চিলেকোঠার সেপাই – ০২

শ্যামবর্ণের রোগা ভাঙা গালওয়ালা এই লোকটিকে ওসমান অনেকবার দেখেছে। কোথায়? এই বাড়ির সিঁড়িতে? তাই হবে। আরো অনেক জায়গায় এর সঙ্গে দ্যাখা হয়েছে। কোথায়? স্টেডিয়ামে? হতে পারে। গুলিস্তানের সামনে সিনেমার পোস্টার দেখতে দেখতে হতে পারে। পল্টন ময়দানের মিটিঙের হতে পারে। ভিক্টেরিয়া পার্কে? আর্মানিটোলা মাঠের ধারে? ঠাঁটারি বাজারের রাস্তার ধারে বসে শিককাবাব খেতে খেতে? হতে পারে। বলাক সিনেমায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করতে করতে? হতে পারে। নবাবপুরে অনেক রাতে ঠেলাগাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে হালিম খেতে খেতে? আমজাদিয়ায় পাশের টেবিলে তর্ক করতে করতে? হতে পারে। মুখটা তার অনেকদিনের চেনা। নাকের ২পাশে ব্রণের দাগ, ২টো দাগ বেশ গভীর, এগুলো কি বসন্তের বন্ধ-করা চোখের পাতার প্রান্তে বড়ো ঘন কালো পল্লব। নাকের ডগায় ও পাতলা ঠোঁটে কালচে ছাপ। এলোমেলো চুলের এদিকে ছোটো কপালে ১টি ভাঁজও নাই। খোঁচা খোঁচা দাড়ি দেখলে বোঝা যায় এগুলো বেশ নরম। বয়স বোধ হয় ২০/২১-এর বেশি নয়, লোকটার পূর্ণ যৌবনকাল চলছিলো। তার চেয়ে ৫/৬ বছর ছোটো, একেবারে গড়পরতা চেহারা বলেই হয়তো এতো চেনা চেনা ঠেকে,-আর সে কিনা গুলিবিদ্ধ হয়ে মরার মর্যাদা পায়। ওসমান একটু কুঁকড়ে বাইরে তাকায়। বাইরে বৃষ্টি নাই, বৃষ্টিধোয়া আকাশে রোদ ঝকঝক করে। অথচ তার বাইরে যাবার উপায় নাই। দারোগা বলে, ‘আপনেরা ঐ ঘরে একটু বসেন। আধঘণ্টার ভেতর আপনাদের ছেড়ে দেবো।
ছেড়ে দেবে মানে? তারা কি তবে বন্দি পাশের ঘরে এসে রিয়াজউদ্দিন হাতলভাঙা চেয়ারে বসে বাইরের দিকে তাকায়। অন্য চেয়ারটিতে চশমা পরা একজন বেটে লোক । তক্তপোষে ওসমান এবং আরেকজন। লাল স্ট্রাইপের হাঙ্কা গোলাপি শার্ট ও পাজামা পরা এই যুবক হলো পারভেজ, তিনতলার ডানদিকে থাকে, মুখের গঠন ও বাঙলা বলার সময় যত্ন থেকে বোঝা যায় যে, তার মাতৃভাষা বাঙলা নয়। রিয়াজউদ্দিন সাহাব, এইতো পর্যু দুপুরবেলা আমি দেখলাম কে জুম্মার পর ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে ঘোড়ার গাড়িতেই স্ট্রাইকের এ্যানাউন্সমেন্ট চলছে আর তালেব বহুত গওর করে শুনছে। আমাকে দেখে বললে৷ কে, পারভেজ ভাই, মওলানা ভাসানী স্ট্রাইক কল করেছে, কাল কি আর অফিস উফিস চলবে?”
কি যে শুরু হইলো, ডেলি ডেলি হরতাল, ডেলি ডেলি ইস্ট্রাইকা’ রিয়াজউদিনের এই সংক্ষিপ্ত মন্তব্য শেষ না হতেই পারভেজ বলে, কালকেই তো, আমি দোকানে যাচ্ছি, দেখি আলি নেওয়াজের সেলুনে বসে তালেব ফিলিম ফেয়ার পড়ছে। তো বললো কি, আজ কৈ যান? আজ না স্ট্রাইক!’
“স্ট্রাইক তো সাকসেসফুল! কিছু দালাল বাদ দিলে কাল অফিস ব্যাকটি বন্ধই আছিলো।’ আলাউদ্দিন এবার এঘরে এসে তক্তপোষে বসে রিয়াজউদ্দিনকে লক্ষ করে একটু খোটা দেয়, ‘পাবলিকরে এইবার ঠেকা দেওয়া কাউরো কাম না।”
পারভেজ বলে, ‘জী। রাত্রে আমার ভাই বললো কে নীলখেতে গুলি হয়েছে, আমার সিস্টারের হাজব্যান্ড এসে বললো, হাতিরপুলের পাওয়ার স্টেশনের এক এমপ্লয়ি তো ডেথ হয়ে গেল। আমি ইম্যাজিন করতে পারলাম না কে আমাদের তালেব-‘ বাক্যের শেষদিকে তার গলা নোনা পানিতে ছলছল করে। তারপর প্রায় মিনিটখানেকের নীরবতা, পাশের কামরার দারোগা ও রহমতউল্লার নিচু স্বরের সংলাপে কিংবা মেয়েদের বিলাপে সেই নীরবতায় একটি টিলও পড়ে না। রিয়াজউদ্দিন হঠাৎ খসখসে গলায় ডাকে, আল্লা, আল্লাহু গনি। তার ডাকার ভঙ্গি দেখে মনে হয় যে, সম্বোধিত আল্লা বোধ হয় বারান্দায় কি পাশের কামরায় তার হুকুমের জন্যে প্রতীক্ষা করছে, আরেকবার হাক দিলেই মুখের বিড়িটা কানে ওঁজে এই ঘরে ছুটে আসবে। কিন্তু এবার ঘরে ঢোকে হাড়ডি খিজির, লোকটা আস্তে কথা বলতে পারে না, কাল গুলিতে মনে লয় সাত আষ্টজনের কম মরে নাই। তার এই কথায় সারা ঘর গমগম করে ওঠে। চশমাওয়ালা বেঁটে লোকটি বলে, ‘মরে কারা? এই মিছিল কন, মিটিং কন, ব্রিটিশ আমল থেকেই তো দেখছি। মরে কারা? সকলের দিকে সে প্রশ্নবোধক চোখে তাকায়, কিন্তু জবাবও দেয় সে নিজেই, “ভালো নিরীহ মানুষগুলো মরে। কৈ কোনো লিডার তো কখনো গুলিতে মরে না! মরতে হয়—।”
তালেৰ বেচারা খুব সিম্পল টাইপের ছিলো। আমি তো চার বছর থেকে দেখছি।” ‘আরে আমি চিনি ঐ পোলায় তখন ন্যাংটা থাকে। রিয়াজউদ্দিনের খসখসে গলা এবার আত্মবিশ্বাসে বেশ মসৃণ হয়েছে, ইসলামপুরে আমার কাটা কাপড়ের দোকান। আমার দোকানের লগেই গল্লি, লেন, ঐ গল্লির চাইরটা, না একটা দুইটা তিনটা বাড়ি পার হইলেই মতিহাজীর বাড়ি, ঐ বাড়ির দোতলায় অরা ভাড়া থাকতো! তালেবের বাপে আমার দোকানে কতো আইছে!” তালেব, এমন কি তার বাবাকেও চেনবার ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা পারভেজের চেয়ে পুরনো—এই তথ্যটি ঘোষণা করে রিয়াজউদ্দিন নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নেয়। চশমাওয়ালা বেঁটে নতুন ভাড়াটে, এখন পর্যন্ত কারো সঙ্গে তার তেমন আলাপও হয়নি। সুতরাং তালেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা প্রচারের প্রতিযোগিতায় নামা তার পক্ষে অসম্ভব। লোকটি হরতাল ও মিছিল সম্বন্ধে তার মতামত নতুন করে ব্যাখ্যা করে, খালি হরতাল, খালি মিছিল। দোকানপাট বন্ধ, অফিস বন্ধ, দেশের ডেভেলপমেন্ট হবে কি করে?
বুঝলাম তো আলাউদ্দিন তক্তপোষে ভালো করে বসতে বসতে উত্তেজিত গলায় জবাব দেয়, স্ট্রাইক করা মানুষের সিভিল রাইট। কিন্তু স্ট্রাইক করলে গুলি কইরা মানুষ মারতে হইৰো-এই জংলি এ্যাকশন কোন দ্যাশে দেখছেন? গলা একটু নিচু করে বলে, এদের এ্যাকটিভিটি হইল একটাই, মানুষরে যেমনে পারো জুলুম করো’
কি পাবলিক রাউডি হয়ে উঠলে—। চশমাওয়ালাকে প্রায় ধমক দিয়ে আলাউদ্দিন ৰঙ্গে ওঠে, কি বাজে কথা কন দেখতাছেন না, আমাগো ব্যাকটিরে কেমুন কায়দা কইরা আটকাইয়া রাখলো। কতোক্ষণ? ইসটুডেনরা ছাড়বো? গুলি কইরা মানুষ মারে, ইসটুডেনরা আইয়া পড়বো না?
ক্যামনে আহে? খিজিরের চড়া গলায় সবাই উসখুস করে, কিন্তু তার বাক্য অব্যাহত থাকে, ক্যামনে আইবো? ঘরের মইদ্যে পুলিস, রাস্তার উপরে পুলিস বিচরাইয়া দ্যাহেন, ছাদের উপরে ভি হালার পুলিস? ইসটুডেনে আইলে এই হালাগো ইষ্ণু টাইট করতে পারতো!”
পারভেজ বলে, “পুলিস যেখানে সেখানেই বহুত হুজ্জত।’ “আপনার আবার ভর কিয়ের? হালারা সইজ্য করবার পারে না খালি বাঙালিগো।” আলাউদিনের এই অভিযোগে পারভেজ একটু জড়সড় হয়। ওসমানের রাগ হয় পুলিসের ওপর। তার ইচ্ছা করে, বারান্দা থেকে রাস্তার মানুষকে ডাক দেয়, গতকাল হরতালের দিন পুলিসের গুলিবর্ষণে নিহত তালেবের লাশ এখানে। সবাই আসুক। স্বৈরাচারী সরকারের গুলিতে নিহত শহীদ তালেবের—। বাসনাটি তার মনেই থেকে যায়। রহমতউল্লা এই ঘরে এসে খিজিরের ওপর চড় মারার ভঙ্গিতে হাত তোলে, ‘খামোশ মাইরা থাক। তুই বেটা কি বোঝস? হাড়ডি খিজির চুপ করে থাকে। সে অবশ্য বেশ লম্বা, একটি টুলে না দাড়ালে তার গালে চড় মারা বাড়িওয়ালার পক্ষে অসম্ভব। বাড়িওয়ালার চাচামেচিতে ওসমানের অস্বস্তি ঠেকে। ইসলামিয়ায় এখন পায়া বোধ হয় শেষ হয়ে গেছে, ওদিকে সেন্ট্রাল হোটেলের পায়াটা ভালো, এখন রওয়ানা হলে অবশ্য ওখানে পৌছতে পৌছতে পায়া আর না-ও থাকতে পারে। তা হোক, নিগারে পরোটা-কলেজি মেরে আমজাদিয়ায় গিয়ে চমৎকার আড্ডা জমাতে পারতো। গতকাল গুলি চলেছে; নবাবপুর, গুলিস্তান, স্টেডিয়াম আজ নিশ্চয়ই খুব সরগরম। রবিবারের সকালটা পুলিসের হাতে মাঠে মারা গেলো।
হঠাৎ করে ১৮/১৯ বছরের ২ জন যুবক এই ঘরে ঢোকে। এদের ১ জনের সঙ্গে ওসমানের আলাপ আছে। এর নাম শাহাদত হোসেন ঝন্টু। ইউনিভারসিটিতে ইকনমিক্স পড়ে। শাহাদত হোসেন ঝন্টু ও তার সঙ্গীর উত্তেজিত ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যে, ব্যাপারটাকে এরা সহজে ছাড়বে না। পুলিসকে এড়িয়ে কিংবা পুলিসকে রাজি করিয়ে এরা এখানে যখন এসে পড়েছে তখন শালার হেস্তনেস্ত একটা না করে আর যাচ্ছে না। ওসমান ৰেশ চাঙা বোধ করে, কিন্তু ঝামেলা একটা হলে তাকেও ফের জড়িয়ে পড়তে না হয়।
“তোমাগো আওনের টাইম হইলো অহন।’ বলতে বলতে আলাউদ্দিন পাশের ঘরের দিকে আঙুল দ্যাখায়।
বটতলায় মিটিও। মিটিও এখানে চলছে।” বলে শাহাদত হোসেন ঝন্টু ও তার সঙ্গী পর্দা তুলে ভেতরে চলে যায়। ওসমান তাদের কারো নজরে পড়ে না। তাদের জন্য তৈরি মুখের বিশেষ ভঙ্গি শিথিল করে ওসমান পরবর্তী ঘটনার প্রতীক্ষা করে। ভয়ে বা ভক্তিতে বা এমনি নিয়ম পালনের খাতিরে রিয়াজউদ্দিন জোরে জোরে বলে, “আল্লা আল্লাহু গনি। এই ধ্বনিসমষ্টি দরজা দিয়ে বাইরে উধাও হয়। ঘরের সবাই এখন তাকিয়ে রয়েছে বাইরের দিকে। রিয়াজউদিনের ভাঙা ভাঙা মোটা গলার আওয়াজ বারান্দায় দাঁড়ানো লোকজন, পুলিস ও পার্টিশনের ক্যানভাসে আঁকা নদী, তালগাছ, সূর্য ও সাহসী পাখিদের কাপিয়ে ধাবিত হয় শূন্যতার দিকে। সেখানে রোদ ঝকঝক করে। পাশের ঘরে ছাত্র-নেতাদের একজন বলছে, বায়তুল মোকাররমে জানাজার পর দাফন হবে।’
জবাবে রহমতউল্লার স্বর ঠাণ্ডা ও শান্ত, “আরে বাবারা, চ্যাতেন ক্যান? গোসল টোসল কমপিলিট। গোরস্থানে খবর গেছে, কবর খোড়ার কাম চলতাছে। জানাজা হইবো ওহানেই। এর মইদ্যে পলিটিক্স ঢোকাইতে চান ক্যান?
‘পলিটিক্সের কি দেখলেন? আমরা অলরেডি এ্যানাউন্স করে দিয়েছি, জোহরের নামাজের পর বায়তুল মোকাররমে জানাজা, জানাজার পর আজিমপুর গোরস্থানে দাফন হবে। শাহাদতের এসব কথা বেশ গুছিয়ে-বলা। দারোগার স্বরও বেশ শান্ত, ছেলেমানুষি করছেন কেন? আপনারা এডুকেটেড লোক, হাইয়েস্ট এডুকেশনাল ইনস্টিটিউটের ছাত্র। জানেন না মুর্দাকে ইজ্জত করতে হয়? মুর্দার সামনে হৈচৈ করলে গোর আজাবের চেয়েও মুর্দা বেশি তকলিফ পায়।’
এ ঘরে আলাউদ্দিন উত্তেজনায় কাপে, ‘দারোগা সায়েব অহন দেহি মৌলবি ভি হইবার চায়! কেমুন ফতোয়া দিতাছে দ্যাহেন।
ও ঘরে বাড়িওয়ালা হঠাৎ বলে, চলেন, এই ঘর ছাইড়া যাই। বেচারা পোলটারে এটু আরামে থাকতে দেন। মৃত তালেবের স্বস্তির জন্য সবাইকে নিয়ে সে ঐ ঘর ছেড়ে চলে আসে। শাহাদত হোসেন ঝন্টু এবার ওসমানকে দেখেছে। কিন্তু দারোগার সঙ্গে কথা বলতেই সে ব্যস্ত। দারোগা কিছুতেই ওদের হাতে লাশ দেবে না, ‘ডেডবডি দিতে পারবো না ভাই। অর্ডার না থাকলে আমরা কি করবো? এদিক ওদিক তাকিয়ে সে বাড়িওয়ালার দিকে তাকায়, মুর্দার গার্জেনের রিকোয়েস্টে আমরা হেল্প করতে এসেছি।
এবার বাড়িওয়ালার গলা হঠাৎ একটু নিচে নামে, আমার ভাইস্তার লাশ আমরা জোহরের আগেই দাফন করতে চাই ।
আপনি কি ওর চাচা? শাহাদত এবার রহমতউল্লাকে বোঝাবার উদ্যোগ নেয়, তাহলে আপনি বুঝবেন। বায়তুল মোকাররম নামাজের পর কতো লোকে তার জানাজা পড়বে। শহীদের লাশ দাফন হবে কাউকে না জানিয়ে এটা কি ঠিক হবে?
“আমাগো উপরে আর জুলুম কইরেন না। রহমতউল্লার চোখজোড়া ছল ছল করে, বহুত গজব পড়তাছে, দ্যাখেন না কই আছে পোলার বাপ, আর পোলায় মরে গুলি খাইয়া।’ নোনাপানিতে তার গলা ভেজে, অর বাপের বয়স হইতাছে। তামামটা জিন্দেগি কাটলো পরের দোকানে গোলামি কইরা, টাঙাইল থাইকা আইয়া দেখবো- এবার সে একেবারে কেদেই ফেললো। রহমতউল্লার কান্না ভেতর-ঘরের মেয়েদের চাপাকান্নায় ইন্ধন জোগায়, তারা জোরে জোরে কাদার সাহস পায়। তালেবের বাবা এসে কি দৃশ্য দেখবে ভেবে ওসমানের কান্না পাওয়ার দশা ঘটে। তবে তার চোখে নোনা ভাপ ওঠার আগেই আলাউদ্দিন ঠাণ্ডা ও নোনামুক্ত স্বরে বলে, এর বাপে তো আউজকাই আইয়া পড়বো। বাপেরে একবার দ্যাখাইবেন না?
কি একটা কথা যে কইলা? রহমতউল্লা ভাগ্নের ওপর বিরক্ত হয়েছে, এর মধ্যেই তার গলা থেকে বিলাপ লুপ্ত হয়ে গেছে, তার বাপে গেছে টাঙাইল। মাহাজনের লাইগা কাপড় কিনবো-বাজিতপুর, বল্লা, কালিহাতি, পোড়াবাড়ি,-চাইরটা পাঁচটা হাট সারবো, কাপড় লইবো, কাপড়ের গাইট করবো, গাইট আবার তুলবো টেরাকের উপর। আরো দুই চাইর দিনের কম না। লাশ পইড়া থাকবো?
শাহাদতের সঙ্গী ছেলেটি প্রায় মিনতি করে, আমরা দুদিন তিনদিন চাই না। এই ঘণ্টা দুই আড়াইয়ের মধ্যে জোহারের নামাজ, নামাজের পর জানাজা। কতোক্ষণ লাগবে? এতোগুলো লোক অপেক্ষা করবে।’
বাড়িওয়ালার গলা ফের চড়ে যায়, তার হাত এখন বেশ শক্ত, তার বাপে থাকলে আপনেরা কইয়া দেখতে পারতেন। আর মায়ে কি কইবো, কন? আমি কি আর লাশ লইয়া মিছিল করবার দিবার পারি?
ওসমান গনি তখন ভেতরে তাকাবার চেষ্টা করে। রঞ্জকে ডেকে একবার বললে হতে না? তার ভাইকে যারা হত্যা করে তাকে দাফন করার ভারও তাদেরই হাতে থাকবে? কিন্তু রঞ্জু কোথায়? ভেতরকার কান্নাকাটিতে রঞ্জুর গলা আলাদা করে ঠাহর করা মুশকিল। আহা, ভাইয়ের জন্য কেঁদে কেঁদে বেচারার চোখজোড়া একেবারে লাল হয়ে গেছে! ওর লাল চোখ এবং নীলচে ঠোট নিয়ে রঞ্জু কি একবার আসতে পারে না? এলিফ্যান্ট রোড তো এখান থেকে মেলা দূরে! সেই রাস্তা ধরে গেলে হাতিরপুল পাওয়ার স্টেশনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভাইয়ের কথা ভেবে রঞ্জুর মনটা খারাপ হয়ে যাবে। ১০/১১ বছর আগে ওসমান কিছুদিন সেন্ট্রাল রোডে ছিলো। পুরনো এলিফ্যান্ট রোড তখন ফাঁকা ফাঁকা, দুইদিকে কোথাও কোথাও বাড়িঘর তৈরি সবেমাত্র শুরু হয়েছে। রাস্তার ২দিকে বেশির ভাগই নিচু জায়গা, ধানক্ষেত, মাঝে মাঝে পানিতে মুখ পর্যন্ত ডুবিয়ে শুয়ে থাকতো কালো কালো মোষ । সন্ধ্যাবেলা নিউমার্কেট থেকে একা একা ঘরে ফেরার সময় ওসমান দেখতে পাওয়ার স্টেশনের চিমনির মাথায় ১টি লাল আলো কোনো গ্রহের মতো স্থির হয়ে জুলছে। ঐ আলোর দিকে তাকিয়ে নির্জন রাস্তায় হাটতে হাটতে রঞ্জুর খুব মন খারাপ করতো। ওখানে চাকরি করতো ওর ভাই তালেব, কথা নাই বার্তা নাই ওখান থেকে বেরিয়ে মিছিলে ঢোকার অপরাধে নীলক্ষেতে তাকে গুলি করা হয়েছে। রঞ্জুর এই মন-খারাপে ওসমানের সারা শরীর ও মাথা শিরশির করে ওঠে। নিহত যুবকের লাশ নিয়ে ২ পক্ষের তর্ক তার কানের পাশ দিয়ে আলোর মতো গড়িয়ে যায়, সে কিছুই শুনতে পারে না।
শাহাদত হোসেন ঝন্টু তাকে জিগ্যেস করে, আপনি এখানে থাকেন? ওসমান তখন ১০/১১ বছর আগে এলিফ্যান্ট রোড ধরে ভ্রাতৃশোকগ্রস্ত রঞ্জুর চলাচল দ্যাখ্যা থেকে ফিরে আসে, বলে, ‘জি। শাহাদত ফের বলে, তিনটায় বায়তুল মোকাররমে প্রতিবাদ সভা, আসবেন। এখন যাই। দেখি।’ গোরস্থানে আসছি। একটু পরে আসবো।”
তোমরা যাও, জুরাইনে আমি খবর পাঠাইতাছি, গোরস্থানেই জানাজা হইবো, পোস্তগোলা, ফরিদাবাদ, মিলব্যারাক থাইকা মানুষ যাইবো। আলাউদ্দিনের এই সব কথা দারোগা বা রহমতউল্লার কানে যায় না, সে প্রায় ফিসফিস করে কথা বলছে। কিন্তু শাহাদতও ভালো করে বুঝলো বলে মনে হয় না। সঙ্গীকে নিয়ে শাহাদত বেরিয়ে গেলে দারোগ বলে, এবার লাশ বের করার ব্যবস্থা করতে হয়। রহমতউল্লার পেছনে পেছনে আলাউদ্দিন ও হাড্‌ডি খিজির ভেতরে চলে যায়। দারোগা এবার সিগ্রেট ধরিয়ে বারান্দা ও ঘরের মাঝখানের চৌকাঠে ১টা পা রেখে বলে, মুর্দার সঙ্গে আপনাদের যাওয়ার দরকার নেই। আপনারা অনেক কষ্ট করলেন, এবার বাড়ি গিয়ে আরাম করেন। ছাত্র ২টােকে সামলাতে পারার সাফল্যে দারোগা সিগ্রেটে কষে টান দেয়, ধোয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, সারাটা রাত ঘুমাতে পারিনি। হাসপাতালে এই লাশ গেছে আসরের নামাজের আগে। রাত যখন বারোটা তখনও পোস্ট মর্টেম কমপ্লিট হয়নি। কেন? ডাক্তার নেই। ডোমও পেলেন ডাক্তারও পেলেন তো কারেন্ট নেই। এদিকে ডিআইজি সাহেব বারবার বলে পাঠাচ্ছেন ভোর হবার আগে হাসপাতাল থেকে ডেডবডি বের করতে না পারলে ছাত্ররা একটা চান্স পেয়ে যাবে। রিয়াজউদ্দিন তার কিস্তিটুপিওয়ালা মাথা নাড়িয়ে দারোগাকে সমর্থন করে। দারোগার কথা শেষ হলেও তার মাথা নাড়ানো আর থামে না। তারপর সে শুরু করে জিভ নাড়াতে, ‘কাম পাইবেন কৈ? কৈ পাইবেন? ডাক্তারগুলির কথা কি কই? কয়দিন আগে ডাক্তাররা ইস্ট্রাইক করলো না? শুনছেন? —কুনো দাশের ডাক্তারে ইস্ট্রাইক করছে শুনছেন?
এদের কথা আর বলবেন না। দারোগা তার অসমাপ্ত বক্তৃতা সম্পূর্ণ করার উদ্যোগ নেয়, আমার এসপি সাহেব বলে, হাসপাতাল থেকে লাশ সরান ! লাশ সরান। সকাল হলে এই ডাক্তাররাই ছাত্রদের ইনফর্ম করবে। চশমাওয়ালা বেঁটেও তার সায় জানায়, এরা লাশ নিয়ে পলিটিক্স করে, মুর্দার ইজ্জত করতে জানে না, এদের দিয়ে কি হবে, বলেন।’
দারোগা হয়তো আরো কথা বলতো, কিন্তু ভেতর থেকে কান্নার প্রবল রকম একটি দমক ওঠায় সবইকে চুপ করতে হয়।
লাশের খাটিয়া কাধে তুলে নেয় রহমতউল্লা, রিয়াজউদ্দিন, আলাউদ্দিন ও ওসমান।
সইরা দাঁড়ান, সইরা দাড়ান’ বাড়িওয়ালার এই নির্দেশে সমবেত কান্নার ধ্বনি সমগ্র বাড়ি উপচে বাইরে গড়ায়।
কৈ যাও? ও আব্বাজান, বাবা আমার বাবারে লইয়া আপনেরা কৈ মেলা করলেন? নিহত যুবকের মায়ের বিলাপে খাটিয়া ভারি হয়ে উঠেছে। হাড়ডি খিজির সামনে যেতে যেতে আস্তে’, ‘ডাইনে’, এটু বামে যান প্রভৃতি নির্দেশ দিচ্ছে। ওসমানের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে পারভেজ। ওর খুব ইচ্ছা তালেবের শরীরটা একবার একটু বহন করে। আলাউদিনের দিকে সে আড়চোখে দেখছে। আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লালাহু বলতে বলতে রহমতউল্লা খিজিরের কাধে খাটিয়ার ১টি অংশ চড়িয়ে দেয়। খাটিয়ার পেছনে ২জন পুলিস। ১জন পুলিস ওসমানের কাছ থেকে খাটিয়ার ১টি অংশ নিজের ঘাড়ে নেয়, আর ১জন পুলিস নেয় আলাউদিনের ঘাড় থেকে। ওসমান এবার সবচেয়ে পেছনে। না, তারও পেছনে আসছে রঞ্জ, রঞ্জুর ঘাড়ে হাত দিয়ে রেখেছে পারভেজ। সিঁড়ির অন্ধকার মোড়ে এলে পারভেজকে নজরে পড়ে না। রঙ্গুনিজের দুই হাত কচলাচ্ছে। কেন? ছাইগাদায় লেবুগাছের সামনে রগুকি লেবু পাতা চটকাচ্ছে? খাটিয়া নিচে নামে। ওসমান ভয়ানক রকম বিচলিত হয়ে ভোররাতের স্বপ্ন ও সকালবেলার দৃশ্যের অস্পষ্ট ও অনিশ্চিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে। বলা যায় না, সে হয়তো এই অবস্থায় নিচেও পড়ে যেতে পারতো কিন্তু তার আগেই শহীদের রক্ত-বৃথা যেতে দেবো না। —এই সমবেত ধ্বনি তাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেয়।
১৭/১৮ জন যুবক ও প্রায় ২৫/৩০ জন পিচ্চি দাঁড়িয়ে শ্লোগান দিচ্ছে। সামনে শাহাদাত হোসেন ঝন্টুর সেই সঙ্গী। দারোগার চোখে কি চালাকি খেলে, খাটিয়া চটপট উঠে পড়ে রাস্তায় দাড়ানো পুলিসের ভ্যানে। ভ্যানে এক এক করে ওঠে রহমতউল্লা, রিয়াজউদ্দিন ও রঞ্জ। আলাউদ্দিন যুবকদের সঙ্গে কি বলছিলো, দারোগা তার পিঠে বেশ সম্ভমের ভঙ্গিতে হাত রেখে বলে, ‘আপনে আমার সঙ্গে আসেন, ওখানে চাপাচাপি হবে।’ তাকে প্রায় ঠেলে দিয়ে জিপে ওঠানো হলো। পারভেজ নাক ঝাড়ার জন্য উবু হয়েছিলো। ওসমান ভাবছিলো উঠবো কি উঠবো না, উঠলে কোন গাড়িতে এবং কোন দিক দিয়ে উঠবো। —এরই মধ্যে শহীদের রক্ত-বৃথা যেতে দেবে না’, ‘আইয়ুব শাহী জুলুম শাহী-ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক’-এইসব শ্লোগানের ধাক্কায় পুলিসের ভ্যান ও পুলিসের জিপ বাদিকে মোড় নিয়ে হেমেন্দ্র দাস রোড ধরে দ্রুতবেগে চলে যায় লোহার পুলের দিকে। চলন্ত ভ্যানে টাল সামলাতে সামলাতে উঠে পড়েছে হাড্‌ডি খিজির।

Akhteruzzaman Elias ।। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস