…কিংবা, আচ্ছা ব্যাপারটা কি এই রকম নাকি, যে, এক তুখোড় চতুর একগুয়ে জেদী আর অব্যৰ্থ শিকারী, একটা বাঘকে মারবার জন্যে, একটা বাঘকে ফাঁদে ফেলে মারবার জন্যে, যেন একটা নধর পুষ্ট ছাগলকে, রাতের অন্ধকারের বনে, গাছের তলায় বেঁধে রেখে দিয়েছিল। আর বাঘটা তার শিকারের ডাক শূনে, গন্ধে গন্ধে, পা টিপে টিপে এল, বন ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে দেখল। দেখে, খেলতে আরম্ভ করল। বইয়েতে তো তাই লেখা থাকে, পাকা শিকারীদের অভিজ্ঞ বর্ণনায় সেইরকম অভিমতই ব্যক্তি হয়ে থাকে যে, একটু খেলা (বা র‍্যালা?) না হলে ঠিক শিকারের তৃপ্তি হয় না। অর্থাৎ পা টিপে টিপে একটু কাছে যাওয়া, আবার, পেছিয়ে আসা, প্রদক্ষিণ করা, প্রদক্ষিণ করতে দূরত্বটাকে কমিয়ে নিয়ে আসা, ওত্‌ পাতা এবং তারপরে এক লাফ। আর লাফ দেবার সঙ্গে সঙ্গেই…

আমার হাসি পেয়ে গেল। একটা চোখ বুঝে, আমি আয়নার দিকে তাকলাম। যেন সেই শিকারীকেই খুঁজলাম, বাঘ শিকারীকে, এবং এক্ষেত্রে যে তার কোন অস্তিত্বই নাই, তাই ভেবে আমি নিজেকেই কয়েকবার চোখ টিপলাম। ভেংচানোর মত হেসে, একটা খিস্তি করলাম, সেই অস্তিত্বহীন কল্পিত শিকারীর উদ্দেশ্যে। উপুড় হয়ে শোয়া অবস্থাতেই সিগারেটটা আমার ঠোঁটে ছিল। আর ঠিক খাট বরাবরই ড্রেসিং টেবিলের উপর আয়নাটা রয়েছে। রয়েছে, মানে রাখাই হয়েছে এমনভাবে, যেমন শুয়ে শুয়ে নিজেকে, নিজে এবং আর কেউ যদি থাকে তাকেও দেখা যায়। আর কেউ বলতে কি বোঝায়? ন্যাকা। নাক টিপলে দুধ গলে, আর কেউ বলতে কি বোঝায়, তুমি জানো না। ডবল ডেকার বাসের ভিড়ে বা চৌরঙ্গীর সিনেমার লরীতে, তুমি এক পলকে, একটি চোখে লাগা মেয়েকে, মনে মনে নগ্ন করে নিখুঁত করে দেখে নিতে পার, আর খাট বরাবর আয়নায়, তোমার কাছে, পাশে বা যে ভাবেই হোক, আর কেউ বলতে কি বোঝায় বা কী উদ্দেশ্য এবং কী ফন্দী ফিকির মনের ইচ্ছা হয়ে লুকিয়ে থাকে, তুমি তা জান না। অবলোকনের কী ঐশিয্যি রক্তকে ডেকে ডেকে তোলে, যার জনে, এ মার্কা বিদেশী ছবি দেখিবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে আগে থেকে এ্যাডভান্স টিকেট কাটো কিংবা ব্লু ফিলম্‌ দেখতে যাও গোপনে, তোমাল্‌ তা দানা নেই।

খচ্চর! একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে, হেসে আমি নিজেকেই আদর করে বললাম। এবং আয়নার প্রতিবিম্বেই নীতার শাম্পু করা রুক্ষ চুলের গোছার দিকে তাকালাম। যে-চুলের গোছা, একটু আগেই আমি বিলি কেটে কেটে, ঘাড়ু থেকে তুলে, ওর মাথার ওপর দিয়ে লুটিয়ে দিয়েছি। নীতাও উপুড় হয়ে রয়ছে। আমিই উপুড় করে দিয়েছি। ঠিক যেখানে ছিল, সেখানেই ঔপুড় করে দিয়েছি। ও আমার বুক ঘেঁষে কোল ঘেঁষে ছিল, এখনো তাই আছে। মুখটা আমার থেকে উলটো দিকে ফেরানো। আয়নার দূরত্বটা এমন জায়গায়, ওর পাশ ফেরানো চোখ বোজা ফর্সা মুখখানি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওর সমস্ত দেহটাই দেখা যাচ্ছে। ওর মেদহীন সুগঠিত খোলা পিঠা, এত সুন্দর আর স্বাস্থ্যপূর্ণ, শিড়দাঁড়ার মাঝখানটা যেন দু পাশ থেকে ঢালু হয়ে নেয়ে এসে একটি তীক্ষ্ণ গভীর রেখায় আঁকা পড়েছে। নিটোল কোমল ফর্সা পিঠ জামা নেই। পিঠটা যেন ক্ৰমাগত ত্রিভুজের রেখায় কোমরের দিকে নেমে গেছে। তারপরে লাল নীল ছাপকা ছাপকা (রং-এর শাড়িটা রং-এর এটা কী ফ্যাশান, আমি জানি না।) আমিই কোমর থেকে ঢেকে দিয়েছি। দেওয়া উচিত, এরকম একটা চেতনার থেকে যে দিয়েছিলাম, তা আমি স্মরণ করতে পারছি না। হতে পারে, নিতান্ত চোখে দেখার অভ্যাসের দরুণই দিয়েছিলাম। শায়াটা তো লুটনোই রয়েছে খাটের এক পাশে, ব্লাউজ ব্রেসিয়ার যেখানে দলা পাকানো।

নীতা আমার বাঁ পাশে। ওর ভ্যান হাতটা মাথার পাশ দিয়ে ওপর দিকে এলানো, বাঁ হাতটা ওর বুকের কাছ ঘেঁষে কনুই মুড়ে রয়েছে। বাঁ হাতটা ওরকম না থাকলে ওর চব্বিশ পুষ্ট যৌবন (যৌবন বলতে আমি ওর সুউচ্চ সুগঠিত বুকের কথাই বলছি, আর এরকম কথা মনে হলেই আমার সন্ধিক্ষণের বয়সে, বেলেঘাটার মাসতুতো দাদার কাছে শোনা সেই গানের কলিটা নির্ঘাৎ মনে পড়বে, ও মালিনী তোর বাগানে জোড়া ডালিমে… ইত্যাদি। সম্ভবতঃ পাশ থেকে আরো উগ্র স্পষ্ট হয়ে উঠত। ওর গায়ে অলঙ্কারের বাহুল্য নেই। ডান হাতে একটা রুলি, বাঁ হাতে ঘড়ি।

আয়নার প্রতিবিম্বেই ওর দিকে আমি চোখ ফিরে তাকালাম। আলস্য মাখানো ভঙ্গীতে, শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে হেসে, নীতাকেই যেন সাক্ষী মানলাম। কারণ, ঘণ্টা দেড়কে আগেই, কিংবা ঘণ্টা দুয়েক হবে বোধ হয়, আমরা দুজনেই আয়নাটার ছায়ায় দুজনে দুজনকে দেখছিলাম, আর বলাবলি করছিলাম। দেখেছ?

যা অসভ্য!

নীতি সলজ্জ হেসে বলছিল, চোখ বুঝে থাকছিল, যাতে আয়নাটার দিকে কোনরকমে চােখ না পড়ো মনে হয়েছিল, লজ্জাটা আসলে কামনার উদ্বেল হয়ে কুঁকড়ে যাওয়ার একটা প্রবণতায় ও ওরকম করছিল। অথবা যথেষ্ট সম্প্রতিভ সাবলীল হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদের ওসব ব্যাপারে একটু লজ্জা-টজ্জা বেশী থাকে, বা কে জানে, হয়তো অবলোকনের থেকে, অনুভবের নেশায় গভীরভাবে ডুবেতেই ওরা বেশী ভালবাসে। জানি না বাবা অত সব। মোটের ওপর নীতা সলজ্জভাবে আয়নাটার দিকে চোখ না দেবার চেষ্টা করছিল। চেষ্টা করছিল, কারণ, দেখছিলাম, ওর চোখ জোড়াকে যেন আয়নাটা সুখীর মত হাতছানি দিয়ে ডাকছিল, এই ৷ এই নীতা, দ্যাখ দ্যাখ। আর সেই ডাক শুনে ও চকিতে চকিতে এক একবার আয়নার দিকে তাকিয়ে ফেলছিল এবং হাত দুটোকে শরীরের নানান অংশে রাখতে চাইছিল। ও তো বেশ্যা নয় যে, একটা বিক্ষুব্ধ ঘৃণায়, প্রায় চেতনাহীন শরীরটাকে আলোকিত ঘরে হাট করে খুলে ফেলে রেখে দিয়েছে, যেখানে অবলোকন বা অনুভূতি, এসবের কোন মূল্য বা তাৎপর্যই নেই। অবিশ্যি, এ সবই আমার ধারণা। যেমন সার্কাসের নেপথ্যে ম্যানেজারের গলা শোনা গেল, ওহে বীরেশ ক্লাউন, এই শেষ খেলাটায় তুমি একটা পাক মেরে এস গে। আজ্ঞে স্যার, নাকটা ল্যাজটা খুলে ফেলেছি যে? আবার লাগাও। আচ্ছা স্যার। তারপর নাক আর ল্যাজ লাগাতে লাগাতে মনে মনে বলতে লাগল, শুয়োরের বাচ্চা, ম্যানেজারগিরি ফলাতে এসেছে, শালা দু মাসের মাইনে দেয়নি, ভাল করে খেতে পর্যন্ত… এই বলে দাঁতে দাঁত পিষতে পিষতে হু-ক্‌ হু-ক্‌ ক ডাক ছেড়ে হাসতে হাসতে মঞ্চে যায়, এবং খেলা দেখিয়ে ফিরে আসে আর কী খেলা দেখিয়ে এল, মুহূর্তেই ভুলে যায়, কেবল বিক্ষোভটাই ভিতরে জমা হয়ে থাকল, অনেকটা সেইরকমের আমি বলছি।

যাকগে এসব কথা। আমার ধারণা দিয়ে কী হবে। মোটের ওপর বাজারের বেশ্যা এবং নীতা এক নয় বলে আমার বিশ্বাস, কারণ ওর জীবনেও নানান বাধ্যবাধকতা থাকলেও, ইচ্ছে মতো, পুরুষ বন্ধর সংসর্গ করার উপায় আছে। এমন নয় কি যে, পুরুষে সংসর্গই হচ্ছে ওর জীবিকা। ভাল লাগার একটা ব্যাপার এখনো বোধ হত্ন আছে। অবিশ্যি এরকম মেয়েদেরই স্বৈরিণী বলে কিনা, আমি জানি না। স্বেচ্ছাচারিণী যাকে বলে। কারণ নীতা ওর ভাল লাটাকে স্বাধীনভাবে কাজে লাগিয়ে থাকে। যেমন আমি। আমিও ওর ভাল লাগা স্বাধীনতার কাজে লেগে থাকি। আমি নিজেও তাই নয় কি? ক নয়, তা জানি না। এ ক্ষেত্রে ভাল লাগার স্বাধীনতাকে কাজে লাগাতে পারলে কেউ কি ছেড়ে দেয়? কে স্বেচ্ছাচারী নয়? আমার তো মনে হয়, গোটা পৃথিবীটা বন্দী-স্বেচ্ছাচারীতে ভারাক্রান্ত।

কিন্তু দূর হ, পৃথিবীটা রসাতলে যাক। নীতার ভাল লাগার কথা ভাবছিলাম। ভাল লাগাটা আছে বলেই আয়নাটা বা ছায়াটা বা আমি, কোন কিছুই বোধ হয় ওর কাছে নিতান্ত প্রাণহীন নিরেট ছিল না।

নিজেদের না দেখবার জন্যেই যদি হবে তবে আয়নাটা ওখানেই রাখা, হয়েছে কেন?

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।

জানি না। ফাজিল!

সব মেয়েদের মতই নীতা ঠোঁট ফুলিয়ে হাসির ধমকে বলেছিল। তার মানেই, পুরোপুরি জানত। তাই, এখন আয়নাটার দিকে তাকিয়ে এসব কথা আমার মনে হওয়ায় নীতার দিকেই আমার চোখ পড়ল, ওকেই যেন সাক্ষী মানলাম। কয়েকবার সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে, বাঁ হাতটা ওর পিঠের ওপর রাখলাম।

বেশ দেখাচ্ছে এখন আমাকে, না? অল ওপন টেরেলিনের সার্টটার সব বোতামগুলোই খোলা। হার গুটানো। অলিভ গ্রীনের মুহরি নালী প্যাণ্টটা কোমর থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত কাপটি খেয়ে এঁটে আছে। আর অলিভ গ্রীনেরই মোজ। পয়েন্টেড টো ইটালিয়ান কালো জুতোসুদ্ধ পা দুটো আমার উঠে আছে। যে-চীনা মেকার জুতো জোড়া তৈরি করে দিয়েছিল সে বলেছিল, তোমার পকেটে আর ছুরি রাখতে হবে না। তার মানে ডগা এতই ছুঁচলো ও তীক্ষ্ণ যে ছুরির কাজ চলে যায়। চীনা আরো বলেছিল, ইপ ইউ শত্‌ এনিবোদি অন দি বেলি, তো বেলি পাত যায়েগা। বলে চোখ ঢেকে, সোনার দাঁত দেখিয়ে খুব রগুড়ে হাসি হেসেছিল। আয়নায় জুতোর তলার ছায়া পড়েছে। খুব একটা ধুলো ময়লা লেগে আছে কি জুতোর তলায়? আছে, তবে তেমন নয়। নীতা খুলতে বলেছিল জুতো জোড়া। ডানলোপিলোর গদীর ওপর এমন ধবধবে ফর্সা চাদর পাতা। খাটটাও তো সুন্দরই। ন্যাচরেল কলার নিচু বিলেতি ডিজাইনের খাটা মোজাইকের মেঝেতে তার একটা হালকা প্রতিবিম্ব পড়েছে। সর্বোপরি নীতা, যার সঙ্গে একই খাটে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলাম, সেও রূপসী বটে, যুবতী তো হাজারবার, এবং পোষাক পরিচ্ছদও যথেষ্ট ফাসানদুরস্ত।

ও বলেছিল জুতে খোল।

আমি বলেছিলাম, আবার জুতো খোল? থাকগে।

নীতা বলেছিল, বিছানাটা ময়লা হবে না?

কতটা আর হবে।

নীতা আর কিছু বলার আগেই আমি গদীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। নীতা একটু থমকে গিয়েছিল, ভুরু কুঁচকেছিল। বিরুক্তির লক্ষণ যাকে বলে। আমি অবিশ্যি একটু ঝোঁকে মাথায় ছিলাম। নীতাও, তবে আমি একটু বেশী ছিলাম, তাই ওর থমকানে। বা ভুরু কোঁচকানো ঝোঁকের ঠ্যালায় গায়েব করেছিলাম। বিকেলে কথা ছিল, প্রতিযোগিতামূলক একটা চাকরির ব্যাপারে একজনের জন্যে, পিছনের দরজার উমেদারিতে যাব রুবি দত্ত-এর কাছে। রুবি দত্ত-এর থেকে রুবী দেবীটাই বেশি উচ্চারিত হয় বর্তমান কলকাতায়। দেবী তো বটেই, কেউ কেউ তো কালী কেলকেত্তাওয়ালীও বলে। অর্থাৎ কলকাতেশ্বরী-ইয়বেঙ্গেশ্বরী বললেই বা ক্ষতি কী! আমার অবিশ্যি ঠাটেশ্বরী বলতে ইচ্ছে করে, বলিও মনে মনে। সেই রুবি দত্ত যদি সামনে দাঁড়ায় তবে অনেক পিছনের দরজার কুলুপই নিঃশব্দে খুলে যায়। ওই মেয়েলোকটিতে কী যাদু আছে জানি না, তবে তাকে ক্ষমতাবান ব্যক্তি ওর আঁচলে বাধা। অনেকে বলে, মাগী জাঁহাবাজ। জাঁহাবাজ স্ত্রীলোক হলেই যে কলকাতার ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের আঁচলে বাঁধা যান, তা আমি মানি না। বিদ্বেষপরায়ণ লোকেরা একটা যা হোক বিশেষন ব্যবহার করতে ভালবাসে। কানে শুনতে একটু যুতসই লাগলেই হল। তার কোন মানে-টানে দরকার নেই, নাকি? তা হলে, ডেসডেমোনিয়াও জাঁহাবাজ, তার রূপটা জাঁহাবাজ রূপ, কেন না, সে অতবড় একজন সেনপতিকে আঁচলে বেঁধেছিল। অবশ্যি রুবি দত্ত-এর সঙ্গে আমি ডেসডেমোনিয়ার তুলনা করছি না। তার আবার নিষ্টা পবিত্রতা সতীত্ব ইত্যাদি ছিল। আর রুবি দত্ত বিবাহিত, হাবুল দত্ত অর্থাৎ যত বদখত্‌ ব্যবসায় ঘুরে বেড়ানো, মদে ডুবে থাকা এবং তেএঁটে বদমাস বলে যার নাম আছে কলকাতায়, সেই লোকেন দত্ত-এর স্ত্রী সে। দৈহিক পবিত্রতা বা সতীত্বের মত কোন বোকামি বা বুজরুকির আগল তার নেই। এই তিরিশ বত্রিশ বছর বয়সেও রূপ যৌবন যথেষ্টই আছে, পেটে বিদ্যেও মন্দ নেই, সোসাইটি, কালচার ইত্যাদি সম্পর্কেও সচেতন, সন্দেহ নেই। যদিচ মাত্র এসব মূলধনেই ক্ষমতাবানদের আয়ত্ত করা যায় না। এ রকম অনেক আছে, অনেক ঘুরে বেড়াচ্ছে এই কলকাতায়। যারা রুবি দত্ত হতে চায়। কিন্তু হতে পারে না। আমার পাশে, এই নীতাও হয়তো তাই চাইত। কিন্তু হতে পারতো না। তা হলে রুবি দত্ত-এর নিশ্চই একটি কোন প্রতিভা আছে। প্রতিভা! কে জানে, ক্ষমতাবান লোকদের আয়ত্ত করার জন্যে, স্ত্রীলোকদের কোন প্রতিভার দরকার হয় কি না। না হলে, অন্যেরাও রুবি দত্ত হয়ে উঠতে পারে না কেন? আঁচলে বেশ ভারী চাবির গোছা তো সবাই বাঁধতে চায়।

এ ক্ষেত্রে প্রতিভাকে খাপ খেয়ে যাওয়া বলে কি না কে জানে। এই যেমন সেদিন শুনেছিলাম, মস্ত আইনজীবী হারাণ নেয়োগী নাকি (বোঝ, বিরাট আইনজীবীর নাম হারাণ নিয়োগী! আমার তো মনে হয়, একমাত্র কারখানার কেরাণী ক্ষান্তবালা পতিরই এ নাম হতে পারে।) বছরখানেক ধরে একটা মেয়েকে নিয়েই পড়ে আছে। মেয়ে মানে, এক্ষেত্রে উপপত্মীই বুঝতে হবে। মধ্যবয়স অতিক্রান্ত, বিবাহিত এইচ এন-এর (হারাণ নিয়োগী) বন্ধু এবং পরিচিত মহলে, এ ব্যাপারে সবাই থ মেরে গেছে। পক্ষকালে বা মাসে মাসে যে-লোকাটা মেয়ে বদলায়, নতুন নতুন চায়, সে বছর ধরে একটা মেয়েকে নিয়ে নাকি কাটিয়ে দিচ্ছে। বছরকাবারির জন্যে বিস্ময়, আর অন্য সময়ে  লোকেদের জ্বালা। শুনলে, জ্বালা আমারও হয়। কার না হয়, তা জানি না। আর জ্বালা, মানেই তো, বদলী স্বাদের জন্যে সকলের জিভই লকলক করছে। তৃষ্ণা বুকেই শুকিয়ে যায়, কারুর অক্ষমতায়, কারুর ভয়ে! এখন সবাই একটু থতিয়ে গেছে, কাণ এটা প্রায় একটা অঘটন। তাও যদি মেয়েটা অতীতের সব মেয়েদের থেকে দেখতে একবারে আনারকলি হত, একটা কথা ছিল; তাও নয়। এখন নাকি সকলের মানে হচ্ছে, এই মেয়েটা এইচ এন-এর কাছে বরাবরের জন্যেই বোধ হয় টিকে গেল। এখন মেয়েটা এইচ এন-এর চারপাশের মহল শত্রু হয়ে উঠেছে। কারণ আস্তে আস্তে মেয়েটা কিছু ক্ষমতার অধিকার পাচ্ছে। এইচ এন-এর তহবিল থেকে শুরু করে, তার বুদ্ধিশুদ্ধি, সবকিছুর ওপরেই মেয়ের দখলীস্বত্ব নিশ্চয়ই কিছুটা স্বাভাবিক। তেমন প্রতিদ্বন্দিনী যদি সহসা না জোটে, তা হলে দখল কায়েমী হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। কেউ কেউ গম্ভীরভাবে ঘাড় দুলিয়ে বলতে আরম্ভ করেছে, জীবনসায়াহ্নে এসে এইচ এন তা হলে ভালবাসার সন্ধান পেল। উল্লুক! তা ছাড়া এদের আমি আর কিছু মনে করতে পারি না। একে কাব্যি করাও বলে না, কব্‌তে করা বলে। জীবনসায়াহ্ন, ভালবাসা! পীরিতের হালুয়া! বিল্বমঙ্গল আর চিন্তামণি, পুরুরবা আর উর্বসী (উর্বশী) নয়? তবে আর এতদিন ধরে লোকে কেনই বা বলে আসলে, অমুকের রূপসী বিদুষী বউ থাকতেও একটি কালকুটি খেঁদিকে নিয়ে পড়ে আছে। সেকেলে লোক হলে বলত, একে বলে পারভারশন। সেকস্‌ এ্যাডজাস্টমেন্ট বললে বুঝি গালাগালি দেওয়া হয় না? বা সেকস্‌ এ্যাটাচমেন্ট? নাকি এটা আবার তেমন বিজ্ঞানসম্মত নয়। এখন তো আবার সবই সায়ান্স, সবাই সায়ান্টিফিক। যাকগে, মোট কথা আমি বুঝেছি বাপু, এইচ এন-এর ক্ষুধাকে এই মেয়েটাই পারে জাগাতে, পারে তৃপ্ত করতে অতএব আইসক্রীম, জমে যাওয়া যাকে বলে আর কি। এখন ভালবাসাই বল আর হিপনোটিজম, যা খুশি বল।

এই পারাটাকে কি মেয়েটার প্রতিভা বলতে হবে নাকি? রুবি দত্তও সেইরকমের প্রতিভার মালিকানী কি না—কিন্তু যাকগে, মোট কথা রুবি দত্ত, বড় বড় চাবির গোছাওয়ালী, আমাকে একটু নেকনজরে দেখে থাকে। কেন দেখে থাকে, এবং সেটাও আবার আমার কোন প্রতিভা কিনা, কে জানে। প্রতিভা! প্রতিভার ছড়াছড়ি। তবে হ্যাঁ, রুবি দত্ত আমাকে, রুবিদি বলে ডাকবার হক দিয়েছে, এবং তোমার যদি আমাকে কোন দরকার-টরকার হয়, জানিও কিংবা সময় পেলে খোঁজ-খবর একটু নিও এমন অধিকার দিয়েছে। রুবি দত্ত? সময় পেলে! দলকার-টরকার!

একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে, আয়নার আমিকেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, আর হাসির দমকে আমার শরীরটা ডানলোপিলোর গদীসহ নাচতে লাগল। নীতার শরীরটাও, যে-ভাবে পড়েছিল সেভাবেই আমার সঙ্গে যেন তাল দিল। এবং হাসিটা থামলে, আমার চোখের সামনে রুবি দত্ত-এর চেহারাটা ভাসতে লাগল। কী করে বোঝাব, ক-ত দরকার, ক-ত অসীম সময় তোমার জন্যে দিতে পারি রুবিদি। কী একটা যে আছে না চোখের মধ্যে, আর শরীরে, আর ভঙ্গিতে, আমার যেন বাদলা পোকার মত পাখা কাঁপতে থাকে। হলই বা বয়সে কিছু বড়। কিন্তু কবে আসবে সেইদিন, আমারে চোখ ইস্‌সারায় (ইশারায়,) ডাক দিলে হায়…। আচ্ছা, সেরকম একটা যন্ত্র যদি সত্যি আবিষ্কৃত হত, ছোট্ট একটা যন্ত্র, পকেটে বা ক্ষুদ্র ভ্যানিটি ব্যাগেই যেটাকে নিয়ে চলাফেরা করা যেত, এবং তুমি যখন যার মনের কথা পড়তে চাইছ তাই ফুটে উঠছে সেই যন্ত্রে। সে যা ভাবছে, তোমার যন্ত্রে তাই ফুটে উঠছে, তা হলে কেমন হত? পর স্বামীর কাছে একটি আছে, স্ত্রীর কাছে একটি প্রেমিকের কাছে একটি, আর প্রেমিকার কাছে আর একটি গোয়েন্দা এবং অপরাধীর কাছে দুটি, তা হলে পৃথিবীর চেহারাটা কেমন হত? অনেক বন্ধুবান্ধবীদের দেখেছি, এরকম একটা যন্ত্রের আলোচনার সময় হাসতে হাসতেই তারা শিউরে উঠেছে। ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছে। বলে উঠেছে, না না, অমন বস্তুরে দরকার নেই বাবা। সব রসাতলে চলে যাবে, খুনখারাপি হয়ে যাবে। তার মানে, কারুরই নিজেকে বিশ্বাস নেই। কেউই কারুর কাছে ধরা পড়তে চায় না। স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধু-বান্ধবী, আর দারোগাদের কথা তো ছেড়েই দিলাম। সকলের মধ্যেই না-বলার অনেক কিছু আছে, এমন কিছু, যা দুজনের কেউ কাউকে কখনোই বলতে পারবে না। পারবে না তো বটেই, সারা জীবন ধরে শুধু পরস্পরের কাছে কত ভালভাবে গোপন করে রাখা যায়, কত সুন্দর ভাবে, নিটোল মুন্সীয়ানার সঙ্গে, দুজনের কাছে দুজনকে জানতে না দেওয়া যায়, তারই চেষ্টা কবে। তাই তো দেখছি আখচার। ঘরে বাইরে, পথে ঘাটে, এই প্রতি মুহূর্তের গোপনীতার জন্যই কত ঠাঁট বাট, কত কথা, কত বিচিত্র আচরণ।

কিন্তু সত্যি কি এরকম একটা যন্ত্রের দরকার আছে? যন্ত্রটা ছাড়াই কি সবাই সবাইকে চেনে না? জানে না? চিনে আর জেনেও এ অন্যায়, এ পাপ এসব মনে হলেও পরস্পর পরস্পরকে মেনে নেয়নি? যাকে বলে এ্যাডজাস্টমেন্ট। তুমিও যা, আমিও তাই। পরস্পরের পাপের সঙ্গে একটা আঙ্কিক কাটাকাটি খেলা খেলে, ইজুকাল টু সমবাওতা করে চলেছে না

তা হলে রুবি দত্ত-এর কাছে বা আমার কাছে, ওরকম একখানি যন্ত্র থাকলেই বা কী লাভ হত। আমরা কি কেউ কাউকে চিনি না? রুবি দত্ত কি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। আমি কি এক এক সময় রুবি দত্ত-এর নেকনজরওয়ালী, তিরছি আঁখের সঙ্গে, একটু আদর মেশানো হেসে বলা, কি হিরো, চেহারাটি তো দেখছি একেবারে পেশাদার লেভীকিলার করে তুলেছ শুনিনি। যন্ত্র ছাড়াই, আমার সম্ভ্রম মেশালো, হুকুম-বরদার এক পায়ে খাড়া, করুণাপ্রার্থী অথঢ় সচকিত ভাবভঙ্গি এবং তাতে রুবি দত্ত-এর খুশী ও তৃপ্তি ও আমার সবকিছুতেই সহাস্য উপভোগ, পরস্পর লক্ষ্য করিনি।

করেছি, এবং লেগেও আছি। এক্ষেত্রে আমাকে লেগে থাকতে হবে, কারণ রুবি দত্ত অনেক উঁচুতে আছে, অনেক ভক্ত আছে তার। আমাকে লড়তে হচ্ছে, লড়ে নিতে হবে। এই তো আজও নীতা বলছিল, রুবি দত্ত-এর থেকে অনেক বেশী সুন্দরী; বয়সেও তানেক ছোট নীতা, ঠোঁট ফুলিয়ে, যেন আভিমান করে বলেছিল,এখন তোমার রুবি দত্ত-এর কাছে যাওয়া আসা, আমাকে কি আর ভাল লাগবে?

কথাটা এমন একটা সময়ে বলছিল, যখন আমি আপ্লুত খুশিতে, সুখের জোয়ারে, মাতালের মত ওকে আদর করতে করতে প্রায় ঙিয়ে গুঙিয়ে বলছিলাম, মাইরি বলছি নীতা, তোমাকে তোমাকে আমি কখনো ভুলতে। পারি না, তোমাকে যদি সব সময়ের জন্যে পেতাম, একলার জন্যে…। তখনই ও কথাটা বলেছিল। ওর চেতনা তখনো আমার জোয়ারের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়নি, বুঝতে পারছিলাম, তাই ও সচেতনভাবেই আমাকে খোটা দিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, মাথা খারাপ, রুবি দত্ত কত বড়!

বড় তো কী।

এখন ওসব বাজে কথা ছাড়।

আমি ওকে আদর করে, চুপ করিয়ে দিতে চাইছিলাম। তার ওকেও অনেক পালটা কথা আমার বলতে ইচ্ছে করছিল। যদিও ওসব বলাবলির কোন মানে হয় না। কেন না, আমি রুবি দত্ত-এর কাছে যাওয়া আসা করি, আর নীতা বুঝি ধোয়া তুলসী পাতা। এই ঘরে নীতার ভাষায় এ্যাপার্টমেন্ট, এই খাটে, এই বিছানায় এমন করে শুয়ে একলা আমিই বুঝি এই আয়নায় এমন করে নিজেকে দেখছি, নীতাকে দেখছি। আর কেউ দেখেনি। ওসব বুজরুকি আমার জানা আছে। আগে আগে আমার এইরকম ধারণা ছিল, নীতা আমার, একলা আমার, আমাদের প্রেম হয়েছে। পেরেম!

প্রথম যেদিন ধারণাটা ভাঙল, আর জানলাম, আমি একা নই, সেদিনে, ও বাবা। আমার কী রাগ! কী কষ্ট, অথচ তার দুদিন আগেই দক্ষিণ বাঙলার এক গ্রামে বেড়াতে গিয়ে একটা ফুটফুটে ষোল সতের বছরের মেল্লেকে…সে মেয়েটাও বলিহারি, পাড়াগাঁয়ের নীরিহ ডাগরচোখ মেয়েটা, আমার চোখের ছাউনি দেখেই গলে গিয়েছিল, হেসেছিল, আর প্রায় নির্ভয়েই…কী বলব—মেয়েটাকে আদর-টাদর করার পর আমি নিজেই তো বলে ফেলেছিলাম, যাঃ শালা।

তবু যখন প্রথম জানলাম, প্রথম সেই দিনটা যে, নীতা আমার একলার। নয়, সেই দিনটি! এ মার্ডার হুইচ আই টি এ স্যাক্রিফাইস : আই স দ্য হ্যাণ্ডকারচিফ। কিন্তু তারপরে আমি অনেক দিন একলা একলা হেসেছি। তুমি সাধুপুরুষ। আর নীতা অসচ্চরিত্রা, বিশ্বাসঘাতিনী! মাথায় গাট্টা! তুমোও যা, আমুও তাই। সবই তো বোঝ বাবা!

উঃ! খেয়াল করিনি, কখন সিগারেটটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, আগুনের তাপ লাগছে ঠোঁটে। পুড়েই গেল বুঝি ঠোঁটটা। ললার সঙ্গে আটকে যাওয়া আগুনের টুকরোটা তাড়াড়াড়ি কোনরকমে তুলে নিয়ে ডান দিকে হেলে পড়লাম। বাঁ হাতে নীতার খোলা পিঠের ওপর হাত দিয়ে, শরীরের ভার রেখে একটু দূরের টি-পায়-এর ওপরে, ছাইদানিতে গুঁজে দিলাম। ঠোঁটটা চেটে অনুভব করতে চাইলাম, সত্যি পুড়ে গিয়ে ফোস্কা পড়েছে কি না। আয়নার প্রতিবিম্বে ঠোঁট উলটে দেখতে চাইলাম। ফোস্কা বোধ হয় পড়েনি, তবে গরম লাগছে খুব, জ্বালাও করছে। আর এটা অনুভব করতে গিয়ে বা হাতটা মনে হল, বরফের ওপর পড়ে আছে। ঠাণ্ডা এবং শক্ত। প্রায় ভুলেই বসে আছি, নীতা ডেড, মানে মরে পড়ে আছে। এতক্ষণ কিন্তু এতটা ঠাণ্ডা লাগেনি। এতটা ঠাণ্ডাও ছিল না। এখন যেমন মনে হচ্ছে, ঠাণ্ডা আর শক্ত। ওর সুগঠিত পিঠের সেই কোমলত। এখন আর অনুভূত হচ্ছে না।

আমি ডান হাত দিয়ে আমার গালে মুখে বুলিয়ে দিলাম। কত তফাৎ অগ্রহায়ণ মাস, শীত তো আছেই। তবু আমার হাত-মুখ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হলেও একটা গরমের ভাব আছে। আর নীতার শরীরের ঠাণ্ডাটা, একেই বোধহয় মৃত্যুর শীতলতা বলে। আর আমারটা—এটাকি প্রাণের উষ্ণতা! হবেও বা। তবে নীতুরটা যে নিশ্চিত মৃত্যু শীতল তাতে সন্দেহ নেই। এই প্রথম, মরা মানুষের গায়ে আমি আর কখনো হাত দেইনি। মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো ধর্ম। তা জানি, কিন্তু সত্যি বলতে কি, ভাবলেই আমার যেন কেমন গা ঘিন, ধিনিয়ে উঠত। অনেকটা সাপের গায়ে হাত দেবার মত। ভয়ের সঙ্গে যেমন একটা গা শিউরনো মিশে থাকে, সেই রকম।

অথচ নীতার বেলায়, আমার ঠিক সেই রকম মনে হচ্ছে না। বোধ হয় ওর শরীরটা বেশী চেলা বলে, না কী? কিংবা ওর গাটা বেশ সুন্দর, বরাবরই খুব ভাল লেগে এসেছে, এবং এখনো ওর সারা গায়ে সুন্দর গন্ধ লেগে আছে। সেই জন্যেই, না কি এই দেহের সঙ্গে অনেকগুলো ক্ষণিক সুখের পরিচয় নিবিড় হয়ে আছে বলে গা ঘিনঘিনিয়ে ওঠা বা শবের প্রতি একটা আলৌকিক ভয় আমাকে শিউরিয়ে তোলেনি। একটা কিছু হবে মোটের ওপর, যাতে কাছ থেকে সরে যাবার মত আমার অবস্থা হয়নি।

আমি মার খাবাটা ওর পিঠের ওপর থেকে তুললাম। কোন দাগ পড়েনি, তবে চাপ খেয়ে আঙুলের ছাপের হালকা গর্ত মত দেখাচ্ছে। অন্য সময় হলে যখন ওর শরীরে কোথাও এরকম চাপ দিয়েছি, ওর ফর্সা গায়ে লাল ছাপ পড়ে যেত। এখন কোন রং ফুটল না। মরে গেলে বোধহয় ফোটে না। আমি। আমার ঘড়ির ব্যাণ্ডটা দিয়ে আলতো করে এর পিঠে একটা চাপ দিয়ে দেখলাম, হ্যাঁ ঠিক, ছাপটা একটু যেন বেতো গায়ের মত চেপেই বসে যাচ্ছে। ওর হাতটা টেনে তুলতে গেলাম, যে হাতটা ওর বুককে আড়াল করে, কনুই বেঁকে বিছানায় পড়ে আছে। আলগা করেই টানতে গেলাম, হঠাৎ উঠল না। যেন নীতা শক্ত করে রেখে দিয়েছে, তুলতে দিতে চায় না। আমি উঁকি মেরে ওর পাশ ফেরানো মুখের কাছে ঝুঁকে পড়লাম, মুখের কাছে মুখটা নিয়ে গেলাম। না, এমন সন্দেহ করবার কোন কারণ নেই যে, ও মরেনি। মুখের একটা পাশই আমি দেখতে পাচ্ছি। চোখটা তো প্রায় খোলাই, যেন বিছানার কোঁচকানো দোমড়ানে। চাদরটার দিকে চোখ নামিয়ে তাকিয়ে আছে। ক্লান্ত ভাবে এলিয়ে, অনেক সময় যেমন করত, পাশ ফিরে এগিয়ে শুয়ে, চোখ আধবোজা করে একদিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকত, আর মাঝে মাঝে ঠোঁট নেড়ে অনেকটা প্রলাপের মত বকত, আচ্ছা, জীবনের কি মানে বলতে পার? সত্যি আমার কিছু ভাল লাগে না। এক এক সময় মনে হয়, সুইসাইড করি। ইত্যাদি নানান রকম কথা। যে-কথাগুলো মোটেই খাঁটি নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, আলস্যে আরামে এলিয়ে পড়ে যেন অনেকটা স্বপ্নের বিলাসে ও নিচু গলায় বলত। হ্যাঁ, এই বেশ রক্তের এক আশ্চর্য নেশায় ঝুঁদ হয়ে আছে, এখনই যত দুঃখের কথা বলতে ইচ্ছে করছে ভাবটা এইরকম। খাবার পর আরামের ঢেকুর তোলার মত, শব্দটা যতই কটু হোক। আদতে, ওসব প্রলাপ বকবার মেয়েই ছিল না ও। একে বলে কুয়ারা। ঢাকা জেলার মাকে, আদরের বকুনি বকতে শুনেছি তার সোহাগ-কাড়ানো সন্তানকে, কুয়ারা করিস না। অনেকটা ঢঙ-এর প্রতিশব্দের মাত্র। কোথা থেকে শব্দটার উৎপত্তি কে জানে। নীতাও নিশ্বাস ফেলে ফেলে নিচু মন্থর গলায় যখন ওরকম বলত, আমার এই শব্দটাই মনে হত, কুয়ারা।

যাই হোক, এখন নীতা সেইভাবেই পড়ে আছে। অন্যসময় এইভাবে পড়ে থাকা কালে আমি যদি মুখ নামিয়ে নিয়ে যেতাম, তাহলে ও ভাবত আমি ওকে। চুমো খাবার চেষ্টা করছি। ও কিন্তু তখন কিছুই বলত না, নিশ্চল নির্বিকার হয়ে পড়ে থাকত। আমি চুমে। খেলেও অমনিভাবে পড়েই থাকত, পালটা দান দুরের কথা, ও ঠিক এভাবেই পড়ে থাকত, এখন যেমন রয়েছে। এইরকম মরার মত। তবে তখনকার সেই ঠোঁট থাকত উত্তপ্ত না আর ভেজা ভেজা। আর নিশ্বাস পড়ত, লালচে নাকের পাটা একটু কেঁপে কেঁপে উঠত। ঠোঁট দুটি অবিশ্যি এরকম থাকত, লিপষ্টিকের রং শুষে নেওয়া, (এখন ওর ঠোঁটের সব এই তো আমার পেটে।) অথচ হালকা একটু দাগ থাকা, যে কারণে স্বাভাবিক লালাভাটা ফ্যাকাসে মনে হয় এবং এইরকম ফাঁক, যে ফাঁক দিয়ে কয়েকটি ওপরের সারি দাঁত দেখা যায়। যেমন দেখা যাচ্ছে এখন। কিন্তু না, ঠিক সেইরকম নেই তো, এখন যেন একটু বেশী রকম ফাঁক হয়ে আছে। ওপরের সারি দাঁতের ফাঁক দিয়ে মুখের ভিতরের অস্পষ্ট অন্ধকারে আমি ওর জিভটা দেখতে পাচ্ছি।

আমি ওর গালে হাত দিলাম। ঠাণ্ডা। একটু টিপে দেখলাম, না, ততোধিক নরম নেই আর, বেঁচে থাকলে যে রকম হয়। একটু যেন শক্ত শক্ত, শরূম জায়গায় ফোঁড়ার থর্‌ উঠলে যে রকম হয়, অনেকটা সেই রকমের। ঠোঁটে হাত দিলাম। ঠাণ্ডা। টিপলাম এবং আলস্যে আদরে যেরকম করি অন্য সময়, সেরকমভাবেই, আলতো করে নখ বিঁধিয়ে একটু চিমটি কাটলাম। না, ঠিক সেরকমটা আর নেই, সেরকম গরম, নরম। শক্ত লাগছে। আচ্ছা, দাঁতের ফাঁক দিয়ে ভিতরে আগুল ঢুকিয়ে একটু জিভটা ছুঁয়ে দেখব? জিভটা যেন ভিতরে এলিয়ে পড়ে আছে। কিন্তু যদি ঠিক সেই সময়েই ওর মুখটা বন্ধ হয়ে যায়? মরা অবস্থাতেই নাকি অনেক সময় শবের কোন কোন অঙ্গ নড়ে ওঠে। আমিও মুখে আঙুল ঢুকিয়ে দিলাম, আর তখুনি হয়তো ঠক্ করে দাঁতে দাঁত পড়ে গেল, চিরজন্মেয় মতই গেল, আঙুলটিও কুট করে কেটে ভিতরে রয়ে গেল। ওরে বাবা! আঙুলটাই বরবাদ।

আমি আমার প্রতিবিম্বের দিকে ফিরে তাকালাম। দেখলাম, আমার চোখ দুটো গোল হয়ে উঠেছে। চুলগুলো কপালের ওপর এসে পড়েছে, আর তার ছায়ার নিচে আমার ছানাবড়া হওয়া চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে, না হেসে পরলাম না। এবং নিজেকে আমি আর এক বার চোখ টিপে আদর কলাম, সালো! (শালা) তারপরেই নিজের ছায়াটার দিকে তাকিয়ে মনে হল, আচ্ছা, আমি দেখতে খুব খারাপ নই, না? সিনেমা-ষ্টার হবার মতই প্রায়। কথাও তো হয়েছিল দু-একবার। বছর পাঁচেক আগে, এক ফিলম, ডিরেকটরের কাছে বহু যাতায়াত করেছি। লোকটা আশা দিয়েছিল। তখন কি জানতাম, এরকম আশা ওরা আমার মত অনেক আণ্ডাগোণ্ডাকে দিয়ে থাকে। মাঝখান থেকে আমি কিছু দিন একেবারে যাকে বলে মুভিষ্টায় বনে গেছলাম। উল্লুক! (তা  ছাড়া আর নিজেকে কী বলা যায়!) এখন তো তবু একরকম, তখন চুলের ভাবই ফিরিয়ে ফেলেছিলাম। মুখে হরদম কালারড, স্নো। কালার্তার ভাবভঙ্গি বিলকুল চেঞ্জ, সব সময়ে অভিনয় করছি। যে কোন ছবি দেখে আসছি, তারই অনুকরণ করছি। আমার ভেতরটা তো তখন আশা তার বিশ্বসে একেবারে জবজবে হয়ে আছে। চেহারাটা তো আপনার ভালই। এরকম ছিপছিপেই দরকার। হাইটগু ভাল, পাঁচ ফুট দশ ইঞ্জি। খালার স্বরুও মাইক ফিটিং। … ঠিক আছে, আপনাকে রোজ রোজ আসতে হবে না। সময় হলে আমরাই আপনাকে খবর দেব।

খবর দেবে। আয়নায় নিজেকেই আমি ঠোঁট বাঁকিয়ে ভেংচালাম। মামার বাড়ির আবদার! তবু অনেকদিন খবর না পেয়ে, আবার গেছলাম। ভদ্রলোক ঘরে লুকিয়ে থেকে লোক দিয়ে বলিয়ে দিলেন, উনি আসেননি। সত্যি, তখন কে যে, বেচারী, ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। আমি না ডিরেকটর। যখন বললাম, আমি অপেক্ষা করতে চাই, দেখলাম, অন্যান্যদের কী ভীষণ অস্বস্তি। প্রায় একটা আতঙ্ক তাদের চোখে। সবাই এক সঙ্গে আমাকে বোঝাতে আরম্ভ না করল, উনি সেদিন আসবেন কি না, তারই ঠিক নেই। মিছিমিছি অপেক্ষা করে কী লাভ। আমি তো পরে আবার যে কোনদিনই আসতে পারি। অবিশ্যি তখনো বোধহয় আমার মনে একটু আশা ছিল, তাই ফেরব্‌ বাজের মত অপেক্ষা কার জেদ করিনি। সত্যি বলতে কি, আমার ভেতরটা তখন হাসছিল। ফিচ্‌লোমির হাসি যাকে বলে। মানুষ স্বাধীনতাকে কী ভীষণ ভয় পায়। বিশেষ করে, ভদ্রলোক হতে গেলে তো কথাই নেই। আমরা যাদের ভদ্রলোক বলি, এই আমিই যেমন। আমিই যখন আমার চাকরিস্থলে কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রে, ভদ্রলোক সেজে থাকি, তখন সব স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়ে, কপালে হাত ঠেকিয়ে হেসে কথা বলি, অন্তরের ভাষাটা যে কী কদর্য, নিজের কানেই শোনা যায় না। প্রায়। আমরা হয় মিথ্যাচার করি, নয়তো যাচ্ছেতাই অভদ্র হয়ে উঠি। অবিশ্যি এই অভদ্র হয়ে ওঠার মধ্যেও ভদ্রলোকি যুক্তি এবং দাবী-দাওয়াগুলো খুব নিখুঁতভাবেই বজায় রাখি। অর্থাৎ আমি ভদ্রলোক হিসেবেই এরকম জঘন্য ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছি, কারণ এরকম উগ্র আচরণ ছাড়া তোমার মত লোককে চিট্‌ করা যায় না। তার মানে, স্বাধীন হওয়ার অক্ষমতাকে চাপা দেবার সবরকম ফন্দি-ফিকিরই আমি রপ্ত করে রেখেছি। অনেক ভেবে দেখেছি, যখন মিথ্যে কথা বলি, আর যখন উগ্র আচরণ করি, ও দুটোই সমান। আমি যে একটি কুলুপ-আঁটা মাল বিশেষ, অর্থাৎ আমার সহস্র পরাধীনতা থেকে স্বাধীন হবার যোগ্যতা যে আমার নেই, নেই নয়, সবরকম স্বাধীনতাকেই আমি ভয় পাই, যেমন এই নীতার সংসর্গ না করার সব স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও, ওর এক ডাকেই আমি চলে এসেছি, যার মানে, আমার প্রতিটি রক্তকণাও পরাধীনতার মদ খেয়ে নেশা করে বসে আছে, সম্ভবত নীতারও তাই, আমি আসলে এই পরাধীনতার মধ্যেই তবু যা হোক একটু খেয়ে পরে বেঁচেবর্তে থাকার আশ্রয় পেয়েছি। সে হিসেবে, স্বাধীনতাকে সবাই আগুনের মত ভয় করে দেখেছি, যেন পড়ে মরবার ভয়ে, খুব সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে এড়িয়ে চলে।

যাই হোক, ফিচ্‌লে হাসিটা যতটা সম্ভব ভদ্র রেখে, আমি ফিরে এসেছিলাম, এবং এখানে আর যাইনি। সেই সময়ের ওদের আপদ বিদায়ের স্বস্তির নিঃশ্বাসটা আমি স্পষ্টই অনুভব করেছিলাম। তবু তারপরেও আরো দু-এক জায়গায় আশা নিয়ে গিয়েছি। আমার মত ছেলেরা কে না মুভিস্টার হতে চায়? একটু চোখ তুলে তাকালেই তো বোঝা যায়, চোখ তুলে একটু সকলের দিকে তাকিয়ে দেখ, নিজের দিকেও অবিশ্যি। সত্যি বলতে কি, আরব্যেপন্যাসের নায়ক হবার এর চেয়ে সহজ পন্থা আর কী আছে। খ্যাতি, অর্থ, ভোগ। ভোগ শব্দটাকে ভেঙে ফেললে, ভেতরে আছে মেয়ে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে যে-কোন বড় মানুষের পাশে তুমি দাঁড়াতে পার। খবরের কাগজ বা সিনেমার কাগজের ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায়, যে-কোন দেশ-বিদেশের বিষয়ে কোন সৌহার্দ্যপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ে যে সুখী পরিবেশটি ফুটে ওঠে না, সিনেমা স্টারদের সঙ্গে সেটাই লদলদিয়ে ওঠে। ব্যাপারটাই এমন লদলদে যে, সবাইকেই বেশ গল্‌গলে মনে হয়। স্টারদের নিয়ে ফটো তুলতে কে না চায়? আর টাকা? তার তো লেখাজোখা নেই। আলিবাবার চিচিংফাঁকের মোহর। তারপর মাথা যখন বেঠিক, তখন তো একটা জায়গাতেই ছুটতে জানি, এই যে একটি জায়গায়, এখন যেখানে আছি। আমি নীতার শাম্পু করা চুলে হাত দিলাম। তখন তো আমি সোনার মাকড়সা আয় কত পোকা আসবি, আয় আমার কালো টাকার জালে, আমার গ্ল্যামারের, যাকে বলে, মরীচিকায়।

হাসি পেয়ে গেল আমার। ব্যাপারটা ঠিক এরকম নয় কি? আমি তো বাবা তাই বুঝি। এরকম জীবনের প্রতি টান কার না থাকে। তারপরে বুঝলাম, কোষ্ঠি যুতের নেই, চেহারা যা-ই হোক। তবে মনের আসল জায়গাটা মুলে হাভাত হয়নি। পর্দাতেই যেতে পারিনি, পর্দার বাইরে থেকেও পর্দার ধাঁচের চিন্তা-ভাবনা আশা-আকাঙ্ক্ষা ভাবভঙ্গিগুলো আমাকে ছেড়ে যায়নি।

যাক গে, এবার একটা সিগারেট—কিন্তু, এ কি, নীতার চুলগুলোও কি শক্ত হয়ে উঠেছে নাকি? সেরকম নরম পেঁজা তুলে তুলো ভাব আর নেই। না কি আমারই হাতের স্পর্শটা এরকম ঠেকছে। অথবা মরা মানুষের চুল হয়তো এরকমই হয়। একটু যেন শক্ত শক্ত, কর্কশ।

আমি ওর ঘাড়ের কাছ থেকে হাত চালিয়ে, চুলগুলোকে বিলি কেটে, মাথার পেই দিকটা চেপে ধরলাম। ছোট্ট মাথাটা। খুলিটাও ঠাণ্ডা, অথচ শাপুর হালকা গন্ধটা ঠিক আছে। জানি না, মরা মানুষের কোন গন্ধ আছে কি না। পচে যাওয়া শবের কথা বলছি না। পচলে তো সব কিছুরই দুগন্ধ হয়। নীতা এখনো পচেনি। হয়তো সারা রাত্রের মধ্যে যাবে। তবে বলা যায় না, শীতের সময় তো। ঠাণ্ডার সব কিছুই জমে থাকে। কোল্ড স্টোরেজে যেমন মাছ মাংস তরকারি ফল ইত্যাদি থাকে। কিন্তু সদ্যমৃতের গা থেকে কি কোন গন্ধ বেরয়?

নীতার খোলা পিঠের ওপর আমি নাকটা খুঁজে দিলাম। ঠাণ্ডা, আর একটা শক্ত মনে হচ্ছে। একটা হালকা মিষ্টি গন্ধই পাওয়া যাছে ওর গা থেকে। হয়তো বিকেলে, সেই দুধের মত শাদা, লিকুইড ক্রীম ও সারা গায়ে মেখেছিল। জানি না, আজ কে মাখিয়ে দিয়েছিল। আমাকে দু-একবার মাখতে দিয়েছে, পিঠেই অবিশ্যি, যদি আমার স্বাভাবিক প্রবণতা বা ঝোঁকটা অন্যদিকেই। থাকতো! অন্যদিকে! মাঝে মাঝে আমার মনটাও সত্যি ভাল কথা ভাবে। অথচ অন্য দিকটা যখন ভাবছি, তখন নীতার সামনের দিকটাই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ওর সামনের দিকটাও সুন্দর। ওর বুক, যদিও একটু টল-থেমেছে, কী যেন বলে তাকে, ঈষৎ-ঈষৎ নম্র, তবু গড়নাটা বেশ সুন্দর, বড় আর সুগোল, হয়তো এই কারণেই তবু চোখে পড়ার মত, যাকে বলে উদ্ধত, তাই মনে হত। বুক জোড়ার ওপরে, কণ্ঠার কাছ পর্যন্ত একটা চওড়া ভাবের অন্যে, আর পেটে চর্বি বা মেদ, অর্থাৎ ভুড়ি না থাকায়, গোটা সামনের দিকটা, এক বথায় দারুন। পিক্‌চার যাকে বলে। পিক্‌চার। তার মানে কী। খুবসুরত্‌! উর্বশী? গুলি মারো। কিন্তু একটা কথা, শরীরের পবিত্রতা কাকে বলে? এর মানে তো আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না। পেটের অসুখ নেই, ডিসপেপসিয়া বা ডিসেণ্ট্রি, লিভার খারাপ নয়, পিলে নেই, দাঁতে পাইসোরিয়া নেই, কান পচা নয়, নাকে ঘা নেই, পায়ে হাজা নেই। অর্থাৎ যেগুলো প্রায়ই থাকে, ক্রনিকের মত, (সাময়িক, বড় বড় অসুখ না।) তাকেই কি শরীরের পবিত্রতা বলে। কী জানি, ওর মধ্যেই সতীত্বটতীত্ব ইত্যাদি ব্যাপারও আবার আছে কি না। বোধহর, আসল মানে ওটাই। কিন্তু শরীর তো অনেক দেখেছি। বাড়িতে কখনো সখনো অসতর্ক মুহূর্তে নিজের বোনকে দেখেছি, অবিশ্যি ওর কথা ভেবেও লাভ নেই, তেইশ বছরের বয়সের মধ্যে ও অনেক প্রেম (পীরিত!) করল। নির্ভেজাল আনকোরা সন্ধিক্ষণের নবীনা দেহ যাকে বলে, তাও দেখেছি। যার সংসর্গ করিনি, কিংবা যার করেছি। অনেকেরই দেখেছি, তার মধ্যে বেশ্যাও আছে, যদিও ভদ্রলোকই বেশী, সতী-অসতীর ছাপ বলে তো কখনো কিছু বুঝতে পারিনি। অথচ কথাগুলো বরাবর চালু আছে।

এই জন্যে হীরেনের গল্প আর খুব মনে পড়ো উল্লুকটা আর্টিস্ট, (আদর করেই বলছি।) কসবার ইতিকে একবার আবিষ্কার করল। ইতিকে দেখেই ও ভ্যান গখের মত বলতে আরম্ভ করল, ঈশ্বরের পুত্র স্ত্রীলোকের গর্ভজাত। যেন কেউ অস্বীকার করছে, যীশু কোন মেয়ের গর্ভে জন্মেছেন। বুদ্ধদেব বা হজরত, কে নয়। আমরাও। তার মানে, হীরেন সেই প্রথম আবিষ্কার করল, মেয়েরা মহৎ। বেশ, আমরা পেটে ধরতে পারি না বলে যদি অমহৎ হরে যাই, না হয় গেলাম। মেয়েরাই সাক্ষী। (আয়নায় চোখ টিপলাম।) আসলে, ইতি মেয়েটির মুখে চোখে ও আবিষ্কার করল একটি করুণ নিষ্পাপ পবিত্রতা। হ্যাঁ, কথাটা একদিক থেকে সত্যিই ছিল। হীরেনের আঁকা ইতির পোরট্রেট্‌ অনেকদিন দেখেছি, ইতিকেও দেখেছি বহুদিন। মনে আছে সেই মুখটি, একটু লম্বা ছাঁদের মুখ, মাঝখানে সিঁ-থি, দু পাশে চুল এলানো। জানি না, নীরক্ত ছিল কি না ইতি, প্রথম আলাপের সময়, আমার যেন একটু ফ্যাকাসেই লাগত। চোখ দুটি সত্যি বড় বড় আর সুন্দর, চাউনিটা সত্যি সুন্দর ছিল, হয়তো তাকেই চোখের গভীরতা বলে। অনেকটা যেন, ওর চোখের ভিতরে জল লুকিয়ে থাকত। কখন টপ করে গড়িয়ে পড়বে, এমনি একটা ভাব। নাকটা টিকলো, ঠোঁট দুটি পাতলা বলা যাবে না, তবে মন্দিরের গায়ে পাথরের মূর্তির মত অনেকটা। পাথরের মূর্তিগুলোর ঠোঁটকে নিশ্চই পাতলা বলা যায় না, ভারতীয় মুর্তির ঠোঁটেই একটা বিশেষ ভঙ্গি আছে। কেন জানি না, সে সব ঠোঁটের ছাঁদ, চুম্বনের পক্ষে বেশ প্রশস্ত ও সুখজনক বলেই আমার মনে হয়েছে)। ইতির ঠোঁটের ভঙ্গিটা অনেকটা সেই রকমের। আমার ধারণা, ভারতবর্ষের অধিকাংশ মেয়েরই ঠোঁট ওইরকম, তবে সব মুখের সঙ্গে, ঠোঁটের সেই ভঙ্গিটা ঠিক ফোটে না। তা ছাড়া, ইতি আমার, আমার ধারণা, ঠোঁটের আশেপাশের পেশী গুলোকে এমান খোঁজ-খাজ দিয়ে রাখতে অভ্যস্ত ছিল যে, ঠোঁটের ব্যাপারে ও বেশ সচেতন ছিল। সচেতন তো নিশ্চয়ই ছিল। অবিশ্যি রোগা রোগা বড়, করুণ চোখে, একটা যেন ক্লান্তি ওর উপছে পড়েছিল, ক্লান্তি আর বিষণ্ণতা। সব মিলিয়ে, আমার মনে হয়েছিল, রোগে ভোগার পর প্রথম আরগ্যের আভাস লাগার মত। কথা বলত আস্তে, ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে সময় লাগত, চলত, ধীরে সুস্থে। আমি, সত্যি বলতে কি, হীরেনের ওই কথাটাই মেনে নিয়েছিলাম, একটি করুণ নিষ্পাপ পবিত্রতা।

প্রায় খান চারেক পোরট্রেট্‌ আঁকা হয়ে গেল মাস খানেকের মধ্যেই। কিন্তু ইতির লম্বা মুখখানি ইতিমধ্যেই আস্তে আস্তে একটু গোল মত হয়ে উঠছিল। অর্থাৎ মুখে মাংস লাগতে আরম্ভ করেছিল। কয়েক মাসের মধ্যেই দেখেছিলাম, ইতির মুখটা বদলে যাচ্ছিল। আমরা যাদের সুখী বলি, সেইরকম মুখ হয়ে উঠছিল। রক্তের ছোপ লাগছিল, সেই বড় বড় করুন চোখ দুটিতে, গভীরতা হয়তো ছিল, তবে ঝিলিক হানতে আরম্ভ করেছিল। শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে, রোগা গতরখানিও একটু ফেঁপেছিল। আমার তো তখন বেশ ভালই লাগত। হীরেনেরও নিশ্চয় লাগত, কারণ গাধাটা তো আবিষ্কারের নেশার বুঁধ হয়েছিল। বিয়ের জলের চেয়ে প্রেমের জলও যে কম গাঢ় না, তা বুঝতে পারছিলাম। এবং ইতির সেই প্রেম-গড়ের মাঠ মূর্তি দেখেও, আমার কিছু পাপী অপবিত্র অকরুণ মনে হয়নি।

তারপর হঠাৎ একদিন হীরেন এসে প্রথম কথাই বললে, বেঁধে গেছে।

ওকে দেখে মনে হল, ওঝার হাতে ভূত পড়লে ওরকম দেখায় বোধহয়। বললাম, তাতে কি, ম্যারেজ রেজিস্টারের অফিস তো খোলাই আছে।

কিন্তু এখন তা সম্ভব নয়, কিছু দিন দেরী আছে।

ঈশ্বরের পুত্রকে যারা জন্ম দেয়, তাদের সঙ্গে যে হীরেন বিশ্বাসঘাতকতা লবে, অতটা ভাবা যায় না। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের মেজাজ আমার নন। বললাম, তবে ইভাকুয়েটা

ইভাকুয়েট মানে–?

খসানো।

হুম, মানে ওই হল আর কি। যাই হোক, একটু ভয় ভয় লাগছে।

ভ্যানগখ্‌! ঈশ্বরের পুত্র! শালুক চিনেছে গোপাল ঠাকুর। মরো গে এবার। আসলে ওর টাকার দরকার হয়েছিল। কথা দিয়েছিলাম দেব, যোগাড়ও করেছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর দেওয়া হয়নি। ঠিক সে সময়েই একটা মেয়ে জুটে গেল, যাকে বলে আনেক্‌সপেক্‌টেড্‌লি, যদিও খরচ সাপেক্ষ, তবু, দুটো দিন আর সব টাকা ব্যয় করে, সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ফেললাম। হীরেন অবিশ্যি আমার জন্যে বসেছিল না, উপায়ও ছিল না। জলের দরে অনেকগুলো ভাল ছবি বিক্রী করে, কোনরকমে টাকাটা সংগ্রহ করে, কার্যোদ্ধার করেছিল। ভেবে রেখেছিলাম, ওকে বলব, কষ্ট করেও মাইরি টাকাটা জোগাড় করতে পারিনি। আর ভেবে দেখেছিলাম, টাকাটা যদি সত্যি ওকে দিতে হত, তবে রাগে আর ঘৃণায় কোন দিন ওর পাছায় লাথি কষিয়া বসাতাম। অন্তত মনে মনে তো বটেই।

কিন্তু টাকা জোগাড় করতে না পারায় ওজরটা হীরেকে শোনাতেই পারিনি। কারণ, ওর কোন পাত্তাই ছিল না। ভেবেছিলাম, রাগ করেছে। আমার ওপরে রাগ, তা ভালই বাবা, তবু কিছু মিথ্যে কথা বলার হাত থেকে বাঁচা গিয়েছিল। তারপরেই একদিন, প্রায় মাসখানের মধ্যেই দেখা হয়ে গিয়েছিল ইতির সঙ্গে। আশ্চর্য, (লে বাবা!) একেবারেই ঠিক সেই মূর্তি, প্রথম দেখা সেই চেহারা, হীরেনের প্রথম আঁকা পোরট্রেট্‌। গালের মাংস গিয়েছে ঝরে, মুখ লম্বা হয়ে উঠেছে আবার। শরীরটা তেমনি রোগা রোগা, ছিপছিপে, মাঝখানে সিঁথি, দু পাশে চুল এলানে, বড় চোখ দুটোতে সেই গভীরতা না কি কে জানে। আর তেমন চোখের ভিতরে যেন জল জমে আছে, টপ্‌ করে গড়িয়ে পড়বে, ঠিক সেই, করুণ নিষ্পাপ পবিত্রতা-এর ছবি। ঈশ্বরের পুত্র স্ত্রীলোকের গর্ভজাত। কে নয়? এমন তো কখনো শুনিনি পুরুষের গর্ভে কোন পুত্র জন্মেছে। এক সেই, আমাদের মাইথলজিতে আছে, কী যেন রাজার নাম? বেশ মজার মজার ঘটনা আছে পুরাণের কাহিনীগুলোতে। শুধু মজার মজার কেন, এমন সব মানুষের আর ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়, আমি বিশ্বাস না করে পারি না। ধার্মিক, যোদ্ধা, প্রেমিক, কামুক সকলেই বেশ সোজা।  প্যাঁচপয়জারও কম নেই। খালি যে পড়তেই ভাল লাগে, তা নয়, ইচ্ছে হয় নিজেও ওইরকম ডাইরেক্ট হয়ে উঠি। তা হলেই হয়েছে, অমনি পাছায় লাথি। লোকেরা মহাভারত মহাভারত করে, কোথায় যে তার সঙ্গে আমাদের মিল আছে, আমি বুঝতে পারি না। কে বিশ্বাস করবে, ওসব হচ্ছে, এ দেশের পূর্বপুরুষদের ব্যাপার। খচ্চরের পূর্বপুরুষকে কি ঘোড়া বলা যাবে? তবে এটা ঠিক, নিজের কল্পনাকেও অনেক দূর ছুটিয়ে দেওয়া যায়। মাঝে মাঝে আমার পড়তে বেশ লাগে।…হ্যাঁ, ওই রাজাটার নাম মনে পড়েছে, ভঙ্গাস্বন। ওর একশো ছেলে ছিল অগ্নির বরে। ইন্দ্র গেল রেগে, তাকে কেন পুজো দেওয়া হয়নি, অতএব রাজাকে মায়াজাল বিস্তার করে, তাকে এক সরোবরে নাইয়ে দিলে অমনি সে হয়ে গেল এক রূপসী মেয়ে। মেয়ে হলেই একটা পুরুষ চাই, বনের মধ্যে এক ঋষির কাছে তাই গেল সে। আবার একশোটা ছেলে হল, আর মেয়ে হয়ে যাওয়া রাজা, সেই একটা ছেলেকেও রাজ্য ভোগ করতে দিয়ে এল। ইন্দ্র দেখল, যাঃ বাবা ক্ষতি করতে গিয়ে লোকটা দুশো ছেলে পেয়ে গেল। তখন সে দুশো ছেলেকে লড়িয়ে দিলে, রাজার ছেলেদের আর ঋষির ছেলেদের, তাতে সবগুলোই মরে গেল। ঠিক যেন অফিসের ঘটনা, কোন্‌ কর্তার মন রাখবে, ঠিক কর। যেদিকেই যাবে, মরবে! তার চেয়ে, যে চেম্বারেই যাবে, স্যার আপনি যা বলেছেন, দ্যাট ইজ রাইট এই বলে চালিয়ে যাও না। যেতেও হল তাই, রাজা বেচারী কান্নাকাটি জুড়ে দিলে, তখন সেম্‌ র‍্যাঙ্ক-এর কর্তা ইন্দ্র এসে বলল, সাজাটা আমিই দিয়েছি, ক্ষমা চাইছ যখন, এবার তোমার ছেলেদের বাঁচিয়ে দিচ্ছি, কিন্তু এক শো ছেলেকে দেব, (প্রমোশনটা আটকাব না, তবে পুরোটা নয়)। এখন কোন ছেলেদের চাই। রাজা বললে, পেট থেকে যেগুলোকে বের করেছি, সেগুলোর ওপরই মায়া বেশী, ওদের আমি মা কি না। ইন্দ্র বললে, তথাস্তু, এবার বল, আর কী চাই? রাজা বললে, দয়া করে আমাকে মেয়েমানুষই রাখুন, কারণ পুরুষ হয়ে মেয়েদের সংসর্গ করে যে সুখ পেয়েছি, মেয়ে হয়ে পুরুষের করে দেখলাম, ও ব্যাপারে মেয়েদের সুখ অনেক বেশী। সোজ কথা বাবা, এর পরে যার ফ্রয়েড ঘাঁটতে ইচ্ছে করে ঘাটো দিয়ে। গল্পটা গাঁজা কি না জানি না, কথা যে সত্যি, সেটা আমি অনেকবার টের পেয়েছি। সে তো ওদের মুখ দেখলে বোঝা যায়, নীতা যেমন সুখের আলস্যে এলিয়ে, স্বপ্নের ঘোরে বক বক করত, সত্যি জীবনটার কোন মানে খুঁজে পাই না। এক এক সময় মনে হয়, সুইসাইড করি। আসলে সুখ কেন কেন শেষ হল, এসব হয়তো তারই বিলাপ, কিংবা সুখের রেশেরই প্রলাপ। তা ছাড়া, গাঁজাই বা কিসের, পুরুষের মেয়ে হওয়ার ঘটনা তো এখন মহাভারত থেকে খবরের কাগজে এসে উঠেছে। তবে, সেখানে কোন ইন্দ্রের কারসাজি টের পাওয়া যায় না, এই যা।

যাক এসব কথা, আমি মেয়েমানুষ হতে চাই না, ভেবে কী লাভ। ওসব হীরনের মাথায় ঢুকলেই ভাল হয়। ইতিকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ও কোথায়?

ইতির হাসিটা সেই প্রথম দেখার মতই, যাকে বলে করুণ। বলেছিল, অনেকদিন দেখা নেই।

সে কি। একটা গোলমাল টোলমালের কথা শুনেছিলাম।

যথেষ্ট সহৃদয় হাসি হেসেই কথাটা বলেছিলাম। ছেপে যাবার কোন যাবার মনে করিনি। তাতে ইতি যা খুশি তাই ভাবতে পারত, কিছু যেত আসত না। বন্ধুভাবে নিলে ভাল, না হলে নিরুপায়। চোখ নামিয়ে, একটু হেসেছিল ইতি, লজ্জায় কি না, কে জানে। খুব আস্তে আস্তে বলেছিল, মিটে গেছে।

তবে, কী হীরেন কেটে পছে নাকি, প্ৰার সেরকম ভেবেই, অবাক হয়ে ইতি মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কিন্তু যেরকম সাংঘাতিক সত্যান্বেষী মানে মহত্ত্বসন্ধানী, প্রায় ভয়ংকরমুখো, অপরাধী-ধরা কুকুরের মতই মহত্ত্ব সন্ধান করে বেড়ায়, ও যে কেটে পড়বে, তা আমি ভাবতে পারি না।

কথা হচ্ছিল, রেস্তেরাঁ পাড়ায়, রেস্তোরাঁ-সিনেমা-বার-ক্যাবারে; যা বল, সবই। ইতি, একটু যেন দ্বিধা, একটু যেন লজ্জিত (বা করুণ, কে জানে) হেসে বসে ছিল, খুব ব্যস্ত আছো নাকি?

হুম্‌, আমি আবার রোগা রোগা করুণ নিষ্পাপ ইত্যাদিতে তেমান উৎসাহ বোধ করি না। তবে মেয়েমানুষ, তাই কাছেই একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকছিলাম। আসল কথা বলার আগে, ইতি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, হীরেনের সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ হয় কি না। তারপরে যা জানা গিয়ে ছিল, নার্সিং-হোমে কিউরেট করতে গিয়ে; ডাক্তারের কাছে হীরেন জানতে পেরেছিল, ওর অত ভয় পাবার কিছু নেই, এর আগেও ইতির কিউরেট কেস্‌ হয়েছে। (তাতে হীরেনের কী। ইতি মাথার দিব্যি দিতে পারে, তাকে যেন হীরেন ছেড়ে না যায়, হীরেনের মাথা তাতে ইতির বোঝায় ভারী হবার কিছু নেই।) আমি অবিশ্যি জানতে চাইনি, সত্যি এর আগেও ওকে ফাঁদ কাটবার ব্যবস্থা করতে হলে ছিল কি না! ও নিজেও কথাটা হ্যাঁ না কিছুই বলেনি আমাকে, তবে মহত্ত্ব-সন্ধানী শিল্পীটির পাতলুন সে তাতে ঢিলে হয়ে গিয়েছিল, সে কথাই ইতি বলেছিল, এবং বলবার সময় সেই করুণ নিষ্পাপ হাসিটা হেসেছিল। শধু তাই নয়, হীরনটা এত বড় সাধ, মহত্ত্ব সন্ধানের মতই, ডাক্তারের কাছে নাকি (ইতির এ্যানেস্‌থেসিয়া প্রয়োগে অজ্ঞান কালে) খোঁজ নিয়ে জেনেছিল, আগের ইভাকুয়েশনের সম্ভাব্য সময়টা ঠিক সে-সময়েই গিয়েছিল, যখন ইতির সঙ্গে ওঁর প্রথম পরিচয় হয়ে ছিল। ডাক্তারদের পক্ষে সেটা বলা খুব কঠিন ব্যাপার কিছু না, কিন্তু মহত্ত্বের তদন্তকারী, এ বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে মাথাটি খারাপ করে বসেছিল, প্রায় পাগল হয়ে যাওয়া যাকে বলে। তারপরে দিন সাতেক বাদে, উদভ্রান্তের মত উল্লুকটা ইতিকে ডেকে, আর একটা পোরট্রেট এঁকেছিল, যে পোরট্রেটটা অবিকল প্রথমটার মতই দেখতে হয়েছিল। এবং ইতিকে বলেছিল, এর দ্বারা ওর কাছে এই প্রমোণ হল যে, ইতির প্রথম পরিচয়ের সময় যে মুর্তিটা এ দেখছিল, সেটাও আসলে নার্সিং হোম থেকে ভেতরের ভেজাল নাশ করার পরেই। আর ভেতরের ভেজাল মানেই পাপ, অর্থাৎ বলতে গেলে, এই দাঁড়ায়, করুণ নিষ্পাপ পবিত্রতা বলে যাকে জেনেছিল ও, সেটা হয়ে উঠল পাপের নারকীয়তা। গাড়ল! উনি এ যুগের একটি তেইশ চব্বিশ বছরের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবেন, তার এক-আধবার কিউরেট হলেই মহাভারত অশুদ্ধ। তুই নিজে যে ফ্রী স্কুল ষ্ট্রীটের অনেক ক্ৰীশ্চিয়ানার মধ্যে আগে দগদগে ‘লাঞ্ছিত আত্মা’ আবিষ্কার করেছিস, তার কী। তাদের নিয়ে ঘর করবার প্রশ্ন ছিল না, তাই। আর ইতিকে নিয়ে যেহেতু ঘর বারবার স্বপ্ন ছিল, সেই হেতু খাঁটি সতীর সন্ধান। তাই তুমি হয়ে উঠলে, মহত্ত্ব আর পবিত্রতার ইনভেস্টিগেটর।

এই সব কথার পর, ইতির গা ঘেঁষে বসে কফি খেতে খেতে, আমি বলেছিলাম আমি কিন্তু আর্টিস্ট নই।

জানি।

কথাটা আমার বলায় উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই ছিল। আমার উদ্দেশ্য ছিল, আর্টিস্টদের সঙ্গেই কেবল মেশার বাতিক না থাকলে, ইতির সঙ্গে আমারও বন্ধুত্ব হতে পারে। তাই বলেছিলাম, ওই সব মহত্ত্ব পবিত্রতার খোঁজ খবর করা আমার পোষায় না।

ইতি হেসে উঠেছিল। হাসির শব্দটার মধ্যে কোন প্রশ্রয় দেবার মত ভালগারিটি ছিল কি না বুঝাতে পারিনি, কিন্তু মুখের ছবিটা ওর তেমনিই দেখতে ছিল। বলেছিল, এখন কোন কাজ আছে নাকি?

ছিল, বাবার জন্য এক ডাক্তারের ল্যাবরেটরিতে যাবার হথা ছিল, কী সব রিপোর্ট-টিপোর্ট নিয়ে আসর জন্য। রিপোর্ট তো বেঁচে থাকা পর্যন্তই থাকবে। চব্বিশ ঘণ্টা দেরী হলেই বা ক্ষতি কী ছিল। বলেছিলাম, কাজের চেয়েও, একটা কোন বাজ ছবি দেখতে গিয়ে ফাঁকা হলে বসতে পারলে হত।

ইতি আবার হেসে উঠেছিল। বলেছিল, তা হলে আর এখানে সময় নষ্ট করে কী লাভ।

আমরা ফাঁকা হলেই গিয়ে বসেছিলাম। তারপরে এ পর্যন্ত ইতির সঙ্গে অনেকবারই ফাঁকা বা বন্ধঘরে বসেছি। হীরেনের সঙ্গেও দেখা হয়েছিল। শিকারী কুকুরের মতই ও এখনো ওই ধরনের মহত্ত্বের সন্ধান করে। ইতির সঙ্গে যে আমর ভাব হয়েছে, ফস্টি-নস্টি যাকে বলে, সে খবরটা ও জানে, এবং এমনভাবে সেটা ব্যক্ত করে, ওদের আবার কী একটা পরিশীলিত আধুনিক মন নাকি আছে, যে মন দিয়ে এইসব তুচ্ছতার থেকে উর্ধ্বে চলে যায়।) সে জন্যে ওর মনে কোন ক্ষোভ নেই। কারণ মানুষ তার সত্তাকে স্বাধীনভাবে পরিচালিত করবে, তার জন্য কেউ পশু হয়ে উঠতে পারে না। বিশ্ব প্রাণের মধ্যে যে বেদনা লুকিয়ে আছে—বুঝেছি, মধ্য রাত্রের শুঁড়িখানাতেই তার উপশম লুকিয়ে আছে। কিন্তু আমার মুখের রক্ত কি হীরেনের পায়ে একটুও লাগে নি? লেগেছে নিশ্চয়, ওর ক্ষ্যাপা পায়ের লাথি নিশ্চয় অনেকবার আমার মুখে পড়েছে।

Samaresh Basu ।। সমরেশ বসু