।। ৪ ।।

দিন কয়েক আমার আর একেনবাবুর কাছে যাওয়া হয়নি। যাদবপুরে একটা সেমিনার ছিল, সেই নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। এর মধ্যে প্রমথ এসে বলল একেনবাবু নাকি বেশ তেড়েফুড়ে নন্দিতার কেস নিয়ে পড়েছেন। ইতিমধ্যেই পুলিশের কাছ থেকে ক্রাইম সিনের বিস্তারিত রিপোর্ট জোগাড় করেছেন। ভাস্বতী নামে মেয়েটার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। সমুবাবুকে এখনও ধরতে পারেননি।

বিস্তারিত রিপোর্টটা কী জিজ্ঞেস করাতে প্রমথ গড়গড় করে যা বলল সেটা হল আততায়ী মনে হয় নন্দিতার পরিচিত। ঘরের দরজা ভাঙা হয়নি, সম্ভবত নন্দিতাই তাকে ঘরে ঢুকতে দিয়েছিল বা তাকে নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল। অর্ধনগ্ন দেহে অত্যাচারের চিহ দেখে বোঝা যায় বলাঙ্কার করা হয়েছিল। কিন্তু ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মনে হয় নন্দিতা বাধা দেওয়ায় আততায়ী গলা টিপে ধরে। পরে গলায় দড়ির একটা ফাঁসও লাগায়। ফাঁসটা কেন লাগাতে হল, সেটা স্পষ্ট নয়। তারপরেও বুকে পেটে এলোপাথারি ছুরি চালিয়েছে, বোধহয় মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হতে। চুরি ডাকাতি করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। ব্যাগ থেকে টাকাপয়সা কিছুই খোওয়া যায়নি। আলমারি খোলা বা ভাঙার চেষ্টা করা হয়নি। বলাকার করতে বাধা পেয়ে খুন করার থিওরিটাও ধোপে টেকে না। খুন করার উদ্দেশ্য প্রথম থেকে না থাকলে ছুরি, দড়ি এসব এনেছিল কেন? যাইহোক, একেনবাবুর কাছে গেলে নিশ্চয়ই আরও কিছু জানা যাবে।

.

দুপুরে প্রমথ আর আমি যাদবপুরের কফি হাউসে গিয়েছিলাম পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। বন্ধুদের একজন থাকে একেনবাবুর বাড়ির কাছে। তাকে নামিয়ে দিয়ে ঠিক করলাম একেনবাবুকে সারপ্রাইজ দেব। গিয়ে দেখি একেনবাবু বেরোচ্ছেন।

“কোথায় যাচ্ছেন?”

“খুব ভালো সময়েই এসেছেন স্যার। চলুন, ম্যাডাম ভাস্বতীর সঙ্গে একটু কথা বলে আসি।”

“ব্যাপারটা কি!” প্রমথ কপট রাগ দেখাল। “আমাদের ছাড়াই আপনি ইনভেস্টিগেশন চালিয়ে যাচ্ছেন!”

“কী যে বলেন স্যার। বাপিবাবু তো এ ক’দিন ব্যস্ত ছিলেন। আর আপনি তো সব কথাই জানেন।”

“ভাস্বতী মানে নন্দিতার সেই বন্ধু?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“হ্যাঁ স্যার, আজ হিন্দুস্থান পার্কে ওঁর মাসির কাছে বেড়াতে এসেছেন। ওখানে গেলে দেখা হবে।”

“ভাস্বতীর ঠিকানা পেলেন কোত্থেকে?”

“তুই একটা ইডিয়ট!” প্রমথ আমাকে ধমক দিল। “কার কাছ থেকে আবার, ইনস্পেক্টর অধীর মুখার্জীর কাছ থেকে!”

ভাস্বতীর মাসির বাড়ি খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। ওই পাড়ায় আগে বহুবার গিয়েছি।

ভাস্বতীর মাসি বাইরের ঘরে বসে উল বুনছিলেন। মাথার চুল বেশির ভাগই সাদা, চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা।

একেনবাবু নিজের পরিচয় দিতেই আমাদের বসতে বলে কাজের মেয়েটিকে চা আনতে বললেন, আপত্তি শুনলেন না।

উল বুনতে বুনতেই বললেন, “ভাস্বতী একটু বেরিয়েছে, এখনই ফিরবে। তোমাদের অপেক্ষা করতে বলে গেছে। ওই যাঃ, ‘তুমি’ বলে ফেললাম, রাগ করলে না তো! তোমরা আমার ছেলের থেকেও ছোটো।”

“একেবারেই না,” প্রমথ বলল, “সবার হয়েই আমি বলছি। কী বলেন একেনবাবু?”

“কী যে বলেন স্যার, সে তো অবশ্যই।”

উনি দেখলাম একেনবাবুর পরিচয় ভালোভাবেই জানেন। নন্দিতার কেসটা যে একেনবাবু নিয়েছেন তার জন্যে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। নন্দিতা ভাস্বতীর প্রাণের বন্ধু ছিল, ওঁর বাড়িতে অনেকবার এসেছে। মারা যাবার কয়েকদিন আগেও গল্পগুজব করে গেছে।

“মিস নন্দিতার আর কোনো বন্ধুর কথা জানেন ম্যাডাম?” একেনবাবু প্রশ্ন করলেন।

“আমাকে ম্যাডাম বোলো না, মাসিমা বলে ডেকো।”

“সরি ম্যাডাম, মানে মাসিমা। আমি জানতে চাইছিলাম, মিস নন্দিতার আর কোনো বন্ধু ছিল কি না।”

মাসিমা একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “ওর সঙ্গে একজনকে দেখেছি। বন্ধু কি না বলতে পারব না। বয়সে অনেকটাই বড়। ওর গাড়িতে করে বার দুয়েক আমার কাছে এসেছিল। ট্যাক্সির মালিক বা ওরকম কোনো একটা ব্যাবসা করে।”

“কী নাম ভদ্রলোকের?”

“নাম তো বলতে পারব না। লোকটাকে আমার পছন্দ হয়নি। কথাবার্তাগুলো শুনে মনে হয় না পড়াশুনো জানা ভদ্ৰপরিবারের বলে। আমি ভাস্বতাঁকে বারণও করেছিলাম লোকটার সঙ্গে মেলামেশা করতে। তবে জান তো, আজকালকার ছেলেমেয়েরা কি আমাদের কথা তেমন শুনবে! তা তোমরা দুজনে কী করো?”

আমার আর প্রমথর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।

প্রমথই আমাদের পরিচয় দিল।

“বাঃ, দু’জনই শিক্ষার জগতে আছ! তা বিয়ে-থা করেছ?”

“না মাসিমা, আমার একটু কমপ্লিকেশন আছে।” তারপর আমাকে দেখিয়ে বলল, “তবে বাপির জন্যে আমরা সবাই সুপাত্রী খুঁজছি!”

“তাই নাকি!” মাসিমা সোৎসাহে বললেন।

আমার ইচ্ছে হচ্ছিল প্রমথর মাথায় একটা চাঁটা মারি! ভাগ্যিস এই সময়ে ভাস্বতী ঘরে ঢুকল! ভাস্বতী বাঙালি মেয়েদের তুলনায় অনেকটাই লম্বা। পাঁচফুট আট ইঞ্চির মতো হবে। মুখের দিকে তাকালে চোখের দিকেই প্রথম নজর পড়ে। চোখদুটো যেন কথা বলছে! একটু লম্বাটে মুখ, কিন্তু অসুন্দর নয়। গায়ের রঙ মাজা। টানটান করে বাঁধা চুল। ঠোঁটে খয়েরি-লাল লিপস্টিকের ছোঁয়া। লাল-হলুদ সালোয়ার কামিজে চোখে পরার মতোই চেহারা।

নমস্কার করে বলল, “সরি, আমার একটু দেরি হয়ে গেল।”

মাসিমা বললেন, “আয় আয় বোস। এঁরা অনেক্ষণ বসে আছেন।”

“ইসস, কী খারাপ যে লাগছে। আসলে ট্যাক্সি পাচ্ছিলাম না। বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে এসে শেষ পর্যন্ত পেলাম।”

“তাতে কী হয়েছে ম্যাডাম। আমরা তো গল্পই করছিলাম।”

ম্যাডাম শুনে ভাস্বতী লজ্জা পেল।

“প্লিজ, আমাকে ম্যাডাম বলবেন না! ভাস্বতী বলে ডাকবেন।”

“সেটা সম্ভব নয়,” প্রমথ গম্ভীরভাবে বলল। “অন্তত মিস ভাস্বতীতে আপনাকে অভ্যস্ত হতে হবে।”

প্রমথর কথার কারণে ভাস্বতী হেসে ফেলল। ঝকঝকে হাসি। অতি সপ্রতিভ মেয়েটা।

“এঁরা দুজন আমেরিকায় প্রফেসরি করেন। আমাদের দেখিয়ে মাসিমা বললেন।

“ওমা, আমাকে তাহলে ভাস্বতী তুমি বলবেন।”

“আমরা বলতে পারি, কিন্তু একেনবাবুকে দিয়ে কি সেটা বলাতে পারব!”এমনভাবে প্রমথ কথাটা বলল শুধু ভাস্বতী নয়, মাসিমাও হেসে উঠলেন।

এরকম খেজুরে আলাপ চলতে চলতেই আমাদের মধ্যে ‘তুমি’ সম্বোধনটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল, ব্যতিক্রম একেনবাবু। কাজের প্রসঙ্গ এল। একেনবাবু ভাস্বতাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “মিস নন্দিতা আপনার খুব বন্ধু ছিলেন শুনেছি। ওঁকে আপনি কতদিন চিনতেন?”

“তা প্রায় বছর ছয়েক।”

“কোথায় আপনাদের পরিচয় হল?”

“আমরা একসঙ্গে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। তারপর এক বছর স্পোকেন ইংলিশ-এর কোর্সও নিয়েছি।”

“আই সি, তারপর?”

“ও কল সেন্টারে চাকরি নিল, আমি এয়ারলাইনসের চাকরিতে ঢুকলাম। তারপর থেকে দেখা-সাক্ষাৎ কমই হতো। কিন্তু ফোনে যোগাযোগটা সবসময়েই ছিল। রবিবার সকালে মাঝেমধ্যে আমরা এই বাড়িতে মিট করতাম।”

“শেষ কবে ওঁর সঙ্গে আপনার দেখা হয়?”

“প্রায় মাস ছয়েক আগে। কোনো একটা ছুটির দিন ছিল। আমরা দু’জনেই এখানে এসে একসঙ্গে লাঞ্চ করি। তার কয়েকদিন বাদেই ও খুন হয়।”

“ওঁর এক বন্ধু ছিলেন সমুবাবু বলে, তাকে আপনি চেনেন?”

ভাস্বতী চকিতে একবার মাসিমার দিকে তাকাল।

“হ্যাঁ, বার কয়েক ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।”

“কী করেন উনি?”

“শুনেছিলাম রেন্টাল কারের বিজনেস আছে। তার বেশি কিছু জানি না।”

“উনি কি মিস নন্দিতার বয়ফ্রেন্ড ছিলেন?”

উত্তরটা দিতে ভাস্বতী একটু ইতস্তত করল, “ঠিক বলতে পারব না।”

“আর কারও সঙ্গে কি মিস নন্দিতার ঘনিষ্ঠতা ছিল?”

“কল সেন্টারের একজনের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব ছিল শুনেছি, কিন্তু তাকে আমি চিনি না।”

বুঝতে পারছিলাম মাসিমার সামনে অকপটে সবকিছু বলতে ভাস্বতী অসুবিধা বোধ করছে।

সেটা বুঝতে পেরেই বোধহয় একেনবাবু বললেন, “আজকে আমাদের একটু তাড়া আছে। আরেকদিন কি আপনি আমাদের একটু সময় দিতে পারবেন?”

ভাস্বতী কিছু বলার আগেই মাসিমা বললেন, “চলে এসো না তোমরা একদিন এখানে। ভাস্বতীও আসবে, বিকেলে সবাই মিলে ভালো করে চা জলখাবার খাবে। কবে আসবে বলো?”

“তা তো করাই যায় ম্যাডাম, সরি… মাসিমা। ফোন করে পরে না হয় সময়টা ঠিক করে নেব।” একেনবাবু বললেন।

“তোমাদের নম্বরটাও ভাস্বতাঁকে দিয়ে দাও,” মাসিমা আমাদের বললেন।

প্রমথ বলল, “হ্যাঁ, বাপি, তোর নম্বরটা ভাস্বতাঁকে দে।”

প্রমথটাকে ঠ্যাঙাতে হয়!

.

পরের দিন সকালে অচেনা মোবাইল থেকে একটা ফোন পেলাম,

“বাপিদা, আমি ভাস্বতী।”

ফোনটা একেবারেই এক্সপেক্ট করিনি, তাই উত্তর দিতে একটু সময় লাগল।

“ও হ্যাঁ হ্যাঁ, একেনবাবুর তো তোমাকে ফোন করার কথা। করেননি?”

“না, কিন্তু কালকে পিসি থাকায় অনেক কিছুই তোমাদের বলতে পারিনি।”

“সেটাই মনে হচ্ছিল। তা কবে আমাদের মিট করতে চাও?”

“আজকে আমার ডে-অফ। একটু আগে আমাকে জানাল যে কাল সকালে আমাকে দু সপ্তাহ ট্রেনিংয়ের জন্য মুম্বাই যেতে হবে। তাই আজকে ছুটি দিয়েছে।”

“ঠিক আছে, আমি একেনবাবুকে ফোন করি। দেখি ধরতে পারি নাকি। তারপর তোমাকে ফোন ব্যাক করছি।”

একেনবাবুকে পেলাম না। একেনবউদি বললেন, ফিরতে রাত হবে। লাঞ্চ ডিনার সব নাকি বাইরে খাবেন। হঠাৎ কি এত কাজ বুঝলাম না, আমাদেরও কিছু জানাননি! এ তো একটা সমস্যা হল! প্রমথকে ধরার চেষ্টা করলাম। ও গেছে কোন্নগরে মামাবাড়িতে, সন্ধেবেলা ফিরবে।

ভাস্বতাঁকে কথাটা জানালাম। বললাম, “আমাকে যা বলার বলতে পার। আমি একেনবাবুকে জানিয়ে দেব।”

“ফোনে এগুলো বলতে চাই না।”

“ঠিক আছে। কোথায় কথা বলতে চাও?”

“খুব শর্ট নোটিস দিচ্ছি, তুমি এখন ব্যস্ত?”

“তেমন না।”

“আমি বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে এক বন্ধুর বাড়িতে আছি। তুমি কোয়ালিটি রেস্টুরেন্টের কাছাকাছি এসে আমাকে ফোন করলেই সেখানে তোমাকে মিট করতে পারি।”

সত্যিকথা বলতে কি, একা একা এভাবে একজন অত্যন্ত স্বল্প পরিচিত মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। অনেক রকমের সমস্যা কলকাতায় আজকাল হয় শুনেছি। একটাই বাঁচোয়া ওর মাসির সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছে, মেয়েটিকেও পুলিশ ইতিমধ্যে জেরা করেছে। তেমন কোনো সমস্যা হয়তো হবে না। একটা জিনিস ভাবছিলাম, কোথায় বসে কথাবার্তা বলব? রেস্টুরেন্টে নিশ্চয় বলা যাবে না।

.

কোয়ালিটি রেস্টুরেন্টের সামনেই ভাস্বতী দাঁড়িয়েছিল। আজকে দেখলাম একটা মেরুন রঙের শাড়ি পরেছে। মুখে প্রসাধনের ছাপ সুস্পষ্ট, অফিসে গিয়েছিল বলেই বোধ হয়। সাইড করে গাড়িটা দাঁড় করাতেই ও দরজা খুলে উঠে বলল, “আমার বন্ধুর বাড়িতে বসে কথা বলতে পারব। খুব কাছেই।”

বন্ধুর বাড়িতে বুঝলাম ভাস্বতীর অবারিত দ্বার। বন্ধু কাজে গেছে। বন্ধুর বৃদ্ধা মা দোতলায় শয্যাশায়ী। বন্ধুর দাদা ডাক্তার, পাশেই তাঁর চেম্বার। বাড়িতে কমলা নামে একটি কাজের মেয়ে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলাম না।

আমরা বসলাম।

“চা খাবে? কমলাকে বললেই করে দেবে।”

“না, আগে কাজের কথাটা শোনা যাক।”

ভাস্বতী একটু চুপ করে থেকে বলল, “নন্দিতার জীবন খুব কমপ্লিকেটেড ছিল। বিধবা মায়ের একমাত্র মেয়ে– অনেক স্ট্রাগল করেছে, অনেকে আবার তার অ্যাডভান্টেজ নিয়েছে।”

“কী রকম?”

ভাস্বতীর মুখটা এবার লাল হল। “কলকাতায় অভিভাবকহীন অবিবাহিত মেয়েদের পদে পদে বিপদ। রক্ষক এখানে ভক্ষক হয়।”

ধরে নিলাম এটা ভূমিকা, আরও কিছু বলবে, তাই চুপ করে রইলাম।

“তোমাকে আমি প্রায় চিনিই না বাপিদা, কিন্তু এগুলো তোমাকে বললে যদি ভাস্বতীর খুনের কোনো কিনারা হয়, তাই লজ্জা না করেই বলব।”

“লজ্জা পাবার কোনো কারণ নেই, তুমি বলো।”

“স্পোকেন ইংলিশ ইনস্টিটিউডের মালিক ধ্রুব দত্ত ওকে সেক্সয়ালি হ্যারাস করত। একটু আধটু সবার সঙ্গেই লোকটা অসভ্যতা করার চেষ্টা করত। নন্দিতা ছিল খুব সফট, ওকেই বেশি করত। নন্দিতাকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিল সমুদা। পরে জানলাম সে আরও জঘন্য চরিত্রের লোক। নন্দিতাকে ব্ল্যাকমেল করে… ওর সঙ্গে… ওর সঙ্গে শুত!” ।

এ ধরণের ঘটনা আগেও শুনেছি। তাও জিজ্ঞেস করলাম, “কী করে ব্ল্যাকমেল করত?”

“নন্দিতার ড্রিঙ্কে কিছু মিশিয়ে ওকে বেহুস করে অনেক নোংরা ছবি তুলেছিল, সেগুলো ওর বিধবা মাকে দেখিয়ে দেবে বলে ভয় দেখাত।”

“পুলিশকে নন্দিতা জানায়নি কেন?”

“তুমি এদেশের পুলিশকে কতটা জানো জানি না, এগুলো জানালে ওর ভালো থেকে মন্দ হতো!”

“তুমি জানালে না কেন?”

“আমি পুলিশের কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাইনি। যখন একেনবাবুর ফোন পেলাম, তখন ঠিক করলাম ওঁকে এটা জানাব। শুধু পুলিশ মহল নয়, বাইরের অনেকেও ওঁর সততা আর রহস্য উদ্ঘাটন করার ক্ষমতার কথা জানে। ওঁকে নিয়ে তোমার লেখাও পড়েছি। কিন্তু বড্ড কম লেখো।”

“আমি তো লেখক নই, বাট থ্যাঙ্ক ইউ। আর কী বলবে বলো।”

“হ্যাঁ আরও আছে, বলছি। এইবার সমুদার হাত থেকে মুক্তি পেতে নন্দিতা রাজা বলে একটি ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে। রাজার কথা ও শুনেছিল স্পোকেন ইংলিশ ক্লাসে কারও কাছ থেকে। সে নাকি গুন্ডামি ছাড়াও উপকার করে বেড়ায় রবিনহুডের মতো। সেই রাজা নাকি সমুদাকে বেশ কড়কে দিয়েছিল। কিন্তু তার জন্যে রাজাকেও পারিশ্রমিক দিতে হয়েছিল। পারিশ্রমিকটা টাকা নয় এটা জানি।”

“এটা কোন সময়ের ঘটনা?”

“আমার সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার দিন দশেক আগের।”

এবার আমি বুঝলাম শুভেন্দু যখন সমুদাকে নন্দিতার কথা জিজ্ঞেস করছিল সমুদা কেন থতমত খেয়ে গিয়েছিল। রাজার কাছে কড়কানি খেয়ে নন্দিতার সঙ্গে সমুদা যোগাযোগ রাখতে সাহস পায়নি। কেন যোগাযোগ রাখেনি, সেই সত্যটা বলতে পারেনি, আর শুভেন্দু ভাবছিল সমুদা কিছু একটা গোপন করার চেষ্টা করছে!

আমি চুপ করে আছি দেখে ভাস্বতী বলল, “কী ভাবছ?”

“কিছু না, বলো।”

“বাড়িতে সে সময়ে নন্দিতার জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছিল। আমি ওকে ভরসা দিচ্ছিলাম, বিয়ের পর এইসব ঝুট-ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবি। নন্দিতা শুধু বলেছিল– ভার্জিনিটি নেই, কোন মুখে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে, তার আগে সুইসাইড করবে।”

“দ্যাক্স ননসেন্স!” আমি বললাম। “প্রি-ম্যারিটাল সেক্স ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত হোক, কোনো অপরাধ নয়।”

“আমিও তাই বলি, কিন্তু এদেশের সব ছেলেরা তো তোমার মতো নয়, বিয়ের সময় সবাই খোঁজে পবিত্র মেয়ে!”

“স্পোকেন ইংলিশ ক্লাসের মালিককে আমি দেখেছি।” আমি বললাম, “দেখলেই মনে হয় বাজে ক্যারেক্টার!”

“বাজে বলে বাজে, আমরা সবাই ওকে হাড়ে হাড়ে চিনি!”

“আর এই রাজা লোকটা, সে কোথায় থাকে?”

“শুনেছি তিলজলায় বাড়ি। ঠিক কার কাছ থেকে নন্দিতা ওর খোঁজ পেয়েছিল সেটা আমাকে বলেনি। তবে আমি ধরে নিচ্ছি পুলিশের খাতায় ওর নাম আছে।”

“আর কিছু?”

“না, এটাই। তোমরা কবে ফিরে যাচ্ছ?”

“জানুয়ারির ১২ তারিখে।”

“তাহলে তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না।” ভাস্বতীর মুখটা যেন বিষণ্ণ।

পকেট থেকে আমার একটা কার্ড এগিয়ে দিয়ে বললাম, “এখানে আমার ইমেল আছে। যোগাযোগটা থাকবে।”

“আরেকটা কার্ড দাও।”

আমি একটু অবাক হয়ে আরেকটা কার্ড দিলাম। কার্ডের উলটোদিকে কিছু লিখে কার্ডটা ফেরৎ দিল। হাতের লেখাটা সুন্দর –ভাস্বতী মিত্র, নীচে ওর ইমেল অ্যাড্রেস।

“আমি কিন্তু প্রথমে ইমেল করব না, তুমি করবে।”

আমি ওর কথার ধরণে হেসে ফেললাম।

“ফেসবুকে আছ?” জিজ্ঞেস করল ভাস্বতী।

“না, কলেজে পড়াই, তাই একটু লুকিয়ে থাকি।”

“আমিও আমার ছবি ফেসবুকে রাখি না, তার বদলে একটা কুকুরের ছবি।” তারপর একটু মুখ টিপে হেসে বলল, “আচ্ছা, আমি পবিত্র কি না জিজ্ঞেস করলে না তো?”

তাজ্জব! এই সাত বছরে কলকাতা কি পালটে গেছে? এই মেয়ের সঙ্গে নিউ ইয়র্কের হিপ মেয়েদের তো কোনো তফাতই নেই!

আমিও তালে তাল রাখলাম, “ঠিক কথা, সত্যি করে বলো তো, তুমি কি পবিত্র?”

দুজনেই হাসলাম।

“আমাকে মাসির বাড়িতে নামিয়ে দিতে পারবে?”

“নিশ্চয়, চলো।”

গাড়িতে আর কোনো কথা হল না। ও কি ভাবছে আমি জানি না, আমি কিন্তু ওর কথাই ভাবছিলাম। সত্যি, এরকম সপ্রতিভ মেয়ে বেশি দেখিনি। হঠাৎ প্রমথর একটা কথা মনে পড়ায় হাসি পেয়ে গেল। আমার সব লেখাতেই নাকি একটা ব্যর্থ প্রেমের কাহিনি থাকে!

“হাসছ কেন?”

“কিছু না।”

ভাস্বতী ভুরু কুঁচকে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না।

নামার সময় আমার কাঁধটা আলতো করে ছুঁয়ে বলল, “ভালো থেকো।”

“তুমিও। আবার নিশ্চয় দেখা হবে।“

ওর চোখটা যেন বলে উঠল, সত্যি বলছ?”

এর উত্তর কথায় হয় না।

Sujan Dasgupta ।। সুজন দাশগুপ্ত