আমাদের বাড়ির ছোট বাগানের বেড়ার ধার দিয়ে বড় রাস্তা থেকে ঢুকতে হয়। যদিও বারান্দা থেকে বেড়ার ধারে সরু রাস্তাটা মাত্র হাত পনেরো, তবু বারান্দার সানসেট্‌-এর তালার আলোটা একটু জোরালো হলে, সবদিক থেকেই ভাল হয়, অথচ প্রায় জিরো পাওয়ারে আলোটা কোন দিনই বদলানো হয় না। এত জঘন্য লাগে আমার, ঠিক যেন মনে হয়, নরকের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি। লালটে মিটমিটে, অন্ধকার অন্ধকার আলো, আর বাগান তো একেবারে যাকে বলে বিশ্বের বিস্ময় হ্যাঙ্গিঙ গার্ডেন, গুচ্ছের কলাবতী ফুল গাছ, যার লম্বা লম্বা পাতা এই মিটমিটে লালচে আলোয় বিচ্ছিরি ধরনের ছায়ার মত দোলে, যা দেখলেই আমার খারাপ লাগে। ভয় আমি পাই না, শুধু আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু বাড়ির যিনি কর্তা, অর্থাৎ আমার পিতৃদেব, তিনি মনে করেন, বাইরের এই আলোটা বেশী পাওয়ারের করা অর্থহীন। কারণ, বারান্দায় আসবার জন্যে, এই আলোই নাকি যথেষ্ট এবং শুধু তাই নয়, বেশী পাওয়ারের আলো দিলেই যেহেতু ওটা যে কোন সময়েই চুরি যেতে পারে, সেই হেতু এভাবে মিসইউজ করার পয়সা নেই। তা ছাড়া, যেটা সন্ধ্যার সময় থেকেই জ্বলবে, সেটাতে বেশী খরচ করা যায় না, এই হল ভদ্রলোকের অভিমত। এই ধরনের হিসেবীদের জন্যেই সম্ভবত সামনে দিয়ে ছুঁচ গলে না, পেছন দিয়ে ফাল গলে যায় কথা শুলোর উৎপত্তি হয়েছে।

হুম, যা ভাবা গিয়েছিল, তাই, বারান্দা থেকে সোজা দোতালা উঠে যাবার সিঁড়ির দরজা বন্ধ, আর বাঁ পাশের বাইরের ঘরে আলো জ্বলছে, এবং যথাপূর্বং তার দরজাও বন্ধ। আর ঘরের মধ্যে যে এখন কে কে আছে, তা-ও আমার জানা, এবং ঢোকার মুখে এই কংক্রীটের ফালি পথে আমার পায়ের শব্দও ঐ যে সেখানে পৌঁছে দিয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই, আর শব্দ পাওয়া মাত্রই যারা, হাতে হাত দিয়ে, গায়ে গা দিয়ে, কে জানে, পায়ে পা গলিরেই বা বসেছিল, নয় তো ঠোঁটে ঠোঁট ঢুকিয়ে–কী বলা যাবে, ওষ্ঠামৃত না কি মুখামৃত পান করছিল (কেন, থুথু-অমৃত বা দাঁতের ময়লা কিংবা পাইরোরিয়ামৃতই বা নয় কেন, জানি না। চোষবার সময় কি আর ওসব মনে থাকে? যদি থাকত, তবে অনেক মুখেই তো মুখ দেওয়া যেত না, অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসত, ওয়াক্‌! শালা, এক একটা মুখে কী দুগন্ধ মাইরি, কিন্তু আশ্চর্য, তখন একেবারেই খেয়াল থাকে না, যদিও একটা বিঘ্‌নি ঠিক লাগে, তবু এই আর কি, লোহা চিবিয়ে খাবার মত যেমন নোংরার বেহদ্দ হোটেলে বসেও খেয়ে নেওয়া যায়, অনেকটা সেই রকমের, আগে তো কলজে ঠাণ্ডা হোক, তারপর ওসব ভাবা বাবে, তারপরে গা ঘুলোর তো বমি করা যাবে। ওরকম আমার অনেকবার হয়েছে, এমন কি, কোন কোন সময় নীতার মুখেও গন্ধ পাওয়া গিয়াছে। ওর পক্ষে যেটা খুবই আশ্চর্যের, কারণ ওসব বিষয়ে ও খুব সচেতন ছিল, তবু গলায় ফ্যানিনজাইটিস না কী বলে, ঠাণ্ডা লাগলে গলা ব্যথা করে কিংবা পাকস্থলী পরিষ্কার না থাকলে দুর্গন্ধ ঠিকই বেরোয়, আমারও বেরোয়, লিভার-টিভার খারাপ থাকলে তো কথাই নেই, যে-কারণে দুর্গন্ধের ভয়টা আমারই বেশী, তবে পেটে একটু হুইস্কি-টুইস্কি থাকলে, ওতেই মেরে দেয়া। তা ছাড়া, আমি তো ওর দাঁতের ফাঁকে এঁটে-থাকা খাবারের কুচিও অনেক সময় গিলে মিরে দিয়েছি, নীতাও নিশ্চয় দিয়েছে, যেমন আজও ওর মুখের মাংসের কুচি বা আমার মুখেরটা ওর মুখে চলে গিয়েছিল, এবং মুশকিল তখন মুখ খুলে, ওগুলো থুথু করে ফেলা যায় না, গিলে ফেলতে হয়, পরে ভাবলে অবশ্য একটু ঘিন ঘিন করে, যদিচ, নীতা বেলায় আমার আবার তেমন কিছু মনে হয় না, এখনো সেরকম মনে হচ্ছে না, ওর হত কি না জানি না, কোনদিন বলেনি।) যাক গে, হ্যাঁ, বাইরের ঘরে, দরজা বন্ধ করে যারা বাড়িতে বসেই সুবোধ বালক-বালিকার মত প্রেম করছিল, তারা নিশ্চয়ই নিজেদের আলাদা করে, যাকে বলে সভ্য ভব্য হলো, যাকে বলে শালীন হয়ে বসেছে, এবং সিঁড়ির দিকে যাবার দরজাটাও বন্ধ ছিল, সেটাও টুক করে গিয়ে খুলে দিয়েছে, যাতে আমার কাছে প্রমাণ করা যায়, দেখ নির্ভাজ সাদা কাগজের মত দুটিতে বসে আছি নিতান্ত খোকা খুকু, তবে যদি বল, এত রাত্রি পর্যন্ত বাইরের ঘরে তোমরা দুটিতে বসে এত কী জরুরী কথা বলছ, সেটা কেমন অভদ্র সন্দেহপ্রবণ বলে মনে হয় না? শত হলেও ভদ্রলোকের ছেলেমেয়ে, মা-বাবার মনের কথাও জান, হ্যাঁ, ওই আর কী, একটা এনগেজমেন্ট মাদি ঘোষণা করা যায়, অ্যারেঞ্জমেন্ট করে তো আর, যাকে বলে সম্বন্ধ দেখে বিয়ে দেও, ওরকম কিছু চাপিয়ে দেওয়া তো  আর চলে না। লেখাপড়া শিখেছে, বড় হয়েছে সবাই, আর বাড়িতে বসেই যখন কথা বলছে, বাইরে গিয়ে তো কিছু বেলেল্লাপনা করছে না (যেন কেউ দেখতে গিয়েছে, সন্ধ্যার কে কোথায় কাটিয়ে এসেছে।) অতএব, এটা তো লুটবেই, তোমাকে এই স্বাধীনতা মেনে নিতে হবে। এই স্বাধীনতা! কৃত স্বাধীনতা যে তলিয়ে গেল, সে খবার কে রাখে।

তবু, অর্থাৎ জুতোর শব্দে সাবধান হলেও, শব্দ পাওয়াটা জানতে দিতে নারাজ, তা হলে সাবধান হওয়াটা খানিকটা প্রমাণ হয়ে যায়, অতএব, আমাকে কলিংবেলের বোতামটা টিপতেই হয়, এবং আমাকেও বুঝে নিতে হবে, বাইরের ঘরে কেউ নেই, অতএব আমি ইচ্ছে করেই বেশী সময় ধরে বোতাম টিপে ধরি, যেন ওপারের লোকদের কানে যাবে বলেই টিপতে হচ্ছে, আর সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা খুলে যায়। দরজা খুলেই সামনে দাঁড়ার বিদিশা, (কেন যে এ ধরনের দাম রাখা হয়েছে, আমার জানা নেই, ওটা যতদূর জানি, একটা, জায়গার নাম, তার মানে বিদিশা সেরকমই একটা জায়গা, ওর বাবা-মা কি তাই ভেবে ছিল, নাকি কানে শুনতে ভাল লেগেছিল বলে জানি না, তবে দিল্লী বোম্বাই কাঠমাণ্ডু কারমাটার কী দোষ করেছিল।) আমার সহোদরা, যাকে ভগ্নী বলে আর কী। ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, যেটা বলতে চাইছে, খুলেছি বাবা আর টিপতে হবে না, যদিও সেটা না বলে, মুখের ভাবেই বোঝাতে চাইছে, এবং আমার বোঝবার কথা নয়, কারণ আমি তো জানি না নিচে বাইরের ঘরে এখন কেউ আছে, অতএব তুই একটা নেকী, আমিও একটু ন্যাকা, যদিও অবিশ্যি পরমুহূর্তেই আমি মুখের ভাবটা করি, ও, তুই নিচেই আছিস নাকি বুঝাতে পারিনি। জানি, আমার মুখের দিকে তাকাবেই, বিদিশা (ওকে বাড়িতে খুকু বলা হয়, আহা, বোনটি আমার খুকুমণি, পার করেছেন কজনই, যাঃ বাবা, কবিতাই বলে ফেললাম, খচ্চরটির প্রতিভা আছে বলতে হবে।) নাকে গন্ধ নেবার চেষ্টা করছে, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইছে, দাদাটি কী পরিমাণ গিলে এসেছেন, যদিও বাড়িতে মাতলামি করবার পাত্র আমি নই, কখনো করিনি, শুধু আমার প্রতি মনে মনে একটা ভয় ঘৃণা ওর আছে আর সেটি মদ খাবার জন্যেই নয়, বাড়ির সঙ্গে আমার সম্পর্কটাই এমন যে, আমি রোজগার করে ওদের মাথা কিনেছি, আমি বড়, অতএব আমাকে রেসপেক্ট করতেই হবে। অথচ আমরা নিজেদের বেশ ভাল করেই জানি, মোটামুটি কার কী মতলব, যে-সব মতলবগুলোর অধিকাংশই হল, কেউ কার কড়ি ধারে না, সবই বুজরুকি, যে-যার নিজেরটা ঠিক বুঝে নেবার তালে আছে, চালিলে যাও বাবা, মরুক গে ছাই, বয়ে গেছে, কার ঝাড়ে কে বাঁশ কাটে এনিভাবে বললে যেরকম বোঝায়, তবু যেমনটা হতে হয়, আমি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ও কনিষ্ঠা ভগ্নি এই ধরনের ওপরের তাপ্পিগুলো বজায় আছে। তুমি কার কে তোমার এ-সব ভগবৎ কাব্য বোঝা হয়ে গিয়েছে বাবা, দুনিয়াদারী ফক্কিকার সবাই বুঝে বুঝে নিয়েছি, তবে কেউই সেটা খোলাখুলি দেখায় না, যদিও মনে মনে সবাই জানে। তার ওপরে, আমার মত যদি বড়ই ভাবিত বা অতীব দায়িত্বশীল (ঘরে নয়, বাইরে, নইলে ছললাটা বজায় রাখা যায় না।) ভাবভঙ্গিগুলো বজায় রাখা যায় না। ভাবভঙ্গিগুলো বজায় রাখা যায়, কিংবা কিছুটা দুর্মুখ বলে প্রমাণ করা মাত্র তা হলে তুমি একটি উৎকৃষ্ট বদ বলে বাড়িতে গণ্য হতে পারি, যে-কারণে সবাই তোমাকে ভয় করবে, ঘৃণা আরো বেশী, কারণ, একটু বেশী খোলাখুলি হয়ে যেতে হয়। তাতে অবিশ্যি সুবিধাটা এই, কেউ বিশেষ ঘটাবার সাহস পায় না, নিজের কোট বজায় থাকে, আর অনেক ফালতু সুযোগ নেওয়া যায়, কারণ, সত্যি বলতে কি, কারুর জন্যে আমার তেমন দুঃখ-টুঃখ হয় না, সেরকম অনেকের দেখা যায় বা শোনা যায়, আমার জন্যেও অন্য কারুর হয় বলে আমি বিশ্বাস করি না, শালুক আমি চিনি। নো কথা হল দিয়ে সংসার-টংসারের রূপোট ভাল লাগে না, যাকে বলে পরিবার, ফ্যামিলি, কারণ, ওসব কাকে বলে আমি বুঝি না।

ঘরে ঢুকতেই যেটা প্রথা লক্ষ্যণীয়, সেটা হল বশংবদ কুকুরের মত হাসি (কুকুর সে হাসে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।) ও লেজ নাড়তে নাড়তে, প্রায় আমারই বয়সী একটা লোক উঠে দাঁড়াল, এই লোকটা—আর্থাৎ বর্তমানে যে বিদিশার প্রেমিক, কত নম্বর, আমি সেটা ঠিক বলতে পারব না, কারণ, বিদিশার সঙ্গে বেশী রাত অবধি গল্প করার অধিকার থালি এ-লোকটাই পায়নি, আরো কয়েকজন পেয়েছে (এই হিসেবটা অবিশ্যি বাড়ির হিসেবের কথা বলছি, যাকে বলা যায়, পিতা-মাতার অনুমত্যনুসারে—কেননা, আজ সন্ধ্যে বেলাতেই কার সঙ্গে কোথায় ঘুরে এসেছে, কে জানে, হয়তো এ-লোকটিকেও ধাপ্পা মেরেছে, সে এখন অনুমত্যনুসারে এত রাত্রি অবধি র‍্যালা করার সুযোগ পেয়েছে, কারণ, এটি নিশ্চয়ই, সমাজে নাম করা, পিতৃদেবের বন্ধুস্থানী এমন কোন ভদ্রলোকের ছেলে, চাকরিটিও মন্দ করে না, অতএব–) সে আমাকে বলে উঠল, এই যে দাদা, ফিরলেন?

এই দাদা উচ্চারণটা ঠিক রাস্তার লোকের দাদা বলার মত নয়, অনেকটা বিদিশার সঙ্গে নৈকট্য প্রনণের জন্য, রেসপক্‌টর-এর সুরে বলা, অর্থাৎ বিদিশার দাদা, (ওরও দাদা ও বাবাকেলে দাদা), যদি বিয়ে হয়, তবে তো তাই বলবে আমাকে, সেটা এখন থেকেই গেয়ে রাখতে চায়। হয়তো গতকাল রাত্রে এ সময়ে অন্য কোন বাড়িতে, আর কোন বিদিশার কাছে গিয়েছিল, কিংবা কে জানে, ইয়ারদোস্তদের সঙ্গে কোন বেশ্যাবাড়িতেই গিয়ে বসেছিল, চেনা আছে সবাইকে, কিন্তু আমার হাতে কিছুই যায় আসে না। যা পাবে ঝেড়ে নিয়ে যাবে, তাতে আমার কী করার আছে, বিদিশার শরীরটা তো আর আমার না। আর বিদিশার বাবা মা-ই যখন সুযোগ দিয়েছে, যারা মরে, তারা হল, মেয়ের নৈতিক পাহারাদার—তখন দাদাই বা সুযোগ দিতে পারবে না কেন।

হেসে (প্রাণের হাসি) বললাম, হ্যাঁ। না ফিরলে সুবিধে হত তা জানি, কারণ অভিভাবকদের সম্ভবত সেইরকম না বলে অনুমতি দেওয়া আছে, মোটামুটি আমি রোজ যে সময়ে ফিরে থাকি, সে সময় পর্যন্তই নিচে বলে কথা বলা যাবে। আর এখন বাড়ি আসা মানে ফেরা-ই, বেরুনো নয়, এবং এ ধরনের ন্যাকার মত কথা সবাই বলে থাকে, অন্তত যাতে কিছু একটা কথা বলা যায়, বিশেষ করে সেখানে, যে-লোকটা সব থেকে অপ্রয়োজনীয়, যার সঙ্গে কথা বলা দূরে থাক, যার মুখটাও সারাদিনে একবার মনে পড়েছে কিনা সন্দেহ, যে লোকটার কথা মনে কোথাও ছিল না, একমাত্র কোন কারণে যদি সন্দেহ হয়ে থাকে, এই বুঝি বাড়ি আসছি; তাহলে আজকের মত লীলাখেলা সাঙ্গ) অথচ কথা না বলেও কোন উপায় নেই, কারণ সেটা আবার বড় বেমানান লাগে। অবিশ্যি, আমার বাড়ি ফেরার একটা বাঁধাধরা সময় প্রায়ই থাকে, যদি না বিশেষ কিছু যোগাযোগ ঘটে যায়। যেন আজ যদি নীতার সঙ্গে কোন হোটেলে খেতাম বা নীতার কাছে সারা রাত্রি থাকার সুযোগ পেতাম তা হলে নিশ্চয়ই দেরী হত, এবং সে ক্ষেত্রে মাতৃদেবীর নিশ্চয়ই টনক নড়ত, এবং সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়েই বলত, (কী জানি, নিচে গেলে মেয়েকে আবার কী অবস্থায় দেখতে হয় কে জানে, যদিও একেবারে খোলাখুলি র‍্যালা কিছু নিশ্চয়ই সাহসে কুলোবে না, তবু হাত ধরাধরি বা চুমো খাওাখায়ি, তাহলেই তো মহাভারত অশুদ্ধ।) তুই কি নিচে রয়ছিস নাকি?

তার মানে, জানি নিচে রয়েছিল, কিন্তু দেরী হচ্ছে, তোর দাদা তো এখনো এল না, এবার উঠে আয় এই হচ্ছে মূল বক্তব্য; ভদ্রলোকদের কথা তো সব সময়েই, সেই ততো ক্যাপসুলের ওপরে একটি পিঠে কোচিং দেবার মত করেই কথা বলতে হয়, কারণ এটাই হচ্ছে শানিত, যদিও আমার ধারণা খুকু কতদূর পর্যন্ত এগোবে, এটা তার মায়ের ভাল করেই জানা আছে, আর মেয়েরা মেয়েদের খুব ভাল করেই জানে, সে মা তার মেরেই হোক আর যা-ই হোক, ওরা দু-এক কথার ভেতর দিয়েই নিজেদের মধ্যে বোঝাবুঝি করে নেয়, একেবারে খোলাখুলি পষ্টাপষ্টি কিছু না বুঝিয়ে বললেও চলে দেখেছি; তবু এই চেনাচেনিটা আছে বলেই শেষ পর্যন্ত অবিশ্বাস না করে উপায় নেই, কারণ জানে, ওদের কদম কদম পেছুবার রীতিটা, কখন এক সময় সব কদমা পেরিয়ে এক লাফে সামনে গিয়ে পড়বে, যেহেতু একবার মনে মনে রাজী হয়ে গেলে আর রক্ষে নেই, আর পুরুষরা তো এগিরেই আছে।

তবু আমি একবার বিদিশার মুখের দিকে তাকালাম, এবং ও ঠিকই অনুমান করল, আমি কী দেখেছি, যে কারণে মুখের একটি অতি সরল (সেই নিষ্পাপ পবিত্রতা।) ভাব করে, অন্য দিকে তাকিয়ে, আর নিশ্চয় মনে মনে আমাকে শয়তান বা পাজি জাতীয় বিছু বলল, কে জানে তার চেয়েও খারাপ কিছু কি না, হয়তো থুথুই দিয়ে দিল আমার মুখে। তখন লোকটা, নামটা মনে পড়েও পড়ছে না, যাক গে।) আবার বলল, এইমাত্র আপনার কথা হচ্ছিল, আপনার আসতে আবার দেরী হবে কি না।

সত্যি? মাইরি? কেন, ওপর থেকে ডাক পড়েছিল নাকি। আমি হাত তুলে ঘড়ি দেখলাম, এগারোটা বাজতে পাঁচ, প্রায় এ সময়েই তো ফিরি, বিশ পঁচিশ মিনিট দেরী হয়েছে হয়তো। বললাম, খুব দেরী হয়নি তো। বসুন।

বলতে বলতে আমি সিঁড়ির দরজার দিকে এগোলাম, এবং বসুন বলাটা ভদ্রতার মধ্যে পড়ে তৎসহ হাসি হাসি ভাবটা, যদিও বসুন বলা কেন, ও দৌড়ে রায় গিয়ে গাড়ি চাপা পড়লেও আমার কিছু যায় আসে না, ওর অস্তিত্বের প্রায় কোন অনুভূতিই আমার নেই, তবু এরকম মিথ্যে কথাই তো সব সময় বলি। তা ছাড়া তুমি যে এখন যাবে না, বা আর একজন তোমাকে যেতে দেবে না, তাও আমি জানি, আর সেটাই তো ওহো, কী গভীর প্রেম। প্রাণটা ‘স্মসান্‌’ হয়ে গেল মাইরি।

আমি বসুন বলাতেই যেন তা গলে গেল, বলল, না, আর বসব না। অনেক রাত হয়ে গেছে।

তবে গোল্লায় যাও শালা মনে মনে বললেও, নেহাত একবার ঘাড় ফিরিরে তাকাবার ভঙ্গি করে আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে আরম্ভ করলাম। আমি তার বিদিশা ছাড়া এ বাড়িতে আর যে তিনটি ছেলেমেয়ে আছে, তারা এতক্ষণে শুয়ে পড়েছে নিশ্চই, কারণ এ সময়ে তারা তাই পড়ো সবাই ভবিষ্যতের ‘আমি’ আর ‘বিদিশা’, যদিও ছেলেবেলা অনেক কিছু মনে হয়। যেমন গান্ধী বা রবীন্দ্রনাথ বা বিদ্যাসাগর বা বিবেকানন্দ, সবাই ওইরকম একটা কিছু হয়ে উঠবে, কারণ আমাদের সবাইকে ছেলেবেলায় ওইরকম একটা কিছু হয়ে ওঠের জন্যেই তালিম দেওয়া হত, এখনো হয়, এবং আচ্ছা, সবাই যদি তাই হয়ে উঠত, গোটা দেশ জুড়ে সব ছেলেরাই যদি কোটি কোটি প্রতিভাবান, আর মেয়েরা সব সরোজিনী নাইডু বা শ্রীশ্রী মা সারদা, তাহলে ব্যাপারটা কী রকম দাঁড়াত। দাঁড়াত বোধহয় এই, ছেলেদের আর রোজগারের কথা ভাবতে হত না, মেয়েদের আর বরের কথা ভাবতে হত না, যে জন্যে ছেলেবেলা থেকে এত তালিম, সে সবই তো তখন হাতের মুঠোর এসে যেত। আহা, ভাব একবার গোটা ভারতবর্ষের ছবিটা, এখন যেমন কথায় কথায় বলা হয়ে থাকে, রবীন্দ্রনাহের ভারতবর্ষ, বিবেকানন্দের ভারতবর্ষ, গান্ধীজীর ভারতবর্ষ অর্থাৎ অনেকটা আক্ষেপ করেই যেন বলা হয়ে থাকে, নতুন ভারতবর্ষ যাদের হাতে তৈরী হয়ে উঠেছে, সেই ভারতবর্যের এ হেন দুর্দশা, দুর্দশা কোথায়, বেশ তে চলেছে বাবা! এফিসিয়েণ্ট মন্ত্রিসভার ভারতবর্ষ, ফিল্‌ম স্টারদের ভারতবর্ষ, ডেমোক্র্যাটিক জনতার ভারতবর্ষ, ডেমোক্রাটিক—ইয়ার্কি নয়, বেশী এদিক-ওদিক করলে এমন মুভমেট করব, পার্লামেন্ট কাঁপিয়ে দেব, অ্যাসেম্বলি ঝুলিয়ে দেব, আমাদের স্‌সব অধিকার আছে।) তথা সেই ভারতবর্ষের ঘরেবাইরে রাস্তা-ঘাটে হোটেল-রেস্তেরাঁয় পান-সিগারেটের দোকানে, সর্বত্র প্রতিভাবান মনীষা ও বিদূষীতে গিজ গিজ করছে। আচ্ছা, এখন আবার দলাদলি মারামারি হত না তো? যারা রবীন্দ্রনাথ, তারা বলল, রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষ। যারা গান্ধী, তারা বলল, না, গান্ধীজীর ভারতবর্ষ! হুম্‌, এতক্ষণে নতুন করে পেটের দ্রব্যগুণ চাগিগে উঠল কিনা কে জানে, নইলে এসব মাথায় আসছে কেন, বেশ তো আছে ভারতবর্য, বেশ তো আছি বাবা, এখন না হয় ভারতবর্ষটা আমাদেরই, মোট কথা আমার ভাইবোনেরাও ঠিকই আছে, ড্রেন পাইপ প্যাণ্ট, কচি ঠোঁটে সিগারেট, কচি শরীরে আট-খাটো ছোট ফ্রক, টুইস্ট এবং ভবিষ্যতের দিলদরিয়া স্বপ্ন, বিলকুল ঠিক আছে। ঘুষের মালকড়িটি নিয়ে এস, রুবি দত্ত আঁচলে চাবির গোছা বাঁধা থাকুক, যাতে পেছনেয় দরজা খোলা যায়, ঠিক কামাল করে দেব। তা ছাড়া ভাইবোনদের আমি কতটুকুই বা চিনি, কতক্ষণই বা দেখতে পাই, ওদের সঙ্গে আমার কতটুকুই বা পরিচয়, ওঁরাই বা আমাকে কতটুকু চেনে? কারণ ওদের সঙ্গে আমার সম্পর্কই বা কী, তার চেয়ে চোখ বুঝলে অফিসের বস, ঘুষ দেওয়ার পার্টি এবং বার-এর বেয়ারা এবং মেয়েদের মুখ আমার অনেক আগে মনে পড়ো ওরা ওদের নিয়ে আছে, আমি আমাকে নিয়ে আছি, আমরা কেউ কাউকে চিনি না, কারণ ওরাও চোখ বুজলে অন্য কিছু দেখতে পায়। আমি সেখানে কোথাও নেই, থাকলে যে অনেক ঝামেলা হত, কোন সন্দেহ নেই।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে, প্রথম ঘরটাই বলতে গেলে আমার, আমার একার থাকবার জন্যে, এবং প্রথম ঘরটাই আমার জন্যে নিদিষ্ট হওয়ার কারণ আর কিছুই নয়, যতটা সম্ভব বাইরের দিকে আমাকে রাখাই যুক্তিযুক্ত মনে করেছে গৃহকর্তা ও কর্ত্রী, কারণ আমি কখন ফিরব না-ফিরব তার কোন ঠিক-ঠিকানা প্রায়ই থাকে না। পারিবারিক নানান ব্যাপার (কী ব্যাপার আমি অত সব জানি না। আমার গোচরে জানাটাও তাদের অভিপ্রেত না এবং আমার নিজের দিক থেকেও সেটাই বাঞ্ছনীয়, গুড়ের কোটায় মাছির মাত্র, (পারিবারিক জীবন।) নিজেদের বেগ সব কিছু নিয়ে মাখামাখি করে থাকতে আমার ঘেন্না করে। মোট ঘর খান চারে, রান্নাঘর আর খাবারঘর ছাড়া সম্ভবত এ হিসেবটি আমার ভুল হচ্ছে না, এটি জোর করে আমি তাও বলতে পারি না, কারণ, আমার আট বছর বয়সে এ বাড়িতে আসা হয়েছে, এখন থেকে আমি, নিজেকে নিয়ে এত বেসামাল যে, আরো দু-একটা ঘর আমার অগোচরে থেকে গেলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। সব থেকে শ্রেষ্ঠ ঘর, যেটা আলো-বাতাস বেশী আছে, যেটা সব থেকে বড়, সেইটি বাড়ির কর্তার জন্যে নির্দিষ্ট আছে। কর্তার জন্যে নির্দিষ্ট মানেই কর্ত্রীর জন্যও বটে। আর সেটাই তো নিয়ম, বস্‌-এরা বরাবরই সব কিছুর ভালটা ভোগ করবে, তা সে বাবাই হোক আর যেই হোক। বাদবাকীগুলোতে তাদের সন্তান-সন্ততিরা থাকে যাদের তারা প্রচুর টাকা রোজগার ও খ্যাতিমান হবার এবং শাঁসালো বর পাকড়াবার জন্যে, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে মানুষ করছে।

আমি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আমার সামনে দাঁড়ালাল, হুম,–-চোখগুলো সত্যি কাল হয়ে উঠেছে এবং ছোট দেখাচ্ছে, এবং দুঃখটা, নাঃ খারাপ নয় তেমন, এখন অনেকটা কী যেন নামা সেই তারকা টির, হলিউডেরই হবে বোধহয়, লামাটা মনে করতে পারছি না, তার মত দেখাচ্ছে। চোখ টিপে নিজে একবার ইশারা করলাম, কোটটা খুলে ওয়ার্ডবের মধ্যে হ্যাঙারে ঝুলিয়ে দিলাম। তারপরে (নিচে দরজা বন্ধ হবার শব্দ হল, ওঃ বিরহ দিয়ে গেল…) সার্টটা টেনে তুলতেই নিচের ছেঁড়া অংশ বেরিয়ে পড়ল, আর সঙ্গে সঙ্গে তার কথা মনে পড়ে গেল। আমি ছেঁড়া জাগাটা তুলে দেখলাম, হ্যাঁ ঠিকই, নীতার নখের রং লেগে আছে এবং আমার মনে পড়ে গেল, পেটের কাছে নীতা খামচে ধরেছিল, মন পড়তেই, দুটো বোতাম খুলে প্যাণ্ট নামিয়ে দিয়ে নিচু হয়ে দেখলাম, শুধু ধরেনি, অস্পষ্ট নখের দাগ পড়ে গিয়েছে এবং একটু ব্যথাও হয়েছে। হাত দিয়ে অনুভব করে দেখলাম, চামড়ার ওপরটা একটু ফুলে ফুলে উঠেছে, নখ দিয়ে আঁচড়ালে যে কম হয়, আর নখ দিয়ে আঁচড়াবার সময় হয়তো এমনও হতে পারে যে, টেরিলিনের এক-আধটা সুতোর ফুঁপড়ি ওর নখে লেগে রয়েছে, কারণ ওর নখগুলো ছোট ছিল না, সুন্দর করার জন্যে বেশ বড় বড়ই রাখত, (যত সুন্দর তত ধারালো, যাতে মাংস অবধি তুলে নেওয়া যায়, সৌন্দর্যের তত্ত্বটা সেরকম কি না, আমি জানি না। অতএব পুলিসের চোখে যদি সেটা ধরা পড়ে, পড়বেই, যদি থেকে থাকে, তাহলে ধরেই নেবে, যে মেরেছে তার গার টেরেলিনের জামা ছিল বা শাড়ি। অবিশ্যি টেরেলিনের শাড়ি থেকে সার্টের কথাটাই আগে ভাববে এবং এই সার্টটা যদি আমার কাছেই থাকে, অসম্ভব নয়, হয়তো আমার এই ঘরটাও সার্চ করতে আসতে পারে। তাহলে নির্ঘাত ধরা পড়তে হবে। তৎক্ষণাৎ সার্টটা খুলে আমি দলা পাকিয়ে ফেললাম, বিছানার তলায় ঢুকিয়ে দিলাম। পরে, অর্থাৎ আজ রাত্রেই যাতে এটাকে একেবারে নষ্ট করে ফেলতে পারি, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। ভাগ্যিস, এসব কথা আমার পড়ে যাচ্ছে, তাই রক্ষে। ধু-র, খুনের এত ঝামেলা, তবু খুনীরা, যারা খুন করলে ভেবে করে, তারা এত ফ্যাচাং পোহায় কী করে! কিন্তু কী করা যাবে, আমি তো আর ভেবে এসব কিছু করিনি, অথচ এসব আমার মন পড়ছে, যেন অনেকটা দৌড়ে বাসে উঠে, ভিড়ের মধ্যে একটা লোকের পা মাড়িয়ে দেবার মত, অনিচ্ছাবশত, তবু যেন অপরাধ করে ফেলেছি এবং তার জন্যে তাড়াতাড়ি নিজেকে সাবধান করে নেওয়া, আর যাতে অপরাধটা (এটা অপরাধ কি না জানি না, ভিড় হলে পা মাড়িয়ে তো যাবেই, অন্যরাও যেতে পারে, যেন নীতা আমাকে মেরে ফেললেও বলার কিছু ছিল না।) গোপন করা যায়, তার জন্য খুবই কায়দা-কানুন করে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া, যাক মিটে গেল। সেইভাবেই সব মিটিয়ে ফেলতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যি ওরকম ক্ষমা চেয়ে নর, অন্যভাবে সবই গোপন করে ফেলতে হবে।

প্যাণ্ট সার্ট সব খুলে ফেলে একবার আড়মোড়া ভাঙার জন্যে গোটা শরীরটাকেই আঁকিয়ে-বাঁকিরে আয়নায় নিজেকে আর একবার দেখলাম, আর সেই মুহূর্তেই আমার গাটা ঘুলিয়ে উঠল। কিন্তু ঘুলিয়ে ওঠবার তো কিছু নেই, কারণ নেশাই জমেনি, অতএব মদ খেয়ে বমি করার মত অবস্থা আমার হয় নি। তবু গা ঘুলিয়ে উঠল শুধু নয়, মাথাটা বোঁ করে যেন একবার পাক খেতে গেল, যেটা প্রায়ই অবিশ্যি হয়, সেটা প্রেশার না উইণ্ড, সঠিক জানি না, কিন্তু এখন এরকম হবে কেন। এমন নয় যে, একেবারে খালি পেটে আছি। নীতার রাত্রের খাবার মাংসের কিছু পরিমাণ তো আমার পেটেই ঢুকেছে, তবু, হ্যাঁ, মুখে যেন খানিকটা জল জলই কাটছে। আমি গলায় একটা হাত, আর পেটে আর একটা হাত রেখে স্থির হয়ে একটু দাঁড়ালাম। আশ্চর্য, আর শীতও করছে না। একটু সামলে নেবার জন্যেই যেন অনেকটা চুপি-চুপি, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম এবং ঢোক গিলে গিলে জলকাটা ভাবটা সামলে নিতে লাগলাম, আর আস্তে আস্তে মনে হল, আবার সব ঠিক হয়ে আসছে। জানি না, কুঁচো কৃমির দৌরাত্মটা আবার বেড়েছে কি না, যেগুলো আমার পেটে প্রায় মোরসী-পাট্টাই গেড়েছে, সময়মতো ঠিক নাগাড় দিয়ে ওঠে। অথচ তবু আয়নার সামনে নিজেকে আমার মন্দ লাগাল না দেখতে। আস্তে আস্তে সরে গিয়ে পাজামাটা বের করে নিয়ে, যেন পড়ে যাবে, এমনিভাবে, যাকে বলে খুব সাবধানে পায়ের মধ্যে দিয়ে গলিয়ে পরলাম, একটা জামাও চাপালাম। আসলে শরীরটা বেশী নড়াচড়া পছন্দ করছে না বোধহয়, একটু চুপচাপ থাকতে চাইছে। যদিচ বাথরুমে আমাকে একবার যেতে হবে, কারণ ঘাড়ে মাথার একটু জল না দিলে চলবে না মনে হচ্ছে, আর সেরকম বুঝলে, গলায় আঙুল দিয়ে, পেটটাকে খালি করে ফেলতে হবে। কি জানি বলা যায় না, বার-এ মালের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল কি না, কিংবা করপোরেশনের জলের মধ্যে কিছু ছিল।

<

Samaresh Basu ।। সমরেশ বসু