এই বাসার সবচেয়ে যে চুপচাপ মেয়ে, সে ছোট চাচার কাছে এসে বলল, ছোটাচ্চু, তোমার সাথে একটা কথা আছে।

মেয়েটা যেহেতু খুব চুপচাপ, কথা বলে কম, তাই সে যখন কথা বলে, তখন সবাই আগ্রহ নিয়ে শোনে। তাই ছোটাচ্চুও আগ্রহ নিয়ে বলল, কী কথা, টুম্পা?

চুপচাপ মেয়েটার নাম টুম্পা। যেহেতু সে চুপচাপ, তাই এই বাসায় এই নাম ধরে খুব বেশি ডাকাডাকি হয় না।

টুম্পা বলল, তুমি তো একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছ।

ছোটাচ্চু বলল, হ্যাঁ, খুলেছি।

তুমি কি আমার একটা কেস নেবে?

ছোটাচ্চু হাসার চেষ্টা করল, কিন্তু ঠিক হাসতে পারল না। তাই শুধু হাসির মতো একটা শব্দ বের হলো। শব্দটা শেষ করে বলল, দেখ টুম্পা, আমি মনে হয় তোদের ব্যাপারটা ঠিক বোঝাতে পারি নাই। আমার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি কিন্তু মোটেও ছেলেখেলা না।

টুম্পা বলল, আমার কেসটাও ছেলেখেলা না।

ছোটাচ্চু একটু থতমত খেয়ে বলল, তোর কেসটা কী?

টুম্পা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। মনে হলো, মনে মনে ঠিক করে নিল কী বলবে। তারপর গলা পরিষ্কার করে বলতে শুরু করল। টুম্পা এমনিতে চুপচাপ, কিন্তু যখন কথা বলতে হয়, গুছিয়ে বলতে চেষ্টা করে। টুম্পা বলল, আমাদের স্কুলে আগে টিফিন দিত। কোনোদিন রুটি-সবজি, কোনোদিন খিচুড়ি, কোনোদিন আলুচপ, কোনোদিন মাংস-পরোটা। টিফিনগুলো হতো খুবই খারাপ, মুখে দেওয়ার মতো না। টিফিন খেয়ে একবার সবার ডায়রিয়া হয়ে গিয়েছিল। শুধু আমার হয় নাই।

ছোটাচ্চু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কেন? তোর হয় নাই কেন?

তার কারণ, আমি কোনোদিন স্কুলের টিফিন খাই নাই।

ছোটাচ্চু ভুরু আরও বেশি কুঁচকে বলল, কেন টিফিন খাস নাই? না খেয়ে থাকলে পেটে গ্যাস্ট্রিক না হলে আলসার হয়ে যেতে পারে, জানিস?

টুম্পা বলল, টিফিন খেয়ে মরে যাওয়া থেকে না খেয়ে গ্যাস্ট্রিক আর আলসার হওয়া অনেক ভালো। স্কুলের টিফিন খেয়ে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই মরে যেত। তখন স্কুল থেকে টিফিন বন্ধ করে দিল। নিয়ম করে দিল, এখন থেকে সবাইকে বাসা থেকে নিজের টিফিন নিজেকে আনতে হবে।

তুই এখন বাসা থেকে টিফিন নিয়ে যাস?

হ্যাঁ। আম্মু প্রতিদিন আমার জন্য টিফিন বানিয়ে দেয়। কিন্তু বলে টুম্পা চুপ করে গেল।

কিন্তু কী?

টুম্পা বলল, সেই জন্য আমি তোমার কাছে এসেছি।

কী জন্য এসেছিস? ছোটাচ্চু এবার একটু অধৈর্য হলো।

আমার কেস।

তোর কী কেস?

প্রত্যেকদিন কেউ একজন আমার টিফিন খেয়ে ফেলে। তোমাকে বের করে দিতে হবে, কে আমার টিফিন খায়। টুম্পা কথা শেষ করে মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল।

ছোটাচ্চু হতাশ ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, দেখ টুম্পা, আমার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি হচ্ছে সিরিয়াস বিজনেস। কে তোর টিফিন খেয়ে ফেলে, সেটা বের করা মোটেও আমার এজেন্সির কাজ না।

টুম্পা বলল, তুমি সত্যিকারের ডিটেকটিভ হলে নিশ্চয়ই বের করতে পারবে।

আমি একশবার সত্যিকার ডিটেকটিভ। ছোটাচ্চু মুখটা গম্ভীর করে বলল, ডিটেকটিভ হতে হলে যা যা শিখতে হয়, আমি সবকিছু শিখে ফেলেছি। মার্ডার সিনে কেমন করে আন্ট্রাভায়োলেট-রে দিয়ে রক্তের চিহ্ন বের করতে হয় তুই জানিস? জানিস না। আমি জানি। আঙুলের ছাপ কেমন করে নিতে হয় তুই জানিস? জানিস না। আমি জানি। ব্লাড টেস্ট করে কেমন করে বের করতে হয় কী ড্রাগস খেয়েছে তুই জানিস

টুম্পা বলল, কে আমার টিফিন খেয়ে ফেলে সেটা বের করে দেবে কি না বলো।

দেখ টুম্পা, তোকে আমি মনে হয় বোঝাতে পারি নাই–

টুম্পা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তার মানে তুমি বের করে দেবে। ঠিক আছে, আমি টুনি আপুর কাছে যাব। টুনি আপু তো তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট, নিশ্চয় বের করে দেবে।

ছোটাচ্চু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, টুম্পা তার সুযোগ না দিয়েই ঘর থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে টুনির কাছে হাজির হল।

টুনি গভীর মনোযোগ দিয়ে টুম্পার কথা শুনল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ক্লাসে কি শুধু তোর টিফিন চুরি হয়, নাকি আরও ছেলেমেয়ের টিফিন চুরি হয়?

মনে হয় শুধু আমার।

তোর ক্লাসে টিফিন ছাড়া আর কিছু কি চুরি হয়?

মনে হয় না।

তোর টিফিন কি প্রতিদিন চুরি হয়?

যেদিন আম্মু স্যান্ডউইচ বানিয়ে দেয়, সেদিন হয় না। মনে হয়, চোর স্যান্ডউইচ পছন্দ করে না।

তুই কি কাউকে সন্দেহ করিস?

আমাদের ক্লাসে অসম্ভব দুষ্টু একটা ছেলে আছে, অসম্ভব পাঁজি একটা মেয়ে আছে, তারা হতে পারে?

কিন্তু তোর কাছে কি প্রমাণ আছে?

নাই।

টুনি চিন্তিত মুখে বলল, প্রমাণ না থাকলে তো লাভ নাই। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোর যে টিফিন চুরি হয়ে যায়, সেটা কি আর কেউ জানে?

জানে।

কে জানে?

আমার যে বন্ধু আছে জিকু, সে জানে।

জিকু ছেলে না মেয়ে?

মেয়ে।

সে কেমন করে জানে?

আমি বলেছি, সেই জন্য জানে। জিকুও টিফিনচোর ধরার চেষ্টা করেছে, পারে নাই। আমি যখন বাথরুমে কিংবা অন্য কোথাও যাই, তখন জিকু পাহারা দেয়। তার পরও টিফিন চুরি হয়ে যায়।

টুনি বলল, হুম।

জিকুর মনটা খুব ভালো। যখন আমার টিফিন চুরি হয়ে যায়, আমাকে তার টিফিন খেতে দেয়।

তুই খাস?

উহু। টুম্পা যতটুকু জোরে মাথা নাড়ার কথা, তার থেকে অনেক বেশি জোরে মাথা নাড়ল।

কেন খাস না?

জিকুর আম্মা একেবারে টিফিন বানাতে পারে না। যে টিফিন তৈরি করে দেয়, সেগুলো খাওয়া যায় না।

কী টিফিন দেয়?

একটা শক্ত রুটি, তার মাঝখানে ডাল।

আর?

আর কিছু না। প্রতিদিন একই জিনিস।

একই জিনিস?

হ্যাঁ। মাঝে মাঝে রুটি বেশি শক্ত, মাঝে মাঝে কম শক্ত। ডালটা মাঝে মাঝে ল্যাদল্যাদা, মাঝে মাঝে আঠা আঠা।

টুনি বলল, হুম।

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, তুমি কি বের করতে পারবে, কে আমার টিফিন চুরি করে?

টুনি বলল, মনে হয় পারব।

সত্যি?

হ্যাঁ, সত্যি। শুধু একটু বিপদ আছে।

বিপদ?

হ্যাঁ।

কার বিপদ?

তোর বিপদ।

টুম্পা অবাক হয়ে বলল, আমার?

হ্যাঁ। তুই যদি বিপদকে ভয় না পাস, তাহলে কালকেই বের করে দেব। কিন্তু পরে আমাকে দোষ দিতে পারবি না। রাজি?

টুম্পা রাজি হলো।

 

পরদিন সকালে টুম্পা স্কুলে যাওয়ার সময় টুনি তাকে থামাল। জিজ্ঞেস করল, টিফিন নিয়েছিস?

টুম্পা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

কী টিফিন?

নুডলস।

এটা কি চুরি হবে?

মনে হয়। নুডলস নিলেই চুরি হয়। চোর মনে হয় নুডলস খেতে খুব পছন্দ করে।

গুড। টুনি হাত পেতে বলল, দে তোর টিফিনের প্যাকেট।

কেন?

কোনো প্রশ্ন করবি না। তুই দে।

টুম্পা তার ব্যাকপ্যাক থেকে পলিথিনে মোড়া একটা প্লাস্টিকের বাটি বের করে আনল। টুনি সেটা হাতে নিয়ে বলল, তুই দাঁড়া, আমি আসছি।

কী করবে তুমি আমার নুডলস নিয়ে।

কোনো প্রশ্ন করতে পারবি না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক।

টুম্পা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল আর টুনি নুডলসের বাটি নিয়ে তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। কিছুক্ষণ পর সে আবার প্যাকেটটা নিয়ে বের হয়ে এল, সাথে দুটো খাম। নুডলসের প্যাকেট আর খাম দুটো টুম্পার হাতে দিয়ে বলল, নে।

কী এগুলো!

যদি তোর নুডলস চুরি হয়, তাহলে পনেরো মিনিট পর এক নম্বর খামটা খুলবি। যদি কোনো সমস্যা না হয়, তাহলে দুই নম্বর খামটা খুলতে হবে না, আমাকে বন্ধ অবস্থায় ফেরত দিবি।

কী আছে খামের ভেতরে?

তোর এখন জানার দরকার নাই। যদি তোর টিফিন চুরি হয়, শুধু তাহলে তুই জানতে পারবি।

টুম্পা বলল, ঠিক আছে।

টুনি বলল, আরও একটা কথা। কী কথা?

তুই আজকে কাউকেই কিছু বলবি না। কোনো বন্ধুকে না, কোনো প্রাণের বন্ধুকে না। এমনকি তোর টিফিন নিয়ে তুই আজকে নিজের সাথেও কথা বলতে পারবি না।

টুম্পা টুনির দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল। নিজের সাথেও কথা বলা যাবে না সেটা কী ব্যাপার, টুম্পা বুঝতে পারছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে নিকে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।

 

স্কুলে গিয়ে টুম্পা তার ডেস্কের ওপর ব্যাগটা রেখে এদিক-সেদিক তাকাল, তার টিফিন চোর এর মাঝে চলে এসেছে কি না, কে জানে। টুনি আপু বলেছে, টিফিন চোর আজ ধরা পড়বে। কীভাবে ধরা পড়বে, সেটাই বা কে বলবে? পুরো ব্যাপারটা নিয়ে জিকুর সাথে আলাপ করতে হবে, কিন্তু টুনি আপু বলে দিয়েছে আজকে কোনো বন্ধু কিংবা প্রাণের বন্ধু কারোর সাথেই এটা নিয়ে কথা বলা যাবে না—কাজেই মনে হয়, তাকে অপেক্ষা করতে হবে। টিফিন চোর ধরা পড়ার পর সেই চোরকে নিয়ে কী করা যায়, সেটা জিকুর সাথে আলোচনা করা যেতে পারে।

একটু পরই জিকু তার ব্যাগ ঝুলিয়ে চলে এল। পাশের ডেস্কে ব্যাগটা রেখে টুম্পাকে জিজ্ঞেস করল, ইংরেজি হোমওয়ার্ক এনেছিস?

টুম্পা মাথা নাড়ল, এনেছি।

আর টিফিন?

টিফিনও এনেছি।

কী এনেছিস।

আম্মু নুডলস বানিয়ে দিয়েছে।

জিকু মুখ শক্ত করে বলল, আজকে তোর ব্যাগ কঠিনভাবে পাহারা দেব। দেখব, কেমন করে চুরি করে।

টুম্পার মুখটা একবার বলার জন্য নিশপিশ করছিল যে আজ টিফিন চোর ধরা পড়বে, কিন্তু বলল না। টুনি আপু না করে দিয়েছে বলা ঠিক হবে না।

ক্লাস শুরু হওয়ার পর টুম্পা তার টিফিন, টিফিন চোরের কথা ভুলে গেল। হাফ টাইমে টুম্পা তার ব্যাগটা চোখে চোখে রাখল। যখন সে ছিল না, তখন জিকু তার ব্যাগটা লক্ষ রাখল। টুম্পা ভেবেছিল, টিফিন চোর চুরি করার সুযোগ পায়নি, কিন্তু টিফিন পিরিয়ডে যখন ব্যাগ খুলল, তখন অবাক হয়ে দেখল, তার প্লাস্টিকের বাটিটা আছে কিন্তু নুডলস হাওয়া। কী আশ্চর্য ব্যাপার! টুম্পা যত অবাক হলো, জিকু অবাক হলো তার থেকে বেশি।

জিকু তার প্যাকেট খুলে রুটি আর ডালের অর্ধেকটা টুম্পাকে খেতে দিল। সেই রুটি আর ডাল দেখেই টুম্পার খিদে চলে গেল। রুটিটাকে দেখে মনে হলো, এটা বুঝি গুইসাপের চামড়া, আর ডালটাকে মনে হলো বিষাক্ত কেমিক্যাল। টুম্পা খেতে রাজি হলো না বলে জিকু একা একাই মুখ কালো করে তার গুইসাপের চামড়া চিবুতে লাগল।

টুনি আপু বলেছিল, ঠিক পনেরো মিনিট পর প্রথম খামটা খুলতে। টুম্পা ঘড়ি ধরে পনেরো মিনিট অপেক্ষা করে খামটা খুলল। ভেতরে দুটি কাগজ, একটা হাতে লেখা অন্যটা টাইপ করা। হাতে লেখা কাগজটা টুনির হাতে লেখা। সেখানে লেখা আছে।

টুম্পা

তোর মনে আছে, আমি তোর নুডলসের বাটিটা কিছুক্ষণের জন্য ঘরে নিয়ে গিয়েছিলাম? তখন আমি একটা কাজ করেছি, তোর নুডলের ওপর কয়েক ফোঁটা গাইকো ফেরাক্সিন থার্টি টু দিয়ে দিয়েছি। এটা একধরনের কেমিক্যাল, পশু-ডাক্তাররা অবাধ্য গরু ছাগলকে বশ করার জন্য এটার ইনজেকশন দেয়। মানুষ খেলে তার ভয়ংকর একধরনের রি-অ্যাকশন হয়, তিন থেকে চার ঘণ্টা এটার প্রতিক্রিয়া থাকে। তারপর আস্তে আস্তে ভালো হয়ে যায়।

কাজেই তুই এখন তোর ক্লাসের সব ছেলেমেয়েকে লক্ষ করে দেখ, কে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ছোটখাটো অসুস্থ নয়, খুব খারাপভাবে অসুস্থ। বমি এবং মাথা ঘোরা। হাত-পায়ে কাঁপুনি ইত্যাদি ইত্যাদি। গাইকো ফ্লেক্সিন থার্টি টু কী ধরনের কেমিক্যাল, সেটা বোঝানোর জন্য ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে একটা পৃষ্ঠা দিয়েছি। ইচ্ছে করলে পড়ে দেখতে পারিস।

দেরি করবি না, তোর হাতে কিন্তু সময় বেশি নাই।

টুনি আপু।
আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি।
অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিটেকটিভ।

 

চিঠি পড়ে টুম্পার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সর্বনাশ! টুনি আপু কী ভয়ংকর একটা কাজ করেছে, টিফিন চোর ধরার জন্য তার টিফিনে বিষ মিশিয়ে দিয়েছে। টুম্পা আতঙ্কিত হয়ে চারদিকে তাকাল। দেখার চেষ্টা করল কেউ বমি করছে কি না, মাথা ঘুরে পড়ে গেছে কি না।

জিকু জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

সর্বনাশ হয়েছে।

কী সর্বনাশ হয়েছে?

টুম্পা কাঁপা গলায় বলল, টিফিন চোর ধরার জন্য টুনি আপু আমার টিফিনে বিষ মিশিয়ে দিয়েছে।

জিকু চিৎকার করে বলল, কী বললি?

হ্যাঁ। এই দেখ। টুম্পা জিকুকে চিঠিটা দেখাল, জিকু চিঠিটা পড়ল এবং টুম্পা দেখল, চিঠি পড়তে পড়তে জিকুর হাত কাঁপতে শুরু করেছে। চোখ-মুখ কেমন যেন লালচে হয়ে উঠছে, আর সেখানে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। জিকুর চেহারা দেখে হঠাৎ করে টুম্পার মাথায় ভয়ংকর একটা চিন্তা খেলে যায়। তাহলে কী—

জিকু কাঁপা হাতে বাংলায় টাইপ করা দুই নম্বর কাগজটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করল। কাগজে লেখা–

গাইকো ফ্রেরাক্সিন থার্টি টুয়ের বিষক্রিয়া

এটি প্রথমে পাকস্থলীর মাংসপেশিকে আক্রমণ করে। রক্তের সাথে মিশে যাওয়ার পর পনেরো থেকে বিশ মিনিটের মাঝে এর বিষক্রিয়া শুরু হয়। সাধারণ প্রতিক্রিয়া মাথা ঘোরা, বমি, অবসাদ ও খিচুনি। শরীরের তাপমাত্রা দুই থেকে তিন ডিগ্রি বেড়ে যেতে পারে। হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়। বিষের প্রতিক্রিয়া চলাকালে টানেল ভিশন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

শিশু ও কিশোরদের ভেতর এর প্রতিক্রিয়া আরও তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী। সাময়িকভাবে কথা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উদাহরণ রয়েছে। শরীর থেকে ঘাম নির্গত হয়। পিঠ ও পাঁজরে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। আঙুলের গোড়ায় স্পর্শানুভূতি লোপ পায়।

আক্রান্ত রোগীকে তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালে স্থানান্তর করা জরুরি। একই সাথে স্যালাইন ও কোরামিন প্রদান করে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো চিকিৎসা নেই। আক্রান্ত রোগীর মনোবল রক্ষার জন্য তাকে সাহস দিয়ে আশ্বস্ত রাখা জরুরি। এই বিষক্রিয়ার কারণে এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর ঘটনা লিপিবদ্ধ নাই।

 

জিকু পুরোটা পড়তে পারল না, তার আগেই তার সারা শরীর কাঁপতে থাকে, পাঁজর ও পিঠে ভয়ংকর ব্যথা শুরু হয়। তার হাত কাঁপতে থাকে আর মোটামুটি শব্দ করে সে বেঞ্চের ওপর পড়ে যায়। তার মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ করে একধরনের শব্দ হতে থাকে।

টুম্পার টিফিন এত দিন কে চুরি করে এসেছে, সেটা বুঝতে টুম্পার বাকি নাই, কিন্তু এই মুহূর্তে তার সেটা নিয়ে এতটুকু মাথাব্যথা নাই। জিকুকে হাসপাতালে কীভাবে নেওয়া যাবে, সেটাই হচ্ছে চিন্তা।

ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্ট ছেলে মিশু আর সবচেয়ে পাজি মেয়ে পিংকি সবার আগে ছুটে এল, জিকুকে দেখে অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে জিকুর?

টুম্পা বলল, বি-বিষ খেয়েছে।

দুষ্ট ছেলে মিশু চোখ কপালে তুলে বলল, বিষ? বিষ কোথায় পেল? কেন বিষ খেল?

এখন এত কথা বলার সময় নাই, টুম্পা শুকনো গলায় বলল, জিকুকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে।

হাসপাতাল?

হ্যাঁ।

কেমন করে নিবি?

টুম্পা কাঁপা গলায় বলল, স্যার-ম্যাডামদের বলতে হবে।

সবচেয়ে পাজি মেয়ে পিংকী বলল, তোরা অপেক্ষা কর, আমি স্যার ম্যাডামদের ডেকে আনি। বলে সে ছুটে বের হয়ে গেল।

জিকু যে রকম অসুস্থ হয়ে পড়েছে, টুম্পাও মনে হয় সে রকম অসুস্থ হয়ে পড়বে। টুনি আপু কেমন করে এ রকম ভয়ংকর একটা কাজ করল? স্যার-ম্যাডাম এসে যখন দেখবেন, সে টিফিনের মাঝে গাইকো ফ্রেরাক্সিন না কী যেন ভয়ংকর বিষ দিয়ে এনেছে, তখন তার কী অবস্থা হবে? তাকে স্কুল থেকে বের করে দেবে না? এত বড় বিপদ থেকে সে কেমন করে রক্ষা পাবে?

ঠিক তখন টুম্পার মনে পড়ল, টুনি আপু দুটি খাম বন্ধ চিঠি দিয়েছে। তাকে বলে দিয়েছে, সে যদি বিপদে পড়ে, তাহলে যেন দুই নম্বর খামটা খোলে। এর থেকে বড় বিপদ আর কী হতে পারে? জিকু বেঞ্চে শুয়ে থরথর করে কাঁপছে। মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে আতঙ্ক।

টুম্পা এর মধ্যে তার ব্যাগ থেকে দুই নম্বর খামটা বের করে সেটা খুলল, ভেতরে সাদা কাগজে বড় বড় করে লেখা

পুরোটা ধাপ্পাবাজি।
টিফিনে কোনো কেমিক্যাল দেওয়া হয় নাই।
গাইকো ফ্লেরাক্সিন থার্টি টু বলে কিছু নাই।
পুরোটাই বানানো।

টুনি
অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিটেকটিভ
আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি।

টুম্পা দুবার চিঠিটা পড়ে চিৎকার করে বলল, আসলে জিকু বিষ খায় নাই। স্যার-ম্যাডামকে ডাকতে হবে না।

সবচেয়ে পাঁজি ছেলেটা বলল, ডাকতে হবে না? হাসপাতালে নিতে হবে না?

না। কিছু করতে হবে না। পিংকীকে থামা।

পিংকীকে থামানোর জন্য মিশু গুলির মতো বের হয়ে গেল। শুধু সে-ই পিংকীকে সময়মতো থামাতে পারবে।

টুম্পা তখন জিকুকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, তোর কিছু হয় নাই। এই দেখ।

জিকু বেঞ্চে শুয়ে একবার টুনির লেখা কাগজটা পড়ল। তারপর উঠে বসে আরেক বার কাগজটা পড়ল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আরেক বার কাগজটা পড়ল। তারপর কথা নাই বার্তা নাই ধড়াম করে টুম্পার নাকের উপর একটা ঘুষি মেরে বসল।

টুম্পা এত অবাক হলো যে বলার নয়। তার টিফিন এত দিন চুরি করে খেয়ে এখন তাকেই মারছে? এর থেকে বড় অন্যায় আর কী হতে পারে?

তখন টুম্পাও ধড়াম করে জিকুর নাকে একটা ঘুষি মেরে দিল। তার মতো একটা শান্তশিষ্ট মেয়ে এ রকম একটা কাজ করতে পারে, কেউ বিশ্বাস করতে পারে না। টুম্পার ঘুষি খেয়ে জিকু তখন আরেকটা ঘুষি দিল, এবার টুম্পার পেটে। টুম্পা তখন জিকুর বুকে একটা ঘুষি দিল। জিকু তখন–

মিশু ততক্ষণে পিংকীকে ধরে নিয়ে এসেছে। তারা দুজন তখন টুম্পা আর জিকুকে ধরে সরিয়ে নিল। সরিয়ে নেওয়ার আগে টুম্পা জিকুর সাথে জন্মের আড়ি দিয়ে দিল। এ রকম অকৃতজ্ঞ বন্ধুর তার কোনো দরকার নেই।

 

টুনির সাথে বাসায় যখন টুম্পার দেখা হলো, টুনি তখন জিজ্ঞেস করল, টিফিন চোর ধরা পড়েছে?

টুম্পা কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল। টুনি জিজ্ঞেস করল, কে? জিকু?

টুম্পা অবাক হয়ে বলল, তুমি কেমন করে জাননা?

না জানার কী আছে। তোর মাথায় যদি এতটুকু বুদ্ধি থাকত, তাহলে তুইও জানতি।

টুম্পা বলল, জিকুর সাথে আমার জন্মের আড়ি হয়ে গেছে।

টুনি চিন্তিত মুখে বলল, তাই নাকি?

টুম্পা কোনো উত্তর দিল না।

 

পরদিন টুম্পা যখন স্কুলে যাবে, তখন তার আম্মু তাকে দুটি টিফিনের বাক্স ধরিয়ে দিল। টুম্পা অবাক হয়ে বলল, দুইটা কেন?

আম্মু বলল, কী জানি। টুনি বলল, এখন থেকে প্রতিদিন তোকে যেন দুইটা করে টিফিন দিই।

টুম্পা কয়েক সেকেন্ড কিছু একটা ভাবল, তারপর দুটি টিফিনের প্যাকেটই হাতে নিল।

স্বীকার করতেই হবে লক্ষণটা ভালো।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল