চিলেকোঠার সেপাই – ১০

রানুর অঙ্কের মাথা তেমন ভালো নয়। এসএসসি ১বার ফেল করেছে অঙ্কের জন্যে, আরেকবার অঙ্কের ভয়ে পরীক্ষা দেয়নি। অঙ্কের জন্য কোনো ক্লাসে তাকে ২বছর করে কাটাতে হয়েছে। রং কয়েকদিন ওসমানের কাছে অঙ্ক নিয়ে এসেছিলো। এরপর রানুর বাবা নিজেই এসে ওসমানকে ধরে। কয়েকদিন কলেজে যাওয়া-আসা না করলে কালো রোগা এই মেয়েটিকে পার করা কি তার মতো ছা-পোষা মানুষের পক্ষে সম্ভব? এখন বেশি টাকা দিয়ে স্কুল বা কলেজের শিওর-শট মাস্টার রাখা সাধ্যের বাইরে। বড়ো ছেলে মারা যাওয়ার উপার্জনের নিশ্চিত পথ বন্ধ। ওসমান তো মাঝে মাঝে প্রাইভেট টুইশান করতো। একটু বিবেচনা করে অল্প টাকা নিয়ে সে তার ছেলেমেয়েদের অঙ্ক শেখাবার ভার নিলে লোকটা নিশ্চিত হতে পারে। তা পয়সা দিয়ে মাস্টার রাখবে, এতে লোকটার এতোটা নুয়ে পড়ার দরকার কি? সপ্তাহ দুয়েক হলোওসমান পড়াচ্ছে, এর মধ্যে রানু এসেছে মোট ৪দিন। এর ২দিন ছিলো শুক্রবার। আজকেও শুক্রবার, রানু হয়তো পড়তে আসবে। ওসমান তাই অফিস থেকে বেরিয়ে প্রভিন্সিয়ালে খেয়ে নিয়েছে, তারপর সোজা চলে এসেছে ঘরে। রকে নিয়ে রানু এখানে আসে সাধারণত আড়াইটে তিনটের দিকে। রঙ্কুটার স্বভাব এমন যে, রানু থাকলে সে বড়ো অমনোযাগী হয়ে পড়ে। পেন্সিল দিয়ে রানুর পিঠে খোঁচা দেয়, রানু কলম নিয়ে রেখে দেয় টেস্ট পেপারের আড়ালে। রানুটা অন্যরকম। একমনে খাতার দিকে তাকিয়ে সে অঙ্ক দ্যাখে বা অঙ্ক কষে। এই শীতেও তার শ্যামবর্ণের নাকের হাঙ্কা-শ্যাম ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। এই সব বিন্দু এতো স্পষ্ট এদের সংখ্যা এতো কম যে, ইচ্ছা করলে সে সবগুলো দিব্যি গুণে ফেলতে পারে। কিন্তু ওসমান তখন অঙ্কের সংখ্যা গুণতে ব্যস্ত থাকে বলে রানুর নাকের ও নকের নিচে ঢেউ-খেলানো জায়গায় ঘামের বিন্দুগুলো অগণিত রয়ে যায়। ওসমান আজ বেশ কয়েকটা অঙ্ক গুছিয়ে রেখেছে, রানু ১টার পর ১টা অঙ্ক ভুল করবে বা ঠিক করবে এবং এই সুযোগে মাথা-নিচু করা রানুর নাকের ডগা বা তার আশেপাশের সবগুলো ঘামের বিন্দু গুণে ফেলবে। অথচ দাখো, রানুর কোনো পাত্তাই নাই। কিংস্টকের প্যাকেট আর ২টো মোটে সিগ্রেট। সিগ্রেট খেতে পারছে না, কারণ রানুকে অঙ্ক করাবার সময় ওর ধূমতেষ্টা পায় বেশি, তখন সিগ্রেট পাবে কোথায়? আবার সিলেট কেনার জন্যে নিচে যেতেও ভরসা পায় না, ঠিক ঐ সময়ে এসে রানু যদি ফিরে যায় তবে ফের কৰে আসবে তার ঠিক কি? এখনো আসছে না কেন? তাহলে নরসিংদি থেকে কোনো খারাপ খবর এলো? নরসিংদি ইপিআরটিসি সাব-ডিপোতে পুলিসের হাতে কয়েকজন কর্মচারী মার খেয়েছে। সকালে সিঁড়িতে রঞ্জুর সঙ্গে দ্যাখা হয়েছিলো, ওরা আলাউদ্দিন মিয়ার দলের ১টি ছেলের মুখে শুনেছে যে, আহত কর্মচারীদের মধ্যে ওর দুলাভাইও থাকতে পারে। রঞ্জকে হয়তো নরসিংদি যেতে হতে পারে। তারঞ্জনরসিংদি গেলেই বা কি? রানু কি একা আসতে পারে না? ওসমান বিরক্ত হয়। এই সব নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে কেবল আপন ভাই বাদ দিয়ে যাবতীয় তরুণের সঙ্গে একজন তরুণীর যৌন-সঙ্গম ছাড়া আর কোনো সম্পর্কের কথা চিন্তা করতে পারে না। যৌন-সঙ্গমকে নৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুমোদন দেওয়ার জন্যে বিবাহ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাকবিবাহ প্রেমের মহড়া চলে। বিয়ে করলেই যেমন ছেলেমেয়ে পয়দা করাটা অপরিহার্য, তেমনি প্রেম মানেই বিবাহ।
আবার ছেলেমেয়েদের মেলামেশা মানেই প্রেম-প্রেম, বিবাহ ও যৌন-সঙ্গম ছাড়া এরা কি আর কিছুই ভাবতে পারে না? ওসমান এর মধ্যে ১টা সিগ্রেট ধরিয়েছে, তার সিগ্রেটের ধোঁয়া ঘরের শূন্যতায় ১টি ঝুলন্ত পর্দা তৈরি করে। মাঝে মাঝে হাওয়ায় নিজেদের ওজনের ভারসাম্য রাখতে না পেয়ে ধোঁয়াগুলো শাদা ও হাল্কা ছাইরঙের পর্দায় ছেঁড়া-খোড়া নানারকম ছবিতে ওঠানামা করে। এদিকে ধোঁয়ার দিকে একভাবে দেখতে দেখতে তার চোখজোড়ায় পানি জমে, তখন ১টি হাল্কা নীলচে খাকি রঙের বোর্ডের ওপর সাটা ডিম্বাকৃতি পুরু কাগজ থেকে রানু ওসমানের দিকে তাকায়। তার পাতা-কাটা-চুল নির্দিষ্ট আঁকাবঁকা পথ বেয়ে মিশে গেছে ঘন কেশরাশিতে। গোলগাল ফর্স মুখে পাতলা ঠোঁটজোড়া খুব চেপে বসানো। কালো-সাদা ছবিতে পাতালা ঠোঁটে পান খাওয়ার আভাস। কাঠের ফেম এবং ধুলো ও কুল দেখতে দেখতে ওসমানের চোখে পানি হু হু বাড়ে। বিষাদেও হতে পারে। কারণ, এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে যে, ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় গড়ানো এই ছবিটি তার মায়ের। হোক না ধোঁয়ায় তৈরি, ভাসুকনা শূন্যতায়, তবু তো মায়ের ছবি ফিফটি সেভেন-সিক্সটি নাইন। এগারো বৎসর। ১১ বছর হলো মা মারা গেছে। ছবিটা কি তেমনি রয়ে গেছে? এই ছবির নিচে ছিলো জানলা, জানলার বাইরে পেয়ারা গাছের পাতা। পাতাগুলো রোদে কাপতো, বৃষ্টিতেও কাপতো। এমনকি খুব জোৎস্না হলে নিজের বেঁটায় ভর করে পেয়ার পাতাগুলো একটু একটু করে নাচতো নাচন ছিলো পেয়ারা পাতায়, কিন্তু আওয়াজ শোনা যেতো বাঁশঝাড়ের। এর সঙ্গে মিশে থাকে ভাঙাচোরা ও পলেস্তারা-খসা পুরনো দালানের সোদা ও ভাপসা গন্ধ। রাষ্ট্ৰীয় ও প্রাকৃতিক সীমানা এবং এতোগুলো বছর ডিঙিয়ে-আসা যেই সব দৃশ্য, ধ্বনি ও গন্ধের ভেতর বন্দি হয়ে শুয়ে থাকে ওসমান গনি। চোখের ওপরের পানি পাতলা পর্দায় দ্যাখা যায় পাতা-কাটা চুলের ভেতর বোকা সোকা চোখ-বসানো মায়ের গোলগাল মুখ। রানু মাথা নিচু করে অঙ্ক করবে যখন, ওসমান ওর মুখটা ঠিক ভালো করে দেখে নেবে।-রানু অনেকদিন বাঁচবে, এইতো রানু এসেই পড়েছে, সিঁড়িতে তার পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ওসমান উঠে বসলো। দরজা খুলে এসো’ বলে সিঁড়ির দিকে তাকালো।
যাক, ঘরেই আছো। কয়েকদিন তোমার পাত্তা নেই।
আনোয়ারকে দেখে ওসমানের ভয় হলো যে, ঘরে আর কাউকে দেখে রানু হয়তো ফিরে যাবে। এই ভয় অবশ্য এতো স্বল্পস্থায়ী যে, এটা ভালো করে বোঝবার আগেই রানুর জন্যে প্রতীক্ষা করতে হচ্ছে না বলে ওসমান বেশ লঘুভার হয়। যেন ম্যাটিনিতে হিচককের ছবি দেখে গুলিস্তানের সামনে রেলিঙে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে উত্তেজনা থেকে অব্যাহতিপাওয়া-চোখে সদ্যোজাত টাটকা বিকালবেলার মানুষের স্রোত ও যানবাহনের অবিচ্ছিন্ন চলাচল দেখছে।
খবর জানো নাকি দোস্ত? খুব গুরুত্বপূর্ণ খবর দেওয়ার জন্য আনোয়ার জুতো খুলে বিছানায় উঠে বসে, খোকা ধরা পড়েছে। আই মিন পুলিস এ্যারেস্ট করেছে।
‘হ্যাঁ, কাগজে দেখলাম। এনএসএফের খোকা তো? পাক-মোটরের কাছে কোন হোটেলে কার ওয়াইফকে রেপ করেছিলো, সেই চার্জে ধরেছে।’
আরে মানুষ খুন করে সাফ করে ফেললো, এখন রেপের চার্জে ধরে আসলে ওর সেফটির জন্যে ওকে ধরেছে, টু গিভ হিম শেলটার।’
শেলটার?
শেলটার বিহাইণ্ড দ্য বার! গভমেন্ট দারুণ প্যানিকি! গবর্নর হাউসও এখন গুণ্ডাপাণ্ডাদের জন্য যথেষ্ট সেফ নয়। ছাত্রদের নতুন প্রোগ্রাম দেখেছে? টুডেন্ট ফন্টে মনে হচ্ছে একসঙ্গে কাজ করা যাবে।’
এগারো দফা? ওসমান জিগ্যেস করলে আনোয়ার বলে, হ্যাঁ, কাগজে দেখেছোঁ?
কাগজে দেখলাম। আলতাফ একটা লিফলেট দিয়ে গেলো কাল। ডিটেল আছে।
‘কাল আলতাফ এসেছিলো?
হ্যাঁ। আমার নিচে দোতলায় একটি ছেলে পুলিসের গুলিতে মারা গেছে না?
‘সে তো মাসখানেকের ওপর হবে।’
‘আজ আলতাফের পার্টির ছেলেরা ঐ ছেলেটির ভাইকে নিয়ে যাবে ওদের মিটিঙে। কাল আলতাফর ওর বাবার সঙ্গে আলাপ করতে এলো, আমিও ছিলাম।
তা ওর ছোটো ভাইকে পাবলিকলি কান্নাকাটি করার জন্যে পটাতে পারলো? কেন, ওর বাপ টপ নেই? বলতে বলতে আনোয়ার উত্তেজিত হয়, বুড়ো অথর্ব টাইপের বাপ হলে আরো জমে। কাঁপতে কাঁপতে স্টেজে দাঁড়াবে, কাঁদতে কাঁদতে পড়ে যাবে। ব্যাস সার্থক জনসভা। তারপর নাটক শেষ হলে অর্গানাইজাররা বুড়োর পাছায় লাথি মেরে বলবে, ভাগ শালা, বাড়ি গিয়ে প্যানপ্যান কর!’ আনোয়ারের এই কথায় ওসমানের এতো খারাপ লাগে যে, ব্যাপারটিকে রসিকতা হিসাবে নিয়ে হাসি-হাসি মুখ করার জন্যে ঠোঁটের প্রয়োজনীয় প্রসারণ ও সঙ্কোচন ঘটাতে ওর অবস্থা কাহিল হয়ে যায়। রঞ্জুর বাবা মোটেও অথর্ব বুড়ো নয়, কিন্তু আনোয়ারের বর্ণনার ফলে ওসমানের চোখের সামনে মকবুল হোসেন সত্যি সত্যি অর্থব কুজো দাড়িওয়ালা ১ বুড়োর আকার পায় এবং নিহত পুত্রের জন্যে শোকপ্রকাশের পর পাছায় হাত দিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে ভিক্টোরিয়া পার্কের রেলিঙের বাইরে।
সিঁড়িতে ফের পদধ্বনি শোনা যায়। ওসমান টেবিলে হঠাৎ করে কি খুঁজতে শুরু করে। তার মনে হয়, রানু এসে পড়লো। আনোয়ারটা যদি ঘণ্টা দুয়েক পরে আসতে!
আরে এসো। আনোয়ার নবাগতকে খুব সাদরে আহবান করে, তোমাদের মিটিং কখন?’
আলতাফ একবার তার দিকে তাকায়, তুমি কখন এসেছে? তারপর ওসমানকে বলে, ওসমান, ওরা বিট্রে করলো কেন? এসবের মানে কি? আলতাফ বেশ রেগে গেছে, তোমার দোতলার ওরা এটা কি ব্যবহার করলো, এ্যাঁ? ঐ যে লোকটা পুলিসের গুলিতে মারা গেছে তার ছোটো ভাইকে আজ নরসিংদি পাঠিয়ে দিয়েছে। কেন? মিটিঙে যেতে দেবে না? কাল বললেই তো পারতো। গরজ তো খালি আমাদেরই, না?
আনোয়ার হাসে, তোমাদের মিটিং, গরজ তোমাদেরই হবে।’ আলতাফ একটু তেতো হাসি ছাড়ে, মিটিং শুধু আমাদের নয়, তোমাদেরও। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ স্ট্রিট কর্নার মিটিং করে বেড়াচ্ছে না? ১৪৪ ধারা আছে, ঘোষণা করে মিটিং করা যাচ্ছে না বলে এই পথ বার করা হয়েছে। তা লোকজন সহযোগিতা না করলে আমরা কি করবো? ছেলেটা ওর বড়ো ভাই সম্বন্ধে দু’একটা কথা বলতো, তাতে ওদের অসুবিধাটা কি?
ওসমান আস্তে আস্তে বলে, রঞ্জুর বড়ো বোনের হাজব্যান্ড নরসিংদি ইপিআরটিসি ডিপোতে কাজ করে। ওখানে কি গোলমাল হয়েছে, রঞ্জু বোধ হয় খোঁজ নিতে গেছে।
‘আরে ভাই, আমাদের ছেলেরাই তো প্রথম খবর দিলো।’ আলতাফ অধৈর্য হয়ে উঠেছে, ‘নরসিংদির ডিপোতে ওয়ার্কাররা স্ট্রাইক করেছিলো। মুসলিম লীগের এক লোক্যাল পাণ্ডা গুণ্ডাপাণ্ডা নিয়ে স্ট্রাইক ভাঙতে আসে, পুলিসও ছিলো। অনেক আহত হয়েছে। আমাদের ছেলেরাই তো বলেছে। এখন দেখছি বলেই ভুল করেছে।’ ওসমান জিগ্যেস করে, ও, তোমরাই খবর দিয়েছো? ‘আরে হ্যাঁ!’ আলতাফ ফের বলে, আমরা বললাম, আপনার ছোটো ছেলেকে স্টেজে দাঁড় করিয়ে দেবো, লোকে একটু দেখবে। তখন তো দেখি ব্যাটার মহাউৎসাহ, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার ছেলে যাবে না কেন? ওর ভাইয়ের কথা ও না বললে বলবে কে?—এই সব চাপাবাজি করে এখন দেখি সব হাওয়া! এদিকে মিটিঙের শুরুতেই ঘোষণা করা হয়েছে শহীদ-কি নাম যেন?—শহীদটার নাম যেন কি?’
আবু তালেব।’ ওসমান নিহত ব্যক্তির নাম মনে করিয়ে দিলে আলতাফ বলে, ‘হ্যাঁ, বলা হয়েছে যে, শহীদ আবু তালেবের ভাই আজ আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখবে। লোকজন সব অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে। ওর বাবা কি খুব ভয় পায় নাকি?
ভয় পাবে না কেন? আনোয়ার বলে, এমনি পুলিসের গুলিতে মারা পড়ায় পুলিস সেই লোকটার ওপর চটে আছে। মরা লোককে শাস্তি দিতে পারে না, শোধ নেবে আত্মীয়স্বজনের ওপর। আবার তারা যদি মিটিং করে বেড়ায় তো ফ্যামিলি কমপ্লিট করে ছাড়বে। ভয় পাবে না কেন?
আলতাফের রাগ আরো বাড়ে, আরে রাখো। হাজার হাজার লোক মিটিঙে যাচ্ছে, ১৪৪ ধারা আছে, তবু এ-ফাঁকে ও-ফাঁকে মিটিঙ করছে, মিছিল করছে, গুলির সামনে দাঁড়াচ্ছে। আর স্টেজে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলবে,—তাতেই বাপ মা ভয়ে অস্থির? পুলিসকে ভয় পায়, না? ভয় তো পাবলিকও দ্যাখাতে পারে!
‘পাবলিক মানে তোমাদের দলের ছেলেরা তো? আনোয়ার জিগ্যেস করে, ভয় দেখিয়ে গান-পয়েন্টে সবাইকে স্টেজে চড়াবে, তোমাদের দলের লোক বলে এ্যাঁনাউগ করবে, এটা কি ধরনের পলিটিক্স ভাই?
কোন পক্ষ নেবে ওসমান ঠিক বুঝতে পারে না। মিটিঙে পাঠাবার ভয়ে যদি রঞ্জকে নরসিংদি পাঠিয়ে থাকে তো মকবুল হোসেন খুব অন্যায় করেছে। আবার রঞ্জু বাওর বাবাকে ভয় দ্যাখাবার জন্যে পাবলিককে ব্যবহার করার ইঙ্গিত দেওয়ায় আলতাফের ওপরেও তার রাগ হয়। তাহলে এই সব গোলমালেই রানু কি ওপরে আসতে পারলো না? একবার নিচে গেলে হতো। চায়ের কেতলি হাতে নিয়ে সে বলে, তোমরা একটু বসো। আমি রাস্তার ওপার থেকে চা নিয়ে আসি।
ওসমানের দিকে কারো খেয়াল নাই। আলতাফ জবাব দেয় আনোয়ারকে, আমাদের দলে ওয়ার্কার এতো বেশি যে, যে-কেউ পুলিসের গুলিতে মরলেই তাকে দলের লোক বলে চালাবার দরকার হয় না। আমরা কথা দিয়েও ছেলেটিকে হাজির করতে পারলাম না বলে খারাপ লাগছে, কিন্তু এতে মিটিং পণ্ড হবে না, আমাদের ইমেজও নষ্ট হবে না। আমরা প্র্যাকটিক্যালি ইস্ট পাকিস্তানের ওনলি অর্গানাইজড় পাটি। এ কি দলের ফ্র্যাকশনের ফ্র্যাকশন, না চারজনের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি? শেষের কথাটি আনোয়ারকে বিশেষভাবে খোঁচা দেওয়ার জন্যে বললো, আনোয়ার কিছু না বলায় তার কথার প্রবাহ দ্বিগুণ বেগ পায়, আমরা ছাত্র ফ্রন্টে ইউনিটি করেছি শুধু সকলের মধ্যে ঐক্যবোধ গড়ে তোলার জন্য। আমাদের পাটির প্রোগ্রাম অনেক স্পেসিফিক, অনেক স্পষ্ট। কেবল সকলের মধ্যে পার্টিসিপেশনের ফিলিং দেওয়ার জন্যে সকলের সঙ্গে নেমেছি। আলতাফের কথায় জনসভার বক্তৃতার আবেগ ও চাতুর্য। আনোয়ার তাকে প্রায় জোর করে থামিয়ে দিয়ে বলে, এগারো দফা মেনে নিয়ে তোমাদের স্টুডেন্ট উইং কি অন্য পার্টিগুলোকে ফেভার করেছে? আমি তা বলিনি। আমি বলছিলাম যে, আমাদের ছয় দফা নিয়েই আমরা সম্পূর্ণ এগিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু কাউকে বাদ দিয়ে কাজ করতে চাই না বলেই আমরা এগারো দফার প্রোগ্রামে সাপোর্ট দিয়েছি। এটুকু তুমি যদি এ্যাঁপ্রিসিয়েট করতে না পারো তো সেটা খুব দুঃখজনক। বলতে বলতে আলতাফ হঠাৎ দাঁড়ায়, আরে ওসমান কোথায়?’
কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের ভাত-কাপড়ের কোনো গ্যারান্টি তো তোমরা দিচ্ছে না। অটোনমি অটোনমি করে পাকিস্তান হয়েছে। তোমাদের অটোনমিতে বাঙালি সিএসপি প্রমোশন পাবে, বাঙালি মেজর সায়েব মেজর জেনারেল হবে, বাঙালি আদমজী ইস্পাহানী হবে। তাতে বাঙালি চাষার লাভ কি? ডিপার্টমেন্ট ভাগাভাগি করে মানুষের ইমানসিপেশন হয়? তাহলে ওয়াপদা, পিআইডিসি, রেলওয়েজ ভাগ করে আইয়ুব খান বাঙালির ইমানসিপেশনে হেল্প করেছে? তোমাদের– ‘
ওসমান চায়ের কেতলি নিয়ে ঘরে ঢোকে। কাপে ও গ্লাসে চা ঢালতে ঢালতে সে হাঁপায় এবং বলে, তাড়াতাড়ি চা খাও। নিচে একটা ঘাপলা হয়েছে।’
কি হয়েছে? কি হলো? আনোয়ারের উদ্বেগে তেমন সাড়া না দিয়ে আলতাফ বলে, ‘বাঙালি আদমজী ইস্পাহানী তৈরি করার প্রোগ্রাম নিলে মানুষ এভাবে সাড়া দেয়?
শোনো দোস্ত। পাকিস্তানের এ্যাঁবসার্ড ও উদ্ভট জিওগ্রাফির জন্যে যে কোনো নেগলেকটেড রিজিওনের লোকের ধারণা হতে পারে যে, এই ভৌগোলিক অবস্থাই তাদের সমস্ত দুঃখকষ্টের একমাত্র কারণ। এই এ্যাঁবসার্ড জিওগ্রাফি থাকবে না, ইট মাস্ট গো। কিন্তু পাকিস্তান নিয়ে মুসলমানরা যখন নাচানাচি করছিলো তাদেরও আইডিয়া দেওয়া হয়েছিলো যে, হিন্দুদের তাড়াতে পারলেই তাদের ইম্যানসিপেশন হবে।’
তাদের এই তর্ক আরো চলতো। কিন্তু ওসমান বারবার তাগাদা দেয়, চলো, চলো। রঞ্জুর বাবাকে ডেকে বাড়িওয়ালা খুব ধমকাচ্ছে। পাড়ার লোকেরা খবর পেয়ে উনার বাড়ি ঘেরাও করতে যাচ্ছে।

নিচে রাস্তায় বেশ বড়ো ধরনের জটলা। চট করে হাড্‌ডি খিজিরকে চোখে পড়ে। তার গলাও সবচেয়ে উঁচু, আমি নিজে দেখছি মাহাজনে উনারে ধামকি দিতাছে, মাহাজনে কয় পুলিসে এক পোলারে মারছে, বাকিটারে পুলিসের হাতে তুইলা দিমু আমি নিজে। কি চোট ছাড়তাছে। আমাগো সায়েবে না গেলে মনে লয় দুইচইরখান চটকানা ভি মাইরা দিতো।’
আঃ! তুই চিল্লাস ক্যালায়? আলাউদ্দিন মিয়া ধমক দেয়, কিন্তু তেমন জোরে নয়। আলতাফকে দেখে সে অনুযোগ করে, আপনে তো পিঠটান দিলেন, পোলাপানে আমারে কয়, মিটিং তো আর ধইরা রাখতে পারি না। পাবলিকে শহীদের ভাইয়েরে দ্যাখবার চায়।
আলতাফ বলে, আমি তো ওদের ঘরে গিয়েছিলাম। শুনি ওর ছোটো ভাই গেছে নরসিংদি আর বাপ কোথায় যেন বেরিয়ে গেছে।
খাইবো ক্যালায়? খিজির আলি ফের এগিয়ে আসে, বাড়িআলা কাউলকা রাইতে একবার ধামকি দিয়া গেছে, রঞ্জুরে জানি মিটিঙেনা পাঠায়। আবার আউজকা মকবুল সাবরে ধইরা লইয়া গেছে। মহল্লার পোলাপান না গেলে তো মাইর দিতো। মিটিঙের মইদ্যে উনিরে এই কথাগুলি কইতে হইবো। ব্যাকটি কইয়া দিবো। মাহাজনে কি কইরা তারে বেইজ্জতি করছে পাবলিকরে কইয়া দিবো। উত্তেজনা ও আবেগে খিজির কাপে, মহল্লার মাইনষে আউজকা মাহাজনরে বানাইয়া ছাড়বো’
‘তুই চুপ কর না। তাকে ধমকে থামায় আলাউদ্দিন, বাঙ্গুর লাহান খালি প্যাচাল পাড়স। মিটিঙের মইদ্যে এইগুলি কইবো ক্যালায়? মিটিঙের এজেন্ডা আছে না?
এইসব হৈচৈ ও লোকজনের মাঝামাঝি হাতে-কাচা ঘি রঙের শার্ট ও সবুজ চেক চেক লুঙির ভেতর থর থর করে কাপে মকবুল হোসেন।
তার ঠোঁটের কাপন দেখেই রঞ্জু ওপরের দিকে তাকায়। ওদের বারান্দায় রেলিঙে কুকে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রানু। রানুর মুখ ভয়ানক ফ্যাকাশে। আহা! মেয়েটা নিশ্চয় খুব ভয় পেয়েছে। চারপাশের কোলাহল ওসমানের কানে বাজে আবহ-সঙ্গীতের মতো, এসব ছাপিয়ে শোনা যায় রানুর মিনতি, আপনে একটু বলেন না। আব্বারে মিটিঙে নিলে আব্বা কিছু বলতে পারবে না, আব্বা এক্কেবারে সাদাসিধা মানুষ! আব্বারে আপনে ঘরে নিয়া যান। ওসমান ফের ওপরে তাকায়,–না, কোথায় রানু? ইশারায় তাকে ডেকে রানু কি এই সব কথা তাকে বলতে পারতো না? ওসমান ভাবে, যাই, রানুকে বলে আসি, আমি তো আছি। তোমার বাবাকে আমি দেখবো। তুমি কিছু ভেবো না।-কিন্তু রানুর সঙ্গে এইসব কথাবার্তা বলার বা তার ওপর রানুর আস্থা উপভোগ করার কপাল কি ওসমানের হবে? লোকজন শালা ছুটছে।
ছুটন্ত জটলার ভেতর থেকে হঠাৎ স্লোগান ওঠে শহীদের রক্ত’-বৃথা যেতে দেবে না। এরপর ফের স্লোগান আরু তালেবের রক্ত-বৃথা যেতে দেবে না। এরকম ২/৩ বার স্লোগান দেওয়ার পর খিজিরের উচ্চকণ্ঠ শোনা যায়, আইয়ুবের দালাল মাহাজন।’ কিন্তু এর কোনো জবাব পাওয়া যায় না। দ্বিগুণ শক্তিতে খিজির চিৎকার করে, আইয়ুবের দালাল মহাজন? এবার জবাব আসে, ‘ধ্বংস হোক, ধ্বংস হোক!’ তারপর ফের স্লোগান ওঠে, মাহাজনের জুলুম, মাহাজনের জুলুম’–’চলবে না, চলবে না। খিজির এবার ফের নতুন প্লোগান তোলে, মানুষরে ডাইকা বেইজ্জতি করা’-‘চলবে না চলবে না’ পাড়ার ছেলেরা মনে হয় মজা পেয়েছে, খিজিরের রাগ তারা উপভোগ করে। রঞ্জুর বাবার ঠোঁট আরো তীব্রভাবে কাপে, ওসমানের ভয় হয়, এরা কি রহমতউল্লার বাড়ি থেকে রানুদের উচ্ছেদের ব্যবস্থা করছে? আলাউদ্দিন মিয়া ছিলো মিছিলের পুরোভাগে, খিজিরের দিকে তাকিয়ে সে একটু থামে। মিছিল এগিয়ে চলে। ওপরের দিকে চামড়া জড়ানো হাড্‌ডিসর্বস্ব হাত ওঠানো খিজির তার সামনে এলে আলাউদ্দিন চোখ ঘুরিয়ে একটু নিচুস্বরে বলে, ‘খ্যাচরামো করনের জায়গা পাইলি না, না? এইগুলি কি কস হারামজাদা, এইগুলি কি? খামোস মাইরা থাক।
কিন্তু আনোয়ার এগিয়ে আসে, কেন? মহাজন তো খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। তার বিরুদ্ধে শ্লোগান দিলে ক্ষতি কি?
খিজির আলি ভরসা পেয়ে বলে, আরে আমি তো তাই কই রঞ্জুর বাপে ইস্টেজের উপর খাড়াইয়া কউক, মাহাজন আমারে লইয়া গিয়া বেইজ্জত করছে! আপনেরা বিচার করেন।’
আনোয়ার সায় দেয়, বলুক না! আইয়ুব খানের লোক্যাল এজেন্টদের এক্সপোজ করা দরকার।
আলাউদ্দিন মিয়া কিন্তু আনোয়ারের দিকে মনোযোগ দেয় না। এমন কটমট করে খিজিরের দিকে সে তাকায় যে, মনে হয় ওকে আচ্ছা করে পেটাতে পারলে তার শীররটা জুড়ায়। কিন্তু মামার বদভ্যাসগুলো তার ওপর বর্তায়নি। চাকরের গায়ে সে কখনো হাত তোলে না, পারতপক্ষে মুখও খারাপ করে না। তাহলে কি খিজিরকে আজ বরখাস্ত করে দেবে? তবে আপাতত সেই কাজ স্থগিত রেখে আনোয়ারকে বলে, আপনেরা আমাগো মহল্লার খবর রাখেন না, তাই এইসব কথা কন রহমতউল্লা সর্দাররে ওপেনলি কনডেম করলে মহল্লায় রি-এ্যাঁকশন খারাপ হইবো, বুঝলেন না?
আলতাফ এবার এগিয়ে আসে আনোয়ারের সমর্থনে, মুসলিম লীগের এইসব পচারদি মালের বিরুদ্ধে কথা বললে কার গায়ে লাগবে?
দরকার কি? আলাউদ্দিন তর্ক করে, মকবুল সাব মঞ্চে দাঁড়াইয়া কইবো, তার পোলারে পুলিসে গুলি করছে তার পোলারে মারার ফলে তাদের ফ্যামিলিতে মুসিবত নাইম আসছে, তার পোলা ছিলো ফ্যামিলির ওনলি আর্নিং মেম্বার।-এইগুলি বলুক। আমাদের দরকার পাবলিকের সিমপ্যাথি, না কি কন?
আনোয়ার তবু গো ছাড়ে না, স্টেজে উঠে কান্নাকাটি করার দরকার কি? এতো নাটক হচ্ছে না, পাবলিক কাদানো আমাদের উদ্দেশ্য নয়, বরং মহাজনের শয়তানিটা এক্সপোজ করলে কাজ হয়। তাই না আলতাফ ?
আলতাফ এবার আলাউদিনের ওপর খুব বিরক্ত হয়েছে, ঐ লোকটাকে এতো ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনাকে পুলিশ এ্যাঁরেস্ট করে যখন তখন এই লোক পুলিশকে ঠেকাতে এসেছিল? তার স্বর একটু নরম হলো, আপনি সেই কবে থেকে পলিটিক্স করছেন, এতো সাফার করলেন, তবু এদের চিনতে পারেন না?
‘ঐগুলি কথা কইয়া ফায়দা কি, কন? আলতাফকে থামিয়ে দিলেও আলাউদ্দিন নিজেই ঐসব কথা শুরু করে, মুসলিম লীগের এগেন্সটে কথা বললে যখন গুনা হইতো, বুঝলেন, গুনা হইতো, জমাতে নমাজ ভি পড়বার দিতো না, আমরা তখন ছোটো আছিলাম, তখন থাইকা জানটারে বাজি রাইখা চোঙা ফুকতাছি। ঐ যে মুজিব ভাইয়ের পিছে খাড়াইছি, আর ইমাম বদলাই নাই, তার পিছনেই রইছি! একটু থেমে সে ফের বলে, ‘মহল্লার মইদ্যে কার কি রকম ইজ্জত আমরা জানি না?

Akhteruzzaman Elias ।। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস