স্কুলের নাম পথচারী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

০১.

তোমরা মনে করতে পার এই গল্পটা বুঝি বানানো, কিন্তু আমি আগেই বলে দিই এটা বানানো গল্প না। যে-মানুষগুলিকে নিয়ে এই গল্প তাঁরা নিজেরা আমাকে এই গল্পটা বলেছেন-তারা তো খামোখা আমার কাছে গুলপট্টি মারবেন না! আমার অবিশ্যি নিজে থেকে তোমাদের এই কথাটা বলে দেয়ার কোনো দরকার ছিল, না কারণ তোমরা একটু শুনলেই বুঝতে পারবে এর মাঝে কোনো ফাঁকিঝুঁকি নেই।

যেই মানুষগুলিকে নিয়ে এই গল্প তার প্রথমজনের নাম ফরাসত আলি। ফরাসত আলি মানুষটার মাঝে কোনো মারপ্যাঁচ নেই। তিনি বেশি মোটাও না আবার তিনি বেশি শুকনোও না। তিনি বেশি লম্বাও না আবার বেশি খাটোও না। তিনি বেশি বোকাও না আবার বেশি চালাকও না। তাকে যদি তোমরা কোনোদিন রাস্তায় দেখ হয়তো বুঝতেই পারবে না যে মানুষটা ফরাসত আলি। কিন্তু যারা তাকে চেনে তাদের বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না, তার এক নম্বর কারণ ফরাসত আলির একটা মজার অভ্যাস আছে। প্রত্যেক বছর যখন খুব গরম পড়ে ফরাসত আলি তখন চুল-দাড়ি কামিয়ে পুরোপুরি ন্যাড়া হয়ে যান, তখন তাকে দেখায় মুসোলিনির মতো। আবার যখন শীত পড়তে শুরু করে তখন তিনি দাড়িগোঁফ কামানো বন্ধ করে দেন আর তখন তাঁকে দেখায় কাল মার্ক্সের মতো।

গত বছর শীতের শেষে যখন গরম পড়তে শুরু করেছে তখন একদিন ফরাসত আলির চুল-দাড়ি কুটকুট করতে শুরু করল, তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর চুল-দাড়ি কাটার সময় হয়েছে। তখন-তখনই তিনি তার নাপিতের দোকানে রওনা দিলেন, গিয়ে দেখেন সেখানে লম্বা লাইন। কোনো কারণে সবাই সেদিন চুল কাটাতে এসেছে। কতক্ষণ আর ফরাসত আলি বসে থাকবেন তাই তিনি দোকানে গেলেন একটা রেজর কিনতে।

বড় মনোহারী দোকান, খদ্দেরের খুব বেশি ভিড় নেই। ফরাসত আলি দোকানিকে বললেন, “ভাই, ভালো দেখে একটা রেজর দেন দেখি।”

দোকানি মানুষটা অবাক হয়ে বলল, “সত্যি?”

ফরাসত আলি ঠিক বুঝতে পারলেন না দোকানি এত অবাক হল কেন, তবুও মাথা নেড়ে বললেন, “সত্যি।”

দোকানি তার বাক্স খুলে কী-একটা কাগজ বের করে সেখানে কীসব লেখালেখি করতে শুরু করল। ফরাসত আলি ঠিক বুঝতে পারলেন না কী হচ্ছে, তবু তিনি ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। দোকানি অনেকক্ষণ লেখালেখি করে তাঁকে কয়েকটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এই যে নেন, একশোটা।”

“একশোটা কী?”

“লটারির টিকেট।” ফরাসত আলি অবাক হয়ে বললেন, লটারির টিকেট?”

“হ্যাঁ। একটা পাঁচ টাকা করে একশোটার দাম পাঁচশো টাকা।”

ফরাসত আলি ঠিক বুঝতে পারলেন না কী হচ্ছে, তিনি মাথা নেড়ে বললেন, “কিন্তু লটারির টিকেট কেন?”

দোকানি অবাক হয়ে বলল, “এই যে আপনি চাইলেন!”

“আমি চাইলাম?”

“হ্যাঁ–”

”কখন?”

“এই তো এক্ষুনি। বললেন একশোটা লটারির টিকেট।”

“মোটেই না! আমি বলেছি রেজর। দাড়ি কামানোর রেজর।”

দোকানি চোখ কপালে তুলে বলল, “রেজর? আপনি মোটেও রেজর বলেননি। বলেছেন একশোটা লটারির টিকেট।”

ফরাসত আলি মুখ শক্ত করে বললেন, “আমি বলি নাই।”

“বলেছেন।” দোকানি তখন আশেপাশে দাঁড়ানো লোকজনকে সাক্ষী মানতে শুরু করল, “ইনি বলেছেন না?”

উপস্থিত লোকজন তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেল। এক ভাগ বলল, বলেছেন, এক ভাগ বলল বলেন নাই, অন্য আরেক ভাগ বলল, তিনি হয়তো বলেছেন ‘রেজর’ কিন্তু তার মুখে এত দাড়ি-গোঁফ থাকায় সেটা শোনা গেছে লটারির টিকেট’। সেটা কীভাবে সম্ভব ফরাসত আলি ঠিক বুঝতে পারলেন না, কিন্তু তিনি সেটা নিয়ে মাথা-ঘামালেন না। খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, “ঠিক আছে, আমি কী বলেছি আর আপনি কী শুনেছেন সেটা নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই। আমি লটারি খেলি না, আমার লটারির টিকেটের দরকার নেই। আমাকে আমার রেজর দেন, আমি যাই।”

দোকানি মুখ কালো করে বলল, “কিন্তু লটারির টিকেট সাইন হয়ে গেলে ফেরত নেওয়ার নিয়ম নেই। এখন এইগুলি আপনাকে নিতেই হবে।”

“কিন্তু আমি লটারি খেলি না।”

“একবার খেলে দেখেন। ভাগ্যের ব্যাপার, লেগে গেলে এক ধাক্কায় তিরিশ লাখ টাকা। তা ছাড়া টিকেট সাইন হয়ে গেছে, এখন তো নিতেই হবে।”

ফরাসত আলি একবার ভাবলেন রেগে যাবেন, কিন্তু তিনি কখনোই বেশি রেগে যান না, তাই এবারেও বেশি রাগলেন না, মেঘস্বরে বললেন, “যদি না নিই?”

দোকানি তখন খুব মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “তা হলে সবগুলি আমার নিজের কিনতে হবে। আমি গরিব মানুষ, খামোখা এতগুলি লটারির টিকেট কিনে

কী করব?”

ফরাসত আলি কী ভেবে লটারির টিকেটগুলি নিলেন। মানিব্যাগে সেদিন পাঁচশো টাকা ছিল, দুদিন আগেই বেতন পেয়েছেন। পাঁচশো টাকা এভাবে বের হয়ে যাবার পর তার সারা মাসে টাকার টানাটানি হয়ে যাবে, কিন্তু এখন কিছু করার নেই। টাকা গুনে ফরাসত আলি যখন বের হয়ে আসছিলেন দোকানি জিজ্ঞেস করল, “রেজর নিবেন না?”

ফরাসত আলি কোনো কথা না বলে মাথা নাড়লেন, তার এখন আর রেজর কেনার ইচ্ছা নেই। তা ছাড়া তাঁর ভয় হচ্ছিল তিনি যদি মুখ ফুটে কিছু-একটা বলেন দোকানি সেটাকে অন্যকিছু একটা শুনে ফেলে আবার তাঁকে কিছু-একটা গছিয়ে দেবে। তিনি যখন বের হয়ে আসছিলেন দোকানি নরম গলায় বলল, “স্যার, রাগ হবেন না আমার উপর। এই লটারির টাকায় ঘূর্ণিঝড়ের আশ্রয় কেন্দ্র বানানো হবে। যদি লটারি না জেতেন মনে করবেন সকাজে দান করলেন। তা ছাড়া লটারির টিকেট সবাই কিনতে চায়-আপনি যদি নিজে একশোটা রাখতে না চান বন্ধুবান্ধবের কাছে বিক্রি করতে পারেন, দেখবেন একেবারে ইলিশ মাছের মতো বিক্রি হয়ে যাবে।”

ফরাসত আলি প্রথম কয়েকদিন তাঁর লটারির টিকেট বিক্রি করার চেষ্টা করলেন কিন্তু সেগুলি ইলিশ মাছের মতো বিক্রি হল না। রইসউদ্দিন নামে তাঁর একজন প্রফেসর-বন্ধু আছে, তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ভুল করে আমি একশোটা লটারির টিকেট কিনে ফেলেছি। তুমি কি কয়টা কিনতে চাও?

তাঁর প্রফেসর-বন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, “নাম্বার কত?”

“নাম্বার?”

“হ্যাঁ।”

“কিসের নাম্বার?”

“লটারির টিকেটে সবসময় নাম্বার থাকে জান না?”

ফরাসত আলি তখন টিকেটগুলি বের করে নাম্বার দেখলেন। প্রথমটার নাম্বার চ-১১১১১১১১। তার বন্ধু রইসউদ্দিন নাম্বারটা দেখে গম্ভীর হয়ে বললেন, “জাল টিকেট।”

“জাল?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“কখনো লটারির টিকেটের নাম্বার এরকম হয় না। চ-এর পরে আটটা এক এটা অসম্ভব ব্যাপার। আমি অঙ্কের প্রফেসর, আমি এসব জানি। পোভাবিলিটি বলে একটা কথা আছে তার নিয়ম অনুযায়ী এটা অসম্ভব।”

ফরাসত আলি সেটা নিয়ে বেশি তর্ক করলেন না। তিনি অঙ্ক ভালো বোঝেন না। পরদিন তাঁর দেখা হল এমাজউদ্দিনের সাথে, এমাজউদ্দিন তার বেশ

অনেকদিনের বন্ধু, কাস্টমসে চাকরি করে। ফরাসত আলি বললেন, “আমার কাছে কিছু লটারির টিকেট আছে, ভুল করে কিছু কিনে ফেলেছি। তুমি কি কয়েকটা কিনতে চাও?”

“কত টাকার লটারি?”

ফরাসত আলি মাথা চুলকে বললেন, “মনে হয় তিরিশ লাখ টাকার।”

এমাজউদ্দিন তার বিদেশি সিগারেটে টান দিয়ে বললেন, “মাত্র তিরিশ লাখ? বেশি টাকা না হলে আমি লটারি খেলি না।”

ফরাসত আলি ভয়ে ভয়ে বললেন, “তিরিশ লাখ টাকা বেশি হল না?”

ধুর! তিরিশ লাখ একটা টাকা হল নাকি? এক দুই লাখ টাকা তো আমার হাতের ময়লা।”

ফরাসত আলির কাস্টমসের বন্ধু এমাজউদ্দিন একটু পরে বললেন, “আর তুমি কেমন করে জান এটা তিরিশ লাখ টাকার লটারি? হয়তো আরও কম।”

ফরাসত আলি মাথা চুলকে বললেন, “কম হওয়ার তো কথা না। একটা টিকেটের নাম্বার চ, তার পরে আটটা এক। এত বড় যদি নাম্বার হয় তার মানে অনেক বড় লটারি–”

এমাজউদ্দিন সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “এগুলি লোক-ঠকানোর বুদ্ধি-মনে হয় সস্তা লটারি। হাজার দুই হাজার টাকার! হা হা হা–”

ফরাসত আলি তবু হাল ছাড়লেন না। তাঁর একজন ডাক্তার-বন্ধু আছেন, তাঁকেও একদিন জিজ্ঞেস করলেন, “আমার কাছে কিছু বাড়তি লটারির টিকেট আছে, তুমি কি কিনতে চাও?”

তাঁর ডাক্তার-বন্ধুর নাম তালেব আলি, তিনি হেহে করে হেসে বললেন, “রইসউদ্দিন আমাকে বলেছে, তুমি নাকি অনেকগুলি জাল টিকেট নিয়ে ফেঁসে গেছ! টিকিটের নাম্বার নাকি চ, তার পরে আটটা এক! রইসউদ্দিন অঙ্কের প্রফেসর–আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে জাল টিকেটে সবসময় এরকম নাম্বার হয়। সত্যিকার টিকেটে নাম্বারগুলি হয় সব সংখ্যা দিয়ে!”

ফরাসত আলি শেষ চেষ্টা করলেন তাঁর অ্যাডভোকেট-বন্ধু আব্বুল করিমের কাছে। আব্বুল করিম মাথা নেড়ে বললেন, “আমার সাথে এমাজউদ্দিনের দেখা হয়েছিল। এমাজউদ্দিন বলেছে এটা নাকি কম পয়সার লটারি, এই টিকেট কেনা মানে মাছি মেরে হাত কালো করা।”

ফরাসত আলি তখন হাল ছেড়ে দিলেন। একবার ভাবলেন রেগেমেগে টিকেটগুলি নর্দমায় ফেলে দেবেন, কিন্তু কী ভেবে শেষ পর্যন্ত ফেললেন না, তোশকের নিচে রেখে দিলেন। সেদিন রাতে তাঁর বন্ধু ফারুখ বখতের সাথে দেখা হল। ফারুখ বখত তার ছেলেবেলার বন্ধু, ভবিষ্যতে কী করবেন সেটা নিয়ে সবসময় চিন্তাভাবনা করেন বলে এমনিতে বিশেষ কাজকর্ম করার সময় পান না। তিনি অসম্ভব শুকনো, মাথার চুলগুলি ঝোড়োকাকের মতে, মুখে বেমানান অনেক বড় বড় গোঁফ। এমনিতে তাকে দেখলে মনে হয় বুঝি অনেক রাগী কিন্তু ফারুখ বখত খুব ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ। ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি একেবারে ছেলেবেলার বন্ধু বলে একজন আরেকজনকে তুই তুই করে বলেন। ফরাসত আলিকে দেখে তিনি একগাল হেসে বললেন, “ফরাসত, তুই নাকি অনেকগুলি লটারির টিকে কিনে ফেঁসে গেছিস?”

“তুই কেমন করে জানিস?”

“সবাই জানে! রইসউদ্দিন বলেছে। এমাজউদ্দিন বলেছে। একটা টিকেটের নাম্বার নাকি চ ১১১১১১১১?”

ফরাসত আলী মাথা নাড়লেন, বললেন, “হ্যাঁ!”

“একশোটা টিকেট তুই কেন কিনলি?”

ফরাসত আলি তখন তাঁকে সবকিছু খুলে বললেন-কেমন করে তাঁকে লটারির টিকেট কিনতে হল তার পুরো বৃত্তান্ত। সব শুনে ফারুখ বখত বললেন, “মন খারাপ করিস না। ধরে নে টাকাটা দান করেছিস। লটারির টাকা দিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের আশ্রয় কেন্দ্র বানানো হবে, অনেক বড় সৎকাজ।”

“তবুও এতগুলি টাকা খামোখা”

“ঠিক আছে পঞ্চাশটা আমাকে দিস।”

“পঞ্চাশটা?”

“হ্যাঁ। বাকিতে। এখন পকেটে টাকা নেই, যখন হবে দিয়ে দেব।”

.

পরের শনিবার ব্যাপারটা ঘটল। অঙ্কের প্রফেসর রইসউদ্দিন সকালে খবরের কাগজ খুলে দেখলেন লটারির ফল বের হয়েছে। প্রথম পুরস্কার তিরিশ লাখ টাকা যে-টিকেটটা লটারী পেয়েছে তার নাম্বার চ ১১১১১১১১! চ-য়ের পর আটটা এক। অঙ্কের প্রফেসর দুইবার গুনে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন।

তার স্ত্রী চোখে মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে তার জ্ঞান ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে গো? রাডপ্রেশারটা আবার বেড়েছে?”

রইসউদ্দিন বুক চাপড়ে বললেন, “না গো ব্লাডপ্রেশার না! ত্রিশ লাখ টাকা এই হাতের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে গেছে। ত্রিশ লাখ টাকা!”

“কেমন করে?”

রইসউদ্দিন তখন তাঁর স্ত্রীকে সবকিছু খুলে বললেন, শুনে তাঁর স্ত্রী মাথা ঘুরে পড়ে যেতে যেতে কোনোমতে একটা চেয়ার ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “এখনও সময় আছে–

“কী সময়?”

“ফরাসত আলি সাদাসিধে মানুষ, এখনও নিশ্চয়ই খোঁজ পায়নি। দৌড়ে তার বাসায় গিয়ে দ্যাখো টিকেটগুলি কিনে আনতে পার কি না–”

“রইসউদ্দিন তখনই ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠে বললেন, ঠিক বলেছ। তুমি ঠিক বলেছ।”

তিনি তখন লাফিয়ে উঠে কোনোমতে জামাকাপড় পরে ছুটলেন ফরাসত আলির বাড়িতে। তাঁর স্ত্রী পিছন থেকে চিৎকার করে বললেন, “খালিহাতে যেও

খবরদার! দুই কেজি মিষ্টি কিনে নিয়ে যেও।”

ফরাসত আলি অনেক দেরি করে ঘুম থেকে উঠে মাত্র এক কাপ চা তৈরি করে চুমুক দিয়েছেন ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল। দরজা খুলে দেখেন তাঁর বন্ধু রইসউদ্দিন, হাতে মিষ্টির বাক্স। তিনি অবাক হয়ে বললেন, “আরে প্রফেসর সাহেব! কী মনে করে?”

রইসউদ্দিন আমতা আমতা করে বললেন, “এই তো মানে ইয়ে ভাবলাম অনেকদিন দেখা হয় না।”

“এই তো সেদিন দেখা হল, মনে নেই? লটারির টিকেট

“ও! হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, প্রফেসর রইসউদ্দিন অনেকবার মাথা নেড়ে বললেন, সেদিন তুমি বললে তাই ভাবলাম তোমার কাছ থেকে লটারির টিকেটগুলি কিনেই নিই।”

ফরাসত আলি খুশি হলে বললেন, “কিনবে?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, কিনব।”

“কয়টা?”

“তুমি যদি বল তাহলে সবগুলি।”

“সবগুলি?” ফরাসত আলি একটু অবাক হলেন এবং তার হঠাৎ একটু সন্দেহও হল। জিজ্ঞেস করলেন, “সবগুলি কিনবে?”

“হ্যাঁ। এত একটা ভালো কাজের জন্যে লটারি।”

“কিন্তু সেদিন তুমি না বললে জাল?”

“জাল হলে হবে! রইসউদ্দিন উদারভাবে হেসে বললেন, ভালো কাজে জাল জুয়াচুরির ভয় করতে হয় না।

ফরাসত আলি বললেন, “ঠিক আছে তুমি যদি কিনতে চাও কেনো।” তিনি গিয়ে তার ভোশক তুলে দেখলেন টিকেটগুলি নেই। তখন মনে পড়ল দুদিন আগে তোশকগুলি রোদে দিয়েছিলেন, তখন লটারির টিকেটগুলি বের করে একটা বইয়ের মাঝে রেখেছিলেন। কোন বইয়ের মাঝে রেখেছিলেন সেটা এখন মনে করতে পারলেন না। ফরাসত আলি খানিকক্ষণ কয়েকটি বইয়ের মাঝে খুঁজে হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “ধুর, এখন খোঁজাখুঁজি করতে ইচ্ছে করছে না। তুমি বিকেলবেলা এসো আমি খুঁজে বের করে রাখব।”

রইসউদ্দিন ফরাসত আলির দুই হাত ধরে প্রায় কেঁদে ফেলে বললেন, “সত্যি? সত্যি?”

ফরাসত আলি একটু অবাক হয়ে বললেন, “সত্যি।

রইসউদ্দিন তখন তার পকেট থেকে পাঁচশো টাকা বের করে ফরাসত আলির হাতে দিয়ে বললেন, “এই যে, একটা টিকেট পাঁচ টাকা করে একশোটা টিকেটের জন্যে পাঁচশো টাকা।”

ফরাসত আলি টাকাটা খানিকক্ষণ হাতে রেখে আবার কী মনে করে রইসউদ্দিনকে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, “এখন দিতে হবে না, বিকালে দিও?”

রইসউদ্দিন খানিকক্ষণ ঝোলাঝুলি করে শেষ পর্যন্ত বিদায় নিলেন। ফরাসত আলি দরজা বন্ধ করে ফিরে আসছিলেন তখন আবার দরজায় শব্দ হল, দরজা খুলে দেখেন তার কাস্টমসের বন্ধু এমাজউদ্দিন। এমাজউদ্দনের হাতে একটা বিশাল রুইমাছ। ফরাসত আলি অবাক হয়ে বললেন, “আরে এমাজউদ্দিন, তুমি

এত বড় রুইমাছ নিয়ে কোথায় যাও?”

“তোমার কাছে এসেছি। ভাবলাম অনেকদিন দেখা নেই, একটু দেখা করে আসি।”

“কে বলল দেখা নেই? এই তো সেদিন দেখা হল!”

“তা বটে!” এমাজউদ্দিন একটু বোকার মতো হেসে হাতের মাছটা দেখিয়ে বললেন, “সস্তায় পেয়ে গেলাম মাছটা, তোমার জন্যে নিয়ে এলাম।”

ফরাসত আলি বললেন, “কী আশ্চর্য! আজকে সবাই দেখি আমার জন্যে কিছু-না-কিছু নিয়ে আসছে!”

এমাজউদ্দিন ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠে বললেন, “আর কে এসেছে?”

“প্রফেসর রইসউদ্দিন।” এমাজউদ্দিন ছোট ছোট চোখ করে জিজ্ঞেস করলো, “কেন এসেছিল?”

“লটারির টিকেট কিনতে।”

“তু-তু-তুমি দিয়ে দিয়েছ?”

“এখনও দিইনি।”

এমাজউদ্দিন একবারে হাতজোড় করে বললেন, “রইসকে দিও না, প্লিজ আমাকে দাও। আমি সবগুলি কিনে নেব ডবল দাম দিয়ে। এই দ্যাখো নগদ দিয়ে দিচ্ছি”

এমাজউদ্দিন পকেট থেকে টাকা বের করছিলেন ফরাসত আলি তাঁকে থামালেন, বললেন, “এখন দেয়ার দরকার নেই, বিকেলবেলা দিও। আমি আগে টিকেটগুলি খুঁজে বের করে রাখি।”

এমাজউদ্দিন ফরাসত আলির দুই হাত ধরে প্রায় কেঁদে ফেলে বললেন, “দেবে তো আমাকে টিকিটগুলি? দেবে তো?”

ফরাসত আলি চিন্তিত মুখে বললেন, “দেখি।”

এমাজউদ্দিন চলে যাবার পর দরজা বন্ধ করার আগেই ফরাসত আলি দেখতে পেলেন ডাক্তার আবু তালেব আর অ্যাডভোকেট আব্বুল করিম হন্তদন্ত হয়ে আসছেন। আবু তালেবের পিছনে একটা ছোট ছেলে, তার মাথায় একঝাঁকা কমলা। আব্বুল করিমের হাতে একটা প্যাকেট, প্যাকেটের ভিতরে কি বোঝা যাচ্ছে না তবে দোকানের নাম দেখে বোঝা যাচ্ছে ভিতরে নিশ্চয়ই নতুন শার্ট। দুজনের মুখেই একধরনের বিগলিত হাসি এবং তারা কিছু বলার আগেই ফরাসত আলি টের পেয়ে গেলেন তারা কী বলবেন।

হঠাৎ করে তার একটা বিচিত্র সন্দেহ হতে শুরু করল।

.

ফারুখ বখত সবসময় খবরের কাগজ খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন, কিছুই ছেড়ে দেন না। হারানো বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে স্বপ্নপ্রদত্ত ঔষধ, মশাল মিছিল থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি সবকিছু তিনি খুব শখ করে পড়েন। তিনি কিছুই বাদ দেন না বলে লটারির টিকেট পর্যন্ত যেতে তার একটু দেরি হল কিন্তু যেই তিনি বিজয়ী টিকেটের নাম্বারটি পড়লেন তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। নাম্বারটি দ্বিতীয়বার পড়ে তিনি চিৎকার করে লাফিয়ে উঠলেন, তারপর খরের কাগজটা হাতে নিয়ে সেই অবস্থায় ফরাসত আলির বাসার দিকে ছুটতে শুরু করলেন। বড় রাস্তার মোড়ে এসে তার একটা স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেল, তিনি বটা ফেলে এক পায়ে স্যান্ডেল পরে ছুটতে লাগলেন। খানিকক্ষণ পর অন্য স্যান্ডেলের ফিতা খুলে গেল, তিনি তখন সেটা ছুঁড়ে ফেলে খালিপায়ে ছুটতে লাগলেন। স্কুলের কাছে এলে তার শার্ট একটা দোকানের ঝাঁপিতে লেগে পটপট করে সবগুলি বোতাম ছিঁড়ে গেল, তিনি হৃক্ষেপ করলেন না। বাজারের কাছে আসতেই ঘেয়ো কুকুরগুলি ঘেউঘেউ করে তাঁকে খানিকক্ষণ তাড়া করল, তিনি সেটা টেরও পেলেন না। দৌড়ে ফারুখ বখত যখন ফরাসত আলির বাসার কাছে পৌঁছালেন তখন তার লুঙ্গি খুলে এল। তিনি দুই হাতে লুঙ্গি শক্ত করে ধরে ছুটতে ছুটতে কোনোরকমে তার বাসায় পৌঁছলেন। ফরাসত আলির দরজা খোলা ছিল, তিনি ভিতরে ঢুকে দড়াম করে মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়লেন।

ফরাসত আলি শব্দ শুনে ছুটে এসে ফারুখ বখতকে এভাবে দেখে একেবারে আঁতকে উঠলেন। একটা হাতপাখা এনে বাতাস করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন, “ফারুখ কী হয়েছে? কী হয়েছে তোর?”

ফারুখ বখত বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে বললেন, “ল-ল-ল-”

“ল-ল-ল–কী?”

ফারুখ বখত আরও খানিকক্ষণ নিঃশ্বাস নিয়ে কোনোমতে বললেন, “টা-টা টা–”

ফরাসত আলি কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তার ছেলেবেলার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফারুখ বখত সবসময়েই একটু পাগলাটে ছিলেন, ফরাসত আলির সন্দেহ হতে লাগল হয়তো এখন পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছেন।

মিনিট পাঁচেক পর ফারুখ বখত ধাতস্ত হয়ে বললেন, “লটারি-লটারি?”

“লটারি?”

“হ্যাঁ। তোর লটারির টিকেট–”

”কি হয়েছে আমার লটারির টিকেট?”

”তোর টিকেট তিরিশ লক্ষ টাকা জিতেছে।”

শুনে ফরাসত আলি মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলেন, কোনোমতে ফারুখ বখতকে ধরে সামলে নিলেন। বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, “কী বললি? কী বললি?”

“তুই তিরিশ লক্ষ টাকা জিতেছিস লটারিতে!”

“সত্যি?”

“সত্যি। এই দ্যাখ খবরের কাগজে উঠেছে! চ ১১১১১১১১।”

ফরাসত আলি খবরের কাগজটা দেখে মাটিতে বসে পড়লেন। তাঁর হাত অল্প অল্প কাঁপতে লাগল, তাঁকে দেখে মনে হতে লাগল তার শরীর খারাপ হয়ে গেছে, এখনই বুঝি হড়হড় করে বমি করে দেবেন। দেখে ফারুখ বখত একটু ঘাবড়ে গেলেন, ফরাসত আলিকে আস্তে একটু ধাক্কা দিয়ে বললেন, “কী হল তোর?”

ফরাসত আলি ফ্যালফ্যাল করে ফারুখ বখতের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফারুখ বখত তার ঘাড়ে একটা থাবা দিয়ে বললেন, “একটু আনন্দ কর! তুই এখন তিরিশ লক্ষ টাকার মালিক।

“তি-তি-তিরিশ লক্ষ? এত টাকা দিয়ে আমি কী করব?”

“ধুর গাধা! টাকা দিয়ে মানুষ আবার কী করে! তুই খরচ করবি।”

“তিরিশ লক্ষ টাকা আমি খরচ করব? আমি একা?” ফরাসত আলি একেবারে কাঁদোকাঁদো হয়ে গেলেন, ফারুখ বখতের দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বললেন, “তুই অর্ধেক নিবি?”

“আ-আ-আমি।”

“হ্যাঁ।”

“আমি কেন?”

“তুই আমার বন্ধু সেজন্যে! তা ছাড়া তুই বলেছিলি তুই অর্ধেক লটারির টিকেট কিনবি, মনে নেই? তোর ন্যায্য পাওনা! নিবি তুই, অর্ধেক টাকা?”

ফারুখ বখত বুঝলেন বেশি উত্তজনায় তাঁর বন্ধুর মাথার ঠিক নেই। তিনি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে তুই যদি দিতে চাস দিবি।”

ফরাসত আলি তখন মনে হয় বুকে একটু জোর পেলেন। ফারুখ বখতের হাত ধরে বললেন, “তুই কথা দে।”

এখানে আবার কথা দেওয়া না-দেওয়ার কী আছে? তিরিশ লক্ষ টাকা দিয়ে কত কী করা যায়, তুই এত ঘাবড়াচ্ছিস কেন? তুই কিছু চিন্তা করিস না, আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। দরকার পড়লে আমি তোর সব টাকা খরচ করিয়ে দেব।”

“সত্যি দিবি? বুক ছুঁয়ে বল।”

“সত্যি দেব। এই দ্যাখ বুক ছুঁয়ে বলছি।”

ফরাসত আলি তখন প্রথমবার একটু হেসে উঠে দাঁড়ালেন। ফারুক বখতও তখন উঠে দাঁড়াতে গিয়ে ঊরু চেপে ধরে বসে পড়লেন, দৌড়াদৌড়ি করে অভ্যাস নেই বহুদিন, হঠাৎ এতটুকু পথ দৌড়ে এসে তার পায়ের মাংসপেশিতে কোথায় জানি টান পড়েছে। একপায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে একটা চেয়ারে বসে তিনি ঘরের চারিদিকে তাকালেন। চারপাশে মিষ্টির বাক্স, রুইমাছ, কমলার আঁকা আর উপহারের বাক্স। ফারুখ বখত জিজ্ঞেস করলেন, “এগুলি কী?”

“উপহার।”

“কার জন্যে উপহার?”

“আমার জন্যে। ফরাসত আলি মিটিমিটি হাসতে হাসতে বললেন, “আগে বুঝতে পারিনি কেন, এখন বুঝেছি। সবাই উপহার নিয়ে এসেছে আমার লটারির টিকেট কিনতে।”

ফারুখ বখত ভয়ে ভয়ে বললেন, “বিক্রি করে দিসনি তো?”

“না, দিইনি! একটা বইয়ের মাঝে রেখেছিলাম, বইটা তখন খুঁজে পাইনি, কপাল ভালো!”

“এখন পেয়েছিস?”

“হ্যাঁ। এই দ্যাখ।”

দুজন মিলে তারা তখন ছোট লটারির টিকেটটার দিকে তাকিয়ে রইলেন, এইটুকু একটা কাগজ, কিন্তু সেটার দাম এখন তিরিশ লক্ষ টাকা বিশ্বাস হতে চায় না।

ফরাসত আলি খানিকক্ষণ পর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “বিকালবেলা সবাই আসবে টিকেট কিনতে। এখন কী করি?”

ফারুক বখত দাঁত বের করে হেসে বললেন, “দাঁড়া, ব্যাটাদের দেখাই মজা! কত বড় জোচ্চোর–তোর কাছ থেকে ঠকিয়ে লটারির টিকেটটা কিনে নিতে চাইছিল!”

“কী করবি?”

“আগে চল টিকেটটা সেফ ডেপোজিট বক্সে জমা দিয়ে আসি। আর দরজায় একটা চিঠি লিখে রেখে যা যে তুই লটারির টিকেটগুলি একটা খামে ভরে টেবিলের উপর রেখে যাচ্ছিস সবাই মিলে যেন ভাগাভাগি করে নেয়।”

.

সেদিন বিকালবেলা একটা এ্যাম্বুলেন্স প্রফেসর রইসউদ্দিন, কাস্টমসের এমাজউদ্দিন, ডাক্তার তালেব আলি তার অ্যাডভোকেট আবদুল করিমকে ফরাসত আলি বাসা থেকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। তারা একজন আরেকজনের সাথে মারপিট করে রক্তারক্তি অবস্থা করেছেন। যারা ব্যাপারটা দেখেছে তারা বলেছে নিজের চোখে না দেখলে এই দুর্ধর্ষ মারপিট নাকি বিশ্বাস করা শক্ত। একটা খাম নিয়ে একজন নাকি আরেকজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন, কিল-ঘুষি-চড়-লাথি মেরে খামচি দিয়ে চুল টেনে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। পাড়ার ছেলেরা এসে অনেক কষ্টে তাদের আলাদা করে হাসপাতালে এ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করেছে।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল