দুসপ্তাহ তবসুমের বাড়ি যাওয়া হয়নি। আমার এইরকম হয়, একটা কাজ শুরু করার পর হঠাৎই উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। আমার স্ত্রী অতসী বলে, কোনও কাজে লেগে থাকার মতো মনের জোর আমার নেই। হবেও বা। কিন্তু কাকে বলে মনের জোর? একটা কাজ শেষ করার জন্য জরুরি প্রত্যয়? কিন্তু এই প্রত্যয় কি শেষ পর্যন্ত মানুষের কোনও কাজে লাগে? ভাবতে গেলে, আমার তো মহাভারতের যুদ্ধের পরবর্তী মৃতদেহ-শিবা-শকুনে ভরা শ্মশানের কথাই মনে পড়ে। অনুশাসন পর্বের সেই কাহিনী ফিরে ফিরে আসে। চক্রাকার এই গতিপথ। রাজশেখর বসুর বই খুলে আমি আবারও গল্পটি পড়ি।

যুধিষ্টির বললেন, পিতামহ, আপনি বহুপ্রকার শান্তিবিষয়ক কথা বলেছেন, কিন্তু জ্ঞাতিবধজনিত পাপের ফলে আমার মন শান্ত হচ্ছে না। আপনাকে শরে আবৃত ক্ষতবিক্ষত ও রুধিরাক্ত দেখে আমি অবসন্ন হচ্ছি। আমরা যে নিন্দিত কর্ম করেছি তার ফলে আমাদের গতি কী প্রকার হবে? দুর্যোধনকে ভাগ্যবান মনে করি, তিনি আপনাকে এই অবস্থায় দেখছেন না। বিধাতা পাপকর্মের জন্যই নিশ্চয় আমাদের সৃষ্টি করেছেন। যদি আমাদের প্রিয়কামনা করেন তবে এমন উপদেশ দিন যাতে পরলোক পাপমুক্ত হতে পারি। ভীষ্ম বললেন, মানুষের আত্মা বিধাতার অধীন, তাকে পাপপূণ্যের কারণ মনে করছ কেন? আমরা যে কর্ম করি তাঁর হেতু সূক্ষ্ম এবং ইন্দ্রিয়ের অগোচর।আমি একটা প্রাচীন ইতিহাস বলছি শোন।-

গৌতমী নামে এক বৃদ্ধা ব্রাহ্মণী ছিলেন, তাঁর পুত্র সর্পের দংশনে হতচেতন হয়। অর্জুনক নামে এক ব্যাধ ক্রুদ্ধ হয়ে সর্পকে পাশবদ্ধ করে গৌতমীর কাছে এনে বললে, এই সর্পাধম আপনার পুত্রহন্তা, বলুন একে কি করে বধ করব; একে অগ্নিতে ফেলব, না খণ্ড খণ্ড করে কাটব? গৌতমী বললেন, অর্জুনক, তুমি নির্বোধ, এই সৰ্পকে মেরো না, ছেড়ে দাও। একে মারলে আমার পুত্র বেঁচে উঠবে না, একে ছেড়ে দিলে তোমারও কোনও অপকার হবে না। এই প্রাণবান জীবকে হত্যা করে কে অনন্ত নরকে যাবে?

ব্যাধ বললে, আপনি যে উপদেশ দিলেন তা প্রকৃতিস্থ মানুষের উপযুক্ত, কিন্তু তাতে শোকার্তের সান্তনা হয় না, যারা শান্তিকামী তারা কালবশে এমন হয়েছে এই ভেবে শোক দমন করে, যারা প্রতিশোধ বোঝে তারা শত্রুনাশ করেই শোকমুক্ত হয় এবং অন্য লোকে মোহবশে সর্বদাই বিলোপ করে। অতএব এই সৰ্পকে বধ করে আপনি শোকমুক্ত হন। গৌতমী বললেন, যারা আমার ন্যায় ধর্মনিষ্ঠ তাদের শোক হয় না; এই বালক নিয়তির বশেই প্রাণত্যাগ করেছে, সেজন্য আমি সর্পকে বধ করতে পারি না। ব্রাহ্মণের পক্ষে কোপ অকর্তব্য, তাতে কেবল যাতনা হয়। তুমি এই সর্পকে ক্ষমা করে মুক্তি দাও। ব্যাধ বললে, একে মারলে বহু মানুষের প্রাণ রক্ষা হবে, অপরাধীকে বিনষ্ট করাই উচিত।

ব্যাধ বার বার অনুরোধ করলেও গৌতমী সৰ্পবধে সম্মত হলেন না। তখন সেই সৰ্প মৃদুস্বরে মনুষ্যভাষায় ব্যাধকে বললে, মূখ অর্জুনক, আমার কি দোষ? আমি পরাধীন, ইচ্ছা করে এই বালককে দংশন করিনি, মৃত্যু কর্তৃক প্রেরিত হয়ে করেছি; যদি পাপ হয়ে থাকে তবে মৃত্যুরই হয়েছে। ব্যাধ বললে, অন্যের বশবর্তী হলেও তুমি এই পাপকার্যের কারণ, সেজন্য বধযোগ্য।

সর্প বললে, কেবল আমিই কারণ নই, বহু কারণের সংযোগ এই কার্য হয়েছে। ব্যাধ বললে, তুমিই এই বালকের প্রাণনাশের প্রধান কারণ, অতএব বধযোগ্য। সর্প ও ব্যাধ যখন এইরূপ বাদানুবাদ করছিল তখন স্বয়ং মৃত্যু সেখানে আবির্ভূত হয়ে বললেন, ওহে সর্প, আমি কাল কর্তৃক প্রেরিত হয়ে তোমাকে প্রেরণ করেছি, অতএব তুমি বা আমি এই বালকের বিনাশের কারণ নই। জগতে স্থাবর জঙ্গম সূর্য চন্দ্র বিষ্ণু ইন্দ্র জল বায়ু অগ্নি প্রভৃতি সমস্থই কালের অধীন, অতএব তুমি আমার ওপর দোষারোপ করতে পার না। সৰ্প বললে, আপনাকে আমি দোষী বা নির্দোষ বলছি না, আমি আপনার প্রেরণায় দংশন করেছি-এই কথাই বলেছি; দোষ নির্ধারণ আমার কার্য নয়। ব্যাধ, তুমি মৃত্যুর কথা শুনলে, এখন আমাকে মুক্তি দাও। ব্যাধ বললে, তুমি যে নির্দোষ তার প্রমাণ হল না, তুমি ও মৃত্যু উভয়েই এই বালকের বিনাশের কারণ, তোমাদের ধিক।

এমন সময় স্বয়ং কাল আবির্ভূত হয়ে ব্যাধকে বললেন, আমি বা মৃত্যু বা এই সর্প কেউ অপরাধী নই, এই শিশু নিজ কর্মফলেই বিনষ্ট হয়েছে। কুম্ভকার যেমন মৃৎপিণ্ড থেকে ইচ্ছানুসারে বস্তু উৎপাদন করে, মানুষও সেইরূপ আত্মকৃত কর্মের ফল পায়। এই শিশু নিজেই তার বিনাশের কারণ।

গৌতমী বললেন, কাল বা সর্প বা মৃত্যু কেউ এই বালকের বিনাসের কারণ নয়, নিজ কর্মফলেই এ বিনষ্ট হয়েছে, আমিও নিজে কর্মফলে পুত্রহীনা হয়েছি। অতএব কাল ও মৃত্যু প্রস্থান করুন, তুমিও সর্পকে মুক্তি দাও। গৌতমী এইরূপ বললে কাল ও মৃত্যু চলে গেলেন, ব্যাধ সৰ্পকে ছেড়ে দিলে, গৌতমীও শোকশূন্য হলেন।

উপখ্যান শেষ করে ভীষ্ম বললেন, মহারাজ যুদ্ধে যাঁরা নিহত হয়েছেন তাঁরা সকলেই কালের প্রভাবে নিজ কর্মের ফল পেয়েছেন, তোমার বা দুর্যোধনের কর্মের জন্য তাদের মরণ হয়নি। অতএব তুমি শোক ত্যাগ করো।

আজ আমি বুঝতে পারি, আমাদের সব কাজ নিয়তি নির্দিষ্ট পথে প্রভাবিত হচ্ছে। একটি সাপ লেজ থেকে নিজেকেই খেয়ে চলেছে। তার এই আত্মভক্ষণের, নিরাকরণের যেন শেষ নেই। আমি শুধু এক অদৃশ্যের আজ্ঞা পালন করছি। মনের জোর বলে যদি কিছু থাকে, তা কি কোনও কাজে আসে? এক গল্প থেকে আরেক গল্পের দিকে আমরা ঝরা পাতার মতো ভেসে যাই।

এরই মাঝে তবসুমের ফোন আসে।-কী ব্যাপার, জনাব? আপনার খুসবুটুকুও যে আর পাওয়া যায় না।

-এই-। কিছু না বলতে পেরে আমি হাসি।

-মান্টোর উপন্যাস কি এভাবেই পড়ে থাকবে?

-কেন?

-আপনার তো আর অনুবাদ করার গরজই নেই দেখছি।

-না-না-। আবার শুরু করতে হবে।

-কী হয়েছে আপনার?

-কিছু না।

তবসুমের হাসি আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

-এই এক আপনার কিছু না। মাঝে মাঝে কী যে কিছু না-তে পেয়ে বসে আপনাকে। কিছু না-টা কী বলুন তো।

-একটা সাদা পৃষ্ঠার সামনে বসে থাকা।

-মানে? এখনই তবসুমের চোখ দুটো নেচে উঠল, আমি দেখতে পাই। আর এই নেচে ওঠায় সঙ্গত করছে তার দুই চোখে আঁকা সুরমার রেখাবিন্যাস।

-সাদা পৃষ্ঠার সামনে বসে আছেন তো আছেনই। তারপর কখন ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে শুরু করল অক্ষর, ছবি।

-সেই অক্ষর কবে ফুটবে?

-আপনি বাশোর কবিতা পড়েছেন?

-কে বাশো?

-সপ্তদশ শতাব্দীর জাপানি হাইকু কবি। বাশো লিখেছিলেন, বুনো হাঁসের মতো আমরা মেঘের ভেতরে হারিয়ে যাব।

-আপনার সঙ্গে আমি তাল রাখতে পারব না জনাব। এই অনুবাদ শেষ হবে না, আমি বুঝতেই পারছি।

-কেন?

-আপনি এখন সাদা পৃষ্ঠার সামনে বসে আছেন। কবে যে অক্ষর ফুটবে, ছবি দেখা দেবে, কে জানে!

-গালিবের সেই গজলটা একবার বলেবেন?

-কোনটা?

-ওই যে- গরমী-এ-নিশাত-এ-

-হুঁ গরমি-এ-নিশাত-এ তসব্বর-সে নগ্ন সংজ
ম্যায় অলী-এ গুলশ-এ না-আফ্রীদ হুঁ।

-তা গানের নেশায় বুদ হয়ে থাকা বুলবুলের বাগান কবে রচিত হবে?

-সে যেদিন ডাকবে।

-কে?

-এবার শীতের মাঝেই যে বসন্তের হাওয়া নিয়ে এল।

তবসুম হাসে।-কী ব্যাপার জনাব? কারোর প্রেমে পড়লেন নাকি?

-অ নিকলতা হ্যয় কভু হসতা, তো হ্যয় বাগ ও বহার
উসকী আমদর্মে হয় সারী ফষ্ট্রে আনে কী তরম্।

-ও বাবা মীর-এ ডুবে আছেন নাকি?

 -উর্দু গজলে মীর সবচেয়ে সেনসুয়াস, আপনার মনে হয় না? গালিবে মেধার দ্যুতি, আর মীর যেন রক্তমাখা হৃদয়টাকে হাতে তুলে দেন। গালিব কোথাও নিজেকে আড়াল করেন। ঘোমটার আড়ালের সৌন্দর্যই তাঁকে টানে।

-ঠিক বলেছেন। কিন্তু আড়াল করার শিল্পটা গালিবের কাছেই শিখতে হয়। মীরের বুকে আপনি হাত রাখতে পারেন, ছুরিও বসিয়ে দিতে পারেন। গালিব অনেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা আয়না। সে শুধু প্রতিবিম্ব গ্রহণ করে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকে। কী অদ্ভুত দেখুন, এই আয়না। সব কিছুর ওপর মানুষ তাঁর ছাপ ফেলে রেখে যেতে পারে। কিন্তু আয়নার সামনে আপনি যতক্ষণ, ততক্ষণই, তারপর আপনি হারিয়ে যাবেন। গালিব সেইরকম একটা আয়না। আয়নার সামনে তকে সরে গেলেই আপনি আর কোথাও নেই।

-আমি ভাবিনি তবসুম।

-কী? তবসুমের কণ্ঠস্বরে একটি পাখি উড়ে যায়।

-গালিবকে আপনার মতো করে তো ভাবিনি।

-আপনি তো আপনার মতোই ভাববেন।

-না তবসুম। আমি এই ধরনের ইন্ডিভিজুয়ালিটিতে আর বিশ্বাস করি না। ধর সূফী গল্পে, জেন গল্পে, এস্কিমোদের গল্পে যে-ভাবনা রয়ে গেছে, আমরা সেভাবে ভাবব না কেন? আমরা ব্যাসদেবের মতো কেন ভাবতে পারব না? কেন মীরাবাঈ-এর মতো ভাবতে পারব না? আমাদের যাজ্ঞবল্ক্য বলেছিলেন, সব ছাপিয়ে যাবার পর আর সংজ্ঞা থাকে না।

-আপনার কী হয়েছে? তবসুমের কথা শান্ত হাওয়ার মতো আমার মাথার ওপর দিয়ে বয়ে যায়। এইরকম হাওয়া এক সময় মিনিয়েচার পেন্টিং-এ সাইপ্রেস গাছের মাথার ওপর দিয়ে বয়ে যেত।

-কেন?

-আপনি কি কোনও ব্যাপারে ডিস্টার্বর্ড?

-না। অনেক নতুন-পুরনো মানুষেরা রোজ এসে আমাকে ঘিরে ফেলছে তবসুম। আমি তাদের কথা শুনতে চাই। কিন্তু আমার হাতে সময় বড় কম।

-মানে?

-বাদ দিন। আমরা আবার কাল থেকে কাজ শুরু করব।

-এড়িয়ে যাবেন না প্লিজ। আপনার হাতে সময় বড় কম-এর মানে কী?

-তাহলে একটা কবিতা শোনাই আপনাকে।

-কার?

-সেই বুড়ো নাবিকের। শুনুন-

দেখিলাম-অবসন্ন চেতনার গোধূলিবেলায়
দেহ মোর ভেসে যায় কালো কালিন্দীর স্রোত বাহি
নিয়ে অনুভূতিপুঞ্জ, নিয়ে তার বিচিত্র বেদনা,
চিত্র-করা আচ্ছাদনে আজন্মের স্মৃতির সঞ্চয়,
নিয়ে তার বাঁশিখানি। দূর হতে দূরে যেতে যেতে
ম্লান হয়ে আসে তাঁর রূপ, পরিচিত তীরে তীরে
তরুচ্ছায়া-আলিঙ্গিত লোকালয়ে ক্ষীণ হয়ে আসে
সন্ধ্যা-আরতির ধ্বনি, ঘরে ঘরে রুদ্ধ হয় দ্বার,
ঢাকা পড়ে দীপশিখা, খেয়ানৌকা বাঁধা পড়ে ঘাটে।
দুই তটে ক্ষান্ত হল পারাপার, ঘনাল রজনী,
বিহঙ্গের মৌনগান অরণ্যের শাখায় শাখায়
মহানিঃশব্দের পায়ে রচি দিল আত্মবলি তার।
এক কৃষ্ণ অরূপতা নামে বিশ্ববৈচিত্রের পরে
স্থলে জলে। ছায়া হয়ে, বিন্দু হয়ে মিলে যায় দেহ
অন্তহীন তমিস্রায়। নক্ষত্রবেদীর তলে আসি
একা স্তব্ধ দাঁড়াইয়া, ঊর্ধ্বে চেয়ে কহি জোড়হাতে-
হে পূষ, সংহরণ করিয়াছ তব রশ্মিজাল,
এবার প্রকাশ করো তোমার কল্যাণতম রূপ,
দেখি তারে যে পুরুষ তোমার আমার মাঝে এক।

-আপনি কি ক্লান্ত?

-না। আমি খুব আনন্দে আছি তবসুম। নিজেকে হারিয়ে ফেলার আনন্দ। এই যে উপন্যাস্টা অনুবাদ করতে করতে আমি একটা খণ্ডহরের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছি। কত ভাঙা চুড়ির টুকরো, কত টুটাফাটা মসলিন, কিতাবের ছেঁড়া পাতা, শুকিয়ে যাওয়া আতরের ভেতরে ডুবে যাচ্ছি। উপন্যাস লেখা তো এভাবে হারিয়ে যাওয়ার জন্যই।

.

সেই আয়নার ভিতরে আমরা-আমি ও তবসুম-সাদাত হাসান মান্টোর পাণ্ডুলিপির সামনে বসে আছি। এই পাণ্ডুলিপি আমাদের এক গভীর সমস্যায় ফেলেছে। মান্টোর পাণ্ডুলিপিতে গালিব ও ফলক আরার কাহিনী ছয় নম্বর অধ্যায়ে। সাত নম্বর অধ্যায়ে মান্টো লেখেননি। কয়েকটা। পয়েন্ট লিখে মান্টো লিখেছেন, পরে লেখা যাবে। এই অধ্যায় লেখার কোনও আগ্রহ নেই এখন। সত্যিই মান্টোকে বোঝা যায় না। যেন পাঠক নয়, নিজে পড়বেন বলেই লিখে যাচ্ছেন। এরপরই মান্টো চলে গেছেন আট নম্বর অধ্যায়ে, যেখানে মির্জা গালিব দিল্লি এসে পৌঁছচ্ছেন। কিন্তু সাত নম্বর অধ্যায়টি আর কখনও লেখেননি মান্টো। তাহলে আমরা কী করব?

-সাত নম্বরটা কেন লেখেননি বলুন তো? তবসুম পাণ্ডুলিপির দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে।

হয়ত তখন লেখার মন ছিল না। প্রচুর হুইস্কি গিলে বেসামাল ছিলেন। কিন্তু পয়েন্টগুলো কী নোট করেছিলেন?

-মির্জার বিয়ে নিয়ে।

-পড়ুন শুনি।

-লিখেছেন, নবাব ইলাহি বক্স খানের মেয়ে উমরাও বেগমের সঙ্গে বিয়ে হল ১৮১০-এ। গালিবের বয়স তখন তেরো, আর উমরাও –এর এগারো। ইলাহি বক্স হচ্ছেন ঝিরকা ও লোহারুর নবাব আহমদ বক্স খানের ভাই।

-তারপর?

ইলাহি বক্সও গজল লিখতেন। তাঁর তখল্লশ ছিল মারুফ। দিল্লির অভিজাতদের একজন তিনি।

-তারপর?

-মির্জা এই নিকাহ মেনে নিতে পারেননি। আবার সেই বড়লোকের বাড়িতে বন্দি হওয়া। মির্জা তো নিজেই বলেছেন, আমার পায়ে শেকল পরানো হল। জস্ দওয়া অওর পাওঁ কী বেড়ি, মান্টোসাব লিখেছেন, এইসব বিয়ে-ফিয়ে নিয়ে একটা অধ্যায় লেখার কোনও মানেই হয় না। কিন্তু জমিয়ে তো লেখা যেত। অভিজাত মুসলিম পরিবারের বিয়ে। হাতি, ঘোড়া, পাল্কি, রোশনচৌকি, নাচা-গানা, বাঈ শরাব। আর মান্টোসাব কিছুই লিখলেন না?

-আর কিছু লিখেছেন?

-না। …ওঁ হ্যাঁ, একটা গল্প লেখা আছে।

-গল্প?

-শ্বশুর মারফকে নিয়ে।

-বলুন, শুনি।

-বেশ মজার গল্প। মারুফসাব একদিন মির্জাকে তাঁর বংশতালিকা নকল করে দিতে বললেন। মির্জা নকল করে দিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রথমজনের পর তৃতীয়জন, তারপর পঞ্চম-এইভাবে। দ্বিতীয়, চতুর্থ পুরুষদের বাদ দিয়ে গেলেন। মারুফসাব তো নকল দেখে রেগে কাঁই। এ কী করেছ তুমি মিঞা? মির্জা শান্ত গলায় বললেন, বংশতালিকা তো একটা মই ছাড়া কিছু নয়। এই মই বেয়েই তো আল্লার কাছে পৌঁছতে হয়। মাঝে মাঝে দুএকটা ধাপ বাদ গেলে ক্ষতি কী? আপনাকে একটু কষ্ট করে উঠতে হবে, এই আর কী!

-তারপর?

-মারুফসাব রেগে বংশতালিকার নকলটা ছিঁড়ে ফেললেন। মির্জাও তখন মুচকি হাসছেন।

-মান্টোসাব আর কিছু লেখেন নি?

-না।

-পাগল। চ্যাপ্টারটা লিখতেই পারতেন।

-কেন?

-নবাবের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে। কত স্কোপ ছিল বলুন তো? বাঙালি নভেলিস্টরা পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ত। চার পাতা জুড়ে উমরাও বেগমের সৌন্দর্যের বর্ণনা। তারপর দশ পাতা বিয়ের ডেসক্রিপশন। ইতিহাস থেকে ডিটেল খুঁজে খুঁজে এনে একেবারে টু টু দ্য লাইফ বর্ণনা। ভাবা যায়? পাঠককে গেলানোর মশলামুড়ি। মান্টোসাব এটাই লিখলেন না। প্রথম দেখার প্রেম থাকত -বড় বড় ডায়লগ লিখতে পারতেন, যাতে–

-আপনি বিশ্বাস করেন?

-কী?

-এইভাবে লেখা?

-তবসুম

সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি তাঁর দৃষ্টিপথে হাজার সারস উড়ে যাওয়ার ছবি দেখতে পাই। তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আয়নায় তবসুমের প্রতিচ্ছবি দেখি।

-উপন্যাস কেন লেখা হয় তবসুম?

-কেন?

-অন্ধকারের ভেতরে অনেক কণ্ঠস্বর শোনার জন্য।

-কাদের কণ্ঠস্বর?

-যাদের আমরা চিনি না।

-তার মানে, নভেলিস্ট তাঁর চরিত্রদের চেনে না?

-না।

-তা হলে মান্টোসাব তা হলে কেন মির্জাকে নিয়ে লিখছিলেন?

-মির্জাকে চিনতেন না বলে।

-উপন্যাস লেখার পর চিনতে পারবেন?

-না।

-তা হলে মান্টোসাবের উপন্যাস কোথায় পৌঁছবে?

-কোথাও না।

-আর মির্জা?

-তিনিও থাকবেন না। একটা ছায়া পড়ে থাকবে।

-কার?

-অনেকের। যারা আর কেউ নেই। তবসুম, আমি এই জন্য আর উপন্যাস লিখতে পারি না। অনেক কঠিন জিনিস আমি সহ্য করতে পারি। একটা ছায়া পড়ে আছে, আমি তাকে বইতে পারি না। চলুন, পরের চ্যাপ্টার থেকে শুরু করা যাক।

-আজ থাক। চলুন, আজ একটু কফি খেয়ে আসা যাক।

আমি সেই আয়ানায় তবসুমকে দেখি। কফি খেতে যাওয়ার কথা বলে সে কেমন নাচের ছন্দে উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত ডানার মতো মেলে দেয়।-কফি ভালবাসেন তো?

-হুঁ।

-আপনাকে আজ একটা স্পেশাল কফি খাওয়াব।

-মির্জাকে ছেড়ে কফি খেতে যাওয়াটা কি ঠিক? একটু সুরাপান করলেই কি ওনার প্রতি সম্মান জানানো হত না? আমি হেসে বলি।

-সে তো আমার সঙ্গে হওয়ার নয়, জনাব।

আমি এমন কফি শপে কখনও আসি নি। এ শহরে নতুন গজিয়ে ওঠা মুশায়েরা যেন। তবে এখানে হাফিজসাব বলতে পারবেন না,

সুবহস্ত সাকিয়া কদহ
পুর শরাব কুন
দোরে ফলক দিরেগ
নদাবদ শিবকুন।
(চেয়ে দেখো, সাকি, রাত্রি পোহায়
দাও মদিরায় ভরে এ পেয়ালা
ঊর্ধ্বে সমানে দে দৌড় দে দৌড় তাড়াতাড়ি করো, বয়ে যায় বেলা) এখানে বসা যায়, তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আধশোয়া হওয়া যায়। কফিশপ জুড়ে হাল্কা ভেসে বেড়ায় জোন বেজ বা কখনও কৈলাস খের; কখনও বেজে ওঠে এক ফেরারি মন-এর গান। তবসুম যে কফির অর্ডার দেয় তার নাম ব্ল্যাক কফি উইথ হানি। কাচের দীর্ঘ পাত্রে সেই গভীর বাদামি তরল আসে। একটু চুমুক দিতেই আমার মুখের ভিতর যেন কোমল এক পাখির উড়াল। তার ডানায় ক্যারামেলের সৌরভ।

-কেমন? তবসুম চোখ নাচিয়ে বলে।

-য়ে ন হী হমারি কিসম কে বিসাল-এয়ার হোতা
অগর অওর জীতে রক্তে য়হী ইন্তজার হোতা।

-আই ব্বাস। কফির টেস্ট এইরকম না কি?

-আপনি লক্ষ্য করেছেন তবসুম

-কী?

-কফি যত ফুরিয়ে আসছে, সুধাসাগর যেন ফুলেফেঁপে উঠছে।

-তাই?

-হুঁ।

-মির্জার কেমন লাগত এই কফি?

-গালিব মিঞা হয়তো লিখতেন-

গালিব ছুটি শরাব পর অব্‌ ভি কভি কভি
পীতা হুঁ রোজ-এ অবর ব শ-এ-মাহতাব মে

কিন্তু আজ আমাকে এই অমৃতের স্বাদের কাছে কেন নিয়ে এলে তবসুম?

তবসুম অনেক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, কাল থেকে আমরা সত্যি সত্যিই দোজখে ঢুকব জনাব।

-তাই?

-পরের চ্যাপ্টারে গালিব দিল্লিতে আসছেন। সে এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়। মান্টোসাব কী করে লিখলেন? দিল্লিতে এসে মির্জার প্রথম কথাবার্তা হল মৃতদের সঙ্গে। মৃতেরা তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। পড়তে পড়তে আমি কেঁদে ফেলেছি। বড় নিষ্ঠুর মান্টোসাব।

আমি মুখের ভিতর ক্যারামেলের স্বাদ নিয়ে খেলতে থাকি।

<

Rabisankar Bal ।। রবিশংকর বল