১০. সারপ্রাইজ পার্টি

প্রিয়াংকা এটা ঠিক কীভাবে করে জানি না–আমাদের ক্লাসের ছেলে-মেয়েদের যেদিন যার জন্মদিন সেদিন সে তার জন্যে একটা উপহার নিয়ে আসে। খুব যে একটা দামি উপহার আনে তা না–ছোটখাটো উপহার কিন্তু সে খুব ভাবনাচিন্তা করে সেটা আনে। জাবেদ হচ্ছে বইয়ের পোকা, তার জন্যে আনলো একটা বই এবং মজার কথা হচ্ছে এমন একটা বই যে বইটা জাবেদ পড়ার জন্যে অনেক দিন থেকে খুঁজছে এবং খুঁজে পাচ্ছে না। বইয়ের প্যাকেটটা খুলে সে যখন বইটা দেখলো তার মুখটা একেবারে একশ ওয়াট বালবের মতো জ্বলে উঠল! আমি তখন বুঝতে পারলাম প্রিয়াংকা কেন এটা করে–একজন মানুষের মুখ যখন আনন্দে একশ ওয়াট বালবের মতো জ্বলে ওঠে সেটা দেখার চাইতে মজার ব্যাপার আর কী আছে? আমাদের নীলিমা হচ্ছে একজন গায়িকা তার জন্যে প্রিয়াংকা আনলো একটা স্বরলিপির বই, বইটা পুরানো এবং পোকা খাওয়া। আমি ভেবেছিলাম এই বইটা দেখে নীলিমা নিশ্চয়ই একটু বিরক্ত হবেহলো ঠিক তার উল্টো, খুশিতে লাফাতে লাগলো কারণ সেটাতে নাকী দ্বিজেন্দ্রলালের কোন একটা হারিয়ে যাওয়া গানের স্বরলিপি আছে! আমাদের ইশতিয়াক হচ্ছে ক্রিকেটের ভক্ত, দুনিয়ার সব ক্রিকেটারদের নামধাম তার মুখস্থ। তাকে দিলো একটা সাইবার ক্যাফের কুপন পিছনে একটা ওয়েব সাইটের ঠিকানা। ঠিকানার নিচে প্রিয়াংকা লিখে দিয়েছে এখানে পৃথিবীর সমস্ত ক্রিকেটের খবর আছে! ইশতিয়াক ইন্টারনেট সাইবার ক্যাফে এসব কিছুই জানতো না, আরেকজনকে নিয়ে সেটা দেখে একেবারে হতবাক হয়ে গেলো! সারা জীবনের জন্যে সে প্রিয়াংকার ভক্ত হয়ে গেলো সাথে সাথে।

প্রিয়াংকার এই বিক্ষিপ্তভাবে আনন্দ প্রদান পদ্ধতিটা আমরা সবাই কমবেশি টের পেতে শুরু করেছি। বিষয়টা মনে হয় একটু ছোঁয়াচে, ক্লাসের আরও অনেকে দেখি সেটা করতে শুরু করেছে। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ইংলিশ মিডিয়াম সেই ছাত্রটার জন্যে আমাকে প্রাইভেট টিউটর বানিয়ে দেয়ার পর মাসের শেষে আমি যখন আড়াই হাজার টাকা পেলাম আমার প্রায় মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হলো! আমিও তখন একটু বিক্ষিপ্তভাবে আনন্দ প্রদান পদ্ধতি করার চেষ্টা করলাম–প্রিয়াংকা যেরকম অনেক দিন সময় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে আমি সেরকম পারি না তাই আমি এরকম জটিল কিছু করার চেষ্টা করলাম না, ক্লাসের সবার জন্যে মোড়ের দোকান থেকে জিলিপি কিনে নিয়ে এলাম। সবাই যখন কাড়াকাড়ি করে জিলিপি খেলো এবং জিলিপির রসে কারো হাত কারো বই খাতা এবং কারো জামা-কাপড় আঠা আঠা হয়ে গেলো সেটাও কম মজার ব্যাপার হলো না।

তবে আমরা কেউ প্রিয়াংকাকে হারাতে পারলাম না, আমরা যখন বিক্ষিপ্তভাবে আনন্দ প্রদান-এর চেষ্টা করি সেটা অনেক সময় হয়ে যায় জোর করে করা, সাজানো বা কৃত্রিম প্রিয়াংকা যখন করে সেটা হয় একেবারে স্বাভাবিক। দেখতে দেখতে প্রিয়াংকা মেয়েটার জন্যে ক্লাসের সবার এতো মায়া হয়ে গেলো সেটা আর বলার নয়। সেটা আমি বুঝতে পারলাম একদিন দুপুরবেলা যখন ক্লাসের সবচেয়ে কাঠখোট্টা ছেলে মুশফিক ঘ্যাস ঘ্যাস করে তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, আমাদের প্রিয়াংকার জন্যে কিছু একটা করা দরকার!

আশেপাশে যারা ছিলো তারা সবাই ঘুরে মুশফিকের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো, সবাই কখনো না কখনো এই কথাটা ভেবেছে। ক্লাসের সবচেয়ে লাজুক এবং মুখচোরা শিউলি বলল, হ্যাঁ, আমাদের সবাই মিলে প্রিয়াংকার জন্যে কিছু একটা করা উচিত।

জয়ন্ত মাথা নাড়ল, বলল, সবাই মিলে। সবাই শব্দটাতে সে আলাদা ভাবে জোর দিলো।

আমি একটু অবাক হয়ে দেখলাম আশেপাশে যারা ছিল তারা সবাই কাছাকাছি জড়ো হয়ে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করল। প্রিয়াংকা এর মাঝে কার জন্যে কী করেছে সেটা নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়ে গেলো–আমার হয়তো সবচেয়ে বেশি কথা বলা উচিত ছিলো কিন্তু আমি চুপ করে বসে অন্যদের কথা শুনতে লাগলাম। প্রিয়াংকার জন্যে কী করা যায় সে ব্যাপারে ছেলেরা এবং মেয়েরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেলো। মোটাসোটা আদনান বলল প্রিয়াংকাকে নিয়ে আমাদের কোথাও চাইনিজ না হলে পিতজা খেতে যাওয়া উচিত। সব ছেলেরা জোরে জোরে মাথা নেড়ে সেই প্রস্তাবে সম্মতি দিল। মৌটুসি বলল প্রিয়াংকার জন্যে আমাদের একটা গানের অনুষ্ঠান করা উচিত এবং সব মেয়েরা সেই প্রস্তাবে ছেলেদের থেকেও জোরে জোরে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। ছেলেদের এবং মেয়েদের মাঝে একটা বাগড়া শুরু হয়ে যাবার অবস্থা ঠিক তখন প্রিয়াংকা ক্লাসে হাজির হলো বলে ঝগড়াটা বেশি দূর গড়াতে পারল না।

পরের দিন যখন প্রিয়াংকা আশে-পাশে নেই তখন আবার আগের আলোচনা শুরু হলো–জয়ন্ত চাইনিজ কিংবা গানের অনুষ্ঠান এই দুটো কোনটাতেই না গিয়ে বলল, আমাদের করা উচিত একটা সারপ্রাইজ পার্টি।

আদনান ভুরু কুঁচকে বলল, সারপ্রাইজ পার্টি?

জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। সেখানে তোর খাওয়া-দাওয়াও থাকতে পারে আবার ধর গান-বাজনাও থাকতে পারে।

প্রস্তাবটা অনেকের মনে ধরল। মৌটুসি জিজ্ঞেস করল, কোথায় হবে সারপ্রাইজ পার্টি?

মামুন বলল, এই ক্লাসেই করতে হবে।

আদনান বলল, ক্লাসে? ক্লাসে খাওয়া-দাওয়াটা হবে কেমন করে?

মৌটুসি বলল, গান-বাজনা করতে হলে হারমোনিয়াম তবলা লাগবে না? ক্লাসে সেটা আনবি কেমন করে?

আদনান বলল, আর যদি আনাও হয় সেটা তাহলে সারপ্রাইজ থাকবে না। প্রিয়াংকা বুঝে যাবে।

শিউলি বলল, হ্যাঁ। মনে নাই সে একবার আমার জন্মদিনে আমাকে সারপ্রাইজ দিল?

সেটি সত্যি, সারপ্রাইজ পার্টি দেওয়ার নিয়মকানুন প্রিয়াংকাই সবচেয়ে ভাল জানে! তাকে সারপ্রাইজ করা মনে হয় খুব সোজা না। ক্লাসে তাকে সারপ্রাইজ করতে হলে মনে হয় সে তো সারপ্রাইজ হবেই না, উল্টো আমরা সারপ্রাইজ হয়ে যাব।

আমাদের মাঝে দিলীপ কথাবার্তা কম বলে, সেটা তার বেশি বুদ্ধির লক্ষণ না কম বুদ্ধির লক্ষণ সেটা আমরা এখনো জানি না। পড়াশোনার ব্যাপারে সে যে খুব ঢিলে সেটা আমরা সবাই জানি কিন্তু অন্য বিষয়ে সে কী রকম তার পরীক্ষা কখনো হয় নি। সে হাই তুলে বলল, আসলে এইটা করতে হবে প্রিয়াংকার বাসায়।

আমরা সবাই অবাক হয়ে বললাম, প্রিয়াংকার বাসায়?

দিলীপ মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।

মৌটুসি জানতে চাইল, সেটা কীভাবে করবি?

তা আমি জানি না। বলে দিলীপ হেঁটে হেঁটে চলে গেলো।

প্রথমে কেউ দিলীপের কথাটা গুরুত্ব দিয়ে নেয় নাই কিন্তু সবাই যখন ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা চিন্তা করলো তখন বুঝতে পারল, সেটাই সবচেয়ে সঠিক জায়গা। সকালবেলা প্রিয়াংকা যখন বের হয়ে যাবে তখন আমরা সবাই সবকিছু নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকে যাব। সবকিছু চটপট রেডি করে ফেলব তারপর প্রিয়াংকা যখন ফিরে আসবে তখন চিৎকার করে বলব, সারপ্রাইজ সাথে সাথে পার্টি শুরু হয়ে যাবে এবং সেটা হবে একেবারে ফাটাফাটি পার্টি! কিন্তু সমস্যা একটাই, আমরা সবাই মিলে প্রিয়াংকার বাসায় ঢুকবো কেমন করে? সেটা নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছে তখন মৌটুসি আমার দিকে তাকালো এবং তাকিয়েই রইলো। আমি বললাম, আমার দিকে তুই এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?

মৌটুসি বলল, তুই।

আমি? আমি কী?

তুই ব্যবস্থা করবি।

আমি কীসের ব্যবস্থা করব?

কেমন করে প্রিয়াংকার বাসায় যাওয়া যায়।

আমি ইতস্তত করে বললাম, আমি কেন?

তা না হলে কে? প্রিয়াংকা তোর জন্যে কী করেছে তুই জানিস?

সত্যি কথা বলতে কী প্রিয়াংকা আমার জন্যে কী করেছে সেটা অন্যেরা কিছুই জানে না। অন্যেরা শুধু জানে গণিত কম্পিটিশনে আমাকে নিয়ে যাবার অংশটুকু! বাকিটুকু শুধু জানি আমি। আমি বললাম, হ্যাঁ, জানি?

তাহলে? এবারে মৌটুসির সাথে অন্যেরাও যোগ দিলো। জয়ন্ত বলল, তোর মাঝে কৃতজ্ঞতা বলে কিছু নাই? মামুন বলল, তুই প্রিয়াংকার জন্যে কিছু করতে চাস না? আদনান বলল, প্রিয়াংকা তোর জন্যে যেটা করেছে সেটা কী অন্য কেউ করতো?

আমি বললাম, হ্যাঁ, তা ঠিক আছে, কিন্তু

কোন কিন্তু নাই। শিউলির মতো মুখচোরা লাজুক মেয়েটা পর্যন্ত হাত তুলে আমাকে ধমক দিয়ে বলল, তোমাকেই ব্যবস্থা করতে হবে।

আমি মাথা চুলকে বললাম, কিন্তু-মানে-আমি-ইয়ে-বলছিলাম কী—তাহলে–

কাজেই কেউ আমার কথা শুনলো না।

 

আমি কী করব বুঝতে না পেরে পরের দিনই স্কুল ছুটির পর প্রিয়াংকাদের বাসায় হাজির হলাম। প্রিয়াংকা সরাসরি বাসায় যায় না, দুনিয়া ঘুরে নানা জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে আনন্দ বিতরণ করে তারপর বাসায় ফিরে আসে। আমি দরজায় শব্দ করলাম, কিছুক্ষণ পর খুট করে শব্দ করে প্রিয়াংকার আব্বু দরজা খুলে দিলেন। আমাকে দেখে একটু অবাক হলেন কিন্তু সেটা প্রকাশ করলেন না, বললেন, আরে আমাদের ম্যাথমেটিশিয়ান দেখি! এসো এসো।

আমি ভিতরে ঢুকলাম। প্রিয়াংকার আবু তার হুইল চেয়ারটি ঘুরিয়ে ঘরের ভেতরে যেতে যেতে বললেন, বসো তপু। প্রিয়াংকা তো এখনো বাসায় আসে নাই, তার আসতে দেরি হয়।

জানি! আমি ইতস্তত করে বললাম, আমি আসলে আপনার কাছেই এসেছি।

আমার কাছে?

জি।

কী ব্যাপার?

ইয়ে মানে আমি বলছিলাম কী–এ্যাঁ এ্যাঁ–প্রিয়াংকার আব্লু খুব ধৈর্য ধরে মুখে হাসি ফুটিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। আমি শেষ পর্যন্ত বললাম, আমাদের ক্লাসের সবাই ঠিক করেছে যে প্রিয়াংকার জন্যে একটা সারপ্রাইজ পার্টি দেবে।

তাই নাকী! কী উপলক্ষে?

কোন উপলক্ষ না। এমনিই।

এমনিতেই সারপ্রাইজ পার্টি?

জি। প্রিয়াংকার আব্লু হেসে বললেন, তা আমাকে কী করতে হবে?

সবাই মিলে ঠিক করেছে পার্টিটা এইখানে হবে।

এইখানে? এবারে প্রিয়াংকার আব্বুর মুখে খুব হালকা মতোন একটু দুশ্চিন্তা উঁকি দিল। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি তিনি দুশ্চিন্তাটা লুকিয়ে ফেললেন।

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, আপনার কিছুই করতে হবে না। সব আমরা করব। আমরা খাবারদাবার নিয়ে আসব। একটা গানের অনুষ্ঠান হবে।

গানের অনুষ্ঠান? মনে হলো আবার তাঁর মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়লো। এবারে ঠিক হালকা দুশ্চিন্তার ছাপ নয় বেশ গভীর।

আমি বললাম, জি। আমাদের ক্লাসের কয়েকজন খুব সুন্দর গান গাইতে পারে। কয়েকজন একটা নাটকও করতে চাইছে।

না-নাটক? এবারে প্রিয়াংকার আব্বুর মুখে আরও বেশি দুশ্চিন্তার ছাপ পড়লো, সেটা ঠিক লুকানোর চেষ্টাও করলেন না। আমতা আমতা করে বললেন, ইয়ে আমি বলছিলাম কী, সারপ্রাইজ পার্টি সাধারণত সারপ্রাইজ থাকে না। তার চেয়ে একটা সাধারণ পার্টি করলে ভাল হয় না? খুব সিম্পল। তোমরা সবাই আসলে আমি আর প্রিয়াংকা মিলে তোমাদের জন্যে একটু চানাস্তা রেডি করলাম–

উঁহুঁ। আমি মাথা নেড়ে বললাম, ক্লাসের ছেলেমেয়েরা রাজি হবে না।

প্রিয়াংকার আকু চিন্তিত মুখে বললেন, রাজি হবে না?

নাহ! আমি মুখটা গম্ভীর করে বললাম, সবাই প্রিয়াংকাকে খুব পছন্দ করে তো–তাই তার জন্যে একটা সারপ্রাইজ পার্টি দিতে চায়।

প্রিয়াংকার আব্বু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আছে! তাহলে তো করতেই হয়।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, জি। আমাকে কী করতে হবে?

কিছু করতে হবে না। আমি ভরসা দিয়ে বললাম, আমরা সবাই আগেই এসে বাসায় সব কিছু রেডি করে ফেলব। তারপর সবাই লুকিয়ে থাকব। প্রিয়াংকা যেই আসবে।

প্রিয়াংকার আব্বু মাথা নাড়লেন, বললেন, বুঝেছি। তোমরা আমাকে আগে জানিয়ে দাও, কবে আসবে, কখন আসবে।

জি। জানিয়ে দেব।

প্রিয়াংকার আব্বুল্লুকে একটু মনমরা দেখালো, বললেন, তোমাকে কী খেতে দেব বলো। ভাল বিস্কুট আছে–

না চাচা। আমি মাথা নেড়ে বললাম, প্রিয়াংকা এসে আমাকে দেখলে সব বুঝে ফেলবে।

তা ঠিক।

আমি যাই চাচা।

ঠিক আছে।

আপনি কিন্তু প্রিয়াংকাকে বলবেন না কিছু।

না। বলব না।

আমি তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হয়ে এলাম।

 

পরের দিন যখন সবাইকে বলেছি যে সারপ্রাইজ পার্টি করার জন্যে সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি তখন সবাই বেশ অবাক হলো। তারা কেউ চিন্তাও করে নাই যে আমি এতো তাড়াতাড়ি প্রিয়াংকার বাসায় গিয়ে তার আব্বুর সাথে কথাবার্তা বলে সব ঠিক করে ফেলব। প্রথমে তারা বিশ্বাস করতে চাইলো না কয়েকবার কিরা-কসম কাটার পর শেষ পর্যন্ত সবাই বিশ্বাস করল।

কাজেই সবাই মিলে এখন পরের অংশটুকু করার জন্যে রেডি হতে লাগলো। ক্লাস-কবি জহুরুলকে দায়িত্ব দেয়া হলো প্রিয়াংকাকে নিয়ে একটা গান লেখার। গান লেখার পর মৌটুসি আর নীলিমা সেটাতে সুর দিলো। গানটার শুরু এরকম :

আমাদের ক্লাসে আছে ছটফটে মেয়ে
দিন কাটে আনন্দে নেচে গান গেয়ে
প্রিয়াংকা সে যে প্রিয়াংকা…

আদনান, ইশতিয়াক, মামুন, জয়ন্ত তারা মিলে একটা নাটক দাঁড় করাচ্ছে। আমাকেও অভিনয় করতে বলেছিল, আমি রাজি হইনি। আমি ভাল করে কথাই বলতে পারি না, অভিনয় করব কীভাবে? সবার কাছ থেকে চাঁদা তোলা হয়েছে। সেগুলো দিয়ে কিছু উপহার কেনা হবে খাবার-দাবার কেনা হবে। কী খাওয়া হবে সেটা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক করে ঠিক করা হলো কাবাব এবং পরাটা কিনে আনা হবে। তার সাথে পেপসি। যদি টাকা-পয়সা দিয়ে কুলানো যায় তাহলে দুই কেজি মিষ্টিও কিনে আনা হবে। সারপ্রাইজ পার্টি করার জন্যে বাসাটাকে সাজাতে হবে। রঙিন কাগজ এবং বেলুন দিয়ে সাজানোর জন্যে আমাদের ক্লাস শিল্পী নাঈমাকে দায়িত্ব দেয়া হলো। পুরো ব্যাপারটা করতে হবে ছুটির দিনে, তাই উৎসাহে সবাই। ছটফট করতে থাকলেও পরের শুক্রবার দুপুর বেলার আগে সময় ঠিক করা গেলো না। আমি সেটা প্রিয়াংকার আব্বুকে জানানোর জন্যে তাকে ফোন করলাম। ফোন ধরে প্রিয়াংকার আব্বু বললেন, হ্যালো।

আমি বললাম, চাচা, আমি তপু।

ও! কী খবর ম্যাথমেটিশিয়ান।

জি ভাল। প্রিয়াংকা আশেপাশে নাই তো?

না। একটু বাইরে গেছে।

চাচা, আমরা শুক্রবার বিকালবেলা টাইম ঠিক করেছি।

গুড। আমার কিছু করতে হবে?

না চাচা কিছু করতে হবে না। শুধু—

শুধু কী?

প্রিয়াংকাকে আধা ঘন্টার জন্যে যদি বাসা থেকে কোথাও পাঠাতে পারেন তাহলে খুব ভাল হয়।

প্রিয়াংকার আব্বু এক মুহূর্ত কী একটা ভাবলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, আমি কোন কাজে প্রিয়াংকাকে আধাঘণ্টার জন্যে বাইরে পাঠিয়ে দেব।

থ্যাংক ইউ চাচা।

কয়টার সময় বাইরে পাঠাব?

আড়াইটার সময়। ঠিক আছে। তাহলে আড়াইটা থেকে তিনটার জন্যে তাকে বাইরে পাঠাব। তোমাদের এর মাঝে চলে আসতে হবে।

জি চাচা।

তাহলে তোমাদের সাথে শুক্রবারে দেখা হবে।

জি চাচা।

আপনি কিন্তু প্রিয়াংকাকে কিছু বলবেন না।

প্রিয়াংকার আব্বু হাসলেন, হেসে বললেন, আমি কিছু বলব না, তবে তোমরা ব্যাপারটা প্রকাশ করে দিও না। এসব ব্যাপারে প্রিয়াংকা কিন্তু খুব চালাক!

জি চাচা। আমরা জানি।

টেলিফোনটা রেখে আমি বুক থেকে একটা বড় নিঃশ্বাস বের করে দিলাম, আমার ওপর যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেটা আমি অক্ষরে অক্ষরে করে ফেলেছি। এখন অন্যদের বাকি দায়িত্ব শেষ করতে হবে। দেখা যাক কী হয়!

 

সেদিন রাত্রিবেলা যখন মিচকি আমার সাথে দেখা করতে এলো আমি তাকে হাতে তুলে নিয়ে ফিসফিস করে বললাম, বুঝলি মিচকি, আগামী শুক্রবারে আমাদের বিশাল প্ল্যান।

মিচকি পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে প্ল্যানটা ভাল করে শুনতে চাইলো। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, প্রিয়াংকাকে একটা সারপ্রাইজ পার্টি দেব। সারপ্রাইজ পার্টি মানে বুঝেছিস? হঠাৎ করে একটা পার্টি দিয়ে চমকে দেওয়া।

রান্নাঘর থেকে দুলি খালা হঠাৎ করে স্টোররুমে উঁকি দিল, বলল, কী ব্যাপার? তুমি একলা একলা কার সাথে কথা বলো?

আমি তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে মিচকিকে আড়াল করে বললাম, কার সাথে কথা বলব আবার? নিজের সাথে কথা বলি?

দুলি খালা দাঁত বের করে হাসলো, বলল, এই বিষয়টা খারাপ না। নিজের সাথে নিজে কথা বললে কোন ঝগড়া-বিবাদ হয় না। তবে খালি একটা সমস্যা!

কী সমস্যা দুলি খালা?

অন্যেরা শুনলে তারা পাগল ভাবে! দুলি খালা হাসতে হাসতে আবার রান্নাঘরে চলে গেলো, আমি শুনলাম, বিড়বিড় করে সে নিজের সাথে কথা বলছে।

আমি মিচকিকে এক টুকরো রুটি ধরিয়ে দিয়ে বললাম, তাড়াতাড়ি খেয়ে পালিয়ে যা! দুলি খালা দেখলে তোর খবর আছে!

মিচকি দুই হাতে রুটির টুকরোটা ধরে গভীর মনোযোগ দিয়ে খেতে শুরু করলো।

 

শুক্রবার দিন দুইটা বাজার আগেই আমি প্রিয়াংকার বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি। বাসার ভিতরে এখন ঢোকা যাবে না তাই কাছাকাছি একটা শপিং মলের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। একটু পরে পরে বাইরে গিয়ে তার বাসার দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করি প্রিয়াংকাকে তার আব্বু বাসা থেকে বাইরে পাঠিয়েছেন কী না। আড়াইটার বেশ আগেই আমাদের ক্লাসের আরো অনেকেই চলে এসেছে। সবার হাতেই কোন না কোন ধরনের ব্যাগ না হয় প্যাকেট। আমরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গা ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে রইলাম, একজন শুধু প্রিয়াংকার বাসার দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো।

আড়াইটা বাজার আগেই আমরা দেখলাম প্রিয়াংকা তার বাসা থেকে বের হয়েছে। তার পিঠে একটা ব্যাগ, হাতে একটা কাগজ। কাগজটা পড়ে সেটা ব্যাগে রেখে সে এদিক সেদিক তাকিয়ে রাস্তায় নেমে একটা রিকশা নিলো। রিকশাটা চলে যাবার সাথে সাথেই আমরা চারিদিক থেকে বের হয়ে, প্রায় দৌড়ে প্রিয়াংকার বাসায় চলে এলাম। সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো। প্রিয়াংকার আব্বু তার হুইল চেয়ারে বসে একটা খবরের কাগজ পড়ছিলেন। প্রিয়াংকার আব্বু যে হুইল চেয়ারে থাকেন সেটা আগেই সবাইকে বলে রেখেছিলাম তাই সবাই সেটা স্বাভাবিক ভাবে নিল। প্রিয়াংকার আব্বু আমাদের দেখে বললেন, তোমরা এসে গেছ তাহলে?

আমি বললাম, জি চাচা।

প্রিয়াংকার আলু বললেন, তোমাদের হাতে আধা ঘণ্টা সময়। আমি প্রিয়াংকাকে পাঠিয়েছি একটা ওষুধ কিনে আনতে ফার্মেসি থেকে, কিন্তু আধা ঘণ্টার মাঝে চলে আসবে।

জয়ন্ত বলল, আধা ঘণ্টার মাঝেই সবাই চলে আসবে, আংকেল।

জয়ন্তের কথা হবার আগেই মৌটুসি আর নীলিমা একটা হারমোনিয়াম আর কিছু পোঁটলাপুটলি নিয়ে ঢুকলো। তাদের পিছু পিছু আরো কয়েকজন। এবং আরো কিছুক্ষণের মাঝে আরো অনেকে। দেখতে দেখতে প্রায় সবাই চলে এসেছে–প্রিয়াংকার আব্বু আমাদের কাজ করতে দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন।

নাঈমা রঙিন কাগজ কেটে লিখে এনেছে জয় হোক প্রিয়াংকার সেটা দেওয়ালে লাগানো হলো। বেলুন ফুলিয়ে ফুলিয়ে ঘরের নানা জায়গায় ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখা হলো। মৌটুসি-নীলিমা আর তার দলবল হারমোনিয়াম নিয়ে রেডি। আদনান, ইশতিয়াক মামুন আর জয়ন্ত তাদের নাটকের জন্যে রেডি। আদনান এবং ইশতিয়াক হবে সন্ত্রাসী, মামুন পুলিশ অফিসার আর জয়ন্ত পথচারী। সন্ত্রাসী আদনান এবং ইশতিয়াকের হাতে অস্ত্র, তাদের চেহারা বিদঘুটে, পুলিশ অফিসার মামুন নকল গোঁফ লাগিয়েছে, পথচারী জয়ন্ত হাবাগোবা সেজে বসে আছে।

শিউলি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে, প্রিয়াংকাকে দেখলেই আমাদের সতর্ক করে দেবে। আমরা তখন সবাই দরজার কাছে চলে আসব।

তিনটা বাজার সাথে সাথেই প্রিয়াংকার জন্যে আমরা অপেক্ষা করতে থাকি। আমাদের সাথে প্রিয়াংকার আব্বুও আছেন, মুখে হালকা একটা দুশ্চিন্তা নিয়ে তার হুইল চেয়ারে বসে আছেন। ঠিক তিনটা দশে প্রিয়াংকাকে রিকশা করে আসতে দেখা গেলো, শিউলি চাপা গলায় বলল, প্রিয়াংকা আসছে! সবাই রেডি!

আমরা সবাই তখন দরজার কাছে ভিড় করে দাঁড়ালাম। উত্তেজনায় আমাদের বুক ধুকপুক করছে, শুনতে পাচ্ছি সে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। দরজার সামনে দাঁড়ালো, তারপর দরজায় শব্দ করলো। আদনান টান দিয়ে দরজা খুলে ফেললো আর আমরা সবাই বিকট গলায় চিৎকার করে উঠলাম, সা-র-প্রা-ই-জ!!

তারপর যে ঘটনা ঘটলো আমরা তার জন্যে একেবারে প্রস্তুত ছিলাম না। প্রিয়াংকা ভয়ানক চমকে লফিয়ে পিছিয়ে সরে যেতে গিয়ে পা বেঁধে পড়ে গেলো। আমরা দেখলাম সে সিড়িতে একেবারে মাথা উল্টে পড়ে গেছে, দেওয়ালে জোরে তার মাথা লেগেছে এবং সেভাবে গড়িয়ে পড়ে যেতে যেতে সিঁড়ির নিচে সে আটকে গেলো। একটা হাত তার শরীরের নিচে এমন অস্বাভাবিকভাবে ঢুকে আছে যে দেখলেই বোঝা যায় হাতটা নিশ্চয়ই ভেঙ্গে গেছে। আমরা বিস্ফারিত চোখে দেখলাম, প্রিয়াংকা নিথর হয়ে পড়ে আছে নড়ছে না। ভয়ে-আতংকে আমার হৃৎপিণ্ডটা হঠাৎ করে যেন থেমে গেলো।

আমি শুনলাম প্রিয়াংকার আব্বু বলছেন, তোমাদের কেউ একজন আমাকে ধরে একটু নিচে নামিয়ে নিয়ে যাও, প্রিয়াংকার কাছে। প্লিজ।

 

হাসপাতালে নেয়ার পর যখন প্রিয়াংকাকে এক্সরে করা হচ্ছে তখন তার জ্ঞান ফিরে এলো। ডান হাতটা কনুইয়ের কাছে ভেঙ্গে গেছে সেটা প্লাস্টার করে দেয়া হলো। যেহেতু মাথায় ব্যথা পেয়েছে সে জন্যে তাকে হাসপাতালে আরো তিনদিন রাখা হলো চোখে চোখে রাখার জন্যে। যখন হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয় তখন আমরা অনেকে সেখানে ছিলাম। প্রিয়াংকার আব্রু যখন প্রিয়াংকাকে নিয়ে অনেক কষ্ট করে ক্যাবে উঠে তার হুইল চেয়ারটা ভাঁজ করে পিছনে রাখছেন তখন আমার দিকে তাকিয়ে কষ্ট করে একটু হেসে বললেন, বুঝলে ইয়ং ম্যাথমেটিশিয়ান, এ জন্যে আমি সব সময় সারপ্রাইজ পার্টিকে একটু ভয় পাই! সারপ্রাইজটা কোন দিক থেকে আসবে কেউ বুঝতে পারে না!

 

প্রিয়াংকার হাতের প্লাস্টার না খোলা পর্যন্ত আমরা সবাই পালা করে তার ক্লাস নোট লিখে দিয়েছি, হোমওয়ার্ক খাতায় তুলে দিয়েছি। স্কুলে টিফিনের সময়। যখন দরকার হয়েছে তাকে খাইয়ে দিয়েছি। প্রত্যেক দিন বিকালে তার স্কুলের ব্যাগ ঘাড়ে করে বাসায় পৌঁছে দিয়েছি। ক্লাসের সব ছেলেরা বলল তারা সবাই মিলে এক হাজার বার কান ধরে উঠ বোস করবে, প্রিয়াংকার মনটা নরম করতে এক হাজার বার করতে হয় নাই একশবার করার পরই সে সবাইকে মাফ করে দিয়েছে।

প্রিয়াংকা মাফ করে দিয়েছে সত্যি কিন্তু তার আব্বু আমাদের মাফ করছেন। কী না, কিংবা এখন না করলেও পরে কোন দিন মাফ করবেন কী না সেই বিষয়ে আমাদের সবারই খুব সন্দেহ রয়ে গেছে।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল