২.

মা’কে সাত দিনের জন্য বাণীপুরে মাসির বাড়িতে রেখে সোমবার ট্রেন ধরে ফিরছি। সকাল সকাল বলে ট্রেনটা একটু ফাঁকা। হাত-পা ছড়িয়ে পত্রিকা উলটোতে উলটোতে একটা ছোট্ট খবর চোখে পড়ল।

প্রমোদতরি থেকে নিখোঁজ

গঙ্গায় হাউসবোটে বেড়ানোর সময়ে সতেরো বছরের
একটি মেয়ে অদৃশ্য হয়েছে। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে।

খবর বলতে এইটুকুই। প্রথমে এ নিয়ে কিছু ভাবিই নি। হঠাৎ মনে পড়ল, বারীনরা তো ওই সময়ে গঙ্গায় বেড়াচ্ছিল! মেয়েটা কি ভাস্বতী হতে পারে? অশুভ চিন্তা একবার পেয়ে বসলে যেতে চায় না। সেটা দূর করার জন্যেই বারীনকে ফোনে ধরার চেষ্টা করলাম। ফোনটা সুইচড অফ। বাকি পথটা কিছুটা উৎকণ্ঠার মধ্যেই কাটল। বাড়িতে পৌঁছলাম সাড়ে ন’টা নাগাদ। বারীনের অ্যাপার্টমেন্টে দেখলাম তালা ঝুলছে। সিঁড়ি দিয়ে যখন উঠছি, বিজয়বাবু নামছেন। চেহারা দেখেই বোঝা যায়, একটা ঝড় বয়ে গেছে ওঁর উপর।

আমাকে দেখে দোতালার ল্যান্ডিং-এ দাঁড়ালেন। “ওর নাম গে, শুনেছেন তো?”

আমার মুখ দিয়ে ফট করে বেরিয়ে গেলো, “ভাস্বতী?”

“নেই। নিখোঁজ!”

“নিখোঁজ মানে?”

বিজয়বাবুর তাড়া ছিল, দোকান খুলতে যাচ্ছেন। যেটুকু জানলাম, সেটা হল শনিবার রাত সাড়ে বারোটার একটু আগেও লঞ্চের পেছনে বসে মেয়েটা বই পড়ছিল। তার একটু পরেই বিজয়বাবু যখন সেখানে যান, ওর কোনও চিহ্ন নেই। ভ্যানিশ্চ!

অনেক প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কিন্তু বিজয়বাবু আর দাঁড়াতে পারলেন না।

জিজ্ঞেস করলাম, “দীপাবউদি বাড়িতে আছেন?”

উনি নামতে নামতে বললেন, “ওর নাম গে, ও আর বারীন একটা ট্রেনিং প্রোগ্রাম-এ তিন দিনের জন্য দুর্গাপুর গেছে।”

বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকলাম। ভাস্বতীর মুখটা বারবার চোখে ভাসছিল। অল্পক্ষণের জন্যেই ওকে দেখেছি, তাও মুখটা একেবারে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছিল। শীলা আর শেখর-দা নিশ্চয় ডিভাস্টেটেড। মনে পড়লো শীলাকে কথা দিয়েছিলাম, প্রমথকে ওর ভাইয়ের কথাটা জানাব। এই মুহূর্তে দ্যাট মাস্ট বি লাস্ট থিং ইন হার মাইন্ড। তবু প্রমথকে ফোন করলাম। কারোর সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো বোধ করব। প্রমথ নেই, ফোন ধরলেন একেনবাবু।

“কেমন আছেন স্যার?”

“ভালো নেই।”

“কেন স্যার?”

“আমার চেনা একটি মেয়ে গঙ্গায় বেড়ানোর সময়ে হাউসবোট থেকে হঠাৎ অদৃশ্য হয়েছে।”

একেনবাবু আমার কথাটা ঠিক ধরতে পারলেন না। “কতদূরে গিয়েছিল বোটটা সমুদ্রের কাছাকাছি?”

“আরে না, বোটের কিছু হয় নি। শুধু মেয়েটা বোট থেকে অদৃশ্য হয়েছে।”

“কী করে?”

“গড নোজ। হয়তো সুইসাইড। অন্য সম্ভাবনা হল খুন, যদি না অ্যাকসিডেন্টালি জলে পড়ে গিয়ে থাকে।”

“সবই সম্ভব স্যার, যদি মনে করেন শি ইজ ডেড।”

“তার মানে?”

মানে স্যার, নিখোঁজ তো অন্য কারণেও হওয়া সম্ভব। হয়তো কোনও লোকের সঙ্গে মেয়েটা পালিয়েছে।”

“হাউ ইজ ইট পসিবল, গঙ্গার মাঝখানে?”

“কখন অদৃশ্য হয়েছে স্যার?”

“মাঝরাতে।”

“বোটটা চলছিল?”

জানি না, তবে অত রাতে বোধহয় নয়।”

“আগে থেকেই হয়তো প্ল্যান করা ছিল স্যার। হাউসবোটে কেউ এসে নৌকো লাগিয়েছে, তাতে উঠেই মেয়েটা চলে গেছে।”

“পালাতে চাইলে তো মেয়েটা বাড়ি থেকে পালাতে পারত! মাঝগঙ্গা থেকে এত কষ্ট করে পালানোর মানেটা কী?”

“গুড পয়েন্ট স্যার। তবে কিনা এক্ষেত্রে পুলিশ আর হয়তো তেমন খোঁজ খবর করবে না। বডি না পাওয়া গেলে ধরে নেবে জলে ভেসে গেছে।”

এই অ্যাঙ্গেল থেকে অবশ্য আমি ভাবিনি।

“কিন্তু এই ভাবে তো মেয়েটাকে একা পেয়ে কেউ অ্যাবডাক্টও করতে পারে!”

“তাও পারে স্যার।”

“তাহলে তো আরেকটা পসিবিলিটি বাড়ল?”

“তা বাড়ল স্যার।”

ভেরি ট্রাবলিং… আর যদি মার্ডার হয়, তাহলে ওই হাউসবোটে যারা ছিল তাদেরই কেউ নিশ্চয় করেছে। সবাই চেনাজানার মধ্যে।”

“এখনই এত দুশ্চিন্তা করছেন কেন স্যার, পুলিশ নিশ্চয় ইনভেস্টিগেট করছে।”

“ধরে নিচ্ছি করছে। আপনার তো সব চেনাজানা লোক, একটু খোঁজ করবেন?”

একেনবাবু এককালে কলকাতা পুলিশে বেশ কয়েক বছর কাজ করেছেন। এখন অবশ্য নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ক্রিমিনোলজি ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যুক্ত, গেস্ট লেকচারার। সাইডে কিছু কিছু গোয়েন্দাগিরি করেন। নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সঙ্গেও বেশ ভালো যোগাযোগ আছে।

“আপনি যখন এত দুর্ভাবনা করছেন স্যার, তখন খোঁজ নেব।”

“থ্যাঙ্ক ইউ। ভালো কথা, প্রমথকে বলবেন আমাকে ফোন করতে। একটি ছেলে আমাদের ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাচ্ছে। যদি কোনও সাহায্যের দরকার হয়, একটু যেন দেখে।”

“ছেলেটি কে স্যার?”

“যে মেয়েটার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, তার মামা।”

“আমাকে নামটা দিয়ে দিন। দরকার হয় আমি দেখব।”

নামটা দিয়ে বললাম, “থ্যাঙ্ক ইউ, আপনি ব্যস্ত মানুষ।”

“কী যে বলেন স্যার, কলকাতার ছেলে, তাকে একটু দেখতে পারব না?”

.

স্নানটান সেরে রেডি হয়ে বেরোতে বেরোতে একটু দেরিই হয়ে গেল। অফিসের কাছাকাছি যখন পৌঁছেছি, তখন ডিপার্টমেন্টের ক্লার্ক নিতাইবাবুর ফোন পেলাম।

“আপনি কি আজ আসছেন?”

“হ্যাঁ। কেন বলুন তো?”

“আপনার জন্য এক ভদ্রলোক বেশ কিছুক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন।”

“আমার জন্য! কে?”

“বললেন তো আপনার বন্ধু, অনিমেষ দত্ত।”

“আমার ঘরে বসান, আমি পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাব। কিন্তু বলে দেবেন দুটোর সময় আমার সেমিনার আছে, বেশিক্ষণ কথা বলতে পারব না।”

.

গতবার এসে অনিমেষের সঙ্গে কয়েকবার দেখা হয়েছে। অনিমেষের মামার বাড়ি আমাদের পুরোনো পাড়ায়। মাঝেমাঝেই ও সেখানে আসত। ছেলেটা পড়াশুনোয় ব্রিলিয়ান্ট ছিল, গানও ভালো গাইত। কিন্তু এম.এসসি পড়তে পড়তেই রাজনীতিতে এমন মাতল, পড়াশুনো উঠল মাথায়। কোনওমতে সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে পাশ করে কিছুদিন এদিক ওদিক করে এখন একটা স্কুলে ফিজিক্স পড়াচ্ছে। টাকাকড়ির অবশ্য অভাব নেই। স্কুলের মাইনের থেকে অনেক বেশি আয় টিউশানিতে। বাড়ির ছাদে একটা বড় ঘর ছিল। সেখানে গ্যালারির মতো চেয়ার বসিয়ে একসঙ্গে কুড়িজনকে পড়ায়! তার সঙ্গে তুলনা করলে আমার নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির দুটো গ্র্যাজুয়েট ক্লাসেও বারোজনের বেশি ছাত্র জোটে না।

.

ঘরে ঢুকে দেখি অনিমেষ বসে আছে। মুখ দেখেই বোঝা যায় বেশ চিন্তিত।

“কীরে, তুই? কেমন আছিস?”

“নট শিওর, তোর একটু সাহায্যের দরকার।”

“কী ব্যাপার?”

“কালকে দুর্ঘটনার কথা শুনেছিস তো?”

“কালকের দুর্ঘটনা!” আমি চট করে ধরতে পারলাম না। তারপরেই খেয়াল হল অনিমেষ বারীনের বন্ধু। “তুই কি ভাস্বতীর…।”

আমায় কথাটা শেষ করতে দিল না অনিমেষ। বলল, “আমিও ছিলাম ওদের সঙ্গে।”

“মাই গড, কী হয়েছিল বল তো?”

“অ্যাবসোলুটলি স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার। রাত সাড়ে বারোটার একটু আগেও ভাস্বতী ডেকে বসেছিল। তার অল্প কিছুক্ষণ বাদে বিজয়দা গিয়ে ওকে দেখতে পাননি। তবে ও যে বোটে নেই সেটা জানতে পারা যায় প্রায় ভোর চারটের সময়ে, যখন শেখদা মেয়েকে ঘরে না দেখে বাইরে আসেন। খোঁজাখুঁজি করে কোথাও না পেয়ে আমাদের সবাইকে ডেকে তোলেন।”

“দাঁড়া দাঁড়া, অত রাত্রে মেয়েটা ওখানে একাই বসেছিল?”

“হ্যাঁ, আমরা সামনের ডেকে গল্পগুজব করছিলাম। কিছুক্ষণ ও আমাদের সঙ্গে ছিল, একটা কোণে বই নিয়ে বসেছিল। তারপর একসময়ে উঠে পেছনের ডেকে চলে যায়।”

“কখন?”

“বলতে পারব না, খেয়াল করিনি।”

“তারপর?”

“তারপর আর কী? বারীনদের পার্টিতে যা হয়, অজস্র মদ্যপান আর ঢলাঢলি। গিয়েছিলাম নিতান্ত বারীনের চাপে পড়ে। আমি ওদের মতো মদও গিলতে পারি না, আর তোকে ফ্র্যাঙ্কলি বলছি, শীলা আর ওর মেয়েকে আমি একটু এড়িয়েই চলি।

কথাটা খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ। তাই বোধহয় বলেই অনিমেষ একটু লজ্জা পেল। আই মিন ড্রিংক করলে শীলা বড্ড গায়ে এসে পড়ে। খারাপ কিছু নয়, শুধু আমার অস্বস্তি হয়।”

“তা তো বুঝলাম, কিন্তু ভাস্বতী কী দোষ করল?”

“আমি ওকে মাস দুই প্রাইভেট পড়িয়েছিলাম। ওর একটু ইয়ে আছে।”

“তার মানে?”

“মানে পড়াশুনোর থেকে ছেলেদের দিকেই ওর বেশি ইন্টারেস্ট। আমার সঙ্গেও ফাজলামির চেষ্টা করত। একবার তো একটা বাজে ক্যারেক্টারের সঙ্গে… যাই হোক, ওটা শোনা কথা।”

ওসব নোংরামি নিয়ে আর প্রশ্ন বাড়াতে চাইলাম না। “ঠিক আছে, ঠিক আছে, বুঝলাম, কিন্তু আমার কাছে কী সাহায্য চাইছিস?”

“সেটাই বলছি। ভাস্বতাঁকে লঞ্চে শেষ দেখি আমি আর বারীন। তারপর থেকে ও অদৃশ্য। পুলিশের যে কর্তাটি তদন্ত করছেন, তিনি এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন আমরা ওঁর কাছে অনেক কিছু লুকোচ্ছি। বারবার একই প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করছেন। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক জেরা করার পরে বলেছেন, আমরা যেন ওঁকে না জানিয়ে কোথাও না যাই। বারীনকে পারমিশন দিয়েছেন ট্রেনিং প্রোগ্রামে যেতে, কিন্তু আমার কলকাতার বাইরে যাওয়া বারণ।”

“কিন্তু পুলিশ তো এইভাবেই তদন্ত করে। তুই ক্লিন, তুই এত চিন্তা করছিস কেন। আর তুই একা তো নোস, বারীনও তো ছিল।”

“তুই বুঝছিস না। পুলিশ কেয়ার লেস অ্যাবাউট সলভিং দ্য কেস। কিন্তু এই ফাঁকে আমাদের ভয় দেখিয়ে যদি টু-পাইস কামাতে পারে, তারই ধান্ধায় আছে।”

“তুই বলছিস ক্লিন চিট পেতে তোকে পয়সা দিতে হবে?”

“ঠিক ধরেছিস।”

“মাই গড! কিন্তু এ ব্যাপারে আমি কী সাহায্য করতে পারি? তুই তো জানিস এখানে আমার কোনও কানেকশন নেই, আমি সাধারণ একজন প্রফেসর।”

আমার ভয় হচ্ছিল অনিমেষ পাঁচ-দশ হাজার ডলার চেয়ে বসবে। এর আগেও অন্য একটা ব্যাপারে ধার চেয়েছিল। সেবার কোনও মতে কাটিয়েছিলাম।

“তোর বন্ধু একেনবাবুর সাহায্য চাই। আমি শিওর হি উইল ফিগার আউট ঠিক কী হয়েছে। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এখানকার পুলিশের উঁচু মহলে ওঁর সুনাম আছে। উনি ব্যাপারটা নিয়ে খোঁজখবর করছেন জানলে খুদে অফিসাররা এইভাবে হ্যারাস করতে পারবে না।”

“একেনবাবুর সঙ্গে আজ সকালে আমার কথা হয়েছে। কিন্তু…।”

“কিন্তু না ভাই, তোকে এটা করতেই হবে। একেনবাবুর প্রাপ্য ফি দেবার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু ভাস্বতীর কী ঘটেছে, তা আমরা সবাই জানতে চাই। একটা সম্মান দক্ষিণা নিশ্চয় সবাই মিলে আমরা দেব।”

“তা না হয় দিবি, কিন্তু উনি তো এখানে নেই। অত দূরে বসে কী করতে পারেন?”

“তাও তুই ওঁকে বল। উনি যা জানতে চান, সব আমরা জানাব। তুই ওঁর হয়ে আমাদের প্রশ্ন কর।”

“আচ্ছা দেখি, এখন তো নিউ ইয়র্কে রাত। আজ রাতে ধরার চেষ্টা করব।”

“কখন ফোন করবি?”

“ধর আটটা নাগাদ। ওখানে তো এখন ডে-লাইট সেভিংস চলছে, তার মানে নিউ ইয়র্কে তখন সকাল সাড়ে দশটা… কথা বলার ভালো সময়।”

“ডে-লাইট সেভিংস’ কী?”

“এক ঘণ্টা সময় এগিয়ে দেওয়া। ওটা নিয়ে ভাবিস না।”

“তাহলে আমি ঠিক আটটার সময়ে তোর বাড়িতে আসব। তুই তো বারীনের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এ আছিস, তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“আমি ওখানেই যেতাম, কিন্তু মনে হল এখানেই তোকে সহজে ধরতে পারব।”

দুটো প্রায় বাজে। আমি ঘড়ি দেখছি দেখে অনিমেষ নিজেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল, “ওই যাঃ, তোর সেমিনারে দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি এখন চলি, রাতে দেখা হবে।”

.

সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় আমি একেনবাবুকে স্কাইপে ধরলাম। স্কাইপ-এর সঙ্গে হয়তো সবাই পরিচিত নন। এটা একটা ফ্রি সফটওয়্যার। যাদের কম্পিউটারে ক্যামেরা আর ব্রডব্যান্ড কানেকশন আছে, তারা এটা ব্যবহার করে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্ত থেকে নিজেদের মধ্যে ভিডিওতে কথা বলতে পারে।

আমি সংক্ষেপে অনিমেষের পরিচয় দিলাম। তারপর ওর সঙ্গে সকালে যা কথা হয়েছে। সংক্ষেপে বলে ওর অনুরোধটা জানালাম। একেনবাবুকে অবশ্য সংক্ষেপে কিছু বলা কঠিন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানান প্রশ্ন করলেন। তারপর বললেন, “আপনার বিশেষ বন্ধু স্যার?”

“বিশেষ না হলেও বন্ধু তো বটেই।”

“আপনি স্যার কী বলেন?”

“আমি আর কী বলব?”

একেনবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, “আপনি যদি সঙ্গে থাকেন, আমি আছি স্যার।”

পেছন থেকে শুনি প্রমথ টিপ্পনী কাটছে, “বাপিকে অ্যাসিস্টেন্ট বানিয়ে লং ডিস্টেন্স ডিটেকটিভগিরি করবেন, আপনার সাহস আছে বটে।”

আমি বললাম, “লুকিয়ে লুকিয়ে কমেন্ট করছিস কেন, সামনে এসে কর।”

প্রমথ গলা বাড়িয়ে ক্যামেরার সামনে মুখটা এনে বলল, “গো টু হেল!”

বলেই আমাকে কোনও উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়ে অদৃশ্য হল। টিপিক্যাল প্রমথ।

আমি একেনবাবুকে বললাম, “আটটার সময় অনিমেষ এখানে আসবে। আপনি কি ওঁর সঙ্গে কথা বলবেন?”

“নিশ্চয় স্যার। তার আগে, আপনি এদের সবার ব্যাকগ্রাউন্ড দিয়ে এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে বলুন।”

আমি পার্টিতে সবার সঙ্গে পরিচয় হওয়া থেকে শুরু করে যা যা মনে পড়ল সবকিছুই বললাম।

“ইন্টারেস্টিং গ্রুপ,” একেনবাবু মন্তব্য করলেন। তারপর বললেন, “যাই বলুন স্যার, আপনার গড়িয়ার লাইফটা তো মনে হচ্ছে নিউ ইয়র্কের থেকে অনেক বেশি এক্সাইটিং।”

“তা যা বলেছেন। এরকম হ্যাঁজার্ডাস ড্রিঙ্কিং এই ধরণের মধ্যবিত্ত পাড়ায় দেখব কল্পনা করিনি। পুরুষ-মহিলা কেউই কম যান না।”

“আপনি মনে হচ্ছে স্যার একটু ডিসগাস্টেড?”

“তা ঠিক নয়, তবে এ ধরণের পার্টি ইজ ব্যাড ফর মাই স্টমাক এন্ড হার্ট।”

কথা বলতে বলতে দেখি আটটা বেজে দশ হয়ে গেছে। বললাম, “বুঝছি না অনিমেষের কি হল, আটটার সময় আসার কথা।”

ঠিক এমন সময়ে ডোর বেল। দরজা খুলে দেখি অনিমেষ।

“দেরি করলি যে?”

“দেরি কোথায়?”

আমারই বোঝা উচিত ছিল। কলকাতায় টাইম মাফিক কেউ চলে না। যাই হোক, আমি বাইরের ঘর থেকে একটা চেয়ার নিয়ে এসে অনিমেষের সঙ্গে কম্পিউটারের সামনে বসলাম। অনিমেষ তো স্কাইপ দেখে মুগ্ধ। মনিটরে একেনবাবুর মুখ দেখে বলল, “এ তো টেলিভিশনের সামনে বসে আছি!”

আমি একেনবাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম।

অনিমেষ ওর বিপদের কথা বিশদ করে বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু একেনবাবু বললেন, “আমি সব শুনেছি স্যার। আমার যেটুকু করার আমি করব। কিন্তু তার আগে আমায় পুরো ব্যাপারটা বুঝতে হবে।”

“আমাকে স্যার বলবেন না। নাম ধরেই ডাকবেন।”

“ওটা আমার হ্যাবিট স্যার।”

অনিমেষকে আমি বললাম, “তুই ওটা পালটাতে পারবি না, এখন উনি যা জানতে চাচ্ছেন বল।”

“বলুন, কী জানতে চান?”

“আমি স্যার সব কিছুই জানতে চাই… যা যা ঘটেছ, দরকারি অদরকারি সবকিছু।”

অনিমেষ একটু ভেবে শুরু করল। হপ্তাতিন আগে আমার বন্ধু বারীন, বাপি ওকে চেনে, এসে বলল যে, ওরা দু’দিনের জন্য বোট-পার্টি করছে। দু’হাজার টাকা লাগবে, খাওয়া থাকা সবকিছু ঐ টাকার মধ্যেই। তবে ড্রিংকস আলাদা। কিন্তু সেটার জন্য আমায় ভাবতে হবে না। আমি আসব কি না। আমি প্রথমে যেতে চাইনি। দু’দিনের জন্য দু’হাজার টাকা খরচ করতে গা খচখচ করছিল। তাছাড়া যে গ্রুপটা যাচ্ছে, তাদের সবার সঙ্গে আমার খুব বনেও না। কিন্তু বারীন এত জোরাজুরি করল যে, ‘না’ বলতে পারলাম না। যাই হোক, পরশুদিন, অর্থাৎ শনিবার সকালে আমরা হাউসবোটে উঠি।”

“কত বড় হাউসবোট স্যার?”

“ছোটো নয়, বেশ বড়ই।”

“একটু ডেসক্রিপশন দিন স্যার। ক’টা কেবিন, কতটা জায়গা…”

“গেস্টদের জন্য পাশাপাশি তিনটে বড় কেবিন, সবগুলোতেই অ্যাটাচড বাথরুম।”

“দাঁড়ান স্যার, পাশাপাশি মানে কী? অ্যালং না অ্যাক্রস?”

“অ্যালং। মানে বলতে চাচ্ছি, বোটের লম্বা দিক ধরে সারি করে তিনটে কেবিন।”

“এবার বুঝেছি স্যার।”

“বোটের সামনে একটা বড় ডেক। সেখানে খাবার আর বসার জায়গা। রান্নাবান্না করার কিচেন গেস্ট কেবিনগুলোর পেছনে। কিচেনের একদিকে ব্যাটারি আর জেনারেটরের ছাউনি, অন্যদিকে বোটের লোকেদের থাকার জায়গা। বোটের একদম পেছনে একটা ছোটো ডেক, সেখানেও কয়েকজন বসতে পারে। সামনে আর পেছনের ডেকে যাবার জন্য কেবিনগুলোর দু’পাশ দিয়ে ছোটো দুটো প্যাসেজ।”

“থ্যাঙ্ক ইউ সার। তারপর?”

“আমাদের পার্টিতে ছিল মোট সাত জন। আমি, বারীন, শেখরদা, বিজয়দা, গীতাবউদি, শীলা, আর ভাস্বতী। ভাস্বতী শীলা আর শেখরদার মেয়ে, যে নিখোঁজ হয়েছে।”

“হ্যাঁ স্যার, ওঁদের পরিচয় আমি বাপিবাবুর কাছে পেয়েছি। তিনটে কেবিন বললেন, আপনারা কে কোথায় ছিলেন?”

“একেবারে পেছনের কেবিনে আমি আর বারীন, মাঝের কেবিনে দীপাবউদি আর বিজয়দা, সামনের কেবিনে শীলা, শেখর-দা আর ভাস্বতী।”

“ঠিক আছে স্যার। বোটে আর কারা ছিলেন?”

বোটের পাইলট কেষ্টবাবু ছিলেন। মিডল-এজড ম্যান, বারীনের পরিচিত। শুনেছি বি.এ. পাশ করা বড়লোকের ছেলে। বাপের টাকাকড়ি খুইয়ে এখন এই ব্যাবসায় নেমেছেন। আর ছিল উনিশ কুড়ি বছরের একটা ছেলে, নাম মন্টু। একটু বোকাসোকা। ওর কাজ রান্না করা, বাসন মাজা, ঘরদোর পরিষ্কার রাখা আর গেস্টদের জন্য অন্যান্য খিদমত খাটা।”

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, বলতে থাকুন।”

“গঙ্গাবক্ষে বিহার মানে গঙ্গাবক্ষে বিহারই। কোথাও নামার কথা ছিল না। প্রোগ্রাম ছিল শনিবার সকাল ন’টায় রওনা দিয়ে বেশ কিছু দূর গিয়ে কোথাও নোঙর করে দাঁড়ানো। সেখানে রাত্রিটা কাটিয়ে রবিবার বিকেলে কলকাতায় ফিরে আসা। আমি প্রথমে না আসতে চাইলেও খুবই এনজয় করছিলাম সারাটা দিন। মন্টু রান্না খারাপ করে না। আর কেষ্টবাবুও বেশ মজাদার লোক। সামনের ডেক যেখানে শেষ হয়েছে, বোটের একদম মুখে পাইলটের জায়গা। সেখানে বসে বোট চালাতে চালাতে নানান গল্পে আমাদের মাতিয়ে রাখছিলেন। সন্ধেতে ঠিক কোথায় আমরা নোঙর করলাম বলতে পারব না, তবে গঙ্গা সেখানে বেশ চওড়া। দূরে একটা ঘাট দেখা যাচ্ছিল, কয়েকজন সেখানে স্নানটান করছিল মনে আছে। দুপুরে প্রচুর খেয়েছিলাম সবাই। রাত্রে খাবারের থেকে পানীয়ের আয়োজনটাই ছিল বেশি। বোট নোঙর করা হয়ে গেছে। আজকের মতো কেষ্টবাবুর পাইলটিং-এর কাজ শেষ। নিজের ঘরে যাবার আগে কেষ্টবাবু ঘোষণা করলেন, রাত ন’টার সময়ে জেনেরেটার বন্ধ করে দেওয়া হবে। তার আগেই যেন রাতের খাওয়া খেয়ে নিই।

“তারমানে? এখানে আলো থাকবে না?’ আমরা সবাই হইহই করে উঠলাম।

‘তা নয়, আলো থাকবে, হ্যারিকেনের আলো। ন’টার একটু আগে মন্টু এসে কয়েকটা হ্যারিকেন রেখে যাবে। সেগুলোও মন্টু এসে ঠিক সাড়ে বারোটার সময়ে নিয়ে যাবে।‘

শেখরদা সেটা শুনে প্রতিবাদ করলেন, এ আবার কী নিয়ম? ডেকে সাড়ে বারোটার পর থাকতে পারব না?’

‘তা পারবেন না কেন? কিন্তু আলো থাকবে না।‘

বারীনও বিরক্ত হয়ে বলল, না, সেটা হয় না। মহিলারা আছেন, একটা হ্যারিকেন অন্ততঃ জ্বলুক।’

“ঠিক আছে, ঠিক আছে। মন্টুকে বলে দেব একটা হ্যারিকেন রেখে দেবে।“

“আর ঘরের আলো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

কেষ্টবাবু বললেন, ‘ঘরের কমজোরি আলো সবসময়েই থাকবে, ওটা ব্যাটারিতে চলে।”

“আমি একটু কনফিসড স্যার,” একেনবাবু অনিমেষের কথার মাঝখানেই বললেন, “হ্যারিকেন তো নিভিয়ে দিলেই হয়, সেগুলো তুলে নিয়ে যাবার কারণটা কী?”

“কেষ্টবাবু চলে যাবার পর সেটা নিয়েই আমাদের মধ্যে একটু আলোচনা হল। বারীন বলল, হয়তো চুরি হয়ে যাবে বলে।

মাঝগঙ্গায় কে হ্যারিকেন চুরি করতে আসবে? হোয়াট ননসেন্স!’ শেখরদা বললেন।

‘আমার কিন্তু ভয় করছে,’ দীপাবউদি বললেন, ‘জায়গাটা সেফ তো?’

‘খুবই নিরাপদ, বারীন সবাইকে আশ্বস্ত করল। কেষ্টবাবু দু’বছর ধরে এই ব্যাবসা করছেন, কোনও সমস্যা হয়েছে বলে তো শুনিনি।’

যাইহোক রাতের খাওয়াটা গৌণ। খাওয়া দাওয়ার পর পানীয়ের আসর বসল। শেখরদা আর বারীন গান ধরল। আমিও দুয়েকটা গান গাইলাম। ন’টা বাজার ঠিক কয়েক মিনিট আগে মন্টু এসে চারটে হ্যারিকেন রেখে গেল। কেষ্টবাবু আমাদের গুডনাইট বলতে এলেন।

বারীন কেষ্টবাবুকে বলল, “আপনিও বসুন না, আমাদের সঙ্গে?”

‘না, আমি যাই।‘ বুঝলাম সংকোচ বোধ করছেন।

‘খালি হাতে যাবেন কেন,’ বারীন একটা গ্লাসে মদ ঢেলে কেষ্টবাবুকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা নিয়ে যান।‘

কেষ্টবাবু সেটা নিতেও অস্বস্তি বোধ করছেন দেখে বারীন বলল, ‘আরে মশাই, আপনি তো আর মদ খেয়ে বোট চালাচ্ছেন ন। অফ ডিউটিতে খাচ্ছেন। কালকে যখন চালাবেন, এক ফোঁটা অ্যালকোহলও থাকবে না শরীরে।‘

তাতেই কাজ হল, গ্লাসটা হাতে নিয়ে ‘গুডনাইট’ বলে কেষ্টবাবু বিদায় নিলেন। এর কয়েক মিনিট বাদেই আলো নিভে গেল।

তখন বোধহয় শীলার খেয়াল হল, ভাস্বতী নেই। ‘ভাস্বতী কোথায়?

ভাস্বতী পেছনের ডেকে চলে গেছে অনেক আগেই। আমি মধ্যে একবার বাথরুমে গিয়েছিলাম। ফেরার সময়ে দেখেছিলাম ও পেছনের ডেকে বসে বই পড়ছে। আমায় দেখতে পেয়ে হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল। ভাস্বতাঁকে আমি একটু এড়িয়েই চলি। কিন্তু ডাকলে তো আর না গিয়ে পারা যায় না।”

“আমি একটু কনফিউসড স্যার,” একেনবাবু বাধা দিয়ে বললেন, “কেন আপনি মিস ভাস্বতাঁকে এড়িয়ে চলেন?”

“আসলে”… অনিমেষ একটু আমতা আমতা করল। মনে হল যে নিখোঁজ বা মৃত, তার সম্পর্কে মন্তব্য করতে অসুবিধা বোধ করছে। “আই মিন ও একটু গায়ে পড়া… আর কিছু নয়।”

“আই সি, তারপর?”

“আমি কাছে যেতেই ও বলল, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। ও আপনি টাপনির ধার ধারে না, প্রায় সবাইকেই তুমি করে বলে।

‘কী সারপ্রাইজ?’

“এখানে বলা যাবে না, তোমার বন্ধু রাগ করবে। পরে তোমার বাড়ি গিয়ে বলব।”

“দাঁড়ান স্যার, ‘আপনার বন্ধু’ বলতে কাকে মেয়েটি মিন করেছিল?”

“বোধহয় বারীন, কিন্তু নাম করে বলেনি।”

“বন্ধুটি কে, আপনি জিজ্ঞেস করেননি স্যার?”

“না, সত্যি কথা বলতে কি, আমার সঙ্গে যখন কথা বলছিল ওর চোখেমুখে একটা কিছু ছিল, যেটা আমার ভালো লাগেনি।”

“কী ছিল স্যার?”

“ঠিক বলতে পারব না। আসলে ও খুব মুডি আর আনপ্রেডিক্টেবল। মনে হচ্ছিল হঠাৎ কিছু বলে বসবে বা করে ফেলবে, যার জন্য আনপ্লেজেন্ট সিচুয়েশনের মধ্যে পড়ব। আমি আর ওখানে দাঁড়াইনি।”

“মিস ভাস্বতী কি ড্রিংক করছিল স্যার?”

“মনে হয় না। মদের বোতলগুলো সব সামনের ডেকে ছিল। এমনিতে ও ড্রিংক করে বলে তো শুনিনি।”

“যেটা আমায় বললেন, সেটা কি আপনি পুলিশকে জানিয়েছেন?”

“না। এটা কি খুব রেলেভেন্ট?”

“হু নোজ স্যার! ভালো কথা, মিস ভাস্বতাঁকে আপনি কতদিন চেনেন?”

“তা প্রায় এক বছর হবে। বারীন একদিন এসে বলল, ওর পরিচিত একটি মেয়ে স্কুলে ভীষণ বাজে রেজাল্ট করছে। ফাইনাল ইয়ার, কিন্তু টিউটর ছুটিতে। আমি যদি এই সময়টাতে একটু পড়িয়ে দিই। বারীন বিশেষ করে বলাতে ওকে মাস দুই প্রাইভেট পড়িয়েছিলাম। সেই থেকে ওর বাবা-মা শেখরদা আর শীলার সঙ্গেও আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়।”

“ঠিক আছে, বলুন স্যার।”

“আমি শীলাকে বললাম, একটু আগেই পেছনে ডেকে দেখলাম বই পড়ছে।

শীলা বলল, “বুঝেছি, বারীনের সেই সিনেমার বই। কী উপহারই যে মেয়েটাকে দিয়েছে!

‘দাঁড়াও আমি একবার দেখে আসি,’ বলে শেখরদা উঠে পিছনে গেলেন। খানিক বাদেই ফিরে এসে বললেন, ‘ঠিকই বলেছে অনিমেষ, ডেকে বসে বই পড়ছে।‘

শীলা অবাক হয়ে বলল, ‘হ্যারিকেনের আলোয়?”

শেখরদা উত্তর দিলেন, ‘মেয়েকে তো চেনো।‘

“ও, একটা কথা কথা বলতে ভুলে গেছি, সেদিন পূর্ণিমা ছিল। হ্যারিকেনের আলো না থাকলেও আমাদের চলাফেরাতে তেমন অসুবিধা হচ্ছিল না।”

এ পর্যন্ত বলে, অনিমেষ একটু চুপ করে থেকে বলল, “আমি কি বেশি ডিটেল-এ বলছি?”

“এতটুকু না স্যার, প্লিজ বলুন।”

“তারপর সবারই নেশা চড়তে শুরু করেছে। বারটেন্ডার হচ্ছে বারীন। মজার ব্যাপার, আমি যে বেশি মদ খেয়েছি তা নয়। কিন্তু নিজেকে একটু জানি আনস্টেডি লাগতে শুরু করেছে। ইনফ্যাক্ট শেখরাও বললেন, বারীন, এটা এই বোটের গুণ না চাঁদের আলো জানি না, কিন্তু আজ এক গেলাসেই দু’গেলাসের নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে!

বারীন ফাজলামি করল, কেন, আমার হাতের জাদু বলছেন না কেন?

‘তাও বলছি,’ শেখরদা হাসতে হাসতে বললেন।

শীলা একটু ‘হাই’ হয়ে গেলে কী যে করে ঠিক ঠিকানা নেই। হঠাৎ এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ওর সঙ্গে গাইতে হবে।

‘কী গান?’

‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ!’

বললাম ‘সব কথা আমার মনে নেই।

‘মনে না থাকলে বানাও… তাই দিয়েই আমার সঙ্গে গাও। না গাইলে তোমাকে আজ ছাড়ব না।’ বলে আরও টাইট করে আমায় জড়িয়ে ধরল।

যে রেটে বারীন সবাইকে মদ গিলিয়েছে, বেশ বুঝতে পারছিলাম নিজের উপর কন্ট্রোল হারিয়েছি। আমিও শীলাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। শীলা কানে কানে বলল, ‘গাওয়ার পরও যদি না ছাড়ি?’ এর পর ঠিক কী ঘটেছিল পরিষ্কার করে বলতে পারব না। শুধু মনে পড়ছে গাইতে গিয়ে দুজনেই কথা ভুলে যাচ্ছিলাম, যা খুশি তাই লাগিয়ে দিচ্ছিলাম। দীপাবউদি গানের মাঝখানেই বলে উঠলেন, ‘শীলা, তুই বড় বাড়াবাড়ি করছিস, এবার ঘরে যা।‘

এরপর যেটা মনে আছে, বারীন আমার চোখেমুখে জলের ঝাঁপটা দিচ্ছে। বারীনকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী রে আউট হয়ে গিয়েছি?”

‘তা একটু গিয়েছিস। এখন কেমন বোধ করছিস?’

‘আমি ঠিক আছি। ওরা সবাই কোথায়?’

‘যে যার ঘরে, এখানে শুধু তুই আর আমি।‘

‘ক’টা বাজে?’

‘অনেক রাত। চল, ঘরে চল।’ বলে আমাকে ধরে বারীন তুলল।

আমি ঘড়িতে দেখলাম বারোটা কুড়ি। ‘ছাড়, আমি নিজেই হাঁটতে পারব।‘

কেবিনের দরজার সামনে যখন এসেছি বারীন বলল, “দাঁড়া, ভাস্বতী কি এখনও পিছনে বসে আছে?”

একটু সরে উঁকি দিয়ে দেখলাম ঠিক তাই। বারীন তখন এগিয়ে গিয়ে ভাস্বতাঁকে কী যেন বলল। ভাস্বতী মাথা নাড়ল।

‘ওকে এক্ষুনি ঘরে যেতে বললাম, বারীন বলল। সবাই শুয়ে পড়েছে। এভাবে একা একা বসে থাকা সেফ নয়।’

‘আমি ঘরে যাচ্ছি, আর দাঁড়াতে পারছি না, বলতে বলতে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম, বারীন চট করে ধরে ফেলল। তারপর আমাকে এনে বিছানায় শুইয়ে দিল। পেটটা ভীষণ গোলাচ্ছিল, এত খারাপ আগে কখনও বোধ করিনি। আজ মরেই যাব রে, বারীনকে বললাম।

‘অত সহজে মরবি না,’ বারীন অভয় দিলো, ‘গা গোলাচ্ছে?’

‘ভীষণ।’

‘বাথরুমে যা, বমি করলে একটু ভালো লাগবে।‘

বেশ খানিক্ষণ বমি করার পর চোখে মুখে জল দিয়ে যখন ফিরলাম, তখন একটু ভালো ফিল করছি। দেখলাম বারীনের হাতে একটা ফেনাচ্ছল গ্লাস।

‘এটা খেয়ে দেখতে পারিস, একটু রিলিফ পাবি।‘

‘দে,’ বলে ঢক ঢক করে খেলাম। বারীনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হ্যাঁ রে, আমি বেশি মাতলামো করিনি তো?’

বারীন বলল, ‘তা একটু করেছিস, শীলাও করেছে। বাট ইট ইজ অ্যামং ফ্রেন্ডস, কেউ মাইন্ড করেনি।’

‘কী করেছি বল তো?”

‘এখন শোনার দরকার নেই, ঘুমো।‘

‘না, বল।’

‘শুনে লাভটা কী হবে, যা হয়েছে তা হয়েছে। আর বলছি তো সবাই জানে যে তোরা একটু বেশি আউট হয়ে গিয়েছিলি। আউট তো অল্পবিস্তর আমরা সবাই হয়েছিলাম। মদ খাব অথচ নেশা হবে না, তাহলে আর মদ খাওয়া কেন!’

এইরকম আরও কিছু কথা হয়তো হয়েছিল, আমার এখন মনে নেই। শুধু মনে আছে, বারীন যখন বলল, ‘চোখ বোজ, ঘরের বাতি নেভাচ্ছি, তখন ঠিক সাড়ে বারোটা।‘

“আপনি শিওর স্যার?”

“হ্যাঁ, ঘুমোতে যাবার সময় আলো নেভার আগে আমি সব সময়ে ঘড়ি দেখি, ওটা আমার বরাবরের অভ্যাস।”

“আই সি, স্যার, তারপর?”

“তারপর যখন ঘুম ভাঙল, তখন ভোর প্রায় চারটে। দরজায় ভীষণ ধাক্কা। সবাই উদ্ৰান্ত, ভাস্বতাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না! এটাই হল ঘটনা।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার, আপনার কথায় যা বুঝলাম, সাড়ে বারোটার একটু আগেও মিস ভাস্বতী ডেকে বসেছিলেন। ঠিক?”

“হ্যাঁ। আর সাড়ে বারোটার পরে ওকে দেখতে পাওয়া যায়নি। বিজয়দা সাড়ে বারোটা নাগাদ পেছনের ডেকে গিয়েছিলেন, তখন ভাস্বতী ছিল না। প্রায় একই সময়ে মন্টুও হ্যারিকেন নিতে পেছনের ডেকে যায়। বিজয়দার সঙ্গে ওর দেখাও হয়।”

“আমি একটু কনফিউসড স্যার, বিজয়বাবু ওখানে কেন গিয়েছিলেন?”

“বিজয়দার কাছে যা শুনেছি, ওঁরও গা গোলাচ্ছিল। কেবিনের বদ্ধ বাতাসে দম আটকে আসছিল, ঘুমোতে পারছিলেন না। হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনে কীসের আওয়াজ দেখতে প্রথমে সামনের ডেকে যান। সেখানে কিছু দেখতে না পেয়ে পেছনের ডেকে আসেন।”

“বিজয়দা ওখানে আগে গিয়েছিলেন, না মন্টু?”

“তা বলতে পারব না, বোধহয় প্রায় একই সময়ে।”

“কী ধরণের আওয়াজ বিজয়বাবু শুনেছিলেন?”

“ধপ করে একটা আওয়াজ আর জলে কিছু পড়ার শব্দ। আর সেই সঙ্গে পায়ের আওয়াজ। মন্টু তখন হ্যারিকেনগুলো নিয়ে হাঁটছিল, সুতরাং পায়ের আওয়াজ শুনতে পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।”

“আপনি কোনও শব্দ শুনেছিলেন?”

“না, তখন বোধহয় আমি ঘুমিয়ে পড়েছি।”

“বারীনবাবু?”

“বারীনও শোনেনি। ও-ও ঘুমোচ্ছিল।”

“বিজয়বাবুর সঙ্গে কি কথা বলা যাবে?” আমায় জিজ্ঞেস করলেন, একেনবাবু।”

“এখুনি ওঁকে পাব না। দোকান বন্ধ করে আসতে আসতে ওঁর ন’টা বেজে যায়। উনি এলেই ধরার চেষ্টা করব। আপনি বাড়িতে থাকবেন?”

“থাকব স্যার।”বলে অনিমেষের উদ্দেশ্যে বললেন, “আর কিছু মনে পড়ছে স্যার ভাস্বতীর ব্যাপারে?”

“ও হ্যাঁ, একটা কথা। জানি না কতটা রেলেভেন্ট। ভাস্বতাঁকে কেউ কিছুদিন ধরে খুব উত্ত্যক্ত করছিল।”

“উত্ত্যক্ত বলতে?”

“লোকটি ভাস্বতাঁকে বিয়ে করতে চায়। না বললে শুনবে না, না চাইলেও ওর হাতেই ভাস্বতাঁকে ধরা দিতে হবে, ওর সন্তানের মা হতে হবে… এইসব আজেবাজে কথা।”

“লোকটি কে?”

“তা বলতে পারব না। তবে বারীনকে ও বলেছিল। বারীনের কাছ থেকেই কথাটা শুনেছি।”

“মিস ভাস্বতী মা-বাবাকে এটা জানায়নি?

“না। বারীনের ধারণা ভাস্বতী এ কথা বাড়িতে বললে শীলা ওকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেবে না। এমনিতেই শীলা সবসময়ে চোখে চোখে রাখে।”

“আই সি স্যার, তার মানে ধরে নিচ্ছি বারীনবাবুও জানাননি।”

“না, কিন্তু আমার বিশ্বাস এ ব্যাপারে বারীন একটা অ্যাকশন নিয়েছিল। তবে সেটা কী, ঠিক জানি না।”

“ইন্টারেস্টিং, পুলিশ এ কথা জানে?”

“বারীন নিশ্চয় বলেছে। তবে পুলিশ আমাদের কারোর কথাই খুব বিশ্বাস করছে বলে মনে হচ্ছে না।”

“তদন্ত করছেন কে?”

“মলয় রায় বলে একজন ইনস্পেক্টর। আপনি চেনেন?”

“মনে করতে পারছি না। তবে খোঁজ নেব।”

“কাইন্ডলি একটু খোঁজ করুন। মনে হচ্ছে ওঁর হাত থেকে আমরা সহজে ছাড়া পাব না। কালকে আবার সকাল ন’টায় আমায় হাজিরা দিতে হবে।”

.

অনিমেষ চলে যাবার খানিকবাদেই পাশের অ্যাপার্টমেন্টে তালা খোলার আওয়াজ এল। অর্থাৎ, বিজয়বাবু ফিরেছেন। গিয়ে ডোরবেল বাজাতেই দরজা খুললেন। খুবই ক্লান্তশ্রান্ত, কিন্তু তাও মনে হল একেনবাবুর কথাটা ওঁকে জানাই। আমার কাছে সব শুনে বললেন,

পুলিশ ওঁকেও হ্যারাস করছে।

আমি বললাম, “আপনি কি এখন একটু আসতে পারবেন? একেনবাবু আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।”

“ওর নাম গে, ফোনে?”

“ঠিক ফোনে নয়। আসুন না, দেখতে পাবেন।”

“চলুন।”

আমি ওঁকে কম্পিউটারের সামনে বসিয়ে আবার স্কাইপে একেনবাবুকে ধরলাম। একেনবাবুর মুখ মনিটরে দেখতে পেয়ে বিজয়বাবু বললেন, “ওর নাম গে, এত ম্যাজিক!”

বিজয়বাবু সম্পর্কে আমি আগেই একেনবাবুকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম। স্বল্পভাষী, বেশি কোনও বর্ণনা আশা করবেন না। একেনবাবু গুটিকতক প্রশ্নই করলেন। তাতে অনিমেষ যা বলেছিল, সেটাই কনফার্মড হল। নতুন যা জানলাম, তা হল শীলা আর শেখর-দা শুতে চলে যাবার একটু পরেই পৌনে বারোটা নাগাদ বিজয়বাবুরা নিজেদের ঘরে যান। দীপাবউদি ঘরে ঢোকার পর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়েন, বিজয়বাবু মিনিট পাঁচেক বাদে। সোয়া বারোটা নাগাদ ওঁর ঘুম হঠাৎ ভেঙ্গে যায়। শরীরটা ভালো লাগছিল না, বিছানাতে শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছিলেন। খানিক বাদে একটা ধপ আওয়াজ শোনেন আর জলে কিছু পড়ার শব্দ। পায়ের আওয়াজও পান।

এছাড়া অন্য কোনও শব্দ বা আওয়াজ উনি শোনেননি। এমনিতে উনি বেরোতেন না। কিন্তু ছোট্ট কেবিনের মধ্যে এত দমবন্ধ লাগছিল… বাইরের বাতাসে একটু ভালো বোধ করবেন ভেবে বেরিয়েছিলেন। বেরিয়ে অবশ্য কিছু চোখে পড়েনি। মন্টু হ্যারিকেন নিয়ে সামনের ডেক থেকে আসছিল, বুঝলেন ওর পায়ের আওয়াজই শুনেছিলেন। সময়টা সাড়ে বারোটার কয়েক মিনিট এদিক-ওদিক হয়তো হবে, নিজে ঘড়ি মিলিয়ে দেখেননি। তবে মন্টুর সাড়ে বারোটার সময় হ্যারিকেন নিয়ে যাবার কথা ছিল, তাই ধরে নিচ্ছেন সাড়ে বারোটাই হবে। জলের আওয়াজটা সম্ভবত কোনও বড় মাছের ঘাইয়ের আওয়াজ, সেটাই তখন মনে হয়েছিল।

বিজয়বাবুর কথা শেষ হতেই একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “একটা প্রশ্ন স্যার, আপনি ঘর থেকে বেরিয়ে কোনদিকে গিয়েছিলেন, সামনের ডেকে না পেছনের ডেকে?”

“পেছনের।”

“সামনের ডেকে নয় কেন স্যার, ওদিকটাই তো খোলামেলা বেশি ছিল?”

“ওর নাম গে, অত ভেবে কোথাও যাইনি। মন্টু পেছনের ডেকে যাচ্ছিল, আমিও ওর সঙ্গে যাই।”

“গিয়ে কী দেখলেন স্যার?”

“কিছুই না, পুরোপুরি অন্ধকার।”

“আমি একটু কনফিউসড, স্যার। আপনি বলছেন অন্ধকার, কিন্তু পেছনের ডেকে একটা হ্যারিকেন জ্বলছিল না?”

“না।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং, কোথায় গেল সেটা?”

“ওর নাম গে, কে জানে! মন্টু ওটা খুঁজছিল।”

“পেয়েছিল?”

“বোধহয় না। ঘুম পাচ্ছিল বলে বেশিক্ষণ দাঁড়াইনি, কেবিনে গিয়ে শুয়ে পড়ি।”

Sujan Dasgupta ।। সুজন দাশগুপ্ত