জন্মের তিন দিনের পর মেকুকে বাসায় নিয়ে আসা হল। মগবাজারে তিনতলায় একটা ফ্ল্যাট। আব্বা আম্মা আর মেকু এই তিন জনের সংসার। আগে যখন দুজন ছিলেন তখন কাজকর্মে সাহায্য করার জন্যে একজন মহিলা বিকেল বেলা কয়েক ঘণ্টার জন্যে আসত। এখন হয়তো সারাদিনের জন্যেই লাগবে। পরিচিত অপরিচিত সবাই ভয় দেখাচ্ছে যে একটা ছোট বাচ্চা নাকি দশ জন বড় মানুষের সমান। সারা দিনে বাচ্চা নাকি শুধু পেশাব করেই ন্যাপি আর কাঁথা ভেজাবে কমপক্ষে এক ডজন। সময়ে অসময়ে খিদে লাগার কথা তো ছেড়েই দেওয়া যাক। সারা রাত নাকি চিৎকার করে কাঁদবে। নিজে ঘুমাবে না অন্য কাউকেও ঘুমাতে দেবে না। অসুখবিসুখ লেগে থাকবে, কান পাকা হবে তার মাঝে এক নম্বর। এগুলি দিয়ে শুরু, বাচ্চা যখন আরেকটু বড় হবে তখন আরো নতুন নতুন ঝামেলা তৈরি হবে এবং সেইসব ঝামেলা শুধু বাড়তেই থাকবে।
আম্মা আর আব্বা অবিশ্যি আবিষ্কার করলেন মেকুকে নিয়ে বাড়াবাড়ি কোনো ঝামেলা হল না। শুধু কাজের মহিলাটি হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল, কেন উধাও হয়ে গেল সেটি কেউ বুঝতে পারল না। ব্যাপারটি যে ব্যাখ্যা করতে পারত সেটি হচ্ছে মেকু কিন্তু সে চুপচাপ ছিল বলে কেউ কিছু জানতেও পারল না। ব্যাপারটি ঘটেছিল এভাবেঃ আম্মা মেকুকে তার ছোট রেলিং দেওয়া বিছানায় শুইয়ে বাথরুমে গিয়েছেন। মেকু ঘুম থেকে উঠে শুয়ে শুয়ে তার বিছানায় সাজিয়ে রাখা খেলনা, বাসার ছাদ, দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ক্যালেন্ডার, জানালার পাখিগুলির কিচির মিচির সবকিছু দেখে শেষ করে ফেলে একটু বিরক্তি বোধ করতে শুরু করেছে। ঠিক তখন দেখতে পেল বাসায় কাজের মহিলাটি ঘর মোছার জন্যে একটা ন্যাকড়া নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। মেকুর বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে সে কিছুক্ষণ মেকুর সাথে হাসি মশকরা করল, মেকু এতদিনে টের পেয়েছে ছোট বাচ্চাকে দেখলেই সবাই তাদের সাথে হাসি মশকরা করতে শুরু করে, অর্থহীন শব্দ করে নিজেদেরকে একটা হাসির পাত্র বানিয়ে ফেলে। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছে করে একটা ধমক লাগিয়ে দিতে কিন্তু মহা ঝামেলা হয়ে যাবে বলে কিছু বলে না।

কাজের মহিলাটা মেকুর গাল টিপে দিয়ে পেটে খানিকক্ষণ সুড়সুড়ি দিন এবং মেকু অনেক কষ্ট করে সেটা সহ্য করল। তখন মহিলাটি মেকুকে ছেড়ে দিয়ে কাজ করতে শুরু করল, ঘরের আসবাবপত্র মুছতে মুছতে আম্মার ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে মহিলাটা কাজ বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে শুরু করে। নানা রকম ভঙ্গি করে আয়নার সামনে দাঁড়ায় শাড়িটা নানাভাবে পেঁচিয়ে পরে শরীর বাঁকা করে দাঁড়াল। তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিল থেকে আম্মার পাওডার নিয়ে নিজের মুখে, গলায়, শরীরে ঢালতে থাকে। একটা ক্রিম নিয়ে মুখে মেখে খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজেকে পরীক্ষা করে দেখে। মেকু অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রাখল। কাজের মহিলাটা তখন একটু পারফিউম নিয়ে কানের লতিতে লাগাল। সেটাও মেকু সহ্য করল। কিন্তু মহিলাটা যখন ড্রেসিং উপর থেকে আম্মার লিপস্টিকটা নিয়ে নিজের ঠোটে ঘষতে থাকে তখন সে আর সহ্য করতে পারল না, ধমক দিয়ে বলল, “কী হচ্ছে? কী হচ্ছে ওখানে?”
কাজের মহিলাটি এত জোরে চমকে উঠল যে তার হাতের ধাক্কায় পাউডারের কৌটা আর ক্রিমের শিশি নিচে পড়ে যায়। সে ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে চারিদিকে তাকাল, কে ধমকে উঠেছে সে বুঝতে পারে না। গলার স্বরটি যে মেকু থেকে আসতে পারে সেটা তার একবারও মনে হয় নি। চারিদিকে তাকিয়ে কাউকে না দেখে সে আবার লিপস্টিকটা নিয়ে নিজের ঠোটে লাগাতে শুরু করে তখন মেকু আবার গর্জন করে উঠে বলল, “ভালো হবে না কিন্তু ”
কাজের মহিলাটি এবারে একটা আর্ত চিৎকার করে ফ্যাকাসে মুখে ঘুরে তাকাল, মেকু তখন আবার ধমক দিয়ে বলল, “লিপস্টিক লাগাবেন না, ভালো হবে না কিন্তু ”
মহিলাটি সাথে সাথে লিপস্টিকটা ড্রেসিং টেবিলে রেখে দেয়। তার হাত থেকে মোছার কাপড় নিচে পড়ে যায়। সে গলায় হাত দিয়ে নিজের একটা তাবিজ বের করে তাবিজটা চেপে ধরে বিড় বিড় করে সুরা পড়তে থাকে। ভয়ে তার হার্টফেল করার অবস্থা হয়ে যায়। মেকু তখন কঠিন গলায় বলল, “ আবার করলে আমি বলে দেব কিন্তু ”
মেকুর কথা শেষ হবার আগেই কাজের মহিলা সবকিছু ফেলে দিয়ে ছুটে যায়। নিজের বিছানায় শুয়ে মেকু শুনতে পেল ঘরের দরজায় ধাক্কা খেয়ে সে একটা আছাড় খেল, সেই অবস্থায় বাইরের দরজা খুলে সিঁড়ি ভেঙ্গে দুদ্দাড় করে ছুটে পালাচ্ছে। কী কারণে এত ভয় পেয়েছে মেকু বুঝতে পারল না।
খানিকক্ষণ পর আম্মা বাথরুম থেকে গোসল সেরে বের হয়ে এসে কাজের মহিলাকে না পেয়ে খুব অবাক হলেন। এদিক সেদিক খুঁজে না পেয়ে বাইরের দরজা বন্ধ করে ঘরে ফিরে এলেন। প্রত্যেকবার মুখ খুলতেই সবাই ভয় পাচ্ছে দেখে মেকু আর মুখ খুলল না, তার নিজের আম্মাও যদি তাকে ভয় পেয়ে যান তখন কী হবে?

দুদিন পর জাঁদরেল ধরনের একজন মহিলা মেকুকে দেখতে এলেন। মেকুর জন্মের পর থেকে অসংখ্য মানুষ তাকে দেখতে এসেছে, বলতে গেলে তাদের সবাই মেকুকে দেখে খুশি হয়েছে। মেকুর গাল টিপে দিয়েছে, পায়ে সুড়সুড়ি দিয়েছে, মাথায় হাত বুলিয়েছে। তার চোখগুলি কত বড় এবং কর সুন্দর সেটা নিয়ে কিছু না কিছু মন্তব্য করেছে। মেকুর প্রায় অসহ্য হয়ে যাবার অবস্থা কিন্তু সে কষ্ট করে সহ্য করে যাচ্ছে, সে এর মাঝে আবিষ্কার করে ফেলেছে মানুষের ভালবাসা অসহ্য মনে হলেও সেটা সহ্য করতে হয়।
জাঁদরেল মহিলার মাঝে মেকু অবশ্যি কোনো ভালবাসা খুঁজে পেলেন না। তিনি ভুরু কুঁচকে মেকুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই বুঝি তোর ছেলে? এত শুকনো কেন? আমার মেয়ের বাচ্চা ছিল চার কেজি।”
আম্মা কিছু বললেন না, মেকু মনে মনে বলল, ওজন বেশি হউয়াই যদি ভালো হয়ে থাকে তা হলে মানুষের বাচ্চা না পুষে হাতির বাচ্চাকে পুষলেই হয়।
জাঁদরেল মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, “রাতে ঘুমায়?”
আম্মা মাথা নাড়লেন, “ঘুমায়।”
“খাওয়া নিয়ে যন্ত্রণা করে?”
“না।”
“কলিক আছে?”
“না।”
“নাম কী রেখেছিস?”
“ভালো নাম এখনো ঠিক করি নি, আমি মেকু বলে ডাকি।”
“মেকু?” জাঁদরেল মহিলা হঠাৎ হায়েনার মত হেসে উঠলেন, “মেকু আবার কী রকম না? এই নামের জন্যে বড় হলে তোর মেকুর বিয়ে হবে না। যার নাম মেকু তাকে কোন মেয়ে বিয়ে করবে?” জাঁদরেল মহিলা আবার হায়েনার মতো খ্যাক খ্যাক করে হাসতে শুরু করলেন।
মেকু দেখল তার আম্মা চুপ করে রইলেন কিছু বললেন না। মেকুর ইচ্ছে হল চিৎকার করে বলে, “আমি বিয়ে করার জন্যে মারা যাচ্ছি না।’ কিন্তু সে কিছু বলল না। যে বাচ্চার বয়স এখনো এক সপ্তাহও হয় নি তার মনে হয় বিয়ে নিয়ে কথা বলা ঠিক না।
জাঁদরেল মহিলা উবু হয়ে মেকুকে দেখে বললেন, “সারা দিনে কয়বার ন্যাপি-কাঁথা বদলাতে হয়?”
আম্মা ইতস্তত করে বললেন, “আসলে বদলাতে হয় না।”
জাঁদরেল মহিলা এবারে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, আম্মার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, “তোর বেকুর হিসি করতে হয় না?”
“বেকু না, মেকু।”
“ওই হল। মেকু হিসি করে না? বাথরুম করে না?”
“করে! আমি তার পটিতে বসিয়ে হিসি করতে বলি সে তখন হিসি করে। বাথরুম করে।”
জাঁদরেল মহিলা কেমন জানি রেগে উঠলেন, বললেন, “আমার সাথে মশকরা করছিস?”
“না খালা। সত্যি বলছি।”
“তুই বললেই আমি বিশ্বাস করব? সাত দিনের একটা বাচ্চা যার এখনো ঘাড় শক্ত হয় নি সে পটিতে বাথরুম করে।”
আম্মা কেমন জানি হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “ ঠিক আছে খালা তুমি যা বল তাই।”
“কিন্তু তুই আমার সাথে মিথ্যে কথা বলবি কেন? আমি তোর খালা না? তোর মা আর আমি এক মায়ের পেটের বোন না?”
আম্মা কেমন জানি অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “খালা, আমি তোমার সাথে মিথ্যা কথা বলি নি।”
“তা হলে দেখা। দেখা তোর পেকু না মেকু সাত দিন বয়সে পটিতে বসে হিসি করে।”
‘সেটা আমি করতে পারি না খালা। আমার সাত দিনের বাচ্চাকে এখন তোমার সামনে পরীক্ষা দেওয়াতে পারি না।”
“কেন পারিস না?”
আম্মা কঠিন মুখে বললেন, “সেটা তুমি বুঝবে না খালা।”
জাঁদরেল মহিলার মুখ কেমন জানি থম থমে হয়ে উঠল, বাঘের মতো নিশ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আছে! আমিই তা হলে দেখব।”
“কী দেখবে?”
“তোর ফেকু না খেকুকে পটিতে বসিয়ে দেখব কী করে।”
“না খালা। ওটা করতে যেও না।” আম্মার নিষেধ না শুনেই জাঁদরেল খালা মেকুর কাছে এগিয়ে গেলেন এবং একটান দিয়ে মেকুর ন্যাপি খুলে তাকে ন্যাংটো করে ফেললেন, ঠিক সাথে সাথে দুর্ঘটনাটি ঘটল। মেকু একেবারে নিখুঁত নিশানা করে জাঁদরেল খালার চোখে মুখে হিসি করে দিল। জাঁদরেল খালা একটা চিৎকার দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, তার মুখ চোখ শাড়ি ব্লাউজ ভেজা, মুখের রং খানিকটা উঠে এসেছে, সব মিলিয়ে তাকে অত্যন্ত হাস্যকর দেখাতে লাগল।
আম্মা হতাশভাবে মাথা নেরে বললেন, “এই জন্যে তোমাকে না করেছিলাম খালা।”
খালা দুই হাত দুইদিকে ছড়িয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর ট্রেনের ইঞ্জিনের মতো ফোঁস করে একটা শব্দ করে বললেন, এই জন্যে তুই না করেছিলি?”
আম্মা দুর্বলভাবে মাথা নাড়লেন। জাঁদরেল খালা মেঘ স্বরে বললেন, “তুই জানতি যে তোর গেকু আমার শরীরে হিসি করে দিবে?”
আম্মা মুখ শক্ত করে বললেন, “জানতাম।”
“কেন?”
“কারণ তুমি একবার তাকে বেকু ডেকেছ, একবার পেকু ডেকেছ একবার ফেকু ডেকেছ, খেকু দেখেছ গেকু ডেকেছ, কিন্তু ঠিক নামতা ডাক নাই। সেই জন্যে সে তোমার উপর রেগে আছে। আমার বাচ্চার নাম হচ্ছে মেকু। মেকু মেকু মেকু। মেকুকে যদি রাগিয়ে দাও তা হলে সে কঠিন শাস্তি দেয়।”
জাঁদরেল খালা প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ে কিছু একটা বলতে চাইছিলেন, আম্মা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “যাও খালা বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে নাও। তোমাকে দেখতে বিদঘুটে দেখাচ্ছে।”
জাঁদরেল খালা কোনো কথা না বলে পা দাপিয়ে বাথরুমের দিকে গেলেন। আম্মা মেকুর কাছে গিয়ে বললেন, বাবা মেকু। তুই এই কাজটা কি ঠিক করলি?”
মেকু তার মাড়ি বের করে হাসল, সে একেবারে এক শ ভাগ নিশ্চিত কাজটা সে ঠিকই করেছে।

দুদিন পর মেকুকে দেখতে এলেন তার বড় মামা। সাথে এলেন মামি আর তার দুই ছেলে মেয়ে। বড় ছেলের নাম সুমন বয়স দশ। ছোট জনের নাম লিপি বয়স চার। ছোট বাচ্চাকে নিয়ে যেসব আহা উঁহু করতে হয় সবকিছু করে বাচ্চাকে তার বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই বসার ঘরে বসে চা খাচ্ছে তখন বড় মামার ছোট মেয়ে লিপি বলল, “ফুপু, আমি মেকুর সাথে খেলি?”
মামি বললেন, “কেমন করে খেলবি মা? মেকু তো অনেক ছোট।”
মামা বললেন, “এখন মেকু শুধু তিনটা কাজ করে। একটা হচ্ছে খাওয়া আরেকটা হচ্ছে ঘুম, আরেকটা হচ্ছে – ”
মামার বড় ছেলে সুমন ঠোঁট উলটে বলল, “বাথরুম!”
লিপি বলল, “তা হলে আমি কাছে বসে থাকি?”
মামি একটু সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললেন, “জ্বালাতন করবি না তো?”
লিপি মাথা নেড়ে বলল, “না মা । একটুও জ্বালাবো না। খালি দেখব।”
“কী দেখবি?”
লিপি হেসে বলল, ছোট বাবু দেখতে আমার ভালো লাগে আম্মু। একেবারে পুতুলের মতো। যাই, দেখি?”
“যা।”
লিপি তখন মেকুকে দেখতে গেল। মেকু বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার হাতটা ব্যাবহার করে শিখছিল, একটা আঙুল সোজা করে রেখে অন্য হাত দিয়ে সেটা ধরে ফেলার চেষ্টা করে। এমনিতে মনে হয় কী সোজা কিন্তু মেকুর জান বের হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই হাতের মাঝে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আসছে না। লিপি মেকুর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে তাকে লক্ষ্য করে বলল,
“ইশ! এই বাবুটাকে কী আদর লাগে!”
মেকুর একটু লজ্জা লজ্জা লাগে, একটা ছোট বাচ্চার সামনে সে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে কিছু করতে পারছে না, বাচ্চাটা তাকে এমনভাবে দেখছে যেন সে একটা দর্শনীয় জিনিস। লিপি মেকুর বিছানা ঘিরে রাখা রেলিং ধরে তাকে বলল,
“এই বাবু তোমার নাম কী? বল তোমার নাম কী? বল। বল না।”
মেকু মাথা ঘুরিয়ে লিপিকে দেখার চেষ্টা করল, লিপির চোখে চোখ পড়তেই সে হাত নেড়ে একটু হেসে দেয়। লিপি আবার হাসিমুখে কথা বলার চেষ্টা করে,
“বাবু। এই বাবু , তুমি কথা বল না কেন?”
মেকু কিছু বলল না। লিপি তখন মুখ সুচালো করে মেকুকে আদর করার চেষ্টা করতে থাকে, “কুচু কুচু বুগু বুগু ওরে ওরে ওরে –”
মেকু আর সহ্য করতে পারল না হঠাৎ করে বলে বসল, “আমাকে জ্বালিও না বলছি – ” বলেই সে চমকে উঠে, সর্বনাশ! এখন এই বাচ্চাটি চিৎকার করে সবাইকে বলে দেবে। মেকু নিঃশ্বাস বন্ধ করে লিপির দিকে তাকিয়ে রইল কিন্তু লিপি চিৎকার করে উঠল না, বরং ভুরু কুচকে বলল, “কে বলছে আমি তোমাকে জ্বালাচ্ছি? আমি তোমাকে আদর করছি না?” বলে সে আবার আদর করার ভঙ্গি করে বলল, “কুচু কুচু কুচু বুগু বুগু বুগু ওলে ওলে ওলে – ”
মেকু খুব সাবধানে তার বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দেয়, এই বাচ্চাটা তার কথা বলাটা খুব সহজভাবে নিয়েছে। একটুও অবাক হয় নি। ছোট বাচ্চারাই ভালো, সব কিছু সহজ ভাবে নিতে পারে, এটা যদি একটা বড় মানুষ হত তা হলে এতক্ষণে চিৎকার করে হই চই করে একটা কেলেংকারী করে ফেলত।
লিপি আরো কিছুক্ষণ অর্থহীন শব্দ করে মেকুকে আদর করে বলল,
“তোমার নাম কী বাবু?”
মেকু ভয়ে ভয়ে বলল, “মেকু।”
“মেকু! ইশ তোমার নামটা শুনলে কী আদর লাগে।”
মেকু সাবধানে আবার একটা নিশ্বাস ফেলল, এই প্রথম একজনকে পাওয়া গেল যে তার নামটাকে পছন্দ করেছে।
লিপি রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মেকুকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে বলল,
“তুমি আমার সাথে খেলবে?”
মেকু বলল, “কেমন করে খেলব? দেখছ না আমি ছোট। শুধু শুয়ে থাকতে হয়।”
লিপি গম্ভীর মুখে বলল, “ও।” একটু পড়ে বলল, “তা হলে শুয়ে শুয়েই খেলি?”
“শুয়ে শুয়ে কেমন করে খেলে?”
“ওই যে হাচুতানী খেলাটা?”
“হাচুতানী খেলাটা কেমন করে খেলে?”
লিপি চোখ বড় বড় করে বলল, “আমি বলব হাচুতানী হাচুতানী, সামনে পিছে হাচুতানী, ডাইনে বামে হাচুতানী – তারপর আমি তোমার কান ধরব।”
“কান ধরবে?”
“হ্যাঁ তারপর তুমি আমার কান ধরবে। তারপর আমরা কান ধরে টানাটানি করব। কী মজা হবে!”
মেকু একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমি তো ছোট, আমি কানও ধরতে পারি না।”
লিপি এবারে খানিকটা অভিমান নিয়ে বলল, “তুমি দেখি কিছুই করতে পার না –”
মেকু উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু বলল না, হঠাৎ করে দেখতে পেল বসার ঘর থেকে সবাই হেঁটে হেঁটে আসছে। বড় মামা লিপিকে জিজ্ঞেস করলেন, “লিপি সোনামণি, তুমি কী করছ?”
“কথা বলছি আব্বু।”
“কার সাথে কথা বলছ?”
“মেকুর সাথে।”
“মেকুর সাথে কী নিয়ে কথা বলছ লিপি?”
“এই তো কেমন করে হাচুতানী খেলব সেটা বলেছি।”
বড় মামা হাসি হাসি মুখে বললেন, “মেকু কী বলেছে?”
“মেকু বলেছে সে ছোট তাই সে কান ধরতে পারবে না।”
“তাই বলেছে?”
“হ্যাঁ আব্বু। মেকু সব কথা বলতে পারে।”
বড় মামা হাসি হাসি মুখে বললেন, “নিশ্চয়ই পারে। পারবে না কেন?”
লিপির বড় ভাই সুমন হাসি চেপে বলল, “লিপি, মেকু কি উড়তে পারে?”
লিপি একটু রাগ হয়ে বলল, “মেকু উড়বে কেমন করে? মেকু কি পাখি?”
লিপির আম্মু সুমনকে ধমক দয়ে বললেন, “কেন ওকে জ্বালাতন করছিস?” তারপর ঘুরে লিপিকে বললেন, “আয় লিপি আজ বাসায় যাই।”
লিপি মেকুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আরেকদিন এসে তোমার সাথে খেলব। ঠিক আছে?”
মেকু চুপ করে রইল, তার চারপাশে এত মানুষ সে কোনো কথা বলার ঝুঁকি নিল না। সুমন বলল, “কী হল লিপি, তোর মেকু কথা বলছে না কেন?”
লিপির আম্মা বললেন, “আহ সুমন! কেন জ্বালাতন করছিস মেয়েটাকে?”
সুমন বলল, “ওকে সত্যি মিথ্যা শিখতে হবে। প্রত্যেকদিন রাতে উঠে বলে ওর টেডি বিয়ার ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দিয়েছে। এখন বলছে মেকু ওর সাথে গল্পগুজব করছে। আরেকদিন বলবে সে উড়তে পারে। আরেকদিন বলবে –”
বড় মামা বললেন, “আহ সুমন। এটা মিথ্যা কথা না। এটা হচ্ছে ওর কল্পনার জগৎ!”
সুমন বলল, “কল্পনার জগৎ না হাতী!”
মেকু শুয়ে শুয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কাউকে যদি জানাতেই না পারে টা হলে তার এই কথা বলার ক্ষমতা দিয়ে সে কী করবে?”

কয়েকদিন পর মেকু টের পেল কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে আম্মা খানিকটা অস্থির হয়ে আছেন। একটু পরে পরে টেলিফোন এসে, আম্মা সেই টেলিফোনে কথাবার্তা বলতে বলতে মাঝে মাঝে চেঁচামেচি করেন, তারপর টেলিফোন ছেড়ে দিয়ে মাথার চুল টানাটানি করেন। ব্যাপারটা কী মেকু ঠিক বুঝতে পারে না, তবে তার নিজের জন্মের সাথে কিছু একটা সম্পর্ক আছে বলে মনে হয়। একদিন আব্বা আর আম্মার মাঝে ব্যাপারটা নিয়ে লম্বা একটা আলোচনা হল তখন মেকু খানিকটা বুজতে পারল। আব্বা বললেন, “শানু, আমাদের মেকুর জন্ম হয়েছে এখনো এক মাস হয় নি এর মাঝে তুমি যদি তোমার অফিসের কাজ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে শুরু কর তা হলে তো হবে না।’
আম্মা মাথা নেড়ে বললেন, “আমি দুশ্চিন্তা শুরু করি নি। আমি এখন ছুটিতে আছি। কিন্তু আমাকে পনের মিনিট পরে পরে টেলিফোন করলে আমি কী করব?”
“তুমি টেলিফোন ধরবে না। তুমি বলবে তুমি ছুটিতে।”
আম্মা একটা নিশ্বাস ফেলেল বললেন, “এমন এক একটা সমস্যা নিয়ে ফোন করে যে না করতে পারি না।”
“তোমাকে না করতে শিখতে হবে।”
আম্মা অনেকটা নিজের মনে বললেন, “এত বড় একটা প্রজেক্ট সেটার উপরে এত মানুষের রুজি রোজগার নির্ভর করছে, সেটা তো এভাবে নষ্ট করা ঠিক না।”
আব্বা বললেন, “নষ্ট কেন হবে? অন্যেরা প্রজেক্ট শেষ করবে।”
আম্মা মাথা নেড়ে বললেন, “পারছে না তো! বুঝেছ হাসান, এটা মানুষকে নিয়ে প্রজেক্ট, মানুষকে দিয়ে কাজ করার প্রজেক্ট এটা সবাই পারে না। মানুষ তো যন্ত্রপাতি না যে সুইচ টিপলেই কাজ করে। এমন একটা সময়ে মেকুর জন্ম হল আর আমি বাসায় আটকা পড়ে গেলাম।”
শুনে মেকুর একটু মন খারাপ হয়ে যায়, সত্যিই তো আরো কয়দিন পরে জন্ম নিলে কী ক্ষতি হত? সেটা কী কোনোভাবে ব্যবস্থা করা যেত না?
পরের দিন আব্বাকে ডেকে আম্মা বললেন, “আমি একটা জিনিস ঠিক করেছি।”
“কী জিনিস?”
“কয়েক ঘণ্টার জন্যে অফিসে যাব।”
আব্বা চোখ কপালে তুলে বললেন, “অফিসে যাবে? আর মেকু?”
“আমার পরিচিত একজন মহিলা আছে তাকে বলব বাসায় এসে থাকতে। মেকুকে দেখতে।”
আব্বা ভয়ে ভয়ে বললেন, “সেই মহিলা কী পারবে? মনে আছে মেকু জোড়া পায়ে কেমন লাথি দিয়েছিল তোমার চাচিকে?”
আম্মা ইতস্তত করে বললেন, “পারবে কী না এখনো জানি না। কিন্তু চেষ্টা করে দেখি। যদি রাখতে পারে তা হলে আমি মাঝে মাঝে অফিসে যাব।”
আব্বা মাথা নেড়ে বললেন, “এর চাইতে আমি বাসায় থাকি। অপরিচিত একজন থেকে আমি ভালো পারব।”
আম্মা হেসে বললেন, “তুমি নিশ্চয়ই অনেক ভালো পারবে কিন্তু সেটা তো সমাধান হল না। তোমার ইউনিভার্সিটি ক্লাস সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে বাসায় বসে থাকবে?”
আম্মা মাথা চুলকে বললেন, “ ইউনিভার্সিটির যে অবস্থা যে কোনো সময় সেটা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। সেখানে খালি স্লোগান আর মিছিল।”
“কিন্তু এখনো তো আর বন্ধ হয় নি। আগে বন্ধ হোক, তারপর দেখা যাবে।”
কাজেই পরদিন মেকু আবিষ্কার করল পাহাড়ের মতো বিশাল এক মহিলা তাকে দেখে শুনে রাখতে এসেছে। আম্মা সবকিছু দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “আমার মেকু খুব বুদ্ধিমান ছেলে, দেখবেন কোনো সমস্যা হবে না।”
পাহাড়ের মতো মহিলা বললেন, “আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। ছোট বাচ্চা আমি খুব ভালো দেখতে পারি।”
আম্মা বললেন, ভেরি গুড। আমি তিন ঘণ্টার মাঝে চলে আসব। মেকুকে ভালো করে খাইয়ে দিয়েছি। খিদে লাগার কথা না। তারপরেও যদি লাগে ফ্রিজে দুধ তৈরি করে রাখা আছে। একটু গরম করে –”
মহিলা বাধা দিয়ে বললেন, আমাকে বলতে হবে না। আমি সব জানি। কত বাচ্চা মানুষ করেছি।”
আম্মা বললেন, “তবু বলে রাখছি। বেশি গরম করবেন না। হাতের চামড়ায় লাগিয়ে দেখবেন বেশি গরম হল কি না। মেকু সাধারণত কাপড়ে বাথরুম করে না। যদি তবুও করে ফেলে তা হলে এই কাবার্ডে শুকনো ন্যাপি আছে –”
মহিলা আবার বাধা দিয়ে বললেন, “আমাকে বলতে হবে না। আমি সব জানি। আমি কত বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করেছি।”
“তবু সব কিছু শুনে রাখেন। এই যে আমার অফিসের টেলিফোন নাম্বার। কোন ইমারজেন্সি হলে ফোন করবেন।”
মহিলা হাত নেড়ে বলল, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমি এসব জানি।”
আম্মা বললেন, “আপনার যদি খিদে লাগে, কিছু খাওয়ার ইচ্ছা করে ফ্রিজে খাবার আছে -।”
পাহাড়ের মতো মহিলার চোখ দুটি হঠাৎ করে এক শ ওয়াট লাইট বাল্বের মতো জ্বলে উঠল। সুড়ুৎ করে মুখে লোল টেনে বললেন, “কোথায় ফ্রিজটা? কত বড় ফ্রিজ? কত সি.এফ.টি.?”
আম্মা কিছু বলার আগেই পাহাড়ের মতো মহিলা কুকুর যেভাবে গন্ধ শুঁকে শুঁকে হাড় বের করে ফেলে অনেকটা সেভাবে পাশের ঘরে গিয়ে ফ্রিজটা বের করে ফেললেন। তারপর একটান দিয়ে ফ্রিজের দরজাটা খুলে বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে আম্মার দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসলেন। ফ্রিজের ভেতর রাখা খাবার গুলি দেখে উচ্ছ্বাসিত হয়ে বললেন, মোরগের মাংস, চকলেট কেক, মুড়িঘণ্টা, পাউরুটি, পুডিং, ডাল, সব্জি, কোল্ড ড্রিংস, দই – আ হা হা হা!”
আম্মা কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন মহিলা বাধা দিয়ে বললেন, “আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমার কোনো অসুবিধা হবে না। তিন ঘণ্টা কেন, দরকার হলে আপনি ছয় ঘণ্টা পরে আসেন।”
মাকু লক্ষ্য করল আম্মা চলে যাবার পর পরই মহিলা একটা থালায় চার টুকরা চকলেট কেক, এক খাবলা দই এবং দুইটা মুরগির রান নিয়ে সোফায় বসে টেলিভিশনটা চালিয়ে দিলেন। মেকু জানে তাদের বাসায় একটা টেলিভিশন আছে কিন্তু সেটাকে কখনোই খুব বেশি চালাতে দেখে নি। টেলিভিশনে মোটা মোটা মহিলারা শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে নাচতে লাগল আর মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর মোটা মোটা গোঁফ ওয়ালা মানুষেরা প্রচণ্ড মারপিট করতে লাগল, সেটা দেখতে দেখতে পাহাড়ের মতো মহিলা খেতে লাগলেন। খাওয়া শেষ হলে মহিলা আবার গিয়ে ছয় টুকরো পাউরুটি, আধাবাটি মুড়িঘণ্ট আর বড় এক গ্লাস কোল্ড ড্রিংস নিয়ে বসলেন। সেটা শেষ হবার পর দুইটা বড় বড় কলা আর ছয়টা টোস্ট বিস্কুট খেলেন। তারপর টেলিভিশন দেখতে দেখতে সোফায় মাথা রেখে বাঁশির মতো নাক ডাকতে ডাকতে ঘুমিয়ে গেলেন।
মেকু মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। তার আম্মা যদি এই পাহাড়ের মতো মহিলার হাতে তাকে প্রত্যেক দিন রেখে যান তা হলে বড় বিপদ হবে। মেকুকে প্রত্যেক দিন তাকিয়ে তাকিয়ে মহিলার এই রাক্ষুসে খাওয়া দেখতে হবে। মহিলাকে রাখা হয়েছে মেকুকে দেখে শুনে রাখার জন্য কিন্তু তিনি একবারও তার খাওয়া ছেড়ে এসে মেকুকে দেখেন নি। মেকুর যদি এখানে কোনো বিপদ হত, কিংবা কোনো ছেলেধরা এসে জানালার গ্রিল কেটে তাকে চুরি করে নিয়ে যেত তা হলেও এই মহিলা টের পেতেন না। মহিলা টেলিভিশন চালু করে রেখেছেন মেকুকে সবকিছু শুনতে হচ্ছে আর দেখতে হচ্ছে। কোন সাবার মাখলে গায়ের চামড়া নরম হয়, কোন টুথপেস্ট নিয়ে দাঁত মাজলে দাঁত চকচক করে, কোন পাওডার গায়ে দিলে শরীরে ঘামাচি হয় না মেকুর মুখস্ত হয়ে গেছে। মুখস্ত হয়ে যাওয়া জিনিস বারবার শুনলে মাথার ভিতরে সবকিছু জট পাকিয়ে যায়। কাজেই মেকু সিদ্ধান্ত নিল পাহাড়ের মতো এই মহিলাকে ঘর ছাড়া করতে হবে।
মেকু আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তার কাজ শুরু করে দিল। বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে সে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দিল। সেই চিৎকার এতই ভয়ংকর যে পাহাড়ের মতো মহিলা চমকে উঠে লাফ দিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে টেবিলসহ হুড়মুড় করে নিচে আছাড় খেয়ে পড়লেন। টেবিলের উপর রাখা থালা, বাসন, গ্লাস সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। পাহাড়ের মতো মহিলা কোনো মতে উঠে দাঁড়িয়ে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে মেকুর কাছে এসে হাজির হলেন। মেকু আরো একবার বাঁকা হয়ে গলা ফাটিয়ে দ্বিতীয়বার চিৎকার দিল। মহিলা কী করবে বুঝতে না পেরে হাত বাড়িয়ে মেকুকে কোলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। মেকু হাত পা ছুঁড়তে থাকে এবং মহিলা তার মাঝে সাবধানে কোনো মতে হাচড় পাচড় করে তাকে কোলে তুলে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। মহিলা নেংচাতে নেংচাতে ফ্রিজের কাছে ছুটে গেলেন, দরজা খুলে মেকুর দুধের শিশি বের করে সেটা তার মুখে ঠেসে ধরার চেষ্টা করেন। মেকু শান্ত হয়ে যাবার ভান করে দুধ টেনে মুখ ভর্তি করে পুরোটা মহিলার মুখে কুলি করে দিল। তারপর আবার বাঁকা হয়ে ভয়ংকর চিৎকার শুরু করে দিল। দুধে মহিলার চোখ মুখ ভেসে গেল এক হাতে চোখ মুছে মহিলা কোনোভাবে মেকুকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। ছোট শিশুকে হয়তো কোনোভাবে শান্ত করা সম্ভব কিন্তু যে পণ করেছে শান্ত হবে না তাকে শান্ত করবে সেই সাধ্যি কার আছে?
মহিলা কী করবে বুঝতে না পেরে দুধের শিশিটা দ্বিতীয়বার তার মুখে লাগালেন, মেকুও শান্ত হয়ে মুখ ভরে দুধ টেনে নিয়ে আবার মহিলার মুখে কুলি করে দিল। মহিলা চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না, চোখ বন্ধ করে হাঁটতে গিয়ে নিচে পড়ে থাকা টেবিলে পা বেঁধে হঠাৎ হুড়মুড় করে পড়ে গেলেন। দুই হাতে মেকুকে ধরে রেখেছিলেন – তাকে বাঁচাবেন না নিজেকে রক্ষা করবেন চিন্তা করতে করতে দেরি হয়ে গেল, মেকুকে নিয়ে তিনি ধড়াস করে আছাড় খেয়ে পড়লেন, হাত থেকে মেকু পিছলে বের হয়ে পাশে গড়িয়ে পড়ল। তার বিশাল দেহ নিচে পড়ে যে শব্দ করল তাতে মনে হল পুরো বিল্ডিং বুঝি কেঁপে উঠেছে।
ঠিক এরকম সময় আম্মা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন, প্রথমেই তিনি আবিষ্কার করলেন মেকুকে, সে মেঝেতে উপুর হয়ে শুয়ে চোখ বড় বড় করে তার পাশেই পড়ে থাকা পাহাড়ের মতো মহিলাটিকে দেখছে। আম্মা ছুটে গিয়ে মেকুকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন – তার কাছে মনে হল ঘরটির মাঝে রিক্টর স্কেলে আট মাত্রার একটা ভূমিকম্প ঘটে গেছে। সোফার টেবিলটা ঠিক মাঝখানে ভেঙে দুই টুকরা হয়ে গেছে। চারপাশে ভাঙা কাচের গ্লাস, থালা বাসন এবং বাটি। বাচ্চার দুধের শিশি ভেঙে দুধ ছড়িয়ে আছে। পাহাড়ের মতো বিশাল মহিলা উপুড় হয়ে পড়ে আছে, বেকায়দায় পড়ে গিয়ে কপালের কাছে ফুলে একটা চোখ প্রায় বুজে গিয়েছে। আম্মা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে এখানে?”
মহিলাটি হামাগুড়ি দিয়ে উঠার চেষ্টা করে আবার ধপাস করে পড়ে গেলন। আম্মা তখন ঘুরে মেকুর দিকে তাকালেন, তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “মেকু, তুই করেছিস?”
মেকু কোনো কথা না বলে তার মায়ের চোখের দিকে অপরাধীর মতো তাকিয়ে রইল। আম্মা হতাশভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “মেকু। কাজটা কিন্তু একটুও ভালো করিস নি!”
মেকু তার মাড়ি বের করে হাসল – তার ধারণা অন্যরকম।
সন্ধেবেলা খেতে বসে আবিষ্কার করা হল ফ্রিজে কোনও খাবার নেই সেটা ধু ধু ময়দান। পাহাড়ের মতো মহিলা সেটা পরিষ্কার করে দিয়ে গেছেন। আম্মা একটু ভাত ফুটিয়ে দুটি ডিম ভেজে নিয়ে আব্বাকে নিয়ে খেতে বসলেন। খেতে খেতে তাদের ভেতর যা কথাবার্তা হল মেকু সেটা কান পেতে শুনল। আব্বা বললেন, “তোমার পরিকল্পনাটা তা হলে মাঠে মারা গেল?”
“শুধু মাঠে না, মাঠে-ঘাটে খালে বিলে মারা গেল।”
“বাসার ভিতরে মনে হয়েছে টর্নেডো হয়েছে। ব্যাপারটা কী?”
আম্মা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “তুমি যখন দেখেছ তখন তো আমি পরিষ্কার করে এনেছি। আমি যখন দেখেছি তখন যা অবস্থা ছিল!” আম্মা দৃশ্যটা কল্পনা করে একবার শিউরে উঠলেন।
“কেউ যে ব্যাথা পায় নি সেটাই তো বেশি।”
“কে বলেছে কেউ ব্যাথা পায় নি? সে মহিলা তো ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে বাসায় ফিরে গেল। দুজনে মিলে টেনে রিক্সায় তুলতে হয়েছে।”
আব্বা চিন্তিত মুখে বললেন, “ব্যাপারটা কী হয়েছিল আমাকে বুঝিয়ে বলবে?”
“আমি জানলে, তা হলে তো তোমাকে বলব! অনুমান করছি আমাদের মেকুর কাণ্ড। মেকু কোনো কারণে মহিলাকে অপছন্দ করেছে, ব্যাস!”
“এই টুকুন মানুষ এরকম পাহাড়ের মতন একজন মহিলাকে এভাবে নাস্তানাবুদ করে কীভাবে?”
আম্মা চিন্তিত মুখে বললেন, “সেটাই তো আমার চিন্তা! এই ছেলে বড় হলে কী হবে?”
আব্বা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “তা হলে আমি ধরে নিচ্ছি এখন তোমার মাঝে মাঝে অফিসে যাওয়ার পরিকল্পনাটা বন্ধ?”
আম্মা মাথা নাড়লেন, “উঁহু।”
“মানে?”
“আজকে অফিসে গিয়ে আমার মাথা ঘুরে গেছে। পুরো প্রজেক্টের অবস্থা কেরোসিন। কিছু একটা করা না হলে সব শেষ হয়ে যাবে তখন স্যালাইন দিয়েও বাঁচানো যাবে না।”
আম্মা চিন্তিত মুখে বললেন, “তা হলে কী করবে বলে ঠিক করেছ?”
“কাল থেকে নিয়মিত অফিসে যাব।”
আব্বা আঁতকে উঠে বললেন, “আর মেকু?”
আম্মা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “মেকুকে তো আর বাসায় একা একা রেখে যেতে পারব না। তাকেও নিয়ে যাব অফিসে?”
আব্বা খানিকক্ষণ মুখ হাঁ করে আম্মার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন, “তুমি এত বড় সফটওয়ার কোম্পানির একটা প্রজেক্ট ডিরেক্টর তুমি একটা গ্যাদা বাচ্চাকে বগলে ঝুলিয়ে অফিসে যাবে? বোর্ড অফ ডিরেক্টরের মিটিঙয়ের মাঝখানে মেকু শরীর বাঁকা করে চিৎকার করে উঠবে তখন তুমি তাকে দুধ খাওয়াবে?”
আম্মা গম্ভীর মুখে বললেন, “সেটাই যদি একমাত্র সমাধান হয়ে থাকে তা হলে তো সেটাই করতে হবে।” তারপর এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন, “আর আমার মেকু কখনোই বোর্ড অফ ডিরেক্টরের মিটিঙয়ের মাঝখানে বাঁকা হয়ে চিৎকার করবে না।”
আব্বা আর কিছু বললেন না। চোখ বড় বড় করে আম্মার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেকু বিছানায় শুয়ে হাত শুন্যে ছুঁড়ে দিয়ে মনে মনে বলল, “ইয়েস!”
পরদিন সবাই দেখল আম্মা এক হাতে তার ব্যাগ এবং অন্য হাতে বগলের নিচে মেকুকে ধরে অফিসে গিয়ে ঢুকলেন। অফিসের এক কোণায় একটা চাদর বিছিয়ে সেখানে মেকুকে ছেড়ে দেওয়া হল, তার চারিদিকে বই এবং ফাইল রেখে একটা দেওয়ালের মতো করে দেওয়া হল যেন সে সেখান থেকে বের হয়ে যেতে না পারে। এক মাসের বাচ্চারা সাধারণত নিজে থেকে বেশি নাড়াচাড়া করতে পারে না, কিন্তু মেকুকে কোনো বিশ্বাস নেই। মেকু তার জায়গায় শুয়ে শুয়ে দুই হাতে পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা টেনে এনে মুখে পুরে চুষতে চুষতে আম্মার কাজ কর্ম দেখতে লাগল। আম্মাও মেকুকে নিয়ে সব দুশ্চিন্তা ভুলে কাজ শুরু করে দিলেন।
আম্মা যে কয়দিন ছিলেন না তখন কাজকর্ম কোনদিকে গিয়ে সমস্যাটা তৈরি হয়েছে সেটা বোঝার জন্যে পুরোনো কাগজপত্র ঘাটতে লাগলেন। যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাদের ডেকে কথা বলতে লাগলেন। হই চই চেঁচামেচি দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল এবং কিছুক্ষণের মাঝে পুরো অফিসে একটা নতুন ধরনের জীবন ফিরে এল।

দুপুর বেলা আম্মা মেকুকে বগলে নিয়ে বের হলেন, তাকে খাওয়ানোর সময় হয়েছে, কোনো একটা নিরিবিলি জায়গায় বসে দুধ খাওয়ানোর আগে নিচে ডাটা-এন্ট্রি ঘরে যে সব মহিলারা কাজ করছে তাদের এক নজর দেখে আসতে চান।
নিচের ঘরটিতে প্রায় পঞ্চাশটা কম্পিউটার টার্মিনালের সামনে বসে মহিলারা কাজ করছে, আম্মা ভিতরে ঢুকেছেন সেটা কেউ লক্ষ্য করল না। আম্মা মেকুকে বগলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে তাদের কাজ দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন হঠাৎ করে কমবয়সী একজন তরুণী মাথা ঘুরিয়ে আম্মাকে দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “আপা, আপনি এসেছেন?”
তরুণীর চিৎকার শুনে প্রায় সবাই মাথা ঘুরিয়ে আম্মার দিকে তাকাল, আম্মাকে দেখে তারা আনন্দের একটা শব্দ করল এবং মেকুকে দেখে তারা আনন্দের একটা চিৎকার করল। আম্মা হাসিমুখে তাদের আনন্দটুকু গ্রহণ করে বললেন, “তোমাদের কাজ কর্ম কেমন চলছে?”
সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে । আমতা আমতা করে একজন বলল, “মোটামুটি ভালোই হচ্ছিল, কিন্তু —”
“কিন্তু কী?”
একজন ইতস্তত করে তার সমস্যাটি বলতে শুরু করে তখন আরেক জন তার সমস্যাটা বলতে শুরু করে, সে শুরু করার আগেই আরেক জন তার সমস্যা বলতে শুরু করে এবং কিছুক্ষণের মাঝেই ঘরের সবাই কিছু না কিছু বলতে আরম্ভ করে। আম্মা হাত তুলে থামালেন, বললেন, “মনে হচ্ছে কাজে কিছু সমস্যা আছে।”
সবাই মাথা নাড়লেন। আম্মা বললেন, “সেটা নিয়ে চিন্তা করো না, এখন আমি এসেছি দেখব যেন কোনো সমস্যা না হয়।”
সবাই মিলে আবার একটা আনন্দধ্বনি করল, আনন্দধ্বনিটা নিশ্চয়ই একটু জোরে হয়ে গিয়েছিল কারণ সেটা শেষ হবার সাথে সাথে একটা বাচ্চার কান্না শোনা গেল। আম্মা মাথা ঘুরিয়ে মেকুর দিকে তাকালেন। মেকু নয় অন্য কোনো বাচ্চা কাঁদছে। আম্মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কে, কাঁদে?”
কম বয়সী একটা মেয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়াল, দুর্বল গলায় বলল, “আমার মেয়ে!”
“কোথায় তোমার মেয়ে?”
মেয়েটি নিচু হয়ে তার টেবিলের তলা থেকে একটা বড় কার্ডবোর্ডের বাক্স বের করল, সেখানে কাঁথা মুড়ি দিয়ে একটা ছোট বাচ্চাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। উপস্থিত সবার মুখ থেকে একটা বিস্ময়ের ধ্বনি বের হয়ে আসে। আম্মা কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলেন। কমবয়সী মেয়েটি অপরাধীর মতো মুখ করে বলল, “ভুল হয়ে গেছে আপা, আর কোনোদিন আনব না। আজকের মতো মাপ করে দেন।”
আম্মা কী বলবেন বুঝতে পারলেন না, তিনি নিজের বাচ্চাকে বগলে ধরে আছেন এরকম অবস্থায় আরেক জন মা’কে তার বাচ্চা আনার জন্যে দোষী করতে পারেন না। কার্ডবোর্ডের বাক্সে বাচ্চাটা গলা ফাটিয়ে তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল, এবং সেটা দেখে মেকুকে খুব উত্তেজিত দেখা গেল। সে যে কোনোভাবেই আম্মার বগল থেকে মুক্তি পেয়ে বাচ্চাটার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। আম্মা অবশ্যি মেকুকে ছাড়লেন না, কম বয়সী মা’টিকে বললেন, “তোমার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে শান্ত কর।”
কম বয়সী মা সাথে সাথে নিচু হয়ে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিতেই বাচ্চাটি ম্যাজিকের মতো শান্ত হয়ে গেল। আম্মা সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের আর কতজনের এরকম বাচ্চা আছে?”
পাঁচজন হাত তুলল। আম্মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তাদের কার কাছে রেখে এসেছ?”
একেক জন একেক রকম উত্তর দিল। কেউ নানির কাছে, কেউ পাশের বাসায়, কেউ ছোট মেয়ে কিংবা ছেলের কাছে। শুনে আম্মা লম্বা নিশ্বাস ফেললেন। কাছাকাছি বসে থাকা একজন মহিলা বলল, আমাদের দুইজন কোনো উপায় না দেখে কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছে।
আম্মা মেকুকে বগলে নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়েই একটা বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। বললেন, কাল থেকে সবাই নিজের ছোট বাচ্চাকে নিয়ে আসবে, আমরা নিচে একটা ঘর ঠিক করব সেখানে আমরা সবাই আমাদের ছোট বাচ্চাদের রাখব। আমাদের ভিতর থেকে একজন সেই বাচ্চাদের দেখে রাখবে।”
বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মা এবং অন্য পাঁচ জন আনন্দে এত জোরে চিৎকার করে উঠল যে কোলের বাচ্চাটি ভয় পেয়ে আবার তারস্বরে কাঁদতে শুরু করল।

রাত্রিবেলা আম্মা আব্বাকে বললেন, “মেকুকে দেখে শুনে রাখার সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি।”
আব্বা অবাক হয়ে বললেন, “কীভাবে?”
আম্মা সবকিছু খুলে বলে চিন্তিত মুখে বললেন, “শুধু একটা জিনিস নিয়ে আমার চিন্তা।”
“কী নিয়ে চিন্তা?”
“মেকুকে নিয়ে। সে যে কী অঘটন ঘটাবে কে জানে!”
আম্মা মেকুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে তোর মাথায় কি কোনো দুষ্টু মতলব আছে?”
মেকু কোনো কথা বলল না, মাড়ি বের করে হাসল। আম্মা সেই হাসি দেখে আরো ভয় পেয়ে গেলেন।

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল