কোন কিছু বোঝার আগেই তপুর জীবনটা হঠাৎ করে পালটে গেলো চিরদিনের মতোই। দেখতে দেখতে তার আপনজনেরা দূরে সরে যেতে থাকে, এক সময় তপু আবিষ্কার করে সে একা। একেবারেই একা।

নিঃসঙ্গ কিশোরের এই দুঃসহ জীবনে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিল তার বিচিত্র সব সঙ্গী সাথী। তাদের নিয়ে সে কী পাড়ি দিতে পারবে তার বান্ধবহীন নিষ্ঠুর এই জীবন?

আমি তপু নিঃসঙ্গ এক কিশোরের বেঁচে থাকার ইতিহাস। নিষ্ঠুরতার ইতিহাস এবং ভালবাসার ইতিহাস।

 

০১. একা একা

আমার নাম তপু। ভাল নাম আরিফুল ইসলাম। আমি বি.কে. সরকারি হাই স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ি। আমাদের ক্লাসে এখন আটচল্লিশজন ছেলে-মেয়ে, তার মাঝে আমার রোল নম্বর পঁয়তাল্লিশ। আমি বেশি লম্বা-চওড়া না, মোটামুটি ছোটখাটো সাইজ। আমার বয়স তেরো কিন্তু নিজের কাছে মনে হয় আমার বয়স বুঝি চল্লিশের কাছাকাছি। আমি জানি কেউ আমার কথা শুনলে একটুও বিশ্বাস করবে না, বলবে, ক্লাস এইটে পড়ে একটা ছেলের কাছে খামোখা। নিজের বয়স চল্লিশ মনে হবে কেন? কিন্তু কথাটা সত্যি আমি একটুও বাড়িয়ে বলি নাই। আমার আব্বু যখন গাড়ি একসিডেন্টে মারা গেলেন তখন আমার বয়স ছিল দশ, আমি তখন পড়ি ক্লাস ফাইভে। তারপর তিন বৎসর পর হয়েছে, এই তিন বৎসরে আমি তিন ক্লাস ওপরে উঠেছি। কিন্তু আব্বু মারা যাবার পর প্রত্যেকটা বৎসর আমার কাছে মনে হয়েছে দশ বৎসরের মতো লম্বা একজন মানুষের দশ বৎসরে যে অভিজ্ঞতা হবার কথা আমার এক বৎসরেই সেই অভিজ্ঞতা হওয়া শুরু করল। তাই আমার সব সময় মনে হয় গত তিন বৎসরে আমার বয়স বেড়েছে তিরিশ বৎসর। সেই জন্যে বলছিলাম সব সময় আমার মনে হয় আমার বয়স প্রায় চল্লিশ। একজন চল্লিশ বছর বয়সের মানুষ যেভাবে চিন্তা করে আমিও মনে হয় সেইভাবে চিন্তা করি অনেকটা বুড়ো মানুষের মত। আমি যখন আসলেই বুড়ো হব তখন কী হবে কে জানে, তবে আমার মনে হয় সত্যি সত্যি বুড়ো হবার অনেক আগেই আমি মরে যাব।

কেন আমি এতো তাড়াতাড়ি বুড়ো মানুষের মতো হয়ে গেছি সেটা খুব বেশি মানুষ জানে না। যারা আমাকে বাইরে থেকে দেখে তাদের ধারণা আমার আব্বু মারা যাবার পর আমি বখে গিয়েছি। সেটা তারা ভাবতেই পারে, আমি তাদের একটুও দোষ দিই না। আগে আমি পড়াশোনায় অসম্ভব ভাল ছিলাম, শুধু যে পরীক্ষায়, ফার্স্ট হতাম তাই না, যে সেকেন্ড হতো সে কখনো আমার ধারেকাছে আসতে পারত না। এখন আমার পরীক্ষায় পাস করা নিয়েই ঝামেলা—আটচল্লিশজন ছেলেমেয়ের মাঝে কোনমতে টেনেটুনে আমি হয়েছি পঁয়তাল্লিশ নম্বর। আমার ধারণা সামনের বছর আমি পঁয়তাল্লিশ নম্বরও হতে পারব না, ক্লাস এইটেই আটকা পড়ে যাব। অঙ্ক ছাড়া আর কোন বিষয়ে আমি পাস করতে পারব না। আমি যে শুধু পড়াশোনাতে খারাপ হয়েছি তা না, আমার আচার-ব্যবহার স্বভাব-চরিত্র সবকিছু খারাপ হয়ে গেছে। আমি কারো সাথে ভাল করে কথা বলি না, খুব সহজে অন্যদের গালাগালি করতে পারি–ভয়ংকর ভয়ংকর খারাপ গালি আমি শিখে গেছি। শুধু যে গালাগালি করতে পারি তা না, মারামারিও করতে পারি। আমার গায়ে যে খুব জোর তা না–কিন্তু মারামারি করার জন্যে আসলে বেশি গায়ের জোর দরকার হয় না, যেটার দরকার সেটা হচ্ছে সাহস। সেটা আজকাল আমার ভালই হয়েছে বড় ক্লাসের ছেলেদেরকেও আমি মাঝে মাঝে ধামকি-ধমকি দিয়ে ফেলি। আমাদের ক্লাসের ভাল ছেলেরা আমার কাছেই আসে না, আর মেয়েদের কথা তো ছেড়েই দিলাম–আমি যদি কখনো তাদের চোখের দিকে তাকাই তাহলেই তারা মনে হয় ভয়ের চোটে ভ্যা করে কেঁদে ফেলবে।

আমি নোংরা কাপড় পরে স্কুলে আসি, চুল থাকে উষ্কখুষ্ক চেহারার মাঝে সবসময় একটা হতচ্ছাড়া ভাব থাকে, আমাকে দেখে আজকাল কেউ কল্পনাও করতে পারবে না যে আমি এক সময় স্কুলের নিখুঁত একটা ভাল ছেলে ছিলাম। কবিতা আবৃত্তি করতাম, ডিবেট করতাম, এমনকী স্কুলের বার্ষিক নাটকে আমি ছোট রাজপুত্রের অভিনয় করে একবার রুপার মেডেল পর্যন্ত পেয়েছিলাম। আমার বড় আপু কিংবা ভাইয়া এখনো নিখুঁত ভালো মেয়ে আর নিখুঁত ভালো ছেলে শুধু আমি অন্য রকম। আমার বড় আপুর নাম ঈশিতা, এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। শাড়ি পরে আপু যখন ইউনিভার্সিটিতে যায় তখন পাড়ার ইউনিভার্সিটি-কলেজে যাওয়া ছেলেরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে আর লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আমার ভাইয়ার নাম রাজীব, সে যখন কলেজ থেকে এসে একটা টি শার্ট পরে ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে খেলতে বের হয় তখন কম বয়সী মেয়েরা চোখের কোণা দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে নিজেরা একজন আরেকজনের সাথে ফিসফিস করে কথা বলে খিলখিল করে হাসে। শুধু আমি অন্য রকম–আমার দিকে কেউ ঘুরে তাকায় না। যারা আমাদের ভাল করে চিনে না তাদের ধারণা আমার আম্মুর দুই ছেলে-মেয়ে, আপু আর ভাইয়া। আমি তাদের খুব দূর সম্পর্কের কোন গরিব হতভাগা আত্মীয়ের বখে যাওয়া ছেলে আর তারা দয়া করে আমাকে তাদের বাসায় থাকতে দিয়েছে। প্রথম প্রথম পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আপু আর ভাইয়া খুব অস্বস্তি বোধ করত, আজকাল করে না। অনেক দিন হলো মেনে নিয়েছে–ধরেই নিয়েছে তারা হলো আমার আম্মুর সত্যিকারের ছেলে-মেয়ে আর আমি তাদের আপন ভাই হয়েও বাইরের একজন মানুষ।

এর শুরুটা ছিল খুব কষ্টের। আব্বু মারা যাবার পর প্রথম ধাক্কাটা সামলে নেবার পর আমরা প্রথম যেদিন খেতে বসেছি তখন সবাই দেখেছি আম্মু কিছু খেতে পারছেন না। প্লেটের খাবার হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন। সেটা দেখে আমাদেরও চোখে পানি এসে গেলো, আব্বু যেই চেয়ারটায় খেতে বসতেন সেই চেয়ারটা আছে কিন্তু আব্বু নাই ব্যাপারটা চিন্তা করেই আমার বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। আমিও নিজেকে সামলাতে না পেরে হঠাৎ ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। আম্মু তখন আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, তপু তুই কাঁদছিস কেন?

আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আব্বুর কথা মনে পড়ছে আম্মু।

আম্মুর চোখগুলো হঠাৎ কেমন যেন জ্বলে উঠল, কঠিন মুখে বললেন, খবরদার, ঢং করবি না।

আম্মুর কথা শুনে আমি এতো অবাক হলাম যে এক মুহূর্তের জন্যে কাঁদতে পর্যন্ত ভুলে গেলাম, আমি অবাক হয়ে আম্মুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আম্মু চিৎকার করে বললেন, বাপকে মেরে এসে এখানে বসে ঢং করিস? জানোয়ারের বাচ্চা।

আম্মুকে দেখে হঠাৎ করে আমার কেমন যেন ভয় লাগতে থাকে, মনে হতে থাকে আমি তাকে চিনি না। আমি ছিলাম সবচেয়ে ছোট ছেলে, আবু আম্মু আপু ভাইয়া সবাই সবসময় আমার সাথে শুধু আহ্লাদি করেছে, আদর করেছে; ধমক দেয়া দূরে থাকুক কেউ কখনো গলা উঁচিয়ে কথা পর্যন্ত বলেনি! অথচ আম্মু এখন আমাকে জানোয়ারের বাচ্চা বলে গালি দিচ্ছে? বলছে আমি আমার আলুকে মেরে এসেছি?

খাবার টেবিলে আপু ভাইয়া আর আমি আম্মুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আপু বলল, কী বলছ আম্মু?

আম্মু চিৎকার করে বললেন, ভুল বলেছি আমি? তোদের আব্বু কী এই বদমাইশটার জন্যে ক্রিকেট ব্যাট কিনতে গিয়ে মারা যায় নাই? ক্রিকেট ব্যাটের জন্যে কী ঘ্যান ঘ্যান করে এই জানোয়ারের বাচ্চা তোর আব্বুর জীবন নষ্ট করে দেয় নাই? যদি সেই রাতে ক্রিকেট ব্যাট কিনতে না যেত তাহলে কী মানুষটা এখন বেঁচে থাকত না?

এটা সত্যি কথা, আমি কয়েক দিন থেকে আব্বুকে বলেছিলাম একটা ভাল দেখে ক্রিকেট ব্যাট কিনে দিতে, আব্বু সেদিন অফিস থেকে এসে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন গুলশান মার্কেটে। ব্যাট কিনে ফিরে আসার সময় উল্টোদিক থেকে একটা গাড়ি হঠাৎ করে ছুটে এসেছে তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। এরপর যখন জ্ঞান এসেছে দেখেছি আমি একটা ভাঙ্গা গাড়ির নিচে চাপা পড়ে থাকা একটা মানুষকে ধরে চিৎকার করছি। মানুষটা আমার আব্বু, কিন্তু রক্তে মাখামাখি হয়ে তাকে আর চেনা যায় না। আব্বু যদি সেদিন আমাকে নিয়ে ব্যাট কিনতে না যেতেন তাহলে সত্যিই হয়তো আলু বেঁচে থাকতেন।

আপু হাত দিয়ে আম্মুকে ধরে বলল, কী বলছ আম্মু? তপুর কী দোষ? এইটা একটা একসিডেন্ট!

একসিডেন্ট? আম্মু টেবিলে হাত দিয়ে থাবা দিয়ে বললেন, তাহলে এই শয়তানের বাচ্চার কিছু হলো না কেন? তার গায়ে একটা আঁচড় লাগল না আর তার বাপ স্পট ডেড–এটা কীরকম একসিডেন্ট?

আমি বিস্ফারিত চোখে আম্মুর দিকে তাকিয়ে রইলাম আর মনে হতে লাগলো কেন আমি আব্বুর সাথে তখন তখনি মরে গেলাম না! আম্মু আমার দিকে হিংস্র চোখে তাকিয়ে থেকে চিৎকার করে বললেন, শয়তানের বাচ্চা, দূর হয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে। দূর হয়ে যা এই মুহূর্তে, না হলে আমি তোকে খুন করে ফেলব!

তারপর কিছু বোঝার আগে আম্মু আমার দিকে পানির গ্লাসটা ছুড়ে মারলেন, আমি মাথাটা সরানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু লাভ হল না। কাচের গ্লাসটা আমার কপালে এসে লাগলো। আমি ব্যথা পেলাম কীনা বুঝতে পারলাম না, ভয়ংকর একটা আতংক নিয়ে আমি আম্মুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আপু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে সরিয়ে নিয়ে গেলো, আমি তখনো থরথর করে কাপছি। আপু আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে, বলছে, সব ঠিক হয়ে যাবে তপু। সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমি ভাঙ্গা গলায় বললাম, আপু, আম্মু এরকম করছে কেন?

খুব বড় শক পেয়েছে তো।

আমার ভয় লাগছে আপু, অনেক ভয় লাগছে।

ভয়ের কিছু নাই। সব ঠিক হয়ে যাবে তপু। দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে।

 

কিন্তু আসলে সব ঠিক হয়ে যায় নি। প্রথম রাত আমি সারারাত বিছানায় শুয়ে

শুয়ে কেঁদেছি, আমার মনে হয়েছে হয়তো রাত্রিবেলা আম্মু আমার কাছে। আসবেন। আগের মতো আমাকে বুকে চেপে ধরে বলবেন, তপু সোনা আমার। রাগ করিস না আমার ওপর বাবা, মাথার ঠিক নেই, কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলেছি। কিন্তু আম্মু রাত্রিবেলা আমার কাছে এলেন না। শুধু যে সেই রাত্রে এলেন না তা না, কোন রাত্রিতেই এলেন না। আমি সারাক্ষণই অপেক্ষা করে থাকতাম যে কখন আম্মু আমার সাথে একটু নরম স্বরে কথা বলবেন, কখন এসে একটু আদর করবেন। কিন্তু আম্মু আদর করা বা নরম সুরে কথা বলা দূরে থাকুক আমার দিকে ভাল করে তাকালেনই না। শেষে আর কোন উপায় না। দেখে একদিন গভীর রাতে আমি নিজেই আম্মুর কাছে গিয়েছি। আম্মু। ঘুমাচ্ছিলেন, আমি আস্তে আস্তে ডাকলাম, আম্মু।

আম্মু ঘোরের মাঝে অস্পষ্ট স্বরে বললেন, কে?

আমি তপু।

তখন আম্মু চোখ খুলে তাকালেন, বারান্দার আলো ঘরে এসে পড়েছে। সেই আলোতে আম্মু আমাকে দেখলেন। আমি মশারি তুলে আম্মুকে ধরার চেষ্টা করলাম, আম্মু কেমন যেন ছিটকে সরে গেলেন, তীব্র স্বরে বললেন, কী হয়েছে?

আমি আর পারলাম না, ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললাম, বললাম, তুমি কেন আর আমাকে আদর করো না?

আম্মু কেমন যেন হিংস্র গলায় বললেন, আদর করব? আমি? তোকে? কেন তোকে আদর করব? তুই কে? নিজের বাপকে খুন করে তুই এখন আমার কাছে এসেছিস?

আমার মনে হতে লাগলো সমস্ত দুনিয়াটা আমার চোখের সামনে ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে, তবু আমি শেষবার চেষ্টা করলাম, বললাম, আম্মু! আমি তো কিছু করি নাই! আবু তো একসিডেন্টে মারা গেছেন।

তুই কেন একসিডেন্টে মারা গেলি না?

আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, তুমি চাও আমিও একসিডেন্টে মারা যাই?

আম্মু চাপা গলায় বললেন, হ্যাঁ। আমি চাই। তুই আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা। আর কোন দিন তুই আমার সামনে আসবি না!

কোন দিন আসব না? না।

বারান্দা থেকে আসা আবছা আলোতে আমি কিছুক্ষণ আম্মুর দিকে তাকিয়ে রইলাম, হঠাৎ করে আমার মনে হলো আমার বয়স বুঝি অনেক বেড়ে গেছে। মনে হলো আমি আর ছোট বাচ্চা নই, মনে হলো আমি অনেক বড় একজন মানুষ। আমি বুঝতে পারলাম এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই, আমি একেবারে একা। আমি যদি বেঁচে থাকতে চাই আমার একা বেঁচে থাকতে হবে, যদি বড় হতে চাই তাহলে একা বড় হতে হবে। আমার চোখের পানি হঠাৎ করে শুকিয়ে গেল, আমি বুঝতে পারলাম যার চোখের পানির কোন মূল্য নেই এই পৃথিবীতে তার থেকে হতভাগা আর কেউ নেই। আমি আর একটি কথা না বলে নিজের ঘরে ফিরে এলাম।

আমি সারারাত জানালার রড ধরে বসে ছিলাম। আব্রু মারা যাবার পর আমার বুকটা একেবারে ভেঙ্গে গিয়েছিল, কিন্তু এখন আমার বুকের ভেতর যে কষ্ট জমা হয়েছে সেটা কখনো কাউকে বলে বুঝাতে পারব না। নিজের ভেতর গভীর একটা অভিমান হলো, আম্মুর ওপর অভিমান, পৃথিবীর ওপর অভিমান, এমনকী আমাদেরকে ছেড়ে এতো তাড়াতাড়ি মরে যাবার জন্যে আব্বুর ওপর অভিমান। আমি রাতের বেলা জানালার রড ধরে বসে থাকতে থাকতে ঠিক করলাম আমি আত্মহত্যা করব।

আমি অবশ্যি আত্মহত্যা করতে পারি নি। আত্মহত্যা করার জন্যে মনে হয় অনেক সাহসের দরকার, দশ বছরের ছোট একটা ছেলের আসলে এত সাহস থাকে না। আমি আত্মহত্যা করার জন্যে অনেক দিন ওভার ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে থাকতাম, একটা বাস বা ট্রাক যাবার সময় আমি মনে মনে ঠিক করতাম যে এখন আমি লাফিয়ে পড়ব কিন্তু কখনোই শেষ পর্যন্ত লাফিয়ে পড়তে পারি নি। আত্মহত্যা না করলেও আত্মহত্যা করে যখন ইচ্ছা তখন সবকিছু শেষ করে দিতে পারব–এই চিন্তাটা আমার ভেতরে খানিকটা ভরসা এনে দিল আর এই ভরসাটার কারণেই আমি একদিন একদিন করে বেঁচে থাকতে লাগলাম।

আস্তে আস্তে বাসায় আমার অবস্থাটা আরো খারাপ হয়ে গেলো। আম্মু এমনিতে ভাল মানুষ, আব্বুর অফিসে তাকে বেশ ভাল একটা চাকরি দিয়েছে। অফিসের গাড়ি এসে আম্মুকে নিয়ে যায় আবার বিকেলে আম্মুকে বাসায় ফিরিয়ে দিয়ে যায়। আম্মু সারাদিন স্বাভাবিকভাবে অফিস করেন, কেউ কিছু বুঝতে পারে না। বাসাতে এসেও হাসিখুশি থাকেন কিন্তু আমাকে দেখলেই হঠাৎ করে খেপে যান, কেউ তাকে থামাতে পারে না। কোন উপায় না দেখে আপু আর ভাইয়া মিলে আমাকে আম্মুর চোখের সামনে থেকে আড়াল করে রাখতে শুরু করল। খাবার টেবিলেও আমি যাই না। আম্মু আপু আর ভাইয়াকে নিয়ে খানআমি খাই আলাদা। আগে নিয়ম ছিল সন্ধে হবার আগে সবাইকে বাসায় ফিরে আসতে হবে এখন সেই নিয়মটা শুধু আপু আর ভাইয়ার জন্যে, আমি বাসায় এসেছি কী আসি নি কেউ সেটা জানতে চায় না। একদিন আম্মুর নতুন অফিস থেকে একজন আমাদের বাসায় বেড়াতে এলো, আম্মু তাকে বললেন তার দুইজন ছেলে-মেয়ে; তারপর ভাইয়া আর আপুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

কেউ কেউ মনে করতে পারে আমি যে আছি সেটা আম্মু ভুলে গেছেন। কিন্তু সেটা সত্যি নয়, আম্মু আসলে সেটা একবারও ভুলতে পারেন না। যখন আস্তে আস্তে নিয়ম হয়ে গেলো আম্মু আপু আর ভাইয়াকে নিয়ে খাবে আর আমি খাব আলাদা তখন আমার খাবারটাও অন্যরকম হয়ে গেল। আম্মু খাওয়া শেষ করে দুলি খালাকে দিয়ে সব খাবার ফ্রিজে তুলে রাখতেন যেন আমি সেটা খেতে

পারি। দুলি খালা আমার জন্যে সেখান, থকে খাবার গরম করতে চাইলে আম্মু রেগে আগুন হয়ে যেতেন–দুলি খালা এতোদিন থেকে আমাদের বাসায় আছেন, তাকে পর্যন্ত আম্মু একেবারে অকথ্য ভাষায় গালাগাল শুরু করতেন।

আস্তে আস্তে আমি দুলি খালার সাথে রান্নাঘরে বসে খেতে শুরু করলাম। মোটা চালের ভাত, কোন একটা ভর্তা, বাসি ডাল এই ধরনের খাবার। দুলি খালা কখনো লুকিয়ে একটা ডিম ভাজা করে দিতো, রান্না করার সময় হয়তো আমার জন্যে একটু খাবার লুকিয়ে রাখতো–কখনো সেগুলো দিতো। আমি যখন খেতাম তখন দুলি খালা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তো আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতো। আমি যে সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করে ফেলি নি দুলি খালা তার একটা কারণ। আপু আর ভাইয়া আমার জন্যে যেটা করতে পারে নি দুলি খালা সেটা করেছিল, সে আমাকে বেঁচে থাকার জন্যে সাহস দিয়েছিল। আমি যখন খেতাম তখন আমার পাশে বসে ফিসফিস করে বলতো, শোন বাবা তপু। তোমার ওপরে কিন্তু খুব বড় বিপদ। তোমার মা তোমারে আদর করে না সেইটা সত্যি না। সন্তান হইল মায়ের শরীলের অংশ। সন্তান চোর ডাকাইত বদমাইশ যাই হোক মা তারে ভালবাসে। যদি কখনো কুনো মা তার সন্তানরে ভাল না বাসে তাহইলে তার অর্থ কী জানো?

আমি জিজ্ঞেস করতাম, কী?

দুলি খালা গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলতো, তার অর্থ তার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। তোমার মা অসুস্থ। তোমার মা পাগলি। তোমার বাপ মরে যাবার পর তার মাথাটা পুরাপুরি আউলে গেছে। অন্য কেউ বুঝতে পারে না, আমি পারি। চোখ দেখলেই বুঝতে পারি।

কেন? চোখে কী হয়েছে?

চোখগুলি জ্বলে তুমি দেখ নাই? তুমি খুব সাবধান বাবা–আমার কেন জানি মনে হয় কোন একদিন তোমার মা তোমারে খুন করে ফেলার চেষ্টা করবে।

শুনে আমার শরীর কেঁপে উঠলো। দুলি খালা তখন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলতো, তোমার বাপ মরে যাবার পর তোমাদের এই সংসারটা ছারখার হয়ে গেছে। এইখানে আমার মন টিকে না বাবা। একেবারে ভাল লাগে না। তবু আমি এইখানে আছি–কেন আছি জানো?

কেন দুলি খালা?

তোমার জন্যে। খালি তোমার জন্যে। তোমার ভাই আর বইন তোমারে রক্ষা করতে পারবে না। আমি না থাকলে তুমি না খায়া মারা যাইবা। বুঝেছ?

আমি মাথা নাড়ি। দুলি খালা বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তোমার মায়ের উপর কুনো রাগ রাইখ না বাবা। তোমার মা আসলে পুরাপুরি পাগল। সে কী করতাছে সে জানে না। তারে আসলে পাগলাগারদে রাখা দরকার। তার চিকিৎসা হওনের দরকার। তারে তাবিজ-কবজ দেওয়া দরকার।

দুলি খালাই আসলে সত্যিকার ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিল, আস্তে আস্তে আমি নিজেই বুঝতে পেরেছিলাম আব্বু মারা যাবার পর সত্যি সত্যি আমার আম্মুর মাথার ভিতরে কিছু একটা গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। তার চিকিৎসা করানোর দরকার ছিল, কিন্তু আমাকে সহ্য করতে না পারা ছাড়া আর কোন সমস্যা ছিল না দেখে সেটা বাইরের কেউ কোন দিন বুঝতে পারে নি। দুলি খালা বলেছিল আম্মু আমাকে খুন করে ফেলতে পারে, আমি সেটা কখনো বিশ্বাস করতে পারি নি। কিন্তু সত্যি সত্যি একদিন একেবারে অকারণে রেগে উঠে আম্মু আমার মাথা বালতির পানিতে চেপে ধরেছিলেন। দুলি খালা। রীতিমতো ধস্তাধস্তি করে আমাকে ছুটিয়ে না আনলে হয়তো সেদিন মরেই যেতাম। সেই থেকে আমি খুব সাবধান হয়ে গেছি। আম্মু যদি বাসায় একা থাকেন আমি বাসার ভিতরেই ঢুকি না। যতদিন আব্বু বেঁচে ছিলেন গায়ে হাত তোলা দূরে থাকুক কেউ আমার সাথে গলা উঁচু করেও কথা বলে নি। এখন সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার, একেবারে অকারণে আম্মু আমাকে মারধর করেন। ছোটখাটো চড়-থাপ্পড় নয় একেবারে অমানুষিক মার। প্রথম প্রথম আপু, ভাইয়া কিংবা দুলি খালা আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতো কিন্তু তাহলে আম্মু আরো রেগে যান বলে আজকাল আর কেউ চেষ্টা করে না। আমি দাতে দাত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করতে শিখে গেছি। মার খাওয়ার যন্ত্রণাটুকু নয় এর পিছনের নিষ্ঠুরতাটুকু আমাকে অনেক বেশি কষ্ট দেয়।

কয়দিনের ভিতরেই আমি রান্নাঘরে স্টোররুমে ঘুমানো শুরু করলাম। আমার পরিচিত মানুষেরা এটা শুনলে নিশ্চয়ই খুব অবাক হতো কিন্তু ততদিনে আমার বাসার সবাই এটা মেনে নিয়েছে। আমি যদি আগের মতো ভাইয়ার ঘরে ঘুমাই তাহলে প্রায় প্রত্যেক রাত্রেই আম্মুর কোন একরকম অত্যাচার সহ্য করতে হয়। আম্মু এমনিতে ভাল মানুষ শুধু আমাকে দেখলেই খেপে যান। তাই সমস্যাটার সবচেয়ে ভাল সমাধান হচ্ছে যেন কোন সময়েই আমাকে দেখতে না। পান। বাসায় এসে আমি তাই রান্নাঘরের স্টোররুমে ঢুকে যেতাম। চালের বস্তা, আলুর টুকরি, তেল-পেঁয়াজ সরিয়ে দুলি খালা আমাকে শোয়ার একটা জায়গা করে দিল। আমি রাত্রেবেলা সেখানে ঘুমাতাম। বাসার সবাই বিষয়টা জানতো কিন্তু এমন ভান করতো যেন জানে না। আপু আর ভাইয়া যখন আমার দিকে তাকাতো আমি বুঝতে পারতাম আমার জন্যে তাদের খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কিছু করতে পারছে না। আমি আস্তে আস্তে আবিষ্কার করলাম এক সময়ে তারাও পুরো ব্যাপারটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেলো, ধরেই নিল আমি রান্নাঘরের স্টোররুমে চালের বস্তার পাশে আলু বেগুন পেঁয়াজ আর রসুনের পাশে গুটিশুটি মেরে ঘুমাব। আগে পড়াশোনার একটা ব্যাপার ছিল এখন সেটাও নাই, খাতা কলম বই পত্র না থাকলে মানুষ পড়াশোনা করে কেমন করে? ধীরে ধীরে পড়াশোনাটাও প্রায় বন্ধ হতে শুরু করল। স্কুলের ছেলেমেয়েরা আর স্যারম্যাডামেরা ধরে নিলো আব্বু মারা যাবার পর আমি আস্তে আস্তে বখে যেতে শুরু করেছি। আমার শরীরে আম্মুর মারের যেসব চিহ্ন থাকতো সবাই ধরে নিতে শুরু করল সেগুলো এসেছে মারামারি করে! আস্তে আস্তে সবাই আমাকে ভয় পেতে শুরু করলো। আমার দুই চারজন যে বন্ধুবান্ধব ছিল তারাও আস্তে আস্তে দূরে সরে যেতে শুরু করল।

আমি হয়ে গেলাম একা। একেবারে একা।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল