০৫. খেলা

আমাদের স্পুটনিক বয়েজ ক্লাব তখন ভীষণ তুখোড় হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে কাসেম চলে আসার পর। বেশ কিছুদিন চলে যাবার পর আমরা কাসেমকে ভূতের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ খুলে বলেছিলাম, কিন্তু ততদিনে সে আমাদের ডিটেকটিভ ক্লাবের মেম্বার, ব্ল্যাক মার্ডারের রক্ত শপথ করা সদস্য, স্পুটনিক বয়েজ ক্লাবের ভাইস ক্যাপ্টেন! কাজেই ওর আমাদের টিম ছেড়ে চলে যাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। বরং ও সবকিছু শুনে ভারি মজা পেল। হাজার হলেও শুধু ওকে দলে টানার জন্যে আমরা এতটা করেছি। ও নিজে ভয় পেয়েছে বলে তার বিশেষ লজ্জা নেই, আক্কাসকে জব্দ করেছি বলেই খুশি!

এখন সলিল কাসেম আর রবিন সেন্টার ফরোয়ার্ড-এ খেলে। হীরা ব্যাকে খেলে। সাতজনে টিম – নান্টু আর মিশু রাইট আউট, লেফট আউট, আমি গোলকীপার। ঠাকুরপাড়াকে হারিয়ে দিতে পারলেই আমরা এ শহরের সেরা টিম হয়ে যেতে পারি। কাজেই আক্কাস যেদিন ঠাকুরপাড়ার হয়ে আমাদের সাথে খেলার একটা দিন তারিখ ঠিক করতে আসল, আমরা খেলতে রাজি হয়ে গেলাম। চেয়ার টেবিলে বসে রীতিমত কাগজে সই করে দুই ক্যাপ্টেন খেলার দিন তারিখ ঠিক করল। ঠিক হল আমাদের স্কুল টীমের ক্যাপ্টেন হবে সেদিনের রেফারী।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে সবাই দেখতে পেল সমস্ত পাড়া পোস্টারে ভরে গেছে। আমরা রাত জেগে ওসব তৈরি করেছি। পোস্টারে খেলার তারিখ, স্থান, সময় ইত্যাদির পর সবাইকে খেলা দেখতে আসার জন্যে অনুরোধ জানানো হয়েছে। সব দেখেশুনে সলিল বলল, সবাইকে তো আসতে বলা হল, যদি হেরে যাই?

ইহ! হারব কেন? রবিন একটু পরে বিড়বিড় করে বলল, আসলে নিজের পাড়ার ছেলেমেয়েরা না থাকলে আনন্দ পাওয়া যায় না।

.

যেদিন খেলা সেদিন বিকালে আমাদের পাড়ার সব ছেলেমেয়ে মাঠে এসে হাজির হল। তারা চেঁচামেচি করে মাঠ গরম করে রাখল। একটু পরে দেখি হীরু ভাই, শফিক ভাই— তারাও এসেছেন। আরেকটু পরে রবিনের আব্বাও গুটি গুটি হাঁটতে হাঁটতে হাজির হলেন, তার সাথে সলিলের আব্বা তার পিছু পিছু আমার আব্বাও। এদিকে ঠাকুরপাড়ার টিম এসে হাজির হল। তাদের সাথে তাদের পাড়ার ছেলেরা। ওরা মাঠের উল্টো দিক দখল করে বসল। রেফারীও এসে গেছে, আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। উত্তেজনায় আমাদের বুক ঢিপঢিপ করছে, বেশি ভয় নান্টুকে নিয়ে ও মাত্র জ্বর থেকে উঠল! এক সময় রেফারী ইঙ্গিত করলে আমরা মাঠে ঢুকলাম, যেভাবে লীগের খেলোয়াড়রা নামে। সাথে সাথে তুমুল হাততালি, তাকিয়ে দেখি আমাদের পাড়ার সবাই হাততালি দিচ্ছে এমন কি আব্বারাও! ভাল করে তাকিয়ে দেখি একপাশে বুলা আপা শিরি, আপা তারাও খেলা দেখতে এসে হাততালি দিচ্ছেন! আমাদের রীতিমত লজ্জা করতে লাগল। এত মানুষের ভিড় দেখে রাস্তার আশেপাশের লোকজনও এসে জমা হল। কিছু বখাটে ছোকড়াও একপাশে বসে বিড়ি খেতে লাগল।

আবার হাততালির শব্দ, এবারে ঠাকুরপাড়ার টিম মাঠে নামছে, তারপর দুই দলের ক্যাপ্টেন হ্যাঁন্ডশেক করল। রেফারী টস করে আমাদের পূর্বদিকে পাঠিয়ে দিল। ভাগ্য খারাপ— ওদিক থেকে চোখে রোদ লাগে।

রেফারী বাঁশী বাজাতেই খেলা শুরু হল। সলিল কাসেম আর রবিন টুকটাক করে বল একবোরে ওদের গোল পোস্টের কাছে নিয়ে গেল। ওদের একজন ফেরত পাঠাল এদিকে, আমি উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।।

যতক্ষণ বল আমাদের পায়ের কাছে ততক্ষণ আমাদের পাড়ার ছেলেমেয়েরা গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে থাকে, যেই বল ঠাকুরপাড়ার ছেলেদের পায়ে চলে যায় অমনি মন্ত্রবলে সবাই থেমে যায়। তখন মাঠের অন্য পাশ থেকে উৎকট চিৎকার ভেসে আসে। মোটকথা তুমুল উত্তেজনাপূর্ণ খেলা হচ্ছে। কোন দলই আরেক দলকে কাবু করতে পারছে না। পনের মিনিটের মাথায় হীরা প্রথম ফাউল করল, ঠাকুরপাড়ার ছেলেরা ধরধর মারমার শব্দে চেঁচামেচি করতে লাগল।

আমি তখন তিন তিনটি মারাত্মক বল আটকিয়ে প্রচুর হাততালি পেয়েছি, গর্বে বুক দশ হাত ফুলে উঠেছে। সবাই আমাকে উৎসাহ দিচ্ছে। মাঠের মাঝে তখন কাসেম একটা জটিল বলকে বের করে আনল, অমনি আমাদের পাড়া তুমুল চিৎকার করে উঠল। রবিন আর সলিল মিলে তখন বলটা কেটে সোজা গোল পোস্টের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, ওদের দিকে ছুটে আসছে অন্যেরা, সলিল আক্কাসকে পাশ কাটিয়ে বলটা দিল রবিনকে রবিন এক মুহূর্তের সুযোগ পেয়ে লম্বা কিক করল। বলটা সাঁই করে গোল পোস্টে ঢুকে গেল— গোও-ও-ও … ল!!

সারা মাঠময় ছেলেমেয়েরা নেচে বেড়াতে লাগল। ঠাকুরপাড়ার ছেলেদের মুখ চুন। রেফারী সবাইকে মাঠ থেকে বের করে দিয়ে আবার খেলা শুরু করে দিল। ঠাকুরপাড়ার ছেলেরা এবার মরিয়া হয়ে উঠেছে, বল শুধু আমাদের দিকেই চাপতে লাগল। আমার এক মুহূর্তের বিশ্রাম নেই। হীরা মিশু আর কাসেম মিলেও আটকাতে পারছে না। বারবার ওরা গোল পোস্টে এসে পড়ছে। একবার ফাঁকা অবস্থাতে বল পেয়ে গেল। আমি উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আক্কাস বল নিয়ে ছুটে আসছে, পিছনে কাসেম তার পিছনে রবিন। কিছু বোঝার আগেই কিক করল, আমার হাত পিছলে বল গোল পোস্টে ঢুকে পড়ল।

গোওওও . . . ল!! ঠাকুরপাড়ার ছেলেদের জয়ধ্বনি শুনতে পেলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল, গোলটা শোধ করে দিয়েছে! ঠাকুরপাড়ার ছেলেরা তখন মাঠে নাচানাচি করছে, আমাদের পাড়ার ছেলেমেয়েরা উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগল এখনো অনেক সময় আছে।

রবিন এসে আমার পিঠ চাপড়ে বলল, ভয় পাস নে। দেখিস ঠিক জিতে যাব।

ভয় আবার পেলাম কখন? তোরা ভাল করে খেল।

আবার খেলা শুরু হল।

.

কিছুক্ষণের ভিতর হাফ টাইম হল। বীরু ভাই লেবু আর চিউইং গাম দিলেন। ঠাকুরপাড়ার টিমের ছেলেরা কিছু আনেনি তাই ওরাও ভাগ পেল। মাঠে সবাই এসে আমাদের উৎসাহ দিল। শিরি আপা এসে বললেন, যদি জিতে যেতে পার মিষ্টি খাওয়াব।

ঠিক?

ঠিক।

রবিন কাটা হাতটা নাচিয়ে বলল, সবাই শুনে রাখ জিততে পারলেই মিষ্টি।

মিষ্টির লোভে না হলেও, আমাদের খেলাটা সবার সম্মানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে ভেবে আমাদের রোখ চেপে গেল। জিততেই হবে।

আবার খেলা শুরু হল। এবার উত্তেজনা অনেক বেশি। বল একবার দারুণ ভাবে আমাদের দিকে ছুটে আসছিল আবার দারুণ ভাবে ওদের দিকে ছুটে যাচ্ছিল। একবার আমাদের পাড়ার ছেলেমেয়েরা চেঁচাতে লাগল একবার তাদের ছেলেরা। রবিন আর সলিল মরিয়া হয়ে উঠল। খেলা শেষ হতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকি। একবার সুযোগ মত বল পেয়ে রবিন ছুটে চলল। আমার কেন জানি মনে হল এবারে গোল দিয়ে দেবে। আক্কাসকে পাশ কাটিয়ে ওদের ব্যাকের পাশ দিয়ে বল সরিয়ে রবিন সলিলকে পাশ দিল। সলিল আবার ফিরিয়ে দিল তাকে। রবিন বলটাকে থামিয়ে ঘুরে এক লম্বা কিক গোলকীপারের হাত বাচিয়ে সোজা গোল পোস্টে, বুলেটের মত!

আমরা আনন্দে হাত ছুঁড়ে নাচতে লাগলাম। রবিন সবাইকে কানে কানে কি একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দিল। খেলা শুরু হলেই বুঝতে পারলাম বুদ্ধিটা কি। লম্বা কিক দিয়ে ওরা বলটাকে মাঠে নাচাতে লাগল। দরকার হলে মাঠের বাইরে। সময়টা কোনমতে কাটাতে পারলেই কেল্লা ফতে! ঠাকুরপাড়ার ছেলেরা রাগে দুয়ো দুয়ো করতে লাগল। উত্তরে আমাদের ছেলেরাও উল্টো দুয়ো দিতে শুরু করল।

সময় প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন হঠাৎ ওরা একটা মারাত্মক সুযোগ পেয়ে গেল। রশীদ নামের ওদের সবচেয়ে মারাত্মক ছেলেটি ফাঁকা অবস্থায় কিভাবে জানি বলটা পেয়ে গেল। তারপর কোন দিকে না তাকিয়ে সে গোল পোস্টে আমার দিকে ছুটে আসতে লাগল। উত্তেজনায় আমি থরথর করে কেঁপে উঠলাম। রবিন প্রাণপণে ছুটে আসছে পিছু পিছু সবাই। রশীদ তখন একেবারে কাছে এসে পড়েছে কিক করলেই গোল সুনিশ্চিত, নেহায়েত ভাগ্য যদি সাহায্য না করে। হঠাৎ রবিন পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তারপর পুরানো কায়দায় কাটা হাত দিয়ে বলটা ছিটকে সরিয়ে দিল।

হৈ চৈ চেঁচামেচি তার মাঝে রেফারীর বাঁশী বেজে উঠল। পেনাল্টি হয়েছে। রবিন যুক্তি দেখাল ওর হাত নেই হ্যাণ্ডবল হতে পারবে না। রেফারী মানল না ইচ্ছে করে হ্যাণ্ডবল, গোল পোস্টের সীমানার ভিতর, কাজেই এটি পরিষ্কার পেনাল্টি! রেফারীর বিরুদ্ধে তো কথা বলা যায় না রবিন আমার দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলল, তোর উপর সব নির্ভর করছে!

উত্তরে আমি ফ্যাকাসে ভাবে হাসলাম! আর মাত্র একটি মিনিট বাকি!

রশীদ পেনাল্টি কিক করবে, সবাই সরে দাঁড়াল। আমি একা গোল পোস্টে। উত্তেজনায় সবাই আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে, রেফারী ঠেলে সরাতে পারছে না। ভিড়ের ভিতর থেকে বীরু ভাইয়ের গলার আওয়াজ শোনা গেল, টোপন! গোল বাঁচাতে পারলে, মর্নিং শো!

আমার বুকের ভিতর তখন ঢাকের মত শব্দ হচ্ছে। এতো বড় গোল পোস্ট, তার মাঝে এতো ছোট আমি, তার উপর এতো কাছে থেকে কিক করছে! রেফারী বাঁশী বাজাল। রশীদ একটু হাসল, তারপর ছুটে এসে কিক করল– দারুণ জোরে!

উত্তেজনায় কিছু খেয়াল নেই শুধু দেখছিলাম বলটা গুলির মত ঠিক আমার দিকে ছুটে আসছে। ধাতস্থ হয়ে দেখি বলটা আঁকড়ে ধরে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছি। হৈ চৈ করতে করতে রবিন সলিল কাসেম ওরা এসে আমায় কাঁধে তুলে নিল। কে জানি চিৎকার করল থ্রী চীয়ার্স ফর টোপন হিপ হিপ হুররে! হিপ হিপ হুররে!!

এর মাঝে রেফারীর বাঁশী বেজে উঠল। খেলা শেষ, আমরা জিতে গেছি। আনন্দে আমার বুকের ভিতর গুরগুর করে উঠে!

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল