।। ৪ ।

আমরা অল্প পরেই একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে পৌঁছলাম। পোকোনোর এই দিকটা পুরোনো, দুয়েকটা ম্যানশন ছাড়া ছোটো ছোটো বাড়ি আর অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এ ভরা। সংস্কারের অভাবে অনেকগুলোরই জরাজীর্ণ অবস্থা। একটা ডুপ্লেক্স বিল্ডিং-এর বাঁদিকের দরজা খুলে বিল বললেন, “এটাই প্রফেসরের অ্যাপার্টমেন্ট। কোনো কিছু সরানো হয়নি।”

ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে একেনবাবু প্রশ্ন করলেন, “মারা যাবার ঠিক আগে দুয়েকদিনের মধ্যে ওঁর বাড়িতে কি কেউ এসেছিলেন?”

“কেবল সার্ভিসের একটি লোক এসেছিল। তার কাছে জেনেছি ওঁর কেবল টিভি কাজ করছিল না, সার্ভিস কল ছিল। আর কুরিয়র সার্ভিসের একটা লোক এসেছিল পার্সেল ডেলিভারি করতে।”

“কিসের পার্সেল স্যার?”

“বইয়ের।” বলে একটা বেডরুম, যেটা প্রফেসর মনে হয় স্টাডি হিসেবে ব্যবহার করতেন সেখানে ঢুকে টেবিলের ওপর রাখা বইয়ের একটা ভোলা পার্সেল দেখালেন। টেবিলের উপরে বেশ কয়েকটা ভাঙা পাথরের মূর্তি আর কিছু কাগজপত্র ছড়ানো। একেনবাবু দেখলাম খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেগুলো দেখছেন।

“ও একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস, সেটাও আপনাকে দেখাই,” বলে টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা চিঠি বের করলেন। চিঠিটা পুরোনো, পাতার নানা জায়গায় খাঁজ পড়া, কোনো তারিখ দেওয়া নেই। ইংরেজিতে লেখা চিঠি যার অনুবাদ–

প্রিয়তম R,

তুমি ভয় পাচ্ছো আমাদের সম্পর্কের কথা ও আঁচ করছে। সে তো আগেও করেছে, তাতে কী হয়েছে? আমি মনঃস্থির করেছি ওকে ছেড়ে তোমার সঙ্গেই থাকব; আর দেরি কোরো না। আগেও লিখেছি, আবার লিখছি এক্ষুণি চলে এসো।

তোমার জানোই তো কে, C

“কার লেখা স্যার এটা?”

“রবার্ট উডের এক্স-ওয়াইফের। ওঁর বহু প্রেমিক ছিল বলে বাজারে গুজব। প্রফেসর উড ছিলেন সেই প্রেমিক দলের সপ্তম বা অষ্টম।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার, ভেরি ইন্টারেস্টিং। আর কোনো চিঠি পেয়েছেন?”

“না, পার্সোনাল চিঠি বলতে ওই একটাই।”

আবার ‘ভেরি ইন্টারেস্টিং’ বলে একেনবাবু এদিক ওদিক ঘরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। একটা আলমারিতে বেশ কিছু ছোটোবড়ো পাথরের টুকরো, কয়েকটা ভাঙ্গা মূর্তি, পাথরের ফলা, ধাতুতে গড়া ছোটোখাটো কয়েকটা জিনিস –ঠিক কী বুঝলাম না, তবে সবগুলোই ধূলিধূসরিত অবস্থায় পড়ে আছে। বইপত্র কিছু আলমারিতে, কিছু মেঝেতে –বলতে গেলে যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে। টেবিল ল্যাম্পের শেডটা ভাঙ্গা। সমস্ত ঘরটাই অত্যন্ত অগোছালো।

একেনবাবু আলমারির জিনিসগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, “এগুলোর দাম কত হবে স্যার?”

“গুড কোয়েশ্চেন। এত পুরোনো জিনিস যখন, কালেকটারদের কাছে দাম নিশ্চয় আছে।” বিল ক্রস বললেন।

“ওঁর কোনো ইন্সিওরেন্স ছিল?” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট জিজ্ঞেস করলেন।

“সাধারণ অ্যাপার্টমেন্ট ইন্সিওরেন্স। জিনিসপত্রের জন্য বড়োজোর পঞ্চাশ হাজার ডলারের কাভারেজ।”

আমার নিজের এইসব জিনিস সম্পর্কে ধারণা নেই। তাও মনে হল যতগুলো জিনিস রয়েছে দেখলাম, সেগুলোর দাম কম হবে না। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট একটা পাথরের মূর্তি তুলে বললেন, “হয়তো হাজার হাজার ডলার খরচা করে উনি এগুলোই কিনতেন। কুড বি স্মাগলড গুডস।”

আমিও তাই ভাবছিলাম। প্রফেসর উডের সঙ্গে নিশ্চয় কোনো ইন্টারন্যাশনাল গ্যাং-এর যোগাযোগ ছিল যারা এইসব প্রত্নতাত্বিক জিনিস চুরি করে ওঁকে বিক্রি করত।

বিল ক্রসের মাথায় বোধ হয় সেই চিন্তাটা আগে আসেনি। একটু চিন্তিত ভাবেই বললেন, “কোয়াইট পসিবল। এইসব লোকদের সঙ্গে ক্যাশ দিয়েই কারবার করতে হয়।”

একেনবাবু দেখলাম গম্ভীরভাবে, কী জানি ভাবছেন। বললেন, “এবার চলুন স্যার, খাদটার কাছে যাই।”

“নিশ্চয়।”

.

জায়গাটা খুব একটা দূরে নয়। হাঁটা পথে মিনিট পাঁচেক। যে পথটা পাহাড়ের ধার দিয়ে নেমে বড় রাস্তায় পড়েছে তার পাশ দিয়ে বেড়িয়েছে একটা সরু পায়ে হাঁটার পথ। চারিদিক গাছপালায় ঢাকা। শেষ হয়েছে ছোট্ট একফালি মাঠে। সেখানে দু’টো বসার বেঞ্চি যেখান থেকে নীচে পোকোনো মেইন রোডটা এঁকে বেঁকে গেছে দেখা যায়। বেঞ্চিগুলোর ফিট দশেক সামনে নীচু জরাজীর্ণ তারের বেড়া। সেখানে কিছু দূর অন্তর অন্তর সাবধানবাণী আটকানো। বেড়াটা অনেক জায়গাতে ভেঙ্গে পড়েছে। সেখানে ‘ওয়ার্নিং সাইন ঝুলিয়ে প্লাস্টিকের হলুদ ফিতে লাগানো। কিন্তু বেড়া বা প্লাস্টিকের ফিতে কোনোটাই খুব একটা সুরক্ষা দিচ্ছে না। বেড়ার ঠিক পেছন থেকেই শুরু হয়েছে গভীর খাদ। সতর্ক না হয়ে পাশ দিয়ে হাঁটলে উলটে খাদে পড়ে যাওয়াটা অসম্ভব নয়। সেই খাদেই মৃতদেহটা পাওয়া গিয়েছিল।

আমরা সেদিকে তাকিয়ে আছি দেখে বিল ক্রস বললেন, “বেড়টা বেশ কিছুদিন ধরেই ভাঙ্গা। পুলিশ রিপোর্টও করেছে সারানোর জন্য, কিন্তু পোকোনো মিউনিসিপ্যালিটি। এখনও সময় করে উঠতে পারেনি। হলুদ ফিতেটা ডেডবডিটা পাওয়ার পরে পুলিশ লাগিয়েছে।”

একেনবাবু এগিয়ে গিয়ে খাদের সামনে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে খানিকক্ষণ দেখলেন। আমার কোনো উঁচু জায়গা থেকে নীচের দিকে তাকালেই মাথা ঘুরতে থাকে। আমি কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে সরে এলাম। তারমধ্যেই দেখলাম প্রায় তিরিশ ফুট নীচে পাথরের একটা চাঁই বারান্দার মতো বেড়িয়ে আছে। সেখানেই নাকি ডেডবডিটা পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু খাদের শেষ অন্ততঃ আরও একশো ফুট নীচে হবে।

বিল ক্রস সঙ্গে একটা ফাইল নিয়ে এসেছিলেন খেয়াল করিনি। সেটা খুলে যে অবস্থায় প্রফেসর উডের মৃতদেহটা আবিষ্কৃত হয়েছিল তার কয়েকটা ক্লোজ-আপ ছবি দেখালেন। মৃতদেহের ছবি দেখতে আমার অসুবিধা হয়। তাই ভালো করে তাকালাম না। তবু দেখলাম রক্তাক্ত একটা দেহ চিৎ অবস্থায় ছেতরে পড়ে আছে। মাথার পাশে একটা মলাট খোলা বই আর কয়েকটা পাথরের টুকরো।

একেনবাবু দেখলাম খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটা দেখছেন। “ছবিটার একটা কপি পেতে পারি স্যার?”

“নিশ্চয়, কিন্তু কী বুঝছেন?” বিল ক্রস জিজ্ঞেস করলেন।

“ভেরি ইন্টারেস্টিং, স্যার।”

“বইটা আর পাথরের টুকরোগুলোর কথা বলছেন?” বিল ক্রস বললেন। “বইটা প্রফেসর উডের। পাথরের টুকরোগুলোও ওঁর বাড়ির আলমারির পাথরগুলোর সঙ্গে ম্যাচ করেছে। উনি বাড়ি থেকে বইপত্র, পাথরের মূর্তি –এইসব নিয়ে এখানে এসে প্রায়ই বসতেন। এখানে বসেই নাকি ভাবনা-চিন্তা গবেষণা সব করতেন।”

“টিপিক্যাল খ্যাপা প্রফেসর,” স্টুয়ার্ট সাহেব মন্তব্য করলেন।

“এক্সাক্টলি,” বিল ক্রস স্টুয়ার্ট সাহেবকে বললেন। “আমার বিশ্বাস এটা আত্মহত্যাই। শুধু টাকার ব্যাপারটাই রহস্য হয়ে ছিল। কিন্তু তোমার অ্যাঙ্গেল ধরে এগোলে, সেটাও মনে হয় এক্সপ্লেইন করা যাবে।”

সেদিন ফিরতে ফিরতে আমাদের সন্ধ্যা হল। ফেরার পথে নানান কথার মধ্যে একেনবাবু আচমকা বলে উঠলেন, “আমি এখনও পাজলড স্যার।”

“কীসের কথা বলছ?” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট জিজ্ঞেস করলেন।

“এই যে গবেষণা করার জন্য বাড়ি থেকে বইপত্তর আর পাথর এনে সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আত্মহত্যা। খুবই পিজলিং। কেন অধ্যাপক মশাই সেটা করলেন? কেন স্যার উনি কেবল টিভি সারাতে ডাকলেন, বই কিনলেন? মরে যাবার পর তো কেউ টিভি দেখে না, বইও পড়ে না… আমি সত্যিই কনফিউজড স্যার।”

বুঝলাম আমরা নানান কথা বলছি, কিন্তু প্রফেসরের মৃত্যুটা ওঁর মাথায় এখনও ঘুরছে।

Sujan Dasgupta ।। সুজন দাশগুপ্ত