পরদিন আমি যখন অফিসে গেলাম, মনে হল অফিসের সবাই আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে দেখছে। অদ্ভুত, মানে অনেকটা যাকে বলে বিদ্বেষহীন, প্রশংসাসূচক চোখে তাকিয়ে দেখল, যা থেকে অনুমান হর, গতকালের অফিসের ঘটনাটা প্রকাশ পেয়েছে, এবং অধস্তন কর্মচারীরা তাতে খুব খুশি হয়েছে, বোধহয় তাদের ‘লড়াই’-এর সঙ্গে আমাকে মিলিয়ে দেখে নিয়েছে, যদিচ জানি, প্রতিটি লোকই ফেরেববাজ, ফাঁকিবাজ, যে যার নিজের তালে আছে। সবাই চায়, তার সঙ্গে কোথাও মিললেই সে তোমাকে খাতির করবে। অথচ অপরাধ করলে লাভবান হবে, এটা যদি তুমি সুযোগ দিতে পার, সবাই নেবে, আমাকে মারলে যদি সকলের এক বছরের মাইনে ইনক্রিমেন্ট দেয় তাহলে এখনি মেরে ফেলবে, কারণ গরীব আবার ভদ্রলোক, আমার ধারণা তারা সব থেকে মারাত্মক। আমার ঘরে ঢুকেই দেখলাম, টেবিলের উপর একটা কাগজ, তাতে লেখা, হে সাহসী বীর, আমাদের অভিনন্দন গ্রহণ করুন। দেখেই বেয়ারাটাকে চীৎকার করে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কে রেখে গেছে এখানে।

বেয়ারা ভয়ে জড়সড় হয়ে বলল, নেই দেখা সাব।

কাগজটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে, ওয়েস্ট পেপারের ঝুরিতে না ফেলে, দরজার বাইরে ফেলে দিলাম। যেন ওদের অভিনন্দনের জন্যেই আমি কিছু করেছি। কিন্তু আমি ভাবি, এসব খবর ওদের কাছে যায় কী করে, কারণ সমস্ত ব্যাপারটা তো সিক্রেটের পর্যায় পড়ে এমন কোন খবর দেখি না, যা বাইরে বেরোয় না, অথচ সবই নাকি সিক্রেট।

কিন্তু কাজ করবার আমি কিছু খুঁজেই পাচ্ছি না, অবিশ্যি একদিক থেকে ভালই হয়েছে, গতকাল থেকে সেই যে শিরা শিরায় ঝনঝনানি, সেটা খুবই বেড়েছে, তার সঙ্গে পেট খামচানো, আর বারে বারে পায়খানা যাওয়াও চেপে ধরেছে। একবার বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম, সেই তুম্‌বোমুখো আবার এসেছে, হাতে একটা খবরের কাগজ। আমাকে দেখাল, যাতে নীতার খাটের ওপর পড়ে থাকা ছবি ও সংবাদ বেরিয়েছে।

জিজ্ঞেস করল, দেখেছেন নাকি?

না। সে কি, সকালের খবরের কাগজে–

দেখি না।

কিন্তু এখন আমি নীতার ছবিটা দেখতে লাগলাম, আর নীচে লেখা রয়েছে, এই যুবতীকে তার এ্যাপার্টমেন্টে খাটের ওপর মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। ময়না তদন্তে জানা গিয়েছে, তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে মারা হয়েছে। অপরাধী এখনো ধরা পড়েনি, পুলিশ অনুসন্ধান চালাচ্ছে। জানি তুম্‌বোমুখো আমার দিকে সেই খোকনের মত অপলক চোখে তাকিয়ে আছে, যাকে বলে আমার মুখের কোন ভাবান্তর হয় কিনা তাই দেখবার জন্যে। কিন্তু কেন, আমি কি উল্লুক নাকি যে ভাবভঙ্গিতে ওকে কিছু বুঝতে দেব। তবু এ কথা ঠিক, আমি ছবিটার দিকে দেখতে দেখতে যেন নীতার গাঁ ছুঁয়ে ফেললাম, এবং এরকম ছুঁয়ে, জড়িয়ে ধরার মত অবস্থা হতেই, হাতটা কেমন নড়ে উঠল, আর তৎক্ষণাৎ কাগজটা তুম্‌বোমুখোর হাতে ফিরিয়ে দিলাম।

কিছু বুঝাতে পারলেন? তুম্‌বোমূখে জিজ্ঞেস করল।

আমি বললাম, মরে গেছে বলেই তো কাগজে লিখেছে।

লোকটা আমার দিকে চুপ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপরে আবার সেই একই কথা জিজ্ঞেস করতে লাগল, আমি খিস্তির মাত্রা একটু চড়ালাম, এবং শেষ পর্যন্ত বিদায় নেবার আগে জানিয়ে গেল, কাল রাত্রে যে মেয়েটা আমার সঙ্গে ছিল, তাকেও ওরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, অর্থাৎ আমার ওপর ওরা সব সময়েই নজর রেখেছে, এবং ধরেই নিয়েছে, ওই মেয়েটার সঙ্গে আমার আগে থেকেই এ্যাপয়েণ্টমেণ্ট করা ছিল। মেয়েটা কী বলছে না বলেছে, আমি তা জিজ্ঞাস করিনি, তুম্‌বোমুখো বলেওনি, আর মেয়েটা নিশ্চয় আমাকে মনে মনে গালাগাল দিয়েছে।

যেহেতু কোন কাজই করা যাচ্ছে না, সেই হেতু আমি টেলিফোনে বাগচিকে বলে, (বলার কোন মানে নেই, বাগচিও শুনল মাত্র, কোন জবাব না দিয়ে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল। গোঁসা হয়েছে।) লাঞ্চ-এর সময়ে বেরিয়ে গেলাম। আর প্রতি মুহূর্তেই একটা আশঙ্কা হতে লাগল, আফিসের লোকগুলো আমাকে না কিছু বলে বসে, যাকে বলে, বিগলিত হয়ে, বীরত্বের ঠেলায়। ট্যাক্সি পাওয়া দুঃসাধ্য দেখছি, তাই হাঁটতে হাঁটতেই চলেছিলাম, এমন সময়ে একটা গাড়ি, নীল রংএর গাড়ি আমার পাশে দাঁড়াল, দেখে মনে হল, চালকই মালিক, আমার অচেনা, অথচ হেসে বলল, স্যার আমি আপনার কাছেই গেছলাম, আপনার দপ্তরে, শুনলাম এইমাত্ৰ বেরিয়ে এসেছেন, বলুন কোথায় যাবেন, পেঁছে দিয়ে আসি।

লোকটা নিজের নামটা বলল, কিন্তু আমার কাছে কী দরকার বুঝলাম না এবং আমি কোথায় যেতে চাই, তাও ঠিক জানি না। লোকটা নাকি আমাকে খুবই জরুরী দরকার, কে জানে ইনটেলিজেন্সরই লোক কি না। যখন জানলাম আপাতত আমার কোন গন্তব্য নেই, তখন সে বলল, তা হলে চলুন কোন একটা নিরিবিলি জায়গায় বসে কথা বলে নিই।

গাড়িতে তুলে নিয়ে লোকটা উত্তর দিকে চলল, আর প্রতি পদে পদে আমার প্রশংসা করতে লাগল, অর্থাৎ আমি যে হরলালের ব্যাপারে খোদ কর্তার সঙ্গে ওর ভাষায় ‘পবিত্র সংগ্রামে’ (উল্লুক!) নেমে পড়েছি, এটা একটা বিরাট ব্যাপার। তারপরে দেখলাম, লোকটা দক্ষিণেশ্বরে এসে হাজির, যেটা মন্দ লাগল না, কারণ কলকাতার বাইরে বলেই একটু ভাল লাগল, যদিচ দোকানপাট, ভিড় এবং মা কালীর দর্শনের জন্য সবাই নানাভাবে ছুটছে, যা দেখলেই মনে হয়, যেন কী পাপ করে সবাই ছুটেছে, অনেকটা গায়ে ঘায়ের জ্বালার মত, ‘ওমা জুড়িয়ে দাও মা’ (মায়ের আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, বদমাইসি করবে, আর সন্দেশ বাতাস এনে দিয়ে যাবে, আর কালী মূর্তি তোমার ঘায়ের মলম হয়ে যাবে।) এই ভাব নিয়ে, তাড়া খেয়ে চলেছে। আমি জানি না, লোকদের কি লজ্জা করে না, এখন তারা এভাবে ছোটে, আর ভাবে (যা তার কখনোই বিশ্বাস করে না।) মাকে ডাকলে, নির্ঘাত ফল ফলবে, কারণ এ সবই হচ্ছে আসলে সব কিছু পাবার একটা, কী বলব, অবসেশন। সবরকম আকাঙ্ক্ষারই একটা অবসেশন! কিন্তু যে লোকটার গাড়িতে এলাম, সে লোকটার মধ্যে মূর্তি দর্শনের কোন ব্যস্ততা দেখলাম না, কারণ আমাকে নিয়ে সে এত ব্যস্ত (কে লোকটা? আমাদের দপ্তর থেকে মালকড়ি হাতাবার তদ্বির করার জন্যে এরকম করছে নাকি, তাহলে তো মাল মিছেই পেট্রল পুড়িয়ে—কিন্তু তা তো নয়, ও তো অন্যরকম কথা বলছিল।) মা কালীর থেকে আমাকে খুশী করতেই যেন যাকে বলে ব্যাকুল। লোকটা বলল, চলুন স্যার, গঙ্গার ধারে কোন গাছতলায় বসা যাক, আপনার আপত্তি নেই তো?

আমি বললাম, আপনার কী কথা; কিছুই বুঝতে পারছি না, আপনাকে আমি চিনিই না।

তা না চিনুন, বলনেই চিনতে পারবেন, চলুন বসি গে।

ঠিক হুকুম নয়, তবু যেন প্রায় ঠেলেই নিয়ে গেল আমাকে গঙ্গার ধারে, যেখানে শান্তি মোটেই নেই, কারণ কিছু ছুঁড়ি আর ছোঁড়া নিজেদের মধ্যে র‍্যালা করছে, যদিও কেউ যে কার পরিচিত নয়, তা বোঝাই যাচ্ছে, মা কালীর থানে প্রথম শীতের রোদে, সকলেই সকলের শরীর দেখে, একটু গরম হতে এসেছে। কেউ কেউ আবার হনুমানের পিছনেও লেগেছিল, পিছনে লাগা মানে, খাওয়ানো। ওটাই পুণ্যের অংশ কিনা, কে জানে, এবং যে ভাবে ছোলা বাদাম নিয়ে খাওয়াবার জন্যে ডাকাডাকি করছে, মনে হচ্ছে, মা কালীর পূজো দেওয়ার থেকে, এটা আরো বেশী মজার। আর খাওয়াচ্ছেও তো ছোঁড়াছুঁড়িরাই, যাদের এখন দেখলেই বোঝা যায়, ওদের নিজেদের খাই খাই-এর চোখাচোখি হনুমানের চেয়ে বেশী। জানাশোনা জোড়ার ভিড়ও মন্দ নয়, পীরিত পুণ্যি সব একসঙ্গে, আহা মা গো, তোমার সন্তানদের এমন জায়গা আর মিলবে না। আমি আমার সঙ্গের লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ওখানে কোন ইউরিনাল আছে কি না। লোকাটা নিশ্চয়ই মুশকিলে পড়ে গেল, যেহেতু ইউরিনাল কোথায় জানে না, তবু ‘আমি দেখছি’ বলে ছুটোছুটি আরম্ভ করে দিল, এবং খোঁজ পেয়ে আমাকে নিয়ে এল। এতটা খাতির, এ অবস্থায় আমাকে কেন করছে বুঝতে পারছি না। ব্যাপারটা নিশ্চয়, এই গাড়লের মত লোকটা (সে রকমই লাগছে আমার) একটা ভুল করেছে। যাই হোক, গঙ্গার ধারে একটু ফাঁকায় এক জায়গায় বসে লোকটা আমাকে সিগারেট দিল, গঙ্গার সৌন্দর্য (উল্লুক) বর্ণনা করল, আবার এও বলল, গঙ্গার চড় পড়ে যাচ্ছে, আজকাল ইলিশ আসছে না, (সালা) ইত্যাদির পর, লোকটা যা বলল, তাতে একে যে কোন শ্রেণীর খচ্চরে ফেলা যায়, তা পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না। লোকটা প্রস্তাব করল, ওর একটা কী নাকি পত্রিকা আছে, তাতে খোদকর্তা এবং হরলাল ভট্টাচার্জের সমস্ত কেলেঙ্কারীটা আমি যদি দলিল দস্তাবেজ সহ, ওকে ছাপতে দিই, তাহলে আমার ফটো ছাপিয়ে রাতারাতি আমাকে হিরো করে দেবে, একটা বিগ এমাউন্টও দেবে, উদ্দেশ্য, স্টান্ট দিয়ে বের করবে যে, গরম তেলেভাজার মত হাজার হাজার কপি (ভবানীপুরে সেই তেলেভাজার মত বোধ হয়) বিক্রী হয়ে যাবে, অর্থাৎ কিছু টাকা করে নেবে, যদিচ সেটা আর উচ্চারণ করল না।

আমি বললাম, আপনি একটা রামখচ্চর লোক।

কী বললেন?

রামখচ্চর। আপনার হাজার হাজার কপি বিক্রীর জন্য ওসব আমি করিনি। এখন কেটে পড়ুন, তার আগে এখানে পাইখানা কোথায় আছে, বলতে পারেন?

লোকটার মুখটা দৈত্যের মত ভয়ংকর হয়ে উঠলেও, হাসতে লাগল এবং বোঝাবার চেষ্টা করল তবু। বলল, তা দেখিয়ে দিচ্ছি স্যার, (আবার স্যার!) কিন্তু আমি জানি, আপনি খুব আপরাইট এ্যাণ্ড ফরওয়ার্ড, আর আপনার মেজাজও ভাল নেই, কিন্তু একটু ভেবে দেখুন। এতে আপনার দিক থেকে—।

আমার দিক থেকে হালুয়া।

হালুয়া?

হ্যাঁ, এখন কাটুন। পাইথনাটা—

তারপরে হতাশ হয়েও (আশ্চর্য!) লোকটা আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইল ওর গাড়ীতে, এবং আমি যাব না শুনে পাইখানা কোথায় বলে দিয়ে চলে গেল, যাবার আগে আর একবার আমাকে ভাবতে বলে গেল।

কখন যে বেলা পড়ে এল, আমি টেরই পাইনি, এবং একটা পাখী, যেটা আমার কানের পাশ দিয়ে যাবার সময় প্রায় পাখা ছুঁইয়ে চমকে দিয়ে গেল। এমন চমকানি, আমার বুকটা পর্যন্ত ধকধকিয়ে উঠেছে, আর তাতেই সংবিৎ ফিরে পেয়ে দেখলাম, নদীটা নীল, মেন হালকা করে নীল রং গুলে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু ওপরের দিকে জলটা লাল দেখাচ্ছে। সূর্যটা খুব বড় আর লাল হয়ে, ওপাড়ের গাছের ডগায় যেন (আমার মনে হচ্ছে) ঘুরছে। বাতাসটা এবার একটু বেশ জোরেই দিচ্ছে। আর বাতাসটা যেন সবকিছুই শুষছে, কেন না, আমার গাটা যেন শুকিয়ে যাচ্ছে এবং সবগাছের পাতাগুলোই তো প্রায় হলদে হয়ে গিয়েছে, কারণ বাতাস শুষছে, তাইতেই ঝরে ঝরে পড়ছে। মাটিতে তো ঝরছেই, উড়ছেই, আমার গায়েও দেখছি, কতগুলো পাতা এসে পড়েছে, টেরি উলের ঠাস বুনোটের কালো রং-এর ওপরে, ওই পাতাগুলো যেন মাটিতে যেমন পড়ে, তেমনি এসে পড়েছে, বেশ স্বাধীনভাবেই। আমি তাই আশেপাশের গাছ গুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সব গাছের পাতাগুলোই বাতাসে কাঁপছে, ওপারের লালচে রোদে চিকচিক করছে, অথচ, দেখছি, তার মধ্যেই এক একটি পাতা খসে পড়ছে, যে কারণে গাছগুলোকে যাকে বলে শীর্ণ দেখাচ্ছে, এর পরে একেবারেই ন্যাড়া হয়ে যাবে। এমন যেন, যাকে বলে বিষয় অথচ সেই ইতি এর মতই একটা নিষ্পাপ ভাবের শীর্ণতা যা নাকি আবার ঠিকই ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে ভরে উঠবে। সূর্যটা একেবারেই ডুবে গেল, তবু জলে এখনো সালের আভা, অনেকটা আগুন থেকে তোলা, জুড়িয়ে আসা ইস্‌পাতের মত নদীটাকে দেখাচ্ছে, যার ওপর ঘেঁষে একটাই মাত্র নৌকা চলেছে কলকাতার দিকে, তাতে আবার পাল তোলা। ঠিক এ সময়েই নদীর ওপর ব্রীজে দমদম শব্দ শুনে, তাকিয়ে দেখলাম, একরাশ ধোঁয়া ছড়িয়ে, ব্রীজের লোহার জালের ভিতর দিয়ে একটা জানালা দরজা ছাড়া গাড়ি, নিশ্চয়ই মাল গাড়ি, অনেকাটা যেন দাপিয়ে আর রেগে চলে এল, যা দেখে আমারও গায়ের মধ্যে জ্বলে গেল, আমি না বলে পারলাম না, শুয়োর। আর তখনই যেন আমার খেয়াল হল, এখানে মন্দিরে ছুটে আসা মেয়ে পুরুষরা সব আমার চারপাশে ভিড় করে (ধর্মের সুখে) বাদামভাজা চিবিয়ে চেঁচামেচি করছে। তখন কলকাতার কথা আমার মনে পড়ে গেল, তার মনে পড়তেই মদের তৃষ্ণা বোধ করলাম, (যেন কলকাতা একটা শুঁড়িখানা) তাই উঠে পড়লাম গঙ্গার ধার থেকে। এতক্ষণ যে কী ভেবেছি, কিছুই জানি না, তবে এটা ঠিক, আমি একটা কথা অনেকবার ভাববার চেষ্টা করলাম, নীতা নেই, ও মরে গিয়েছে, অথচ আশ্চর্য, নিজেকে কিছুতেই এ কথাটা আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। এও আবার সেই মামদোবাজীর মতই একটা ব্যাপার মনে হচ্ছে। যাকে নিজের হাতেই মেরে ফেলেছি, তার সম্পর্কে বিশ্বাস করতে পারছি না, সে নেই, এবং আর কখনোই তাকে দেখতে পাব না, ছুঁতে পাওয়া তো অনেক দূরের কথা, এটাকে একটা ভাবনা বলে, মনে করতেই পারছি না, কারণ এ অর্থহীন কথা ভেবে কোন লাভ নেই, তবু (মাইরি) আমার ভিতরটা যেন একটা জেদবশতই মানতে রাজী না যে, নীতাকে (সে যাই হোক) আর কখনই (যেভাবেই হোক) পাব না।

আসতে গিয়ে, অনেক লোককে, মন্দিরের দিকে যেতে দেখে, আর কাঁসরের ঘণ্টা শুনে, একবার গেলাম, চত্বর পেরিয়ে। মন্দিরের কাছে যেতেই পোকার মত মানুষের ভীড় দেখে গায়ের মধ্যে কী রকম করে উঠল, তাড়াতাড়ি ফিরতে গিয়ে একটা দলজা দিয়ে হঠাৎ পুকুরটা চোখে পড়তে (ওখানেই ইউরিনাল) এগিয়ে গেলাম, কিন্তু একটা ছোঁড়া আর একটা ছুঁড়ি ছিঁটকে সরে গেল, যেন ছিঁড়ে নিয়ে গেল ভয় পেয়ে। দেখে মা কালীর দয়া (আহা বেচারীরা!) আবার ফিরে চলে এলাম। চত্বর থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়ে, দরজার সামনে, আলোয় একটা চেনা মুখ দেখতে পেলান যেন। দেখবার জন্যে, ভাল করে চোখ তুলতেই চিনতে পারলাম, সেই তুম্‌বোমুখো লোকটা, ডিভাইন খচ্চরটি। জ্বালালে দেখছি। কোন কথা না বলে বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু লোকটা কাছে এসে বলল, কালী। দর্শন করতে গেছলেন?

না।

আমি আবার প্রায়ই একটু দর্শন করতে আসি।

কোন জবাব দিলাম না, দেবার দরকার নেই, জানি মিথ্যে কথা বলছে, আসলে পিছনে পিছন ঘুরছে। মরুক, কিছু বলার নেই। পাশে চলতে চলতে বলল, খুনের এখনো কোন কিনারা করতে পারেনি, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট গলা টিপে হত্যা, বাপ মাকে টেলিগ্রাম করা হয়েছে, আজই তারা ডেভ বডি পেয়ে যাবে রাত্রে, আরো দু জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য, যদিও কিছুই লাভ হয়নি, ইত্যাদি এবং তারপরে, আপনি কি মনে করতে পারলেন, কোথায় ছিলেন?

নাঃ।

আচ্ছা, চলি।

চলবে যে কোথায়, তা জানি, তবে আমার চোখের সামনে আর না এলেই হয়, মাথার উকুন! একটা বাস ধরে কলকাতায় এলাম, বারে গেলাম, দু-এক জন বন্ধুবান্ধব পাওয়া গেল, যারা নীতার মার্ডার নিয়ে নানান কথা বলল, ঝাঁকের মাথায় অনেকে সন্দেহ করে নাম পর্যন্ত বলতে লাগল, কে মারতে পারে। কিন্ত আমার কথা কেউ বলল না। তারপরে কোন মেয়ের কাছে যাব কি না, এটা ভাবতে ভাবতে অনেক আগেই বাড়ি এসে পৌঁছলাম, এবং সেখানে মায়ের কাছে শুনলাম, দপ্তরের খোদ কর্তা আমাকে ডিসমিস করবেনই যদিচ পানিশমেন্ট দেবেন না। এমন কিছু ফাইলপত্র নাকি পাওয়া গিয়েছে, যার থেকে দেখা যাচ্ছে, আমি অনেক অনাচার করেছি, পাপ যাকে বলে, (বাগচি-চ্যাটার্জি-ঘোষ থাকতে আমাকে অপরাধে জড়ানো এমন কঠিন, বিদিশাও পারে।) সুতরাং খেল খতম, যদিচ এখনো পিতৃদেব আমাকে এমন পন্থা বলে দিতে পারেন, যাতে এখনো উপায় হতে পারে। মা বলল, গোঁয়ার্তুমি না করে কর্তাদের কথা মতই চলতে এবং ‘আমার রুবিদি’ (রুবি দত্ত) নাকি ফোন করেছিল, দেখা করতে বলেছে। কিন্তু আমি এখন গর্তের বাইরে এসে পড়েছি। এখন আর আমার বুঝতে একটও ভুল হচ্ছে না, যে মুহূর্তে নীতাকে মেরে ফেলেছি, (‘না মরেনি’ ইয়ারকি!), সেই মুহূর্ত থেকেই বাইরে ছিটকে পড়েছি। ভেতরে ঢোকার পথ বন্ধ, আর জঘন্য স্বাধীনতার আশ্রয়টা বোধহয় এই রকমই, কোথাও ঠেস দিয়ে গুটিশটি হয়ে থাকবার জায়গা নেই, অর্থাৎ যাকে বলে, সুখ নেই।

কিন্তু আমি জামা প্যাণ্ট খোলবার আগেই কলিংবেলটা বাইরে থেকে বেজে উঠলো, এবং কেউ যেন সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ছুটে এল। আমি দেখতে পেলাম না, কারণ আমার দরজাটা ভেজানো, আমি সবে মাত্র আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কোটটা খুলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু খুললাম না, ভাবলাম হয়তো তুমবোমুখোই এসেছে পরোয়ানা নিয়ে, অতএব কোট খুলেই বা কী হবে? কিন্তু ছুটে যাওয়া পায়ের শব্দ আমার দরজার সামনে এল না চলে গেল বাড়ির কর্তার ঘরের দিকে। যদিচ, তাতে নিশ্চিত হবার কিছু নেই হয়তো ভয়ংকর সংবাদটা বিদিশা আগে ওর বাবাকেই দিতে চায়, ভয়ংকর অর্থাৎ আমার জেলে যাওয়া, (কী ঘেন্না, হারামজাদাটা খুনী।) অথচ জেল-টেল ব্যাপারটা তেমন কিছু মনেই হচ্ছে না আমার। তারপরেই আবার পায়ের শব্দ বেজে উঠল, এবার আমার ঘরের কাছেই, এবং দরজাটা খুলে গেল। বিদিশা (বেচারী! বাড়ির আবহাওয়া দেখে ওর বাঁধা প্রেমিকটিকে বোধহয় আজ বিদায় দিতে হয়েছে।) আমার দিকে তাকাল, ওর চোখে মুখে একটা যেন উত্তেজনার ছাপ। ও কিছু বলবার আগেই আমি সিঁড়ির মুখে মায়ের গলা শুনতে পেলাম, আপনি এসেছেন, আমাদের কী ভাগ্যি, আসুন আসুন।

বিদিশা আস্তে উচ্চারণ ক্ষরল, রুবি দত্ত।

আঃ সেই জাঁহাবাজ মেয়েমানুষটি আবার, এবং আহা কি ভাগ্যি আমার মায়ের। পিতৃদেবও নিশ্চয় তার ঘরে মনে মনে উলসে উঠেছেন, আর বিদিশার এত উত্তেজনা ছুটোছুটি, কেন না, নেটোরিয়াস হাবুল দত্তের স্ত্রী, খোদ কর্তার উপপত্নী, (কেনরে উল্লুক, প্রেমিক বলতে পারিস না?) স্বয়ং কলকাতেশ্বরী পিছন দরজার অনেক কুলপকাটি তার আঁচলে বাঁধা, কেন কি না, কলকাতার অনেক ক্ষমতাবান ব্যক্তিরাই যে তার আচলে বাঁধা, কিন্তু বেশ্যা টেশ্যা বলো না বাবা, শী ইজ কালচার্ড, এ জেম্‌!) সেই র্‌র্‌রুবি দত্ত এসেছেন। আমি কলকাতা গলানো সেই, যাকে বলে ‘কণ্ঠস্বর’ তাই শুনতে পেলাম, না না! এ আবার ভাগ্যি কী, একটু এলাম দুষ্টুটার (আই আই!) সঙ্গে দেখা করতে, কোথায় ও?

তারপরে একটু চুপচাপ, বোধহয় মাতৃদেবী চুপিচুপি কিছু বলছেন, অর্থাৎ বোঝাচ্ছেন, এবং কয়েক সেকেণ্ড পরেই ঠাটেশ্বরী দেখা দিল দরজায়। এক গম্ভীর, একটু মানোকষ্ট, (তা তো হবেই) এমনি মুখের ভাব, যদিচ প্রসাধনে পোষাকে, অন্যান্য দিনের থেকেও যেন বেশী ঝিলিক হানছে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে অনুমতি না নিয়েই সে ঘরে ঢুকল। দরজা বন্ধ করে, আবার আমার দিকে ফিরে তাকাল। একে বলে দাঁড়ানো, কোথায় যে বাঁক মেরেছে, কোথায় একটু বেশী পা সরেছে, র‍্যালাউলী ছুঁড়িরা এসে দেখে যাক। তারপরে এক পা এক পা করে, চোখের থেকে চোখ না নামিয়ে (সম্মোহন!) আমার সামনে এসে দাঁড়াল, নাকের পাশ একটু কোঁচকালো, বোধহয় মদের গন্ধে। আহা রুবি দত্ত, মদের গন্ধ সইতে পারে না, কিন্তু আঃ শরীরখানি কী মৌজি কায়দায় দেখানো যায়। কেন এখনি ডুবে যায় না। খাঁটি উর্বসী (উর্বশী)। সামনে এসেও অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর, কেবল মুখ ফুটে বেরুল, উঃ, দেখালে বটে!

আমার মুখটা যে তখন কেমন দেখাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না, তবে মুখের চামড়া-টামড়া নড়ছে না, তা বুঝতে পারছি, এমন কি চোখের তারাও অনড়, মরে গেলাম নাকি। রুবি দত্ত-এর মিঠে গন্ধ মুখ থেকে (গায়ের না মুখের জানি না) আবার বেরুল, কর্তা তো (খোদকর্তা) অবাক যে, তার অফিস সত্যি এরকম ডিসওবিডিয়েণ্ট অফিসার থাকতে পারে। আমাকে বলতে গিয়ে গলার স্বর পর্যন্ত ভেঙে গেল, (ও মা কোথায় যাব!) কিন্তু আমি বললাম, ও রকম ছেলেই নয়, নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে। অবিশ্যি, আমি আন্দাজ করেছি, নীতার ব্যাপারটাই কোনরকম গোলমাল পাকিয়েছে, হঠাৎ এরকম একটা সংবাদ…।

রুবি দত্ত-এর চোখে জিজ্ঞাসা, অর্থাৎ কি বলছি কি না? এমনি একটা ভাব, এবং সেই সঙ্গে ঠিক বলেছে কি না, সেটাও আমার মুখ দেখে যাচাই করে নিতে চাইছে, কিন্তু আমি তো বুঝতে পারছি, এ মুখ মরা।

আবার কাঁচা মাংসের মত রং করা ঠোঁট নড়ল, বলল, না হয় আমি ধরেই নিলাম, তুমি নিজের হাতেই কাজটা করেছ, কেন না আমি জানি জেলাসি মানুষকে সামটাইমস হেলপলেস করে ফেলে। তা সেজন্যেও তোমার ভাববার কিছু ছিল না, তুমি জান, দেয়ার আর সেভিয়ার্স। কিন্তু খোদকর্তার সঙ্গে—না না এ কখনো ভাবাই যায় না। শুনলাম, হরলালের এভিডেন্স-এর কাগজপত্রগুলো পর্যন্ত বাড়িতে এনে রেখেছ। ছিঃ, এ কি ছেলেমানুষি!

কিন্তু, একি, আমি কি সত্যি মরে গিয়েছি নাকি, কেন না, রুবি দত্ত-এর শরীরের সব থেকে এগিয়ে আসা, একেবারে যাকে বলে সুচাগ্র বিন্দুটিই তো আমার শরীরে লাগছে তবু একবার চামড়া কাঁপল না। গলায় দড়ি দেওয়া উচিত।

রুবি দত্ত তার হাতের ব্যাগের বন্ধ মুখ খুলল, এক রাশ টাইপ করা কাগজ বের করল, বলল, উইদড্র রিপোর্টটা আমি নিয়ে এসেছি, নাও, সই করে দাও।

আচ্ছা সেই একটা গানের কলি কেন এই মুহূর্তেই আমার মনে পড়ল, আমি জানি না, কে আবার বাজায় বাঁসসী, এ ভাঙা…। অথচ আমি বলে উঠলাম, আচ্ছা রুবিদি, আজ আপনি সেই বিলেত থেকে নিয়ে এসেছিলেন, দেড়শো টাকা দামের (পাউণ্ডের হিসেব জানি না।) অডিকলনটা মেখে আসেন নি, না?

একটু অবাক হলেও কলকাতেশ্বরী হাসল, বলল, ওটার গন্ধ বুঝি তোক খুব ভালো লাগে?

দারুন।

বেশ তো তোমাকে আমি ওই স্টাফের একটা প্রেজেন্ট করব। এখন নাও, একটা তাড়াতাড়ি সই করে দাও তো।

আপনার পেটে বোধহয় এ বেলা মাল পড়েনি, না?

এতটা ফাজলানি করার অধিকার কখনো না পেলেও, রুবি দত্ত এটাকে তাই মনে করল, বলল, ফাজলামি করো না, সে সব হবে এখন, আগে সই করে দাও।

না, আমি এদের কাউকেই কিছু বোঝাতে পারব না, এমন কি নীতার খুন থেকে রেহাই পাবার জন্যেও নয়। অথচ রুবি দত্ত ধরেই নিয়েছে, আমি তার হাত ধরে গর্তের মধ্যে ঢুকে যাব। তাই আমাকে এবার পরিষ্কার করেই বলতে হল, চলুন, আপনাকে গাড়ীতে তুলে দিয়ে আসি।

তৎক্ষণাৎ রুবি দত্ত-এর চাবিওয়ালী চোখ দুটি স্পার্ক দিল, আর গলার স্বরেও যাকে বলে বিদ্যুত্তরঙ্গ। বলল, তুমি সই করবে না তা হলে?

আমি মিথ্যে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছি।

তার মানে–।

আহা খোদকর্তা যার কোলে মাথা লুটিয়ে পড়ে, সে কী রকম অসহায় হয়ে পড়েছে। আবার বলে উঠল, আমার একটা অহংকার ছিল–।

কথা শেষ করতে পারল না, কারণ, বিদ্যুত্তরঙ্গ চোখ ও গলা থেকে হারিয়ে গেল এবং শকড, আহত হওয়া যাকে বলে, সেইরকম অবস্থা হল, এবং আমি দেখলাম, কাঁচা মাংসের রং ঠোঁট দুটি আমার চিবুকের কাছে, (ওহো—প্রেম, প্রেমময়ী!) মৃণালভুজ আমার কাঁধে, খোদকর্তার সুখ, আমার বুকে। শুনলাম, প্লীজ, এরকম ছেলেমানুষী করো না, আমার মান রাখ।

মাইরি বলছি রুবিদি, আমাকে এখুনি বাথরুমে যেতে হবে।

তার মানে?

কুবি দত্ত এবার তানে খানি সরে গেল, এবং এবার তার সারা শরীরেই বিদ্যুত্তরঙ্গ। বলল, বড্ড বেড়ে উঠেছ, না?

হ্যাঁ, ধরে রাখতে পারছি না?

বেশ, বাড়িতে যেসব কাজ পত্র রেখেছ, সেগুলো দিয়ে দাও।

সে সব আজ আবার নিয়ে বেরিয়েছিলাম, কোথায় রেখেছি, কিছুই মনে করতে পারছি না।

ততক্ষণে রুবি দত্ত, যাকে বলে তীরের মত দরজার কাছে সরে গিয়েছে, এবং, সেখান থেকেই কাঁচা খেয়ে ফেলার মত গলা শোনা গেল, তবে প্রস্তুত থেকো।

দরাম করে দরজাটা বন্ধ হল, পায়ের শব্দ সিঁড়ির দিকে চলে গেল, সেই সঙ্গে আরে পায়ের শব্দ, নিশ্চয়ই মায়ের পায়ের শব্দ, এবং মায়ের গলায় একটা অস্পষ্ট আওয়াজ শোনা গেল, তারপরে নিঝুম। রাস্তায় গাড়ী ট্রাটের শব্দ হল, শুনতে শুনতে আমি আয়নার দিকে ফিরে তাকালাম, এবং নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে, আমি যেন আমার মধ্যেই ডুবে গেলাম, আর একটি বড় নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল ভিতর থেকে যাতে একটা নিবিড় প্রশান্তি বোধ করলাম। তারপর আঙুল নেড়ে, নিজের ছায়াটাকেই ডাকলাম।

<

Samaresh Basu ।। সমরেশ বসু