খুনের আগে খুনী খোঁজা – একানবাবুর গল্প – সুজন দাশগুপ্ত

০১.

এবারে গ্রীষ্মের ছুটিতে কলকাতায় বেড়াতে এসে আমাদের পুরনো আড্ডাটা আবার জমে উঠেছে। প্রতি সন্ধ্যাতেই আমি একবার একেনবাবুর বাড়িতে ঢু মারি। প্রমথও আসে। শনি-রবিবার ওঁর বাড়িতে সকালে আমাদের চা আর জলখাবার বাঁধা। একেনবাবু পুলিশের চাকরি ছেড়ে কলকাতায় পুরোনো একজন সহকর্মীকে নিয়ে একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছেন। পার্টনার অবশ্য এখনও চাকরি করছেন, খাতায় কলমে নামটা হল তাঁর স্ত্রীর। ছুটিতে এসে ওঁর বেতনহীন সহকারী হলাম আমি আর প্রমথ। তবে বেতন হিসেবে যদি একেনবউদির অফুরন্ত স্নেহ, ভালোবাসা এবং স্বহস্তে রান্না চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় ধরা যায়, তাহলে তার পরিমাণ মোটেই উপেক্ষণীয় নয়।

শনিবার সকালে গরম গরম শিঙাড়া আর জলভরা সন্দেশ নিয়ে একেনবাবু, আমি আর প্রমথ চা খাচ্ছি। একেনবউদি ভেতরে গেছেন, একেনবাবু ঝালমুড়ির বায়না তুলেছেন বলে।

প্রমথর মুখ পত্রিকার আড়ালে, কিন্তু মাঝেমাঝেই বাক্যবাণ ছাড়ছে।

“আপনি মশাই যা-তা, এত খাবার সামনে, তাও ঝালমুড়ির জন্য পোঁ ধরলেন, দেখুন তো বউদিকে আবার ছুটতে হল!”

“আসলে স্যার, আপনারা আসেন, তাই এই শনি-রবিটা ভালো করে খাই।”

“আর অন্যদিন বউদি আপনাকে কিছু খেতে দেন না?”

“তা নয় স্যার।”

“তাহলে?”

“আপনার সঙ্গে স্যার কথায় পারা মুশকিল।”

ঠিক সেই সময়ে একেনবউদি এক বাটি ঝালমুড়ি নিয়ে ঢুকলেন।

“কি ভাই, এত মন দিয়ে কী পড়ছেন?” প্রমথকে প্রশ্ন করলেন একেনবউদি।

এইবার প্রমথ কাগজটা নামাল।

 “দেখছিলাম বউদি, একেনবাবুকে কোনো কাজে লাগাতে পারি কিনা, নইলে তো আপনাকে সারাদিন জ্বালিয়ে মারবেন।”

“কিছু পেলেন?” মুখ টিপে হেসে একেনবউদি জিজ্ঞেস করলেন।

 “একটা কেস আছে, কিন্তু সিম্পল চুরির কেস, একেনবাবুর মন ভরবে না।”

“তবু শুনি না।”

“সতীশ মিত্রের অফিসে চুরি।”

“সতীশ মিত্র, মানে উকিল সতীশ মিত্র? গড়িয়াহাটে যাঁর বিশাল বাড়ি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“ঠিক। ওঁর অফিস থেকে নানান ফাইলপত্তর চুরি হয়েছে।”

“দেখি,” বলে আমি প্রমথর হাত থেকে কাগজটা ছিনিয়ে নিলাম। সতীশ মিত্রের নাম বেশ কিছুদিন হল খবরের কাগজে খুব বেরোচ্ছে। শাসকদলের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলায় তিনিই প্রধান উকিল।

দেখলাম, ইতিমধ্যেই রাজনীতির খেলা শুরু হয়েছে। বিরোধী নেতারা বলছে যে, এটা সাধারণ চুরি নয়, মামলার দরকারি নথিপত্র চুরি করার জন্যই শাসকদল এটা করিয়েছে। পুলিশের বক্তব্য দেরাজ একটা ভাঙা হয়েছে বটে, কিন্তু বিশেষ কিছু খোয়া যায়নি, কারণ তার আগেই বাড়ির কাজের লোক আওয়াজ পেয়ে উপর থেকে নেমে আসায়, চোর পালিয়েছে।

 “এই নিয়ে এখন বন্ধ না হলে বাঁচি,” আমি বললাম। হলে কাল আমাদের দীঘা যাওয়া মাটি।

বলতে ভুলে গেছি, আমরা অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম দিন কয়েকের জন্য দীঘায় যাব। রোববার সকালে রওনা দেবার কথা।

“তুই একটা ইডিয়ট,” প্রমথ বলল। “রবিবার কখনো বন্ধ হয়, তাহলে ফায়দাটা কোথায়? বন্ধ হলে সোমবার বা শুক্রবার। আমরা যাচ্ছি রোববার, ফিরছি মঙ্গলবার, সুতরাং সেফ।”

বন্ধ-এর কথায় একেনবাবু উত্তেজিত হলেন। ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠে টিভিটা চালালেন। টিভি-তে অবশ্য এ নিয়ে কিছুই শুনলাম না। মিনিট দশেক পঞ্চায়েতের ইলেকশন নিয়ে নানান বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা শোনার পর প্রমথ দুত্তোর বলে উঠে টিভিটা বন্ধ করল।

এমন সময়ে বাইরের দরজায় বেল। একেনবাবুর বাড়ির কাজের মেয়ে নমিতা এসে খবর দিল, এক ভদ্রলোক একেনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চান, খুব জরুরি।

“দেখো, আবার কী ঝামেলা এল,” বলে একেনবউদি ভেতরে চলে গেলেন।

.

০২.

একটু বাদে লাঠি হাতে একটু কুঁজো হয়ে যে ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন তাঁর বয়স ষাট পঁয়ষট্টি হবে। দেখে মনে হয় শৌখিন লোক। কাঁচাপাকা চুল, গায়ে কাজ-করা সবুজ সিল্কের দামি পাঞ্জাবি। চোখে গোল্ড রিমের হাই পাওয়ারের চশমা, তাও দেখতে বোধহয় একটু কষ্ট হচ্ছে। আমাদের তিন জনকে দেখে বললেন, “আমি একটু একেনবাবুর সঙ্গে কথা বলব।”

প্রমথ সামনে ছিল, একেনবাবুকে দেখিয়ে বলল, “ইনিই একেনবাবু।”

“আপনি!” ভদ্রলোকের কথার সুরে বিস্ময়, সংশয়, নিরাশা ইত্যাদি অনুভূতিগুলির মিশ্রণ। এতে এখন আর অবাক হই না, একেনবাবুও মনে হয় মজাই পান।

আগন্তুকের বিস্ময়সূচক ‘আপনি’-র উত্তরে বললেন, “হ্যাঁ স্যার, বসুন, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?”

ভদ্রলোক ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। তারপর পকেট থেকে একটা নোটের বান্ডিল বার করে একেনবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এটা রাখুন।”

ভদ্রলোকের মাথায় নিশ্চয় গোলমাল আছে, নইলে এভাবে কোনো কথাবার্তা না বলে, কেউ টাকা এগিয়ে দিতে পারে! না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

“এটা?”

“কুড়ি হাজার আছে, অ্যাডভান্স।”

“তা-তো বুঝলাম স্যার, কিন্তু কাজটা কী?”

“আমার খুনিকে আপনাকে খুঁজে বার করতে হবে।”

 লোকটা যে সম্পূর্ণ উন্মাদ, সে বিষয়ে এবার আর সন্দেহ রইল না।

একেনবাবু মাথাটা একটু চুলকে বললেন, “আমি একটু কনফিউসড স্যার, আপনার খুনিকে খুঁজে বার করব!”

“ঠিকই শুনেছেন।”

“কিন্তু আপনি তো বেঁচে আছেন স্যার!”

“এখনও আছি, কিন্তু বেশিদিন থাকব না।” প্রমথ আর চুপ করে থাকতে পারল না। বলল, “একদিন তো আমরা সবাই মরব।” ভদ্রলোক প্রমথর দিকে একটা চকিত অবজ্ঞা-দৃষ্টি দিয়ে একেনবাবুকে বললেন, “আমাকে খুন করার চেষ্টা চলছে আমি জানি। পুলিশের উপর আমার ভরসা নেই, খুনই হয়তো হব। তাই আগে থেকেই তদন্তের ভারটা আপনাকে দিয়ে যেতে চাই।”

“কারা চেষ্টা চালাচ্ছেন স্যার, মানে আপনাকে খুন করার?”

“সেটা জানলে আর আপনার সাহায্য চাইছি কেন?” ভদ্রলোকের গলায় বিরক্তি ঝরে পড়ল।

“এবার বুঝলাম স্যার। আপনি জানেন খুন করার চেষ্টা চলছে, কিন্তু ঠিক কারা চালাচ্ছে সেটা জানেন না।”

“এক্সাক্টলি।”

“কিন্তু কীভাবে বুঝলেন স্যার, আপনাকে খুন করার চেষ্টা চলছে?”

উত্তরে ভদ্রলোক একটা বড়ো সাদা খাম এগিয়ে দিলেন।

 “পড়ুন।”

খামের মধ্যে তিনটে চিঠি। চিঠির উপর এক নম্বর, দু-নম্বর আর তিন নম্বর লেখা।

সাদা কাগজে কালো কালিতে লেখা প্রথম চিঠিটা:

শ্যামল দত্ত: তোমার পাপের শাস্তির দিন রবিবার রাত্রে….

 ব্যাস আর কিছু নয়।

দ্বিতীয় চিঠিটাও একই ভাবে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা।

শ্যামল দত্ত: দানধ্যানে প্রায়শ্চিত্ত হয় না, পাপের শাস্তি পেতেই হবে, অন্তিম দিনের জন্য প্রস্তুত হও– এই রবিবার।…

তৃতীয় চিঠিটা, কম্পিউটারে ছাপানো। কোনো সম্বোধন নেই। শুধু লেখা: রবিবারই শেষ রজনী। — ব্যাস আর কিছু নেই।

আমরা যখন চিঠিটা পড়ছি, ভদ্রলোক বললেন, “প্রথম চিঠিটা আমার লেটার বক্সে কেউ রেখে গিয়েছিল ঠিক ছ’দিন আগে। পরের চিঠিটা তিনদিন আগে, সেটাও ছিল লেটার বক্সে। শেষ চিঠিটা পেয়েছি কাল রাতে। বিগ বাজারে গিয়েছিলাম, কেউ আমার গাড়ির মধ্যে রেখে গিয়েছিল।”

চিঠিটা উলটেপালটে দেখে একেনবাবু বললেন, “আপনি স্যার শ্যামল দত্ত?”

ভদ্রলোক নিঃসন্দেহে শ্যামল দত্ত, কিন্তু তাও একেনবাবুর প্রশ্নটা করা চাই। এইজন্যেই প্রমথ একেনবাবুকে তুলোধোনা করে। বলে, “একটা সিম্পল জিনিস আপনার মাথায় ঢুকতে দু-ঘণ্টা লেগে যায়, আবার মোস্ট কমপ্লেক্স প্রব্লেম আপনি সলভ করেন, আপনি মশাই বিধাতার এক অদ্ভুত সৃষ্টি!

প্রশ্নটা শুনে ভদ্রলোক মনে হল একটু বিরক্তই হলেন। কী জানি বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে বললেন, “হ্যাঁ।”

“পাপের শাস্তি…” একেনবাবু আস্তে আস্তে আবার পড়লেন, তারপর ঘাড় চুলকে বললেন, “এটার অর্থ কী? কী পাপ? বুঝতে পারছেন কিছু স্যার?”

“না, অন্তত জ্ঞানত কোনো পাপ-কাজ করেছি বলে তো জানি না।”

“পুলিশকে স্যার চিঠিগুলোর কথা জানিয়েছেন?”

“ওদের জানিয়ে কিছু লাভ হয়?” ভদ্রলোক এবার একটু উত্তেজিত হলেন। “প্রথম চিঠিটা পেয়ে ভেবেছিলাম কেউ ফাজলামি করছে। কিন্তু দ্বিতীয় চিঠিটা পেয়ে একটু দুশ্চিন্তা হল। থানায় গিয়েছিলাম। ডিউটি অফিসার যিনি ছিলেন, পাত্তাই দিলেন না। বললেন, ‘মশাই, এসব ফালতু জিনিস নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আমাদের নেই। আমি বললাম, ‘এ-রকম হুমকি দেওয়া চিঠিকে আপনি ফালতু বলছেন? উনি ঠাট্টা করলেন, “নিশ্চয় পুজোয় চাঁদা-টাদা দেননি, তাই ক্লাবের ছেলেরা পেছনে লেগেছে।

“আমি দু-হাজার টাকা চাঁদা দিই পুজোয়, কিন্তু লোকটার সঙ্গে এ নিয়ে কিছু বলতে প্রবৃত্তি হল না। তারপর এই তৃতীয় চিঠি। আমি এখন শিওর ব্যাপারটা সত্যিই সিরিয়াস। ক’দিন আগে পত্রিকায় আপনার কথা পড়েছিলাম, নিউ ইয়র্কের নানান মার্ডার মিস্ট্রি সলভ করে আপনি কলকাতায় ফিরে এসেছেন। তাই সোজা আপনার কাছে চলে এলাম।”

“কিন্তু পুলিশ হয়তো ভুল বলেনি স্যার, হতে পারে কেউ স্রেফ আপনাকে ভয় দেখিয়ে মজা পাচ্ছে। হত্যার হুমকি দিয়ে যদি কেউ টাকা চাইত, তাহলে অবশ্য দুশ্চিন্তার কারণ থাকত।”

কথাটা শ্যামলবাবুর মোটেই মনঃপূত হল না। গলাটা একটু চড়িয়েই বললেন, “শুধু লেটার বক্সে চিঠিগুলো পেলে হয়তো কথাটা মানতাম, কিন্তু শেষ চিঠিটা পেয়েছি গাড়িতে, তার মানে আমার অজান্তে কেউ আমার পেছনে ঘুরছে। সেটা শুধু স্রেফ মজা করার জন্য?”

“সেটাই একটু স্ট্রেঞ্জ স্যার, মানছি। আপনার ড্রাইভার কাউকে দেখেনি?”

“সে ব্যাটা এক দেশওয়ালির সঙ্গে বসে খইনি খাচ্ছিল। গাড়ির দরজাও লক করেনি। যদিও আমি বার বার ওকে বলেছি, গাড়ি লক না করে দূরে কোথাও যাবি না। কিন্তু কে কার কথা শোনে!”

“কতদিন আপনার চাকরি করছে ড্রাইভারটি?”

“কাজ করেছিল বহুকাল। ইদানীং নেশাভাঙ করে কাজে ফাঁকি দিচ্ছিল, ধমক-ধামকে কাজ হচ্ছিল না। কিন্তু এই ঘটনার পর ওকে তাড়িয়েছি, আমারই খাবে, অথচ হুকুম মানবে না, এটা তো বরদাস্ত করতে পারি না।”

“তা তো বটেই স্যার। কিন্তু, চিঠিটা বিগ বাজারেই আপনার গাড়িতে কেউ রেখেছিল, সেটা কী করে বুঝলেন?”

“কারণ বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ে সেটা ছিল না।”

“আপনি শিওর স্যার?”

“হ্যাঁ। আমার সিটের উপর ওটা পড়েছিল।”

“কিন্তু বাড়িতে যখন গাড়িতে উঠলেন, তখন তো অন্যমনস্ক হয়ে চিঠির উপরেও বসতে পারেন।”

“আপনি আমায় বিশ্বাস করছেন না?” ভদ্রলোক একটু বিরক্ত হয়ে বললেন।

“না স্যার, অবিশ্বাসের কোনো ব্যাপার নয়। আসলে এই তিন নম্বর চিঠিটার কাগজটা একটু দোমড়ানো-মোচড়ানো, তাই প্রশ্নটা মনে এল।”

ভদ্রলোক একটু যেন থতমত খেলেন। তারপর উত্তেজিত হয়ে বললেন, “না, আমার পরিষ্কার মনে আছে ওঠার সময়ে সিটে কিছু ছিল না।”

এই সামান্য প্রশ্নে এত উত্তেজিত হবার কি আছে বুঝলাম না। তবে লোকটা খ্যাপা, সুতরাং নর্মাল লজিকে ওঁর ব্যবহার ব্যাখ্যা করা যায় না।

“তাহলে স্যার ছিল না,” একেনবাবু বললেন।

“আপনার কথার ধরন দেখে মনে হচ্ছে যে, আপনিও ওই পুলিশের মতো আমার চিন্তাটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। আপনি কেসটা নেবেন কিনা, বলুন!”

“কী মুশকিল স্যার, নেব না তো বলিনি। কিন্তু…”

““কিন্তু কী?”

“ধরুন স্যার, কিছুই যদি না ঘটে।”

একেনবাবু কী বলতে চাচ্ছেন শ্যামল দত্ত মনে হয় আঁচ করলেন। বললেন, “অর্থাৎ আমি যদি না মরি, তাই তো? এই টাকা আমি আর ফেরত চাইব না। এটা কনসাল্টেশন ফি হিসেবে রাখবেন। তাতে আপনার আপত্তি আছে?”

“সে কি স্যার, আপত্তি কেন থাকবে! ঠিক আছে স্যার, আপনার এই কেসটা নিচ্ছি।”

“থ্যাঙ্ক ইউ।” ভদ্রলোক মনে হল একটু স্বস্তি পেয়ে আরাম করে বসলেন।

একেনবাবু চিঠিগুলোতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে প্রশ্ন করলেন, “আপনার কোনো শত্রু আছেন যিনি আপনার মৃত্যু চান?”

“দেখুন, আমি ব্যবসায়ী, অনেকের সঙ্গে আমার লেনদেন, তাতে দু-একজন নিশ্চয় আমার উপর সন্তুষ্ট নয়। তাদের কেউ কেউ আমার মৃত্যু কামনা করতেই পারে, কিন্তু খুন করতে চাইবে বলে তো আমার মনে হয় না।”

“এই কেউ কেউ-রা কারা?

শ্যমলবাবু চুপ করে খানিকক্ষণ ভাবলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “না, অকারণে কাউকে আমি জড়াতে চাই না।”

“আপনার কোনো বিজনেস পার্টনার আছেন?”

“বেশির ভাগ বিজনেসেরই আমি সোল প্রোপ্রাইটার। দুটো পার্টনারশিপ ব্যবসা আছে। একজন পার্টনার হলেন, শিবদাসবাবু– শিবদাস রায়। দ্বিতীয়জন হলেন, শৈবাল চৌধুরী।” নামদুটো বলে শ্যামলবাবু যোগ করলেন, “দু-জনেই অ্যাবাভ এনি সাসপিশন।”

“আই সি। আচ্ছা স্যার, আপনি মারা গেলে আপনার সম্পত্তি কে পাবে?”

ভদ্রলোক এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। “আমি অবিবাহিত, থাকার মধ্যে আছে আমার এক ভাইপো। দাদা মারা যাবার পরে ছোঁড়াটার সঙ্গে আমার যোগাযোগ বেশি নেই। পড়াশুনো ছেড়ে একটা যাত্রা না নাটকের দলে ঢুকে একেবারে বখে গেছে। আর আছে আমার একটি বিশ্বস্ত অনুচর বিনয়। বিনয় প্রায় আটবছর আমার কাছে আছে। আমিই ওকে কলেজে পড়িয়েছি। এখন আমার কাজকর্ম দেখাশোনা করে। আমার সম্পত্তি আমি বিনয়কে উইল করে দিয়েছি। তবে ভাইপোকে বঞ্চিত করিনি, লাখ দুয়েক টাকা ওর জন্যেও রেখেছি।”

“আপনার উইলের কথা কি স্যার আপনার ভাইপো আর বিনয় জানেন?”

“আলবাত জানে, লুকিয়ে আমি কোনো কাজ করি না। তবে…” কিছু একটা বলতে গিয়ে শ্যামল দত্ত হঠাৎ চুপ করে গেলেন।

“তবে কী স্যার?”

“ভাবছি এটা ঠিক হল কিনা?”

“কোনটে স্যার?”

“মানে এই উইলটা। ভাইপোটা যত নচ্ছারই হোক, যে-দাদা আমাকে মানুষ করেছে। তারই একমাত্র ছেলে। আমার চেনা-জানা দু-একজন বলছেন বিনয়কে সব কিছু উইল করে দেওয়াটা বিবেচনার কাজ নয়। আপনার কী মনে হয়?”

শ্যামলবাবুর কথা যত শুনছিলাম, ততই অবাক হচ্ছিলাম। উইল করে সেটা ঠিক করেছেন কিনা সেই নিয়ে সম্পূর্ণ অপরিচিতর সামনে স্বগতোক্তি করা, আবার তার মতামত নেওয়া!

“উইল তো স্যার আপনার ইচ্ছে, যা চান তাই করবেন।”

“ঠিক, আর বিনয় চমৎকার ছেলে।”

“বিনয়কে আপনি কতদিন চেনেন?”

“ওই যে বললাম, আট বছর।”

“আপনার কাছে আসার আগে বিনয়বাবু কোথায় থাকতেন?”

“একটা অনাথ আশ্রমে। সেখানে যখন ওর সঙ্গে আমার দেখা হয় তখন ও স্কুল ফাইনাল দিচ্ছে। ওকে দেখে আমার ভালো লেগে গেল। আশ্রমের মেট্রনের সঙ্গে কথা বলে ওকে আমি নিয়ে আসি।”

“বিনয়ের বাবা-মা নেই?”

“মা ছিল। বাপের কথা কেউ জানে না। আমার সঙ্গে ওর দেখা হবার কিছুদিন আগে ওর মা মারা যায়।”

“ওঁর অন্য কোনো আত্মীয়স্বজন নেই?”

“না। কিন্তু বিনয় সম্পর্কে এত প্রশ্ন করছেন কেন, আপনি কি বিনয়কে সন্দেহ করছেন? হি ইজ এ ফাইন বয়।”

“কী মুশকিল স্যার, কিছুই তো ঘটেনি, সন্দেহ করার কি আছে!”

“কিন্তু তাও তো ওকে নিয়ে প্রশ্ন করছেন!” শ্যামলবাবু নিজের অসন্তোষ আর চাপলেন না।

“ঠিক আছে স্যার, করব না। তবে একটা কথা, আপনার মনে যখন খুন হওয়া নিয়ে একটা খটকা লেগেছে, আপনি কোনো সিকিউরিটি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করুন। একজন বডি গার্ড নিয়ে ঘুরুন কিছুদিন।”

শ্যামলবাবুর কথাটা বোধহয় মনঃপূত হল। “আমিও সেটাই ভাবছিলাম। আচ্ছা চলি।” বলে উঠে যাবার উদ্যোগ করলেন।

“এই চিঠি তিনটে আমি রেখে দিতে পারি স্যার?”

“নিশ্চয়।”

“দাঁড়ান, স্যার, একটা রসিদ দিয়ে দিই।”

“কীসের রসিদ? এই চিঠি তিনটের জন্য!”

“না স্যার, এই যে টাকাটা দিলেন তার।”

“সিদ নিয়ে আমি কী করব! শুধু কাজটা মনে করে করবেন।”

“কী যে বলেন স্যার, দীর্ঘদিন বাঁচবেন আপনি। আপনার লাঠিটা ফেলে যাচ্ছেন স্যার।”

“থ্যাঙ্ক ইউ,” বলে ভদ্রলোক লাঠিটা তুলে নিলেন। “ও, হ্যাঁ,” পকেট থেকে একটা কাগজ বার করলেন শ্যামলবাবু, “আমার উকিলের ঠিকানা আর ফোন নম্বর। ওঁকে আমি বলে যাব আমি বেঁচে থাকি বা না-থাকি আপনার সব খরচাপাতি যেন উনি দিয়ে দেন।”

একেনবাবুকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে শ্যামল দত্ত চলে গেলেন।

একেনবাবুর কাছ থেকে শ্যামল দত্তের দেওয়া কাগজে উকিলের নামটা দেখলাম। সতীশ মিত্র। নীচে বাড়ির ঠিকানা আর ফোন নম্বর। আর কিছু লেখা নেই।

“সতীশ মিত্র! এর অফিসে চুরি হবার খবরই তো সেদিন পত্রিকায় দেখলাম!” আমি বলে উঠলাম।

“তাই তো দেখছি স্যার।”

“বাঃ, এতো চমৎকার যোগাযোগ!” প্রমথ বলল, “এই ছুতোয় উকিল মশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে, তার চুরির ব্যাপারটারও ফয়সল্লা করুন। আরও টু-পাইস ঘরে আসবে।”

“কী যে বলেন স্যার!”

“ভুলটা কী বললাম মশাই? ভালো কথা, এই শ্যামল দত্ত লোকটা মরুক-বাঁচুক, আই ডোন্ট কেয়ার, বিশ হাজার টাকা ফোকোটে পেয়েছেন… আজ রাতেই বউদিকে ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টে ভালোমন্দ খাওয়ান। চাইলে আমরাও যেতে পারি।”

“অত তাড়াহুড়ো করিস না,” আমি বললাম। “নোটগুলো জাল কিনা, সেটা আগে জানা দরকার। সমস্ত ব্যাপারটাই আমার কাছে রহস্যজনক লাগছে।”

একেনবাবু দেখলাম মন দিয়ে নোটগুলো পরীক্ষা করছেন। “না স্যার, জেনুইন জিনিসই মনে হচ্ছে।”

“তাহলে বউদিকে জানিয়ে দেওয়া যাক রান্নাবান্নার ঝামেলা আজ না করতে। কাল সকালেই তো আবার সবাই দীঘা রওনা দিচ্ছি! বউদি, বউদি!” বলে প্রমথ চিৎকার জুড়ল।

ও বলতে ভুলে গেছি, আমার আর প্রমথর এই দীর্ঘ যাত্রা একেনবাবুদের দশম বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে। একেনবাবুকে আমরাই জোর করেছিলাম বউদিকে নিয়ে দীঘায় যেতে, কিন্তু একেনবউদির ভীষণ লজ্জা! একেনবাবু আবার লজ্জাটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এই বলে, হিন্দু বিবাহ মতে ওঁদের বিয়েটা ঠিক সিদ্ধ নয়। সেটার বার্ষিকী উদ্যাপন করাটা একেবারেই ঠিক হবে না।

শুনে প্রমথ খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠেছিল, “কী আজেবাজে বকছেন! না কি এটা আপনার খরচ বাঁচাবার ফন্দি?”

“আরে না স্যার, কতই বা খরচ! আসলে আমার আর ও-র মধ্যে সম্পর্কটা সপিণ্ড।”

“সপিণ্ড-টা কী?”

“সপিণ্ড সম্পর্কের বিচার হয় স্যার মায়ের দিক থেকে তিন পুরুষ আর বাবার দিক থেকে পাঁচ পুরুষ ধরে। একজন যদি অন্যজনের সপিণ্ড সম্পর্কের কেউ হয়, অথবা তৃতীয় কেউ যদি দু-জনের সপিণ্ড সম্পর্কের পড়ে তাহলে বিয়েটা সিদ্ধ হয় না।”

“হোয়াট ননসেন্স, দক্ষিণভারতে তো মামা-ভাগ্নিতেও বিয়ে হচ্ছে।”

“ওটা স্যার লোকাচার, হিন্দু বিয়ের আইনে লোকাঁচারকে মানা হয়।”

“এইসব ফালতু জিনিস কোত্থেকে জানলেন?”

কী করব স্যার, এইসব আইনগুলো একটু জানতে হয়, পুলিশে কাজ করতাম না!”

“তাহলে আর কী করা, আপনার অসিদ্ধ বউকে নিয়েই দীঘাতে আনন্দ করে আসুন।” আমি বললাম।

কথাটা শুনে একেনবউদি লজ্জায় লাল হয়ে বললেন, “ওঁর কথা ছাড়ন তো! বিয়ের পর কোত্থেকে আবিষ্কার করেছে আমার ঠাকুরদা-র ঠাকুরদা নাকি ওঁরও ঠাকুরদা-র ঠাকুরদা।”

প্রমথ বলল, “বউদি, আমরা কি আপনার কর্তার কোনো কথায় কান দিই, ওঁর অর্ধেক জিনিসই তো বানানো।”

“তাহলে ভাই আপনারা দু-জন আমাদের সঙ্গে চলুন।”

.

০৩.

আমরা ছিলাম নিউ দীঘায়। জায়গাটা পুরোনো দীঘার চেয়ে পরিচ্ছন্ন, লোকজনও কম। তবে দীঘার সেই বিখ্যাত ঝাউবন এখন প্রায় নেই বললেই চলে। নীল সমুদ্রের বুকে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের বর্ণচ্ছটা দেখলাম মুগ্ধ হয়ে। একদিন কাছাকাছি কাননগড়ে অমরাবতীর কৃত্রিম লেকে বোটিং করে এলাম। একেনবাবুর মতো লোক যিনি কোথাও গেলে ঘ্যানঘ্যান করে মারেন, তিনিও একদিন বলে ফেললেন, “যাই বলুন স্যার, মাঝে মাঝে কলকাতার বাইরে এলে, শরীর-মন দুটোই ঝরঝরে হয়ে যায়। তবে খাবারটাই ট্রাবল দেয়।”

“তাই বলে বউদিকে দিয়ে রান্না করানোর ফ্যাচাং তুলবেন না!” প্রমথ একটু ধমকের সুরে বলল।

“কী যে বলেন স্যার, ও-ও তো রিল্যাক্স করতে এসেছে।”

“আপনার এই সূক্ষ্ম অনুভূতি এখনও আছে দেখে মোহিত হলাম।” প্রমথ কখনোই একেনবাবুর পেছনে না লেগে পারে না।

একেনবাবু অবশ্য এসব গায়ে মাখেন না।

.

মঙ্গলবার কলকাতায় এসে আমরা যখন পৌঁছোলাম, তখন প্রায় বিকেল পাঁচটা।

একেনবাবু বাড়িতে ঢোকামাত্র স্নান করতে ছুটলেন। একেনবউদি বললেন, “আপনারা ভাই সবাই আজ রাতের খাওয়া খেয়ে যাবেন।”

“আজকেই আবার রাঁধবেন বউদি?” প্রমথ বলল।

“দেখছিলেন তো বাইরের খাবার খেয়ে ওঁর অবস্থা!”

“আপনি বউদি বড় ইনডাজ করেন একেনবাবুকে, সেইজন্যেই মাথায় চড়ে বসেন।”

“ঠিক আছে ভাই, আর করব না,” বলে বউদি সস্নেহে প্রমথর তাকিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন।

আমি আর প্রমথ টেবিলের উপরে স্থূপাকৃত গত কয়েকদিনের পত্রিকাগুলো তুলে নিলাম।

দীঘাতে এ ক’দিন খবরের কাগজ পড়ার কোনো মুডই ছিল না। হোটেলে খাওয়া দাওয়া আর ঘুম ছাড়া সমুদ্রের বীচ-এ বসেই কাটিয়েছি। কলকাতা আছে কি নেই– ভুলে গিয়েছিলাম।

পত্রিকার প্রথম পাতাতেই আমার চোখ আটকে গেল।

বউবাজারের ধনী ব্যবসায়ী শ্যামল দত্তের সন্দেহজনক মৃত্যু!

আমি চেঁচিয়ে প্রমথকে বললাম, “কী সর্বনাশ প্রমথ, সেই ভদ্রলোক মারা গেছেন।”

আমি নামটাও বলিনি, কিন্তু প্রমথ বুঝল ঠিক। বলল, “বলিস কিরে –খুন?”

প্রমথ সামনের চেয়ার থেকে উঠে এসে আমার পাশে বসল।

 হেডিং-এর নীচে সংক্ষিপ্ত খবর।

শ্যামল দত্তর মৃতদেহ বাঘাযতীন স্টেশনের কাছে রেললাইনের ধারে রবিবার দুপুরে পাওয়া গেছে। আঘাতের চিহ্ন দেখে পুলিশ সন্দেহ করছে এটা আত্মহত্যা নাও হতে পারে। লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা চলছে। মৃত্যুর কারণ জানার জন্য ময়নাতদন্ত করা হচ্ছে।

ব্যাস আর কিছু নেই।

প্রমথ বলল, “মাই গড, ভদ্রলোকের সন্দেহ তাহলে ভুল নয়, আমরাই পাত্তা দিচ্ছিলাম না।”

একেনবাবু স্নান সেরে বেরোতেই আমরা পত্রিকাটা ওঁকে দিলাম।

একেনবাবু পত্রিকাটা পড়ে বললেন, “ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার!”

“কী করবেন এখন,” প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “আপনি তো কেসটা নিয়েছেন!”

“তা নিয়েছি স্যার, কিন্তু এটা যে আত্মহত্যা নয়, সেটা তো আমরা জানি না।”

“আপনি কী বলতে চান মশাই? রবিবার আমাকে কেউ খুন করবে বলে আপনাকে। ভাঁওতা দিয়ে ভদ্রলোক নিজে আত্মহত্যা করেছেন! উনি খ্যাপা, না আপনি খ্যাপা?”

“তা নয় স্যার। পুলিশ আগে ওদের কাজটা শেষ করুক। খুন প্রমাণিত হলে তো আমাকে কাজে লাগতেই হবে।”

“অর্থাৎ বউদির হাতের রান্না না খাওয়া পর্যন্ত আপনি কিছু করবেন না, এই তো?”

একেনবাবু আমার দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে ঘাড় নাড়াতে নাড়াতে বললেন, “প্রমথবাবু না স্যার, সত্যি!”

আমি প্রমথকে বললাম, “ওঁকে একটু সুস্থির হয়ে বসতে দিবি? এক্ষুনি না ছুটলেও তো চলে।”

“তোর মুণ্ডু,” বলে প্রমথ রান্নাঘরে গেল। বোধহয় চায়ের তদারক করতে।

প্রমথ যেতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী বুঝছেন?”

“ভেরি কনফিউসিং স্যার, ভেরি কনফিউসিং।”

.

চা খাবার পর একেনবাবু নিজেই পকেট থেকে মোবাইল বার করলেন। তাতে চার্জ নেই। তখন উঠে দেয়ালের পাশে রাখা টেলিফোন তুলে কাকে জানি ফোন করলেন। অন্যপক্ষের কথা বুঝতে পারছিলাম না, কিন্তু এটুকু বুঝলাম শ্যামল দত্তের মৃত্যু নিয়েই কথা হচ্ছে। এও বুঝলাম, যাঁর সঙ্গে কথা বলছেন, তিনি খুব একটা কো-অপারেটিভ নন। খানিকক্ষণ কথা বলার পর কিছুটা হতাশ হয়েই একেনবাবু চেয়ারে এসে বসলেন।

“কার সঙ্গে কথা বলছিলেন?”

একেনবাবু সোজাসুজি কথাটার উত্তর দিলেন না। বললেন, “রাখাল ছুটিতে, তাই একটা ঝামেলা।”

রাখালবাবু সি.আই.ডি-র লোক। এককালে একেনবাবুর কলিগ ও শাগরেদ দুই-ই ছিলেন।

“কেন, যে ফোন ধরল, সে আপনাকে চেনে না?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“চিনবে না কেন স্যার। তবে সবাই তো একরকম নয়।”

 এ নিয়ে আর কিছু জানা যাবে না, তাই প্রশ্ন করলাম না।

.

এ-রকম কোনো একটা ঘটনা ঘটলে, বিশেষ করে বাংলা পত্রিকায় বেশ কয়েকদিন ধরে খুব মাতামাতি হয়। তদন্ত কদুর এগিয়েছে তা নিয়ে অনেক খবরাখবর বেরোয়। তার কতটা সত্যি অবশ্যই একটা প্রশ্ন। আসলে এ ধরনের খবর পাবলিক খুব পছন্দ করে। কাগজে কিছু বেরোনো মানেই সেটা ধ্রুব-সত্য। সেই সত্য অনুসারে এটি হত্যাকাণ্ড। এর প্রত্যক্ষদর্শীও নাকি রয়েছে। এক রিক্সাওয়ালা নাকি একটি যুবককে দেখেছিল একজন বৃদ্ধকে ধরাধরি করে রেললাইনের ধার দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।… পাঠকরা ভাবতেও চায় না, এ ধরনের স্পর্শকাতর এবং গোপনীয় বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে পুলিশ রিপোর্টারদের এসব জানাবে কেন?

.

০৪.

পরদিন দুপুরে একেনবাবুর ফোন পেলাম। উনি আর প্রমথ উকিল সতীশ মিত্রের বাড়িতে সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ যাবেন, আমি আসব কিনা। ঠিক হল, গড়িয়াহাট মোড়ের কাছে পেট্রল পাম্পের সামনে ছ’টার একটু আগে আমি যাব, সেখানে উনি আর প্রমথ আমার জন্য অপেক্ষা করবেন।

সতীশ মিত্রের বাড়ি পেট্রল পাম্প থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। উনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শ্যামল দত্ত একেনবাবুকে ওঁর মৃত্যুর তদন্তের ভার দিয়ে গেছেন শুনে উনি তো অবাক! আমাদের দিকে এমন ভাবে তাকালেন, আমরা হয় উন্মাদ অথবা ওঁর সঙ্গে বদ-রসিকতা করতে এসেছি! যাইহোক, ভাগ্যক্রমে একেনবাবুর নামটা ওঁর কাছে অপরিচিত নয়। তাই ধৈর্য ধরে পুরো ব্যাপারটা শুনলেন। তারপর বললেন, শ্যামল দত্ত ওঁকে কোনো ইনস্ট্রাকশন দিয়ে যাননি। এও বললেন যে, শ্যামলদত্ত এঁকে দিয়ে তাঁর উইলটা করিয়েছিলেন বেশ কিছুদিন আগে।

“তাতে কি উনি ওঁর সমস্ত সম্পত্তি বিনয়বাবুকে দিয়ে গিয়েছেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“হতে পারে, আমার মনে নেই।” ওঁর সংক্ষিপ্ত উত্তর শুনে মনে হল, এ নিয়ে উনি আলোচনা করতে চান না।

“উইলটা কি আপনার কাছেই আছে স্যার?” একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

 “কেন বলুন তো?”

“না, মানে কয়েকদিন আগে আপনার এখানে একটা চুরি হয়েছিল, তাই ভাবলাম ওটা যদি চুরি হয়ে থাকে।”

“না, চুরি যায়নি। আর চুরিও এখান থেকে কিছু হয়নি। পত্রিকাগুলো তিলকে তাল করেছে। আর কিছু জানতে চান?”

“তাহলে উইলটা আপনার কাছেই আছে?”

“না, শ্যামলবাবু কিছুদিন আগে ওটা ফেরত নিয়ে গেছেন।”

“কেন স্যার?”

“তা বলতে পারব না। আমার জুনিয়ারকে ফোন করেছিলেন। এ বিষয়ে আমি আর কিছু জানি না। জুনিয়ারও জানে না, কারণ ওকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।”

“শ্যামলবাবু থাকতেন কোথায় স্যার?”

 সতীশ মিত্রের ভ্রু কুঞ্চিত হল। “কসবায়। আপনাদের ঠিকানা দেননি?”

“না স্যার, শুধু আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে গিয়েছেন।”

“স্ট্রেঞ্জ! যাক, আর কিছু জানতে চান?”

ভদ্রলোকের সময়ের দাম আছে, আর আমাদের জন্য সময় নষ্ট করতে চান না মনে হল।

“আচ্ছা স্যার, আসি।” একেনবাবু উঠে পড়লেন, সেই সঙ্গে আমরাও।

উকিল মশাইয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেসটা কী বলুন তো, শ্যামলবাবু পরিষ্কার বলে গেলেন যে সতীশ মিত্রের কাছে উনি তদন্তের জন্য যা টাকা লাগে রেখে যাবেন, অথচ সতীশ মিত্র বলছেন কিছুই জানেন না!”

“মনে হয় টাকাটা উকিল মশাই মেরে দিয়েছেন। যার টাকা তিনি তো আর খোঁজ নিতে আসবেন না।” প্রমথ সবকিছুই নেগেটিভলি দেখে।

“আরেকটা সম্ভাবনা হল,” আমি বললাম, “হয়তো সতীশ মিত্রকে ইনস্ট্রাকশন দেবার আগেই উনি খুন হয়েছেন।”

“কে জানে স্যার, একেনবাবু একটু অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, “তবে ডেফিনিটলি কনফিউসিং।”

“আপনি কিছু একটা ভাবছেন,” প্রমথ একেনবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল।

 “তা একটু ভাবছি স্যার।”

“ঝেড়ে কাশুন না, আপনার ভাবনাটা আমাদেরও একটু ভাবতে দিন।”

“আজ সকালে রাখালকে ধরতে পেরেছি, কাজে জয়েন করেছে। ওর কাছে শুনলাম পুলিশ শ্যামলবাবুর মৃত্যুটা আত্মহত্যা বলেই ভাবছে।”

“আত্মহত্যা!”

“তাই তো বলল, স্যার।”

“তাই যদি হবে, তাহলে ভদ্রলোক আমাদের কাছে খুন হতে যাচ্ছেন কাহিনি ফাঁদলেন কেন? বিশ হাজার টাকাই বা দিলেন কেন? মেকস নো সেন্স!”

“সেটাই তো কনফিউসিং স্যার।”

 আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আত্মহত্যা সন্দেহ করার কারণটা কী?”

“মারা যাবার কিছু আগে তিনি একটা এস.এম.এস পাঠিয়েছিলেন, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়’ বলে।”

“কাকে পাঠিয়েছিলেন?”

“বিনয়বাবুকে।”

“বিনয়? মানে যাকে উনি ওঁর সম্পত্তি দিয়ে গেছেন!”

“ঠিক স্যার।”

“এস.এম.এস-টা যে উনিই করেছেন তার প্রমাণ কী?”

“শ্যামলবাবুর ফোন থেকেই করা হয়েছে স্যার।”

“তা বুঝলাম,” প্রমথ বলল, “কিন্তু কেউ তো ওকে খুন করেও ওঁর ফোন থেকে এস.এম.এস করতে পারে। পারে না?”

“তা পারে স্যার।”

“তাহলে?”

“পুলিশের কাছে খবর উনি প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসারে ভুগছিলেন, ডাক্তাররা ওঁকে তিনমাসের মতো সময় দিয়েছিল। মৃত্যুকে বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারতেন না, তার ওপর ক্যানসারের যন্ত্রণা!”

আমি আর প্রমথ চুপ করে রইলাম। পুলিশের চিন্তাটা অযৌক্তিক নয়, কিন্তু এক্ষেত্রে শ্যামলবাবুর আমাদের কাছে এসে ওই সব বলার ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না।

একেনবাবু আস্তে আস্তে বললেন, “যে লোকটা কয়েক মাসের মধ্যেই মারা যাচ্ছে, তাকে কেউ খুন করতে চাইবে কেন? কী লাভ?”

“হয়তো যে খুন করেছে খবরটা জানত না। অথবা, এটা আপনার সেই আইডিয়াল জুয়েলরির কাফলিংক-এর কেসের মতো… খুন করা হয়েছে সম্পূর্ণ অন্য একটা কারণে।” আমি বললাম।

“হতে পারে স্যার।”

“আবার নাও হতে পারে, প্রমথ বলল। “পুলিশ এক্ষেত্রে হয়তো ঠিকই বলছে– এটা পিওর এন্ড সিম্পল কেস অফ সুইসাইড। যদিও তাতে একেনবাবুর ক্ষতি।”

“তার মানে?”

“ওঁর ফি-টা মাঠে মারা যাবে।”

“ফি-টা দিচ্ছে কে? দেবার তো কোনো লোক নেই। কী মশাই, চুপ করে আছেন কেন?”

“কী আর বলব স্যার,” বলে একেনবাবু মুখে কুলুপ আঁটলেন।

.

০৫.

শ্যামল দত্তর মৃত্যু নিয়ে হয়তো আমরা কেউই আর মাথা ঘামাতাম না, যদি না হঠাৎ শিবদাস রায় বলে এক ভদ্রলোক বৃহস্পতিবার সকালে আমাদের আড্ডায় এসে হাজির হতেন। শিবদাস রায় নামটা চেনা চেনা কেন লাগছিল সেটা পরিষ্কার হল যখন জানলাম উনি শ্যামলবাবুর বিজনেস পার্টনার ছিলেন। শিবদাসবাবু জানালেন, শ্যামলবাবু ওঁকে বলে গিয়েছেন, যদি কোনো কারণে ওঁর হঠাৎ মৃত্যু হয়, তার তদন্তের জন্য যা খরচাপাতি লাগে একেনবাবুকে যেন দেন।

যাক, একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, শ্যামলবাবু অন্তত একজনকে একেনবাবুকে কাজে নিযুক্ত করার কথাটা জানিয়েছেন।

শিবদাসবাবুও দেখলাম সমস্ত ব্যাপারটাতে বেশ কনফিউসড। কেন শ্যামলবাবু খুন হবেন বলে ভয় পাচ্ছিলেন শিবদাসবাবু জানতেন না। শ্যামলবাবুকে জিজ্ঞেসও করেছিলেন মৃত্যু নিয়ে তদন্ত করতে হবে কেন! সন্তোষজনক কোনো উত্তর পাননি। শিবদাসবাবু জানতেনও না শ্যামলবাবুর ক্যানসারের কথা! জেনেছেন বিনয়ের কাছ থেকে শ্যামলবাবুর মৃত্যুর পর। একেনবাবুর কাছে উনি এসেছেন ওঁর পার্টনার ও বন্ধুর অনুরোধ রক্ষা করতে। তবে শিবদাসবাবুর কাছ থেকে জানতে পারা গেল শ্যামলবাবু উইল করে ভাইপো সত্যব্রতর জন্য দু-লাখ টাকা ছাড়া পুরো সম্পত্তিই বিনয়কে দিয়ে গেছেন।

“উনি কি ওঁর উইল পালটাবার কথা ভেবেছিলেন?”

সঠিক উত্তর শিবদাসবাবু দিতে পারলেন না। তবে বললেন, “ভাইপোর ভাগটা একটু বাড়াবার কথা বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিল। যেদিন মারা যায়, তার দিন দুই আগে বলেছিল নতুন একটা উইল করেছে বা করছে। খুব মন দিয়ে কথাটা শুনিনি, জোর করে বলতে পারব ন। করে থাকলে ওঁর উকিল সতীশ মিত্র জানবেন।”

একেনবাবু বললেন, “সতীশ মিত্র কিন্তু সে-রকম কিছু বলেননি।”

“তাহলে হয়তো করছি’ বলেছিল, শেষ পর্যন্ত করেনি।”

“উইল করতে তো উকিল লাগে না, দু-জন সাক্ষী থাকলেই যথেষ্ট, প্রমথ গম্ভীর ভাবে বলল।

“তাই নাকি? রেজিস্ট্রি-টেজিস্ট্রি করতে হয় না?” শিবদাসবাবু প্রশ্ন করলেন।

বিজ্ঞের মতো সাক্ষীর কথাটা বললেও প্রমথও নিশ্চয় জানে না। জানলে প্রশ্নের উত্তরে নির্বাক হয়ে থাকার পাত্র সে নয়!

যাইহোক, শিবদাসবাবু একেনবাবুকে বললেন, তদন্তের কাজে টাকা যা প্রয়োজন ওঁকে জানাতে। বিশ হাজার টাকার অ্যাডভান্স দেওয়ার কথা উনি জানেন। সেটা শেষ হলেই উনি আবার কিছু অ্যাডভান্স করে যাবেন।

এখন পর্যন্ত একবার উকিল সতীশ মিত্রের বাড়ি যাওয়া আর দুয়েকটা ফোন কল ছাড়া আর বিশেষ কিছুই করা হয়নি। সুতরাং আবার আগাম টাকা নেবার প্রশ্ন নেই।

শিবদাসবাবুর কাছ থেকে বিনয়বাবুর ফোন নম্বর আর ঠিকানাটা সংগ্রহ করা গেল। সত্যব্রতর ঠিকানাটা ওঁর জানা নেই। তবে জেনে যত তাড়াতাড়ি পারেন জানিয়ে দেবেন বললেন। শ্যামলবাবুর আর এক বিজনেস পার্টনার শৈবাল চৌধুরী আবার শিবদাসবাবুর বন্ধু। ওঁর ঠিকানা আর ফোন নম্বরও শিবদাসবাবুর কাছ থেকে পাওয়া গেল।

“ভালোকথা স্যার, ওঁর ডাক্তার কে ছিলেন?”

“ওর নানান সমস্যা ছিল, অনেকের কাছেই যেত। সবার নাম বলতে পারব না। তবে ছোটোখাটো অসুখে আমি আর ও দু-জনেই ডাক্তার অমল সেন-এর কাছে যেতাম।”

এক অমল সেনের চেম্বার আমি দেখেছি, দেশপ্রিয় পার্কের কাছে শরৎ বসু রোডের উপর।

“ঘাঁর চেম্বার শরৎ বসু রোডে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 “হ্যাঁ, উনিই।”

“সবার ঠিকানাই তো দিলেন স্যার, এবার আসল লোকের ঠিকানাটা দিন।”

“আসল লোক! ও..” ভদ্রলোক এবার বুঝতে পারলেন, “এই নিন আমার কার্ড। এতে আমার মোবাইলের নম্বরও আছে। যখন দরকার মোবাইলেই করবেন, নইলে আমাকে ধরা মুশকিল।”

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।” শিবদাসবাবু যখন চলে যাচ্ছেন, একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা স্যার, আপনার সঙ্গে শ্যামলবাবুর শেষ দেখা কবে হয়?”

শিবদাসবাবুকে একটু ভাবতে হল, “তা প্রায় দিন পনেরো আগে।”

“তখনই আপনাকে আমার কথা বলেছিলেন?

“না না, আপনার কথা বলেছিলেন ফোনে, এই কয়েকদিন আগে। আসলে ওর শরীরটা খুব ভালো যাচ্ছিল না। নইলে আগে প্রায় প্রতিদিনই আমাদের দেখা হত। অফিসে আসত নিয়মিত।”

“ঠিক আছে স্যার, আপনাকে আর আটকাব না।”

.

শিবদাসবাবু চলে যাবার পর একেনবাবু দেখি চোখ বুজে ঘন ঘন পা নাচাচ্ছেন।

একেনবাবুর চিন্তা শুরু হলে ঘন ঘন পা নাচানো সুরু হয়। প্রমথ ওঁকে বহুবার বলেছে, ‘এই বিশ্রি হ্যাবিটটা ছাড়ন তো মশাই।’

একেনবাবু প্রতিবারই করুণভাবে বলেছেন, “কী করব স্যার, আপনা-আপনিই নাচে।

“ননসেন্স! এগুলো হচ্ছে ভলান্টারি মাসল, আপনা-আপনি নাচলেই হল!’

তাতে ক্ষণকালের জন্য নাচানি থেমেছে ঠিকই, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার নবোদ্যমে শুরু হয়েছে। প্রমথ যে প্রমথ, সেও এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। পৃথিবীতে নাকি কিছু কিছু লোক আছে যাদের মানুষ করা সম্ভব নয়।

আমি একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী ভাবছেন বলুন তো?”

একেনবাবু পা নাচানি থামিয়ে বললেন, “একটু চা পেলে মন্দ হত না।”

“আপনারই তো বাড়ি মশাই এটা, বাপিকে বলছেন কেন!” তারপরেই হাঁক দিয়ে প্রমথ বলল, “বউদি, আপনার পতিদেবতার চা লাগবে।”

দূর থেকে উত্তর এল, “এই তো খেলেন।”

“এইসব দাম্পত্য খিটিমিটির মধ্যে আমাকে জড়াবেন না, আমি শুধু অনুরোধটা রিলে করছি।”

সহাস্য উত্তর এল, “আচ্ছা ভাই, সবাইকেই দিচ্ছি।”

একেনবউদির আবার প্রমথকে খুব পছন্দ। ওঁর ধারণা প্রমথর জন্যেই ওঁর কর্তা একটু সিধে থাকেন।

“চা তো আসছে, এবার বলুন কী ভাবছেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“স্টুয়ার্ট সাহেব সব সময়ে ওঁর লোকদের বলতেন, ফলো দ্য মানি ট্রেইল অথবা ফাইন্ড দ্য উওম্যান।”

“আপনার আস্পর্ধা তো কম নয় মশাই, বউদির করা চা খাচ্ছেন, আর বউদির জাতকে গালমন্দ করছেন! সব ক্রাইমের পেছনেই মেয়ে জড়িত, এটা একটা কথার কথা হল!” প্রমথ বলল।

“কী যে বলেন স্যার, এটা কি আমার কথা! স্টুয়ার্ট সাহেবের কথা। আর মেয়ে ছাড়া টাকার কথাটাও তো আছে।”

“শ্যামলবাবুর চেহারা দেখে তো মনে হল না খুব একটা উওম্যানাইজার বলে,” আমি বললাম। “কিন্তু টাকার ব্যাপার থাকতে পারে। বিনয় যদি আঁচ করে শ্যামলবাবু উইল পালটে ভাইপোকে একটা বড়ো অংশ দিতে চলেছেন, তাহলে সেটা উকিলের কাছে জমা পড়ার আগে শ্যামলবাবুকে সরিয়ে দেওয়াটা নিশ্চয় একটা সম্ভবনা।”

“তুই বলছিস বিনয়ই খুন করেছে?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

“আমি একটা পসিবিলিটির কথা ভাবছি। আপনি কী বলেন একেনবাবু?”

“অবশ্যই সেটা একটা সম্ভাবনা স্যার।”

একেনবাবু আমার কথায় সায় দিচ্ছেন দেখে আমি উৎসাহিত হলাম। বললাম, “শুধু সম্ভাবনা নয়, আমার মনে হচ্ছে এটাই ঘটেছে। নইলে যে লোকটা এমনিতেই তিন-চার মাস বাদে মারা যাচ্ছে, তাকে খুন করে কী লাভ? লাভটা এইখানে যে উনি তিন মাস বাঁচলে বিনয়বাবুর আর্থিক ক্ষতি।”

“তুই বলছিস, এস.এম.এস-টা বিনয়ই ওঁর মোবাইল থেকে করেছিল?”

“নিশ্চয়, পুলিশকে ধোঁকা দেবার জন্য যে এটা আত্মহত্যা।”

“দ্যাটস টু সিপ্লিস্টিক এন্ড অবভিয়াস!” প্রমথ আমাকে উড়িয়ে দিল। পুলিশ যদি এত সহজেই ধোঁকা খায়, তাহলে এদেশে কোনো খুনি ধরা পরবে না!” তারপর একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “আপনার চেলা রাখালবাবু কী বলেন?”

“আপনি স্যার বড় লজ্জা দেন, রাখাল আমার চেলা হবে কেন! তবে রাখাল আজ বিকেলে আসছে।”

“তাহলে আমরাও আসব। আপনার কোনো আপত্তি নেই তো?”

“শুনছেন স্যার, প্রমথবাবুর কথা। আপনারা আসবেন তার জন্য আবার পারমিশন লাগবে?”

Sujan Dasgupta ।। সুজন দাশগুপ্ত