নীতার খেতে যাবার কথা ছিল, আবার মনে পড়ছে, ওর খাওয়া হয়নি। আচ্ছা, ঝিটা, কী নাম সেন, চিত্রা–চিত্রা কি এখনো, নীতার ঘুম কিছুতেই ভাঙছে না। ভেবে দরজার গোড়ার চুপ করে বসে আছে। তা বোধ হয় সম্ভব নয়, কারণ চিত্রাও তো প্রেম করে ফিরেছে, শরীরটা এলিয়ে এলিয়ে পড়া ভাব, ওরও এখন পেটের খিদে মিটিয়ে (অন্য ক্ষুধা তো মিটেছেই) একটু শুতে পারলেই হয়, তাই ঘন ঘন বেল বাজিয়েও যখন চাবির ফুটো দিয়ে দেখেছে, নীতা একইভাবে পড়ে আছে, তখন হয়তো একটু অবাক হয়েছে, ভয়ও পেয়েছে কি না কে জানে, তবে ব্যাপারটা নিশ একটা অদ্ভুত লেগেছে, তাই বেল বাজাবার সঙ্গে সঙ্গে চীৎকার করে ডেকেছে হয়তো যা শুনে পাশের আপার্টমেণ্টের সেই ইন্দোনেশিয়ান মাগীটা (তা ছাড়া আর কী বলা যাবে, কোন এক চক্রবর্তীর বউ হয়ে নাকি কলকাতায় বসে আছে, সেই চক্রবর্তীর কোন পাত্তাই কোনদিন পাওয়া যায় না, সে নাকি বোম্বেতে থাকে, আর ইন্দোনেশিয়ানী চক্কোত্তি সন্ধ্যে হলেই যত রাজ্যের পুরুষ বন্ধুদের সম্বর্ধনা করতে থাকবে, বোধ হয় সবাই স্বামীর বিরহ মেটাতে আসে, তার রেট কত আমি জানি না, নীতার পাশের ঘর কিনা!) বেরিয়ে এসেছে, জিজ্ঞেস করেছে কী ব্যাপার, তারপরে নিজে বেল বাজিয়েছে, চাবির ফুটো দিয়ে দেখেছে, কে এসেছিল না এসেছিল, জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, (নাঃ তলপেটটায় খিল ধরে গেল!) না জানতে পেরে ঠিক ব্যাপারটাই হয়তো সন্দেহ করেছে, অর্থাৎ নীতা বেঁচে আছে কি না, সন্দেহ হতেই, বাড়িওলাকে সংবাদ দেবার পরামর্শ দিয়েছে, যে ওপরের তলায় থাকে। এতক্ষণে চিত্রা বোধহয় তাই দিয়েছে, অন্যান্য ঘরের লোকেরাও হয়তো দরজা খুলে উঁকি-ঝুঁকি মেরেছে, এবং বাড়িওয়ালার কাছে যদি ডুপ্লিকেট চাবি থেকেও থাকে, তবু দরজা খোলাটা ঠিক হবে কি না, এরকম ভেবে, লালবাজারে ফোন করে দিয়েছে।

নাঃ, আর বসে থাকা যায় না, হয়তো বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল, আস্তে আস্তে পেটের যন্ত্রণাটা কমে যাবে, কারণ পা দুটো ভারী হদ্রো যেন টনটনিয়ে উঠছে। আর এক প্রস্থ চোখে মুখে পায়ে হাতে জল ছিটিয়ে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম, খাবার ঘরে আলো জ্বলছে, পায়জামা আর সার্ট পরা ওড়িয়া ঠাকুরাটা (নিশ্চয় ব্যাটা আমাকে মনে মনে গাল দিচ্ছে, সালা মাতালটার আর আসবার সময় হয় না কারণ ও আমাকে মাতালই ভাবে।) দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাকে খেতে দেবে বলে। যদিও খাবার ইচ্ছা আমার একেবারেই নেই, কিন্তু ওকে সে কথা এখন বলতে যাবার আমার উৎসাহ নেই। আমি আমার ঘরের দিকেই গেলাম, যাবার সময়ে, বিদিশা ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এল, জিজ্ঞেস করল, খেতে বসলে না?

না, খাব না।

আমি এগিয়ে গেলাম, এবং সেই মুহূর্তেই বিদিশা মনে মনে বলল, বাঁচা গেল তা যেন আমি স্পষ্টই শুনতে পেলাম।

সাধারণত আমি খেতে বসলে, মা, বা মা যদি না আসতে পারে, তা হলে খুকুকে বলে দেয়, সে যেন একবার একটু দাঁড়ায় গিয়ে, কারণ তা নইলে নাকি সেটা ঠিক সংসারের পক্ষে ভাল দেখায় না, বাড়ির ছেলে খেতে বসল, কেউ একবারটি কাছে দাঁড়ায় না (আহা, নিমাই, আমার নিমাই রে!) যদিচ আমার ছোট ভাই খেতে বললে এই নিয়ম না মানলেও চলে, আমার বেলায় চলে না, কিংবা পিতৃদেবের বেলায়, কারণ যদি রাগ হয়, বিগড়ে যাই, অর্থাৎ একটা ফর্মালিটির মতই যাকে বলে, ওই সেই কতগুলো চলতি নিয়মকানুনের মধ্যে, যাতে ভাল দেখায়, দেখানোর জন্যে মেনে চলা। আজ বাথরুমের ঘটনায় সেহেতু মায়ের রাগ হয়ে গিয়েছে, সেটা আমাকে জানবার জন্যেই, খুকুকে অগেই বলে রাখা হয়েছে, আমি খেতে বসলে সে যেন একটু সামনে দাঁড়ায়, এবং দাঁড়াতে হবে না শুনে খুকু মনে মনে খুবই খুশি হয়েছে জানি। তা ছাড়া, ও জানে, আমার চেয়েও বাবা মাকে খুশি রাখাই ওর সব দিক থেকে উচিত, আমি ওর কোন কিছুর মধ্যেই নেই, ওর নিজের গর্তের মধ্যে, ওর বাবা মা-র সাহায্যটাই বেশী দরকার। জানি না, আমার চীৎকারে অন্যান্য ভাইবোনেরাও জেগে গিয়েছে কি না, গিয়ে থাকলে নিশ্চয় গালাগালি দিয়েছে, শালা-টালা বলেছে কি না জানি না, তবে মনীষা চৌদ্দ বছরের বোনটা, যেটা বিদিশার কাছে শোয়, সে নিয়ে বলেছে, দাদাটা যাচ্ছেতাই। হয়তো, আমার মরে যাবার কথাও ভাবে, এরকম অবস্থায়, সবাই হয়তো ভাবে, বাবার কাটামুণ্ডু দেখতে চাওয়ার মত।

আমি ঘরে গিজে ঢুকতে না ঢুকতেই, চাকরটা জাগে করে জল দিয়ে গেল। আমি দরজাটা বন্ধ করে, ফ্যানটা খুলে দিলাম। অথচ একটু যেন গরমই লাগছে, বাতাস লাগলে হয়তো ভালই লাগবে। অথচ শীতটা মোটামুটি মন্দ নয়। জাগটা তুলে নিমে, আনেকটা জল খেলাম। বাইরে দুটো দরজা বন্ধ হল, একটা বিদিশার, আর একটা মায়ের। এবার শ্রীমান ঠাকুর ব্যাটা খাবে, এবং খাওয়ার ঘরেই ও আর চাকরটা শোবে। মাঝে মাঝে ওদের ভাব আর ঝগড়া দেখলে মনে হয়, দুটোতে প্রেম করে। কিন্তু জামাটা, ওটার একটা ব্যবস্থা না করতে পারলে স্বস্তি পাচ্ছি না। কনুইটা একবার তুলে দেখলাম, কনুইটাই খুনী, গায়ের চামড়ার থেকে একটু বেশি কালো আর চামড়াটা কোচকানো, এই কনুইটাই যেন নীতাকে মেরে ফেলেছে, কারণ এই ছুঁচলো হাড়টাই তো ওর গলায় বিঁধেছিল। কিন্তু কনুইটাকে দেখে কিছুই বোঝাবার উপায় নেই, যাকে বলে, কোন একস্‌প্লেশনই নেই, তবু যে কনুইকে আমার কখনোই, সারা জীবনেতে তুলে দেখবার দরকার হয়নি, আজ যেন মনে হচ্ছে, সেই কনুইটাই একটা বিশ্যে কিছু। চেষ্টা করে দেখলাম, কনুইটা আমার গলার কাছে আসে কি না, আসে না, এলে একটু চেপে দেখতাম, ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ায়। কিন্তু না, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, শুয়ে পড়া দরকার কিন্তু জামাটার একটা ব্যবস্থা না করে শুই কেমন করে, কারণ ঘুমিয়ে পড়লে, যদি আজ রাত্রেই, কিংবা ভোরেই পুলিস এসে পড়ো আসাটা খুবই স্বাভাবিক, নীতার পরিচিতদেরই আগে খুঁজবে, ডাকবে, জিজ্ঞাসাবাদ করবে। হয়তো সার্চ করতেও চাইবে, এবং তখন যদি জামাটা পায়, তা হলেই তো গেলাম। তখন নিশ্চয়ই প্রমাণ করতে পারব না যে আমি, (মাইরি স্যার) খুন করতে চাইনি, কিন্তু আমার গর্তের মধ্যে আমার সুখের পরাধীনতার মধ্যে অতি কুৎসিত নোংরা স্বাধীনতা নামক একটা জিনিস আছে, যে হঠাৎ আমার কনুইয়ে ভর করেছিল, শুনে নিন স্যার, (আর শোনাবার দরকার নেই, ডেলিবারেট মার্ডার, চল শ্রীঘর!) আপনাদের আমি বোধহয় ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারলাম না, মানে, আসক্তি এবং অনাসক্তি নীতাকে নিয়ে এ দুয়ের মাঝখানে, (হ্যাঁ জানি এসব উল্লুকের মত কথা, কিন্তু বিশ্বাস করুন স্যার, সত্যি বলছি।) একটা অদ্ভুত, কী বলব, একটা বিশ্রী দ্বন্দ্বের মধ্যে আমি ছিলাম, আরো পরিষ্কার করে বলল, ওকে ভালবাসতাম, অথচ ঘৃণা করতাম, (মামদোবাজী বলছেন তো, আমিও তা জানি, কিন্তু কী করব, ব্যাপারটা যে তাই!) এবং যাকে আমি ভালবাসতাম, তাকেই একটা ঘৃণা আর রাগে আমি (আমি নয়, কনুইটাই তো চেপে বসেছিল।) মেরে ফেলেছি। নীতা যদি আমাকে মেরে ফেলত, আমার মনে হয়, ওরও সেরকম মনের অবস্থা হয়েছিল, তা হলে, আমার মত এরকম কথাই বোধহয় বলত, আর তাতে আমি কোন মিথ্যা দেখি না। অবিশ্যি, এ কথাটা আমি এ জন্যেই বলতে পারছি যে, নীতার ঘৃণা উথলে উঠতে আমি দেখেছিলাম, এবং এই ঘৃণা আর রাগটাই সব থেকে সন্দেহজনক ব্যাপার–নারী পুরুষের ব্যাপারে, (আমার তো তাই ধারণা।) কারণ এতে ঠিক নির্ভেজাল গর্তের সুখের প্রেমে প্রণিত হয় না, যা নিয়ে সবাই যে আছে!

জানি এ সবই বুজরুকি বলে প্রমাণ হবে, কারণ খুন, খুনই, নীতা করলেও তাই হত, আমি করেছি, অতএব তাই প্রমাণ হবে, অতএব জামটা তাড়াতাড়ি সরাও, কেননা, কারণ স্বাধীনতার (কী ভয়ংকর) সাহস যে ভাবে, একজনকে একেবারে শেষ করেছে, যে একজনটা, আসলে কী বলে, একটা দ্বন্দ্ব এবং একজনকে শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকবার জন্যে শেষ চেষ্টা করেছে, তার চিহ্ন হিসোবেই জামাটা রয়ে গিয়েছে। এ কথা মনে হতেই আমি আর অন্য কিছু ভাবলাম না, কোটের পকেট থেকে তাড়াতাড়ি দেশলাইটা বের করে, বিছানার ভেতর থেকে জামাটা টান দিয়ে নিয়ে, কাঠি জ্বালিয়ে ধরিয়ে দিলাম মেঝের ওপর। টেরেলিনের জামা সামান্য একটা সিগারেটের ফুলকিতেই কী রকম ফুটো হয়ে যার সঙ্গে সঙ্গে, আর এখন একটা পুরো দেশলাইয়ের কাঠির আগুন পেয়ে যেন আনন্দে জ্বলে উঠল, যেন অনেকটা উপোষী মাতালের শুকনো গলায় বেশ বড় পেগ-এর মাল পড়ল, আর দেখতে দেখতে তার চোখ জ্বলজ্বলে হয়ে উঠল, মুখটা ঝকঝকিয়ে উঠল, ভেতরের কথা ফুটে উলঠ। আমি নাকের পাটা ফুলিয়ে গন্ধ নেবার চেষ্টা করলাম, বন্দ দরজা জানালার দিকে তাকালাম, কিন্তু তেমন কিছুই হচ্ছে বলে আমার মনে হল না। গন্ধ তো তেমন একটা কিছু পাচ্ছি না, কোন দুর্গন্ধ বা সুগন্ধ, যার জন্যে পোড়া গন্ধ পেয়ে কোর্ট ছুটে আসতে পারে। কেবল ঘরটা আলো হয়ে উঠল, আর অল্প একটু সময়ের মধ্যে নিভে ছাই হয়ে গেল। নিভে যেতেই, আগুনের আলো শেষ হয়ে যেতেই, ঘরটা আগের তুলনার অন্ধকার লাগল, এবং ধোঁয়া দেখা গেল, এবং এবার একটা গন্ধ আমার নাকে ঢুকল, যে গন্ধটা ভাল না। আমি তাড়াতাড়ি, বাড়ির বাইরের দিকের জানালা খুলে দিলাম, নিচু হয়ে কালো রং-এর ছাইটা দেখলাম, কালো রং-ই, অথচ সুতোর জামা-কাপড় পুড়লে, তার রংটা ছাই ছাই দেখায়, এটা কালচে, এবং মেঝের দাগ করে দিয়েছে। একটা বাজে কাগজ টেনে নিলাম খাটের তলা থেকে, তার মধ্যে দুইটা পুরে নিলাম, কিন্তু মেঝে যেন কেমন কালচে রস ও চটচটে মত জিনিস লেগে রইল, যেটা তখনি কাগজ দিয়ে ঘসে তুলতে চেষ্টা করলাম, অথচ ঠিক মত উঠল না। জাগের থেকে খানিকটা জল সেখানে ফেলে দিয়ে, ঘষে ঘষে তুললাম, আর তাতে এবার অনেকটাই উঠে গেল, তার ওপরে আবার পা দিয়েও ঘষে ঘষে দিলাম। কিন্তু ধোঁয়াটা ঘরের মধ্যে যেন জমে থাকতে চাইছে, বাইরে বেরুতে চাইছে না, তাই ফ্যানের রেগুলেটার ঘুরিয়ে আরো জোর করে দিলান এবং পোড়ানো জামাটার, (জামাটা তৈরী করতে খরচ পড়েছিল সাত টাকা। হার্ডলি দু মাস গায়ে দিয়েছি, অথচ একটা টেরেলিনের জামা অনেক দিন যায়, বছর কাবার তো বটেই। আবার একটা তৈরী করতে দিতে হবে, জামাটা আমার বেশ প্রিয় ছিল।) সব ছাই রঙ চিহ্ন, বা ছিল সবটুকু কাগজের মধ্যে নিয়ে, দরজার কাছে দাঁড়ালাম। আর একবার ঘরের মধ্যে তাকালাম, ধোঁয়াটা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে এসেছে, মেঝেটাও পরিষ্কার দেখাচ্ছে, সামান্য একটি হালকা ছাপ আছে, কাল সকালে ঘর মোছার সময়, আর নিশ্চয় থাকবে না, তা দরজাটা খোলার আগে আমি বাইরে কান পেতে একটু অপেক্ষা করলাম। বোঝা গেল কেহই ওঠেনি, কারুরই নাকে কোন গন্ধ যায়নি, এবং সম্ভবত ঠাকুর চাকর, দুজনেই খাবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। যাকে বলে শয্যা গ্রহণ তা বোধহয় এখনো হয়নি, হয়তো এখনো আমার বিষয় নিয়েই তাদের আলোচনা হচ্ছে, যার অধিকাংশ কথাই হল, মাতাল লোকটি শয়তান দেবতার ঘরে (আমার বাবা, দেবতা দেবাদিদেব) অসুর কিংবা কে জানে, আরো খারাপ খারাপ কথাই বলছে হতো এবং দুপুরের ছুটীর অবসরে, আশেপাশের সব বাড়ি-তুই চাকর ঠাকুরদের মারফত, এ বাড়ির বিষয় পাচার হয়ে যাবে। সকলের গায়ইে গন্ধ, তবু তার একজনের গায়ের গান্ধটি না পেলে যেন আমাদের স্বস্তি হয় না, ওতে একটা বিশেষ আনন্দ পাওয়া যায়।

দরজাটা আস্তে আস্তে খুললাম, বারান্দার আলো জ্বলছে। সারারাত্রিই জ্বলে, এবং যা ভেবেছিলাম, তা-ই, খাবার ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, সব ঘরের দরজাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমি বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। ভেতরে ঢুকে, দরজা বন্ধ করে, সমস্ত ছাই আর কাগজ গুলো ছোট ছোট টুকরা করে, পায়খানার প্যান-এর মধ্যে খেলতে লাগলাম, আর মগে করে জল ঢেলে দিতে লাগলাম। সব ফেলে দেবার পর, অনেকখানি জল ঢেলে দিলাম, যাতে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় পাইপের ভিতর দিয়ে সব দূরে চলে গিয়েছে এবং যখন মোটামুটি নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, তখন সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেললাম। ফিরে যেতে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়ালাম, হুম, বোধহয় জামাটা নিশ্চিহ্ন করার ব্যাপারেই এত বেশী ব্যস্ত ছিলাম যে, তলপেটের টনটনানি টের পাইনি, এখন ফিরে যেতে গিয়ে সেটা পেলাম, এবং সেই একই কষ্ট, কিছুতেই যেন ভেতরটা একেবারে সম্পূর্ণ, যাকে বলে ভারমুক্ত হতে চায় না। তারপরেই ঘরে গিয়ে, দরজা বন্ধ করে, ফ্যান অফ করে দিলাম আগে, একটা সিগারেট ধরালাম, এগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। আচ্ছা, সত্যি কি আমাকে কোন খুনে অপরাধীর মত দেখাচ্ছে। আমি খুনীদের অনেক ছবি ভাবার চেষ্টা করলাম। আর আশ্চর্য, দু একটি যা মনে পড়ল, তাদের সকলের চেহারাই যেন আমার থেকে ভাল। সবাইকেই প্রায় ফিলমের হিরোর মত দেখায়। আমাকেও তো দেখায়, তাই—আসলে এ কথা বোধহয় হলপ করে বলা যায় না, খুনীর বিশেষ কোন চেহারা আছে।

কিন্তু এ সবও কোন ঠিক কাজের কথা নয়, আসলে আমার কী রকম একটা অস্বস্তি হচ্ছে, এবং সে অস্বস্তিটা যে কী রকমের, আমি বুঝাতে পারছি না। শরীরের অস্বস্তিটা এখন তো নেই অথচ মনে হচ্ছে, আমার যেন কী সব করবার আছে, অথচ করতে পারছি না, কারণ, কী করার আছে, তা মনে করতে পারছি না। আমার সবই মামাদোবাজী, (আয়নার ছায়ায় নিজেকেই একটা কোমর দোলানো ভঙ্গি করে দেখলাম, সেটাকে কী বলে, খুবই অশ্লীল বলা হয়।) আমার নিজের কী করবার আছে, তাও আমি মনে করতে পারছি না, তার মানে, বলা যায়, আমার কিছুই করবার নেই। নেই, তবে আমার ভেতরে কী ঘটছে, আমি বুঝতে পারছি না, কিন্তু কিছু একটা ঘটছে, যেটা ঠিক ধরতে পারছি না। যেন অনেকটা, আর মাথাটা এখন একেবারে চিন্তা শূন্য হয়ে গিয়েছে, কিছুই ভাবতে ছি না, অথচ যেন কিছু একটা ভাবতে পারলেই ভাল হত। এ আমার কী রকম ব্যথা, এ রকম কি মানুষের হয় নাকি যে কিছু ভাবতে চাইছে, কী ভাবতে চাইছে, তা জানে না, অথচ ভাবতেও পারছে না। অতএব, তার চেয়ে ঘুমানো ভাল, এই ভেবে সিগারেটা এ্যাস্‌ট্রেতে ঢুকিয়ে দিয়ে, আলো অফ করে দিয়ে শুয়ে পড়লাম এবং বেশ বুঝতে পারলাম, ভাবনাচিন্তাহীন মস্তিষ্কে একটা ভার নেমে আসছে, চোখ বুজে আসছে। আঃ ধূ-র, হঠাৎ মনে পড়ে গেল, মা আমাকে প্রায়ই বিয়ের কথা বলে, অর্থাৎ আমাকে বিয়ে করার কথা বলে, এবং এখনই হঠাৎ এ কথাটা কেন মনে পড়ল, আমি বুঝতে পারলাম না। বিছানায় একলা শুতে হচ্ছে বলেই নিশ্চয় এ কথা মনে হচ্ছে না, কারণ ঘুমোবার সময় আমার পাশে কেউ শুয়ে আছে, কোন সময়েই তা ভাবতে পারি না, বরং কেউ থাকলে ঘুমোতেই পারি না। এমন যে ঘটে নি, তা না, সারারাত্রিই হয়তো পাশাপাশি শুয়ে থেকেছি। (এ বয়সে, ধরেই নিতে হবে, নিশ্চয় কোন পুরুষের সঙ্গে নয়, কোন মেয়ের সঙ্গে, সে যে-ই হোক, নীতাও।) কিন্তু কখনোই ঘুমোতে পারিনি। তবু এ কথাটা কেন মনে পড়ল, আমি জানি না, নিশ্চয় এমন নয় যে, আমি হঠাৎ সুবোধ বালকের মত ভাবতে আরম্ভ করেছি, সকলের মত একটি বিয়ে করে, (যেটাকে বেশ্যাবৃত্তির চেয়েও -খারাপ মনে হয় আমার কাছে, কারণ বেশ্যাবৃত্তির সময় ব্যাপারটাই খুব পরিষ্কার, সোজাসুজি, কড়ি আর তেল মাখাতেই যার শেষ, আর বিয়ে মানেই আজীবন কড়ি ফেলা তো আছেই, তেল মাখাও বটে, তার সঙ্গে যতদিন বাঁচতে হবে, ততদিনই প্রতি পদে পদে ছলনা, মিথ্যে কথা, তুমি সৎ না আমি সৎ, যদিও দুজনেই জানে, তারা একটা বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে গিয়েছে, মনের কথা খুলে বলা আর কোনদিনই যাবে না, যা এমনিতেই অনেক ছলনা করতে হয়, মন্তর পড়ে বা আইনের প্যাঁচ কষে আবার নতুন হলপ করে, তা করতে চাই না।) চোর দারে ধরা পড়ব। বিয়ে! শব্দটাই খুব পুরনো, অবাস্তব আর অর্থহীন বলে মনে হয় না? বিয়ে কেন করে লোকে? জানি, এত মিথ্যে কথা এর স্বপক্ষে বলবার আছে, যেন শুনলেই হঠাৎ মনে হয়, সমস্ত কথাগুলো দা্রুন, যাকে বলে পাণ্ডিত্যপূর্ণ আর গম্ভীর, এবং প্রথম কথাই বোধহয় এখনো একদল লোক বলে উঠবে (নিতান্ত মূর্খ!) ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’ (হ্যাঁ, উৎপাদনের যন্ত্র!) যেটা এখন অধিকাংশ লোক ভাবতে পর্যন্ত শিউরে ওঠে। আর যাই হোক, এ শ্লোকটা (শ্লোগান) লোকে ভাবতেই ঘৃণা বোধ করে বলে আমার ধারণা, যে কারণে, ওই বীভৎস উৎপাদনটা বন্ধ করা যায় কী করে, তার জন্যেই পণ্ডিতেরা হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। আর আসল ভয়টাই তো সেখানে, যে কারণে, এখানকার শ্লোক হচ্ছে, ‘জন্মনিয়ন্ত্রণ’। যার অর্থ হল, সবই চলবে, সবই হবে, কিন্তু উৎপাদনটি হবে না। তার জন্য বিয়ে করার কী দরকার আমি বুঝতে পারি না, কারণ নিয়ন্ত্রণটা যখন সবাই জানছে, এ যুগের সব ছেলেমেয়েরাই, আর লোকে কাজে লাগাচ্ছে, যেমন আমরা লাগিয়ে থাকি, তখন আর বিয়ে-ফিয়ের র‍্যালা কেন, বলতে পারি না। উৎপাদন যখন চাই না, তখন কী বলে, যৌন জীবনটা যেটা ফাঁকি দিতে পারা যাবে না, সেটার জন্যে বিয়ের বাঁধাবাঁধি কেন, যখন বিয়ে না করেই সব চালিয়ে যাচ্ছে সবাই। নাকি, এরপরে আবার ‘একনিষ্ঠ যৌন জীবন’ এ রকম একটা কথার আমদানি করতে হবে, যেটা, আমার মনে হয়, সোনার পাথরবাটির মত অনেকটা। ‘একনিষ্ট যৌন জীবন’ আহা, বেড়ে শোনাচ্ছে, প্রায় ‘ভালবাসার’ মত মহৎ, তুমি আমার আমি তোমার, আর কেউ নয়। কিন্তু আমার হঠাৎ বিয়ের কথা মনে পড়ল, আমি বুঝতে পারছি না। যাকগে, বোধহয় ঘুমটা জড়িয়ে আসছে বলেই এসব মনে পড়ছে, কিংবা, আচ্ছা এরকম নয় ব্যাপারটা নিশ্চয় যে, নীতা মরে গিয়েছে, সুতরাং যেহেতু মা যতবারই বিয়ের কথা বলেছে, ততবারই নীতার কথা আমার মনে পড়ে গিয়েছে, তাই এখন হঠাৎ বিয়ের কথা মনে পড়ে গেল এই ভেবে, বিয়ের ভাবনা আমার ঢুকে গেল। কিন্তু সে ভাবনা তো আমার অনেকদিনই ঢুকে গিয়েছিল। যদিও, মা যখন তৃতীর শ্রেণীর অফিসারদের বাজারদর যাচিয়ে আমার বিয়ের কথা বলে, এবং নীতার মুখ আমার মনে পড়ে যায়, বিশেষ করে নীতার কথা মনে পড়ে যায় বলেই এসব চিন্তা আমার চুকে গিয়েছিল। তবে আজ (ঘম আসছে) এই মুহূর্তে চুকে যাওয়া ব্যথাই আর একবার মনে পড়ে গেল গেল। নীতা না মরেও (ঘুম নামছে) এসব… ধূ-র… শালুক … চিনেছ… নীতা এখন পুলিশ…ডাক্তার।

<

Samaresh Basu ।। সমরেশ বসু