ্ত বস্তুগুলোকে হাত বুলানোও একটা তৃপ্তি।

অথচ এক এক সময় বনলতা কী দারুণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, জীবনটাকে দু হাতে দলে মুচড়ে ইচ্ছে করে ভেঙে ফেলতে, তছনছ করতে। কেন না, সে তো চায় আসুক জীবনের দুঃখ পীড়ন নিষ্পেষণ। ভাঙুক ঘর, পড়ক জল। ভাঙুক বাঁধ, ড়ুবুক মাঠ, ফাট ধরুক মাঠে জ্যৈষ্ঠের রোদে আর নিশ্বাসে, আসুক তার এই বস্তৃত গর্ভ থেকে নাড়ি ছিঁড়ে খুঁড়ে সন্তান; আসুক জীবনের পথে জমা সব সংকট, সব দুঃখ, সব অপমান, ক্লেশ, সবই বুক পেতে নেবে, বনলতা; সব সব সব, বনলতার সমস্ত বলিষ্ঠ দেহ দিয়ে সে সব নেবে, ঠেকাবে, ক্ষয় করবে নিজেকে পলে পলে।

কিন্তু হায়, কালনাগিনীর বিষাক্ত মসৃণ গা থেকে জীবনের সে রূপটাই যে ঝরে যায় বার বার। জীবনের সেই খোলা সংগ্রামের দিকটা এল না তার। শিউরে উঠল বনলতা। দু-হাত দিয়ে মুখটা চেপে ধরে অত্যন্ত আতঙ্কের সঙ্গে সে চোখ দিয়ে লেহন করল নিজের দেহটাকে। ইচ্ছে করল, প্রাণটাকে ছিনিয়ে নিয়ে এসে এখুনি আছড়ে শেষ করে দেয় ঘরের মেঝেটাতে। বড় অসহ্য হয়ে ওঠে এক এক সময় তার প্রাণটাকে জড়ানো রং-বেরং-এর ইন্দ্রিয়গুলোর বিচিত্র খেলা। ইচ্ছে করল, এই মুহূর্তে লাফিয়ে উঠে ঘরের মাচাটা ধরে ঝুলে পড়ে, ধ্বসিয়ে দেয় ঘটা, ভেঙে ফেলে তছনছ করে।

হ্যাঁ, এমনি তার জীবনের ঝড়ের বেগ, এমনি অসহ্য হয়ে ওঠে।

<

Samaresh Basu ।। সমরেশ বসু