…জগুর পিসিমার ছড়া কাটাতে, যুক্তিতে, আমরা দুইজনে সুঘরাই হইতে সেই বিরাট বনস্থলীর প্রতি দৃষ্টি সঞ্চার করিলাম, এ বন দৃঢ়–পশু যেখানে পদে পদে পথে বাধা সৃষ্টি করে। ক্রমান্বয় আরোহী কল্পনা! দেখিলাম কুহক, আমরা বুঝিতে প্রয়াসী হইলাম, দেখিলাম হস্তী-দন্ত নির্ম্মিত রমণী, যিনি কহিলেন,–শত পুত্র গর্ভে ধরিলেও আমি কুমারী। এমনও যে কুড়লের আওয়াজ আমাদের চীনে বুলবুলির ডাক বলিয়া ভ্রম হইল, এ বনভুবঃ কুমারী যে! দূর হইতে ভাঙ্গিয়া ভাঙ্গিয়া বন্দুকের আওয়াজ আসিল, আমাদের দ্বারা বিবেচিত হইল, কোন পশুর (মিলন ইচ্ছা স্বর) মেইটিং কল!

আঃ! বন্দুকের আওয়াজও মেটিং কল!

এ কারণ যে এ বনভূমি রোসনাই! আমরা দুজনেই বড় মন কেমন অনুভবে, আবার কীদৃশী ঈর্ষায় আমি, কি ভয়ঙ্কর রোষে আমি, আবার ঠিক তখন পিকনিক পার্টিতে পোরটেল গ্রামোফনে একটি কমিক রেকর্ডের ফাটাতে পিন ঠেকিয়া ক্রমাগত একই শব্দের অদ্ভুতভাবে পুনরাবৃত্তি ঘটিতে আছে, যাহা আমারে অধিকতর উন্মত্ত করে! কোন ক্রমে আমি সুঘরাইএর প্রতি লক্ষ্য করিলাম, সেই দ্বিপ্রহরে এখন যেন সন্ধ্যাপ্রসবী শিঙ্গা বাজিতেছে! আমার আবার অক্ষর পরিচিতি ঘটিল! বুঝিলাম আমারও মনিব মাধব! আছেন, তাই আমি আর এক বুনো!

এই পৰ্য্যন্ত বিস্তারিয়া মনিব মহাশয় সদম্ভে প্রতিষ্ঠা করিলেন, ঐ বালক সেই মিসিং লিঙ্ক!

ল্যভ লেটারএর…!

ইনি এবং উচ্চারণের পরক্ষণেই মনিব পত্নী বিদ্যুতে জিহ্বা দংশনের পরই কহিলেন, ও মা, ঐ কারা আসছে দেখ…।

.

এই ডাগর মনোহর হিরণার টিলার উত্তরে আরও দেশদেশান্তর সকল আছে, এখন উত্তরে প্রতীয়মান ঐ ভাগে যোজনব্যাপী আলুলায়িত প্রলম্বিত রম্য উত্তম শ্রীমণ্ডিত উত্রাই, কোথাও একলা আতা গাছ, কখনও বা পাথরপৃষ্ঠ, মহুয়া স্থির সস্ত্রীক, তারপর সমতল; তারপরও চিঠি যাইয়া থাকে; ঐদিকে মানুষের নিঃশ্বাসে আকাশ খুব নীলিমা; চোখে জল; ঐ রাস্তা যারপরনাই লক্ষ্মী, যায় ও আসে, ঈদৃশ পথটি বেচারী ঘুমকে কভু সমালোচনা করে না।

মনিব মহাশয় ঐ পথে শরৎকালকে আসিতে দর্শনে বলিয়াছিলেন, শরৎ আসিয়াছে এস কাঁদি তাঁহার চক্ষু সজল হইয়াছিল।

বঙ্কিমবাবুর লাইন আষাঢ় আসিয়াছে এস নামি!

.

এখন পত্নীর ইঙ্গিতে, মনিব মহাশয় তাঁহার মানসিক শান্তি হইতে–তিনি যেহেতু বিচারই শান্তি বিশ্বাসী যেহেতু, তিনি কিছু সিদ্ধান্তে আসিয়াছেন, তিনি আপন বালভৃত্যকে আর এক সৌখীনতায় আপন সৌখীনতাতে (!) অন্তরিত করিতে পারিয়াছেন-উৎরাই পর্য্যবেক্ষণ করিলেন;

পরিদৃশ্যমান হইল এই যে, চৈত্রের ঘূর্ণায়মান বাত্যায়-জব্দ কিছু পাতার ন্যায় একটি দল, ইহা প্রভাময়ী; যে উহারা জনে জনে তুমুলগোঁয়ার বাতাসে গাত্রবস্ত্রাদি কেহ ফ্রক কেহ শাড়ী সামলাইতে যে, ইহা জলবৎই যে সকলেই অপূৰ্ব উৎসুক যে ঐ আলোড়িত দল গীত গাহিতে আছে, যাহারই এক আধ মাত্র ঘুরন্ত বাতাসে এত দূরেও ছিটকাই আসে।

এহেন দৃশ্য মারচ! অভিরাম রঙ্গিলা! উহারা যেন প্রকৃতিকে ডাকিতে গিয়াছিল, না না, তাহা কেন, উহারা প্রকৃতিকে বাড়ী পৌঁছাইয়া দিতে গিয়াছিল, যে ইহা নজরে মনিব মহাশয় পূর্ণ, ধীরে ধীরে বলিলেন,…বেশ দেখিতে লাগিতেছে না বল! আজব হেরোইক! উহারা যেন ব্রাহ্মণী হংসের রুট ধরিয়া। আসিতেছে না? সপ্লেইনডিড!…প্লেনডর!…

কে ওরা বুঝতে পাচ্ছ? মাগো আমার কথা ওরা বোধ হয় শুনতে পেয়েছে গো…লাজে মরি!

যে ইহা শুনিয়া মনিব মহাশয় তদীয় বৈষ্ণবীয় মনস্কতা হইতে, স্বীয় সহধর্মিণীরে আশ্বাস। স্বগতভাবেই দিয়াছিলেন, তুমি কি পাগল! ওরা কে…

বুঝতে পাচ্ছ না, ‘ছোট-বাইরেরা’ গো, যদি ওরা কিছু শুনে থাকে, ওরা বড় বাবা যেমন বলেন বড় জবরদস্ত মৌলবী!

হইবে না-ই বা কেন! হেডমিসট্রেস বলিয়া কথা…!

সম্প্রতি তাহারা, ঐ দল, দূরে থমকাইল, এখন কেমন একরূপ তাহারা দোমনা করিতেছিল অগ্রসর বিষয়ে, স্পষ্টতই যে এখন তাহারা রাস্তা ছাড়িয়া পার্শ্ববর্ত্তী জমিতে ইতস্তত রহিয়াছে! যাহা নেহারিয়া মনিব পত্নী ভ্রদ্বয় কুঞ্চিত করেন, ব্ৰীড়ায় অবনত মুখে জানাইলেন,না গো, ছ্যা ছ্যা ওরা নিশ্চই আমার ‘লাভ লেটার’ বলাটা শুনতে পেয়েছে! বড় তরাসে ওরা যদি এতটুকুন আঁশ গন্ধ রইল ত অমনি হাঁ হাঁ করবে’খুনি…।

তুমি খেপিয়াছ…আমার ধারণা বলে উহারা আমাদের এড়াইতে চাহিতেছেন, সেদিনকার ব্যাপারের, মানে সাঁওতাল নৃত্যের দিন মনে নাই!

.

রকমারি লণ্ঠন ও পেট্ররোমাক্সের বিকিরণ গাছলতাপাতা নানা ছাঁদে, বহুস্তরে, ভেদিয়াছে–কভু বা আজব রামধনু! ছটাস কতক নাবি জিনিয়াতে ও জলদি ডেলিয়াতে, কখনও আন্দোলিত চামেলীতে (আঃ আমাদের রিখিয়ার বাড়ীর জানালার নীচে কি অফুরন্ত চামেলী! কি তারিখহীন!), আবার অন্যদিকে সাঁওতাল রমণী যাহারা ইতস্তত আছে, তাহাদিগের দেহে ঐ আলো, যে এবং এই সকলের সেই ছায়াই যাহা ক্ষণিক নিমিত্তই চকিতেই জাগাইতে পরিশ্রম করিয়া করিয়া যায় মুরারীবাবুকে–ইনি তিনি যিনি রৌদ্র-প্রত্যক্ষ-বোধ লইয়া নিম-নিদ্রিত।

ইনি টুলেতে বসিয়া, যে টুল একটি ইজিচেয়ারের পিছনে আছে, ইহার শিয়রে পশ্চাৎ হইতে তিনি মাথা রাখিয়াছেন; তাই এইভাবে তাঁহার ঘাড়ের রেখাঁটি সম্মোহ হইয়াছে। নিশ্চয়ই তিনি এখানকার পাহাড়ী হাওয়ার মধ্যকার পারিপার্শ্বিকতাকে উক্ত আকার অতুলনীয় অভিব্যক্তিতে স্বপ্নে আনিতেছিলেন; যে তদীয় মুখমণ্ডল এরূপ যে স্বতঃই মনে হইবে যে মুহূর্তেই তিনি চোখ মেলিয়া ঘোষণা করিবেন, কি গ্রাণ্ড!

এবার ঐ মুরারীবাবুর আঁখিপক্ষ্ম কম্পিত ছিল, তিনি সজাগ; কেননা তিনি সজাগ, কেন না তিনি অলৌকিকতা শুনিতেছিলেন। কেহ, পরিতোষবাবুই, তাহা বর্ণিতেছিলেন যে: আমার স্ত্রী, শুধু আমার স্ত্রী বলি কেন, উহাদের গোষ্ঠী মানে ফ্যামিলির সবাই খালাস করিতে খুবই অর্থাৎ পারদর্শী, কি এক পুণ্য আছে! যদি ক্কচিৎ বাই চান্স একটি নষ্ট হয় ত কান্দিয়া আকুল হন, দু-তিন দিন অন্ন গ্রহণ পৰ্য্যন্ত করেন না, খালি কান্না! হা ভগবান, আমি জন্ম রহস্য দেখিতে বিহ্বল কেন হইলাম!

সে ক্রন্দন শুনিতে পাষাণ দ্রবীভূত হয়! কেদার দাস বলিয়াছিলেন এরূপ পাকা হাত ক্কচিৎ…একবার এক ছোকরা ডাক্তার এক পোয়াতি দর্শনে সেই গৃহস্থদের বলে,–যে মশাই কত বলিব–তোমরা গাছ চাহ না ফল চাহ…। আমার স্ত্রী বলেন তাহা শুনিয়া তাহার হাত অবশ। সেই বাড়ীর লোকেরা বলিল গাছ!

ঠিক এই সময়েতে নৃত্য উৎসবে বাড়ীর সিঁড়ির কাছে একটি ছোট ভীড় দ্বারা মধু মধুর হাস্য খেলিয়া উঠিল। যে বালিকা সেদিন চাননায়ার রোগা তীরে বালির বসত নির্ম্মাণ করিয়াছিল, আর যে, যে বালকের ভাগ্য, অপরূপ কান্তির নুড়ি সকল প্রাপ্ত ব্যাপারে, অতি অতি অতি শুভ সুপ্রসন্ন, আর এই বালকই বড় তীক্ষ্ণ তীব্র ভাবে চানোয়ার স্রোত দেখে, এবং এই দেখাঁটি ভবিষ্যতে যে কোন বহমানতা এমন কি নর্দ্দমার দ্রুত গতিপ্রবাহে আরোপিত হইবে, সে হাততালি দিয়া উঠিবেক, আঃ ঐ চানোয়া! ক্রমে ঐ ছবি তাহারই মধ্যে মরিয়া শুধু কম্পন হইবে কী?

আঃ কত বাস্তবতাই আমার রক্তে!

এখন ঐ বালিকা আর ঐ বালকের ছায়া সেই হাস্য-খর ভীড়কে শ্যামীকৃত করিয়াছিল; এবং মুরারীবাবু তদীয় (আমাদের মনগড়াই নহে) সব কিছু ঘোষণা করার মনোবৃত্তি হইতে অর্ধনিমীলিত চোখে হাস্যের প্রতি লক্ষ্যে আয়াস করিলেন।

এখন তাহার ঠাওর হইল, যে সিঁড়িতে, স্যর পি-র পরমা সুন্দরী নাতনি চতুর্দশী অলোকা! পিছনে জড়োয়া ক্যাপিটাল দেওয়া ফ্লটেড থাম–আর উপরে খিলানের রেখা; সামনে অলোকা; পাশেই তদীয় চমৎকার ‘সরাইল’ কুকুর (এরূপ নোবল কুকুর জাত খুব কমই) ও টর্চ হস্তে অলোকার পরিচারিকাবৃন্দ।

সে বেচারী অলোকা সদাই বিভীষিত, সর্প তাহার ভয়, উজর হাসনুহানা যাহার আতঙ্ক, স্ফূৰ্ত্তমান কামিনী গাছ দেখিলে যে নীল হইয়া যায়! ঐশ্বৰ্য্যময়ী অনলাকার মধ্যে তখনই চোরা-স্বেদ দেখা দেয়! তাহার অনামিকা যে নয় ক্যারেট হীরক খণ্ড ক্রমাগত ঐ সকল কিছুকে মহাস্পর্ধা শাসন করিতেছে, যে অলোকা চরাচরের দিকে চাহিয়া বলিতেছে, তোমরা আমাকে হে সৌরভিত বৃক্ষসকল, আর শঙ্কিত ভীত করিও না–তথাপি যে সেই অলোকাই ঐখানে থাকিয়া ঐ হাস্যে যোগ দিয়াছিল!

ঐ উদ্দীপনা এক শিশুকেন্দ্রিক।

অদূরে বিলি, যে এতাবৎ এক পেয়ারা গাছের একটি নমনীয় ডাল টানিতে থাকিয়া-ফলে তাহার দেহে আলোর হিলমিল আছে। নিজ জীবনযৌবনের উপাখ্যান কহিতে আছিল,–যে বহুতেই নিলর্জ হইয়াছে তাহার নিমিত্ত, এবং সে স্কুলে…যখন তখন টপসী (টমকাকার কুটির) ওরফে প্রমদা, যাহারে কাফ্রীর মত দেখিতে, যে তাহাদের ক্লাসে সর্বপ্রথম সাড়ী পরিতে বাধ্য হয়, যে তাহারে সে অনিমেষনয়নে দেখিত, প্রমদা রূপসী।

কিন্তু কি ভয়ঙ্কর তাহার ঠোঁট, গা কণ্টকিত হয়। এই বিবরণে শ্রোতারা ব্রীড়ায়ে চারিদিকের ঠিক লইয়াছে যে কেহ শুনিল কি! আরও আরও বিলি জ্ঞাপন করে, যে সে ইটুম্যান্ট বসের ডিভাইডারের কাঁটা দিয়া (তখনকার দিনে এমন লেখা খুব চলন ছিল) আপন হস্তে প্রমদার নামের আদ্যক্ষর ‘পি’ লিখিয়াছে, রক্ত পড়িয়াছে–ইহাতে যত কিছু ডাক বাবা-মা-ভাই ইত্যাদির স্বরভঙ্গ হইয়াছে–তবু সে মরিয়া!

ইতিমধ্যে ফ্রক পরা ও পুরুষ পোষাকে (যেহেতু তাহার মা ছেলে চাহে–হয় নাই বলিয়া তাহাকে পুরুষবেশী করে) একটি মেয়ের সান্নিধ্যে আসিতেই সে বলিয়াছে, অভাগীর স্বর্গ চমৎকার! কখনও ভগিনী নিবেদিতা, কভু পণ্ডিতানী রমাবাঈ, অতএব সে, বিলি, বহু প্রাচীন রীতির চতুর, বলিয়াছে, অজস্র শত চিঠি আমার নিকট জমিয়াছে…তাহা দিয়া আমি এলবামের মত(!) করিয়াছি…।

যে বিলি আবার আরম্ভিল যে একদা প্রমদার কুহকময়ী অগ্নি উদগার দেহ স্মরণে ‘এ কি এ কি!’ শব্দ উচ্চারিয়াছিল এবং যে তাহাতে ঘুম ছিল না! যে ইহা ভাবনা হইত তাহার নিজের দেহ যদি লীলা-র মত হয়, সত্যি যাহার বক্ষ সমতল ছিল! আমি রাতদিন ভগবানকে ডাকিতাম।

এ হেন যে বিলি সেও ঐ হাস্য খুসী উচ্ছাসে আকৃষ্ট হওয়ত-যে তখন বেচারী জানে নাই যে উহার কারণ কি, (আপন অনুগত) শিষ্যসমানদের লইয়া গ্রাভল পথে কর্কশ আওয়াজ তুলিয়া জলদিই এখানে, যেখানে মাধুৰ্য্য! এবং এই সময় এমন ঘটে–মনুশেফের স্ত্রী স্বীয় কন্যা অনুপমা–যে তাহার মায়ের অজস্র সঙ্কেত ইসারা দেখিয়াও দেখে নাই, যে বিলির সংস্পর্শ ত্যাগ করে না–পথ রোধ করিলেন।

অনুপমাকে কবলিত করিয়া তদীয় মাতা গোপনতা সৃষ্টি করত, উষ্মবর্ণ-প্রায় বাক্য উচ্চারণে তিরস্কার করিলেন,–রহ তোমার বাবাকে আমি বলিতেছি তুমি ওই ঢলানীর দুর্বিনীতার সহিত মাখামাখি। করিতেছ, উহার পদদ্বয়ের গড়ন বানরতুল্য! সে বিপথগামিনী, অনবরত মিথ্যাবাদিনী, বলে ডাইসেসন হইতে পাশ করিয়াছি, উহা মিথ্যা…কি এতেক তোমাদের কথা?

প্রথমে, এবম্প্রকার কটুবাক্যেও অনুপমার চোখ জোর হারায় নাই, যে সে বলিতে ইচ্ছুক যে বিলি খুব কালচারড, ফরওয়ার্ড! সে একা কলেজে যায়, সে আলোকপ্রাপ্তা!

অথচ এ সময় এবং তাহার কর্ণে বিলির শ্লেষ্ম-জড়িত স্বর ছিল, যথা প্রমদা বলিয়াছিল, বিবাহ না-হওয়া পর্যন্ত এ দেহ স্পর্শ করিতে দিবে না, বিবাহের পর যাহা খুসী যেখানে খুসী; এবং ইহা যে একদিন শিলা বৃষ্টিতে বিলির সারা অঙ্গে কিভাবে শিলা বাজিতেছিল!

এখন অনুপমার মৌনভঙ্গ হইল; তদীয় মাতাকে সে জানাইয়াছিল গত সরস্বতী পূজায় বিলির নিজেকে কি পর্য্যন্ত রমণীয় সুলক্ষণীয়া দেখিতে হইয়াছিল তাহারই কথা!

কিন্তু যে আদতে ঐ সূত্রে বিলি ঘোষণা করিয়াছিল, যে আমাকে অপূৰ্ব দেখিতে হইয়াছিল, মাথা ঘষিয়াছিলাম, সাগর-খেলা চুল মাথায়, পরনে বাসন্তী রঙের সাড়ী, কলেজের মেয়েরা সমস্বরে ‘আঃ!’ আনন্দিত ফুকারিয়া উঠিল, উঃ সত্যই আমাকে যা চমৎকার দেখিতে হইয়াছিল না, রাস্তার আবালবৃদ্ধ, সবাই হাঁ হইয়াছে, এক অতি নীচু ক্লাসের একজন লোক আমারে দেখিয়া উল্লাসে আতিশয্যে হাঁটু পর্যন্ত লুঙ্গি সংবৃত করত, লোকটি আপনার সমগ্র দেহ যেন ছুঁড়িয়া দিল, শ্রুত হইল…মাইরি দুইটি (ভাত) ছড়িয়ে দিও–পায়ে পড়িয়া থাকিব!

এবং বিলি কহিল আমি মন্তব্য করিয়াছিলাম কি অসভ্য! কি আস্পর্ধা! ছোটলোক মেয়েদের করিতে জান না!

আর যে অনুপমা যাহা স্মরণেও জন্মমূর্খের মত আপনকার মুখে ভাব আনিয়া স্থির থাকিয়া মাতাকে কহিল অন্য আর একটি মেয়েকে আপন সপক্ষে মানিল, কোকোও জানে জিজ্ঞাসা কর না কি গল্প হইতেছিল!

য-বাবুর ভগিনী, ইনি নিকটেই ছিলেন; ইনি বর্ষীয়সী, ইনি বিধবা, ইনি ‘উদভ্রান্ত প্রেম’ মুখস্থ বলিতে পারেন, হঁহার পায়ে কেডস এবং ইহার কারণে ইনি ঈষৎ কিন্তু-তে আছেন, ইনি কোকো নাম শুনিয়া বিস্মিত হইলেন, কোকো আবার কে? অবিলম্বেই তাঁহার দৃষ্টি ঐরূপ নামধারিণী অল্পবয়সী মেয়েটির প্রতি, এত বয়সেও তাহাকেও কুঞ্চিত করিতে হইল, যেহেতু ঐ মেয়েটি তাঁহারই বোনঝিরে বলিয়াছে যে তাহার নাম লাভলি।

অথচ উহার নাম দুর্গা, আশ্চর্য্য উহার, মেয়েটির মাতা প্রথম ঐ লাভলি নাম অস্বীকার করে, পরে বলিয়াছিলেন, উহার মামা রাখিয়াছিলেন।

যবাবুর ভগিনী অবাক হইয়াছিলেন, এখন তিনি থ, নিশ্চিত ভাবিলেন রিখিয়াতে আসিয়া এক একজন এক এক রূপ ধারণ করে…অনেকের কথা মনে আসিল–যে যাহা ভাবিলে গাত্রে সিঞ্চিড়া উপস্থিত হয়; মেয়েটি বিলির সহিত অহরহ কানে কানে কথা কয়!

অথচ দুর্গার মা বলিয়াছে, যে আমার কন্যা দুর্গা সেরূপ নহে, সে এখনও জানে, চুম্বনে পুত্র গর্ভে আসে, দুর্গা ‘মেস’-বাসী অসভ্যদের জুতা ঝাঁটা দেখাইয়া থাকে। য-বাবুর ভগিনীর একটি প্রবচন এই সূত্রে মনে স্বভাবতই আসিল।

পুড়বে মেয়ে উড়বে ছাই।
তবে মেয়ের গুণ গাই ॥

এবং চকিতে ইনি, খানিক বিলির প্রতি চাইলেন, তাঁহার দেহ মোচড় দিল, এই বিলিই দূর সম্পর্কে তাঁহার ভাইঝি, হাতে টাটু (তোমার পাত্র) লইয়া যখন ফুল তুলিতেছিল এবং তখনও পাঁজি লিখিত তিল সম্পর্কে ব্যাখ্যা করিতেছিল; যে এবং ইহাও তিনি সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে বিলির মাতাই ইহার জন্য। দায়ী, বেহায়া মেয়েরে কখন শাসন করে না এবং ইহাও যে, নিজে, বিলির মাতা, এত সোমত্ত মেয়ে থাকিতে রঙীন কাপড় পরেন, তাহার আর কাণ্ডজ্ঞান কি হইবে!

এই মাতা, ইহা প্রচলিত যে, বিলির পিতা বিলির কিছু বেচাল দর্শনে কিছু বলিলে তর্ক করিয়া থাকেন। যে: এই যুগ নূতন! তুমি বৃদ্ধ!…বিলাতে কি হয়! লোকে বলে, লোকের মুখে ছাই, তাহারা কি খাইতে অথবা পরিতে দিবে। আমরা জীবনে কোন সাধ আহ্লাদ করিতে পারি নাই, মেয়ের সম্পর্কে তোমারে ভাবিতে হইবে না! (আশ্চৰ্য্য বিলির পিতা উচ্চপদস্থ কর্মচারী)।

যে এবং এই সকল কথা বিচারিয়া যবাবুর ভগিনী উপলব্ধি করিলেন, দুই দিনের জন্য আসিয়াছি, আমার কি প্রয়োজন। তাহার সাক্ষাতে নব-যৌবনারা কেমন যেমন নগ্ন, তাহাদের গাত্রবর্ণ মেঘতুল্য ধূসর, যে এবং ইনি সংযতভাবে মুনশেফের স্ত্রীর সহিত ইহা যোগ দিলেন, না মিশিলেই পার, আমি অন্য কিছু বলি না, তবে যে ঐ ব্লাউজ পরা বগলকাটা কেন, ঘটি হাতাই ত ভদ্র…আবার হাতাবিহীন…বিলি শুনিতে পাই কাঁচা রসুন খাইয়া থাকে…গোবিন্দই জানেন!

অনুপমা এহেন তিক্ততার মধ্যে থাকিয়াও বিদ্যুতে বিলির নজর লইল, কেমন যেন ভীরু, কেমন যেন জেল্লারহিত, কিছুক্ষণ পূর্বে কি কুহকিনী যে সে! উহার হস্তীদন্তের (আসলে সাধারণ হাড়ের) ঝুমকো, উহার মীন অথচ টানা নয়ন, গৌর গাত্রবর্ণ, উহার কাজল, সিন্দুর টিপ–এ সকলেতে যেন পৃথিবী নড়িতেছিল, সর্বৈব ফোয়ারা।

এখন বিলি উপস্থিত ঐ শিশুকেন্দ্রিক আবহাওয়ায় নিজে যেন অনেকটা বিলি-র স্বীয় উক্তির ন্যায় নির্ঘাত ক্যাড, চিবি, চিশী; যাহা এই যে ঐ সরস্বতী পূজার দিন তাহার কোন বন্ধুর ভাই তাহার এক ফটো তুলিয়াছিল, ফটো আসিল, কিন্তু কোথায় সে বাসন্তী রঙ, কোথায় সেই অপূৰ্ব্ব কেশরাশি! যথার্থ বিপরীত তাহারে দেখিতে যেন রাক্ষসী…চিবি চিশ্রী ক্যাড।

এবং এই বিবরণের পরই বিলি অপোবদনে থাকে, খানিক বাদেই হঠাৎ বলিয়া ফেলিল, আমার ফটো কেন যেন ভাল উঠে না, বোধ হয় তুক আছে।…এবং এই স্বীকারে সে উৎসব-মাতৃক বিলি ফ্যাকাশে, হায় বিলির স্তব্ধতা আছে। কোন এক গ্রহের দ্বারা অজানিতেই তাহার পরমার্থ অপহৃত হইয়াছে।

কিন্তু ঝটিতি তিলেক মধ্যেই বিলি নিজের কথাকে উড়াইয়া দিল…ধেৎ মা বলিয়াছে উহাদের হাত খারাপ, ক্যামেরা বাজে। তথাপি তাহার এই যুক্তির পরও তাহার সেই বিষণ্ণতা গুণগ্রাহী সকলে দেখিয়াছে; দেখিয়াছিল, বিলি যখন একাকিনী!

এখন শিশুর সান্নিধ্যে বিলিরে অনুপমার যথার্থই তেমন তেমন উপলব্ধি হইল; যে সুতরাং সে বেচারী এতেক স্তম্ভিত, যে যাহাতে সে আপনার অতি ধ্যানে কৃত কেশবৈচিত্র্যে হাত দিয়াছে অসাবধানতায়, বিলি যেমন ময়লা যে বিলি ধূপের ধূম্র রেখার তুল্য ম্লান, সেই স্পর্কিত দ্বীপ তাহার কোথায়, চন্দ্রালোক যে দারুচিনি অরণ্য মর্মরিত করিয়া বিচ্ছুরিত হইত তদীয় ভ্রমণের হেতুতে; যে তরঙ্গ সকল তাহার লাগিয়া অলঙ্কার নিমিত্ত, বিবিধ প্রকারের ঝিনুক আনিত, তাহা শুধুই যেমত বা কবিপ্রসিদ্ধ!

এখন অনুপমার দ্বারা ইহা পরিলক্ষিত হইল, যে বিলি ঐ চম্পক স্থান হইতে অপসৃয়মাণা হয়। যে সে শিশু আদৌ ভালবাসে না, ইহা অনুপমা জানিয়াছে এবং ঈদৃশ হলপে আশঙ্কিত হইলেও চোরা-মনে রাখিয়াছে। কিন্তু, অন্যপক্ষে শিশু যে নির্দোষ মাধুৰ্য, যে ইনোসেন্স যে বিলিকে এইভাবে যে আঘাত করে–তাহা নির্বোধ অনুপমা কভু বুঝিবে না; আঃ ইন্‌নোসেন্স কি মারাত্মক!

এখন বিলি সদলে চলিয়া গিয়াছিল, গ্রাভেলের কর্কশ আওয়াজ পুনরায় বিস্তারিয়াছিল, যে ক্রমে বিলি বেষ্টিত সহচরীদের মধ্যে আপন মুখোনি বিষাদ হইতে উন্নীতকরণে-সক্ষম হয়; এবার সে তীক্ষ্ণ, প্রকাশিল, যে ঐ হাস্যসূত্র গ্রাম্য দোষযুক্ত, যে উহাদের ভাষা অশালীন আনকালচারড, প্রায় ক্যাড।

আধা বৃত্তাকারে সহচরীবৃন্দ নির্বিচারে তাহার ডাগর মানসিকতা দেখিয়াছে। তাহারা উহার ঢলঢলে বেলোয়ারি মুখ–যাহার কারণে এইবিশনের স্নো-এসেন্সের দোকানদাররা অকাতরে সাম্পেল উপহার দেয়–সেই আকর্ষণ হইতে চোখ ফিরায় নাই, বিলি সাবাস! তাহার ক্যাড শব্দ উচ্চারণ সৰ্ব্বত্রে, খেলিয়া ফিরিতে আছে।

কখনও সভয়ে ইহাও সহচরীদের মনে পড়িবে, অমলাকেই বিলি ক্যাড বলিয়াছে, তাহারা যাহারা। বাঙালী জীবনে ল্যাভম্যারেজ অবধি শুনিয়াছে, তাহারা বিলি-কে কখনও শুনে নাই!

অমলা ক্যাড। এ অমলা সেই, যে খুব সরল, যে লক্ষ্মী, যে খুব ভাল, যাহার দ্বিতীয় পক্ষে বিবাহ হইয়াছে, যে সগৰ্ব্বে রুলী পরে, তাহার বিবাহতে এক কাণ্ড হইয়াছিল, যাবতীয় মিষ্টি গুড়ের তৈয়ারী হয়, কারণ তখন বয়কটের যুগ, সবই নষ্ট হইল কেননা কেহ মুখে দেয় নাই। সে সুন্দর গান জানিত, বহু সভায় উদ্বোধন সঙ্গীত বন্দেমাতরম্ সেই গাহিত, সে কাজী সাহেবের গান আরও ভাল করিত।

এই সেই অমলা, যাহার গানের খাতাটি অতীব মনোমুগ্ধকর ছিল। এই অমলাই সেই যে গত পূজায় ঁবিজয়ার দিন সিদ্ধি খাইয়া একটু এলোমেলো হয়, গীত গাহিতে প্রথমে পাতকী বলিয়া কিগো’ পরক্ষণেই ‘লালদীঘিতে আগুন’ অবিলম্বেই ‘আয় মন বেড়াতে যাবি’ সঙ্গে সঙ্গেই ‘শত কোটি কল কল নিনাদে’ ইত্যাকারে গীতপ্রবাহের কালে বহুবারই উহার বস্ত্রাঞ্চল স্থলিত হয়, আর বহুবারই সে জিহ্বা দংশন করে! তাহাতে কোন মতিচ্ছন্নতা নাই–সে বড় ঘর-বোলা। গত ভূতচতুর্দশীর দিন সে কোথা না কোথা হইতে এই রিখিয়াতে চৌদ্দশাক তুলিয়া আনিয়া সকলকে বিলাইয়াছে। সে বহু পাখী চেনে, উহাদের ডাক নকল করিতে পারে।

এই অমলাই এখন একটি চেয়ারে বসিয়া আপন পুত্রকে স্তন্যদান করিতেছিল। আঃ সমগ্র ধরণীর মঙ্গল হউক; আঃ দিক সকল সৌর সম্বন্ধীয় না হইয়া আপনি স্থিতিশীল হউক! আঃ পতঙ্গ সকল স্রোতস্বিনীতে নির্ভয়ে স্নান করুক!

অমলার স্তন্যদান-এই নিপটতার ছায়া, চলমান লণ্ঠনে, গাছে, পাতায় দেওয়ালে জানালায়, বিলি কঠিন দৃষ্টিতে ঐ প্রতীয়মানতা লক্ষ্য বিতৃষ্ণায় করিল, তদীয় হাল্কা দুল জোড়া ক্ষিপ্র আন্দোলিত হইল, ব্লাউজের গলার নিকট রাখা রুমাল লইয়া স্বেদ অপনোদন করিল। (হাতব্যাগের তখনও চলন নাই) যে সে নিম্নগ্রামে উচ্চারিল, ক্যাড! সহচরীরা ভাবতঃ ঈষৎ অপরাধী।

বিলির খাসা শ্রীযুক্ত মুখোনি, যাহা দক্ষিণ ভারতীয়দের মত সদাই নড়ে, তাহা খানিক স্থির, জানাইয়াছিল, অধুনা স্তন্যদান কুশিক্ষা প্রণোদিত, উহাতে রমণীর রম্য সুষমা খৰ্ব্ব হইয়া থাকে, যে অমলা বৃথাই স্বদেশী (!) করিয়াছে। আর যে এহেন বাক্যে সকলেই ত্রস্ত, ক্রমে অবশ্যই দৈবক্রমে। দেখিল, স্তন্যদানের বিপরীতে যে রমণী–সে রমণী আর এক রহস্য!

আঃ বিলি তুমি আহেলী ডিকাডেন্স বহন করিতেছ! আঃ বিলির শুধুমাত্র বাম হাতের অনৈসর্গিক কালো চূড়ীর পৌনঃপুনিকতাই কি সবুজতা!

এখন ঐ শিশুকেন্দ্রিক দলের আশেপাশে গিরি ঝরণা নদী সৃজিত হইতেছিল, শিশুটি তখনও সমানভাবে খুসী, আর আর সকলে তাই বড় উৎফুল্ল। কাণ্ড এই যে, মনিব মহাশয় মহা-অথৈ আদরে বিজলী নাম্নী একটি মেয়ের সাত মাসের কন্যারে কোলে লইয়াছিলেন, আর সে সেই শিশু হঠাৎ প্রস্রাব করে! মনিব মহাশয় তাঁহার মহামূল্য চীনাংশুক পাঞ্জাবীর নিমিত্ত কোন খেদ না করিয়া বরঞ্চ উদাত্তে, গ্র্যাণ্ড…এ্যাণ্ড! বলিয়া এই সংবাদ সমবেতদের দিয়াছিলেন, তাই ঐ হাস্য-ঝটিকা!

এখন প্রধান শিক্ষয়িত্রী, যিনি রাশভারী, ইনি তড়িৎ দাশ সি.আই.ইর স্ত্রী, এবং এই সময়েতে ইনি। পুরুষদিগের সহিত বাক্যালাপ করিতে থাকিয়া–পুরুষগণের সহিতই আলাপ তাঁহার শোভা পায়– ক্কচিৎ অন্যত্র মনস্কা ছিলেন, রকমারি আসন ইজিচেয়ার, টুল, তক্তাপোষ হইতে বহু আকৃতির পশ্চাতে এখন সাঁওতাল রমণীগণ ইতস্তত আছে।

প্রধান শিক্ষয়িত্রী সহবতে ঐ সূচনাতে মনঃসংযোগ করিলেন; তিনি আপনকার চশমার তলা-কার কাঁচ দিয়া দেখিতে ব্যর্থ হইলেন; তৎক্ষণাৎই কোন সুলক্ষণা রমণী আলোকবিহীনতা হইতে শিশুকে কপট শাসন করিলেন,–ওরে আবার হাসা হচ্ছে, শয়তান মুতিয়াছ আবার…এবং মহিলার রম্য দম্ভপাতি ভাস্বর হইয়াছিল।

যাহা শ্রবণেই প্রধান শিক্ষয়িত্রীর স্নায়ু দুষ্ট হইল, অভিজাত মনিব পত্নী এবং অলোকার প্রতি অসহায়ভাবে একাধারে নেত্রপাত করিলেন, অবশেষে স্বীয় স্কন্ধের কাছে বস্ত্রাঞ্চল প্রান্ত ধৃত ব্ৰচ আছে, যাহা মনোহর কাজনিদর্শন–সোনার বসানে প্রত্যাগত এক পক্ষী, লার্ক সম্ভবত, তাহাতে যত্ন দিলেন।

এবং পার্থক্য ইহাদের সহিত তাঁহার নিজের ঐ সময়েই হৃদয়ঙ্গম হইল, পুরুষদিগের প্রতি চোখ ফিরাইতে পারেন না, ঐ সময় ভাগ্যশঃ অনেক আলো থাকিলেও ছায়া ঢাকিবার মত জোনাকী ব্যতিরেকেও, গোপনতা থাকে, সেই স্থলে উপস্থিত তিনি ক্ষিপ্রতায় ‘মুত’ শব্দটিকে নিজের কারণে সুখকর অনুবাদ (!) করিলেন ‘ছোট বাইরে’।

এবং অতঃপর তিনি অবোধ শিশু বালিকার ব্যবহারে ভদ্রতাবশে মৃদু হাস্যে কহিলেন: ও, ছোট বাইরে করেছ বুঝি! প্রধান শিক্ষয়িত্রীর চমকপ্রদ মনোলোভা স্বরে, সকলেই বুদ্ধির অঙ্ক হইয়া গেল, তখন সকলেই খানিক সচেতন ছিল, অবশ্য পরে বড় অসংযম উজরাইয়াছে নিজেদের মধ্যে ঐ পদসূত্রে।

দূরে সেই ভাবমুগ্ধকারী দল, আঁকিয়া বাঁকিয়া আসিতেছে, তাহারা আপনাদের স্বাভাবিক রাখিতে গীত গাহিতেছিল, নূপুর বেজে যায়, ক্রমে ঐ দল কোথায় যে তাহাদের স্বপ্নত্ব বাহার ত্যাগ করিল গোপন করিল তাহা বিস্ময়ের, পট তেমনই উজর আছে, পথ তেমনই মায়াযুক্ত আছে, সম্প্রতি যেমন বা ইহারা ঘোর জড়বাদের অন্তর্গত হইল। এখন তাহারা টিলায়। মনিব মহাশয় ও তদীয় পত্নী সহজ হইলেন, উদ্যোগী হইলেন, সুঘরাই অল্প তফাৎ রহিল।

ইহারা বিভিন্ন ধরনে সাড়ী পরিহিতা, তাই কিছু সলজ্জ, তাহারা একে অন্যের পশ্চাতে আশ্রয় লইতে সমুৎসুক, প্রধান শিক্ষয়িত্রী রুমাল দিয়া কপালে থুপি দিলেন, উপস্থিত দুই পক্ষই মৃদু মৃদু আনন্দ প্রকাশ করিতেছিলেন। কিয়দংশে এই ব্যবহার নিমকমিকাল বৈকি! তথাপি এই বিরাট ফাঁকা মানুষের যাবতীয় উপহাসাত্মকতাকে নিশ্চিহ্ন করিল। পার্শী মারাঠি মদ্র ধরনের এবং স্কুল ও সামনে-আঁচল রীতির কাপড় পরন দর্শনে মনিব পত্নী অনেক প্রশংসা করিলেন।

তৎকালে প্রধান শিক্ষয়িত্রী একবার বাবুটির, একবার পশ্চাতের চানোয়ার হোথায় নিরীক্ষণে কহিলেন–প্লেইজেনট! অপূৰ্ব্ব! বলিয়া তিনি মনিব মহাশয়ের দিকে ফিরিলেন।

তাঁহার মধুর স্বরসঙঘাত ব্যাপ্ত হইল; অবশ্য ঐ উক্তির রেশে যেন ‘কিন্তু আছিল, সঙ্কোচ নাই, অন্যপক্ষে যেন নিজ উপস্থিতি সম্পর্কে উহাদের সচেতন করার মতিত্বও যেন তাহাতে; এবং আরও তিনি মনে মনে যুক্তি রচনা করিতেছিলেন; এবং যে কেন তাঁহারা লোকালয় ছাড়িয়া উত্তরে যাইয়া থাকেন!

মনিব পত্নী তাঁহার অভিমান ত্বরিতেই বিচার করিতে পারিয়া সত্যই মজা পাইতে গিয়া সাবধান হইয়াছেন, তথাপি অসতর্কতায়ে তাঁহাকে তাঁহাদের গিরিডি চলিয়া যাওয়া বিষয়ে প্রশ্ন সূত্রে–গিরিডি প্রসঙ্গে: যে চমৎকার উস্রি, কি অদ্ভুত মেঘ করে! ধন্য পরেশনাথ! কি শান্তরসাস্পদ বারগড্ডা ইত্যাকার বাক্য স্থির করিতে অধুনা ন্যায়ত থমকাইয়া আছেন যে তাহাতে, ঐ সকল উল্লেখে, বেজার দেখা দিতে পারে ইহা মনে করেন।

যেহেতু প্রধান শিক্ষয়িত্রীর অভিজ্ঞতা হয় যে রিখিয়া অত্যন্ত গ্রাম্য! কুসংস্কারাচ্ছন্ন! আর যে তিনি সিন্দুর পরাতে বিশ্বাসী নন, সত্যনারায়ণ শুনিতে যাইতে রাজি নন!

তিনি বলিয়াছেন এখানে প্রায়ই স্ত্রীলোকেরা অশিক্ষিত; তাঁহার লারডারের (খাদ্যসামগ্রী রন্ধনের ছোট আলমারী) উপরে কাঁচে, কালোর উপরে সোনার জলে ‘ঈশ্বর মঙ্গলময়’ লেখা আছে এবং সেই লেখার মধ্যে ‘ঙ্গ’ অক্ষর ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়া মিটিয়া গিয়াছে, এবং ইহা লইয়া অর্থাৎ এখন যে কথা দাঁড়াইয়াছে এবং তাঁহার ভাষা লইয়া গ্রাম্য-রিখিয়ার সকলে তামাশা করিয়াছে! এবং তাঁহারা তাই গিরিডি যাইবেন, সেখানে নিজেদের ব্রাহ্মগোষ্ঠি আছে, একটি সমাজমন্দির আছে! প্রাণীজগৎ ও উদ্ভিদ ছাড়া প্রাচীনতা সাবেকত্ব উপরন্তু নাই।

অতএব এখানে মনিব পত্নী অল্প অস্বাচ্ছন্দ্য বোধের ক্ষণেই আপন সরলতায় আসিলেন, একারণ যে, সমক্ষেই ফুলমৃদু বালিকারা–যে তাহাদের অনেক অলৌকিকতা ছিল। তিনি খুব বন্ধুতায় কহিলেন, একদিন আসুন না…আমাদের বাড়ীতে।

প্রধান শিক্ষয়িত্রী এই আহ্বানে, সম্ভবত খুসী হইয়া তৎক্ষণাৎই, নিশ্চয় আমরা খুব খুসী হইব, বলিয়াই অল্প অন্যমনা–মিথ্যা তাঁহারা প্রয়োজনে বলিয়া থাকেন কহিলেন, সময় যদি পাই।

অন্তরে তিনি–মনিব পত্নীকে, যিনি ধর্ম্মপ্রাণা, এখন এড়াইতে চাহেন যেহেতু ইহার ভাষা কুশ্রী– অথচ চালচলনে ভীষণ ইংরাজ–যেহেতু ইনি ভূতপূজক হিন্দু; জন্মান্তরবিশ্বাসী ও গঙ্গা-সমর্পিত মন, যাহাদের প্রধান শিক্ষয়িত্রী হিসাবে ঘৃণা করিতেন, অপছন্দ করিতেন! সুতরাং এই ক্ষেত্রে তিনি যে কি করিবেন তাহা মনস্থ হইবার পূৰ্বেই ফ্রক-পরা অল্পবয়সী মেয়েটিও যে মারাঠি ধরনের সাড়ী পরিহিতা, সে বিস্ময়াবিষ্ট হইল, সুঘরাইএর পাখী দেখিয়া কহিল,–পিসিমা দেখুন দেখুন, কি বিউটিফুল পক্ষী, দেখুন পক্ষীটি বালকের হাত টুকরাইতেছে! ইহা আশ্চর্য্যের! উহা কি পক্ষী!

প্রধান শিক্ষয়িত্রী ঐ অপ্রার্থিত সুযোগ লাভে স্বস্তিতে যোগ দিয়াছিলেন, সত্যই চমকপ্রদ! মহাশয় উহা কোন জাতীয় পক্ষী? এবং যুগপৎ স্বীকার করিলেন, যে এইসব বিষয়ে আমরা এত অল্পই জানি…এবং যেক্ষণে তিনি হাসিয়া উল্লেখ করিবেন যে, ঈসল্স বা হিতোপদেশে ইহার কথা নাই, তখনই শুনিলেন যে, উহা তিতির!

এবং ঐ তিতির শব্দ তিনি সুষ্ঠুভাবে উচ্চারণের পরে পার্শ্ববৰ্ত্তিনী মারাঠি সাড়ী পরিহিতা কিশোরীকে প্রশ্ন করিলেন, তিতিরের ইংরাজী কি বল ত দেখি… সিনি? আঃ অত দুলিতেছ কেন! ওকি! ভদ্র হও…ছিঃ! এই মেয়েটি এবং ঐ মেয়েটি আমার মধ্যম ভ্রাতার কন্যা…গত পরশু আসিয়াছে…আবার দুলিতেছ…যেখানে উহারা থাকে সেখানে ভাল স্কুল নাই…দুঃখের…অমন করিও না…ইহারা কি ভাবিতেছেন ছিঃ…!

ঐ তিরস্কৃত মেয়েটি তখন মনিব মহাশয়দের চোখে অলৌকিক শোভা ধারণ করিয়াছিল, এ কারণ যে,–সম্ভবপর ইহা যে সাড়ী পরার অনভ্যাস বা অস্বাচ্ছন্দ্যের জন্যই–তাহার পদদ্বয়ের যাহা সৰ্ব্বলোক বন্দনার জন্য, প্রণামের জন্য গঠিত তাহা যেমন সাঁচিতে আছে ঠিক তেমন তেমনভাবেই পশ্চাতে ঈষৎ উত্তোলিত ছিল।

মনিব মহাশয় আপন সহধর্মিণীরে নিজ মনোভাব জ্ঞাপন করিলেন, কি মিষ্টি না,…যেমনটি সাঁচিতে…নয়? আহা কি!

মনিব পত্নী জানাইলেন, আহা কি ভাব! কি চমৎকার, এবং এই পৰ্য্যন্ত বলিয়া তিনি ইতস্ততর মধ্যে, প্রায় তাঁহার ওষ্ঠে আসিয়াছিল, যে, ঐ মেয়েরে পূজা করা যায়, কিন্তু প্রধান শিক্ষয়িত্রীর রুচি তাঁহার

অবিদিত ছিল না, এখন এইরূপে শেষ করিলেন, ওদের দেখ, প্রত্যেককেই বড় খাসা দেখতে নয়!

প্রধান শিক্ষয়িত্রী পুনরায়, তিতিরের ইংরাজী জিজ্ঞাসাতে, মেয়েটি উত্তর দিল,–পারর…টরিজ।

ছিঃ কি উচ্চারণ করিতে আছ, আর-এ র’য়ে মানে প্রথমটিতে…তারপর বলিলাম ত ঐ স্থানে ভাল স্কুল নাই…।

পার্শী সাড়ী পরিহিতা যুবতী ইচ্ছাকৃত অবশ্য কিছুটা উদ্বেলতায় ঐকথায় বাধা দিল,–শুনিয়াছি ইহাতে খুব ভাল রোষ্ট হয়…খাইতে খুব ভালও…!

নিশ্চয় খুব ভাল খাইতে…তুমি তখন খুব অল্পবয়সী, যখন আমি পেশোয়ারে…স্কুলে…উনি কলেজে…এই তিতিরের মাংসে অপূৰ্ব্ব রান্না হয়, তবে সেই রন্ধনে কাশ্মীরজাত লঙ্কার প্রয়োজন হয়…আমরা একটু হলুদ দিয়া থাকি বটে, এবং শা-মরিচ…বুঝিলেন, বেশ ভালভাবে কাটিয়া…প্রথমে ভিনিগার বা নেবু রসে ভিজাইয়া অথবা মাখাইয়া…হ্যাঁ কাটার পরই…।

মনিব মহাশয় ইহাতে অবশ্যই অবাক, সুঘরাইএর প্রতি অপরাধীর ন্যায় চাহিলেন, যে এবং খুব সোজাই মৃদুস্বরে বলিয়াছিলেন,–ও বেচারীর পাখী অন্ত প্রাণ!

স্বামীর এহেন নির্ব্বুদ্ধিতায়ে মনিব পত্নী ঝটিতি অপ্রতিভ হওয়ত, যাহাতে অভ্যাগতরা না ক্ষুণ্ণ হন। তন্নিবন্ধন অতীব তিক্ত শ্লেষে বলিলেন, ছাড়ুন ত ওঁর কথা, পাখী অন্ত প্রাণ না হাতী, অষ্টপ্রহর ওর পিছনে লেগে আছে, আবার কথা, ওই মুখপোড়া ছোঁড়ার ভগনীপতিই যে বলে…বলে পাখীটাকে কাটবে বলে শাসায়, ও ভয় পায় এখন…সত্যি যদি কাটে, রাঁধে তখন ছোঁড়াও হয়ত দেখব একটা ঠ্যাং খাচ্ছে…আজই পাখীটিকে এমন হিস্ শব্দ করে জাত সাপের শব্দ করে ভয় দেখাচ্ছিল, যে আমার এবং ওঁর পিলে চমকে গেসল!…বল…আমরা আঁৎকে উঠি…খুব বকলুম ব’লে অবলা জীব তারে পোষাই বা কেন…কি বলবেন বলুন…জাতে ওরা ডোম, ছোট জাতদের আবার মায়া মমতা…মন বলতে কিছুটি ওদের নেই…উনিও বললেন পূব্বজন্মের পাপ হলে হাড়ি ডোম হয়, যে এবং তাঁহার স্বর ক্রমবিলীয়মান হইল।

মনিব মহাশয় বলিলেন, সত্যই বলুন! হাড়ি ঢোম উহাদের মন থাকিবে, মমতা থাকিবে ইহা আশা করাই বাতুলতা…।

প্রধান শিক্ষয়িত্রী ও তদীয় পার্শ্ববৰ্ত্তিনীরা সরমে কুণ্ঠিত, অধোবদন; মারাঠি সাড়ী পরিহিতা ও তাহার দিদি পৰ্য্যন্ত, যদিও তাহারা বঙ্গের বাহিরে প্রায় বাঙালীবর্জিত স্থানে থাকে, তবু, যে সকলেই মলিন, যে সকলেই নিজেদের আড়ষ্টতা কাটাইবার মানসে সুঘরাইএর প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াছিল।

প্রধান শিক্ষয়িত্রী এহেন নোংরা ধারায়, মনিব পত্নীর, বলার ভঙ্গী জীবনে শুনেন নাই, একমাত্র এখানে স’স টানের রাহিত্য থাকে; অতএব তাঁহার ভিতরে এখন বিতৃষ্ণা উদ্ভূত হইয়াছে, তাজ্জব যে। এমনও একদা সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে অন্তত সব সত্ত্বেও মনিব পত্নীর শুধু আরশোলা ভীতি আছে। জানিয়া তাঁহাকে মার্জিত বলিয়া বিবেচনা তাঁহার হইয়াছিল।

আরশোলাকে ঘৃণাতে প্রধান শিক্ষয়িত্ৰী বড় সুখী হইয়াছিলেন, নিজের সহিত মিল দেখেন, যে মনিব পত্নীরও একই ঘৃণা আছে। এখন নিশ্চয় মনে হইল তাহা মিথ্যা বালখিল্যতা, সম্প্রতি কোনমতে যেন স্বগতেই তাঁহার ওষ্ঠে বাক্য ফুট হইল! কি অসভ্য! তৎসহ ভঁহার গোষ্ঠির সকলেই সুঘরাই প্রতি নেত্রপাতে সমস্বরে মন্তব্য করিল, ওমা কি অসভ্য ভাই!

অবশ্যই এবম্প্রকার উক্তি মেয়েরা যেন তাহাদের স্বীয় ইজ্জতের কারণেই বিশেষত করিয়াছিল। এবং, ঐ পদ প্রকাশের বৃত্তিতেও প্রধান শিক্ষয়িত্রীর কিন্তু যে পূৰ্ব্বলব্ধ ভ্রষ্টতা যেমন তিরোহিত হয় না, এক ঘৃণা হইতে অগণন ছুঁৎমার্গে বিশালা ব্যক্তিত্বশালিনী প্রধান শিক্ষয়িত্রী উৎক্ষিপ্ত হইলেন।

অন্যপক্ষে যে এরূপ সঙ্গীন তিনি যে তদীয় অভিভাবকত্ব অধীনাদের প্রতি তাকাইতে তিনি অসমর্থ; ক্কচিৎ আপনার সূত্রের কথা মনে হইল যেন, ধীরে তিনি শিক্ষয়িত্রী-বিহিত রীতিতে মস্তক আন্দোলিত করত সকলকে একাগ্র করত অনেক কষ্টে আরম্ভিলেন, সিলি দ্যাটাস ব্যাড! অর্থাৎ মেয়েদের ঐরূপ মন্তব্য।

যে এইটুকুতে তাঁহার হৃতমান ফিরিল, যে এই টুকুতেই ক্লান্তি বিদূরিত হইল, যে এই টুকুতেই প্রত্যয়ের সঞ্চার হইল। ঐ ছোট ইংরাজী পদ ব্যবহারে ভব্যতা সম্পর্কে তিনিই প্রথম সচেতনতা আনিলেন, যে অবশ্যই তিনি সদসৎ তত্ত্ব পৰ্য্যায়ে মনিব দম্পতিরে লইতে পারিবেন।

সুতরাং সুঘরাইকে কেন্দ্র করা তাঁহার কোন অভিপ্রায় নাই–শুধু মাত্র তাহারে উপলক্ষ করিয়া সাজাইতেছিলেন যে ডোম বলিয়া ইত্যাদি। কিন্তু অসাধনেই যেন বলিলেন, আপনি না শুনিলাম, খাদ্যাখাদ্য বিচার করেন না…অক্‌সো (oxo) খাইয়া থাকেন, এবং যাহাতে এই উক্তি আঘাতরূপে না। বুঝায় তজ্জন্য তাঁহার মুখে স্নেহপ্রযুক্ত হাস্য ছিল।

অউক্‌সো! কে বলিল…!

আমিই সিদিন বছিলুম, যে মুরগীগুনো সব মারা গেল হঠাৎ, রাতে কিছু নাই…সব্বাইকে খুঁজতে পাঠালুম; অবশেষে অউক্‌সো…ছিল…!

এ সময়ে প্রধান শিক্ষয়িত্রী তাঁহার সঙ্গের বালিকাদের ঐ বিশেষ্যটি সম্পর্কে কৌতূহল দর্শনে তাহা নিবৃত্তির মানসে নিম্নস্বরে কহিলেন, অসসা…না বভরিল কোনটি, বিফ ইন বৃফ্‌ (beef in brief)। আমার ত ভুলিয়া যাওয়া উচিত নহে, কোথায় দেখিয়াছি–আঃ আমার বয়স হইয়াছে, রহ মনে করি, ইনসিওর ইট উইথ গিলেনডারস–সম্ভবত অক্সসাই?…কিন্তু ইহার পরক্ষণেই উত্রাই-নামার বেসামাল তাঁহাতে, কেননা ঐ অক্‌সো সূত্রে মনিব পত্নীর ভদ্রতা-ব্যভিচারিণী কথা তাঁহাকে জ্বরগ্রস্ত করিল। যুগপৎ স্বদেশীনেতার মন্তব্য কানে আসিল, গরু খাওয়া ঠিক নয়!

এই বিষয়ে বিলাসিতা-বিরোধী স্বদেশী নেতার জবাব প্রথমে প্রধান শিক্ষয়িত্রীর আরামপ্রদ বলিয়া বোধ হয় (আদতে যেহেতু প্রথমত ঐ ব্যক্তি মনিব দম্পতিদের বুজরুক বলিয়া থাকে ও তাঁহারা অত্যন্ত ধনী বিধায় ইংরাজের খয়ের খাঁ বলে) তাই এই নেতাকে তিনি পছন্দ করেন–আবার অপছন্দ করেন খুবই, কেন না তাঁহার স্বামী বলিয়াছেন যে তাঁহাকে এ্যানারকিষ্ট দীননাথ জানাইয়াছে ঐ লোকটি নিজের ফটোর একটি ব্লক করিয়াছে, দুঃস্থ নির্বোধ পত্রিকাওয়ালারা যাঁহারা ব্লক ছাপান উচ্চমানভাবে, তাঁহাদের দিয়া থাকে, ছবি ছাপায়।

এইভাবে সেই লোকটি জনপ্রিয়। লোকটি রাজনীতিবিদরা যেমন হইয়া থাকে, চরকা কাটে, অনেক,গ্রামে প্রহৃত হইয়াছে, অনেক বন্যার টাকা আত্মসাৎ করিয়াছে…এ-ক্লাস প্রিঞ্জনার ত দূরের কথা কখনও বি-ক্লাসও নয়! এখন কোন এক মিউনিসিপালিটির ধাঙ্গড় নেতা, সে তাহাদের শোষণ করিতেছে, বলে পৃথিবীতে রাজা বলিয়া কিছু নাই! যুবতী দেখিলেই কামে গোঁয়ার হইয়া উঠে! এই বিলাসিতা-বিরোধী স্বদেশী নেতা মনিব পত্নীর মুখে অক্‌,সো গো-মাংস শুনিয়া মহা ধিক্কারে কহিলেন, গরু খাওয়া ঠিক নয়…একে গরম দেশ, গরু মানুষের উপকারী…আমাদের দেশ…।

ইহাতে মনিব পত্নী নিদারুণ অবজ্ঞায় মুখ ঘুরাইয়া লইয়াছিলেন, এমন যে তাহার সহিত তাঁহার বাক্যালাপে মানহানি ঘটিতে আছে, বিলাসিতা-বিরোধী স্বদেশী নেতা প্রস্থান করিল। তিনি, মনিব পত্নী এখন নিলজ্জভাবে বলিয়াছিলেন,–গরম দেশ…উনি যেমন বলেন মেয়েছেলে সহ্য হচ্ছে না? আর গরুর মাংস ত কি কথা…! সমবেত সকলে এই সরলতায় বিশেষ আমোদিত হয়। একমাত্র প্রধান শিক্ষয়িত্ৰী ব্যতিরেকে, যিনি এখনও যুবতীর ন্যায় কণ্টকিত লাল হইয়া থাকেন। তিনি বড়ই অপদস্ত হইয়াছিলেন।

এখন প্রধান শিক্ষয়িত্রী কোনক্রমে ঐ বিষয় এড়াইতে তৎপর হইয়া কহিলেন, কিছু মনে লইবেন, আপনাদিগের তুল্য এত উচ্চশ্রেণীর অর্থাৎ মানে…যা বলিতে চাহি তাহা ইহা যে…ইত্যাকারে তাঁহার কণ্ঠস্বর শ্লেষাত্মক হইতেছিল, জাতিতত্ত্ব লইয়া ঝটিতি বলিলেন–আমাদের কাহাকেও ছোট ভাবিয়া অর্থাৎ ছোট করিয়া বড় ভাবা…মানে ঈশ্বর যাহাকে যেমন করিয়াছিলেন…কি উচিত…শোভা পায় না…।

মনিব মহাশয় অত্যন্ত বাধিত হইয়া উত্তর করিলেন,–আমার বাক্য আপনি মার্জনা করিবেন –আমাদের এই চমৎকার ঘৃণা অবজ্ঞাটা থাকিতে দিন…।

যে প্রধান শিক্ষয়িত্রী একদা নিঃসংশয়চিত্ত হইলেন যে মনিব মহাশয় নিজে আত্মসমালোচনা করিলেন, আবার একদা কুঞ্চিত তাঁহার হইল, অতএব কোন তত্ত্ব অনুমানে–মনিব মহাশয়ের উক্তি কি শ্লেষ-নির্ঘাত তাহা অবধারণে তিনি মুস্কিলে ছিলেন; সম্ভবপর হইলে এই স্থান তিনি ত্যাগ করিতেন, তবু স্বভাববশত উত্তর করা উচিত বিধায়ে ব্যক্ত করিলেন, মানুষ কোন কদভ্যাস বা…আপনার ন্যায় ব্যক্তি এরূপ…মনোভাব।

সম্ভ্রান্ত শিক্ষিতা ভদ্রমহিলার মন্দ দশা বুঝিয়া মনিব মহাশয় বিচলিত হইয়াও বলিতে উদ্যত হইলেন যে আপনি কি মদীয় জীবনী পাঠ করিয়াছেন, কিন্তু তিনি স্তব্ধ।

এখন খানিক শাসনের ভঙ্গীতে বিড়ম্বিত প্রধান শিক্ষয়িত্রী ব্যাখ্যা করিলেন,–উহাদের ডোম বলিয়া ছাড়িয়া দিলে চলিবে না…আমাদের কর্তব্য উহাদের শিক্ষা দেওয়া…ক্রীশ্চান ধৰ্ম্ম বলে…আমরা ত বলি মানুষকে সৎপথে চালিত করা…বালককে…সে চপলমতি, তাহারে শিক্ষা দিতে হইবে যে পক্ষী হইলেও উহাদের সুখদুঃখ বোধ তথা প্রাণ আছে…এখন হইতে যদি শিক্ষা দিতে অবহেলা করি তাহা হইলে, একটু একটু করিয়া যে পাপ আত্মায় প্রবেশ করিতেছে…!

মনিব মহাশয় তদুত্তরে, তিনি আবাল্য জানিতেন আত্মা সম্পর্কে ভগবান কি বলিয়াছেন, তিনি আলস্য ত্যজিয়া মৌখিক বিনয়ে নিবেদন করিলেন,–সুঘরাইএর ভাবান্তর কোন আলোচনার বস্তু নহে…ইহা অবশ্যই একশবার যে আপনি যাহা বলিলেন তাহা অভ্রান্ত-তবে যদি অনুমতি করেন তাহা হইলে বলি যে সুঘরাইএর উক্ত ব্যবহারে কোন আত্মসুখ নাই–সে নিষ্পাপ! উহা নিষ্পাপ! যেমত যেমন পিঠোপিঠি ভ্রাতা ভগিনীতে ঘটিয়া থাকে…আমি দেখিয়াছি ও নিজে পাখীটিরে আঘাত করিয়া বলিতেছে, আমারে তুই মার না কেন?–সহজ সম্পর্ক তাহা ব্যতীত অন্য কিছু না,…জানিবেন ইহা খুনসুড়ীই, কেহ বলিতে পারেন যে মাত্রালঙ্ঘিত খুনসুড়ী ইহা, তবু ইহা খুনসুড়ী!

এবং ইহার সহিত-যে তিনি শিক্ষিত, যে তিনি চিন্তা করিতে পারেন, ইহা যাহাতে সুস্পষ্ট হয়, তৎপ্রবর্ত্তীত উত্থাপন করিলেন যে, ইহার মধ্যে সেই ঐতিহাসিকতার আঁশ নাই, যাহা কোন ফরাসী পাদরী (দু’বোয়া!) মনে পড়ে যাহারে ‘প্লেইজির ইল্লিসিট’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন ইহা তাহা নয়!…ইহা অতীব প্রাচীন মনুষ্য বা বালকস্বভাব মাত্র…দেখুন মানুষে অনেক বিশ্রী বস্তুর সুন্দর নামকরণ করে, তেমনি উচিত ছিল এই সহজ সাধারণ স্বভাবের একটি বিশেষ নাম দেওয়া…তাহা হইলে…আমরা ইহার চরিত্র বা প্রকৃতি নিরূপণে নিশ্চিত হইতাম…আমার ধারণা ইহা সম্পূর্ণ পূৰ্ব্ব কথিত সম্পর্ক ইহা।

চশমাটির ফ্রেমে ঠিক দিয়া প্রধান শিক্ষয়িত্রী অল্প হাসিলেন অর্থ এই যে কাহারও বিদ্যার অভিমানকে চোট দেওয়া তাঁহার অভিপ্রেত নহে কহিলেন বটে আপনার যুক্তি অন্যায় মানিবে না, বলা যায় পক্ষপাত অর্থাৎ শূন্য নহে…(!) আপনি একটি অনৈমিত্তিক বৃত্তিরে রাসিওনলাইজ করিতে। চাহিতেছেন…আমরা দৈনন্দিন জীবনেতে…জীবনের মধ্য হইতে অনেক তত্ত্বাভিজ্ঞতা লাভ করিতে পারি, তখন সিদ্ধান্ত হইবে যে, কথিত ঐ প্রকার খুনসুড়ী বা তদর্থবাচক শব্দ যে কোন…যে কি পৰ্য্যন্ত বিঘাতক…উদাহরণস্বরূপ ভাই-ভাইএর তাদৃশ পরস্পরের প্রতি আচরণ, কালে কলহ এবং যে কলহের। পরিণামে পরিবারের সকলেরই মর্মপীড়ার কারণ হয়,…এইরূপে প্রতিবেশীতে ও সমাজে বিশৃঙ্খলতা…আমরা দেখিব যে লঘুতা খেয়ালখুসী, বড়ই দুঃখজনক, বড় ব্যথার কারণ হয়…ঈশ্বর বড়ই…।

ক্ষমা করিবেন, যতদূর মনে হয় ভগবান উহার, সুঘরাইএর জন্য লজ্জা পাইবেন না…আর যে, আপনি যাহা বলিলেন তাহাতে বুঝায় উহারে আইন অনুগ করা–এবং যুগপৎ তিনি কহিলেন,–দেখুন দেখুন এবং তৎসহ দেখ দেখ সম্বোধনে আপন সহধর্মিণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিলেন সুঘরাইএর প্রতি, তদীয় গাত্রে জামা সত্ত্বেও ইহা ওতপ্রোত যে সে প্রজ্জ্বলিত কিছু শিখা সকল, তিব্বতীয় টঙ্ক যাদৃশ–তেমনই, এখন ডিগরিয়ার একদিকে সূৰ্য, তাহারই কিরণমালা, সুঘরাইএ প্রতিফলিত! মনিব মহাশয় জ্ঞাপন। করিলেন,–তাজ্জব সে মনে হয় প্রজ্জ্বলিত ও দুঃখিত, দেখুন উহার বা উহাদের ভগবান নাই।

প্রধান শিক্ষয়িত্রী এবম্প্রকার উক্তিতে অত্রাহি হইলেও, তাঁহার অধীনারা বিমূঢ় হইলেও, সকলেই এককালে সুঘরাইকে লক্ষ্যে অভিভূত ক্রমে তাহারা সকলে চীৎকাঠের বাঁধ, ও অগণন তালবৃক্ষ ও সিজেল জাতীয় বৃক্ষ (!) মহিমা আর অনেক সম-বিসম ইদানীং ফলসা-টে উঁচু নীচু জমির পিছনে ডিগরিয়ার দক্ষিণে মারচস্ সূৰ্য্য দেখিল! তাহারা বিমোহিত। ইহাদের মধ্যে পার্শী সাড়ী পরিহিতা সম্ভ্রান্ত সৌভাগ্যবতী যুবতী কহিল,–যে ঈশ্বর আছেন তাহা উহারে…জ্ঞাত করা বিধেয়…আঃ ঈশ্বর বলিয়া সে আপনকার উত্তমাঙ্গ বড় নিশ্চিন্তে অলৌকিক নির্ভাবনায় রিখিয়ার বৈভবের চারিদিকে ঘুরাইল। সে। নিকটে ছিল, সুতরাং বৈকালিক প্রসাধনে ব্যবহৃত জলসেকের আর্দ্রতার, এখনও, এত ভ্রমণেও, চাকচিক্য প্রতীয়মান, পার্শী কায়দায় সে বড় দূরে ছিল, তাই সে অদৃশ্য।

তাহার ঐ বাক্য মনিব দম্পতি, যাঁহারা ধর্ম্মবিশ্বাসে অন্ধ, ভগবান বলিতে যাঁহাদের নয়ন সজল হয়, তাঁহারা সমস্ত সৃষ্টি হইতে হস্তদ্বয় তুলিলেন, মনিব পত্নী গললগ্নিকৃতবাস হইলেন, আপন আপন জুতা ত্যাগ করিলেন ও বক্ষস্থলে করজোড় স্থাপন করিলেন। তাঁহারা অপূৰ্ব্ব শোভা ধারণ করিয়াছিলেন। অতঃপর এবং ঐভাবেই মনিব মহাশয় বলিলেন, আমার ধ্রুবজ্ঞান যে বালক আপনার ধর্ম্মবিশ্বাস আপনি বহন করিতেছে।

মনিব পত্নী তদীয় সমৃদ্ধ পুষ্ট দেহ দুলাইয়া এদিক সেদিন নজরের পর শান্ত স্বরে সুঘরাইকে আজ্ঞা করিলেন,–আ মোল যা ছোঁড়া সন্ধ্যেবেলা বলেছি না স্থির হয়ে থাকতে হয়, এত ঘুঘুর করছিস কেন মরণ…! কাছে কাছে থাক না–ইহাতে এই শেষোক্ত পদে ইনি কিছু ব্যক্ত করিলেন,এখানে আয়…ও লজ্জা কচ্ছে বুঝি, বুঝেছি খবার পাখীটারে কষ্ট দিস নি…শুনলি ত ওতে পাপ হয়!

এবম্ভূত অভিযোগে, সুঘরাই বটেই যে নিগৃহীতই ছিল, যদ্যপি যে সে সহজ হইতে উন্মুখ, কিন্তু সে আপনাকে প্রকৃতই শান্ত রাখিতে লায়েক না, সে অসংলগ্ন হইয়া আছে; সে মনিব পত্নীর উপর যারপরনাই ত্যক্ত বিরক্ত হইতে সাহসী হইয়াছে; নিশ্চয়ই সে ভাবিয়াছে যে এত লোকসমক্ষে তাহাকে হেয় করা (!) সঙ্গত হয় নাই ও তপ্রভাবে সে দূরে থাকে, এবং সপক্ষে এই কথাই তাহাতে উত্থাপিত হয় যে সে বিবেচনা করে যে, যে কেন এই শালা!–এবং এই শালা উচ্চারণেই সে সচেতন যে, তাহার কোথাও এতক্ষণ গৰ্ব্ব হইতেছিল–অর্থাৎ আপন পাখীর কারণে ঐ গঞ্জনা তাহার গৌরব–যে সে আত্মপ্রসাদে, যাহা এইরূপে ব্যাখ্যা করা যায় যে, তবু ত অর্থাৎ তবু ভাল ইহা যে সে তদীয় পক্ষীর হেতুতে কথা শুনিতে আছে! পুনরায় সুঘরাই আপন পক্ষীর দিকে নজর রাখিয়া ইহা যেন কহিতে লাগিল যে:

এই শালা, এখন, যে, এই বিরাট জবা রঙ টিলায় ঘুরিতে ফিরিতে আছে শালা, তোমার জান না বড় খচ্চড়, কিছু দিন পূর্বে আমি যখন খাঁচার কাঠি বদলাইতে সারাইতে কাঠি চৌরস করি, একনিষ্ঠভাবে মোহিলির দেওয়া মন্তর উচ্চারণ করিতেছিলাম, যদি না করি তাহা হইলে, ভূত খাঁচার কাছে আসিবে; ভূত খাঁচায় ঢুকিবে, উহাকে বধ করিবে…আমি যে কত উহারে ভালবাসি…আমার তিতির তখন আমার কোলেই বসিয়াছিল, মন্তরের মাঝে মাঝে আমি তাহার সহিত গল্প করিতেছিলাম, আশ্চৰ্য্য যে সে আমার কোল সে নোংরা করে নাই, আমার হাতে ধারালো ছুরি, বাঁশ ফাড়িয়া দুই একটি কাঠি সবে মাত্র তৈয়ারী করিয়াছি হঠাৎ এমত সময় পাখী নড়িতেই আমার এই আঙুলটি কাটিয়া যায়, যে অনেক রক্তপাত হইল, আমার পরনের বস্ত্রে কিছু পড়িল,…অনেক অনেক মেজেতে; আমি লাফাইয়া উঠিয়া পড়িলাম, আমার এত আদরের পাখী শালা কিছুই বুঝে না; পাখী দূরে দূরে অবশ্য আমার দিকে চাহিয়াছিল, শুনিয়াছি…পাণ্ডাঠাকুরের ময়না পাখী। পাণ্ডাঠাকুর মরিতে অনেক কাঁদিয়াছিল, দু-তিনদিন কিছু গ্রহণ করে নাই, শুনিয়াছি বদরীবাবুর কুকুর, তিনি মরিতে, পাগল হয়।…দেওঘর হইতে দারগা আসিয়া তাহাকে গুলি করে! বেচারী।–অনেক রক্ত দর্শনে আমাতে ঘোর উপস্থিত, আমি আঙুল চাপিয়া বসিয়া পড়ি, প্রথমে পাখীটি আমার সেই পতিত রক্তের উপর দিয়া নিৰ্ব্বিবাদে চলিয়া যায়, মেঝেতে অনেক পায়ের রক্তাক্ত ছাপ অবলোকনে আমি ভীত হই–আঃ নাট্যকাররা কি সুদক্ষ কি চতুর, এহেন ভীতিকে চমৎকার স্বগত উক্তিতে রাখিয়া থাকে!

সুঘরাই লজ্জাতে কাঁদিবে এমন, মরমে সে মরিয়াছে!

তাদৃশ সদ্য রক্তাক্ত ছাপ সকল বিস্ফারিতনেত্রে সুঘরাই দেখিতে থাকে, সে যেমন যে ইহা যে গণনা শিখিবে, ঐ এলোমেলো মুদ্রণে তাহার জিজ্ঞাস্য ছিল অঢেল, কিন্তু সে আর স্থির থাকিতে পারে না, সবেগে বাগানে গিয়াছিল দ্রুতই, কিছু গাঁদাপাতা আহরণ করত ক্ষত স্থানে চাপিয়া, ঐ কথিত স্থানে ফিরিয়া সে বজ্রাহত, তাহার মাথা আপনা হইতে আনত হইল, যে সে যেমন উচ্চবর্ণসভৃত, সে ডোম নহে, কেন না ছোটজাতদের মস্তক কখনও আনত হয় না, তাহার বেচারী নেত্রপক্ষ ভারাক্রান্ত হইল, তখনও সে হতবুদ্ধি সে তটস্থ, যে তাহাবই রক্ত তাহারই প্রাণাধিক প্রিয় পক্ষী খানিক মস্তক কাৎ করত অপূৰ্ব্ব শোভাতে চঞ্চু দ্বারা রক্ত পান করিতে একমনা আছে।

ক্রমে তদ্দর্শনে সুঘরাই শনৈশ্চর হইল, চক্ষুর্ঘয়ে জরাবর্ণ দেখা দিল, যে সে উঠানে মৃত্তিকায় দানবীয় ক্রোধে পদাঘাতে আপনারে জাগ্রত করিল, যে সে ঢেলা তুলে নাই, শুধু দৌড়াইয়া গিয়া দশ মরদ জোরে লাথি মারিল; এই রক্ষা যে লাথির সবটা অর্থাৎ পায়ের পুরা চোট, পাখীর গায় লাগে নাই, তাহা হইলে, বেচারী পাখী তৎক্ষণাৎ প্রবল বেগে উৎপাটিত উৎক্ষিপ্ত হওয়ত দেওয়ালের সংঘাতে নিশ্চয়ই মরিয়া যাইত! এখন লাথির স্বল্প ঘা’য়ে পাখীর দু-চারটি পালক খসিল আর যে পাখী ত্রাহি চীৎকারে এক কোণে যাইল, কম্পিত ছিল; ঐ আতঙ্কিত পক্ষীর ভয়ার্ত আর্তনাদ অনুরূপ তাহারও কণ্ঠে ধ্বনিত আপনা হইতেই অগোচরেই হইতেছিল, আপাততভাবে মনে হয় সে যেমন বা ভ্যাংচাইতেছে; এবং সুঘরাই নিজ বেগে বেসামাল হওয়ত, সশব্দে পতিত হয়।

ঐ শব্দে মনিব পত্নী দ্বিপ্রহরিক নিদ্রা উখিত হইয়া ঐ স্থলে যাইয়া এবং তখন সুঘরাইকে ছুটিতে দেখিয়া ও তৎসহ রক্তাক্ত মেজে প্রত্যক্ষে হা হা রব করিয়া উঠিলেন, তাঁহার মাথা কেমন করিয়াছিল, তথাপি জিজ্ঞাসিলেন,–ওরে এত রক্ত কোত্থেকে এল সব্বনাশ, তোর পাখী কৈ রে…কিরে অমন হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস…পাখী কৈ…শব্দ হল কিসের–তোর কাপড়ে রক্ত কি সব্বনাশ!

সুঘরাই আনুপূর্বিক সকল কিছুর বিবৃতি দান করিল না।

সত্বর ফার্স্ট এইড বাত্সটি লইয়া আসিয়া তাহার ক্ষতস্থানে ব্যাণ্ডেজ করিলেন, সুঘরাই আইওডিনে লাফাইতে লাগিল, মনিব পত্নী তখনও বিস্মিত হইয়া আছেন, বলিলেন, বেচারী তোর দুঃখেই বুঝি অমনধারা ক্যাঁক্যাঁ করে উঠল! আমি বলি বেড়াল টেড়াল…!

সুঘরাই এখনও দারুণ রোষদগ্ধ, তাদৃশ বীভৎস কদর্য্য দৃশ্যে সে মতিচ্ছন্ন, তাহার ওষ্ঠ কাঁপিতে আছে, প্রকাশিল যে,–বেড়ালে ধরিলে খুব ভালই হইত, ঐ পক্ষী রাক্ষসী উহাকে আর সে পুষিবে না…উহা রাক্ষসী ভূত পেত্নী…আপনি শুনিলে বিকল হইবেন যে, উহা আমার রক্ত নির্ঘ মনে মাড়াইল, ঐ দেখুন সারা মেজেতে উহার রক্ত লাগা পায়ের দাগ, তখনও কিছু বলি নাই, দেখিলাম সে আমার রক্ত খাইতেছে, আমি রাগিয়া যাই আমি লাথি মারি আমি পড়িয়া যাই! উহা পেত্নী মনে হয়, উহাতে পেত্নী ঢুকিয়াছে নিশ্চয়…এই বার তাহার চোখে জল আসিল। এ বিষয়ে সে মোহিলিকে খবর দিবে।

স্নেহময়ী মনিব পত্নী তাহারে ভর্ৎসনা করিয়াছিলেন এইরূপে যে, তুই ছোঁড়া মহা পাগল,…দেখছি সাক্ষাৎ পাপ তুই–যা আগে কাপড় ছাড়…ফের যদি করিস তোর কান ধরে উনি বার করে দেবেন– পরে সান্ত্বনা দিয়াছিলেন,–দেখ দেখি কি কাঁপছে বেচারী, তুই না ওকে দারুণ ভালবাসিস…ওর কি জ্ঞান আছে…ও সব করবে, তুই তাতে মারবি কেন…তুই না বলিস আমাকে যে, মা আমাকে তি তি করে ডাকবে আমি আসব…তুই না সিরিয়া পাহাড়ে ওর নাম লিখবি!…ছোঁড়া উনি শুনলে তোকে আস্ত রাখবেন…তোর পাখী হারাতে উনি না খুঁজতে যান, কত টোটা নষ্ট হল (সেদিন অবশেষে মল্লিক লজের পশ্চাতে ভাঙা বাড়ীর কাছে যখন গুলি ছোঁড়া হইল তখন-তিতির কোথা হইতে বাহির হইয়া উড়িল–এবং একজন যুবক ও যুবতী, ইহাদের মুখ পাংশু ছিল। যুবতী শুনি, দুল হারাইয়াছিল, তাই যুবকের সহিত খুঁজিতেছিল)…ওর গায়ে পা দিলি!নমস্কার কর ছোঁড়া, ওতে না ঠাকুর আছেন? ও অমন হবে কেন…জানিস ওদের চোখেও জল আছে, নে ছোঁড়া নমস্কার কর শিগগীর।

সুঘরাই আপনার পক্ষীরে নমস্কার করিল। তিতিরটি গ্রীবা তুলিয়া সুঘরাইকে দেখিতে আছে। সুঘরাইএর দেহ সুমহৎ বেপথু খেলিয়া উঠিল, একদা শ্রাবণের ঘোর শ্যামবর্ণ মেঘের নিকট সে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল যে, সে পাখীটিকে বুকে রাখিবে, সে পিঙ্গল রক্ত স্রোত স্পর্শ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল যে সে পাখীকে বুকে রাখিবে, যে সে গম্ভীর অশ্বত্থ বৃক্ষের নবোদগত পত্র স্পর্শে প্রতিজ্ঞা করে যে সে উহাকে বুকে রাখিবে!

<

Kamal Kumar Majumdar ।। কমলকুমার মজুমদার