০৫. চোর

বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়াটা আরও কয়েকদিনের জন্যে পিছিয়ে দিতে হলো। স্কুল থেকে আমাকে টি.সি দিয়ে বের করে দেয়া হবে না সেটা আমি বুঝে গেছি। সেদিন যখন স্কুল ছুটি হবার পর বাসায় ফিরে যাচ্ছি তখন প্রিয়াংকা আমার কাছে ছুটে এসে বলল, তপু।

আমি বললাম, কী?

তুই দেখলি কী হলো?

অনেক দিন পর কেউ একজন আমার সাথে তুই তুই করে কথা বলল। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম একজন যখন আরেকজনের সাথে আন্তরিকভাবে কথা বলে তখন কেমন লাগে। আমি আমার অবাক হওয়াটা গোপন রেখে বললাম, কেন কী হয়েছে?

তুই প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে কী বলেছিলি মনে আছে?

কী?

রাজাকার স্যার রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ান না, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে টিটকারি মারেন—

আমার মনে পড়ল, বললাম, ও, হ্যাঁ মনে আছে।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ঠিক এগুলি নিয়ে কথা বলেছেন। রাজাকার স্যার দশ বছর ধরে যে সর্বনাশ করার চেষ্টা করেছেন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এক ঘণ্টায় সেটা ঠিক করে দিলেন। প্রিয়াংকা আনন্দে দাঁত বের করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।

আমার দিকে তাকিয়ে অনেকদিন কেউ হাসে নি, আমার কাছে বিষয়টা এমন বিচিত্র মনে হলো যে আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে রইলাম। প্রিয়াংকা বললাম, তোর কী হলো? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?

আমি বলল, না কিছু হয় নাই।

প্রিয়াংকা বলল, প্রিন্সিপাল ম্যাডামের জন্যে কিছু একটা করতে হবে।

আমি বললাম, কী করবে? বলতে চেয়েছিলাম কী করবি? কিন্তু বলতে পারলাম না। কীভাবে কীভাবে জানি নিজের চারিদিকে একটা দেওয়াল তুলে ফেলেছি, কারো সাথে সহজ হতে পারি না।

প্রিয়াংকা বলল, এখনও ঠিক করি নাই। চিন্তা করছি।

প্রিয়াংকা মনে হয় চিন্তা করতে করতেই ব্যাগ ঝুলিয়ে চলে গেলো। আমিও স্কুল থেকে বের হয়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে লাগলাম। অন্ধকার হবার আগে আমি কখনো বাসায় ফিরে যাই না।

 

সেদিন রাত্রিবেলা আমি একটা বিচিত্র কাজ করলাম। স্টোররুমে আমার বিছানায় গুটিশুটি মেরে বসে আমাদের বাংলা বইয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাটা মুখস্থ করে ফেললাম। মোটামুটি বড় কবিতা কিন্তু দেখতে দেখতে মুখস্থ হয়ে গেলো। আমি যখন মনে মনে কবিতাটা আবৃত্তি করছি ঠিক তখন নেংটি ইঁদুরটা দরজার চৌকাঠের অন্যপাশ থেকে আমার দিকে উঁকি দিল। আমি মেঝেতে আঙুল দিয়ে ঠোকা দিয়ে ফিসফিস করে বললাম, এই মিচকি! এই!

নেংটি ইঁদুরটা আমার দিকে এগিয়ে এলো, আমি আমার পকেট থেকে ছোট ছোট রুটির টুকরো বের করে কাছাকাছি ছড়িয়ে দিলাম। নেংটি ইঁদুরটা একটু দূর থেকে সাবধানে আমাকে লক্ষ্য করে আস্তে আস্তে কাছে এসে একটা রুটির টুকরো সাবধানে সরিয়ে নিয়ে কুটুর কুটুর করে খেতে থাকে। আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, এই মিচকি? তোর কী কবিতা ভাল লাগে?।

নেংটি ইঁদুরটা আমার কথার উত্তর না দিয়ে তার দ্বিতীয় টুকরোটার জন্যে এগিয়ে এলো। আমি ফিসফিস করে বললাম, শুনবি কবিতাটা? নেংটি ইঁদুরটা তার মাথা তুলে সাবধানে আমার দিকে তাকালো, আমি সেটাকেই সম্মতির চিহ্ন হিসেবে ধরে নিয়ে বললাম, তাহলে শোন।

আমি তারপর ফিসফিস করে কবিতাটা আবৃত্তি করে শোনাতে থাকি। ডাইনিংরুমে তখন আম্মু আপু আর ভাইয়াকে নিয়ে খাচ্ছে। দুলি খালা টেবিলে খাবার নিয়ে যাচ্ছে, ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করছে। আমি সবকিছুকে ভুলে গিয়ে আমার নেংটি ইঁদুরকে ফিসফিস করে কবিতা শোনাতে লাগলাম। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাকে দেখলে খুব অবাক হতেন নিশ্চয়ই!

নেংটি ইঁদুরটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আমি আমার হাতের তালুতে তুলতে চেষ্টা করলাম কিন্তু সে রাজি হলো না। হাতের আঙুলগুলোর কাছাকাছি এসে সাবধানে গন্ধ শুকে এমন একটা ভাব করলো যে তার গন্ধটা পছন্দ হয় নি, তারপর লাফিয়ে লাফিয়ে চলে গেলো। এই নেংটি ইঁদুরের সময়ের জ্ঞান খুব বেশি, তার হাবভাব দেখেই মনে হচ্ছে কোথাও একটা জরুরি এপয়ন্টমেন্ট আছে, তাকে এখনই চলে যেতে হবে!

নেংটি ইঁদুরটা চলে যাবার পর আমি কিছু করার নেই বলে আমার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। এখন মে মাস, ভ্যাপসা গরম। এই স্টোররুমের বিছানায় শুয়ে আমি এপাশ-ওপাশ করতে থাকি। আমার যখন ঘুম আসে না তখন আমি মাথার ভেতরে কোন একটা অঙ্ক করার চেষ্টা করি, তখন সময়টা বেশ কেটে যায়। ঘড়িতে ঠিক তখন সাড়ে দশটা বাজার একটা ঘণ্টা বাজলো তখন আমি চিন্তা করতে লাগলাম কতক্ষণ পর পর ঘড়ির ঘণ্টা আর মিনিটের কাটা ঠিক এক জায়গায় এসে হাজির হয়। ঘণ্টার কাঁটা প্রতি মিনিটে আধা ডিগ্রি যায় মিনিটের কাটা যায় ছয় ডিগ্রি। প্রথমবার ঘণ্টা আর মিনিটের কাঁটা এক জায়গায় থাকে ঠিক বারোটার সময়। এর পরের বার ঘণ্টা আর মিনিটের কাটা এক জায়গায় আসবে একটা বেজে সাড়ে পাঁচ মিনিটের দিকে। মিনিটের সঠিক সংখ্যাটা হচ্ছে ত্রিশকে সাড়ে পাঁচ দিয়ে ভাগ করলে যে সংখ্যা পাওয়া যায় সেটা। প্রতি ঘণ্টার পর এই সংখ্যার সমান সংখ্যক মিনিট সরে যেতে হবেসমস্যাটা আসলে একেবারে কঠিন না। একেবারে পানির মতো সোজা। সময় কাটানোর জন্যে আমার আরো কঠিন একটা সমস্যা দরকার।

একটা সমবাহু ত্রিভুজের প্রত্যেক বাহুর মাঝখানে যদি বাহুর তিন ভাগের এক ভাগ সমান একটা ত্রিভুজ বসানো হয় তাহলে কেমন হয়? সেই ত্রিভুজের মাঝখানে আরেকটা ছোট ত্রিভুজ, তার মাঝখানে আরেকটা এভাবে যদি বসানোই হতে থাকে তাহলে যে জিনিসটা তৈরি হবে তার পরিসীমা কতো? তার ক্ষেত্রফলইবা কতো? কিছুক্ষণের মাঝেই সমস্যাটা আমি মাথার মাঝে করে ফেললাম কিন্তু যে উত্তরটা পেলাম সেটা হলো খুব অদ্ভুত। ক্ষেত্রফল সসীম কিন্তু পরিসীমা অসীম। কী আশ্চর্য!

আমি বিছানা থেকে উঠে বসলাম, এটা একটা ভাল সমস্যা। এর পিছনে কিছুক্ষণ সময় কাটানো যায়। সমস্যাটা মাথার মাঝে করে ফেলা গেছে কিন্তু এটা সত্যি কীনা বোঝার জন্যে কাগজ-কলম লাগবে। আমি উঠে বসে আমার একটা খাতা আর কলম নিয়ে হিসেব করতে লাগলাম। ঠিক যখন মাঝামাঝি এসেছি আর দুটি লাইন করলেই পরিসীমাটি পেয়ে যাই তখন আমার বল পয়েন্ট কলমের কালিটা শেষ হয়ে গেল! আমার এতো মেজাজ খারাপ হলো যে বলার মতো নয়–ইচ্ছে হলো কলমটাকে কামড়ে খেয়ে ফেলি। কিন্তু বল পয়েন্ট কলম কামড়ে খেয়ে ফেললেও তো সেটা থেকে লেখা বের হবে না!

আমি আমার কাগজগুলো নিয়ে ছটফট করতে লাগলাম, সমস্যাটা শেষ করার জন্যে হাত নিশপিশ করতে লাগলো। ভাইয়া কিংবা আপুর কাছ থেকে একটা কলম চেয়ে আনা যায়, কিন্তু আম্মুর চোখে পড়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে! সবাই ঘুমিয়ে যাবার পর খুব সাবধানে উঠে গিয়ে ভাইয়া কিংবা আপুর টেবিল থেকে একটা কলম নিয়ে আসা ছাড়া আর কোন সহজ উপায় নেই। তা হলে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বাসা থেকে পালিয়ে যাবার জন্যে অনেকদিন থেকে আমি একটু একটু করে টাকা-পয়সা জমানোর চেষ্টা করছি, সেখান থেকে দুটো টাকা নিয়ে একটা বল পয়েন্ট কলম কিনে ফেলা যাবে। কিন্তু এখন রাত সাড়ে দশটা-এগারোটার সময় আমার কিছুই করার নেই।

সবকিছু ভুলে গিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করা যায় কিন্তু আমি ঘুমাতে পারছি না। দেখাই যাচ্ছে আমি যে জিনিসটার পরিসীমা আর ক্ষেত্রফল বের করার চেষ্টা করছি তার মাঝে একটা বিচিত্র ব্যাপার রয়েছে। এর ক্ষেত্রফল অসীম কিন্তু পরিসীমা সসীম। এটা কীভাবে হতে পারে?

বিষয়টা ভাল করে দেখার জন্যে আমার ভেতরটা আঁকুপাকু করতে লাগলো। আমার দরকার একটা কলম বা পেন্সিল! আমি আমার বিছানা কাগজপত্র ভাল করে উল্টেপাল্টে দেখলাম, কোথাও আরেকটা কলম কিংবা পেন্সিল নাই। বহুদিন থেকে লেখাপড়া করি না, তাই থাকার কথাও না। কী করব বুঝতে না পেরে শুয়ে শুয়ে আমি ছটফট করতে লাগলাম।

রাত সাড়ে এগারোটার দিকে বাসার সব আলো নিভে গেল, তার মানে সবাই শুয়ে পড়েছে। তারপর আমি আরো কিছুক্ষণ সময় দিলাম, যখন মনে হলো সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে তখন আমি সাবধানে আমার বিছানা থেকে উঠে পা টিপে টিপে ভাইয়ার ঘরের সামনে হাজির হলাম। খুব সাবধানে দরজাটা একটু খুলে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেলাম। ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার, কোন কিছু দেখা যায় না। বাম পাশে বিছানায় ভাইয়া ঘুমাচ্ছে, পাশে টেবিলে তার বই খাতাপত্র। টেবিলের উপরে নিশ্চয়ই কলম পেন্সিল ছড়ানো থাকবে সেখান থেকে হাতড়ে একটা কলম খুঁজে নিতে হবে। আমি টেবিলের উপর হাত দিলাম, বই, কিছু কাগজ, গানের সিড়ি এরকম জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিন্তু কোন কলম বা পেন্সিল নেই। আমি দুই পাশে হাত বুলাতে থাকি, অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না হঠাৎ করে হাত লেগে কিছু একটা পড়ে গেলো, টেবিল থেকে গড়িয়ে সেটা মেঝেতে পড়ে সশব্দে ভেঙ্গে যায়।

আমার হৃৎপিণ্ড হঠাৎ করে যেন থেমে গেলো। বিছানায় লাফ দিয়ে ভাইয়া উঠে বসেছে, ভয় পাওয়া গলায় চিল্কার করে উঠেছে, কে?

আমি কী করব বুঝতে পারলাম না। উপায় না দেখে ফিসফিস করে কাতর গলায় বললাম, ভাইয়া, আমি তপু।

ভাইয়া অবাক হয়ে বলল, তপু!

ততক্ষণে সর্বনাশ যেটা হবার সেটা হয়ে গেছে, পাশের ঘর থেকে আম্মু জিজ্ঞেস করেছেন, রাজীব, কী হয়েছে?

ভাইয়া বলল, কিছু না আম্মু।

কার সাথে কথা বলিস?

ভাইয়া ইতস্তত করে বলল, তপুর সাথে।

পাশের ঘরে আম্মু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তারপর আমি শুনতে পেলাম বিছানা থেকে নামছেন। আলো জ্বালালেন তারপর দরজা খুলে ভাইয়ার ঘরে এসে ঢুকলেন। ভাইয়ার ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বালালেন। তীব্র আলোয় আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। স্টোররুমে হঠাৎ করে আলো জ্বালালে তেলাপোকাগুলো যেমন কোথায় গিয়ে পালাবে বুঝতে পারে না, আমার অবস্থা হলো ঠিক সেরকম। আম্মুর সামনে আমি জবুথবু হয়ে দাড়িয়ে রইলাম, নিজেকে নিয়ে কোথায় লুকাবো আমি বুঝতে পারছিলাম না। এক পলকের জন্যে আম্মুর দিকে তাকিয়ে আমি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলাম, আম্মুর চোখ ধ্বকধ্বক করে জ্বলছে।

আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, তুই এখানে কী করছিস?

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। কিছু না বলে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকাই মনে হয় সবচেয়ে নিরাপদ।

আম্মু আরও এক পা এগিয়ে এসে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেন এসেছিস এখানে? আম্মু নিচের দিকে তাকালেন, আমার হাতে লেগে টেবিলে রাখা গ্লাসটা পড়ে ভেঙ্গে গেছে। শুধু যে গ্লাসটা ভেঙ্গেছে তা নয়, পানি পড়ে টেবিলে রাখা ভাইয়ার বই-কাগজপত্রও একটু ভিজে গেছে।

আম্মু আরও এক পা এগিয়ে এসে খপ করে আমার চুল ধরে একটা হ্যাচকা টান দিলেন, হিংস্র গলায় বললেন, কী করতে এসেছিস এই ঘরে?

আমি যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বললাম, একটা কলম নিতে এসেছিলাম।

আম্মু আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললেন, কলম নিতে এসেছিস? কলম?

আমি মাথা নাড়লাম। আম্মু গলায় বিষ ঢেলে বললেন, আমার জ্ঞানের সাগর আইনস্টাইন রাত দুপুরে এসেছেন কলম চুরি করতে! আমার সাথে তুই ইয়ারকি মারতে এসেছিস? তুই ভাবছিস আমি জানি না তোর পড়াশোনার নমুনা? তুই কয় সাবজেক্টে পাস করিস আর কয় সাবজেক্টে ফেল করিস আমি সেটা জানি না ভেবেছিস?

আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আম্মু এদিক সেদিক তাকিয়ে চেয়ারে রাখা ভাইয়ার প্যান্ট থেকে তার বেল্টটা খুলে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। চিৎকার করে বললেন, সত্যি করে বল কেন এসেছিস? কী চুরি করতে এসেছিস?

কথা শেষ করার আগেই বেল্টটা দিয়ে আম্মু সমস্ত শরীরের শক্তি দিয়ে আমাকে মারলেন, মনে হলো আমার চামড়া কেটে বেল্টটা শরীরের ভেতর ঢুকে গেলো। যন্ত্রনায় আমি নিজের অজান্তেই কেঁদে উঠলাম।

আমাকে কাঁদতে দেখে আম্মু মনে হয় আরো খেপে উঠলেন, বেল্টটা দিয়ে আমাকে নির্মমভাবে আরো কয়েকবার মেরে বললেন, বল তুই কী করতে এসেছিস? বল জানোয়ারের বাচ্চা জানোয়ার।

আমার কান্না আর আম্মুর চিৎকার শুনে ভাইয়া তার বিছানা থেকে নেমে এসেছে, আপুও তার ঘর থেকে চলে এসেছে। দুলি খালাও বের হয়ে এসেছেন। সবাই নিঃশব্দে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, কেউ আমাকে বাঁচাতে এলো না। গরমের জন্যে আমার খালি গা, ময়লা খাটো একটা পায়জামা পরে আছি, ঠিকমতো গোসল করতে পারি না বলে গায়ে ময়লা, একমাথা ময়লা চুলে আমাকে নিশ্চয়ই দেখাচ্ছে হতচ্ছাড়া একজন মানুষের মতো। আমি জানি আমাকে দেখে কারো ভেতরে কোন মায়া হচ্ছে না, কোন করুণা হচ্ছে না। সবার ভিতরে এক ধরনের বিষ্ণা হচ্ছে, ঘেন্না হচ্ছে। একটা ঘেয়ো কুকুরকে যখন কেউ লাথি মারে, সেটা কেঁউ কেঁউ শব্দ করে পালিয়ে যায়, তখন সেই কুকুরটার জন্যে যেরকম মায়া হয় না, ঠিক সেরকম আমার জন্যেও কারো মায়া হচ্ছে না। আমার নিজেকে এতো ছোট, এতো জঘন্য মনে হতে লাগলো যে ইচ্ছে হলো মাটির তলায় ঢুকে যাই।

এক সময় আপু এগিয়ে এসে শুকনো গলা বলল, আম্মু তপু হয়তো আসলেই একটা কলমের জন্যে এসেছে। একটা কলম দিয়ে দাও। তারপর শুতে চলো। এতো চেঁচামেচি করলে তোমার শরীর খারাপ করবে।

আম্মু চিল্কার করে বললেন, তুই এই বদমাইশটার কথা বিশ্বাস করছিস? তুই জানিস এই বদমাইশটা একটা চোর? চুরি করতে এসেছে

আপু বলল, থাকুক আম্মু—

আম্মু বললেন, কেন থাকবে? একটা চোরকে আমি বাসায় পালব?

আপু কী বলবে বুঝতে পারল না, ঘুম ঘুম চোখে একটা হাই তুলে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিল। আম্মু বললেন, আমি লিখে দিতে পারি এই বদমাইশটার ঘর সার্চ করলে বের হবে এটা কী কী জিনিস চুরি করে।

আপু আবার বলল, থাকুক আম্মু।

আম্মু বললেন, তুই আমার কথা বিশ্বাস করলি না? আয় আমার সাথে। তারপর আমার চুল ধরে হিড়হিড় করে আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন আমার স্টোর রুমে। আমার ময়লা তোষকটা তার হাত দিয়ে ধরতে ঘেন্না হলো তাই পা দিয়ে সেটা ওল্টাতে শুরু করলেন। পালিয়ে যাবার জন্যে আমি অনেক দিন থেকে টাকা জমিয়ে যাচ্ছি–সত্যি কথা বলতে কী তার অনেকটুকু আমি আসলেই চুরি করেছি। কেউ যেন বুঝতে না পারে সেভাবে, অল্প অল্প করে। কখনো ভাইয়ার পকেট থেকে, কখনো আপুর ব্যাগ থেকে। বাসায় যখন কেউ নেই তখন ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে। এই সবগুলো টাকা আমি ঘরের কাগজে মুড়ে বিছানার নিচে লুকিয়ে রেখেছি, আম্মু পা দিয়ে সেটা বের করে ফেললেন। সাথে সাথে তার সারা মুখ আনন্দে চকচক করতে থাকে, ভাইয়া আর আপুকে ডেকে বললেন, দেখলি? দেখলি তোরা? আমি বলেছিলাম না এ চোর? দেখেছিস?

আপু আর ভাইয়া একবার টাকাগুলি দেখলো তারপর আমার দিকে তাকালো। আপু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ছিঃ! তপু। ছিঃ! আপুর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো আমি যেন এখনি মরে যাই।

আম্মু টাকাগুলো হাতে তুলে নিলেন, তারপর বেল্টটা হাতে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত মৃত্যু দেখতে পেলাম। আম্মু যখন আমার আমাকে মারতে শুরু করলেন আমি বৃথাই আমার হাত দিয়ে আমার মুখটা বাচাতে চেষ্টা করলাম।

দুলি খালা শেষ পর্যন্ত যদি আমাকে সরিয়ে না নিতেন তাহলে আম্মু মনে হয় সত্যিই শেষ পর্যন্ত আমাকে মেরে ফেলতেন। আমি প্রথমে কিছুক্ষণ চিৎকার করেছি, কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই আমি আর চিৎকার করতে পারছিলাম না। আমি মেঝেতে পড়ে গেলাম, গলা দিয়ে গোঙ্গানোর মতো এক ধরনের শব্দ বের হতে লাগলো। আপু আর ভাইয়া অনেকবার এই দৃশ্য দেখেছে তারা কাছাকাছি বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে রইল কিন্তু দুলি খালা একসময় আর সহ্য করতে পারল না, আম্মুকে ঠেলে একরকম জোর করে আমাকে সরিয়ে নিল।

 

পরদিন আমার সারা শরীর ফুলে গেলো। জায়গায় জায়গায় রক্ত নীল হয়ে জমে আছে। তার সাথে গা কাঁপিয়ে জ্বর। আমি আমার ময়লা তোষকের উপর গুটিশুটি মেরে শুয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। জ্বরের ঘোরে আমি বিচিত্র সব জিনিস স্বপ্নে দেখতে লাগলাম, কখনো দেখলাম আম্মু একটা বিশাল কিরিচ নিয়ে আমার দিকে ছুটে আসছেন, আম্মুর চুলে আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে আর আম্মু হা হা করে হাসছেন, তার মুখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। কখনো দেখলাম পাগলা কুকুর আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়ছে, আঁচড়ে-কামড়ে আমাকে ছিঁড়ে ফেলছে। আবার কখনো দেখলাম একটা বড় ত্রিভুজকে ঘিরে অনেকগুলো ছোট ত্রিভুজ, তাদের ঘিরে আরো অনেকগুলো ছোট ত্রিভুজ। সেগুলো কখনো বড় হচ্ছে কখনো ছোট হচ্ছে কখনো ঘুরছে কখনো নড়ছে, আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি এই ক্ষেত্রটির পরিসীমা বের করতে পারছি না, আর পারছি না বলে যন্ত্রণায় ছটফট করছি।

জ্বরের ঘোর থেকে মাঝে মাঝে আমি জেগে উঠেছি, জেগে উঠে আমি দেখেছি স্টোররুমের অন্ধকার কোনায় আমি শুয়ে আছি। আমার বুকটা খাঁ খাঁ করছিলো একটুখানি স্নেহের কথার জন্যে একটুখানি মমতার কথার জন্যে। শুধু মনে হচ্ছিল, আহা, কেউ যদি আমার কপালে হাত রেখে বলতো, তপু, এখন কেমন লাগছে তোমার? কিন্তু কেউ আমাকে সেটা বলল না, আমি একা একা শুয়ে রইলাম।

কেউ যে আমার কাছে এলো না সেটা সত্যি না। আমি যখন রাত্রিবেলা জ্বরের ঘোরে আধা অচেতন হয়ে পড়েছিলাম তখন হঠাৎ করে আমার হাতের মাঝে একটু সুড়সুড়ি অনুভব করলাম। চোখ খুলে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম নেংটি ইঁদুরটা আমার হাতটা শুকে সেখানে উঠে বসেছে। এক ধরনের কৌতূহল নিয়ে সে আমার দিকে তাকাচ্ছে। প্রতিরাত আমি তার জন্যে রুটির টুকরো এনে রেখেছি, আজ কিছু নেই–নেংটি ইঁদুরটা মনে হয় সেটা বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি চোখ খুলে ফিসফিস করে বললাম, মিচকি? তুই এসেছিস?

আমার স্পষ্ট মনে হলো নেংটি ইঁদুরটা মাথা নাড়ল। আমি বললাম, তোর জন্যে কোন খাবার আনতে পারি নি রে মিচকি! সরি। দেখছিস না আমার অবস্থা? আমার আম্মু মেরে আমাকে একেবারে ভর্তা বানিয়ে দিয়েছে।

আমার মনে হলো নেংটি ইঁদুরটা আমার কথা বুঝতে পারল। সেটা সম্মতির ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল। আমি বললাম, আজকে তুই নিজে নিজে কষ্ট করে কিছু একটা খেয়ে নে। কাল তোর জন্যে খাবার আনব। ঠিক আছে?

জ্বরের ঘোরে সবকিছু ওলটপালট হয়ে আছে, তাই আমার মনে হলো নেংটি ইঁদুরটা মাথা নাড়ল। আমি তখন অন্য হাত দিয়ে খুব আস্তে করে তার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলাম, আর কী আশ্চর্য সেটা অন্যদিনের মতো লাফিয়ে সরে গেলো না। আমি হাতটা নিচে রাখলাম তখন নেংটি ইঁদুরটা হাত থেকে নেমে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে গেল।

 

আমি স্কুলে গেলাম দুইদিন পর। সারা শরীরে আম্মুর বেল্ট দিয়ে মারের চিহ্ন, সেগুলো আমি শার্ট দিয়ে ঢেকে রেখেছি। শুধু বাম গাল থেকে গলা পর্যন্ত একটা দাগ ঢেকে রাখা যায় নি। সেটা নিয়ে আমি অবশ্যি খুব বেশি ভাবছি না। আমার আম্মু যে আমাকে এভাবে মারেন সেটা কেউ জানে না। সবাই ধরে নেয় আমি পথেঘাটে মারামারি করে নিজের এ অবস্থা করি।

স্কুলে আমাকে দেখে সবাই সরে গিয়ে জায়গা করে দিলো। আমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলো না, শুধু প্রিয়াংকা চোখ কপালে তুলে বললো, সে কী, তোর গালে কী হয়েছে?

আমি বললাম, কিছু না।

আমি বলতে চাইছি না দেখে প্রিয়াংকা আর কিছু জানতে চাইল না। বলল, তুই দুইদিন স্কুলে আসিস নি কেন?

আমি একটু অবাক হয়ে প্রিয়াংকার দিকে তাকালাম, আমি স্কুলে এসেছি কী আসি নাই কেউ সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে পারে সেটা আমার বিশ্বাস হয় না। আমি আমতা আমতা করে বললাম, শরীর খারাপ ছিল।

ও। প্রিয়াংকা হড়বড় করে বলল, তুই যা একটা ফাটাফাটি জিনিস মিস করেছিস!

কী জিনিস?

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কালকে আবার ক্লাসে এসেছিলেন।

সত্যি?

হ্যাঁ।

প্রিয়াংকা রহস্য করে বলল, বল দেখি কী নিয়ে কথা বলেছেন?

মুক্তিযুদ্ধ?

উঁহু। প্রিয়াংকা দাঁত বের করে হেসে বলল, হিন্দু-মুসলমান নিয়ে। এতো সুন্দর করে বলেছেন যে তুই শুনলে বেকুব হয়ে যেতি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

কী বলেছেন?

আমি কী আর ম্যাডামের মতো বলতে পারব? প্রিয়াংকা গম্ভীর হয়ে বলল, বলেছেন যে পৃথিবীটা সুন্দর তার বৈচিত্র্যের জন্যে। তাই যেখানে বৈচিত্র্য বেশি সেখানে সৌন্দর্য বেশি। যেখানে কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান কেউ বৌদ্ধ কেউ খ্রিস্টান এবং বাঙালি কেউ পাহাড়ি কেউ চাকমা কেউ সাঁওতাল এবং সবাই যখন মিলেমিশে থাকে আর একজন আরেকজনের বৈচিত্রটাকে উপভোগ করে সেটাই সবচেয়ে সুন্দর।

আমি বললাম, ও। প্রিয়াংকা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি ঠিক করে বলতে পারলাম না তাই তুই বলছিস ও! যদি ম্যাডামের কথা শুনতি তাহলে তোর চোখ ভিজে আসত।

আমি আবার বললাম, ও।

প্রিয়াংকা এবারে তার মুখটা আমার কাছাকাছি এসে ষড়যন্ত্রীর মতো করে বলল, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কেন হিন্দু-মুসলমান নিয়ে কথা বলছেন, বল দেখি?

আমি বললাম, কেন?

তোর জন্যে! তুই যে রাজাকার স্যারের কথা বলে দিয়েছিলি মনে আছে? ক্লাসে হিন্দু ছেলেমেয়েদের পেটাতেন–

আমি বললাম, ও।

প্রিয়াংকা বিরক্ত হয়ে বলল, তোর হয়েছেটা কী? তোকে যেটাই বলি তুই। বলিস, ও!

আমি একটু লজ্জা পেলাম, বললাম, না মানে ইয়ে—

তুই কী অন্য কিছু ভাবছিস?

আমি আসলে অন্য কিছু ভাবছিলাম না, প্রিয়াংকা কী বলছে সেটাই খুব মন দিয়ে শুনছিলাম, কিন্তু আমার সমস্যা হলো মানুষের সাথে কতা না বলতে বলতে আমি আজকাল আর ঠিক করে কারো সাথে কথা বলতে পারি না। কেউ কিছু বললে তার উত্তরে ও তাই নাকী আচ্ছা এই রকম কথাবার্তা ছাড়া আর কিছু বলতে পারি না। কিন্তু প্রিয়াংকাকে সেটা বলতে আমার লজ্জা করল, তাই বললাম, হ্যাঁ আসলে একটা জিনিস ভাবছিলাম তো–

কী জিনিস?

মানে–ইয়ে একটা অঙ্ক।

অঙ্ক? প্রিয়াংকা চোখ কপালে তুলে বলল, কী রকম অঙ্ক?

ইয়ে একটা সমবাহু ত্রিভুজের তিন বাহুর মাঝখানে যদি আরো তিনটা ছোট সমবাহু ত্রিভুজ আঁকা যায়–আমি প্রিয়াংকাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম সে ঠিক বুঝতে পারল বলে মনে হলো না। তখন খাতা বের করে পুরোটা এঁকে বললাম, এই যে ক্ষেত্রটা দেখছ এটা খুব বিচিত্র খুব একটা ক্ষেত্র।

কেন?

আমি যদি তোমাকে বলি একটা কলম দিয়ে এর পরিসীমাটা আঁকো তুমি পারবে না। পৃথিবীর সমস্ত কলম দিয়ে আঁকার চেষ্টা করলেও পারবে না, কারণ এর পরিসীমা হচ্ছে অসীম! ইনফিনিটি?

প্রিয়াংকা বলল, তাই নাকী?

হ্যাঁ।

কিন্তু তোমাকে যদি বলি এর ভেতরের ক্ষেত্রফলটা রং করে দাও তাহলে তুমি একটা কলম দিয়ে ঘষে ঘষে রং করে ফেলতে পারবে! ক্ষেত্রফল হচ্ছে সসীম কিন্তু পরিধি হচ্ছে অসীম–কী অদ্ভুত দেখেছ?

বিষয়টা যে খুব অদ্ভুত সেটা প্রিয়াংকা প্রথমে ঠিক বুঝতে পারে নি। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে তাকে বোঝাতে হলো। যখন সত্যি সত্যি বুঝতে পারল তখন সে এতো অবাক হলো বলার মতো নয়। একটু পরে পরে বলতে লাগলো, এটা কেমন করে সম্ভব? এটা কেমন করে সম্ভব?

আমি বললাম, খুব সম্ভব। তুমি নিজেই দেখছ।

প্রিয়াংকা খানিকক্ষণ আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, তোর অঙ্ক করতে খুব ভাল লাগে?

আমি ইতস্তত করে বললাম, তা তো জানি না।

তুই বড় হয়ে গণিতবিদ হবি?

আমি হেসে ফেললাম, বললাম, ধুর!

প্রিয়াংকা ভাবল আমি বিনয় করছি, কিন্তু আমি যে দুই একদিনের মাঝে বাসা থেকে সারা জীবনের মতো পালিয়ে যাব কেউ আর আমার খোঁজ পাবে না সেটা আর বললাম না। বড় জোর একটা বেদে হয়ে পথেঘাটে সাপের খেলা দেখাব। আমার জীবনে এর থেকে বেশি আর কী হতে পারে? আমি জানি আমার কপালে এটা সিল মেরে লিখে দেওয়া আছে।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল