০৩. প্রিন্সিপাল ম্যাডাম

আমি বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়াটা কয়েক দিনের জন্যে পিছিয়ে দিলাম। কেন। ঠিক পিছিয়ে দিলাম নিজেই জানি না, নিজেকে নিজে বোঝালাম যে বাসা থেকে সত্যি সত্যি পালিয়ে যাবার আগে আমার অন্তত একবার আম্মু, আপু আর ভাইয়ার সাথে শেষবার দেখা করে যাওয়া দরকার। সেটা অবশ্যি সত্যি কারণ হতে পারে না, আমাকে দেখলেই আম্মু যেভাবে খেপে যান যে দেখা না হওয়াই ভাল। আপু আর ভাইয়ার সাথে দেখা হলে তারা এতো অপ্রস্তুত হয়ে যায় যে কোথায় গিয়ে লুকাবে বুঝতে পারে না। তাই তাদের সাথে দেখা করে যাওয়াটাও আসল কারণ হতে পারে না। আমার ধারণা আসল কারণটা হচ্ছে প্রিয়াংকা, এই মেয়েটা একটু খ্যাপা টাইপের। মনে হচ্ছে ক্লাসে আরো কিছু অঘটন ঘটাবে, ঠিক কী অঘটন কীভাবে ঘটাবে সেটা দেখার একটা কৌতূহল হচ্ছে। তার ওপর রাজাকার স্যারকে যেভাবে হুমকি দিয়ে এসেছি সেটা নিয়ে স্কুলে একটু হৈচৈ হতে পারে, ব্যাপারটা কোন দিকে গড়ায় সেটা না দেখে পালিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না।

ডাইনিং টেবিলে বসে যখন আম্মু আপু আর ভাইয়া খেতে খেতে গল্প করে আমি তখন স্টোররুমে আমার বিছানাটায় গুটিশুটি মেরে বসে থাকি। তাদের কথাবার্তা পুরোটুকু শোনা যায় না, একটা দুটি কথা হঠাৎ মনে হয় ছিটকে ছিটকে আসে। আমি মাঝে মাঝে কান পেতে শোনার চেষ্টা করি তারা কী নিয়ে কথা বলে। আজকে মনে হচ্ছে তারা টেলিভিশনের কোন একটা নাটক নিয়ে কথা বলছে–আমার কাছে এসব কত দূরের একটা বিষয়। নাটকের কোন একটা চরিত্রের কথা বলে তিনজন হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল। তাদের হাসির শব্দ শুনে মনে হলো সেটা বুঝি অন্য কোন জগৎ থেকে ভেসে আসছে! শুনতে শুনতে আমার বুক ভেঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। আমি দুই হাতে নিজের কান চেপে ধরে বসে থাকি, সবকিছু ভুলে মাথাটা ফাকা করে দেবার চেষ্টা করতে থাকি। আগে হলে কোন একটা বই খুলে কিছু একটা পড়ার চেষ্টা করতাম, বাসা থেকে পালিয়ে যাব ঠিক করার পর সেটাও ছেড়ে দিয়েছি। বনে জঙ্গলে, নদীর তীরে হাঁটতে হাঁটতেই যখন জীবনটা কাটিয়ে দেব তখন শুধু শুধু পড়াশোনা করে সময় নষ্ট করে কী হবে?

ঠিক যখন রাত দশটার ঘণ্টা বাজলো তখন স্টোররুমের দরজার পিছন থেকে ছোট একটা নেংটি ইঁদুর খুব সাবধানে মাথা বের করল। নেংটি ইঁদুরের সময়ের জ্ঞান যে এতো ভাল আমি কখনো জানতাম না। গত কয়েক দিন থেকে লক্ষ্য করছি ঠিক দশটার সময় এই নেংটি ইঁদুরটা স্টোররুমের দরজার পিছন থেকে উঁকি দেয়। প্রথম কয়েক দিন আমাকে দেখেই লাফ দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, এখন আমাকে দেখে একটু অভ্যস্ত হয়েছে। নেংটি ইঁদুরের প্রিয় খাবার কী কে জানে–আমি রুটির কয়েকটা টুকরো ছড়িয়ে রেখেছিলাম, গত কয়েক দিন থেকে দেখছি টুকরোগুলো দুই হাতে ধরে কুট কুট করে খাচ্ছে। নেংটি ইঁদুরের খাওয়ার ভঙ্গিটা ভারি সুন্দর, দেখে আমার এতো মজা লাগে যে বলার মতো নয়। আমার হাতে ছোট এক টুকরো রুটি ছিল, সেটা এগিয়ে দিলাম, নেংটি ইঁদুরটা একটা ছোট লাফ দিয়ে সরে গেলো। দূর থেকে আমাকে সাবধানে লক্ষ্য করল, তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে রুটির টুকরোটা মুখে করে একটু দূরে টেনে নিয়ে গেল। আমার দিকে সাবধানে তাকিয়ে সে দুই হাতে টুকরোটা ধরে কুটুর কুটুর করে খেতে শুরু করে। আমি ফিসফিস করে নেংটি ইঁদুরটাকে ডাকলাম, এই! এই পিচকি। এই মিচকি!

নেংটি ইঁদুরটা আমার ডাক শুনে খুব যে উৎসাহিত হলো সেরকম মনে হলো না, সাবধানে রুটির টুকরোটা নিয়ে আরেকটু দূরে সরে গেলো। আমি আরেকটু গলা উঁচিয়ে ডাকলাম, মিচকি। এই মিচকি।

নেংটি ইঁদুরটা এবার একটু ভড়কে গিয়ে তার রুটির টুকরোটা ফেলে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে গেল। আমি অবশ্যি খুব হতাশ হলাম না, কারণ আমি জানি আগামীকাল রাত দশটার সময় সে আবার এসে হাজির হবে। আবার ইতিউতি তাকিয়ে আমার আরেকটু কাছে আসবে। এই বাসায় আমার একমাত্র বন্ধু এই নেংটি ইঁদুর, ব্যাপারটার মাঝে কোথায় জানি একটু দুঃখের চিহ্ন আছে।

 

পরের দিন ক্লাসে গিয়ে আমি মনে মনে আশা করছিলাম যে প্রিয়াংকা আজকেও আমার পাশে বসবে। কিন্তু দেখলাম সে আজকে অন্য পাশে বসেছে। আজকেও তার মুখে এক ধরনের হাসি, চারিদিকে দেখতে দেখতে পা দোলাচ্ছে, দেখে। মনে হয় পুরো ক্লাসটা যেন একটা নাটকের দৃশ্য, সে যেন একজন দর্শক এবং যেন খুব আগ্রহ নিয়ে নাটকটা দেখছে। আমি আমার সিটে বসলাম, অন্যদিন হলে ক্লাস রুমে থেকে বের হয়ে বাউন্ডারি ওয়ালে পা ঝুলিয়ে বসতাম। আজ আর বের হলাম না, প্রিয়াংকা যেরকম আগ্রহ নিয়ে পুরো ক্লাসকে দেখে আমিও অনেকটা সেভাবে দেখতে শুরু করলাম।

ব্যাপারটি মন্দ না, যেমন ধরা যাক ইশতিয়াকের ব্যাপারটা। সে যে এতো মনোযোগ দিয়ে কেনে আঙুল দিয়ে কান চুলকাতে পারে আমি সেটা জানতাম না। তাকে দেখে মনে হয় চুলকাতে চুলকাতে কানের মাঝে গর্ত করে ফেলবে। আদনান পকেট থেকে কী একটা বের করে মুখে দিয়ে খাচ্ছে, খুব সতর্কভাবে খাচ্ছে যেন কেউ বুঝতে না পারে। বুঝতে পারলে যদি ভাগ দিতে হয় সেজন্যে এরকম সাবধান। নাঈমা নামের ফর্সা মেয়েটা নিজের চেহারা নিয়ে নিশ্চয়ই খুব সচেতন, ব্যাগ থেকে ছোট একটা আয়না বের করে নিজেকে দেখে চুলগুলো একটু সামনে নিয়ে এসে আবার আয়নাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল। মুশফিক আর জহুরুল গল্প করছে, কি নিয়ে গল্প করছে শোনা যাচ্ছে না কিন্তু বিষয়টা নিশ্চয়ই খুব মজার। দুইজনে দাত বের করে হি হি করে হাসছে! মানুষকে হাসতে দেখা খুব মজার একটা বিষয়, তাদেরকে দেখে আমারও হাসি পেয়ে গেলো!

আমাদের ক্লাসের দুই ভাল ছাত্র জয়ন্ত আর মামুন নিশ্চয়ই কোন জ্ঞানের বিষয় নিয়ে কথা বলছে কারণ দুইজনের চোখে-মুখেই এক ধরনের গম্ভীর ভাব। তারা কথা বলতে বলতে আমার কাছাকাছি চলে এলো বলে জ্ঞানের বিষয়টা আমিও শুনতে পেলাম, জয়ন্ত বলছে, বল দেখি কোন সংখ্যাকে যতবার সেটা দিয়ে গুণ করা হোক প্রথম সংখ্যা সেটাই হয়?

এই সহজ বিষয়টা নিয়ে দুইজন এরকম গম্ভীর হয়ে কথা বলছে দেখে আমার হাসি পেয়ে গেল! এরকম সংখ্যা দুটি হচ্ছে পাঁচ আর ছয়। মামুন দেখলাম কয়েকবার মাথা চুলকে চিন্তাভাবনা করে বলল, পাঁচ।

জয়ন্ত বলল, আরো একটা আছে।

মামুন আবার মাথা চুলকাতে শুরু করল। একটু চিন্তা করে বলল, ছয়।

জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। এবার বল দেখি দুই অংকের কোন সংখ্যাকে যতবার নিজের সাথে গুণ করা যায় ততবার প্রথমে সেই সংখ্যাটা পাওয়া যায়?

মামুনকে আবার একটু বিভ্রান্ত দেখায়। ভুরু কুঁচকে চিন্তা করতে শুরু করে। মামুন সবসময় পরীক্ষায় ফাস্ট-সেকেন্ড হয়, অথচ এরকম সহজ একটা জিনিস চিন্তা করে বের করতে তার এতোক্ষণ লাগে? যে কেউ বলতে পারবে, সংখ্যাটা হচ্ছে পঁচিশ!

মামুন বলল, দাড়া ক্যালকুলেটরটা নিয়ে আসি।

জয়ন্ত বলল, উঁহুঁ ক্যালকুলেটর দিয়ে করলে হবে না। এমনি এমনি বের করতে হবে।

মামুন বলল, এতগুলো গুণ করব? একশটার মতো।

আমার আবার হাসি পেলো, শুধু নামেই ফাস্ট-সেকেন্ড আসলে মাথায় কিছু নেই। বোঝাই যাচ্ছে সংখ্যার প্রথম অংকটা হবে পাঁচ না হয় ছয়। শুধু সেই সংখ্যাগুলো পরীক্ষা করতে হয়। যেমন পনেরো, পঁচিশ, পঁয়ত্রিশ কিংবা ষোল, ছাব্বিশ, ছত্রিশ। কতোক্ষণ আর লাগবে?

মামুন এবারে একটা কাগজ নিয়ে গুণ করতে শুরু করল, কী আশ্চর্য! এই সংখ্যাগুলো গুণ করতে কাগজ-কলম লাগে? মাথার ভিতরেই তো করে ফেলা যায়। পঁচিশ পঁচিশে ছয়শ পঁচিশ, পঁয়ত্রিশ পয়ত্রিশে বারোশ পঁচিশ, পঁয়তাল্লিশ পঁয়তাল্লিশে দুই হাজার পঁচিশ।

মামুন অনেক সময় লাগিয়ে সবগুলো গুণ করে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, পঁচিশ।

জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, গুড।

তারপর দুজন হেঁটে চলে গেলো। দুই অংকের আরেকটা সংখ্যা হচ্ছে ছিয়াত্তর, এই দুজন সেটা মনে হয় জানেই না। আমার একবার ইচ্ছে হলো জয়ন্ত আর মামুনকে ডেকে সেটা বলি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু বললাম না। এরা। হচ্ছে ক্লাসের ভাল ছেলে তারা জ্ঞানের কথাবার্তা বলে, আমি হচ্ছি ক্লাসের খারাপ ছেলে আমিও যদি তাদের সাথে জ্ঞানের কথাবার্তায় যোগ দিই তাহলে তারা ভড়কে যেতে পারে।

জয়ন্ত আর মামুন চলে যাবার পর আমি হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম দুই অংকের সংখ্যা পঁচিশ এবং ছিয়াত্তরের মতো তিন অংকেরও দুটি সংখ্যা আছে সেগুলো হচ্ছে তিনশ ছিয়াত্তর আর ছয়শ পঁচিশ। শুধু তাই না চার অংকেরও একটা সংখ্যা আছে সেটা হচ্ছে নয় হাজার তিনশ ছিয়াত্তর। এর চাইতে বড় সংখ্যাও আছে আমি সেটা ভেবে বের করতে যাচ্ছিলাম তখন হঠাৎ আমার একটা অন্য জিনিস মনে হলো। জয়ন্ত আর মামুন দুইজন হচ্ছে আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে ভাল ছাত্র, তাদের এই সহজ জিনিসগুলো বের করতে এতো সমস্যা হচ্ছে কেন? নাকি উল্টোটা সত্যি, যে জিনিসগুলো এতো সহজ নয়, কোন কারণে আমার কাছে সহজ মনে হচ্ছে? বিষয়টা কীভাবে পরীক্ষা করা যায়? কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারলে হতো, কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করব? আমার একমাত্র বন্ধু হচ্ছে বাসায় সেই নেংটি ইঁদুরটি। সে আসবে রাত দশটায়, তাকে যদি জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা মিচকি, বল দেখি কোন সংখ্যাকে সেই সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে প্রথমে সেই সংখ্যাটা পাওয়া যায়? তখন সে কী করবে? বিষয়টা চিন্তা করেই আমার একটু হাসি পেয়ে গেলো।

আমি ক্লাসে বহুকাল কোন কিছুতেই মনোযোগ দিই না, আজকে জ্যামিতি ক্লাসে একটু মনোযোগ দিয়ে স্যারের কথা শোনার চেষ্টা করলাম এবং অবাক হয়ে লক্ষ করলাম স্যার ক্লাসে রীতিমতো হাস্যকর জিনিস পড়াচ্ছেন। অনেক কষ্ট করে একটা উপপাদ্য প্রমাণ করলেন যেটা অনেক সহজেই অন্যভাবে প্রমাণ করা সম্ভব কিন্তু আমি সেটা বলার চেষ্টা করলাম না। আমি অনেক দিন পর আমাদের গণিত বইটা উল্টেপাল্টে দেখলাম, ভিতরের বিষয়বস্তু আশ্চর্য রকম সহজ। আমি আবার একটা ধন্ধের মাঝে পড়ে গেলাম–বিষয়টা আসলেই সহজ নাকী আমার কাছে সহজ মনে হচ্ছে?

 

দুপুর বেলা ইংরেজি ক্লাস হচ্ছে তখন স্কুলের দপ্তরি কালীপদ ইংরেজি স্যারের কাছে একটা চিরকুট নিয়ে এলো। স্যার চিরকুট পড়ে ভুরু কুঁচকালেন, আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আরিফুল ইসলাম তপু আর প্রিয়াংকা চৌধুরী কে?

ক্লাসের দুই পাশ থেকে আমি আর প্রিয়াংকা উঠে দাঁড়ালাম। স্যার খানিকক্ষণ আমাদের দুজনকে একটু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন তারপর বললেন, তোমাদের দুইজনকে প্রিন্সিপাল ডেকে পাঠিয়েছেন।

সারা ক্লাসে আতংকের একটা ফিসফিসানি শোনা গেলো। আমাদের স্কুলের আগের প্রিন্সিপাল ছিলেন খুব হাসিখুশি মানুষ। মাসখানেক হলো নতুন প্রিন্সিপাল এসেছেন, তিনি মহিলা এবং কমবয়সী। তার চেহারা খুব সুন্দর কিন্তু সেটা যেন কেউ বুঝতে না পারে সেজন্যে একেবারে সাজগোজ করেন না। বুড়ো মানুষের একটা চশমা পরে থাকেন এবং সব সময় মুখটা পাথরের মতো। শক্ত করে রাখেন। আমরা শুনেছি এই ম্যাডাম নাকী অসম্ভব কড়া, আমাদের পুরো স্কুলটাকে এক মাসের মাঝে একেবারে ধনুকের ছিলার মতো সোজা করে ফেলেছেন! সেই প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমাদের দুজনকে ডেকে পাঠিয়েছেন সেটা একটা ভয়ের ব্যাপার হতেই পারে।

ইংরেজি স্যার বললেন, যাও দেখা করতে যাও।

আমি আর প্রিয়াংকা দপ্তরি কালীপদের সাথে ক্লাস রুম থেকে বের হলাম। প্রিয়াংকা গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ব্যাপার কী তপু? আমাদের ডেকেছে কেন?

রাজাকার স্যার নিশ্চয়ই নালিশ করেছে।

কী স্যার?

রাজাকার স্যার। আমি ব্যাখ্যা করলাম, বাংলা স্যারের নাম হচ্ছে। রাজাকার স্যার।

কেন?

কয়দিন থাকলেই বুঝতে পারবে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় নাকী রগ কাটতেন।

শুনে প্রিয়াংকা কেমন যেন চমকে উঠল। আমার দিকে এমন ভাবে তাকালো যে আমি বুঝতে পারলাম সে আমার কথা বিশ্বাস করে নাই। না করলে নাই–কয়দিন গেলে নিজেই বুঝতে পারবে।

প্রিন্সিপাল ম্যাডামের রুমে গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমার ধারণা সত্যি। রাজাকার স্যার প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সামনে একটা চেয়ারে বসে আছেন। কালীপদ বলল, আপা এই যে, এই দুইজন।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কী একটা কাগজ দেখছিলেন, সেটা সরিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। তার চোখের দৃষ্টি খুব পরিষ্কার, মুখে কিছু না বললেও চোখ দিয়ে বলছেন, তোমাদের মতো পাজী নচ্ছাড় বেয়াদব ছেলে-মেয়ে আমি অনেকবার দেখেছি, আগে আমি তাদের সিধে করে ছেড়ে দিয়েছি, তোমাদেরকেও সিধে করে ছাড়ব।

আমি আর প্রিয়াংকা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। বড় একটা টেবিল ঘিরে বেশ কয়েকটা চেয়ার। ভারি পর্দা, দেয়ালের সাথে লাগানো বেশ কয়েকটা শেলফ, সেগুলো বোঝাই বই দিয়ে। এক পাশে একটা আলমারি, সেখানে স্কুলের ছেলেমেয়েরা স্পোর্টস, ডিবেট, ছবি আঁকার কম্পিটিশান এসব করে যেসব কাপ, শিল্ড আর মেডেল এনেছে সেগুলি সাজানো আছে। আমি খারাপ হয়ে যাবার আগে যখন খুব ভাল ছিলাম তখন ডিবেট করে বড় একটা কাপ এনেছিলাম। সেই কাপটাও নিশ্চয়ই এখানে কোথাও আছে।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একবার আমার দিকে আরেকবার প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, তোমাদের বিরুদ্ধে আমি যেটা শুনছি সেটা সত্যি?

আমি কিছু বললাম না, শুধু উদাস মুখে শরীরের ভরটা এক পা থেকে অন্য পায়ের উপর সরিয়ে নিলাম। প্রিয়াংকা খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে, সে বলল, আপনি কী শুনেছেন সেটা জানলে বলতে পারতাম ম্যাডাম।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম রাজাকার স্যারকে দেখিয়ে বললেন, তোমাদের এই স্যার বলেছেন, তোমরা তার সাথে খুব বড় বেয়াদবি করেছ।

প্রিয়াংকা ম্যাডামের কথা শুনে একটুও ঘাবড়াল না, বেশ হাসি হাসি মুখে বলল, স্যার যদি বলে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই সেটা সত্যি। স্যারের কাছে নিশ্চয়ই মনে হয়েছে আমরা বেয়াদবি করে ফেলেছি। কিন্তু ম্যাডাম-

কিন্তু কী?

আমরা একটুও বেয়াদবি করতে চাইনি ম্যাডাম।

করতে না চাইলে সেটা কেমন করে হয়?।

রাজাকার স্যার হঠাৎ করে সোজা হয়ে বসে বললেন, আমি আপনাকে বলি কী হয়েছে। এই যে মেয়েটাকে দেখছেন, এ নতুন এসেছে। কোন স্কুল। থেকে এসেছে জানি না। ডিসিপ্লিনের খুব অভাব–ক্লাসে ঢুকেই দেখি পিছনের বেঞ্চে বসে কথা বলছে। আমি বললাম, সামনে এসে বসো। সে বলল বসবে না। কতো বড় বেয়াদব শুধু যে সামনে এসে বসল না তা না, আমার সাথে মুখে মুখে তর্ক জুড়ে দিল।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম শীতল চোখে প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কিছু বলার আছে মেয়ে?

প্রিয়াংকা একটু চোখ বড় বড় করে একবার প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একবার রাজাকার স্যারের দিকে তাকাচ্ছিল, এক মুহূর্তের জন্যে একবার আমার দিকেও তাকালো। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এবার ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলেন, আছে কিছু বলার?

প্রিয়াংকা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে, ভাল ফুটবল খেলা বা ভাল গান গাইতে পারার মতো এটাও নিশ্চয়ই একটা বড় গুণ। আমি শুনলাম প্রিয়াংকা বলল, জি ম্যাডাম, আমার কিছু বলার তো নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু আমার মনে হয় কিছু না বলাটাই সবচেয়ে ভাল হবে।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ভুরু কুঁচকে বললেন, কেন? না বলাটা কেন ভাল হবে?

যদি আমি কিছু বলি সেটা অন্যরকম শুনাবে। মনে হবে, মনে হবে—

কী মনে হবে?

মনে হবে স্যার যে কথাটা বলছেন আমি সেটা অস্বীকার করছি।

রাজাকার স্যার এবারে কেমন যেন খেপে গেলেন, প্রায় টেবিলে থাবা দিয়ে বললেন, দেখেছেন? দেখেছেন কতো বড় বেয়াদব? বলার চেষ্টা করছে আমি মিথ্যা কথা বলছি-

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম হাত তুলে রাজাকার স্যারকে থামালেন। তারপর আমার দিকে ঘুরে তাকালেন, বললেন, আর তুমি? তুমি কী করেছ?

আমি কিছু না বলে দাড়িয়ে রইলাম। রাজাকার স্যার বললেন, এর কথা ছেড়ে দেন ম্যাডাম। একে যদি এখনই টি.সি. দিয়ে স্কুল থেকে বিদায় না করেন তাহলে কিন্তু স্কুলের বেইজ্জতি হয়ে যাবে।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ভুরু কুঁচকে রাজাকার স্যারের দিকে তাকালেন, কেন?

আর কয়দিন পরে এই ছেলে মানুষ মার্ডার করবে। এর চেহারাটা একবার দেখেন। এর কতো বড় সাহস, ক্লাসে আমাকে থ্রেট করে।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমার দিকে ভাল করে তাকালেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি?

আমি এবারেও কিছু না বলে দাড়িয়ে রইলাম। কথা না বলতে বলতে আমি ঠিক করে কথা বলতেই ভুলে গেছি। মুখ খুলে কিছু একটা বলতে গেলেই উল্টাপাল্টা কিছু একটা বলে ফেলব তখন আরো বড় ঝামেলা হয়ে যাবে। এর থেকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকাই ভাল।

রাজাকার স্যার থামলেন না, বললেন, আপনি নতুন এসেছেন তাই আপনি জানেন না। এ একসময়ে খুব ভাল ছাত্র ছিল। তারপর হঠাৎ করে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বদমাইশ হয়ে গেলো–এখন পরীক্ষায় পাস করতে পারে না। দিনরাত রাস্তাঘাটে মারামারি করে। রীতিমতো গুণ্ডা। সন্ত্রাসী।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আবার আমার দিকে তাকালেন, খানিকক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি?

আমি এবারেও কিছু বললাম না। এই পৃথিবীতে বিচার বলে যে কিছু নেই সেটা আমার থেকে ভাল করে কেউ জানে না, কাজেই প্রিন্সিপাল ম্যাডাম যে রাজাকার স্যারের কথা বিশ্বাস করে আমাকে টি.সি, দিয়ে বিদায় করে দেবেন সে ব্যাপারে আমার একটুও সন্দেহ নাই। তবে এখন তাতে আর কিছু আসে যায় না, আমি বাসা থেকে যখন পালিয়েই যাব তখন টি.সি. নিয়ে আর না নিয়ে পালিয়ে যাবার মাঝে পার্থক্য কী?

রাজাকার স্যার বললেন, এক ঝুড়ি আপেলের মাঝে একটা পচা আপেল থাকলে সব আপেল পচে যায়। এ হচ্ছে পচা আপেল, একে যদি এখনই বিদায় করেন পুরো ক্লাসকে কিন্তু নষ্ট করে দেবে।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমার দিকে তাকালেন, তোমার কিছু বলার আছে?

আমার অনেক কিছুই বলার আছে কিন্তু আমি তো গুছিয়ে কথা বলতে পারব না। তবে সারা জীবনের জন্যে যখন চলেই যাচ্ছি তখন যা খুশি বলে দিলে ক্ষতি কী? আর কেউ তো কখনো এটা করতে পারবে না। আমি প্রিন্সিপাল ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বললাম, জি ম্যাডাম। বলার আছে।

কী বলার আছে?

আমাকে যদি বের করতেই হয় তাহলে ঐ স্যারকেও বের করে দিতে হবে।

কথাটা আমি ভেবে বলি নাই, বলে ফেলার পর কথাটা শুনে আমি নিজেই চমকে উঠলাম, বলেছি কী আমি? কিন্তু বলে যখন ফেলেছিই এটা তো আর ফিরিয়ে নেয়ার উপায় নেই। রাজাকার স্যারের চোয়ালটা কেমন যেন ঝুলে পড়ল, মাছের মতো খাবি খেলেন কয়েকবার। প্রিয়াংকা বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যে মনে হলো আমার কথা বুঝতে পারছেন না। খুব ধীরে ধীরে তার মুখটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলো, শোনা যায় না এরকম গলায় আস্তে আস্তে বললেন, ছেলে, তোমার তো সাহস কম না, তুমি আমার সামনে দাড়িয়ে তোমার স্যারের সম্পর্কে এরকম একটা কথা বলো?

প্রিয়াংকা আমার জায়গায় হলে নিশ্চয়ই কী চমৎকার একটা উত্তর দিতে পারতো, আমি কিছুই বলতে পারলাম না। কী বলা যায় সেটা চিন্তা করতে করতে আবার নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম, আমি যদি পচা আপেল হই তাহলে স্যারও পচা আপেল।

আমার কথা শুনে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের চোখগুলো বড় বড় হয়ে উঠল। ম্যাডাম তার চশমাটা খুলে টেবিলে রেখে বললেন, ছেলে, তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে?

আমি মাথা নাড়লাম, না।

তাহলে?

আমি চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, তুমি এভাবে কথা বলছ কেন?

রাজাকার স্যার আমার জন্যে উত্তরটা দিয়ে দিলেন, বললেন, এই পাজী ছেলেটা এইভাবেই কথা বলে। এর মতো বেয়াদব ছেলে স্কুলে আর একটাও নাই।

আমি রাজাকার স্যারের দিকে না তাকিয়ে প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে বললাম, ম্যাডাম, আমাকে তো স্কুল থেকে তাড়িয়েই দিবেন, তাই যাওয়ার আগে আপনাকে সত্যি কথাটা বলে যাই।

রাজাকার স্যার চিৎকার করে বললেন, চোপ। চোপ বেয়াদব ছেলে-

আমি তখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছি, আরও গলা উঁচিয়ে বললাম, এই স্যার ক্লাসে কখনো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন কবিতা পড়ান না। এই স্যার মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে ক্লাসে টিটকারি মারেন। এই স্যার হিন্দু ছাত্রদের পিটান

রাজাকার স্যারের মুখটা ভয়ংকর রাগে কেমন যেন বিকৃত হয়ে গেল, ঘরে আর কেউ না থাকলে একেবারে নিশ্চয়ই আমাকে খুন করে ফেলতেন। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কেমন যেন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, বললেন, তুমি কী বলছ ছেলে?

আমি সোজাসুজি প্রিন্সিপাল ম্যাডামের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি সত্যি কথা বলছি।

রাজাকার স্যার হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে বললেন, আপনি আমার সাথে আসেন ম্যাডাম। ক্লাসে গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এক ধরনের অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর ঘুরে রাজাকার স্যারের দিকে তাকালেন, বললেন, তার কোন প্রয়োজন নেই সরকার সাহেব।

তাহলে, তাহলে–

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এক ধরনের ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমি ব্যাপারটা দেখছি। আপনি এখন আসুন।

রাজাকার স্যার হঠাৎ করে কেমন জানি চুপসে গেলেন। দাড়িয়ে থেকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন, ঠিক বলতে পারলেন না, একবার আমার মুখের দিকে তাকালেন তারপর বের হয়ে গেলেন।

আমি আর প্রিয়াংকা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম অন্যমনস্কভাবে টেবিলে আঙুল দিয়ে শব্দ করতে করতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। তাকে দেখে মনে হতে লাগলো যেন ভুলেই গেছেন আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি।

আমরা কী করব বুঝতে পারছিলাম না তখন ম্যাডাম আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা ক্লাসে যাও।

আমি আর প্রিয়াংকা প্রিন্সিপাল ম্যাডামের অফিস থেকে বের হয়ে এলাম।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল