৷৷ ২৬ ৷৷

বল্লভ শাহর কাহিনি কতটা সত্য আর কতটা বানানো সেটা ভাবার বিষয়। প্রমথ বাড়ি ফিরে সব কিছু শুনে ওর সুচিন্তিত মত দিল, “এটা একটা ইলাবোরেট মার্ডার প্লট। উনি ঠিক করেছিলেন রোহিত রয় আর দিলীপকে মারবেন। তার প্রিপারেশন করতেই শান্তিনিকেতনে একটা বাক্স চুরি করালেন। আর সেটা চুরি করালেন একটা মিস্ট্রিম্যানের জন্যে, যাকে কেউই চেনে না! দিস ইস ইনক্রেডিবল! বল্লভ শাহ কি এতই কাঁচা লোক যে কেউ ওঁকে একটা বাক্স নিয়ে আসতে বললেই উনি নিয়ে আসবেন? বাক্সটাতে তো ফলস বটম থাকতে পারত –স্মাগলাররা তো এইভাবেই হিরে-মুক্তো চালান করে।”

“ইউ হ্যাভ এ পয়েন্ট স্যার।”

“আরও দেখুন, এই ঘটনাটা যারা জানে, মানে এই মিস্ট্রিম্যানের ব্যাপারটা তারা কনভিনিয়েন্টলি কেউই বেঁচে নেই। সুতরাং তাদের প্রশ্ন করে এই গল্পের সত্যতা বার করা যাবে না।”

আমি বললাম, “দ্যাটস নট টোটালি ট্র্য, শরৎ না কে, সে তো আছে।”

“সেটাও বল্লভ শাহ ক্লিয়ার করে রেখেছেন, শরৎ উলটোপালটা বকে বলে।”

আমাকে মানতেই হবে প্রমথর কথাগুলো খুবই যুক্তিপূর্ণ।

একেনবাবুও বললেন, “আপনি স্যার সত্যি খুব ইনসাইটফুল কথা বলেন।” বলেই উঠে পড়লেন।

আমি বললাম, “কোথায় চললেন?”

“এই একটু ঘুরে আসি স্যার, স্টুয়ার্ট সাহেব ছুটি থেকে ফিরেছেন, একটু মুখ দেখিয়ে আসি। তারপর একটু লাইব্রেরিতেও যাব।”

“তাড়াতাড়ি ফিরবেন,” প্রমথ বলল। “আজকে কষা মাংস রাঁধব।”

“ওঃ, আপনি স্যার, সত্যি একজন মহাপুরুষ!” বলে একেনবাবু অদৃশ্য হলেন।

প্রমথ আজ নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে গেছে। সারা অ্যাপার্টমেন্টে কষা-মাংসের যে খুশবাই বেরিয়েছে, তাতেই অর্ধেক খাওয়া যায়! তার ওপর আমায় বলেছে পুরি বানাতে সাহায্য করতে, যেটা আমার পক্ষে বাস্তবিকই একটা রেয়ার প্রিভিলেজ। প্রমথর রাজত্বে আমি বড়োজোর শাকসবজি এবং বাসনপত্র বোয়াটোয়ার কাজ পাই। তবে ওর এই উৎসাহের কারণটা একটু বাদেই আমার কাছে স্পষ্ট হল। আমাদের কাছে পুরির গল্প শুনে ফ্রাইন্সস্কা পুরি খেতে চেয়েছে, তাই প্রমথর এই উদ্যোগ। আমার উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আটার সঙ্গে অল্প একটু ময়দা মিশিয়ে জল দিয়ে সেটাকে মাখা। নুন-টুন আর বোধহয় একটু মার্জারিন –যাই হোক, যা দেবার সেটা প্রমথই দিয়েছে। আমার যেটা দেওয়ার, সেটা শুধু ম্যানুয়াল লেবার। কিন্তু তার ওপরও প্রমথ খবরদারি চলছে। “এটা কি হচ্ছে, তুই কি কলম পিষছিস? একটু মাসল পাওয়ার দে।”

নিতান্ত খাবার লোভে অপমানগুলো হজম করছি। ভাগ্যক্রমে এই সময়ে ফ্রান্সিস্কা এসে গেল। ওর সঙ্গে প্রমথ সুবিধা করতে পারে না। আমি বুদ্ধি খাঁটিয়ে চট করে আমার দায়িত্বটা ওর ঘাড়ে চাপালাম। এরপর প্রমথ যেই “ওফফ ওরকম করে নয়’ বলতে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সিস্কা ধমক, “ডোন্ট বি সিলি, আমি অনেক ডো বানিয়েছি, জাস্ট হ্যাভ সাম পেশেন্স।”

সাধে কি বলে নারীশক্তি! একেনবাবুর ভঙ্গিতে বলতে হয়, “ম্যাডামের পায়ে শতকোটি প্রণাম।’ ফ্রান্সিস্কা শুধু আটা ভালো মাখল না, লিভার লাগান প্রেশার প্লেট দিয়ে চমৎকার গোল গোল করে পুরিও বেলে ফেলল। পুরি ভাজা আরম্ভ হওয়ার মিনিট কয়েকের মধ্যেই একেনবাবু এলেন। খাবারের গন্ধে দেখলাম মুখ একেবারে উদ্ভাসিত।

খেতে বসে আমি একেনবাবুকে বললাম, “পুরিগুলোর জন্য কিন্তু সব ক্রেডিট ফ্রান্সিস্কার।”

“তাই নাকি! সত্যি ম্যাডাম ফ্রান্সিস্কা, এরকম পারফেক্ট গোল গোল পুরি কিন্তু আমি অনেকদিন দেখিনি, একেবারে অ্যামেজিং!”

প্রমথ বলল, “আপনার মতো নিমকহারাম দুনিয়াতে নেই। কেন, আমি আপনাকে আগে গোল গোল পুরি খাওয়াইনি?”

“কি মুশকিল স্যার, নিশ্চয় খাইয়েছেন। তবে অনেকদিন খাওয়াননি।”

“আর এই যে মাংস খাচ্ছেন –সেটার কথা তো বললেন না!”

“আমি তো মাংসের কথায় আসছিলাম স্যার, আপনি তো তার সুযোগই দিলেন না।”

“থাক, আর আসতে হবে না।”

ফ্রান্সিস্কা আমায় জিজ্ঞেস করল, “হচ্ছেটা কি?”

আমি বললাম, “প্রমথর হিংসা হচ্ছে যে একেনবাবু তোমার পুরির প্রশংসা করছেন, কিন্তু প্রমথর রান্নার প্রশংসা করেননি।”

ফ্রান্সিস্কা প্রমথর দিকে তাকিয়ে ভারি মিষ্টি করে হেসে বলল, “কাম অন, ইউ নো ইউ হ্যাভ ডান এ সুপার জব।”

.

খাওয়া দাওয়ার পর ফ্রান্সিস্কা কফি বানাতে বসল। মেয়েটা সত্যিই অপূর্ব কফি বানায়। সেই একই কফি বিন, একই গ্রাইন্ডার আর একই কফি-মেকার ব্যবহার করে। কিন্তু কেন যে এত ভালো স্বাদ হয় ভগবান জানেন। প্রমথ ভালো কফি বানায়। কিন্তু ফ্রান্সিস্কার কাছে লাগে না। একেনবাবু অবশ্য ইনস্ট্যান্ট কফি তৈরি করা ছাড়া অন্য ভেঞ্চারের মধ্যে পা দেন না। ফ্রান্সিস্কা কফি বানাতে বানাতেই জিজ্ঞেস করল, “ডিটেকটিভ, তোমার মার্ডার মিস্ট্রি সলভ হল?”

একেনবাবু বললেন, “না ম্যাডাম, এখনও একটু খটকা আছে।”

“কি রকম?”

“মানে যে লোকটা মার্ডার করেছে বলে আমরা সবাই মনে করছি, সে হয়তো করেনি যদি প্রমথবাবু যা বলছেন, তা সত্যি হয়।”

“কী যা-তা বকছেন মশাই, আমি আবার কি বললাম?” প্রমথ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।

“ঐ যে স্যার আপনি বললেন, ফলস বটমে মণি-মুক্তো লুকোনো থাকার কথা। শিশিরবাবুর বাক্সে যদি সত্যিই মণি-মুক্তো লুকোনো থাকে, তাহলে সেই বাক্স দু’হাজার ডলার খরচা করে আনতে বলার অর্থ হয়। তাহলে বল্লভ শাহর গল্পটা একেবারে বানানো নাও হতে পারে। সেইজন্যই বলছিলাম এখনও খটকা আছে।”

“আপনি কি গাঁজা-ফাঁজা খাচ্ছেন নাকি?”

“কী যে বলেন স্যার, এই তো পুরি আর মাংস খেলাম!”

আমি বললাম, “দাঁড়ান, আপনি নিশ্চয় কিছু জানেন, যা আমাদের বলছেন না।”

“কী মুশকিল স্যার। আমি যা জানি, আপনারাও তাই জানেন।”

“ওসব ছাড়ুন,” প্রমথ বলল, “বটম লাইনটা কি?”

“বটম লাইন হল স্যার, পুলিশ মনে হচ্ছে বল্লভ শাহকেই ধরবে।”

“আর আপনি?”

“আমি স্যার এখনও একটু কনফিউজড।”

“ডিটেকটিভ, ইউ আর অলওয়েজ কনফিউজড,” বলে ফ্রান্সিস্কা প্রথম কফির কাপটা একেনবাবুর হাতে ধরিয়ে দিল। একেনবাবুকে ফ্রান্সিস্কা খানিকটা শিশুর মতোই দেখে।

“থ্যাঙ্ক ইউ, ম্যাডাম ফ্রান্সিস্কা, “ কাপটা হাতে নিয়ে একেনবাবু অননুকরণীয় ভঙ্গিতে মাথা নোয়ালেন।

“ইউ আর ভেরি ওয়েলকাম, ডিটেকটিভ।”

আমরা সবাই কফি নিয়ে সোফায় বসার পর একেনবাবু বললেন, “ভালো কথা স্যার, মিষ্টার পিন্টোর কাছে একটা মেসেজ পেলাম। আমি ফোন করিনি বলেই বোধ হয়।”

“আপনি আর যাননি! উনি যে সেদিন আপনাকে বললেন কিছু টিপস দেবেন?”

“সময় পেলাম কোথায় স্যার। কাল যাব ভাবছি, আপনারা আসবেন?”

“যাবেন কিনা ভেবে দেখুন, প্রমথ বলল। “কেন স্যার?”

“ওই যে শুনলাম ওঁর টাকা-পয়সার টানাটানি চলছে। আপনার গাঁটের পয়সা যদি খসাতে পারেন, সেই জন্যেই নিশ্চয় ফোনটা করেছেন।”

একেনবাবু মনে হল একটু চিন্তিত হয়েছেন। “না স্যার, যাব। আপনারাও আসুন না, জোর করে তো আর পয়সা নিতে পারবেন না।”

“ও, আমরা যাব আপনাকে ওঁর হাত থেকে বাঁচাবার জন্য?”

“কী যে বলেন স্যার।”

ঠিক হলো আমি আর প্রমথ দুজনেই যাব।

ফ্রান্সিস্কা বলল, “সে কি, আমি যেতে পারি না? আমি জিনিওলজিতে খুব ইন্টারেস্টেড।” ।

“আপনি আসবেন ম্যাডাম?”

“না ইনভাইট করলে কি করে যাই?”

“আঃ, সে কি কথা, নিশ্চয় আসবেন ম্যাডাম। আমি মিষ্টার পিন্টোকে বলে রাখব, আমরা অনেকে যাব। আমার মনে হয় না ওঁর আপত্তি থাকবে বলে।”

“মোটেই নয়, প্রমথ বলল, “এতগুলো পোটেনশিয়াল ক্লায়েন্ট।”

.

।। ২৭ ।।

একেনবাবু সকাল ন’টায় বাবু পিন্টোর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিলেন। ফ্রান্সিস্কা সেইজন্য সকাল সকাল এসে হাজির হয়েছে। বাড়ি থেকে যখন বেরোতে যাচ্ছি, তখন একেনবাবুর একটা ফোন এল। “আমি একটু আসছি স্যার,” বলে ঘরে গিয়ে উনি ফোনটা ধরলেন। খানিকক্ষণ বাদে বেরিয়ে এসে বললেন, “একটু কফি খাওয়া যাক স্যার কি বলেন?”

প্রমথ ব্যাপারটা আঁচ করল, “বাবু পিন্টো অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করলেন বুঝি? আপনাকে মুর্গি বানানো যাবে না, লেট-এ হলেও বুঝছেন।”

“সে সব বোঝার উনি উর্ধ্বে স্যার, হি ইস ডেড।”

“হোয়াট!” প্রমথ চেঁচিয়ে উঠল। আমি আর ফ্রান্সিস্কা হতবাক। “ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট এক্ষুণি ফোন করে জানালেন।”

“আরেকটা মার্ডার?”

“মনে হয় না স্যার। আমার বিশ্বাস এটা সুইসাইড।”

“সুইসাইড! কী করে বুঝলেন?”

“আগে একটু কফি খেতে হবে স্যার, গলাটা শুকিয়ে গেছে।”

“আর ইউ অলরাইট?” ফ্রান্সিস্কা একটু চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করল।

“আমি ঠিক আছি ম্যাডাম। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা বলতে সময় লাগবে –কফি ছাড়া পারব না।”

“হেঁয়ালি ছেড়ে একটু হিন্ট দিন না, পুরো ব্যাপারটা মানে কি?” প্রমথ প্রশ্ন করলো। “মানে স্যার, এই সুইসাইড, মার্ডার, চুরি –এইসব।”

“লুকস লাইক ইউ সলভড দ্য মিস্ট্রি!” ফ্রান্সিস্কা সপ্রশংসদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল কথাটা।

“আই থিঙ্ক সো ম্যাডাম। তবে ক্রেডিট আমার একার নয়– প্রমথবাবু আর বাপিবাবুরও অনেক কনট্রিবিউশন।”

কথাটার প্রতিবাদ করার আগেই ফ্রান্সিস্কা কপট রাগের ভান করে বলল, “বাঃ, আমার নয় কেন?”

“কী যে বলেন ম্যাডাম, আপনি হলেন ইনস্পিরেশন। আপনি মিস্ট্রি সলভ করতে না বললে কি মিস্ট্রি সলভড হত?”

“থ্যাঙ্ক ইউ।”

“থাক, ফ্রান্সিস্কাকে আর তেল দিতে হবে না, আমি কফি বানাচ্ছি। কিন্তু না বানানো পর্যন্ত একটা কথা নয়।” হুকুমটা দিয়ে প্রমথ সোফা ছেড়ে উঠল।

“কি মুশকিল স্যার, এইভাবে মৌনভাবে কি করে বসে থাকি?”

“চেষ্টা করুন।” বলে প্রমথ কিচেনে অদৃশ্য হল।

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “কি করে শিওর হলেন, এটা সুইসাইড?”

“বাপি কোনো কোয়েশ্চেন নয়,” প্রমথ কিচেন থেকে হুঙ্কার দিল।

“দিস ইস সিলি,” ফ্রান্সিস্কা বলল, “এইভাবে চুপ করে বসে থাকা যায় নাকি! ডিটেকটিভ তুমি কিচেনে চলো, সেখানে বলবে। তবে সব কিছু ডিটেইলস-এ বলতে হবে–ফ্রম দ্য বিগিনিং টু দ্য এন্ড।”

“ম্যাডামের হুকুম স্যার, চলুন,” আমার দিকে তাকিয়ে একেনবাবু বললেন।

কিচেনে গিয়ে একেনবাবু বললেন, “আসলে মিস্ট্রি তো স্যার একটা নয়, ছিল দু-দুটো –একটা শিশিরবাবুর মৃত্যু আর অন্যটা এখানকার দুটো মার্ডার। এদের মধ্যে যে কোনো যোগ ছিল, সেটা মোটেও ভাবিনি। ফ্র্যাঙ্কলি স্যার, যেদিন জানলাম শিশিরবাবুর মৃত্যুর সঙ্গে প্রভাসবাবু জড়িত নন, ও নিয়ে আর ভাবিওনি। রোহিত রয় খুন হবার আগে পর্যন্ত সময় কাটাচ্ছিলাম রিচার্ডমেসোর ডায়রি পড়ে। যাই বলুন স্যার, জিনিওলজি ব্যাপারটা দরুণ ইন্টারেস্টিং। রিচার্ডমেসো অনেক খেটেছিলেন ফ্যামিলি হিস্ট্রি বানাতে। তবে একটা জিনিস স্যার, সুভদ্রামাসির বাবার দিকটায় উনি নজর দেননি। মায়ের দিকে অনেক ইনফরমেশন আছে, নামের পাশে একটা A+ ও লাগিয়েছেন। বাবাকে দিয়েছেন গোল্লা। হয়তো কিছু খুঁজে পাননি বলে পাশে একটা কোয়েশ্চেন মার্ক দিয়ে রেখেছেন। বাপিবাবু সেটা শুনে বলেছিলেন, অধ্যাপক মানুষ, নিজেকেও গ্রেড দিয়েছেন। মনে আছে স্যার?”

আমি মাথা নাড়লাম।

“শুধু তাই নয় স্যার, খেয়াল করেছিলেন কিনা জানি না, মাসিমার বাড়িতে রিচার্ডমেসো যে ছবিগুলো বাঁধিয়ে রেখেছিলেন, সেখানেও বাবার সাইডে কারোর কোনো ছবি নেই।”

“করেছি,” প্রমথ বলল, “বাপিকে বলেওছি সেকথা। কিন্তু আপনি কি সুভদ্রামাসির জিনিওলজি নিয়ে লেকচার ঝাড়বেন, না মার্ডার সম্পর্কে কিছু বলবেন?”

“বলছি স্যার, বলছি। আসলে এগুলো সবই কানেক্টেড। একটু ধৈর্য ধরুন।”

“ইয়েস, হ্যাভ সাম পেশেন্স,” ফ্রান্সিস্কাও একটু বকল প্রমথকে।

“থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম।” একেনবাবু বলে চললেন, “হয়তো স্যার এর পেছনে কোনো রহস্য ছিল না। রিচার্ডমেসোর আনটাইমলি ডেথই ছিল এর কারণ। অথবা মাসিমার বাবা পিতৃপরিচয়হীন অনাথ। সেক্ষেত্রে অবশ্য এক লাইন ডায়েরিতে লিখতে পারতেন! ইতিমধ্যে একটা ঘটনা ঘটল, যেটা ম্যাডাম আপনি জানেন না, কিন্তু প্রমথবাবু আর বাপিবাবু জানেন।”

আমি আর প্রমথ দুজনেই তাকালাম একেনবাবুর দিকে।

“সে দিন বাপিবাবু আমাদের সবাইকে কফি না খাওয়ালে আসল ব্লু-টাই হয়তো মিস করে যেতাম।”

“কোনদিনের কথা বলছেন আপনি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“ঐ যে স্যার, যেদিন আপনার বাবার ছবিটা নিয়ে আমরা সবাই বেরোলাম, ফেরার পথে আপনি আমাদের কফি খাওয়ালেন, মনে নেই?”

“তা মনে আছে। কিন্তু তার সঙ্গে ব্লু-র কি সম্পর্ক?”

“মনে পড়ছে, সেদিন কতগুলো ছেলে বাজে বাজে কথা কাঁচের দেয়ালের উপরে লিখছিল?”

প্রমথ এক কাপ করে কফি সবার হাতে ধরিয়ে একেনবাবুকে বলল, “মশাই, বাপি সুবোধ ছেলে, নোংরা নোংরা কথা ও মনে রাখে না। কিন্তু কথাগুলোর মধ্যে কী এমন ক্রু পেলেন?”

“কথাগুলো নয় স্যার। ওরা বাইরে কাঁচের ওপর লিখছিল, আর আমি ভেতরে বসে উলটো করে পড়ছিলাম। তখন হঠাৎ খেয়াল হল, নীলিন’ শব্দটা উলটো করে পড়লে ‘নলিনী’ হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অশুদ্ধ ভাবে নিলীন-কে নীলিন লেখা কি বাই চান্স ঘটেছে, না ভেবেচিন্তেই হয়েছে।”

“আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড, ফ্রান্সিস্কা বলল।

সত্যিকথা বলতে কি, আমিও বুঝতে পারছিলাম না, একেনবাবু কিসের কথা বলছেন। কিন্তু তারপরেই মনে পড়ে গেল। আশ্চর্য! উনি ঠিক মনে রেখেছেন শিশিরবাবুর বাড়ির নাম এবং তার ভুল বানানের কথা! প্রমথ অবশ্য ধরতে পেরেছিল। “আমি এক্সপ্লেইন করে দিচ্ছি,” বলে সংক্ষেপে শিশিরবাবুর বাড়ির নাম আর ভুল স্পেলিং-এর জাস্টিফিকেশনের গল্পটা ফ্রান্সিস্কাকে বুঝিয়ে দিল।

“ওকে, গো এহেড।”

“শিশিরবাবু বিদগ্ধ লোক স্যার, উনি বানানটা ভুল দেখে শুদ্ধ করার চেষ্টা করবেন না, এটা বিশ্বাস করতে পারিনি। যদিও প্রভাসবাবুকে প্রপার নাউনের বানান নিয়ে একটা বিরাট ব্যাখ্যা উনি দিয়েছিলেন। সেগুলো আসল কারণ ঢাকার চেষ্টা।”

আমি বুঝতে পারছিলাম একেনবাবু কোনদিকে যাচ্ছেন, তাও জিজ্ঞেস করলাম, “আসল কারণ?”

“আসল কারণ স্যার, শিশিরবাবু নিশ্চয় নলিনী নামে কোনো মেয়েকে চিনতেন। নামটা স্ত্রী, মা বা অন্য কোনো পরমাত্মীয়ার হলে, উলটো করে লিখতেন না –ঠিক ভাবে লিখেই স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতেন। উলটো করে লেখার অর্থ বাইরের কাউকে না জানিয়ে একান্ত গোপনে স্মৃতিকে আঁকড়ে রাখা।”

প্রমথও আঁচ করেছিল একেনবাবু কি বলতে চান। “তারমানে নলিনী বলে উনি কাউকে ভালোবাসতেন এবং সেটা ব্যর্থ প্রেম ছিল। এ নিয়ে এত ধানাই পানাই করছেন কেন, সোজা বলে ফেলুন না কথাটা।”

“ঠিকই বলেছেন স্যার। এখন প্রশ্ন হল এই নলিনী মেয়েটি কে? একজন নলিনীর নাম আমরা এখানে সবাই শুনেছি, যিনি মাসিমা-র মা। তিনি কি এই নলিনী হতে পারেন? হওয়ার সম্ভবনা খুবই অল্প। নলিনী একটা চলতি নাম। শিশিরবাবুর সমসাময়িক বহু মেয়ের নামই নলিনী ছিল। তবু এটা একটা তথ্য স্যার, মনের মধ্যে গেঁথে রইল। তারপর মাসিমার বাড়িতে গিয়ে আমি শুনলাম যে মাসিমা শিশিরবাবুর নাম শুনেছেন– বলা উচিত সম্ভবত শুনেছেন এবং শুনেছেন রিচার্ডমেসোর কাছ থেকে। রিচার্ডমেসোর সঙ্গে শিশিরবাবুর যোগাযোগ থাকবে কী সূত্রে? শিশিরবাবু ইংরেজির অধ্যাপক, রিচার্ডসাহেব অ্যানথ্রপলজির লোক। দেখা কি হঠাৎ করে হয়েছে, না অন্য কারণে? এর মধ্যে মাসিমার কাছে জানলাম রিচার্ডসাহেব জিনিওলজির ব্যাপারে নানান জায়গায় ঘুরেছেন, নানান লোকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তার সঙ্গে কি এর কোনো যোগাযোগ আছে? আমি কিন্তু ডায়েরির প্রতিটি লাইন পড়েও শিশিরবাবুর কোনো উল্লেখ দেখিনি। হয়তো অন্য কোনো সূত্রে ওঁদের দুজনের যোগাযোগ হয়েছিল। মোটকথা শিশিরবাবুর প্রিয়া নলিনী সম্পর্কে যে আঁধারে ছিলাম, সেই আঁধারেই রইলাম।

“এরমধ্যে একদিন কথায় কথায় বাপিবাবু বললেন, শূন্যর কনসেপ্ট হিন্দুদের। তখন আমার মাথায় এল, সেইজন্যেই আমাদের অ-আ-ক-খ-র মধ্যে শূন্যের মতো দেখতে কিছু নেই। কিন্তু ইংরেজি অ্যালফাবেট-এ “ও” আর শূন্য দেখতে এক রকম। মনে আছে স্যার?”

আমি বললাম, “মানে আছে, ধরে নিয়েছিলাম ওটা নম্বর এবং স্ক্রিপ্ট সম্পর্কে আপনার নিজস্ব থিওরি।”

“সে যাই হোক স্যার। আপনি যখন বলেছিলেন রিচার্ডমেসো নিজেকে গ্রেড দিয়েছেন, তখন মনে হয়নি। কিন্তু প্রমথবাবুর কথায় খেয়াল হল, এদেশে পরীক্ষায় ভালো করলে A বা A+ দেয় ঠিকই, কিন্তু বাজে নম্বর দিতে গোল্লা তো দেয় না দেয় D বা F। তাহলে গোল্লা কেন? তার মানে স্যার, উনি নিজেকে গ্রেড করেননি, উনি অন্য কিছু লিখেছিলেন। গোল্লা যদি না হয়, তাহলে ওটাকে হতে হবে অক্ষর ০। হঠাৎ A+ আর ০ উনি কেন লিখতে যাবেন, আর কেনই বা ০–র পরে একটা প্রশ্নচিহ দেবেন?”

“ব্লাডগ্রুপ,” প্রমথ মন্তব্য করল।

“নাঃ স্যার, আপনাদের মাথা ভীষণ সাফ। ঠিকই, দুটোই হল ব্লাডগ্রুপ। তাহলে কি উনি মাসিমার মা আর বাবার ব্লাডগ্রুপের কথা লিখেছেন? কিন্তু তাই যদি হবে তাহলে কোয়েশ্চেন মার্কটার অর্থ কি? বাপিবাবুর কাছে মাসিমার মা আর বাবার মৃত্যুর সময়কার খবর আমরা সবাই শুনেছি। দুবারই রিচার্ডমেসো কলকাতায় ছিলেন। মায়ের বেলায় নিজে একবার রক্তও দিয়েছেন, তাই না স্যার?”

“হ্যাঁ” আমি উত্তর দিলাম।

“মাসিমার বাবার বেলায় সেটা দিয়েছিলেন কিনা জানি না, তবে ধরে নিচ্ছি মাসিমার বাবার ব্লাড টাইপ কি তা নিশ্চয় জানতেন, কারণ ওঁর সার্জারি হচ্ছিল। তিনি মারা যাবার পরে রিচার্ডসাহেব বাপিবাবুকে বলেছিলেন, ‘টুথ ইজ অ্যাস অফন নট নোন।’ কেন, উনি এই কথাটা বলেছিলেন? তার অর্থ কি শুধু মৃত্যুর কারণ না জানা, না আরও একটা কিছু ন জানার কথাও অজান্তে রিচার্ডসাহেবের মুখ থেকে বেরিয়েছিল।”

“কী বলছেন মশাই, একটু পরিষ্কার করে বলুন তো?” প্রমথ অধৈর্য হয়ে বলল।

“বলছি স্যার, বলছি। আপনাদের মনে আছে যে মাসিমা একদিন বলেছিলেন ব্লাড নেবার ব্যাপারে উনি হলেন ইউনিভার্সাল রিসিভার। তার মানে ওঁর ব্লাড-টাইপ নিশ্চয় AB। সেক্ষেত্রে মাসিমার মা’র ব্লাড-টাইপ A+ হলে, বাবার ব্লাড-টাইপ ০ হওয়াটা প্রায় অসম্ভব।”

“এটা ঠিক বললেন না,” প্রমথ বলল, “ব্লাড টাইপ দিয়ে পিতৃত্ব বিচার করা যায় না। জেনেটিক মিউটেশনের একটা ব্যাপার আছে।”

“সেই জন্যেই তো স্যার বললাম, প্রায় অসম্ভব। তাই ওই কোয়েশ্চেন মার্ক। রিচার্ডমেসোর মনে প্রশ্ন জেগেছিল, তাই উনি সংক্ষেপে নোটবইয়ে লিখে রেখেছিলেন।”

“ইন্টারেস্টিং, চালিয়ে যান,” আমি বললাম।

“বোধ হয় সেই জন্যেই উনি মাসিমার বাবার দিকের ফ্যামিলি ট্রি বানাননি। তবে খুব ইনট্রিগড হয়েছিলেন ব্যাপারটা নিয়ে এবং খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন কার সঙ্গে মাসিমার মা’র ছেলেবেলায় পরিচয় ছিল। তার থেকেই শিশিরবাবুর নাম জানতে পারেন এবং ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এগুলো সবই আমার স্পেকুলেশন স্যার।”

এইটুকু বলার পর একেনবাবু কফিটা শেষ করলেন। তারপর বললেন, “আর একটু কফি বানাই?”

ফ্রান্সিস্কা বলে উঠল, “না, মাঝপথে থামা চলবে না। আমি বানাচ্ছি।”

গল্পটা এত জমে গেছে যে আমরা কিচেন থেকে নড়িনি। আমি বললাম, “বুঝতে পারছি আপনি কোনদিকে এগোচ্ছেন। বলতে চান শিশিরবাবুই সুভদ্রামাসির আসল বাবা, তাই তো?”

“তা বলতে পারি না স্যার, তবে হওয়া সম্ভব। কিন্তু ওঁদের মধ্যে যে প্রেম ছিল, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।”

“কী করে?”

“তার প্রমাণ হল শিশিরবাবুর বাড়ি থেকে পাওয়া চিঠিগুলো।”

আমিও ভেবেছিলাম উনি এটাই বলবেন। শিশিরবাবুর সঙ্গে যদি সত্যিই সুভদ্রামাসির মায়ের প্রেম থাকত, তাহলে ওঁর বাড়ি থেকে পাওয়া চিঠিগুলো সুভদ্রামাসির মায়েরই হওয়া উচিত।

“ওগুলো যে সুভদ্রামাসির মায়ের হাতের লেখা চিঠি, সেটা কী করে বুঝলেন?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

“আপনি আর ম্যাডাম ছিলেন না স্যার, কিন্তু রোহিত রয় যেদিন মারা গেলেন, সেদিন বিকেলে বাপিবাবুর সঙ্গে মাসিমার বাড়ি গিয়েছিলাম। তখন মাসিমা ওঁর মায়ের একটা চিঠি দেখান। তখনই সন্দেহ হয়েছিল স্যার। বাড়িতে ফিরে শিশিরবাবুর চিঠিগুলো দেখে নিশ্চিত হলাম।”

“চিঠি তো আমিও দেখেছি, কিন্তু আমার তো খেয়াল হয়নি!”

“কারণ স্যার, হ্যান্ডরাইটিং নিয়ে আপনি চর্চা করেন না, তাছাড়া আমি যে সব কিছু মেলাচ্ছি –নীলিন, নলিনী, শিশিরবাবু।”

“মেলাচ্ছিলেন কেন, রোহিত রয়ের মৃত্যুর সঙ্গে শিশিরবাবুর মৃত্যুর কী সম্পর্ক ছিল?”

“মেলানো আমার স্বভাব স্যার। এক একটা জিনিস ভাবি, সেটা যখন মিলে যায়, বেশ মজা লাগে। বেশ কেমন জানতে পারলাম শিশিরবাবুর বান্ধবী ছিলেন মাসিমার মা।”

“কোথায় মিল পেলেন আপনি চিঠিগুলোতে?” আমি প্রশ্ন করলাম।

“আপনি যদি এখন মিলিয়ে দেখেন, আপনিও মিল ঠিক খুঁজে পাবেন। দেখবেন,

উকারের টান, ক, ণ, আর কয়েকটা অক্ষর সবগুলো চিঠিতেই হুবহু এক, আর খুবই আনইউসুয়াল লেখার ধরনটা।”

“আর বানান ভুলও নিশ্চয় নেই,” প্রমথ যোগ করল, “সেখান থেকে প্রমাণিত হবে বাপি অন্ততঃ চিঠিটা লেখেনি। বলুন, তারপর কি?”

“তারপর অবশ্য স্যার আমরা জড়িয়ে পড়লাম, মিস্টার রয়ের মার্ডার নিয়ে। আর পুলিশ এগোতে থাকল ভুল দিকে। পুলিশের ধারণা হলো রোহিত রয় লোকদের ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করেছিলেন। যাঁদের ব্ল্যাকমেইল করছিলেন, তাঁদেরই কেউ খুন করেছেন রোহিত রয়কে। আরেকটা সম্ভাবনাও ছিল। সেটা হল, এই ব্ল্যাকমেইলের ব্যাপারে রোহিত রয়ের অন্য পার্টনার ছিলেন। সেই পার্টনার বা পার্টনারদের সঙ্গে রোহিত রয়ের বখরার কোনো গোলমাল লাগায় রোহিত রয় খুন হয়েছেন। আমি কিন্তু অন্য সম্ভবনাগুলোকে বাদ দিতে পারছিলাম না। যদি ধরেও নেওয়া যায় যে রোহিত রয় ব্ল্যাকমেইলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেখান থেকে প্রমাণিত হয় না যে তিনি তার জন্যেই খুন হয়েছেন। আর ব্ল্যাকমেইলের ব্যাপারটাও পুলিশের স্পেকুলেশন। ওঁর কম্পিউটারে কতগুলো আপত্তিকর ছবি পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন সেলিব্রেটিও আছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে পুলিশ তো কোনো অভিযোগ পায়নি। এও তো হতে পারে যে আসল খুনি আমাদের ভুল পথে চালনোর জন্য এই ছবিগুলো ঢুকিয়েছে। কিন্তু এর পর খুন হলেন দিলীপ পারেখ, যিনি রোহিত রয়ের সঙ্গে ডিজিটাল ফোটো এডিটিং-এর ব্যাপারে জড়িত। রোহিত রয় ছবির রাফ কম্পোজিশন করে দিলীপ পারেখকে দিয়েই ফিনিশিংটা করাতেন। সেগুলো যেত অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সিতে। কিন্তু শুধু কি বিজ্ঞাপনের জন্যই ওঁরা এটা করতেন?

“দিলীপ খুন হবার পর বলতে গেলে পুলিশ প্রায় নিঃসন্দেহ হল এটি ব্ল্যাকমেইল সংক্রান্ত খুন। স্বভাবতই সন্দেহ পড়ল স্যার, বল্লভ শাহর উপরে। তিনি রোহিত রয়ের পরিচিত এবং দিলীপের বস। পুলিশ রোহিত রয়ের বান্ধবী আইলিনকেও খুঁজছিল। সে বল্লভ শাহর পরিচিত, সম্ভবতঃ চক্রটার সঙ্গে যুক্ত। মন কিন্তু বলছিল স্যার, রোহিত রয় বা দিলীপ কেউই ব্ল্যাকমেইল চক্রে যুক্ত নয়, যদিও বল্লভ শাহকে ধোয়া তুলসীপাতা মনে হচ্ছিল না। এই সময়ে শান্তিনিকেতন থেকে দুলালবাবু জানালেন, দুটো লোক লাগিয়ে একজন শিশিরবাবুর বাড়ি থেকে একটা পুরোনো বাক্স চুরি করিয়েছে। এতদিন পর্যন্ত আমরা ভাবছিলাম, বাক্স থেকে কিছু চুরি গেছে, এখন জানলাম উদ্দেশ্য ছিল বাক্স-চুরি। একটা পুরোনো বাক্স, কেন সেটা কেউ চুরি করাতে চাইবে? নলিনীদেবীর চিঠিগুলো মেঝেতে পড়েছিল, সুতরাং চিঠিগুলো ওই কাঠের বাক্সেই থাকত। বহু বছর আগে শিশিরবাবু হয়তো শখ করে কিনেছিলেন। অ্যান্টিক হলেও এমন কি দামি হবে? সেইজন্য আমি মিস্টার লংফেলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম, সে তো আপনাদের আগেই বলেছি। এমনি সময়ে থ্যাঙ্কস টু প্রমথবাবু, দ্য বিগেস্ট ব্লু পেয়ে গেলাম।”

প্রমথ বলল, “গুড, এতক্ষণ ভাবছিলাম আমার কথাটা চেপে যাচ্ছেন কেন! বলুন তো এবার, কী সাহায্য করলাম?”

“সেদিন যখন মিস্টার লংফেলোর কথা বলছিলাম, আপনি হঠাৎ শ্যামল মিত্রের গানটা চালালেন।”

“কোন গানটার কথা বলছেন?”

“ঐ যে স্যার, দেখেছি তোমাকে মুখর মেলায়, পথেরই বাঁকে আর রঙেরই খেলায়। কেন জানি না স্যার ওই বাঁকে’ কথাটা আমায় নাড়া দিল। তখনই মনে হলো ওটা আপনারই মুখে আগে শুনেছি। কবে? ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেল। ক্যালিস্টোর একটা লেখা আপনি অনুবাদ করেছিলেন, মনে আছে স্যার?”

“নিশ্চয় মনে আছে –‘রেখে দিও মোর শূন্য পাত্র পথের বাঁকে’।”

“না না, স্যার, ওটা ছিল –‘রেখে দিও মোর শূন্য চায়ের পাত্র, ব্রিজের বাঁকে বাঁকে। বুঝতে পারছেন তো স্যার ব্যাপারটা?”

“না,” আমি প্রমথ দুজনেই মাথা নাড়লাম।

“বুঝতে পারছেন না স্যার!” একেনবাবু এক্সসাইটেড হয়ে বললেন, “রেখে দিও– মানে কিপ ইট। চায়ের পাত্রটাকে টি কাপ না ভেবে ভাবুন টি ক্যাডি। আর ব্রিজের বাঁকে বাঁকে –টার্ন ব্রিজ। অর্থাৎ, টার্ন ব্রিজের ফাঁকা টি-ক্যাডিটা রেখে দিও। ওটা ছিল প্যারিস পাবলিকেশন্স-এর ছাপা ওঁর কবিতার বইয়ের টাইটল। আর “দ্য লাইট” ডায়মণ্ডটা কোথায় আছে, সেটার ব্লু তিনি মারা যাবার আগে দিয়ে গিয়েছিলেন –“দ্য অ্যানসার ইস ইন দ্য টাইটেল’।

“আপনাদের মনে আছে কিনা জানি না স্যার, তখনই আমি বাপিবাবুর দিদিমা আর নলিনীদেবীর ছবিটা নিয়ে ছুটেছিলাম মিস্টার লংফেলোর কাছে। মিস্টার লংফেলো কনফার্ম করলেন, মূতির নীচের বাক্স নিঃসন্দেহে টার্ন ব্রিজের টি-ক্যাডি। ব্যাপারটা এবার বুঝুন স্যার, মাসিমা বলেছিলেন মূর্তি যে-বাক্সে থাকত সেটা ওঁর দাদুর ঠাকুরমার, অর্থাৎ জিনিওলজি অনুসারে ক্যালিস্টোর বোনের। মূর্তি শুদু বাক্সটা চুরি যায় নলিনীদেবীর বিয়ের ঠিক আগে। ছবিটা তোলা হয়েছিল নলিনী দেবীর যখন বিয়ে হয়নি, সুতরাং মনে করা যেতে পারে ওটাই সেই বাক্স!”

“দাঁড়ান মশাই দাঁড়ান, এত জোরে রেলগাড়ি চালাবেন না। ওটা তো চুরি গেছে বহুদিন, শিশিরবাবুর কাছে যায় কি করে?”

“বলছি স্যার, বলছি। মনে আছে, দুলালবাবু নলিনী দেবীর লেখা চিঠিগুলো পাঠিয়েছিলেন, তার শেষ চিঠিটাতে কী লেখা ছিল?

এটা রেখে দিও, আর কাল ভোর চারটের সময় ট্যাক্সি নিয়ে বাইরে অপেক্ষা কোরো।

সেই ‘এটা’-র উল্লেখ আর কোনও চিঠিতে নেই। চিঠিটা তাড়াহুড়ো করে একটা ছেঁড়া কাগজে লেখা। মনে হয় স্যার, কোনও মতে একটা কাগজ জোগাড় করে বাড়ির লোকদের অজান্তে চিঠিটা পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু এই ‘এটা’-টা কী? তখনই আমার মনে পড়ল, মাসিমা বলেছিলেন সোনা-রূপোর ওই নারী-মূর্তি ওঁর মা’র বিয়ের সময়ে চুরি যায়, কিন্তু পরে চোর এসে সেটা ফেরত দেয়। এইবার আমার কাছে ঘটনাগুলো স্পষ্ট হতে লাগল। চিঠির ‘এটা’ হল সেই নারী-মূর্তি। নলিনীদেবী বিয়ের আগের দিন সেটি বাক্স-সমেত বিশ্বস্ত কারোর হাত দিয়ে তার প্রেমিক শিশিরবাবুকে দিয়েছিলেন। কথা ছিল খুব ভোরবেলা শিশিরবাবু ট্যাক্সি নিয়ে আসবেন, উনি পালাবেন।”

“বুঝলাম না,” প্রমথ বলল, “অফ অল দ্য থিংস, ওই মূর্তিটা উনি পাঠালেন কেন?”

“সেটাও স্যার মাসিমা বলেছিলেন। দিদিমার কাছ থেকে পাওয়া ওই মূর্তি ছিলো মাসিমার মা নলিনীদেবীর প্রাণপ্রিয়। বাড়ির সঙ্গে সব যোগাযোগ ছিন্ন হতে যাচ্ছে বুঝে মায়ের দেওয়া মূর্তি কাছে রাখতে চেয়েছিলেন। কেন নলিনী দেবী তার পরদিন বেরিয়ে যেতে পারেননি, কে জানে! শিশিরবাবুই হয়তো ভয় পেয়ে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। হতে পারে নলিনীদেবীই বেরোবার সময়ে ধরা পড়ে যান। মোটকথা নারীমূর্তি অদৃশ্য হয়। পরে ওটা শিশিরবাবু লুকিয়ে লুকিয়ে ফেরত দিয়ে যান। তিনি জানতেন মূর্তিটা নলিনীদেবীর কী ভীষণ প্রিয় ছিল। কিন্তু বাক্সটা ফেরত দেননি। মানুষের সাইকোলজি নানা ভাবে কাজ করে স্যার। হয়তো একটা স্মৃতি চিহ শিশিরবাবু ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। প্রিয়াকে তাঁর প্রিয়বস্তুটা ফেরত দিলেও পুরোটা দিলেন না। অন্তরটা দিলেন স্যার, কিন্তু খোলসটা অর্থাৎ বাক্সটা ধরে রাখলেন। নাউ ইট স্টার্টেড মেকিং সাম সেন্স স্যার।

“প্রমথবাবু হয়তো খেয়াল না করেই বলেছেন, বল্লভ শাহ কখনোই অচেনা কারোর কথায় বাক্স আনার মতো কাঁচা কাজ করবেন না, বাক্সের ফলস বটমে তো মণি-মুক্তো-ও থাকতে পারে। আপনি কিন্তু স্যার পারফেক্টলি রাইট।” প্রমথর দিকে তাকিয়ে একেনবাবু বললেন। “ক্যালিস্টো টি-ক্যাডির খোপগুলো কেটে একটা ফলস বটম বানিয়ে ‘দ্য লাইট’ আর কিছু দামি মণিমুক্তো রেখেছিল। পুলিশ সব জায়গায় খুঁজেও ওখানে আছে ভাবেনি। ক্যালিস্টোর সব কিছুই পায় তার বোন। বোন বাচ্চা হবার পরপরই মারা যান, আর তাঁর স্বামী অর্থাৎ সুভদ্রামাসির দাদুর ঠাকুরদা বাচ্চাকে নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। সেই সঙ্গে টি-ক্যাডিটাও আসে।”

আমার মনে প্রশ্ন জাগল, “এটা তো অন্য কোনো টি- ক্যাডিও হতে পারত?”

“তা পারত। তবে কিনা দুটো জিনিস। প্রথমত, ক্যালিস্টোর বোন, অর্থাৎ সুভদ্রামাসির দাদুর ঠাকুরমা, মারা যাবার আগে বলে গিয়েছিলেন ওই টি-ক্যাডি যেন ওঁর বাচ্চা পায়। মাসিমা যখন কথাটা বলেছিলেন আমার খুব স্ট্রেঞ্জ লেগেছিল। অফ অল দ্য থিংস স্যার, কোন মা তার বাচ্চাকে টি-ক্যাডি দিয়ে যাবার কথা ভাববে! তাই মনে হয় ক্যালিস্টো-র বোন নিশ্চয় জানতেন যে ওতে মহামূল্য জিনিস লুকোনো আছে। দ্বিতীয়ত স্যার, এটা অর্ডিনারি টি-ক্যাডি নয়। এর ভেতরটা মডিফাই করা হয়েছে। নইলে ঐ নারীমূর্তি ওর ভেতর ঢুকত না। সেইজন্যেই শিশিরবাবুও নলিনীদেবীর চিঠিপত্রগুলো ওর মধ্যে রাখতে পেরেছিলেন।”

“কিন্তু এটাও তো সম্ভব যে শিশিরবাবু বহুদিন আগেই ওই টি-ক্যাডিটা ফেলে দিয়েছিলেন, এটা সম্পূর্ণ অন্য একটা কাঠের বাক্স– হয়তো শ্রীনিকেতন থেকে বানানো?” প্রমথ প্রশ্ন তুলল।”

“গুড পয়েন্ট স্যার। কিন্তু মনে রাখবেন রোহিত রয় ওটাকে চিনতে পেরেছিলেন।”

“কী করে?”

“কী মুশকিল স্যার, উনিই তো বাপিবাবুর দিদিমা আর সুভদ্রামাসির মায়ের ছবিটা ডিজিটালি এনহ্যান্সড করেছিলেন!”

“এ পর্যন্ত বুঝলাম, আমি বললাম। কিন্তু রোহিত রয়কে খুন করল কে?”

“বাবু পিন্টো।”

“বাবু পিন্টো!”

“হ্যাঁ স্যার। বাবু পিন্টো মাসিমার জিনিওলজিটা খুব ভালোভাবেই জানতেন। রিচার্ডর্সাহেবের নোটবুকের প্রায় সব তথ্যই বাবুর কাছ থেকেই পাওয়া। আমরা লজিক্যালি যেসব জিনিস চিন্তা বার করছি, বাবু পিন্টো সেইভাবেই সেগুলো বার করতে পারবেন, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। উনি সম্ভবতঃ শিশিরবাবুর সঙ্গে সুভদ্রামাসির মায়ের সম্পর্কটাও আবছা আবছা জানতেন। হয় রিচার্ডসাহেবের কাছ থেকে অথবা রোহিত রয়ের কাছ থেকে। রিচার্ড সাহেব নিজের স্ত্রীকে না বললেও জিনিওলজির ব্যাপারে অনেক কথাই হয়তো কনফিডেনশিয়ালি এঁদের বলেছিলেন। শিশিরবাবু যখন অন্যের কাছ থেকে পাওয়া সব জিনিস ফেরত দিচ্ছেন স্যার, তখন বাক্সটাও ফিরিয়ে দেবার কথা ভাবছিলেন। এ প্রসঙ্গে আপনাদের প্রভাসবাবুকে বলেও ছিলেন যে এক বহু পুরোনো পরিচিতের জামাইয়ের সঙ্গে হঠাৎ দেখা। তার জিনিসটাও ফিরিয়ে দিতে হবে। সেটা যে সত্যি সত্যিই করার চেষ্টা করছিলেন, সেটা জানলাম কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে খোঁজ নিয়ে। রিচার্ডমেসোর কাছে একটা চিঠি এসেছিল ইন্ডিয়া থেকে, সেটা ভুল করে ওরা রিচার্ডমেসোর পুরোনো ঠিকানায়, অর্থাৎ রোহিত রয়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল।” সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল, স্টুয়ার্ট সাহেবের সেদিনের সেই মেসেজের কথাটা, যেটার মাথামুন্ডু তখন বুঝিনি। এখন সেটা পরিষ্কার হল।”

একেনবাবু বলে চললেন, “রোহিত রয় সেই চিঠি থেকে বাক্সর কথা জানলেন। বাবু পিন্টোও একই কথা জানালেন অন্যভাবে। রিচার্ডমেসোর কার্ডে দুটো ঠিকানাই ছিলো। একটা হল ওঁর পুরোনো ম্যানহাটানের ঠিকানা, যেখানে রোহিত রয় থাকতেন। আরেকটা হল ওঁর কলেজের ঠিকানা। আমার বিশ্বাস, শিশিরবাবু দু-জায়গাতেই চিঠি পাঠিয়েছিলেন, যাতে একটা চিঠিটা অন্ততঃ ঠিকমতো রিচার্ডসাহেবের হাতে পৌঁছয়। রোহিত রয় বাইরে থাকায় বাবু পিন্টো মিস্টার রয়ের চিঠিগুলো তোলেন। রিচার্ডসাহেব বহুদিন হল মারা গেছেন, চিঠিটা আসছে শিশিরবাবুর কাছ থেকে, যার সম্পর্কে বাবু পিন্টো জানেন। উনি চিঠিটা খোলেন। তখনই উনি জানতে পারেন যে শিশিরবাবু একটা কাঠের বাক্স ফেরত দিতে চান। এ-ও সম্ভব স্যার যে সেই চিঠিতে উনি হয়তো লিখেও ছিলেন যে ওটা ওঁর শাশুড়ির পুতুলের বাক্স বা ওরকম কোনো কথা। মিস্টার পিন্টো বুঝতে পারেন যে এটাই সেই বাক্স! উনি সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যান করলেন কী ভাবে এটাকে খুব তাড়াতাড়ি আনানো যায়। উনি জানতেন স্যার, বল্লভ শাহ প্রায়ই ইন্ডিয়া যান জিনিসপত্র আনতে। কিন্তু উনি যদি সোজাসুজি এটা আনতে বলেন, তাহলে সন্দেহ জাগতে পারে। তাই উনি ছদ্মবেশের আশ্রয় নিলেন। দিলীপের সঙ্গে ওঁর সব কথাবার্তার কথা তো স্যার বল্লভ শাহর কাছেই শুনেছেন।”

“তা শুনেছি, তারপর?”

“যাইহোক, রোহিত রয় এই বাক্সের হিস্ট্রি কতটা জানতেন জানি না। জানলে এক কথা। না জানলেও উনি চাননি, একটা অচেনা লোক এইভাবে মাসিমাদের ফ্যামিলির জিনিস নিয়ে যাবে। বাবু পিন্টো বাক্সটা রোহিত রয়ের কাছে আছে জেনে সকালে রোহিত রয়ের অ্যাপার্টমেন্টে আসেন, বাক্সটা এঁকে দিতে বলেন। না পেয়ে রোহিত রয়কে গুলি করেন। ব্যাপারটাকে অন্য একটা অ্যাঙ্গল দেবার জন্য কতগুলো বাজে বাজে ছবি রোহিত রয়ের কম্পিউটারে পুরে দেন।”

“এতদিনের এক বন্ধুকে এর জন্যে খুন!”

“স্যার, আমি আপনাকে বলেছিলাম, দেয়ার হ্যাঁস টু বি এ মোটিভ। বল্লভ শাহ সেদিন বললেন, আর স্টুয়ার্ট সাহেবও খবর নিয়েছেন –বাবু পিন্টোর ফাইনানশিয়াল অবস্থা একেবারে শোচনীয়। শেয়ার মার্কেটের ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝি না স্যার। এটুকু বুঝি দেনায় ওঁর চুল বিকিয়ে গেছে। বলতে পারেন এটা ছিল পাওনাদারদের হাত থেকে রক্ষা পাবার একমাত্র উপায়। হি ডিসাইডেড এগেইন্সট ফ্রেন্ডশিপ।”

“দিলীপকে মারলেন কেন?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

“দিলীপ ওঁর ছদ্মবেশটা ধরে ফেলেছিল স্যার। সুতরাং না সরিয়ে ওঁর কোনো উপায় ছিল না।”

এমন সময়ে ফোনটা আবার বেজে উঠল। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট। নিশ্চয় কংগ্রাচুলেশনস জানাচ্ছেন। একেনবাবু বারবার বলছেন, “থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ। না না স্যার, আমি একা কেন –এ তো সবাই মিলে সলভ করা। হ্যান্ডগানটা তাহলে পাওয়া গেছে?… নিশ্চয় স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ এগেইন।”

ফোনটা নামাতেই আমরা চেপে ধরলাম।

“কি ব্যাপার?”

“স্টুয়ার্ট সাহেব বললেন ব্যারেল-কাটা হ্যান্ডগানটা পাওয়া গেছে।”

“ওরকম ক্রিপ্টিক্যালি কথা বলছেন কেন, একটু বিশদ করুন। ব্যারেল-কাটা হ্যান্ডগানের বিশেষত্বটা কি?” প্রমথ প্রশ্ন করল।

“ওটা একটা ওল্ড টেকনিক স্যার। হ্যান্ডগানের ব্যারেলটা কেটে ফেললে তার গুলির গায়ে কোনো মার্কিং থাকে না। গুলিতে মার্কিং না থাকলে গানটা আইডেন্টিফাই করা কঠিন।”

“কঠিন কেন, আমি বললাম, সেক্ষেত্রে ব্যারেল কাটা হ্যান্ডগান থেকেই গুলিটা বেরিয়েছে।”

“সেটা খুব পজিটিভ আইডেন্টিফিকেশন হল না– যে কোনো ব্যারেল কাটা গান থেকেই গুলিটা বেরোতে পারে।”

“তাহলে সবাই ব্যারেল-কাটা ত্যান্ডগান ব্যবহার করে না কেন?”

“গুড কোয়েশ্চেন স্যার। মুশকিল হল, ব্যারেল কাটা থাকলে নিশানা করা খুব কঠিন। খুব কাছাকাছি না থাকলে লক্ষ্যভ্রষ্ট হবার সম্ভাবনা খুবই বেশি। গুলিটাও সোজা না বেরিয়ে চক্কর খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে যায়। যখন শুনলাম গুলিতে মার্কিং নেই আর বড় সাইজের ক্ষত, তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল।”

প্রমথ বলল, “সবই তো শুনলাম, কিন্তু এগুলো দিয়ে তো প্রমাণ হতো না যে বাবু পিন্টোই খুনি। উনি আত্মহত্যা করতে গেলেন কেন?”

“ইউ আর রাইট স্যার, যা বললাম তা দিয়ে প্রমাণ করা যেত না। সেই জন্যেই ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট বাবু পিন্টোর ব্যাঙ্ক লকার চেক করেছেন। সেখানে ‘দ্য লাইট’ আর বেশ কয়েকটা হিরে, রুবি, ইত্যাদি পাওয়া গেছে। বুদ্ধমূর্তিতে আঙুলের ছাপগুলোও নেওয়া হয়েছে। পাওনাদারের চাপে আর তদন্তের জাল ধীরে ধীরে গুটিয়ে আসছে বুঝতে পেরে উনি নিজের মান বাঁচিয়েছেন। ব্যারেল-কাটা হ্যান্ডগানটা ওঁর অফিসে পাওয়াতে পাজলের শেষ ফাঁকটা পূর্ণ হল।”

একেনবাবুর কথা শেষ হতেই, “কনগ্রাচুলেশন্স মাই ডিটেকটিভ, ইউ ডিসার্ভ এ কিস,” বলে ফ্রান্সিস্কা একেনবাবুকে জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু দিল। একেনবাবুর মুখের অবস্থা তখন দেখার মতো। লজ্জায় বেগুনি। মাথা নুইয়ে নুইয়ে বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।”

Sujan Dasgupta ।। সুজন দাশগুপ্ত