টুনি ছোটাচ্চুর কাছে এসেছিল তার কলমের মতো ভিডিও ক্যামেরাটা দেখতে, ঠিক তখন ফারিহা আপু এসে হাজির। সে একা নয় তার সাথে আরেকজন মেয়ে। কিছু কিছু মানুষের চেহারার মাঝে দুঃখ দুঃখ ভাবের একটা পাকাঁপাকি ছাপ থাকে, এই মেয়েটা সেরকম। টুনিকে দেখে ফারিহা বলল, আরে। আমাদের ইয়াং ডিটেকটিভ! কী খবর তোমার?

টুনি বলল, ভালো। তুমি ভালো আছ ফারিহাপু?

ভালো থাকা কি সোজা ব্যাপার নাকি? জান দিয়ে চেষ্টা করছি ভালো থাকার।

ফারিহাকে দেখলেই ছোটাচ্চুর মন মেজাজ ভালো হয়ে যায়, তাই ছোটাচ্চু লাফ দিয়ে তার বিছানা থেকে নেমে চেয়ারের ওপর থেকে তার বইপত্র নামিয়ে খালি করে দিয়ে বলল, এসো এসো। বস।

ফারিহা বলল, শাহরিয়ার, তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। পাকাঁপাকিভাবে মন খারাপ করা চেহারার মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল, এ হচ্ছে তনু। আমার বান্ধবী। একটা জটিল সমস্যায় পড়েছে সে জন্যে তোমার কাছে নিয়ে এসেছি। তুমি তোমার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে সাহায্য করতে পার কি-না দেখ।

ছোট চাচ্চুর চেহারার মাঝে একটা আঁটি ডিটেকটিভ ডিটেকটিভ ভাব চলে এল। গম্ভীর গলায় বলল, অবশ্যই দেখৰ। কী সমস্যা শুনি।

সমস্যাটা কী শোনার জন্যে টুনির খুবই কৌতূহল হচ্ছিল, শুধু ফারিহাপু আর ছোটাচ্চু থাকলে সে বসে বসে শুনতো, তাকে কেউ ঠেলেও সরাতে পারত না। কিন্তু এখন ফারিহার সাথে আরেকজন এসেছে তার নিজের সমস্যা নিয়ে, এখানে তার বসে থাকাটা মনে হয় ঠিক হবে না।

টুনি বলল, ছোটাচ্চু তোমরা কথা বল, আমি যাই। আমি এসেছিলাম তোমার কলমের মতো ভিডিও ক্যামেরাটা একটু দেখতে।

ছোটাচ্চু মুখটা একটু গম্ভীর করে বলল, এটা কিন্তু ছোট বাচ্চাদের খেলনা না। এটা সত্যিকারের একটা টুল।

সেজন্যই দেখতে চাচ্ছিলাম ছোটাচ্চু। টুনি ইচ্ছে করলেই বলতে পারত এই ভিডিও ক্যামেরাটা যখন বানর চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল তখন সে এটা উদ্ধার করে দিয়েছিল। তবে টুনি কিছু বলল না। বাইরে একটা মেয়ের সামনে এটা বলা মনে হয় ঠিক হবে না।

ছোটাচ্চু মুখ কুঁচালো করে জিজ্ঞেস করল, কী দেখতে চাস?

টুনি বলল, ভিডিও ক্যামেরাটা কেমন করে কাজ করে একটু দেখব।

অন্য সময় হলে ছোটাচ্ কলমের মতো ভিডিও ক্যামেরাটা তাকে দিত কি সন্দেহ আছে, কিন্তু ফারিহা আপু আর মন খারাপ চেহারার মেয়েটার সামনে করতে পারল না। ড্রয়ার থেকে একটা ছোট বাক্স বের করে টুনির হাতে দিয়ে বলল, এই যে, নে। দেখিস আবার হাত থেকে ফেলে দিয়ে নষ্ট করিস না।

তুমি চিন্তা করো না ছোটাচ্চু। আমার হাতে কখনো কোনো কিছু নষ্ট হয় না। শুধু দেখিয়ে দাও, কেমন করে অন অফ করে।

ছোটাচ্চু বাক্সটা খুলে ভিডিও ক্যামেরাটা বের করে কেমন করে অন অফ করতে হয় দেখিয়ে দিল, টুনি তখন সেটা অন করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ছোটাচ্চু ফারিহা আর তনুকে নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিল বলে বুঝতে পারল না, টুনি বের হবার সময় সেটা জানালার উপর রেখে গেছে। ফারিহা আপুর বন্ধু মেয়েটি কী নিয়ে কথা বলে সেটা শোনার এটা একটা অসাধারণ সুযোগ।

ঘণ্টাখানেক পর ফারিহা তার বন্ধু তনুকে নিয়ে চলে যাবার পর টুনি ছোটাচ্চুর ঘরে গিয়ে হাজির হল। ছোটাচ্চু তার ছোট নোট বইয়ে খুব গম্ভীর হয়ে কিছু একটা লিখছিল, টুনি সাবধানে তাকে ডাকল, ছোটাচ্চু।

ছোটাচ্চু তার নোট বই থেকে মুখ না তুলে বলল, উ।

ফারিহা আপু আর তার বন্ধু তোমাকে কী বলেছে?

কোনো একটা কারণে ছোটাচ্চুর মেজাজটা ভালো ছিল তাই ধমক না দিয়ে বলল, তুই শুনে কী করবি?

মনে নাই, আমি তোমার এসিস্টেন্ট?

তোর ধারণা তুই আমার এসিস্টেন্ট। আসলে এটা বড়দের একটা প্রফেশনাল অর্গানাইজেশান-

টুনি বলল, ঠিক আছে। আমি ফারিহা আপুকে জিজ্ঞেস করব। ফারিহা আপু আমাকে বলবে।

ছোটাচ্চু বলল, ফারিহাকে জিঙেস করতে হবে না। কয়টা দিন যাক, আমিই তোকে বলব। তুই এবারে দেখিস আমি কতো কায়দা করে কেসটা সলভ করব। ছোটাচ্চু কথা শেষ করে বুকে একটা থাবা দিল।

ছোটাচ্চু তখন আবার তার নোট বইয়ের উপর ঝুকে পড়ল আর টুনি ঘর থেকে বের হবার সময় জানালা থেকে কলমের মতো দেখতে ভিডিও ক্যামেরাটা হাতে করে নিয়ে এল।

ক্যামেরাটা তখনো চলছে, টুনি সুইচ টিপে সেটাকে বন্ধ করে নিল। এখন ক্যামেরাটাতে কী রেকর্ড হয়েছে সেটা দেখা দরকার। কীভাবে দেখতে হয় সে এখনো জানে না। ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেস করা যায় কিন্তু সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ছোটাচ্চুর মেজাজ ভালো থাকলে তার ল্যাপটপে দেখিয়ে দিতে পারে কিন্তু যখন দেখবে টুনি গোপনে তার ঘরে ফারিহা আপু আর তার বন্ধুর সব কথা ভিডিও করে ফেলেছে তখন সে বিপদে পড়ে যাবে।

টুনি কোনো ঝুঁকি নিল না, সে শান্তকে খুঁজে বের করল, তাকে জিজ্ঞেস করল, শান্ত ভাইয়া, তুমি আমার একটা কাজ করে দিবে?

অন্য যে কেউ হলে জিজ্ঞেস করতো, কী কাজ? শান্ত সেটা জানতে চাইল না, জিভেস করল, কতো দিবি?

দশ টাকা।

শান্ত বলল, আমি এতো কম টাকার কাজ করি না।

কী কাজ সেটা শুনবে না?

কী কাজ!

টুনি তার হাতে ধরে রাখা কলমের মতো দেখতে ভিডিও ক্যামেরাটা শাত্তর হাতে দিয়ে বলল, এইটার মাঝে যে ভিডিওটা আছে, সেটা কম্পিউটারে কেমন করে দেখতে হয় আমাকে শিখিয়ে দেবে?

কী আছে ভিডিওর মাঝে?

তাও জানি না। মনে হয় ছোটাচ্চুর কথা।

ছোটাচ্চুর ভ্যাদর ভ্যাদর?

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, মনে হয়।

শান্ত বলল, ছোটাচ্চুর ভ্যাদর ভাদর ভিডিও ক্যামেরা থেকে শুনতে হবে কেন? ছোটাচ্চুর সামনে গেলেই তো অরিজিনাল ভ্যাদর ভ্যাদর শুনতে পারবি।

টুনি বলল, বললাম তো আমি ছোটাচ্চুর ভ্যাদর ভ্যাদর শুনতে চাই না—এটা কীভাবে ব্যবহার করতে হয় সেটা শিখতে চাই।

শান্ত মুখ শক্ত করে বলল, জ্ঞান অর্জন এতো সোজা না। ভ্যান দেওয়া আরো কঠিন। দশ টাকায় হবে না। বেশি লাগবে।

ভিডিও ক্যামেরা কেমন করে চালায় সেটা জান?

একশবার।

টুনি শান্তকে ভালো করে চিনে তাই মুখটা আরো শক্ত করে বলল, ঠিক আছে আমি তাহলে প্রমি আপুর কাছে যাব। প্রমি আপু তোমার মতো এতো টাকা টাকা করে না।

প্রমি বাচ্চা কাচ্চাদের ভেতর বড়, শান্তশিষ্ট এবং ঠাণ্ডা মেজাজের। কাজেই শান্ত তার নগদ দশ টাকার ঝুঁকি নিল না, বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে! এইবার করে দিচ্ছি, পরের বার এতো কম টাকায় কাজ হবে না, সেইটা মনে রাখিস।

টুনি বলল, শান্ত ভাইয়া, তোমাকেও টাকা ছাড়া কাজ করা শিখতে হবে।

আমি সব সময় টাকা ছাড়া কাজ করি। কোনোদিন শুনেছিস সকালে নাস্তা করার জন্যে আম্মুর কাছে টাকা চেয়েছি? স্কুলে যাবার জন্যে কোনোদিন আব্রু আম্মুর কাছে বিল করেছি? রাত্রে ঘুমানোর জন্যে কোনোদিন টাকা চেয়েছি? চাই নাই। চাওয়া উচিত ছিল।

টুনি কোনো কথা বলল না, এই ভাবে যে চিন্তা করা যায় টুনি সেটাও কোনোদিন চিন্তা করেনি।

শান্ত তার ঘরে কম্পিউটারটা অন করে কলমের মতো দেখতে ভিডিও ক্যামেরাটার পিছন দিকটা খুলে একটা ইউ এস বি পোর্ট বের করে আনল। সেটা তার কম্পিউটারে লাগিয়ে ক্যামেরা থেকে ভিডিও ফাইলটা কপি করে সেটাতে ক্লিক করতেই ভিডিওটা শুরু হয়ে যায়। ভিডিওর ছবিটা অবশ্যি কাত হয়ে আছে, তাড়াহুড়াে করে রাখার সময় ক্যামেরাটা সোজা করে রাখা হয়নি। টুনি অবশ্যি সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। শান্তকে বলল, এতো সোজা? তোমার সাথে দশ টাকার চুক্তি করা ঠিক হয় নাই। দুই টাকা দেয়া উচিত ছিল।

শান্ত মুখ শক্ত করে বলল, দশ টাকার এক পয়সা কম হবে না।

টুনি ভিডিওটার দিকে তাকিয়ে ছিল, ছোটাচ্চু আর ফারিহা আপু এখনো ভদ্রতার কথা বলছে, আসল কথা শুরু করেনি। আসল কথা শুরু করলে কী বলবে তার পুরোটা শুনতে ঢায় তাই তাড়াতাড়ি তার পকেট থেকে একটা ময়লা দশ টাকার নোট বের করে শান্তির হাতে দিয়ে তাকে বিদায় করে দিল। শান্ত চলে যাবার পর টুনি, ছোটাচ্চু, ফারিহা আপু আর তার বন্ধুর কথাগুলো শোনা শুরু করল। কথাগুলো বেশ স্পষ্ট, বুঝতে কোনো সমস্যা হল না। ভদ্রতার কথা শেষ হবার পর ফারিহা বলল, শাহরিয়ার, তনুর সমস্যাটা খুবই আজব। তুমি কিছু করতে পারবে কি-না আমি জানি না।

শহরিয়ার বলল, আগেই হাল ছেড়ে দিও না। মনে নাই ষােল কোটি মানুষ থেকে একজনকে খুঁজে বের করেছি। ভিডিওর ছবিতে ছোটাচ্চুর চেহারাটা স্পষ্ট দেখা গেল না কিন্তু মনে হল সেখানে একটা অহংকারর ছাপ পড়ল।

ফারিহা বলল, তনু, তুমিই বল।

তনু নামের মেয়েটি, যার চেহারার মাঝে পাকাঁপাকি ভাবে একটা দুঃখের ছাপ-সেটা অবশ্যি ভিডিওটাতে এখন এতোটা বোঝা যাচ্ছে না, গলা

পরিষ্কার করে বলল, আমি ঠিক কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। সমস্যাটা আমার মাকে নিয়ে। আমার মা সব সময়েই ছিলেন খুব সেনসিটিভ, অল্পতেই ভেঙে পড়েন। বাবা ছিলেন শক্ত টাইপের মানুষ। বাবা বছর খানেক আগে হঠাৎ করে মারা গেলেন।

তনু একটু থামল, ছোটাচ্চু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আহা! আই এম রিয়েলি সরি। টুনি ছোটাচ্চুর মুখটা স্পষ্ট দেখতে না পারলেও টের পেলো সেখানে একটা দুঃখের ছাপ পড়েছে, ছোটাচ্চুর মনটা খুব নরম এরকম কিছু শুনলে ছোটাচ্চু সত্যি সত্যি মন খারাপ করে ফেলে। নরম গলায় বলল, কতো বয়স ছিল তোমার বাবার?

বাহান্ন।

মাত্র বাহান্ন? আহা! কী হয়েছিল?

ডাক্তারেরা পরিষ্কার করে ধরতে পারিনি। ব্লাড ক্যান্সারের মতো আবার পুরোপুরি ব্লাড ক্যান্সার না। যাই হোক, বাবাকে বেশিদিন ভুগতে হয়নি, বাবা যখন বুঝতে পারলেন তখন সেই অসুস্থ অবস্থাতেই আমার মায়ের জন্যে সবকিছু গুছিয়ে দিলেন। ব্যাংক একাউন্ট, ফ্ল্যাটের কাগজপত্র পেনশনের নমিনি সবকিছু। এমন কী বেশিদিন হাসপাতালে থাকতেও রাজি হননি, শুধু শুধু টাকা নষ্ট হবে, তাই।

যাই হোক, বাবা মারা যাবার পর স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের খুব মন খারাপ হল। আমাকে অবশ্যি খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিতে হল মায়ের জন্যে। মা একেবারে ভেঙে পড়লেন, ব্যাপারটা মানতেই পারেন না। বলা যেতে পারে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিলেন, সারারাত জেগে বসে থাকেন। তার ধারণা হতে থাকল আমার বাবার আত্মা তার সাথে যোগাযোগ করতে আসছেন। মা পরলোক নিয়ে চর্চা করতে লাগলেন। ঠিক তখন সর্বনাশটা হল।

তনু চুপ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, কী সর্বনাশ হল?

মা ইন্ট্রোভার্ট ধরনের মানুষ, বাইরে খুব যোগাযোগ নেই। সেই সাদাসিধে মা ফেস বুক একাউন্ট খুলে খোঁজাখুঁজি করতে লাগলেন, কারা মৃত মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। আর ঠিক ঠিক মানুষজন পেতেও লাগলেন, তারা মাকে নানা ধরনের খবর দিতে লাগল। যে যেটা বলে মা সেটা বিশ্বাস করে বসে থাকেন। আর তখন একেবারে খাটি একটা ক্রিমিনাল এসে হাজির। এই দাড়ি, এই চুল, চোখ টকটকে লাল। কালো আলখাল্লা গলায় লাল শালুর চাদর। কীভাবে যে মায়ের খোঁজ পেয়েছে কে জানে, মাকে বোঝাল সে বাবার আত্মাকে হাজির করে দেবে। মাও বিশ্বাস করে বসে থাকলেন। লোকটার চেহারা রাসপুতিনের মতো, কাজকর্মও সেইরকম। অনেক রকম ভড়ং চড়ং করে তারপর তার ওপর বাবার আত্মা এসে ভর করে, মায়ের সাথে কথা বলে প্রথম প্রথম শুধু পরকালের খবরাখবর এনে দিত। আজকাল বাবার আত্মা মাকে উপদেশ দিতে শুরু করেছে। টাকা পয়সা ব্যাংক ব্যালেন্স এসব নিয়ে কথা বলছে।

ছোটাচ্চু বলল, সর্বনাশ!

হ্যাঁ সর্বনাশ। আমাদেরকে না জানিয়ে মা মনে হয় এই লোককে টাকা পয়সাও দিয়েছে। কিন্তু সেইটা সর্বনাশ না। সর্বনাশ হচ্ছে এই লোেক এখন মাঝে মাঝেই আমাদের বাসায় রাত কাটাতে শুরু করেছে। ঘরের মাঝে ধূপ ধূনা জ্বালিয়ে কাপালিক সাধনা শুরু করেছে। মাকে কিছুই বোঝানো যায় না—এই ক্রিমিনালের পা ধরে বসে থাকে।

ছোটাচ্চু জিভেস করল, তোমার মাকে কী বলে এইভাবে বশ করেছে?

তনু বলল, লোকটা মহা ধুরন্ধর। মায়ের সাথে যোগাযোগ করার আগে একটু খোঁজ খবর নিয়ে এসেছে। বাবা কোথায় কাজ করতো, কোন হাসপাতালে ছিল, তার আয় • কারা এরকম। তারপর এই ফ্যাক্টগুলো সে ব্যবহার করে। আমাদের কথা খুব মন দিয়ে শোনে, সেখানে যেগুলো শোনে সেগুলো মনে রাখে, আগে পিছে কিছু একটা লাগিয়ে নিয়ে ব্যবহার করে। লোকটার অসম্ভব বুদ্ধি মাঝে মাঝে রিস্ক নিয়ে কিছু একটা বলে যদি মিলে যায় তাহলে তো কথাই নাই—যদি টের পায় মিলছে না তখন কথাটা ঘুরিয়ে ফেলে।

ফারিহা বলল, কী সর্বনাশ!

তনু বলল, এখন আমাদের সেফটি নিয়ে দুশ্চিন্তা। কোনো এক রাতে আমাদের জবাই না করে চলে যায়। মাকে বলাই যায় না, বাবা বাবা করে অজ্ঞান।

ফারিহা বলল, তুমি এখন শাহরিয়ারকে কী করতে চাও বল।

এই লোকটার খোঁজ খবর নিয়ে আমাদেরকে দেয়া। মাকে বোঝাব-দরকার হলে পুলিশে খবর দেব।

ছোটাচ্চু দুশ্চিন্তিত মুখে মাথা চুলকালো। বলল, হুম। ফারিহা ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেস করল, পারবে?

ছোটাচ্চু চেষ্টা করল জোর দিয়ে বলতে, অবশ্যই পারব। কিন্তু গলায় খুব জোর পেল না। মাথা চুলকে বলল, লোকটার ছবি আছে? নাম ঠিকানা।

ঠিকানা নাই, তার কারণ সে নাকি ঘর বাড়ি ঠিকানা বিশ্বাস করে না। নাম গাবড়া বাবা।

গাবড়া?

হ্যাঁ,গাবড়া, গাবড়া বাবা। আর ছবি?

তনু তার পকেট থেকে মোবাইল বের করে বলল, আমি গোপনে ছবি তুলেছি। এই হচ্ছে সেই লোক–

তনু তার মোবাইল টেলিফোনে লোকটার ছবি দেখাল আর সেই ছবি দেখে ছোটাচ্চু আর ফারিহা দুজনেই মনে হল ভয়ে আঁতকে উঠল।

এর পর আরো কিছু সময়ের ভিডিও আছে কিন্তু সেখানে কীভাবে কী করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা, টুনি সেটাও মন দিয়ে শুনল। যখন ভিডিওটা শেষ হল তখন সে কম্পিউটারটা বন্ধ করে ঘর থেকে বের হয়ে

এল। শান্তর আম্মু রান্না ঘর থেকে বললেন, কে? টুনি নাকি?

জি চাচী।

চলে যাচ্ছিস?

জি চাচী।

ফুচকা বানিয়েছি, খেয়ে যা।

টুনি খুব সখ করে বেশ কয়েকটা ফুচকা খেলো।

চাচী জিভেস করল, কেমন হয়েছে?

টুনি বলল, অসাধারণ! একেবারে রাস্তার ফুচকার মতো!

চাচী হেসে টুনির মাথায় একটা ঢার্টি দিলেন, বললেন, রাস্তার মতো?

জি চাচী। রাস্তার ফুচকা হচ্ছে বেট! তুমি একটা টং ভাড়া করে আমাদের স্কুলের সামনে বসে যাও, দুইদিনে বড়লোক হয়ে যাবে।

চাচী আবার টুনির মাথায় চাটি দিলেন।

 

একটু পর টুনি ছোটাচ্চুর ঘরে উঁকি দিল। ছোটাচ্চু বিছানায় পা তুলে বসে আছে তার চোখে মুখে এক ধরনের উত্তেজনার ভাব, চোখগুলো জ্বল জ্বল করছে। টুনিকে দেখে চোখের জ্বল জ্বলে ভাবটা আরেকটু বেড়ে গেল, বলল, টুনি? তুই।

টুনি মাথা নাড়ল, তোমার ভিডিও ক্যামেরাটা। ড্রয়ারে রেখে দেব?

ছোটাচ্চু বললেন, দে। রেখে দে।

টুনি ড্রয়ারে ভিডিও ক্যামেরার বাক্সটা রেখে সাবধানে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। বাক্সের ভিতরে ভিডিও ক্যামেরাটা নেই, ভিডিও ক্যামেরার মতো দেখতে একটা কলম আছে। ছোটাচ্ বাক্সটা খুলে পরীক্ষা করলেও চট করে ধরতে পারত না কিন্তু টুনি কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। যদি ধরা পড়ে যেতো তাহলে ভুল করে সত্যিকারের একটা কলম রাখার জন্যে অবাক হবার ভান করতো। ছোটাচ্চু সেটাও ধরতে পারত না। টুনি আরো কয়েকদিন ভিডিও ক্যামেরাটা ব্যবহার করে দেখতে চায়। আর স্কুলের একজন ম্যাডামের ধরার জন্যে কাজে লাগবে।

টুনি ছোটাচ্চুর বিছানার কাছে রাখা চেয়ারে বসে বলল, ছোটাচ্চু। বল। ফারিহা আপুর বন্ধুর কেসটা বলবে?

ছোটাচ্ মাথা নাড়ল, একজন ক্লায়েন্ট যখন আমার কাছে একটা কেস দেয়, সেটা আমার গোপন রাখতে হয়।

তুমি আমাকে বল, আমি গোপন রাখব।

ছোটাচ্চু বলল, বলা যাবে না। টুনি ভাবল বলে ফেলে যে সবকিছু জানে, কিন্তু মনে হয় সেটা বুদ্ধিমানের কী হবে না। ছোটাচ্চুর মুখ থেকেই বের করতে হবে।

টুনি বলল, ঠিক আছে তুমি যদি বলতে না চাও তাহলে আমি বিশটা প্রশ্ন করি। তুমি হ্যাঁ কিংবা না বলে তার উত্তর দাও। মনে নাই তুমি এই খেলাটা আমাদের শিখিয়েছ?

যে খেলাটা ছোটাচ্চু নিজেই বাচ্চাদের শিখিয়েছে এখন সেটা খেলতে না চাওয়াটা কেমন দেখায়, তাই ছোটাচ্চু একটু গাই গুই করে রাজি হল, তবে বিশ প্রশ্নে নয়, দশ প্রশ্নে। টুনি যেহেতু সবকিছু জানে, এখন শুধু ছোটাচ্চুর মুখ থেকে সেটা বের করে আনার ভান করতে হবে, তাই সেও খানিকক্ষণ গাই গুই করে রাজি হয়ে গেল। টুনি গভীর ভাবে চিন্তা করার ভান করে প্রথম প্রশ্নটা করল, যে সমস্যাটা নিয়ে এসেছে সেটা কি ফারিহা আপুর বন্ধু তনুর সমস্যা?

ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, না।

তাহলে কি তার মায়ের সমস্যা?

হ্যাঁ।

টুনি গভীর ভাবে চিন্তা করার ভান করতে লাগল, জোরে জোরে চিন্তা করার ভঙ্গি করে বলল, তার মায়ের সমস্যা কিন্তু তার বাবার কাছে না গিয়ে তোমার কাছে এসেছে, তার মানে তার বাবা নিশ্চয়ই বেঁচে নেই।

ছোটাচ্চু ভুরু কুঁচকে বলল, এটা কি তোর তিন নম্বর প্রশ্ন?

না। টুনি বলল, তুমি মাত্র দশটা প্রশ্ন দিয়েছ তাই আমাকে খুব সাবধানে সেগুলো করতে হবে। আমার প্রশ্নটা হচ্ছে, বাবা মারা যাবার কারণে কি মায়ের এই সমস্যা শুরু হয়েছে?

প্রশ্ন শুনে ছোটাচ্চু কেমন যেন হকচকিয়ে গেল, কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, হ্যাঁ।

টুনি চোখে মুখে আনন্দের একটা ভঙ্গি করল, তারপর জিজ্ঞেস করল, এটা কি আত্মীয়দের সম্পত্তি নিয়ে মামলা মোকদ্দমা করা?

ছোটাচ্চু বলল, না।

টুনি একটা প্রশ্ন নষ্ট হয়ে যাওয়া নিয়ে হতাশার মতো একটা শব্দ করল। ছোটাচ্চু বলল, তোর চারটা প্রশ্ন হয়েছে আর ছয়টা বাকি আছে।

টুনি গভীর চিন্তায় ডুবে যাবার একটা অসাধারণ অভিনয় করল তারপর বলল, তাহলে এটা কি বাবা মারা যাওয়ার পর তার আত্মা ফিরে এসে মাকে ভয় দেখানোর ব্যাপার?

ছোটাচ্চু আবার কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল, খানিকক্ষণ মাথা চুলকে বলল, ইয়ে, মানে ইয়ে, আঁ, আঁ মানে, হচ্ছে গিয়ে ঠিক উত্তরটা হ্যাঁ কিংবা না কোনোটাই না—তাহলে–

টুনি আবার আনন্দের শব্দ করল, বলল, তুমি এই প্রশ্নের উত্তর দাওনি কাজেই আমার এখনো ছয়টা প্রশ্ন আছে।

ছোটাচ্চু কী করবে বুঝতে না পেরে মাথা চুলকাতে লাগল। টুনি উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত হবার ভঙ্গি করে ঘর পায়চারী করতে লাগল, তারপর বিড় বিড় করে বলল, তুমি প্রশ্নটার উত্তর না দিলেও আসলে এখান থেকে আমি সবকিছু বুঝে গেছি!

কী বুঝে গেছিস?

তুমি আমার বাকি ছয়টা প্রশ্নের উত্তর দাও তারপর বলছি।

পাঁচটা।

ছয়টা।

ছোটাচ্চু বলল, উহু, তুই যদি আমার উত্তর থেকে কিছু একটা উত্তর পেয়ে যাস তাহলে সেই প্রশ্ন করা হয়ে গেছে।

টুনি বলল, কিন্তু তোমার উত্তর হ্যাঁ কিংবা না হওয়ায় কথা। তুমি কোনোটাই বলনি।

সব প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ আর না দিয়ে দেওয়া যায় না। আমি যদি জিজ্ঞেস করি তুই কি প্রত্যেকদিন তেলাপোকা ভাজা করে খাস, তাহলে কি তুই হ্যাঁ কিংবা না বলে উত্তর দিতে পারবি?

টুনি হাল ছেড়ে দেওয়ার ভান করে বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। পাঁচ প্রশ্নই থাকুক। এখন আমি বুঝে গেছি ফারিহা আপুর বন্ধুর মায়ের সাথে তার বাবার আত্মা আসা নিয়ে একটা ব্যাপার হয়েছে। যদি সেটা ভয়ের ব্যাপার হতো তাহলে তোমার কাছে আসতো না—যেহেতু তোমার কাছে এসেছে তার মানে কোনো একজন ক্রিমিনাল এটা ঘটাচ্ছে। ঠিক কি না?

এটা কি একটা প্রশ্ন?

টুনি বলল, হ্যাঁ এটা একটা প্রশ্ন। কোনো একজন মানুষ কি তনুর বাবার আত্মার কথা বলে তার মাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে?

ছোটাচ্চু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ।

টুনি হাতে কিল দিয়ে বলল, মানুষটা কি ভণ্ড পীর?

না—মানে—ঠিক ভণ্ড পীর না—

তাহলে কি কাপালিক? তাত্রিব, লম্বা চুল দাড়ি?

হ্যাঁ। মা

নুষটা কি ফারিহা আপুর বাসায় উঠে এসেছে?

হ্যাঁ।

টুনি গম্ভীর গলায় বলল, আমার এখনো একটা প্রশ্ন বাকি আছে কিন্তু এর মাঝে সবকিছু বের হয়ে গেছে! ছোটাচ্চু এখন তুমি বল আসলে কী হয়েছে।

ছোটাচ্চু কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, মাথা চুলকে বলল, তুই কেমন করে দশ প্রশ্নে এটা বের করে ফেললি?

নয় প্রশ্নে।

হ্যাঁ, না প্রশ্নে। তুই আসলেই খুবই বুদ্ধিমান। তোর লেখাপড়া কেমন হয়? পরীক্ষায় ফার্স্ট হোস?

না ছোটাচ্চু। ফাস্ট সেকেন্ড উঠে গেছে, এখন শুধু এ, এ প্লাস এই সব। বেশি পড়তে হয় না।

ভেরি ইন্টারেস্টিং। অসাধারণ।

থ্যাংকু। তাহলে এখন আমাকে বল কী হয়েছে।

তোকে আর কী বলব- তুইতো জেনেই গেছিস।

তবু তোমার মুখ থেকে শুনি।

একটু আগে ভিডিওটাতে যা যা শুনে এসেছে ছোটাচ্চু সেগুলো আবার বলল, টুনি গম্ভীর মুখে সবকিছু শোনার ভান করল। গাবড়া বাবা নামটা শুনে খুব অবাক হবার অভিনয় করল। তারপর জিজ্ঞেস করল, এখন কী করবে ঠিক করেছ?

ছোটাচর চোখ চক চক করে উঠল, বলল, হ্যাঁ, একটা প্ল্যান করেছি। কী প্ল্যান ছোটাচ্চু?

প্রথমে ভেবেছিলাম এই গাবড়া বাবাকে ফলো করে দেখব লোকটা আসলে কী করে, কোথায় থাকে। তখন মনে হল— ছোটাচ্চু কথা থামিয়ে একটু হাসি হাসি মুখ করে বলল, তার চেয়ে অনেক ভালো হবে স্টিং অপারেশান!

আগের মতন?

হ্যাঁ। গাবড়া বাবাকে ফাদে ফেলব।

কীভাবে ফাঁদে ফেলবে?

গাবড়া বাবা মহা ধুরন্ধর। তার এই ধুরন্ধর বুদ্ধি দিয়েই তাকে ধরা হবে। ছোটাচ্চু দুলে দুলে হাসতে থাকে।

কীভাবে?

তনুর বাবার যে কোনোকিছু যদি সে শুনে তাহলে সেটাই সে আত্মা সেজে এসে ব্যবহার করে। কাজেই তনুর বাবাকে নিয়ে ভুল একটা তথ্য দেয়া হবে, সেটা যখন ব্যবহার করবে তখন ধরা পড়ে যাবে!

ভুল কী বলবে ছোটাচ্চু? কীভাবে তাকে জানাবে।

মারাত্মক রকম ভুল কোনো তথ্য। যেমন আমি চিন্তা করছি এরকম।

ছোটাচ্চু মুখটা সুঁচালো করে বলল, যখন তনুর মা বাসায় নেই কিন্তু গাবড়া বাবা আছে তখন একজন মহিলা গিয়ে তাদের বাসায় হাজির হবে। গিয়ে সে দাবী করবে সে তনুর বাবার আগের পক্ষের স্ত্রী। স্ত্রী যদি পাওয়া না যায় তাহলে একটা ছেলে বা মেয়েও যেতে পারে, গিয়ে বলবে সে আগের পক্ষের ছেলে না হয় মেয়ে। সে তখন তনুর বাবার সম্পত্তির অংশ চাইবে। গাবড়া বাবা তখন নিশ্চয়ই মনে করবে তনুর বাবার আগের একজন স্ত্রী আছে। সেটা সে যখন ভড়ং চড়ং করে বলবে তখন হাতেনাতে ধরা পড়ে যাবে।

টুনিকে স্বীকার করতেই হল বুদ্ধিটা খারাপ না। একটা মৃত আত্মা আর যেটা নিয়েই ভুল করুক আগের পক্ষের স্ত্রী আছে কি নেই, সেটা নিয়ে নিশ্চয়ই ভুল করবে না। গাবড়া বাবার মুখ দিয়ে এটা বলাতে পারলেই সে হাতেনাতে ধরা পড়ে যাবে। টুনি জিজ্ঞেস করল, কে যাবে তনুদের বাসায়?

প্রথমে ভেবেছিলাম আমি নিজেই যাব, গিয়ে বলব আমি আগের পক্ষের ছেলে। কিন্তু পরে মনে হল এটা ঠিক হবে না—হাজার হলেও আমি ডিটেকটিভ, আমার এই কাজটা করা ঠিক হবে না।

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, তোমার নিজের যাওয়া ঠিক হবে না। তোমার অভিনয় খুবই জঘন্য ছোটাচ্চু।

ছোটাচ্চু চোখ পাকিয়ে বলল, তুই কেমন করে জানি আমার অভিনয় জঘন্য? তুই জানিস ইউনিভার্সিটিতে আমি মাতালের ভূমিকায় একটিং করেছি।

আমরা সেটা দেখি নাই কিন্তু বাসায় তুমি যখন কোনো একটা কিছু ভান করার চেষ্টা করে—আমরা সব সময় ধরে ফেলি।

কখন ধরে ফেলিস?

এই মনে কর যখন ফারিহা আপু আসে তুমি ভান করো যেটা তোমার কাছে খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু তোর দেখলেই বোঝা যায় ভিতরে ভিতরে খুশিতে তুমি ডগমগ করতে থাক।

বাজে কথা বলবি না। দেব একটা থাবড়া।

টুনি বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর বলব না। তুমি এখন বল, কাকে পাঠাবে।

আমার এক বন্ধু আছে নাটক থিয়েটারে একটিং করে। অসাধারণ একটিং, দেখলে বেকুব হয়ে যাবি। ভাবছি তাকে রাজি করাব।

রাজি হবে?

আমি বললে রাজি হবে কি না জানি না, ফারিহা বললে রাজি হবে।

ফারিহা আপু বলবে?

একশবার বলবে। ফারিহাকে কোনোদিন দেখেছিল এইরকম কাজ না করেছে?

টুনি মাথা নাড়ল, আসলেই ফারিহা আপু কখনো এরকম কাজে না করে না। ছোটাচ্চু খানিকক্ষণ কিছু একটা চিন্তা করল, তারপর বলল, কালকে ভাবছি ঐ বাসা থেকে ঘুরে আসি। সরেজমিনে দেখে আসি। গাবড়া বাবাকেও দেখে আসি। স্টিং অপারেশন শুরু করার আগে মানুষটা দেখা দরকার।

টুনি মুখ কাচুমাচু করে বলল, ছোটাচ্চু।

কী হল।

তুমি আমাকে সাথে নিয়ে যাবে।

তোকে কোথায় সাথে নিয়ে যাব?

গাবড়া বাবার কাছে।

তোকে? গাবড়া বাবার কাছে? কেন?

টুনি একেবারে হাত জোড় করে বলল, প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ!

তুই বাচ্চা মানুষ বড়দের কাজকর্মের মাঝে কেন থাকবি?

থাকব না ছোটাচ্চু। শুধু দেখব। প্লিজ প্লিজ প্লিজ। তুমি যা চাইবে তাই দেব ছোটাচ্চু।

ছোটাচ্চু মুখ ভেংচে বলল, তোর আছে কী যে আমাকে দিবি?

যা আছে তাই দেব। মনে নাই আমি তোমার ডিটেকটিভ এজেন্সির কতো কাজ করে দিয়েছি!

তোকে কাজ করতে বলেছে কে? তোর এই কাজকর্মই তো যন্ত্রণা।

ঠিক আছে আমার কাজকর্ম যদি যন্ত্রণা হয়, তাহলে আমি আর তোমাকে জ্বালাব না।

সত্যি?

সত্যি। তুমি যদি চাও, তাহলে তোমার এসিস্টেন্ট হবার জন্যেও চাপাচাপি করব না।

ঠিক তো?

ঠিক।

ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, ঠিক আছে কাল তোকে নিয়ে যাব। সবাইকে বলা হবে তোর নাচের স্কুল থেকে তোকে নিয়ে বাসায় যাচ্ছি।

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।

আর যতক্ষণ থাকবি একটা কথা বলবি না। ঠিক আছে?

ঠিক আছে।

যা তাহলে, কাল বিকেলে রেডি থাকিস।

টুনি বলল, ছোটাচ্চু তোমার মুখটা একটু নামাবে?

কেন?

তুমি খুবই সুইট, তোমার গালে একটা চুমু দিই।

আমার গালে তোর চুমু দিতে হবে না, ভাগ এখান থেকে।

টুনি চলে এলো, ছোটাচ্চু দেখতেও পেল না তার মুখে এগাল-গাল জোড়া হাসি। এরকম একটা হাসি দেখলে ছোটাচ্চু নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তার মাঝে পড়ে যেতো।

 

পরদিন বিকাল বেলা টুনি ছোটাচ্চুর সাথে রওনা দিল, হাতে একটা মোটা বই। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, কীসের বই এটা।

বিজ্ঞানের।

তুই কবে থেকে বিজ্ঞানের বই পড়া শুরু করেছিস?

আজকে থেকে।

ঢং করিস?

না ছোটাচ্চু! ঢং করব কেন? আমার কি বিজ্ঞানের বই পড়ার ইচ্ছা করতে পারে না?

ছোটাচ্চু কোনো কথা বলল না, গজগজ করতে লাগল। ছোটাচ্চু কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবে না যে, টুনি ইচ্ছে করে একটা বিভানের বই হাতে নিয়ে রওনা দিয়েছে কোন ছোটাচ্চু বইটা হাতে ন! নেয়।

তনুদের বাসার সানে গিয়ে ছোটা তনকে ফোন করল। তনু তখন নিচে নেমে এসে ছোটাকে উপরে নিয়ে গেল। ছোটা নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমার আম্মু বাসায় আছেন?

তনু বলল, হ্যাঁ। আছে।

কী করছেন?

গাবড়া বাবার জন্যে রাধছেন। গাবড়া বাবার পাঙাস মাছ খাওয়ার সখ হয়েছে।

গাবড়া বাবা কী করছে?

ধ্যান করছে।

আজ রাতে কি থাকবে তোমাদের বাসায়?

মনে হয় থাকবে।

দোতলার একটা ফ্ল্যাটে তনু তার মাকে নিয়ে থাকে। বসার ঘরেই ধূপের ঝাঝালো গন্ধ। পাশে একটা ঘরের ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হয়ে আসছে। তনু ফিস ফিস করে বলল, এই ঘরে গাবড়া বাবা আছে।

আমরা কি দেখা করতে পারি? দাঁড়াও, মাকে বলে আসি। মা তার গাবড়া বাবাকে দেখে শুনে রাখে

ঠিক আছে, যাও, আমরা এখানে বসি।

ছোটাচ্চু আর টুনি সোফায় বসল, তনু তখন ভেতরে গেল তার মাকে ডাকতে। কিছুক্ষণের মাঝেই আঁচলে হাত মুছতে মুছতে তনুর মা বের হয়ে এলেন, রান্না করছিলেন বলে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কপালের দুই পাশের চুল পাকতে শুরু করেছে। ছোটাচ্চুকে দেখে জ্বলজ্বলে চোখে বললেন, তোমরা বুঝি গাবড়া বাবাকে দেখতে এসেছ?

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, জি। তনুর কাছে শুনেছি। আমার ভাতিজিকে নাচের স্কুল থেকে নিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন মনে হল গাবড়া বাবাকে এক নজর দেখে যাই।

একেবারে সত্যিকারের সিদ্ধপুরুষ। আমাদের কতো বড় সৌভাগ্য এখানে পায়ের ধুলো দিয়েছেন।

ছোটাচ্চু বলল, ও।

বাবা ধ্যান করছিলেন। ধ্যানের সময় বাবাকে ডিস্টার্ব করা ঠিক না।

ছোটাচ্চু বলল, ও।

তোমাদের কারো সাথে যোগাযোগ করতে হবে?

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, না।

আগে মনে হতো জীবন আর মৃত্যু বুঝি একেবারে আলাদা। বাবার সাথে পরিচয় হবার পর বুঝেছি কোনো পার্থক্য নাই। যখন খুশি দেহান্তরিত মানুষের সাথে কথা বলা যায়। পরকালটা যেন পাশের একটা ঘর।

ছোটাচ্চু বলল, ও। তনুর বাবা এখন নিয়মিত আমার সাথে যোগাযোগ করে। গাবড়া বাবা থাকলে যে কী হতো।

ছোটাচ্চু আবার বলল, ও।

ঠিক এই সময় পাশের ঘর থেকে একটা বিকট শব্দ শোনা গেল, আর তনুর মা তখন ছটফট করে উঠে বললেন, বাবার ধ্যান ভেঙেছে। যাই আমি বাবার জন্যে দুধ নিয়ে আসি।

তনুর মা প্রায় ছুটে গিয়ে একটু পরে বিশাল একটা মগে করে দুধ নিয়ে এলেন। ছোটাচ্চুকে বললেন, এসো আমার সাথে। বাবার পা ধরে সালাম করো, তোমার জন্যে দোয়া করবেন।

তারপর টুনির দিকে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন, তুমিও ভিতরে যাবে?

টুনি ছোটাচ্চুকে কথা দিয়েছিল যে, সে একটা কথাও বলবে না। তাই সে কথা বলল না, মাথা নেড়ে তনু মাকে জানাল সেও গাবড়া বাবার সাথে দেখা করতে চায়।

তনুর মা দরজা একটু ফাঁক করে বললেন, বাবা, আপনার ধ্যান শেষ হয়েছে?

গাবড়া বাবা সোজা হয়ে বসেছিল, চোখ খুলে বলল, হাম্মম্। হামম্ বলে কোনো শব্দ ছোটাচ্চু কিংবা টুনি কেউই শোনে নি। তনুর মা মনে হল এই শব্দের সাথে পরিচিত, দুধের মগ নিয়ে ভিতরে ঢুকে বলল, বাবা, আপনি এখন একটু দুধ খান।

গাবড়া বাবা বলল, গামম!

এই শব্দটাও মনে হয় তনুর মা বুঝে গেলেন, তাড়াতাড়ি দুধের মগটা গাবড়া বাবার পায়ের কাছে রেখে বললেন, এই দুইজন আপনার দোয়া নিতে এসেছে বাবা।

গাবড়া বাবা মুখ তুলে এবারে ছোটাচ্চু আর টুনির দিকে তাকাল, তখন তারা তাকে প্রথমবার ভালো করে দেখতে পেল। মাথায় কুচকুচে কালো লম্বা আর ঘন চুল। মুখে তার থেকেও কালো ঘন লম্বা দাড়ি। চুল দাড়ির জঙ্গলে গাবড়া বাবার চেহারাটাই ভালো করে দেখা যায় না। চাপা নাক আর ঘন ভুরু। চোখ দুটো টকটকে লাল। কপালে টকটকে লাল সিঁদুর। কালো একটা আলখাল্লা পরে আছে। সামনে একটা মাটির মালশা সেখানে এক খাবলা ধূপ দিতেই কুচকুচে কালো ধোঁয়া বের হয়ে এলো।

তনুর মা ফিস ফিস করে বললেন, বাবাকে সালাম করো।

ছোটাচ্চুর সালাম করার কোনো ইচ্ছে ছিল না কিন্তু তনুর মাকে খুশি। করার জন্যে এগিয়ে গিয়ে গাবড়া বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করল। টুনির হাতে বিজ্ঞানের মোটা বই, সেটা ঘরের কোনায় শেলফে রেখে নিচু হয়ে গাবড়া বাবাকে সালাম করার ভঙ্গি করল। গাবড়া বাবা হুংকার দিয়ে বলল, হামমুম্।

মনে হল তনুর মা এই কথাটাও বুঝে ফেললেন। বুঝে ঝলমলে একটা হাসি ফুটিয়ে বললেন, তোমাদের আর কোনো চিন্তা নাই, গাবড়া বাবা তোমাদের জন্যে দোয়া করে দিয়েছেন।

ঘরের ভেতর ধোয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তাই ছোটাচ্চু আর বেশিক্ষণ থাকার চেষ্টা করল না, টুনির হাত ধরে বের হয়ে এল। বাসার কাছাকাছি পৌঁছানোর পর টুনি বলল, ছোটাচ্চু, আমার বিজ্ঞানের বইটা আমি গাবড়া বাবার রুমে ফেলে এসেছি।

ছোটাচ্চু বলল, এখন বলছিস? আগে বললি না কেন?

আগে মনে ছিল না।

এখন আমি তোর বইয়ের জন্যে ফিরে যেতে পারব না।

টুনি বলল, এখন যেতে হবে না, কিন্তু পরের বার তুমি যখন তনু আপুর বাসায় যাবে তখন নিয়ে এসো।

মনে থাকলে–

আমি মনে করিয়ে দেব। বইটা স্পেশাল।

বিজ্ঞানের একটা বই আবার স্পেশাল হয় কেমন করে? গল্প উপন্যাস হলে তবু একটা কথা ছিল।

ছোটাচ্চুর বিজ্ঞান নিয়ে একটা এলার্জির মতো আছে, টুনি সেটা খুব ভালো করে জানে। বইটা এখন ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি। টুনি হালকা একটু দুশ্চিন্তা নিয়ে তার মাথা চুলকাতে থাকে।

পরের দিন গাবড়া বাবাকে নিয়ে স্টিং অপারেশান শুরু করার কথা। ফারিহা ছোটাচ্চুর কথামতো নাটকদলের সেই ছেলেটাকে রাজি করিয়েছে। বিকেলবেলা তনুর মা গাবড়া বাবার জন্যে বাজার করতে কাঁচা বাজারে যাবেন, ঠিক তখন এই ছেলেটা তনুদের বাসায় যাবে। গাবড়া বাবার তখন ধ্যান করার কথা, বাসা নীরব থাকে, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বললে গাবড়া বাবা শুনতে পাবে। টুনির পুরো ঘটনাটা দেখার ইচ্ছা ছিল কিন্তু তার কোনো উপায় নেই। যখন গাবড়া বাবার জন্যে এই নাটকটা হবে তখন সেখানে তনু ছাড়া আর কেউ থাকবে না। ছোটাচ্চু আর ফারিহা পর্যন্ত বাইরে একটা চায়ের দোকানে অপেক্ষা করবে।

নাটকের ছেলেটাকে নিয়ে ছোটাচ্চু আর ফারিহা বাইরে অপেক্ষা করছিল, যখন দেখল তনুর মা হাতে একটা ছাতা আর বাজারের ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেলেন তখন নাটকের ছেলেটা ভেতরে ঢুকলো। আগে থেকে ঠিক করা ছিল, বেশ কয়েকবার কলিংবেল টেপার পর তনু দরজা খুলল, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা তার নাটকের গলায় জিজ্ঞেস করল, এইটা কি আনোয়ার সাহেবের বাসা?

তনুর বাবার নাম আনোয়ার হোসেন। তনু বলল, জি।

আমি কি ভিতরে আসতে পারি?

আসেন।

নাটকের ছেলেটা ভিতরে ঢুকলো, বসার ঘরে একটু হাঁটল। গাবড়া বাবার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ভেতরে ধোঁয়া কেন?

তনু বলল, সেটা অন্য ব্যাপার। আপনি কার কাছে এসেছেন?

নাটকের ছেলেটা হা হা করে হাসল, বলল, কী আশ্চর্য! আমি আমার নিজের বাসায় আসতে পারব না?

তনু অভিনয় করে না, তবু আশ্চর্য হবার অভিনয় করে বলল, নিজের বাসা?

গাবড়া বাবার ঘরের ভেতর হালকা শব্দ হচ্ছিল, হঠাৎ করে ঘরটা নিঃশব্দ হয়ে গেল। বাইরের ঘরে কী নিয়ে আলাপ হচ্ছে গাবড়া বাবা নিশ্চয়ই শোনার চেষ্টা করছে।

নাটকের ছেলেটা স্টেজের এক মাথা থেকে হলঘরের অন্য মাথায় পৌছে দেবার মতো তেজি গলার স্বরে বলল, হ্যাঁ। এইটা আপনার যেরকম বাসা, আমারও সেইরকম বাসা। আনোয়ার হোসেন আমার বাবা।

তনু অতি অভিনয় করে বলল, বাবা?

হ্যাঁ। আমার মা হচ্ছেন আপনার বাবার প্রথম স্ত্রী। আমি তার প্রথম স্ত্রীর ছেলে। তার মানে আপনি আমার ছোট বোন। ছোট বোনকে আপনি করে বলতে হবে কেন? আমি তুমি করে বলব। তুমি আমার ছোট বোন। তুমি তুমি তুমি।

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

নাটকের ছেলেটা অপূর্ব অভিনয় করে বলল, তোমরা আমাদের দুঃখ কোনোদিন বুঝবে না। আমার মা খুব সাধারণ একটা মেয়ে ছিল। আমার জন্মের পর তোমার বাবা আমার মাকে ছেড়ে এসে তোমার মাকে বিয়ে করেছে। আমার মা কতো কষ্ট করে আমাকে বড় করেছে তুমি জান?

তনু বলল, আমি বিশ্বাস করি না।

নাটকের ছেলেটা নাটকীয় ভঙ্গিতে হা হা করে হাসল, বলল, আমি জানি তোমরা বিশ্বাস করবে না, সে জন্যে আমি সাথে করে প্রমাণ নিয়ে এসেছি।

কী প্রমাণ? এই দেখ।

তখন নাটকের ছেলেটা একটা খাম বের করে সেখান থেকে কয়েকটা ফটো বের করার ভান করল। গলা উঁচিয়ে বলল, এই দেখ আমার মায়ের বিয়ের ছবি। তোমার বাবাকে চিনতে পারছ?

হ্যাঁ। আসলেইতো এটা আমার বাবা, কী আশ্চর্য!

পাশে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা কি তোমার মা?

তনু বলল, না।

এটা আমার মা। কুলসুম বেগম।

তনু বলল, কুলসুম?

ছেলেটা খাম থেকে আরো কিছু কাগজ বের করল, বলল, এই দেখো আমার মাকে লেখা বাবার চিঠি। হাতের লেখা চিনতে পারো? কার হাতের লেখা এটা?

আমার বাবার।

কী লিখেছ দেখেছ? কুলসুম, আমি দুঃখিত তোমার সাথে আমার আর সম্পর্ক রাখা সম্ভব না। রাজুকে দেখেশুনে রেখো–

রাজু কে?

আমি। আমার নাম রাজু।

তনু বলল, এই ফটো, চিঠিপত্রগুলো আমাকে দেবে?

নাটকের ছেলেটা গমগমে গলায় বলল, না। এগুলো এখন আমি তোমাকে দেব না। তোমরা যদি নিজেরা আমাকে গ্রহণ করে নাও ভালো,

কোর্টে যেতে হয় তাহলে এগুলো হবে আমার একমাত্র প্রমাণ। তোমার মা কোথায়?

নাটকের ছেলেটা গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমার মা গত বছর মারা গিয়েছেন। হয়তো পরকালে বাবা শেষ পর্যন্ত মাকে গ্রহণ করেছেন। কে বলতে পারবে? কে উত্তর দেবে?

তুমি এখন কী চাও?

তোমার বাবার সন্তান হিসেবে আমি আমার অধিকার চাই।

কীভাবে?

তোমার সাথে যেভাবে কথা বলেছি, সেভাবে তোমার মায়ের সাথে কথা বলতে চাই।

তনু মাথা নেড়ে বলল, না, না। এখন আমার মাকে এটা বলা যাবে। আমার মা তাহলে একেবারে ভেঙে পড়বে।

আগে হোক পরে হোক এটা তোমার মাকে বলতেই হবে।

তনু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এই বিষয়টার কথা আর কে কে জানে?

মায়ের আত্মীয় স্বজনেরা জানতো, তারা কেউ বেঁচে নেই। মা বেঁচে নেই তাই আমি ছাড়া কেউ জানত না। এখন তুমি জানো।

আর কেউ?

না। আর কেউ জানে না। আমার বাবা জানতো, কিন্তু সে তো আর এটা বলার জন্যে ফিরে আসবে না।

তনু কোনো কথা বলল না, নাটকের ছেলেটা যেরকম নাটকীয় ভাবে এসেছিল ঠিক সেরকম নাটকীয়ভাবে চলে গেল। তনু কিছুক্ষণ ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল, শুনতে পেলো গাবড়া বাবা দরজার কাছ থেকে সরে গেল। ধুরন্ধর মানুষটা সবকিছু শুনেছে। তনু একটু এগিয়ে ঘরের ভেতর উঁকি দিল। ঘরের মাঝখানে গাবড়া বাবা পদ্মাসনে ধ্যান করার ভঙ্গিতে বসে আছে। দেখে মনে হবে কিছু শুনে না, কিছু জানে না।

 

টুনি ছোটাচ্চুকে এমনভাবে জ্বালাতন করল যে ছোটাচ্চু সেদিন তনুদের বাসা থেকে তার বিজ্ঞানের বইটা উদ্ধার করে নিয়ে এল। কৃতজ্ঞতা হিসেবে

টুনি ছোটাচ্চুর গালে একটা চুমু দিতে রাজি ছিল কিন্তু ছোটাচ্চু সেটা নিতে রাজি হল না। তবে তনুর বাসায় কী হয়েছে সেটা বেশ রংচং দিয়ে টুনিকে শুনিয়ে দিল। এখন শুধু অপেক্ষা করতে হবে কখন গাবড়া বাবার উপর তনুর বাবার আত্মা এসে ভর করে। সেটার জন্যে খুব বেশি দেরি হওয়ার কথা না।

সত্যি সত্যি একদিন পরেই ছোটাচ্চুকে তনু খবর দিল, গাবড়া বাবা জানিয়েছে তনুর বাবা তার পরিবারকে কিছু জরুরি খবর দিতে চায়। রাত্রিবেলা তনুর বাবা স্বপ্নে বলে গেছে। গাবড়া বাবা সেজন্যে বিকেলে মৃত আত্মাকে আহ্বান করতে চায়।

শুনে তনু খুবই কাচুমাচু হয়ে বলল, ছোটাচ্চু–

ছোটাচ্চু কথাটা শোনার জন্যে অপেক্ষা করল না, রীতিমতো হুংকার দিয়ে বলল, নো। নেভার। তোকে নিয়ে যাওয়া যাবে না।

একবার। শুধু একবার। এই শেষ-

ছোটাচ্চু আরো জোরে হুংকার দিল, না। এর আগেরবার তুই বলেছিস আর কোনোদিন আমাকে জ্বালাতন করবি না।

আমি জ্বালাতন করব না ছোটাচ্চু। চুপ করে থাকব। এর আগেরবার কি একবারও কথা বলেছিলাম?

ছোটাচ্চু জোরে জোরে মাথা নাড়ল, না। এটা বড়দের ব্যাপার। ভণ্ড কাপালিককে হাতে নাতে ধরা হবে। এখানে শুধু বড়রা থাকবে। ছোটদের জায়গা এটা না।

টুনি তারপরেও চেষ্টা করল কিন্তু ছোটাচ্চু কিছুতেই রাজি হল না।

 

দুপুরের দিকে কিছু একটা খেয়ে ছোটাচ্চু বের হয়ে গেল। টুনি তখন শান্তকে খুঁজে বের করে বলল, শান্ত ভাইয়া, তোমার সাথে কথা আছে।

কী কথা?

আমার একটা কাজ করে দিতে হবে।

কতো টাকার কাজ?

এখনো জানি না, কম হলেও পাঁচশ টাকা তো হবেই।

শান্তর চোয়াল ঝুলে পড়ল, বলল, পাঁ-চ-শ-টা-কা?

টুনি বলল, বেশিও হতে পারে, সেটা নির্ভর করবে তোমার উপর। তবে—

তবে কী?

কোনো এডভান্স দিতে পারব না। কাজ শেষ হলে টাকা পাবে।

শান্ত ভুরু কুচকে কিছুক্ষণ চিন্তা করল, তারপর বলল, ঠিক তো? পরে ফাকি দিবি না তো?

টুনি মুখ শক্ত করে বলল, কখনো দিয়েছি? শান্ত বলল, ঠিক আছে কী করতে হবে বল।

টুনি তার কাজটা ব্যাখ্যা করতে থাকে আর সাথে সাথে শান্তর মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে উঠতে থাকে। এই হাসি দেখে যে কোনো স্বাভাবিক মানুষের ভয় পেয়ে যাবার কথা।

 

বিকেলবেলা গাবড়া বাবার ঘরে তনু, তনুর মা ছাড়াও ছোটা আর ফারিহা বসে আছে। গাবড়া বাবার সামনে একটা মাটির মালশা থেকে ধােয়া বের হচ্ছে। ঘরের সব জানালার সব পর্দা টেনে রাখা হয়েছে, দরজাও বন্ধ তাই ঘরের মাঝে আবছা অন্ধকার। সামনে একটা মোমবাতি জ্বলছে। গাবড়া বাবার শরীরে কালো আলখাল্লা, একটা লাল চাদর গলা থেকে ঝুলছে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গাবড়া বাবা হঠাৎ হুম-ম-ম-ম করে একটা শব্দ

করল, সেই শব্দ শুনে ছোটাচ্চু রীতিমতো চমকে উঠল।

গাবড়া বাবা হঠাৎ তার লাল চোখ খুলে সবাইকে এক নজর দেখে নিল, তারপর বলল, কেউ কথা বলবা না। তাহলে আত্মার কষ্ট হবে। আত্মা আসতে পারবে না। আবার আসলে যেতে পারবে না। মহাবিপদ হয়ে যাবে।

সবাই এমনিতে চুপ করে বসেছিল, এখন আরো চুপ করে গেল, মনে হল শ্বাস প্রশ্বাসও নিতে লাগল নিঃশব্দে। গাবড়া বাবা কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইল তারপর হঠাৎ থরথর করে কাঁপতে লাগল, মুখ দিয়ে নানারকম বিচিত্র শব্দ করতে লাগল তারপর হঠাৎ কাঁপুনি থামিয়ে সোজা হয়ে বসে নাকি সুরে বলল, নিলু। নিলু তুমি কই?

নিলু নিশ্চয়ই তনুর মায়ের নাম, একেবারে ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসে বললেন, এই যে, এই যে আমি।

আমি আনোয়ার।

তনুর মা বললেন, জানি। আমি জানি।

আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে নীলু। অনেক কষ্ট।

কেন? কষ্ট কেন? তনুর মা একেবারে ব্যাকুল হয়ে উঠলেন।

পৃথিবীর মায়া আমাকে বড় কষ্ট দেয়। তোমার কথা তনুর কথা আমি ভুলতে পারি না। তাই বারবার তোমাদের কাছে আসি।

ছোটাচ্চু গাবড়া বাবার ফিচলে কথা শুনে মুগ্ধ হল। লোকটা যত বড় ক্রিমিনালই হোক কথা বলে গুছিয়ে।

তনুর মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন, বললেন, তোমার কথাও আমরা ভুলতে পারি না। গাবড়া বাবা আছে বলে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারি। মনটা শান্ত হয়।

গাবড়া বাবা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, নীলু। তোমার মনটা শক্ত কর। এখন তোমাকে আমি একটা কথা বলব।

কী কথা।

আমার সাথে কুলসুমের দেখা হয়েছে।

ছোটাচ্চু আবছা অন্ধকারে মুচকি হাসল। গাবড়া বাবা ফাঁদে পা দিচ্ছে। স্টিং অপারেশন শুরু হয়ে গেছে।

তনুর মা অবাক হয়ে বললেন, কুলসুম? কুলসুম কে?

তুমি কুলসুমকে চিন না। তার কারণ আমি তোমাকে কোনোদিন কুলসুমের কথা বলি নাই। কুলসুম আমার প্রথম পক্ষের স্ত্রী।

তনুর মা চমকে উঠে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন, বললেন, তোমার আগের পক্ষের স্ত্রী আছে?

গাবড়া বাবা নাকি সুরে বলল, হ্যাঁ নিলু। তোমাকে আগে কখনো বলি নাই, আজকে বলি। তোমাকে বিয়ে করার আগে আমি আরেকটা বিয়ে করেছিলাম, তার ঘরে আমার একটা ছেলেও আছে। ছেলেটার নাম রাজু।

ছেলে? রাজু?

হ্যাঁ। তারা তোমার কাছে আসবে।

আসবে?

হ্যাঁ। সম্পত্তির জন্যে মামলা করবে সাবধান।

কথা শেষ করে গাবড়া বাবা হঠাৎ আবার থরথর করে কাঁপতে শুরু করল, তারপর ধড়াম করে উপুড় হয়ে পড়ে গেল।

রে বসে থাকে তারপর তনুর মা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললেন। বললেন, কী আশ্চর্য!

গাবড়া বাবা তখন একটা ঝাকুনি দিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল, কে? কী?

কেউ কোনো কথা বলল না। গাবড়া বাবা বলল, এসেছিল? তোমার স্বামী এসেছিল? ভর করেছিল আমার উপর?

এবারেও কেউ কোনো কথা বলল না। গাবড়া বাবা বলল, কী হল? তোমরা সবাই চুপ করে আছ কেন?

এবারে ছোটাচ্চু বলল, তার কারণ আমরা বুঝতে পেরেছি আপনি একজন ভণ্ড।

এবারে গাবড়া বাবা চমকে উঠল, বলল, ভণ্ড?

হ্যাঁ, আপনি ভণ্ড এবং প্রতারক।

গাবড়া বাবা আরো জোরে চমকে উঠল, ভণ্ড এবং প্রতারক?

হ্যাঁ।

কেন এরকম বলছ? কী হয়েছে তোমার?

তার কারণ তনুর বাবা আনোয়ার হোসেনের আগের কোনো স্ত্রী নেই। আগের কোনো ছেলে নেই। আনোয়ার হোসেনের একজনই স্ত্রী আর একজনই মেয়ে।

গাবড়া বাবা কেমন যেন ঘাবড়ে গেল, বলল, কিন্তু কিন্তু কিন্তু–

এর মাঝে কোনো কিন্তু নেই। আমরা আগেই সন্দেহ করছিলাম আপনি ভণ্ড। আপনি ভান করেন যে, আপনার উপর আত্মা ভর করে, আপনার মুখ দিয়ে আত্ম কথা বলে। আসলে সব আপনার একটিং!

এবারে তনুও মুখ খুলল। গলা উঁচিয়ে চিৎকার করে বলল, আমার বাবা কখনো আগে আরেকটা বিয়ে করেনি!

গাবড়া বাবা এবারে কেমন যেন ঘাবড়ে গেল, আমতা আমতা করে বলল, না মানে ইয়ে, আসলে এটা তো আমি বলি নাই, আনোয়ার সাহেবের আত্মা বলেছে।

তনু আরো জোরে চিৎকার করে বলল, মোটেও আমার বাবার আত্মা এসে এগুলো বলেনি! আমার বাবার আত্মা এসে ফালতু মিথ্যা কথা বলে বেড়াবে না।

গাবড়া বাবা এবারে মোটামুটি ভয় পেয়ে গেল, মনে হল সে তার ঝোলাটার দিকে হাত বাড়াল, হাতে নিয়ে মনে হয় একটা দৌড় দেবে কিন্তু ঠিক সেই সময় তনুর মা তীক্ষ গলায় চিৎকার করে বললেন, তনু! তুই থামবি?

তনু প্রায় কান্না কান্না গলায় বলল, কেন মা? আমাকে কেন থামতে হবে? এই লোক আমাদের ঠকিয়ে যাচ্ছে, আমাদের সাথে তামাশা করছে আর দিনের পর দিন আমাদের সেটা সহ্য করতে হবে?

তনুর মা ঠাণ্ডা গলায় বললেন, গাবড়া বাবা মোটেও তামাশা করছেন।

তনু হকচকিয়ে গিয়ে বলল, মানে?

গাবড়া বাবার একটা কথা এখনো ভুল বের হয়নি। নিশ্চয়ই তোর বাবা গোপনে আরেকটা বিয়ে করেছিল। আমাকে কখনো বলে নাই। পরকালে সেটা নিয়ে অপরাধবোধে ভুগছে। এখন নিশ্চয়ই সেটা আমাদেরকে জানাতে চায়। আমাদেরকে বলে অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হতে চায়। আমাদের এখন খোঁজ নিতে হবে। ছেলেটাকে খুঁজে বার করতে হবে।

তনু চোখ কপালে তুলে বলল, কী বলছ তুমি মা? তুমি জান তোমার গাবড়া বাবা কেন এই কথা বলছে? তুমি জান?

তনুর মা বলল, আমার কোনো কিছু জানার দরকার নাই। শুধু তুই জেনে রাখ, আমার মেয়ে হয়ে তুই গাবড়া বাবাকে অসম্মান করতে পারবি না। তোকে এক্ষুনি গাবড়া বাবার পা ধরে ক্ষমা চাইতে হবে।

তনুর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। সে গাবড়া বাবার মুখের দিকে তাকাল, তার চোখেমুখে তখন আনন্দের মৃদু হাসি, শুধুমাত্র বড় বড় দাড়ি-গোঁফের কারণে সেটা ঢাকা পড়ে আছে। তনুর মা আবার বললেন, পা ধর গাবড়া বাবার। এক্ষুনি পা ধর বলছি।

তনু পা ধরল না, তার চেহারাটা কেমন জানি ম্লান হয়ে গেল। তনুর মা চিৎকার করে বলল, পা ধরে মাপ চা বলছি। তা না হলে তোকে আমি ত্যাজ্য কন্যা করে দেব। বাড়ি থেকে বের করে দেব–

ঠিক তখন দরজায় বেল বাজল, কেউ একজন এসেছে। গাবড়া বাবা এই বাসায় জায়গা নেবার পর অন্য কেউ আজকাল খুব আসে না। বেল বাজার জন্যে অবশ্যি তনু উঠে যাবার সুযোগ পেল। দরজা খুলে দেখে সেখানে টুনি দাঁড়িয়ে আছে। তনু অবাক হয়ে বলল, তুমি? তুমি কোথা থেকে?

টুনি বলল, এই তো এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন মনে হল একবার আপনাদের দেখে আসি।

তনু কিছু বলল না। টুনি বলল, আপনাদের কী খবর?

তনু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, খবর ভালো না।

ভেতর থেকে তনুর মা বললেন, তনু। ভেতরে আয় বলছি। গাবড়া বাবার সাথে বেয়াদপী করার জন্যে এক্ষুনি পা ধরে মাপ চা।

টুনি কী একটা ভাবল, তারপর দরজা ঠেলে গাবড়া বাবার ঘরে ঢুকে গেল। ভেতরে আবছা অন্ধকার, ছোটাচ্চু তার মাঝেই টুনিকে দেখে অবাক হয়ে বলল, টুনি! তুই কী করছিস এখানে?

টুনি বলল, মনে নাই, আমার নাচের ক্লাস হয় এখানে। ছোটাচ্চু রেগে বলার চেষ্টা করল, না-না-নাচ?

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। আমার নাচের টিচারকে গাবড়া বাবার কথা বলেছি, তাই নাচের টিচার একটা জিনিস নেবার জন্যে আসতে চাচ্ছিলেন। আমি বললাম, আমিই নিয়ে আসব।

ছোটাচ্চু ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল, কী জিনিস?

গাবড়া বাবার একটা চুল।

চুল? চুল দিয়ে কী হবে?

তাবিজ। টুনি চোখ বড় করে হাত নেড়ে বলল, আমার নাচের টিচার বলেছেন, সিদ্ধ পুরুষের চুল দিয়ে তাবিজ বানানো যায়। ফাটাফাটি তাবিজ!

তনুর মা জিজ্ঞেস করলেন, কিসের তাবিজ?

সবকিছুর তাবিজ। আমাদের নাচের টিচার তার ছেলের জন্যে বানাতে চাইছে।

ছেলের কী সমস্যা?

বিছানায় পিশাব করে দেয়।

তনুর মা একটু থতমত খেয়ে বললেন, ও!

টুনি সবাইকে পাশ কাটিয়ে গাবড়া বাবার দিকে এগিয়ে যায়। গাবড়া বাবা কেমন যেন ব্যস্ত হয়ে বলল, দিচ্ছি, আমি দিচ্ছি। আমার একটা চুল ছিড়ে দিচ্ছি।

টুনি বলল, আপনাকে দিতে হবে না। আপনি বসে থাকেন, আমি নিয়ে নেব। একটা চুল, খালি একটা।

গাবড়া বাবা দুই হাতে নিজের চুল জাপটে ধরে বলল, না, না।

কিন্তু ততক্ষণে টুনি প্রায় ডাইভ দিয়ে গাবড়া বাবার চুল ধরে ফেলেছে। সে বলেছে তার একটা চুল দরকার কিন্তু দেখা গেল সে মোটেও একটা চুলের জন্যে চেষ্টা করছে না। খাবলা দিয়ে চুলের ঝুটি ধরে ফেলেছে। এতোগুলো চুল ছেড়া সম্ভব না কিন্তু তারপরও টুনি হ্যাচকা টান দিয়ে চুলের গোছা ছিড়ে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল। সবাই বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে এবং তার মাঝে হঠাৎ পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপারটি ঘটে গেল। টুনির হ্যাচকা টানে হঠাৎ করে গাবড়া বাবার মাথার পুরো চুল উপড়ে টুনির হাতে চলে এলো। অন্য সবাই বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলেও টুনি মোটেই অবাক হল বলে মনে হল না। সে পুরো চুলগুলো ছোটাচ্চুর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে এবারে খাবলা দিয়ে গাবড়া বাবার দাড়ি ধরে হ্যাচকা টানের পর টান দিতে লাগল। কোনো একটা বিচিত্র কারণে এবারে সবাই বুঝে গেল চুলের মতো পুরো দাড়িগুলোও উপড়ে চলে আসবে। বড় ধরনের হুটোপুটি শুরু হয়ে গেল, গাবড়া বাবা ঝটকা দিয়ে টুনিকে সরানোর চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু টুনি গাবড়া বাবার দাড়ি ছাড়ল না, সে টানতেই লাগল এবং হঠাৎ করে পুরো মিশমিশে কালো দাড়ি গাবড়া বাবার মুখ থেকে খুলে এলো। টুনি সেই দাড়িগুলো বিজয়ীর মতো ধরে রেখে বলল, তাবিজ বানানোর জন্য আসল চুল দাড়ি দরকার। এই নকল চুল দাড়ি দিয়ে হবে না।

টুনির কথা কেউ শুনল না, সবাই অবাক হয়ে গাবড়া বাবার দিকে তাকিয়ে রইল, এখন তাকে দেখাচ্ছে খুবই অদ্ভুত। মাথায় একটাও চুল নাই বিস্তৃত টাক, মুখে একটা দাড়িও নেই। থুতনিটা ছোট, মনে হয় তাকে তৈরি করার সময় মালমশলার অভাব হয়েছিল বলে থুতনিটা অসমাপ্ত রেখে শেষ করে দেয়া হয়েছে। পাতলা ঠোঁট আর তরমুজের বিচির মতো কালো কালো দাঁত বের হয়ে আছে। কুকুতে চোখ এবং দেখে মনে হয় কেউ একজন একটা খাটাসকে সিদ্ধ করে তার সবগুলো লোম খিমচে খিমচে তুলে নিয়েছে। মানুষটার দিকে তাকালে সবার আগে যেটা চোখে পড়ে সেটা হচ্ছে ডান গালে একটা কাটা দাগ, কানের নিচ থেকে শুরু করে থুতনি পর্যন্ত লোম এসেছে।

গাবড়া বাবা নামের মানুষটার কয়েক সেকেন্ড লাগল বুঝতে কী হচ্ছে, তারপর হাত দিয়ে তার লাল রঙের ঝোলাটা হাতে নিয়ে সে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ব্যাগের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে সে একটা রিভলবার বের করে সবার দিকে তাক করে বলল, খবরদার। খুন করে ফেলব।

যে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল, কেউ অনুমান করেনি হঠাৎ করে ঘটনাটা এভাবে মোড় নেবে। লোমবিহীন খাটাসের মতো দেখতে গাবড়া বাবা নামের মানুষটা তার রিভলবারটা সবার দিকে তাক করে আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। লাথি দিয়ে দরজাটা খুলে হিংস্র গলায় বলল, খবরদার! আমার পিছনে পিছনে আসলে খুন করে ফেলব।

তনুর মা বললেন, কেউ তোমার পিছন পিছন যাবে না। তুমি বিদায় হও। তারপর মানুষটা শুনতে পায় না সেভাবে ফিস ফিস করে বললেন, বদমাইস জোয়াচ্ছ্বর কোথাকার!

গাবড়া বাবা নামের মানুষটা দড়াম করে দরজা বন্ধ করে বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। তারা শুনতে পেল সে বসার ঘরের দরজা খুলে বের হয়ে যাচ্ছে।

ছোটাচ্চুর হাতে গাবড়া বাবার চুল, টুনির হাতে তার দাড়ি। ছোটাচ্চু চুলগুলো মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে টুনিকে জিজ্ঞেস করল, তুই কেমন করে জানলি এর চুল দাড়ি নকল।

আমার বিজ্ঞানের বই।

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, বিজ্ঞানের বই?

হ্যাঁ, মনে নেই, আমার বিজ্ঞানের বইটা এই ঘরে ভুল করে রেখে গিয়েছিলাম?

হ্যাঁ। তাতে কী হয়েছে?

আসলে ভুল করে ফেলে যাই নাই, ইচ্ছা করে ফেলে গিয়েছিলাম। তার কারণ হচ্ছে আসলে ঐ বইটা খালি বিজ্ঞানের বই ছিল না, তোমার ভিডিও ক্যামেরাটা এর মাঝে ফিট করা ছিল।

ছোটাচ্চুর চোখ বড় বড় হয়ে গেল, আমার ভিডিও ক্যামেরা?

টুনি বলল, হ্যাঁ। সারারাত এই ঘরের ভিডিও তুলেছে। সেই ভিডিওতে আমি দেখেছি গাবড়া বাবা রাত্রিবেলা চুল দাড়ি খুলে ঘ্যাস ঘ্যাস করে মাথার চাদি আর গাল চুলকায়।

আমাকে বলিসনি কেন?

ভয়ে।

কীসের ভয়?

তুমি যদি বকা দাও। মনে নাই আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম আর কোনোদিন তোমাকে জ্বালাব না!

তাই বলে এটা বলবি না? এখন দেখ লোকটা পালিয়ে গেল, আগে থেকে জানলে ধরে ফেলতে পারতাম।

টুনি মুখ কাচুমাচু করে বলল, একটা কথা বলব ছোটাচ্চু?

কী কথা?

তুমি বকা দিবে না তো?

না বকা দিব না। বল।

এই লোকটা আসলে পালিয়ে যেতে পারবে না।

ছোটাচ্চু চোখ বড় বড় করে বলল, পালিয়ে যেতে পারবে না? কেন?

তোমার পারমিশান না নিয়েই তোমার নামে শান্ত ভাইয়ার সাথে পাঁচশ টাকার কন্ট্রাক্ট করেছি।

কী কন্ট্রাক্ট করেছিস?

শান্ত ভাইয়া তার বন্ধুদের নিয়ে নিচে অপেক্ষা করছে। তাকে বলেছি যদি দেখে কালো আলখাল্লা পরা কোনো মানুষ ছুটে বের হয়ে যায় তাকে ধরে ফেলতে হবে। মানুষটার হয় অনেক লম্বা লম্বা চুল দাড়ি থাকবে, না হলে একেবারে চাঁচাছোলা হবে।

সত্যি?

হ্যাঁ, লোকটা পালাতে পারবে না। ছোটাচ্চু দুশ্চিন্তিত মুখে বলল, কিন্তু মানুষটার কাছে রিভলবার—

টুনি মাথা নাড়ল, কোনো সমস্যা নাই। শান্ত ভাইয়ার বন্ধুদের মাঝে দুইজন ব্ল্যাকবেল্ট। রিভলবার চাকু ওদের কাছে কোনো ব্যাপার না।

ছোটাচ্চুর দুশ্চিন্তা তবু যায় না, বলল, তারপরও —

 

আসলে ছোটাচ্চুর দুশ্চিন্তার কোনো কারণ ছিল না। গাবড়া বাবা যখন গেট খুলে বের হল, শান্ত আর তার বন্ধুদের বুঝতে একটুও দেরি হল না যে এই সেই লোক। কালো আলখাল্লা, লাল ব্যাগ, মাথায় একটা চুল নেই, মুখে। একটা দাড়ি নেই, কেমন যেন চাঁচাছোলা ভাব। মানুষটার দিকবিদিক জ্ঞান নেই, গেট খুলে প্রাণ নিয়ে ছুটতে থাকে। তাকে ধরার কোনো চেষ্টা না করে শান্ত তাকে ল্যাং মেরে দিল, আর মানুষটা তখন তাল হারিয়ে একেবারে কাটা কলাগাছের মতো আছাড় খেয়ে পড়ল। সেই অবস্থায় লোকটা তার লাল ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে তার রিভলবারটা বের করার চেষ্টা করছিল, তখন ব্ল্যাকবেল্ট নম্বর ওয়ান একটা লাথি দিয়ে তার হাতের বারোটা বাজিয়ে দিল। ঠিক তখন দুই নম্বর ব্ল্যাকবেল্ট পিছন থেকে তার হাতটা এমনভাবে পেঁচিয়ে ধরল যে তার আর নড়ার উপায় থাকল না। অন্যরা তখন ছুটে এসে তার শরীরের নানা জায়গা মাটির সাথে চেপে ধরে তারস্বরে চেঁচাতে লাগল। শান্তর গলা উঠল সবার উপরে, আর দেখতে দেখতে গাবড়া বাবাকে ঘিরে মানুষের ভিড় জমে গেল। একজন কাছে এসে গাবড়া বাবাকে এক নজর দেখে চিৎকার করে উঠল, আরে! এটা তো গাল কাটা বকইর‍্যা!

আরেকজন জিজ্ঞেস করলাম, সেটা আবার কে?

শীর্ষ সন্ত্রাসী। দেওয়ালে বিশজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর পোস্টার দিয়েছে দেখেন নি? ধরতে পারলেই পুরস্কার। এ হচ্ছে তাদের একজন।

 

গাল কাটা বকইর্যাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে ছোটাচ্চুর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিকে পুরস্কারের টাকা দেওয়া হয়েছিল। তনুর মায়ের কাছেও ছোটাচ্চু একটা বিল পাঠিয়েছিল। যত টাকা বিল করেছিল তনুর মা তার দ্বিগুণ টাকার একটা চেক পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির উপার্জন হিসেবে সেই চেকটার একটা ছবি বড় করে ছোটাচ্চুর ঘরে টানানো আছে।

শান্তর সাথে পাঁচশ টাকার কন্ট্রাক্টের টাকাটা ছোটাচ্চুকে দিতে হয় নি। ঘটনার পরপর তনু নিজের ব্যাগ থেকে সেটা শান্তকে দিয়ে দিয়েছিল। তার শুধু টাকা নয়, সাথে কাছাকাছি ফাস্টফুডের দোকানে নিয়ে তাদের সবাইকে ভরপেট খাইয়ে দিয়েছিল।

টুনি যদিও কথা দিয়েছিল সে আর ছোটাচ্চুকে কোনোদিন জ্বালাতন করবে না কিন্তু তারপরেও আবার কারণে-অকারণে জ্বালাতন করতে শুরু করেছে। ছোটাচ্চু শুধু যে জ্বালাতনটুকু সহ্য করে তা না, মাঝে মাঝে পরামর্শ করার জন্যে টুনিকে নিজে থেকেই ডাকে। বেশিরভাগ সময়েই টুনি না ডেকে টুনটুনি বলে ডাকে।

আজকাল টুনটুনি বলে ডাকলেও টুনি সাড়া দেয়।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল