।। ৪ ।।

পরের দিন ইউনিভার্সিটিতে কোনো কাজই ছিল না। একেনবাবুও ফ্রি। আমাকে বললেন, “চলুন স্যার, মুরুব্বিজনের সেবাটা করে ফেলি।”

“তারমানে?”

“মানে মামুদ সাহেবের খালুর কাজটা করে ফেলা যাক।”

“আপনি আবার গুরুজনদের মুরুব্বি বলতে শুরু করলেন কবে থেকে?”

“তারেক সাহেব তো সবসময় তাই বলেন।”

“তারেক তো অনেক কিছুই বলে! সে কথা থাক, কিন্তু এই সক্কালবেলায় কুইন্সে ছুটবেন! তার ওপর ঠিকানাটাই তো মনে হচ্ছে ভুল।”

“ভুল হলে তো চুকেই গেল স্যার, একটু হাওয়া খেয়ে আসা যাবে।” তারপর প্রমথকে বললেন, “আপনিও চলুন না স্যার, তিনজনে বেশ গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।”

প্রমথ ব্রেকফাস্ট করে দ্বিতীয় কফিটা শেষ করছে। মামুদের খালুর গল্পটা কালকেই ওকে করেছিলাম। কিন্তু ও কোনো উৎসাহই দেখাল না। বলল, “ছ’দিন বাদে ক্রুজে যাব, কী ঝুট-ঝামেলার মধ্যে ঢুকছেন! একজনকে চেনেন না, কী টাইপের লোক জানেন না, হঠাৎ গিয়ে হাজির হবেন? হয়তো ড্রাগ ডিলার, দরজায় অচেনা বাদামি চামড়া দেখলে গুলি চালিয়ে দেবে!”

প্রমথটা আমার চেয়ে অনেক প্র্যাকটিক্যাল। আমি এতসব ভাবিনি।

একেনবাবু বললেন, “না, না, স্যার, রিস্ক নেব কেন, একটু খোঁজখবর করা আর কি। সেই ফাঁকে কুইন্সও একটু ঘোরা হয়ে যাবে… আর যেতে যেতে একটু গল্পও করা যাবে।

“গল্প তো এখানেই হতে পারে, আর হাওয়া খেতে চান তো সেন্ট্রাল পার্কে চলুন, আমি রাজি। কুইন্সে নয়।” বলে প্রমথ কফির কাপ ধুতে গেল।

প্রমথর মতো আমিও দুয়েকবার কাটাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু প্রমথর ক্যারেক্টারের ডিজিটালিটি আমার মধ্যে নেই। প্রমথ হয় ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’, নো কম্প্রোমাইজ। আমি অত জোর দিয়ে কিছু বলতে পারি না। একেনবাবুর ঘ্যানঘ্যানানি সহ্য করতে না পেরে শেষে বেরোলাম।

.

রহমান সাহেবের অফিসের লোকটি খুব একটা ভুল বলেনি। ঠিকানাটা খুঁজে পেতে আমাকেও কয়েকবার চক্কর খেতে হল। খুঁজতে খুঁজতে শেষে একটা ইলেকট্রনিক স্টোরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দোকানের মালিক ছাড়া এই ঠিকানায় কাউকে পাওয়া সম্ভব নয়। তাও একেনবাবুকে গাড়িতে বসিয়ে আমি নামলাম। পার্কিং নেই, গাড়িতে কেউ না থাকলে টিকিট দেবে।

ছোট্ট দোকান, মালপত্রে ঠাসা! সেলস কাউন্টারে একজনই। লোকটাকে দেখে মনে হল হিস্পানিক। এড ফাউলারের নাম শুনে বেশ বিরক্ত হল। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বলল,

“কালকেও একজন এসেছিল তোমাদের দেশ থেকে, একই প্রশ্ন করেছিল। উত্তরটা কি এক দিনের মধ্যে পালটে যাবে?”

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “আমি খুব লজ্জিত, খবরটা জানতাম না।”

মোস্ট আনফ্রেন্ডলি লোকটা। বলল, “এখন তো জানলে, গুড বাই।”

“ওকে।” বলে আমি বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠলাম।

“রং অ্যাড্রেস! খামোকা আসা হল।”

“আই অ্যাম কনফিউজড স্যার, একটা ভুল ঠিকানা ভদ্রলোক কেন দিলেন?”

আমি গাড়িটা স্টার্ট দিতে দিতে বললাম, “গুড কোয়েশ্চেন, কিন্তু উত্তরটা কে দেবে!”

“এই ঠিকানায় অন্য কোনো অ্যাপার্টমেন্ট নেই, বাড়িটা তো তিনতলা।”

একেনবাবুর কথায় খেয়াল হল। নামার সময় অত খেয়াল করিনি। স্টার্ট বন্ধ করে আবার ঢুকলাম দোকানে। “আচ্ছা, ওপরের তলা দুটোর ঠিকানা কি এক?”

লোকটা দেখলাম এবার বেশ চটেছে। “তুমি কি এদেশে নতুন এসেছ? জানো না, এক ঠিকানা দুটো জায়গার হতে পারে না!”

আমি চুপ আছি দেখে বোধহয় একটু করুণা হল। বলল, “উপরের ঠিকানা ৩৮ আর ৩৯। আর কিছু জানতে চাও?”

“না, না থ্যাঙ্ক ইউ, সরি।”

ফিরে এসে একেনবাবুকে বললাম, “আপনার প্রশ্নের উত্তর হল। ৩৮ আর ৩৯।”

“হ্যাঁ, সেটাই বুঝতে পারলাম।”

“তার মানে!”

“ওই যে দেখুন, সামনের দোতলা বাড়িতে লেখা ৪৮; আর তার পাশে একটা তিনতলা বাড়ি, সেখানে অবশ্য ঠিকানা কোনো লেখা নেই। কিন্তু ওগুলোর নম্বর নিশ্চয় ৫০, ৫১ আর ৫২। কারণ পাশের লম্ৰোম্যাটে নম্বর হচ্ছে ৫৩।”

আমি একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, “এই ক্যালকুলেশনটা একটু আগে করলেই পারতেন, আমাকে দোকানের লোকটার ধাঁতানি খেতে হত না। আর খুঁজছেন তো ৪৭!”

“তা ঠিক, কিন্তু আরেকটা জিনিসও বার করেছি স্যার।”

“কী?”

“আমার মনে হয় এড ফাউলার লিখতে চেয়েছিলেন ৪৯। দেখুন, ৭-এর সামনেটা একটা শুড়ের মতো, ওটাকে ইংরেজি ৯-ও মনে করা যায়।”

“সব কিছুই মনে করা যায়, কিন্তু আমি আর গাড়ি থেকে নামছি না। আপনি চান তো নেমে সন্দেহ নিরসন করুন।”

“নিশ্চয় স্যার, আপনি বসুন।”

একেনবাবু এলেন মিনিট কয়েকের মধ্যে। মুখ দেখেই বুঝলাম একটা কিছু ঘটেছে। কাউকে ফোন করতে করতে আসছিলেন। গাড়িতে উঠতেই স্টার্ট দিলাম।

“না, স্যার এখন যাওয়া যাবে না, একটু দাঁড়াতে হবে।”

“তার মানে?”

“আমার ধারণা এড ফাউলার খুন হয়েছেন। ধরে নিচ্ছি স্যার, ঘরে উনিই ছিলেন।”

“হোয়াট! কী বলছেন যা-তা!”

“ঠিকই বলছি স্যার। উপরে যাবার সিঁড়ির নীচে দেখলাম দুটো মেলবক্স। ৪৯ নম্বরের মেলবক্স-এ এড ফাউলার লেখা। ৪৮ নম্বরের মেলবক্সে কোনো নাম নেই। দোতলায় উঠে দেখি দরজাটা অল্প একটু খোলা। তার ফাঁক দিয়েই দেখলাম একটা লোক চিৎ হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। পুরো বুকটা রক্তে ভেজা। ভেতরে ঢুকলাম না, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে ফোন করলাম।”

“ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট তো ম্যানহাটনের– এটা তো ওঁর জুরিসডিকশন নয়! 911 ডায়াল করলেই পারতেন!”

“জানি স্যার, কিন্তু এখানকার পুলিশকে ফোন করলে আমাদের নিয়ে ঝামেলা করত। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টই কুইন্সের পুলিশকে খবর দিচ্ছেন। আমাদের পরিচয়ও দিয়ে দেবেন। তাই পুলিশ না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করি।”

“আচ্ছা বিপদ হল তো!”

কয়েক মিনিটের মধ্যে দুটো পুলিশের পেট্রল গাড়ি লালাবাতি ঘোরাতে ঘোরাতে এসে হাজির হল। গাড়িতে দুজন করে অফিসার। একজন পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে আমাদের গাড়ির সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, “হু ইজ মিস্টার সেন?”

অন্য গাড়ি থেকে নেমে দু’জন গটগট করে দরজা খুলে উপরে গেল।

“দ্যাট মি স্যার, দ্যাট মি!” তড়িঘড়ি করে একেনবাবু গাড়ি থেকে নেমে হাতটা এগিয়ে দিলেন।

অফিসার হ্যান্ডশেক করল না। বরং সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞেস করল, “আপনি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর?”

“নট এ গুড ওয়ান স্যার, বাট ইয়েস।”

একেনবাবুর সাজপোষাক, ভাবভঙ্গি আর কথা বলার ধরণ দেখে অফিসারের ভুরুটা কোঁচকাল। “ডোন্ট অ্যাক্ট স্মার্ট, যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দিন। আপনি এই মৃত্যুর কথাটা রিপোর্ট করেছিলেন?”

“ইয়েস স্যার।”

“এখানে না করে ম্যানহাটনে কেন?”

“আমি ওখানে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে চিনি, আমি জানি উনি খবরটা ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবেন।”

“নেক্সট টাইম কল ৯১১। দিস ইস আওয়ার এরিয়া।”

“হ্যাঁ, স্যার।”

“আপনি এখানে কেন এসেছিলেন?”

“বাংলাদেশের একজন ডিপ্লোম্যাট আমাকে পাঠিয়েছিলেন স্যার, এড ফাউলারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।”

“এড ফাউলার কে?”

“আমার ধারণা যিনি মারা গেছেন স্যার।”

“তিনি যে মারা গেছেন কি করে জানলেন?”

“দেখে তো তাই মনে হল স্যার।”

“দেখে মনে হল! আপনি অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছিলেন?”

“দরজাটা খোলা ছিল স্যার, ভেতরে ঢুকিনি। দরজার বাইরের থেকেই দেখেছি।”

“যিনি এড ফাউলারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পাঠিয়েছিলেন, তাঁর নাম কি?”

“পুরো নামটা তো জানি না স্যার,” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “রহমান সাহেবের পুরো নাম কি স্যার?”

আমি মাথা নাড়লাম, “ঠিক জানি না।”

“কেন যোগাযোগ করতে চেয়েছিলেন?”

“এড ফাউলার বলে একজন ওঁকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন, সেই ব্যাপারে।”

“চিঠি! কি ধরণের চিঠি?”

“ওঁর এক আত্মীয়ের খবর চেয়ে…”

“হোয়াট! ইউ আর মেকিং নো সেন্স!”

এভাবে প্রশ্ন আর উত্তর চললে পরিস্থিতিটা আরও গোলমেলে হয়ে যাবে। আমি তাই সংক্ষেপে ব্যাপারটা অফিসারকে বললাম।

অফিসার সেটা শোনার পর আমাকে প্রশ্ন করল। “আপনি কে?”

“আমি নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে পড়াই।”

“কী পড়ান?”

“ফিজিক্স?”

“আপনি এখানে এলেন কেন?”

“আমি মিস্টার সেনকে রাইড দিচ্ছি।”

“উনি আমাকে নানা ভাবে সাহায্যও করেন,” এটা বলার কোনো দরকার ছিল না একেনবাবুর। শুধু শুধু কথা বাড়ালেন।

“কী রকম সাহায্য?”

“নট রিয়েলি। আমরা অ্যাপার্টমেন্ট শেয়ার করি। আমরা বন্ধু। ওঁর গাড়ি নেই, তাই ওঁকে অনেক সময় রাইড দিই।”

অফিসার একটু চুপ করে ঘড়িটা দেখলেন। তারপর একটু সরে গিয়ে সেলফোনে কার সাথে কথা বলতে শুরু করলেন।

আমি একেনবাবুকে বললাম, “আর মেলা আত্মীয়তা করবেন না, চলুন ওঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি যাওয়া যাক।”

অফিসার ফিরে এসে বললেন, “কখন এসেছিলেন আপনারা?”

“মিনিট দশেক আগে।”

“আপনাদের কোনো কার্ড আছে, যদি যোগাযোগ করতে হয়।”

আমি পকেট থেকে আমার একটা ভিসিটিং কার্ড দিলাম। আমাদের একই ফোন নম্বর। পেছনে একেনবাবুর নামটা লিখে দিলাম।

“ইউ মে গো নাই।”

আর দেরি না করে গাড়ি চালালাম।

“হঠাৎ, এভাবে ছেড়ে দিল! আমি ভেবেছিলাম আরও জেরা করবে।” আমি বললাম।

“আমার মনে হয় স্যার, বুঝতে পেরেছে আমরা জড়িত নই। মৃত্যুটা আমাদের আসার অনেক আগেই হয়েছে। মুখে যাই বলুক, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট নিশ্চয় এদের বসকে ভালো করেই জানিয়েছেন আমরা কারা। তবে আমার মনে হয় স্যার রহমান সাহেবকে এরা জেরা করবে।”

আমরা বাড়ি ফিরে এড ফাউলারের খুনের খবরটা রহমান সাহেবকে জানালাম।

তিনি তো শুনে অবাক। বললাম, “পুলিশ হয়তো আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।”

“আমার সঙ্গে!”

“আমাদের কাছে শুনেছে, আপনি খোঁজ করছিলেন বলেই আমরা গিয়েছিলাম।” কথাটা শুনে রহমান সাহেব উৎফুল্ল হলেন না। বললেন, “লোকটা মরার আর সময় পেল না। শুধু শুধু একটা ঝুট-ঝামেলা!”

খুব একটা ঝুট-ঝামেলা অবশ্য নয়। পরে শুনলাম পুলিশ ইউএন-এর বাংলাদেশ মিশনে শুধু একটা ফোন করেছিল। রহমান সাহেবের ডিপ্লোম্যাটিক ইস্যুনিটি আছে। এসব ব্যাপারে ওঁকে ঘাঁটাবার কোনো এক্তিয়ারই পুলিশের নেই।

রহমান সাহেব পরের দিন সকালেই চলে গেলেন। পার্ফেক্ট জেন্টলম্যান। যাবার আগে আমাদের বাই’ বলে গেলেন–যার কোনো দরকার ছিল না। বার বার ধন্যবাদ দিলেন। বললেন, ঢাকায় কোনো দিন এলে, আমরা ওঁর সঙ্গে যেন অবশ্যই যোগাযোগ করি। নিজের একটা কার্ডও দিলেন। আমার একটু লজ্জাই লাগছিল। যে কাজটা আমরা করার চেষ্টা করছিলাম, সেটা যে কেউই করতে পারত। তাছাড়া এড ফাউলার ডেড, সুতরাং ওঁর বড়োচাচার প্রশ্নের উত্তরটাও পেলেন না।

.

।। ৫ ।।

ক্রুজে যাবার দিন এগিয়ে আসছে। তার আগে বেশ কিছু কাজ সারতে হবে। ঘুম থেকে উঠে ভাবছিলাম আজ দুপুরে বেরিয়ে একটা মোটা সোয়েটার আর মাফলারের খোঁজ করব। ও দুটো থাকলে আলাস্কায় একটা একস্ট্রা প্রোটেকশন থাকবে। কিন্তু কোথায় মিলবে সেটাই প্রশ্ন। এই সময়ে দোকান থেকে ওগুলো সব হাওয়া হয়ে যায়, আবার উদয় হয় শীত যখন আসব আসব করছে। মেসি-র বেসমেন্টে যদি পাওয়া যায়! আর কী কী সম্ভাব্য দোকান আছে ভাবছি। এড ফাউলারের ব্যাপারটাও মাথা থেকে যায়নি। তবে ফাউলার মারা যাওয়ায় একদিক থেকে আমরা বেঁচ্ছি। ওই রহস্যে একবার ঢুকলে সেই জল গড়াতে গড়াতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াত তার ঠিক-ঠিকানা নেই।

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আমি এক পট কফি চাপিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস নিয়ে বসলাম। ভেবেছিলাম ফাউলারের মৃত্যুর খবরটা নিউ ইয়র্ক টাইমসে নিশ্চয় পাওয়া যাবে। খুন সম্পর্কে কিছু না কিছু ইনফর্মেশন সেখানে অন্তত থাকবে। না, কোনো খবরই নেই।

একেনবাবু পাশেই বসেছিলেন। বললাম, “দেখলেন, কালকে একটা মার্ডার দেখে এলেন, কিন্তু তার কোনো উল্লেখ নেই আজকের পেপারে।”

“মার্ডার তো দেখিনি স্যার, মার্ডার ভিক্টিমকে দেখেছি।”

“ওই হল। কিন্তু কোথাও তো কিছু দেখছি না পেপারে। হয়তো লোকটা মরেনি।”

“না স্যার, অনলাইনে আছে খবরটা।”

“সেকি! নিউ ইয়র্ক টাইমসের অনলাইনে? কাগজে তো নেই।”

“নিউ ইয়র্ক টাইমস নয় স্যার, কুইনস ট্রিবিউনের অনলাইনে।”

যে কথাটা আগে কোথাও লিখিনি, একেনবাবু এখন নেট স্পেশালিস্ট হয়ে গেছেন। প্রথম যখন ম্যানহাটানে এসেছিলেন, তখন কম্পিউটারের কী-বোর্ডে হাত দিতেও ভয় পেতেন। প্রমথই অসামান্য ধৈর্য সহকারে একেনবাবুকে কম্পিউটার ব্যবহার আর নেট সার্ফ করা শিখিয়েছে। এমন কি ওঁকে দিয়ে একটা ল্যাপটপও কিনিয়েছে। শেষেরটাই সবচেয়ে বড়ো অ্যাচিভমেন্ট। একেনবাবু বারবার আপত্তি জানিয়েছিলেন, “কী দরকার স্যার, আপনাদের দুটো তো আছেই!”

“সেইজন্যেই তো কেনাচ্ছি, আমাদের কম্পিউটারে যাতে ভাইরাস না ঢোকান।”

“কী যে বলেন স্যার, আপনার এত ট্রেনিং-এর পরে কি আর সেই ভুল করব!”

যাক সে কথা। আমি একেনবাবুকে বললাম, “কুইনস ট্রিবিউন বলে যে একটা পত্রিকা আছে, সেটাই তো জানতাম না।”

“আমিও জানতাম না স্যার। উইকলি পেপার, তবে অনলাইনটা মনে হয় আপডেটেড হয়। নেট সার্ফ করতে করতে পেয়ে গেলাম।”

“কী লিখেছে সেখানে?”

“খুবই ছোট্ট করে স্যার। বৃহস্পতিবার দুপুর এগারোটা নাগাদ করোনার এক অ্যাপার্টমেন্টে একজন লোক খুন হয়েছে। লোকটির বয়স চল্লিশের কোঠায়। খুনি পলাতক।”

“ভিকটিমের নাম দেয়নি?”

“না স্যার।”

“তার মানে লোকটা তো এড ফাউলার নাও হতে পারে।”

“আমিও সেটা ভাবছিলাম স্যার।”

“থাক গে, আর ভাবাভাবি না করে একটা সাহায্য করুন। নেট-এ দেখুন তো সোয়েটার আর মাফলার কাছাকাছি কোন দোকানে পাওয়া যাচ্ছে?”

একেমবাবু পরম উৎসাহে কাজে লাগলেন।

.

।। ৬ ।।

পাঠকদের কেউ কেউ হয়তো ক্রুজে গেছেন। এসব জাহাজে কী থাকে আর না থাকে বিলক্ষণ জানেন। আমাদের কাছে পুরো ব্যাপারটাই একটা নতুন অভিজ্ঞতা। বইপত্রে পড়েছি, সিনেমাতেও ক্রুজ শিপের কিছু কিছু দৃশ্য দেখেছি। কিন্তু চাক্ষুস দেখা অন্য জিনিস! আমি তো একেবারে থ। অথচ আইল্যান্ড প্রিন্সেস জাহাজ হিসেবে খুব একটা বড়ো নয়। কিন্তু খেলাধূলোর জায়গা, সুইমিং পুল, সিনেমা হল, শপিং মল, এন্টারটেনমেন্ট সেন্টার, এক্সসারসাইজরুম, লাউঞ্জ, বার, বিউটি পার্লার, ওয়েডইং চ্যাপেল, কী নেই! ক্যাফেটেরিয়াতে অঢেল ফ্রি খাবার। এছাড়া রয়েছে আরও গোটা পাঁচেক রেস্টুরেন্ট। বলতে গেলে একটা ছোটোখাটো শহর জলে ভেসে বেড়াচ্ছে।

বিকেল পাঁচটায় জাহাজ ছাড়ল। তার আগে লাইফবোট কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তার একটা মহড়া হল। জাহাজ ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সবাই আলাদা হয়ে গেলাম। প্রমথ সাঁতার কাটবে প্ল্যান করে এসেছিল। একেনবাবু ওঁর অগাধ অনুসন্ধিৎসা নিয়ে জাহাজ পর্যবেক্ষণে বেরোলেন। আমি উপরে অবসার্ভেশন ডেকে দাঁড়িয়ে চারদিকের জল, ধীরে ধীরে দূরে সরে যাওয়া ভ্যানকুভার শহরের উঁচু উঁচু বাড়িগুলো দেখতে লাগলাম। ডেকে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন বেশীরভাগই সাহেব। একজন ছাড়া কোনো ভারতীয়ই চোখে পড়ল না। ভারতীয় ভদ্রলোকটি একটু বয়স্ক, কিন্তু বেশ মিশুকে –ঘুরে ঘুরে অনেকের সঙ্গেই কথা বলছেন। খানিক বাদে আমার পাশে এসে আলাপ করলেন। হার্লেমে থাকেন, নাম টিম ব্যাসারাথ। বয়স দূর থেকে যা ভেবেছিলাম, তার থেকে একটু বেশিই। গল্প করতে ভালোবাসেন। প্রশ্নও তেমন করতে হল না। নিজের থেকেই অনেক কথা বললেন। বাপঠাকুরদার একটা মনিহারি দোকান ছিল। কিন্তু উনি ব্যবসায়ে না ঢুকে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়েছিলেন। কয়েকটা হোটেলে চাকরি করার পর ঢুকেছিলেন এই প্রিন্সেস ক্রুজ লাইনে। ক’দিন আগেও এই জাহাজেই ক্রুজ ডিরেক্টর ছিলেন। অফিশিয়ালি রিটায়ার করেছেন এই ট্রিপ আরম্ভ হবার ঠিক আগে। ওঁর রিপ্লেসমেন্টেও এসে গেছে। প্রথম আলাপেই এতগুলো কথা বলে ফেলে বোধ হয় একটু লজ্জা পেলেন। বললেন, “কিছু মনে করলেন না তো এত কথা বলে ফেললাম!”

“এতটুকু নয়, খুব ভালো হল আপনার সাথে আলাপ হয়ে। আগে আমরা কোনোদিন ক্রুজে আসিনি। জাহাজের সাইজ দেখে তো আমরা হতভম্ব! কি আছে কি নেই বুঝতে বুঝতেই ট্রিপটা শেষ হয়ে যাবে।”

“কিছু প্রশ্ন থাকলে ক্রুজ ডিরেক্টরের অফিসে চলে যাবেন। যাত্রীদের দেখভাল করার কাজ ঐ অফিসারের।”

“তার আর দরকার কি, আপনার সঙ্গেই তো আলাপ হয়ে গেল।”

হেসে ফেললেন টিম। “আমার কাজ তো শেষ। ভালোকথা, মেইন ডাইনিং রুমটা কালকের জন্যে এখনই গিয়ে বুক করে নিন, দেরি করলে জায়গা পাবেন না। ওখানকার অ্যাম্বিয়েন্স চমৎকার আর ক্যাফেটেরিয়ার থেকে বেটার খাবার।”

আমার কতগুলো প্রশ্ন ছিল, কিন্তু সেগুলো আর করা হল না। জাহাজের একজন স্টাফ ব্যস্ত হয়ে টিমকে ডাকতে এল। এক্সকিউজ মি’ বলে উনি চলে গেলেন।

এরমধ্যে জাহাজ সমুদ্রের অনেকটা ভেতরে চলে এসেছে। চরিদিকে শুধু জল ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমি অবসার্ভেশন ডেক থেকে মেইন ডেকে নেমে এলাম। আগে খেয়াল করিনি, ছোটো একটা লাইব্রেরিও জাহাজে আছে। সেখানে আর কেউ নেই, একা একেনবাবু সোফায় বসে ল্যাপটপে কিছু দেখছেন।

আমাকে দেখে বললেন, “অ্যামেজিং স্যার, ট্রলি অ্যামেজিং।”

“কি অ্যামেজিং?”

“এই যে মাঝসমুদ্রে নেট কানেকশন। স্লো ঠিকই, কিন্তু আসছে।”

“আপনি এখানেও ইন্টারনেট দেখছেন, কত চার্জ জানেন?”

“সেকি স্যার, ফ্রি নয়!”

“জাহাজে ফ্রি হয় কি করে, নিশ্চয় স্যাটেলাইট কানেকশন!” আমি দেখেছিলাম রেটটা, কিন্তু একটু বাড়িয়েই বললাম। “প্রতি মিনিট ৫ ডলার।”

“কী সর্বনাশ স্যার! আমি তো প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে সার্ফ করছি!”

“তারমানে একশো ডলার। যাক গে, করেই যখন ফেলেছেন তখন তো আর কিছু করার নেই! তা কী এত হাতিঘোড়া দেখছিলেন?”

একশো ডলারের অঙ্কটা শুনে একেনবাবু এতই বিমর্ষ হয়ে পড়লেন যে আমার খারাপ লাগল। বললাম, “আঃ, ছাড়ন তো। আপনার জন্যই তো আমরা ফোকোটে এই ক্রুজে এসেছি, এটা না হয় আমরাই দেব।”

এতে বোধহয় একটু কাজ হল। ল্যাপটপের মুখটা বন্ধ করতে করতে বললেন, “না না স্যার, আপনারা কেন দেবেন! আসলে কি জানেন স্যার, চট করে কনক্লশানে আসাটা খুব ভুল। নেটে দেখেছিলাম ক্রুজ শিপে নেট কানেকশন আছে। তার থেকে ধরে নিয়েছিলাম ওটা টিকিটের সঙ্গে ইনডেড।”

“তা তো বুঝলাম, কিন্তু এতক্ষণ ধরে এখানে করছিলেনটা কি? শুধু নেটে তো ছিলেন না বুঝতে পারছি।”

“এই একটু বই পড়ছিলাম স্যার। কিন্তু বইয়ের কালেকশন খুব লিমিটেড।”

“তা তো হবেই, ক্রুজে আর ক’জন বই পড়তে আসে!”

“ট্রু স্যার। কিন্তু জায়গাটা সুন্দর। লোকজন নেই, বাইরের দেয়ালটা দেখুন, পুরো কাঁচের। সেদিকে তাকালেই স্যার অন্তহীন সমুদ্র।”

“আপনি তো কবিদের মতো কথা বলছেন? কী পড়ছিলেন, কবিতার বই?”

“না স্যার, ভাস্করদের জীবনী।”

“ভাস্কর মানে? স্কাল্পটার?”

“হ্যাঁ, স্যার।”

“আপনার যে এ ব্যাপারে এত উৎসাহ ছিল। তা তো আগে জানতাম না?”

“ছিল না স্যার। তবে সেদিন ম্যাডাম ফ্রান্সিস্কা যে বললেন ফণীন্দ্রনাথ বসু-র কথা… হঠাৎ ওঁর নামটা চোখে পড়ল। তাই পড়ছিলাম।”

সেদিন মানে সপ্তাহ দুয়েক আগে। প্রমথর গার্লফ্রেন্ড ফ্যান্সিস্কা আমাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল মেট্রোপলিটান মিউজিয়ামে। মেয়েটা আমাদের পছন্দ করে, তাই মাঝেমাঝে গার্জেনগিরি করে। কেমিস্ট্রির ছাত্রী হলেও স্কাল্পচার, আর্ট এইসব নিয়ে পড়ে থাকে। তার ধাক্কা মাঝে মাঝেই আমাদের পোয়াতে হয়। শুধু প্রমথ নয়, আমরাও যাতে করে শিল্পজগতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জিনিসগুলো উপভোগ করতে শিখি, তার জন্য ফ্রান্সিস্কা সদা সচেষ্ট। রোদাঁর একটা স্পেশাল এক্সিবিট চলছিল মিউজিয়ামে –বড়ো বড়ো তিন ডজন স্কাল্পচার আর তার সঙ্গে ওঁর আঁকা ছবি। সেই যাত্রাতেই ফ্রান্সিস্কা কথায় কথায় ফণীন্দ্রনাথ বসু-র প্রসঙ্গ তুলেছিল। রোদাঁ নাকি ওঁর কাজ পছন্দ করতেন। ফ্র্যাঙ্কলি আমি ভুলেই গিয়েছিলাম পুরো ব্যাপারটা। আর্ট,স্কাল্পচার ইত্যাদিতে আমার কোনও ইন্টারেস্টই নেই। একেনবাবুর সঙ্গে আমার আর প্রমথর তফাৎ হচ্ছে ওঁর জ্ঞানপিপাসা প্রবল। একটা কিছু কানে গেলেই হল, তক্কে তক্কে থাকেন কী করে সে ব্যাপারে আরেকটু জানা যায়। ওঁর কিছু জানা মানে আমাদের জ্বালাতন, বকবক করে বেশ কিছুদিন কান ঝালাপালা করবেন।

“ভেরি ইন্টারেস্টিং লাইফ স্যার। দেশের লোকেরা ওঁকে তেমন চেনেন না, কারণ ওঁর শিল্পীজীবনটা বিদেশে কেটেছে। মারাও গেছেন মাত্র ৩৮ বছর বয়সে স্কটল্যান্ডের এক শহরে জলে ডুবে।”

আমি হাঁ হুঁ কিছু না বলে, আলমারিতে কি কি বই পড়ার মতো আছে দেখতে গেলাম। একেনবাবু তাতে দমলেন না।

“আরও একজন বাঙালীর কথা এখানে লেখা আছে স্যার।” বইটা তুলে দেখালেন একেনবাবু। “ফণীন্দ্রনাথ বসুর মৃত্যু প্রসঙ্গে ফুটনোট হিসেবে। রোঁদার আরেকজন ভারতীয় ছাত্র মহম্মদ এম রহমানেরও অপঘাতে মৃত্যু হয়েছিল। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে খুন হন।”

“তাই?” অন্যমনস্ক হয়ে শেলফের বইগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

“হ্যাঁ স্যার, ওঁর বডিটা পোড়া অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। ‘হিজ বার্নট বডি ওয়াজ ফাউন্ড নিয়ার এ ডিচ। গট টু বি এ মার্ডার।

“দাঁড়ান, দাঁড়ান, কী বলছেন?” বই খুঁজতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম! খুন শুনে সম্বিত ফিরল। “পুড়িয়ে মারা হয়েছিল! কে খুন করল?”

“আর কিছু লেখা নেই স্যার এখানে, ওইটুকুই।”

“অন্য কোনো জায়গায় নিশ্চয় কিছু আছে?”

“বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি, স্যার।” রবীন্দ্রনাথের এই ফেমাস লাইনটা একেনবাবু প্রায়ই আওড়ান। বিশেষ করে যখন উত্তরটা জানা নেই বা চেপে যেতে চান। “আপনি পড়ুন স্যার, আমি ল্যাপটপটা ঘরে রেখে আসি।”

একেনবাবু চলে যাচ্ছেন দেখে বললাম, “রুমে যাবার আগে একটা কাজ করবেন প্লিজ, ডাইনিং রুমটা কালকে ডিনারের জন্য বুক করে আসুন। শুনলাম বেশি দেরি করলে নাকি ওখানে জায়গা মিলবে না।”

“তাই নাকি স্যার, এখনই যাচ্ছি!” বলে ব্যস্তসমস্ত হয়ে একেনবাবু ছুটলেন।

আমি ইতিমধ্যে বুক শেলফ থেকে জেমস থার্বারের মাই লাইফ এন্ড হার্ড টাইমস বইটা তুলে নিয়েছি। কিছু কিছু মজাদার বই আছে যা বারবার পড়া যায়, এটা তার একটা। পড়তে পড়তে কখন বইয়ের মধ্যে ডুবে গেছি খেয়াল নেই। প্রমথর ঠেলায় ঘোর কাটল।

“কি রে খাবি, না বই পড়ে খিদে মিটাবি?” প্রমথ সাঁতার কেটে স্নান টান সেরে রেডি। “একেনবাবু কোথায়?”

“উনি কালকের জন্যে ডিনার টেবিল বুক করতে গেছেন।”

“টেবিল বুক করতে!”

“হ্যাঁ, ডাইনিং রুমের টেবিল আগের দিন বুক না করলে জায়গা মিলবে না। দু’হাজার লোককে তো একসঙ্গে বসাতে পারবে না।”

“আর আজকে?”

“আজ কাফেটেরিয়ায় খেতে হবে। নো চয়েস।”

Sujan Dasgupta ।। সুজন দাশগুপ্ত