১০. বেগম জোহরা কামাল

ভোরবেলা হোস্টেলের মেয়েরা ভয়াবহ আতংকে জেগে উঠল, অনেকদিন পর হঠাৎ করে শুনতে পেল বারান্দায় গুম গুম শব্দ করে খোরাসানী ম্যাডাম হাঁটছে এবং হাঁটতে একেকটা রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় একটা লাথি মেরে হুংকার দিয়ে বলছে, দশ মিনিটের মাঝে মাঠে। নাহলে জবাই করে ফেলব।

নিতুর বুকটা ধ্বক করে উঠে, শান্তা আপা আসার পর থেকে তাদেরকে বুক আগলে খোরাসানী ম্যাডাম থেকে রক্ষা করে এসেছেন এখন হঠাৎ করে খোরাসানী ম্যাডাম ফিরে এসেছে, তার মানে কী? তাহলে কী শান্তা আপার কিছু হয়েছে? শান্তা আপা কী হাসপাতালে? একসিডেন্ট হয়েছে? নাকি খোরাসানী ম্যাডাম খুন করে তার ডেডবডি কোথাও পুতে ফেলেছে? নিতু ভয়ার্ত মুখে অন্যদের দিকে তাকায়, সবাই ফ্যাকাসে মুখে বসে আছে, হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে তাদের বুঝি কোনো প্রিয়জন মারা গেছে এবং তারা কী করবে বুঝতে পারছে না। কিন্তু খোরাসানী ম্যাডাম বলেছেন দশ মিনিটের মাঝে মাঠে হাজির হতে হবে, তাই কেউ আর ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামানোরও সময় পেল না। দৌড়াদৌড়ি করে বিছানা থেকে উঠে যে যেভাবে পারে কোনোরকমে ঘুমের পোশাক ছেড়ে অন্য কিছু একটা পরে মাঠের দিকে ছুটল। শান্তা আপার ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় সবাই এক মুহূর্তের জন্যে থেমে বন্ধ দরজার দিকে তাকাল, সেখানে একটা তালা ঝুলছে। ঘর ছেড়ে যাবার সময় শান্তা আপা প্রায় সব সময় তার দরজা খোলা রেখে যেতেন। মাঝে মাঝে ঘর বন্ধ করে যেতে হলে শান্তা আপা এই তালাটি লাগিয়ে যেতেন। চাবি কখনো সাথে নিতেন না জানালার কাছে আড়াল করে রেখে যেতেন সব মেয়েরা সেটি জানত। ঘরে তার তালাটি লাগানো কাজেই শান্তা আপা নিশ্চয়ই তার ঘরের তালা মেরে কোথাও গিয়েছেন। কিন্তু কোথায়?

সব মেয়ে ভয়ার্ত এবং পাংশু মুখে মাঠে লাইন বেঁধে দাঁড়িয়েছে তখন গুম গুম করে হেঁটে খোরাসানী বারান্দায় এসে দাঁড়াল। কোমরে হাত দিয়ে খোরাসানী ম্যাডাম একটা জেনারেলের মতো দাঁড়াল, তার ঠিক পিছনেই জমিলার মা এসে দাঁড়িয়েছে, আজকে তাকে দেখতেও আমরি সুবদোরের মতো দেখাচ্ছে। খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিয়ে বলল, হতচ্ছাড়া পাজী, বদমাইস শয়তানের ঝাড়।

সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। খোরাসানী ম্যাডাম সবার দিকে তাকিয়ে আবার খেকিয়ে উঠল, আরশোলার বাচ্চা, নোংরা ইঁদুর, হুকওয়ার্মের ছাও।

নিতু একটা নিশ্বাস ফেলল। গালাগালির মাঝেও কী এই দানবটি একটু সমবেদনা দেখাতে পারে না?

খোরাসানী ম্যাডাম হতে দিয়ে নিজের গলা কেটে ফেলার ভঙ্গি করে বলল, তোদের দিন শেষ। এখন তাদের জবাই করব। একজন একত্র করে। জবাই করে চামড়া ছিলে ফেলব। বুঝেছিস?

সবাই চুপ করে রইল খোরাসানী ম্যাডাম তখন আকাশ ফাটিয়ে হুংকার দিল, বুঝেছিস?

সবাই তখন ভয় পেয়ে একসাথে বলল, বুঝেছি, ম্যাডাম।

বুতরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে আর কিছু থাকুক কী না থাকুক, এখানে একটা জিনিস আছে, সেটা হচ্ছে শৃঙ্খলা। সেই শৃঙ্খলার যদি কেউ উনিশ-বিশ করে তাকে এই স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। খোরাসানী ম্যাডাম দাতের ফাঁক দিয়ে হুশশ করে একটা নিশ্বাস টেনে বলল, তোদের সেই হতভাগা হোস্টেল সুপারিনটেন্টেকে তাই এখান থেকে বের করে দিয়েছি। গরিলারা যেভাবে বুকে থাবা দেয় খোরাপানী ম্যাডাম সেইভাবে থাবা দিয়ে বলল, আমি ম্যাডাম খোরাসানী। আমি এই স্কুল চালাই যারা আমার কথা শুনে না এই স্কুলে তাদের জায়গা নাই। যন্ত্রণা যেটা ছিল সেটা দূর হয়েছে। আৰাগীর বেটি শান্তা চৌধুরী ইজ আউট। সে আর এই খানে ফেরত আসবে না। এখন আমি একজন একজন করে তোদের সিধা করব। তাদের চামড়া ছিলে সেই চামড়া দিয়ে আমি ডুগডুগি বাজাব।

খোরাসানী ম্যাডাম সবগুলো মেয়ের দিকে তাকিয়ে দাঁত দাঁত ঘষে আবার হুংকার দিয়ে বলল, আমি সব খবর রাখি। সব খবর। এই হোস্টেলে নাকি বার্থডে পার্টি হয়। খোরাসানী ম্যাডাম মুখ ভেংচে বলল, বার্থ-ডে-পার্টি! আমি দেখব সেই বার্থ-ডে পার্টি কে করে। বার্থ ডে না—ডেথ ডে হবে এখন থেকে। খুন করে ফেলব আমি। খুন!

নিতু একটা নিশ্বাস ফেলল, ভয় নয় হঠাৎ কেমন জানি ভয়ংকর রাগে নিতুর শরীরে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠতে থাকে।

এখানে নাকি গানের আসর হয়। খোরাসানী ম্যাডাম মুখ খিচিয়ে বলল, গী-নে-র আ-স-র। আমি গানের আসর করা বের করব।দেখব, গানের আসর কেমন করে হয়। সবাইকে দিয়ে আমি যদি মড়া কান্নার আসর না বসাই তাহলে আমি ম্যাডাম খোরাসানী না। তোদের বাবা মা তোদের চায় না। তোদের ভাইবোন তোদের চায় না। তোদের আত্মীয় স্বজনও তাদের চায় না, তাই তোদেরকে এই খানে দিয়ে গেছে। এই পৃথিবীতে তোদের কোনো জায়গা নাই। যদি সিধা হয়ে না থাকিস তাহলে এই বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়েও তোদের জায়গা হবে না। আমি খুন করে তোদের মাটিতে পুঁতে ফেলব। খোরাসানী ম্যাডাম মাথা ঘুরিয়ে হিংস্র চোখে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কথা বিশ্বাস হয়?

সবাই চুপ করে রইল, তখন খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিয়ে বলল, বিশ্বাস-হ-য়?

সবাই সমস্বরে বলল, হয় ম্যাডাম।

হ্যাঁ। বিশ্বাস হয়। না হয়ে উপায় নাই — এইভাবে এক সুরে খোরাসানী ম্যাডাম পাকা পায়তাল্লিশ মিনিট গালাগালি করে গেল। নিতু এক ধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে খোরাসানী ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে থাকে, একজন মানুষ কী রকম করে এতো হৃদয়হীন আর নিষ্ঠুর হতে পারে? নিজের চোখে না দেখলে নিতু কখনো বিশ্বাস করত না যে একজন মানুষ তাদের মতো বাচ্চা মেয়েদের এত ঘেন্না করতে পারে। তারা কী সত্যিই এত খারাপ?

গালাগাল শেষ করে খোরাসানী ম্যাডাম সবাইকে নিজের ঘরে পাঠাল। সবাইকে প্রথমে নিজের ঘর পরিষ্কার করে তারপর বাথরুম এবং টয়েলট পরিষ্কার করতে হবে। এটা হচ্ছে তাদের শাস্তির শুরু, দুপুরের খাবারের পর নাকি সত্যিকারের শাস্তি শুরু হবে।

কেউ একটি কথা না বলে মাথা নিচু করে নিজেদের ঘরে ফিরে যেতে শুরু করল। শান্তা আপার ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় মিতুল নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, শান্তা আপার কী হয়েছে মনে হয়?

রেবেকা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মনে হয় খুন করে ফেলেছে।

সবাই চমকে উঠে রেবেকার দিকে তাকল, নিতু বলল, কী বলছিস তুই?

শান্তা আপা কী কখনো আমাদের কিছু না বলে চলে যাবেন?

সবাই মাথা নাড়ল, বলল, না।

তাহলে?

নিতু বলল, শান্তা আপা হয়তো কোনো কাজে গেছেন, চলে আসবেন আবার।

তানিয়া গম্ভীর গলায় বলল, খোরাসানী ম্যাডাম কোনো একটা ফন্দি করে শান্তা আপাকে বহিরে পাঠিয়েছে। এখন গেট বন্ধ করে রাখবে শান্তা আপাকে আর ঢুকতে দেবে না।

নিতু শান্তা আপার ঘরের বন্ধ দরজায় ঝোলানো তালার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, যদি শান্তা আপা আর ফিরে না আসে তাহলে আমাদের সবার জীবন শেষ।

মিতুল মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ জীবন শেষ।

একজন একজন করে খুন করে আমাদের পুঁতে ফেলবে। পৃথিবীর কেউ আর খোঁজ পাবে না।

কেউ খোঁজ পাবে না?

নিতু হঠাৎ চোখ বড় বড় করে বলল, খোরাসানী ম্যাডামকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেওয়া যায় না?

পুলিশের কাছে?

হ্যাঁ।

কেন?

সে যে মেয়েদেরকে খুন করেছে।

সবাই মাথা নাড়ল, কারো মনে এ ব্যাপারে একটু সন্দেহ নেই। রুনু দুর্বল গলায় বলল। কিন্তু তার প্রমাণ কই?

নিশ্চয়ই প্রমাণ আছে। খুঁজলেই পাওয়া যাবে। কোথায় খুঁজৰি?

রেবেকা হঠাৎ চমকে উঠে বলল, মনে নাই শান্তা আপার ঘরে একটা ধাপের মতো আছে, ভিতরে একটা বাক্স।।

সবাই চোখ বড় বড় করে রেবেকার দিকে তাকাল। মিতুল বলল, কিন্তু শান্তা আপাকে না বলে সেটা খুলবি?

শান্তা আপা কিছু মনে করবেন না।

নিতু বলল, মনে নাই শান্তা আপা বলেছিলেন যখন এডভেঞ্চার করার ইচ্ছা করবে তখন সেটা খোলা হবে?

এখন কী এডভেঞ্চার করার ইচ্ছা করছে?

এর থেকে বড় এডভেঞ্চার আর কী হতে পারে? আমাদের একজন একজনকে মেরে পুতে ফেলবে ম্যাডাম নিজে বলেছে।

তা ঠিক।

তাহলে দেরি করে কাজ নেই, আয় কাজ শুরু করে দিই।

যখন সব মেয়েরা নিজেদের ঘর পরিষ্কার করে বাথরুম পরিষ্কার করছিল তখন নিতু আর তার বন্ধুরা শান্তা আপার ঘরে ঢুকে গেল। শান্তা আপা সাধারনত তার ঘরে তালা লাগাতেন না, এটা খোলাই থাকত। মেয়েরা জিজ্ঞেস করলে বলতেন, আমার ঘরে কী ই বা আছে নেয়ার মতো! আর হোস্টেলের মেয়েরা চারপাশে থাকলে চোর ডাকাতের সাহস হবে কাছে আসার?

শান্তা আপা যদি কখনো বাইরে যেতেন তাহলে তালা মেরে চাবিটা জানালার ওপর একটু আড়াল করে রেখে যেতেন, সব মেয়েরাই সেটা জানে। শান্তা আপা নিজেই মাঝে মাঝে কাজ করতে করতে কোনো একটা মেয়েকে বলতেন তার ঘর খুলে কিছু একটা নিয়ে আসতে। কাজেই শান্তা আপার ঘরে ঢোকা খুব কঠিন কিছু নয়। রুনুকে বাইরে রেখে অন্য সবাই ভিতরে ঢুকে গেল, রুনু বাইরে থেকে আবার তালা মেরে দিল, হঠাৎ করে খোরাসানী ম্যাডাম এসে গেলে যেন বুঝতে না পারে শান্তা আপার ঘরে কেউ আছে।

রুনু যখন একা তাদের ঘরটা পরিষ্কার করছে তখন অন্য সবাই শান্তা আপার ঘরের ভিতরে কাজে লেগে গেল। ঘরের মাঝামাঝি দেয়ালের সাথে লাগানো ধাপটার একটা ছোট সুন্দর কার্পেট বিছিয়ে শান্তা আপা খুব সুন্দর একটা বসার জায়গা তৈরি করেছেন। ওরা সেটা সরিয়ে ধাপটা বের করে নিল। রান্নাঘর আর স্টোর রুম খুজেঁ একটা বড় ক্রু ড্রাইভার, একটা হাতুরি আর একটা বটি পাওয়া গেল। এগুলো দিয়েই তারা কাজ শুরু করে দেয়। এক পাশে প্যালেস্তারা খসে খানিকটা জায়গা বের হয়ে আছে সেখানে কে তারা পুরোটা বের করে আনতে শুরু করে। খুব সাবধানে কাজ করতে হচ্ছিল, হঠাৎ করে বেশি শব্দ হয়ে গেলে অন্যেরা সন্দেহ করতে পারে। ভিতরে যে পাঁচজন আছে তাদের মাঝে একজন সবসময় জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল, সন্দেহজনক কিছু দেখলেই সে একটা সংকেত দিত এবং অন্য সবাই কাজ থামিয়ে ফেলত।

ধাপের ভেতর লুকিয়ে থাকা বাক্সটা বের করা প্রথমে একটা দুঃসাধ্য কাজ বলে মনে হল। ঠিক কী ভাবে কাজ শুরু করলে কাজটা সহজ হবে সেটাও তারা বুঝতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত ঠুকে ঠুকে ওপরের প্যালেস্তারাটা সরিয়ে ফেলাই একমাত্র উপায় বলে মনে হওয়ার পর একজন হাতুরি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে ফাটল তৈরি করতে শুরু করে লাগল, অন্যেরা খুচিয়ে খুচিয়ে সেটা তুলে ফেলতে লাগল। ঘণ্টা খানেক কাজ করার পর কাজটা বেশ সহজ হয়ে গেল, স্কু ড্রাইভারের ফলা দিয়ে বাক্সের ওপর চাড় দিতেই একসাথে অনেকটুকু খুলে আসতে থাকে। ভেতরের বাক্সটা এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে। এই বাক্সের ভেতরে একটা মেয়ের মৃত্যুদেহু থাকতে পারে ভেবে তাদের বুকের ভিতরে কেমন জানি শির শির করতে থাকে। আরো ঘণ্টাখানেক কাজ করার পর পুরো বাক্সটা বের হয়ে আসে।

সেটাকে ধরাধরি করে বের করে আনা মাত্রই জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা তানিয়া হঠাৎ চাপা স্বরে বলল, সাবধান।

সবাই যে যার জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তানিয়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেল, রক্তশূন্য মুখে অন্যদের দিকে বলল, খোরাসানী ম্যাডাম।

তানিয়া জানালা থেকে সরে আসে যেন বাইরে থেকে দেখা না যায়। একটু পরেই তারা গুম গুম পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল এবং পায়ের শব্দ ঠিক শান্তা আপার ঘরের সামনে এসে থেমে গেল। নিতু এবং তার বন্ধুদের হৃৎস্পন্দন থেমে আসতে চায়। তারা নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বাইরে খোরাসানী ম্যাডামের গলার আওয়াজ শোনা গেল, শেষ পর্যন্ত যন্ত্রণাটাকে দূর করা গেছে।

যন্ত্রণা বলতে নিশ্চয়ই শান্তা আপাকে বোঝাচ্ছে। সাথে নিশ্চয়ই জমিলার মা আছে কারণ তার গলা শোনা গেল, জি মাডাম। যন্ত্রণা গেছে। আপদ বালাই দূর হইছে। একটু থেমে যে কথাটা বলল শুনে ভিতরে সবাই একেবারে চমকে উঠে, ঘরটা খুলবেন না ম্যাডাম?

চাবি এনেছিস?

চাবি তো নাই ম্যাডাম।

খোরাসানী ম্যাডাম তালা ধরে বলল, এই তালা খুলতে আবার চাবি লাগে নাকি? একটা লাথি দিলেই খুলে যাবে।

দিবেন একটা লাথি?

ভিতরে সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে রইল, শুনতে পেল কয়েক মুহূর্তে পরে খোরাসানী ম্যাডাম বলছে, নাহ! এই মহিলা সাংঘাতিক বড় যন্ত্রণা। দেশের সব আইন কানুন জানে। তালা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকলে আবার না কেস ফেস করে দেয়। যন্ত্রণা হবে।

জমিলার মা জিজ্ঞেস করল, কোথায় আছে এখন?

ঠিক জানি না। রাত্রে চিঠি পাওয়ার পর অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিল। খুব সকাল বেলা বের হয়ে গেছে। খোঁজ নেওয়ার জন্যে লোক লাগিয়েছি।

দরজার বাইরে খোরাসানী ম্যাডাম আর জমিলার মা আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। শেষে শোনা গেল খোরাসানী ম্যাডাম বলছে, আয় যাই। শয়তানের ঝাড় গুলিরে একটা দাবড়ানি দিয়ে আসি।

জমিলার মা বলল, ম্যাডাম, এত মানুষ দেখেছি জীবনে, কিন্তু আপনার মতো দাবড়ানি আর কেউ দিতে পারে না।

ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে খোরাসানী ম্যাডাম বলল, দাবড়ানীর তুই দেখেছিস কী? এখনও তো শুরু করলামই না?

ঘরের ভেতরে সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে শুনতে পায় গুম গুম করে পা ফেলে খোরাসানী ম্যাডাম চলে যাচ্ছে। পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাবার সাথে সাথে তারা আবার বাক্সের উপর ঝুঁকে পড়ল। এটা খুলে ভিতরে কী দেখা যাবে কে জানে। যে ভাবে এটাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে এর মাঝে কোনো না কোনো রহস্য নিশ্চয়ই আছে। কাঠের বাক্সের ঢালাটাতে একটা ছোট তালা লাগানো ছিল, দীর্ঘদিনে জংধরে সেটা জীর্ণ হয়ে গেছে, হাত দিয়ে ঝাকুনী দিতেই খুলে গেল! বাক্সের তালা ধরে টেনে খোলার আগে নিতু সবার দিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বলর যদি ভিতরে একটা কংকাল থাকে কেউ ভয় পাবি না তো?

সবাই মাথা নাড়ল, বলল, তারা ভয় পাবেন এবারে সাবধানে ঢালাটা ধরে টেনে উপরে তোলার চেষ্টা করে। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে ঢালাটা খুলে যায়, ভেতর থেকে এক ধরনের ভ্যাপসা চোটকা গন্ধ বের হয়ে আসে। সবাই ভয়ে ভয়ে ভিতরে তাকাল, সেখানে কোনো কংকাল নেই—আছে কিছু বই, খাতা, কাগজ পত্র, কিছু ব্যবহারের জিনিস। নিতু সাবধানে বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দেয়, যদিও মুখে কংকালের কথা বলছিল কিন্তু সত্যি সত্যি একটা কংকাল বের হয়ে গেলে কী করত কেউই জানে না।

ওরা ধীরে ধীরে বই খাতা কাগজ পত্রগুলো বের করতে থাকে। প্রথম বইটি রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা। বইয়ের ভেতরের পৃষ্ঠায় নাম লেখা বেগম জোহর। কামাল। ওরা আরো একটা বই বের করল এই বইটার নাম তিথিডোর, লেখকের নাম বুদ্ধদেব বসু। এই বইটার উপরেও নাম লেখা বেগম জোহরা কামাল। ওরা আরো কয়েকটা বই বের করল, একটা ইংরেজি বই, নাম দা জাংগল বুক, লেখকের নাম রুডইয়ার্ড কিপলিং। একম আরো বেশ কিছু বাংলা আর ইংরেজি বই। তার নিচে কয়েকটা ডাইরি। পাতা পুরানো হয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে, ভিতরে গোটা গোটা হাতে লেখা, কোনো পৃষ্ঠায় একটা ছোট কবিতা, কোনো পৃষ্ঠায় একটা ছোট লিস্ট, কোনো পৃষ্ঠায় একটা দিনের বর্ণনা, আবার কোনো পৃষ্ঠায় একটা চিঠির অংশ। ডাইরিগুলো সরিয়ে তারা আরো কিছু খাতা পেল। গোটা গোটা হাতে সেই খাতায় অনেক কিছু লেখা, মনে হয় গল্প বা উপন্যাস। এবারে নিতু আর তার বন্ধুদের আশাভঙ্গ হতে শুরু করেছে। পুরো বাক্সটাই হচ্ছে বেগম জোহরা কামাল নামের একজন ভদ্রমহিলার বই, কাগজপত্র, লেখালেখির নমুনা আর ডাইরি। ভদ্রমহিলা যেসব বই পড়তেন বা যেভাবে লেখা লেখি করেছেন সেটা দেখে মনে হয় তিনি মানুষটা বেশ জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমতী ছিলেন কিন্তু এত বড় বিপদের ঝুঁকি নিয়ে এই বাক্সটা খুলে তার ব্যক্তিগত কাগজপত্র বের করে কী লাভ হল তারা বুঝতে পারল না। সত্যি কথা বলতে কী নিতু আর তার বন্ধুদের বেশ মন খারাপ হয়ে গেল। তারা এবারে দ্রুত বাক্স হাতড়ে কাগজপত্রগুলো বের করতে থাকে। একটা চিঠির বাণ্ডিল বের হল। বেশ কিছু খবরের কাগজ বের হল, একটা এলবাম সেখানে অনেকগুলো পারিবারিক ছবি, সবগুলো, ছবি সাদা কালো তখন নিশ্চয়ই রঙিন ছবি ছিল না। ওদের এখন ছবি দেখার সময় নেই তাই সেগুলো সরিয়ে রেখে অন্যান্য জিনিসগুলো বের করতে থাকে। ছোট একটা। টিনের কৌটা, তার মাঝে কিছু টাকা পয়সা একটা আংটি, কয়েকটা তেতুলির বিচি আর কয়েকটা কড়ি। ওরা বাক্সের নিচের দিকে চলে গেছে আর সেরকম কিছু নেই, আরো কিছু খবরের কাগজ, কয়েকটা ম্যাগাজিন একেবারে নিচে একটা ফাইল। ফাইলটা খুলে দেখা গেল অফিসের জাগজপত্র যেরকম হয় ঠিক সেরকম কিছু কাগজ পত্র।

ঝুনু একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এই?

রেবেকা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে খোলা বাক্স আর তার ভিতর থেকে যেসব জিনিস বের হয়েছে সেগুলির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর প্রায় ভাঙ্গা গলায় বলল, এত কষ্ট করে বাক্সটা বের করলাম, তার ভিতরে এই সব ব্যবহারী জিনিস?

নিতু বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। একজন মানুষের ব্যবহারী কাগজপত্র কেন এত কষ্ট করে লুকিয়ে রাখা হবে? নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।

মিতুল জানতে চাইল, কী কারণ?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

যাই হোক—এডভেঞ্চার তো শেষ হয়েছে, এখন চল ঘরে ফেরত যাই।

চল। সবাই উঠে দাঁড়াল এবং তখন হঠাৎ করে তাদের মনে পড়ল শান্তা আপার এই ঘরটিতে বাইরে থেকে তালা দেয়া রয়েছে। রুম খানিকক্ষণ পর পর এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে এবং আরেকবার খোঁজ নিতে না আসা পর্যন্ত তাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে।

সবাই খুব মন খারাপ করে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে অপেক্ষা করতে শুরু করে। ঝুনু এলবামটাতে ছবি দেখতে থাকে, তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে মিতুলও ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেকদিন আগের ছবি, দেখে কেমন যেন অবাক লাগে। রেবেকা ডাইরিটা পড়তে থাকে, অন্য একজন মানুষের ব্যক্তিগত ডাইরি পড়তে কেমন জানি সংকোচ হয় শুধু মনে হয় একটা অন্যায় কাজ করা হচ্ছে। তানিয়া বইগুলি দেখছে, নিতুও বইগুলো উল্টে পাল্টে দেখে আবার ফাইলটা টেনে নিয়ে ভিতরের রাখা অফিসের কাগজপত্রের মতো দেখতে কাগজগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের মতো চমকে উঠল চাপা স্বরে চিৎকার করে বলল, দেখ।।

সবাই মাথা তুলে তাকাল, কী?

বেগম জোহরা কামালের দলিল।

দলিল?

হ্যাঁ।

এই দেখ, স্ট্যাম্পের মতো কাগজ, এই দেখ কতগুলো সই। এটা হচ্ছে স্কুলের দলিল।

স্কুলের দলিল?

হ্যাঁ, এই দেখ আরো কাগজপত্র। সব স্কুলের কাগজ পত্র। এই দেখ এখানে কী লেখা—

কী লেখা?

নিতু পড়ে শোনাতে থাকে, আমি নয়নপুর নিবাসী বেগম জোহরা কামাল আমার সকল সম্পত্তি মেয়েদের একটি আদর্শ স্কুল তৈরি করার জন্যে দান করে গেলাম। কোনো অবস্থাতেই এই স্কুলের নামটি আমার নামানুসারে করা যাবে না তাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে, শিক্ষার জন্যে সাহিত্যের জন্যে বা দেশের মানুষের অধিকারের জন্যে ত্যাগ করেছেন, দেশের প্রয়োজনে জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এরকম একজন মহিলার নামে এই স্কুলের নামকরণ করতে হবে।

নিতু এইটুকু পড়ে থামল, বলল, দেখলি?

বুতুরুনেসা কী সে রকম মহিলা?

না। মিতুল চাপা স্বরে বলল, জানিস না বুতুরন্নেসা কে?

কে?

খোরাসানী ম্যাডামের নানী।

বুতুরুন্নেসা কী জাতির জন্যে নেতৃত্ব দিয়েছে?

কক্ষনো না।

তাহলে?

মিতুল বলল, আগে পড় বাকিটা।

নিতু পুরো কাগজগুলো দেখে বলল, পুরোটা পড়তে অনেকক্ষণ লাগবে, এই স্কুলটা কেমন হবে সবকিছু লেখা আছে। এই দ্যাখ—এই স্কুলটির আবাসিক অংশটিতে মেয়েদেরকে গভীর ভালবাসায় লালন করতে হবে যেন তারা অনুভব করতে পারে যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে ভালবাসা। তাদেরকে শারীরিক শাস্তি দূরে থাকুক কখনো তিরস্কারও করা যাবে না। নিতু পড়া বন্ধ করে বলল, দেখলি? দেখলি কি লেখা?

নিতু আবার কাগজের ওপর ঝুঁকে পড়ল, এই স্কুলের সকল মেয়েদের পড়াশোনার সাথে সাথে শিল্প সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে উৎসাহী করতে হবে। যারা গান গাইতে পারে তাদেরকে আলাদাভাবে গান শেখাতে হবে এবং জ্যোৎস্না রাতে স্কুল প্রাঙ্গণে সবাইকে নিয়ে মধুর গানের আসরের ব্যবস্থা করা যেতে পারে? নিতু মুখ তুলে বলল, দেখলি?

আর কী লেখা আছে? পড় দেখি—

নিতু আবার পড়তে শুরু করছিল ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল, রুনু খোঁজ নিতে এসেছে। নিতু ফাইলটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল, বলল, চল যাই।

রুনু তালা খুলে দিতেই সবাই বের হয়ে এল, দরজায় আবার তালা লাগিয়ে সবাই সাবধানে নিজের ঘরে ফিরে এল। ঘরের দরজা বন্ধ করে আবার সবাই ফাইলটা নিয়ে বসে। সবাই পুরো ফাইলটা খুটিয়ে খুটিয়ে পড়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। বেগম জোহরা কামাল নামে একজন মহিলা তার বিশাল সম্পত্তির পুরোটা মেয়েদের একটা চমৎকার স্কুল তৈরি করার জন্যে দান করে দিয়ে গিয়েছেন। স্কুলটি কীভাবে চালাতে হবে তার একেবারে খুটি নাষ্টি এখানে লেখা আছে সেটি মানা না হলে কী করা হবে তাও বলে দেয়া আছে। অথচ সেই চমৎকার স্কুলটি বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয় নাম নিয়ে একটা ভয়ংকর কয়েদখানা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরোটা পড়ে নিতু ফাইলটা বন্ধ করে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, বুঝতে পারছিস?

কোনটার কথা বলছিস?

আমাদের এখন কি করতে হবে?

কী?

শান্তা আপাকে খুঁজে বের করে তার কাছে এই ফাইলটা দিতে হবে।

মিতুল হাতে কিল দিয়ে বলল, ইয়েস!

অন্য সবাই তাদের হাতে কিল দিয়ে বলল, ইয়েস! ইয়েস!! ইয়েস!!!

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল