৭. নেংটি ইঁদুর

নিতুর হাতের তালুতে ছোট্ট একটা নেংটি ইঁদুরের বাচ্চা বসে দুই হাত দিয়ে এক টুকরা বিস্কুট ধরে কুট কুট করে খাচ্ছে। নিতু হাত দিয়ে হালকাভাবে ইঁদুর ছানাটার পিঠে আদর করে বলল, দেখে যা, ইঁদুরের বাচ্চাটা কী সুইট!

এই ঘরের ছয়জন উঁদুরের বাচ্চার ব্যাপারে দুই দলে ভাগ হয়ে আছে। নিতু রেবেকা আর তানিয়া মনে করে এই ছোট ইঁদুরের বাচ্চার মতো সুন্দর কিছু পৃথিবীতে সৃষ্টি হয় নি। রুনু ঝুনু আর মিতুল মনে করে একজন মানুষের পুরোপুরি মাথা খারাপ হলেই সে ইঁদুরের বাচ্চার সাথে মাখামাখি করতে পারে। কাজেই নিতু যখন তার হাতের তালুতে বসে থাকা ইঁদুরের বাচ্চাটা দেখে যাওয়ার জন্যে ডাকল তখন শুধুমাত্র রেবেকা আর তানিয়া উঠে এল। রেবেকা বলল, আমার হাতে একটু দিবি?

তানিয়া বলল তোর হাতে মনে হয় যাবে না।

কেন যাবে না?

ইঁদুরের বাচ্চাটার তো আগে চোখ ফোটে নি—যখন চোখ ফুটেছে তাকিয়ে দেখেছে নিতুকে, তাই এটা মনে করে নিতু হচ্ছে তার মা। এই জন্যে নিতুর সাথে এত খাতির।

আমি না হয় খালাই হলাম। খালার কাছে একটু আসতে পারে না?

দেখা গেল ইঁদুরের বাচ্চাটা খুব সহজেই মায়ের হাত থেকে খালার হাতে চলে গেল। শুধু চলেই গেল না, বিস্কুটটা খাওয়া শেষ করে নাক উঁচু করে গন্ধ শুকতে শুকতে সেটা হাত বেয়ে ওপরে উঠে গিয়ে রেবেকার কাপড়ের ভেতর ঢুকে গেল, বগলের পাশে দিয়ে নেমে পেটের উপর দিয়ে তিরতির করে হেঁটে নামতে থাকে আর রেবেকা কাতুকুতু লাগছে কাতুকুতু লাগছে— বলে হি হি করে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে।

রেবেকার হাসি শুনে মজা দেখার জন্যে রুনু ঝুনু আর মিতুলও এসে হাজির হল। ইঁদুরের বাচ্চাটা অবলীলায় রেবেকার শরীরের ভেতর দিয়ে তিরতির করে হেঁটে হেঁটে বের হয়ে এসে আবার নিতুর হাতে হাজির হল। সামনের দুই পা উপরে তুলে এটা পিছনের পায়ের উপর ভর দিয়ে বসে ইতিউতি তাকাচ্ছে। ইঁদুরের বাচ্চাটাকে দেখে এত বড় ইঁদুর, বিদ্বেষী রুনু ঝুনুও ফিক করে হেসে ফেলল। নিতু বলল, হাতে নিবি?

হ্যাক! খুঃ। বলেও ঝুনু অবশ্যি ইঁদুরের বাচ্চাটাকে আদর করে দেয়।

চোখ ফোটার কয়েক ঘণ্টার মাঝে অবশ্যি সবাই টের পেয়ে গেল একটা ইঁদুরের বাচ্চা মা হিসেবে একটা মানুষকে পেলে কী কী সমস্যা হতে পারে। যেহেতু বাচ্চাটা চোখ ফুটে নিতুকে মা হিসেবে আবিষ্কার করেছে কাজেই সেটি ধরে নিয়েছে মানুষ সম্প্রদায় মাত্রই তার শুভাকাক্তক্ষী। এটি যখন তখন শুধু যে নিতু রেবেকা বা তানিয়ার পা বেয়ে তাদের শরীরে উঠে পড়তে লাগল তাই নয়। সুযোগ পেলেই রুনুঝুনু কিংবা মিতুলের পা বেয়েও তাদের শরীরে উঠে পড়ার চেষ্টা করতে লাগল। নিতু, রেবেকা বা তানিয়া ব্যাপারটাকে একটা মজার ব্যাপার হিসেবে নিয়ে হেসে কুটি কুটি হয়। রুনু ঝুনু আর মিতুলের বেলায় অন্য ব্যাপার, তারা ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করে, শরীর থেকে ঝেড়ে বাচ্চাটাকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। হোস্টেলে এরকম চিৎকার এবং চেঁচামেচি খুব ভয়ের ব্যাপার। খবরটা কোনোভাবে হোস্টেল সুপার কিংবা খোরাসানী ম্যাডাম পর্যন্ত পৌছে গেলে বড় বিপদ হতে পারে।

রাত্রে ঘুমানোর সময় ইঁদুরটি যেন ঘুমন্ত কারো শরীরে উঠে পড়তে না পারে সে জন্য নিতু সেটাকে একটা কার্ড বোর্ডের বাক্সে আটকে রাখল, রাতে খিদে পেলে খাবার জন্যে ভেতরে দুই টুকরা বিস্কুট, তৃষ্ণা পেলে খাওয়ার জন্যে ছোট একটা কৌটায় একটু পানি এবং ঘুমানোর জন্যে কম্বল হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে একটা রুমাল। নিতু মোটামুটি নিশ্চিত ছিল রাতটা কাটিয়ে দেওয়ার জন্যে যা যা প্রয়োজন সবই দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু গভীর রাতে প্রথমে রেবেকা এবং তারপর রুনু চিৎকার করে জেগে উঠে, ইঁদুরের বাচ্চাটি নাকি তাদের পেটের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছে, বগলের কাছাকাছি একটা আরামদায়ক জায়গা বের করে সেখানে ঘুমানোর চেষ্টা করেছে। নিতু জেগে উঠে ইঁদুরের বাচ্চাটিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করল। সাধারণত একটা ইঁদুরের বাচ্চাকে খুঁজে বের করা খুব কঠিন, ঘরের নানা জিনিস পত্রের আড়ালে সেটি লুকিয়ে থাকতে পারে কিন্তু এই বাচ্চাটির কথা ভিন্ন, মানুষ থেকে যে লুকিয়ে থাকতে হয় সেটি এটা জানে না। তার ধারণা মানুষ হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় বন্ধু এবং বিপদের সময় মানুষের কাছে ছুটে যেতে হয়। তাই ঘরের বাতি জ্বালানোর সাথে সাথে সেটি ঝুনুর মশারিতে কেটে করে রাখা ফুটোর ভিতর দিয়ে বের হয়ে লাফাতে লাফাতে নিতুর কাছে চলে এল এবং পা বেয়ে তার শরীরের উপর দিয়ে একেবারে ঘাড়ের কাছে হাজির হল। নিতু চাপা গলায় বলল, পাজী ছেলে। মানুষকে ঘুমের মাঝে এই ভাবে ডিস্টার্ব করে?

নিতু ইঁদুরের বাচ্চাকে কার্ডবোর্ডের বাক্সে আটকে রেখে এবারে বাক্সটার ঢাকানাটি কয়েকটা ভারী বই দিয়ে চাপা দিয়ে রাখল যেন ভেতর থেকে বের হতে না পারে। বাকি রাতটুকু যেন সবাই শান্তিতে ঘুমুতে পারে।

শেষরাতের দিকে বিকট চিল্কার করে মিতুল তার বিছানা থেকে প্রায় হুড়মুড় করে নিচে এসে পড়ল, হোস্টেল সুপার কিংবা আশে পাশের রুমের মেয়েরা জেগে উঠেছে কী না সেটা চিন্তা করতে করতে নিতু প্রায় লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে আসে। অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে মিতুলের কাছে গিয়ে বলল, কী হয়েছে?

কী আবার হবে? মিতুল চাপা গলায় ফোঁস করে বলল, তোর পাজী ইঁদুরের বাচ্চা! কী সাহস আমার কানের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে।

নিতু একটা নিশ্বাস ফেলল, এই ইঁদুরের বাচ্চা নিয়ে সত্যিই বড় সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাবধানে উঠে লাইট জ্বালাতেই ইঁদুরের বাচ্চাটি মিতুলে বিছানা থেকে নেমে তির তির করে হেঁটে হেঁটে নিতুর কাছে হাজির হল। মিতুল এক ধরনের আতংক নিয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি যদি আস্ত একটা থান ইট দিয়ে ইটার মাথা ঘেঁচে না দিই—

নিতু ইঁদুরের বাচ্চাটাকে হাতে তুলে নিয়ে ফিস ফিস করে বলল, ছিঃ! মিতুল হোস্টেল সুপারের মতো কথা বলিস না! ঘুমা গিয়ে। আমি দেখছি আর যেন এটা বের হতে না পারে।

কার্ডবোর্ডের বাক্সের কাছে গিয়ে দেখল ইঁদুরের বাচ্চাটা দাঁত দিয়ে কেটে প্রমাণ সাইজ একটা ফুটো করে বের হয়ে এসেছে। এইটুকু ছোট ইঁদুরের বাচ্চা এরকম ধারালো দাঁত হতে পারে কে জানত! নিতু আবার সেটাকে বাক্সে বুন্দি করে বই চাপা দেয়। দাঁত দিয়ে কেটে যেন বের হয়ে আসতে না পারে সেজন্যে পুরো বাক্সটা ঠেলে ঘরের এক কোনায় নিয়ে চারিদিকে বই খাতা দিয়ে ঢেকে দিল। তার পাঠ্যবই কেটে বের হয়ে এলে কী হবে সেটা নিয়ে এখন দুশ্চিন্তা করার সময় নেই।

ইঁদুরের বাচ্চাটি অবিশ্যি ভোর হওয়ার আগেই সেই দুর্ভেদ্য বাক্স থেকে বের হয়ে এল। ততক্ষণে সকাল হয়ে গেছে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করে সবাই ক্লাশে যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে তাই তাদের মাঝে উঁদুরের বাচ্চাটিও যে ছোটাছুটি করছে সেটি কারো চোখে পড়ল না।

রাতে ঘুমানোর সময় মিতুল এসে বলল, নিতু। আজ রাতে যদি তোর বাচ্চা আমার বিছানায় আসে আমি কিন্তু তার মাথা ছেচে ফেলব।

রুনু ঝুনু ও মাথা নাড়ল, বলল, কোনোদিন শুনেছিস ইঁদুরের বাচ্চা বিছানায় উঠে এসেছেঃ ছিঃ!

রেবেকা বলল, বাচ্চাটা দেখতে সুইট, তাই বলে বগলের তলায় ঘুমাবে? তানিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, রোগ জীবাণুরও একটা ব্যাপার আছে।

নিতু দুর্বল ভাবে হেসে বলল, তোরা চিন্তা করিস না, আজ একটা পাকা ব্যবস্থা করছি।

কী করবি?

আমার একটা চকলেটের টিন আছে সেটার মাঝে আটকে রাখব, ওখান থেকে বের হতে পারবে না।

নিতু সত্যি সত্যি তার চকলেটের টিনের নিশ্বাস নেবার জন্যে কয়েকটা ফুটো করে ভিতরে ইঁদুরের বাচ্চার ঘুমানোর ব্যবস্থা করল। কয়েক টুকরো বিস্কুট, খাবার পানি ঘুমানোর জন্যে কম্বল, ধারালো দাঁত দিয়ে কাঁটাকুটি করার জন্যে কয়েকটা ভাঙা পেন্সিল, খেলার জন্যে একটা ছোট প্লাস্টিকের বল। রেবেকা মুচকি হেসে বলল, পড়ার জন্যে একটা গল্পের বই দিলি না? হাত মুখ ধোওয়ার জন্যে সাবান আর তোয়ালে?।

মিতুল হি হি করে হেসে বলল, দাঁত ব্রাস করার জন্যে টুথ ব্রাস?

নিতু বলল, ফাজলেমি করিস না। এইটুকুন একটা বাচ্চা একা একা থাকবে সারা রাত।।

গভীর রাতে নিতুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানার নিচে রাখা চকলেটের টিনটাতে একটা শব্দ হচ্ছে। কুট কুট শব্দ, মনে হয় ইঁদুরের বাচ্চাটা বের হবার জন্যে চেষ্টা করছে। নিতুর ভাবল, আহা বেচারা, তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।

মাঝরাতে আবার নিতুর ঘুম ভেঙ্গে গেল, তখনো বিছানার নিচে চকলেটের টিনটাতে ইঁদুদেরর বাচ্চাটা কুটকুট করে শব্দ করছে। নিতুর এত মায়া লাগল যে বলার নয়। স্বাধীন একটা বাচ্চা, সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়ানোর কথা অথচ একটা চকলেটের টিনে আটকা পড়ে আছে। যদি কোথাও কয়েক ঘণ্টার জন্যে ছেড়ে দিয়ে আসা যেত কী চমৎকারই না হতো। নিতু খানিকক্ষণ চিন্তা করে হঠাৎ চমকে উঠল, হোস্টেল সুপারের রুমে নিয়ে ছেড়ে দিলে কেমন হয়? হোস্টেল সুপার ইঁদুরকে যা ভয় পায় সেটি বলার মতো নয়, যখন নেংটি ইঁদুরের বাচ্চা তার মিশে যাওয়া নাকের ভিতরে কিংবা কামের ফুটো দিয়ে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করবে তখন যা একটা মজা হবে সেটি না দেখা পর্যন্ত বিশ্বাস করা যাবে । নিতু বিছানায় বসে একা একাই খিক খিক করে হাসতে থাকে।

পুরো ব্যাপারটা সে আরেকবার চিন্তা করে দেখল, এমন কিছু কঠিন নয় কাজটা। ঘুমানোর সময় হোস্টেল সুপারের বাশির মতো নাক ডাকে, কাজেই সে কি ঘুমিয়ে আছে না জেগে আছে বোঝা কঠিন নয়। যদি ঘুমিয়ে থাকে তাহলে জানালার ফাঁকে দিয়ে নেংটি ইঁদুরের বাচ্চাকে ছেড়ে দেবে, বাকিটুকু নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ইঁদুরের বাচ্চাটা মানুষকে খুব ভালবাসে, সে ঠিক খুঁজে খুঁজে হোস্টেল সুপারের মশারি কেটে ভিতরে ঢুকে যাবে। তারপর যা একটা মজা হবে চিন্তা করে আবার নিতুর সবগুলি দাঁত বের হয়ে এল।

নিতু সাবধানে বিছানা থেকে নেমে আসে। চকলেটের টিনটা কোনো শব্দ না করে খুলতেই ইঁদুরের বাচ্চাটা দুটি ছোট ছোট লাফ দিয়ে নিতুর হাতে চলে এসে মুখ ঘষে আদর জানাতে থাকে। আবছা অন্ধকারে বাচ্চাটার পিঠে আঙুল বুলিয়ে সে একটু আদর করে উঠে দাঁড়ায়, সাবধানে দরজার কাছে গিয়ে ছিটকিনি খুলতেই খুট করে একটা শব্দ হল। মিতুলের ঘুম খুব হালকা সে সাথে সাথে জেগে উঠে বলল, কে?

আমি নিতু।

কোথায় যাস?

নিতু চাপা গলায় বলল, হোস্টেল সুপারের ঘরে।

সে কী! কেন? মিতুল তার বিছানায় উঠে বসল।

ইঁদুরের বাচ্চাটা ছেড়ে দিয়ে আসি, কী একটা মজা হবে না?

মিতুল এবার পুরোপুরি জেগে উঠল, চাপা গলায় বলল, তোর কী মাথা খারাপ হয়েছে?

মাথা খারাপ হবে কেন? হোস্টেল সুপার ইঁদুরকে কী ভয় পায় জানিস না? যখন গা বেয়ে উঠে যাবে— বাকিটা চিন্তা করে নিতু অন্ধকারে হি হি করে হাসতে থাকে।

মিতুল কিছুক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আবছা অন্ধকারে নিতুর দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর সে নিজেও হি হি করে হাসতে শুরু করে। কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলল, সাবধানে যাবি, ধরা পড়লে কিন্তু বিপদ আছে।

চিন্তা করিস না তুই। নিতু সাবধানে দরজা খুলে বের হয়ে এল। বারান্দায় আলো জ্বলছে, হঠাৎ করে কেউ দেখে ফেললে বলবে বাথরুমে যাচ্ছে। হাতে ইঁদুরের বাচ্চাটা নিয়ে নিতু নিশব্দে হাঁটতে থাকে। কয়েকটা রুম পার হবার পরই দূর থেকে হোস্টেল সুপারের বাঁশির মতো নাক ডাকা শুনতে পেল। আরো খানিকদূর যাবার পর বুঝতে পারে নাক ডাকার শব্দটি ঠিক বাঁশির মতো নয় অনেকটা প্লেনের ইঞ্জিনের মতো অনেক দূর থেকে সেটাকে বাঁশির মতো শোনায়। এতো শুকনো চিমশে যাওয়া মানুষ কেমন করে এরকম বিকটভাবে নাক ডাকতে পারে কে জানে!

নিতু সাবধানে হোস্টেল সুপারের ঘরের সামনে দাঁড়াল। একটা জানালা আধ খোলা, সেদিক দিয়ে ভেতরে বিছানাটা দেখা যাচ্ছে, মশারি টানানো, ভিতরে হোস্টেল সুপার ঘুমাচ্ছে। নিতু সাবধানে হাতের মুঠো থেকে ইঁদুরের বাচ্চাটা জানালায় ছেড়ে দিয়ে ফিস ফিস করের বলল, যা ব্যাটা, মজা দেখিয়ে দে।

নেংটি ইঁদুরের বাচ্চাটা জানালায় বসে একবার ইতিউতি তাকিয়ে হঠাৎ করে লাফ দিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। নিতু সাথে সাথে নিশব্দে হেঁটে নিজের ঘরের ফিরে এল। মিতুল তখনো জেগে বসে আছে। নিতুকে দেখে ফিস ফিস করে বলল, কতক্ষণ লাগবে বলে তোর মনে হয়?

বেশিক্ষণ লাগার কথা না। নিতু চাপা গলায় বলল, হোস্টেল সুপারের ঘরটা একবার ঘুরে দেখে নিয়েই আমাদের ইঁদুর বাবাজী মশারির ভিতরে ঢুকে পড়বে!

কী হবে বলে তোর মনে হয়?

ঠিক কী হবে জানি না তবে বড় মজা হবে।।

নিতু আর মিতুল দুজনেই মুখে হাত চাপা দিয়ে এখন খিক খিক করে হাসতে থাকে।

দুজনে চুপ চাপ বসে মজার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু মজা আর শুরু হয় না। অপেক্ষা করে করে যখন তাদের মনে হতে থাকে নেংটি ইঁদুরের কোনো কারণে হোস্টেল সুপারকে অপছন্দ করে তার বিছানায় ঢুকতে চাইছে না ঠিক তখন হঠাৎ তারা একটি বিকট চিৎকার শুনতে পেল। মনে হল যেন ডাকাত পড়ছে—হোস্টেল সুপরি গলা ফাটিয়ে এমন ভয়ংকর আর্তনাদ করতে লাগল যে নিতু আর মিতুল পর্যন্ত ভয় পেয়ে গেল। হোস্টেল সুপারের ঘরে দড়াম দড়াম করে শব্দ হতে লাগল, মনে হতে লাগল পুরো হোস্টেল বুঝি ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছে।

নিতু আর মিতুল মুখে হাত দিয়ে খিক খিক করে হাসতে থাকে। ঘরের অন্যেরাও জেগে ওঠেছে আশে পাশের রুমে যারা আছে তাদের কেউ কেউ দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। তখন নিতু আর মিতুলও দরজা খুলে বের হয়ে এল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তারা দেখতে পেল হঠাৎ করে হোস্টেল সুপারের দরজা খুলে গেল এবং ভিতর থেকে হোস্টেল সুপার গুলির মতো ছুটে বের হয়ে এল, বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিকট অঙ্গভঙ্গি করে লাফাতে থাকে, দেখে মনে হয় কোনো একটা বিচিত্র কারণে হোস্টেল সুপার তার শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলি খুলে ফেলতে চাইছে। শুধু তাই নয়, সেই বিকট নর্তন কুর্তনের সাথে সাথে হোস্টেল সুপার মুখ দিয়ে প্রচণ্ড জোরে চেঁচাতে শুরু করেছে।

মেয়েরা অবাক হয়ে হোস্টেল সুপারের কাছে হাজির হল, সবাই মিলে মোটামুটি গোল হয়ে তাকে ঘিরে দাঁড়াল এবং মাঝখানে হোস্টেল সুপার তার বিকট ক্যারিকেচার করতে থাকল। ষাড়ের মতো চেঁচাতে চেঁচাতে সে লাফাতে থাকে, দেখে মনে হয় তাকে কেউ গরম তাওয়ার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। খানিকক্ষণ লাফাতে লাফাতে হঠাৎ হাত দিয়ে শরীরের বিচিত্র সব জায়গায় খামচাতে শুরু করে। মুখ বিকৃত করে বিকট শব্দ করতে করতে শরীরের কাপড় খুলতে শুরু করে এবং হঠাৎ করে থেমে গিয়ে শরীর ঝাকাতে ঝাকাতে ছোটাছুটি করতে থাকে দেখে মনে হয় অদৃশ্য কোনো ভূত বুঝি তাকে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে।।

সবগুলি মেয়ে হতবাক হয়ে হোস্টেল সুপারের এই বিচিত্র নৃত্য দেখতে থাকে। হৈ চৈ গোলমাল শুনে জমিলার মাও চলে এসেছে, এমনিতে তার মুখে কোনো রকম অনুভূতির ছাপ পড়ে না কিন্তু এখন সেখানেও একটা অবাক হওয়ার ভাব। সে খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের গলায় ঝােলানো তাবিজটা হাত দিয়ে চেপে ধরে ফিস ফিস করে বলল, জীনের আছর।

কাসেম মেয়েদের মাঝে সবচেয়ে সাহসী, সে একটু এগিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, কী হয়েছে ম্যাডাম?

হোস্টেল সুপার তখন একটু শান্ত হয়েছে, কিন্তু ঠিক পুরোপুরি শান্ত হতে পারছে না, মাঝে মাঝেই কেমন যেন গা ঝাড়া দিয়ে শিউরে শিউরে উঠছে। শাড়ি প্রায় খুলে এসেছে, ব্লাউজের বোতাম খোলা, পাটের মতো চুল উশখুখুশকো, চোখে মুখে একটা অমানুষিক আতংক। কাসেম আবার জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে ম্যাডাম?

হোস্টেল সুপার মুখ হাঁ করে বড় বড় নিশ্বাস নিতে নিতে বলল, ইঁদুর।

ইঁদুর? অনেক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

হোস্টেল সুপার চোখ বড় বড় করে বলল, আমার পেটের ওপর দিয়ে এসে নাকের মাঝে ঢোকার চেষ্টা করেছে।

যে ছয়টি মেয়ে এই নেংটি ইঁদুরের বাচ্চার ইতিহাস জানে তারা ছাড়া অন্য সবাই হঠাৎ করে আতংক একটা আর্ত চিৎকার করে উঠল। হোস্টেল সুপার ভয়ে ভয়ে চারিদিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, আমি যখন হাত দিয়ে সরানোর চেষ্টা করেছি তখন শরীরের কাপড়ের ভিতর ঢুকে গেল।

মেয়েগুলি আবার একটা শব্দ করল, আনন্দে না ভয়ে এবার সেটা ঠিক ভালো করে বোঝা গেল না। জমিলার মা অবিশ্যি হোস্টেল সুপারের কথা বিশ্বাস করল না, মাথা নেড়ে বলল, জীনের আছর।

মিতুল অবাক হবার ভান করে বলল, জীনের আছর?

হ্যাঁ।

কেন? জীন কেন হবে?

ইন্দুর কখনো মানুষের কাছে আসে না। ইন্দুর মানুষকে ভয় পায়। মানুষ থেকে দূরে দূরে থাকে।

সত্যি?

হ্যাঁ। ইন্দুর মানুষের ঘ্রাণ সহ্য করতে পারে না। তাদের নিশ্বাসের থেকে দূরে থাকে। এইটা ইন্দুর না। অন্য কিছু।

হোস্টেল সুপার ফ্যাকাসে মুখে বলল, তাহলে এইটা কী?

জীন ভুতের আছর হলে এরকম হয়। আমার ফুপাতো বোনের হয়েছিল।

কিন্তু—কিন্তু–হোস্টেল সুপার তোতলাতে তোতলাতে বলল, আমার স্পষ্ট মনে হল ইঁদুর।

নিতু হঠাৎ বলে ফেলল, হয়তো ইঁদুরের ভূত।

হোস্টেল সুপার ঢোক গিলে বলল, কী বললি?

বলেছি, ইয়ে মানে ইঁদুরের ভূত। মানে ইঁদুর মরে যে ভূত হয়।

ই-ই-ইঁদুরের ভূত?

হ। মনে নাই সোদন যে ইঁদুর গুলি মেরেছিলেন? মানে ইয়ে, হয়তো তাদের ভূত এসেছে। আপনি মেরেছিলেন তাই আপনার ওপরে রাগ বেশি। হতে পারে না?

এখানে ভূত বিষয়ক অভিজ্ঞ মাত্র একজনই, জমিলার মা, সবাই তার দিকে তাকাল, হতে পারে?

জমিলার মা মাথা চুলকে বলল, বলা মুশকিল। তবে—

নিতু বলল, মানুষ মরে যদি মানুষের ভূত হয় তাহলে ইঁদুর মরে ইঁদুরের ভূত কেন হতে পারে না?

হোস্টেল সুপার এতক্ষণ পর হঠাৎ খেয়াল করল যে তার দুর্দশা নিয়ে মেয়েরা কথাবার্তা বলছে। ব্যাপারটি ভালো নয়। সে তার শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে মুখ গম্ভীর করে ধমকে দিয়ে বলল, যা সবাই ঘুমাতে যা। তোরা কেন বিছানা থেকে উঠে এসেছিল।

ধমক খেয়ে সবাই নিজের নিজের ঘরে ফিরে গেল। নিতু এবং তার পাঁচ রুমমেট দরজা বন্ধ করে হেসে কুটি কুটি হয়ে গেল। যখন শুনতে পেল নিতু নিজে গিয়ে ইঁদুরের বাচ্চাকে ছেড়ে দিয়ে এসেছে তখন অন্যেরা বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি খেতে শুরু করল।

নিতু হাসি থামিয়ে চাপা গলায় বলল, ইঁদুরের বাচ্চাটা এখনো ফিরে আসে। নি। তার মানে কী জানিস?

কী?

আজ রাতে আবার এটাক হতে পারে!

ব্যাপারটা চিন্তা করে আবার সবাই হি হি করে হাসতে শুরু করে।

বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ পর আবার যখন তাদের চোখে প্রায় ঘুম লেগে এসেছে তখন দ্বিতীয়বার হোস্টেল সুপার বিকট স্বরে চিৎকার করে লাফঝাপ দিতে শুরু করল। অন্য অনেকে দ্বিতীয়বার মজা দেখতে গেলেও এই ছয়জন ঝুঁকি নিল না, হোস্টেল সুপারের নর্তন কুর্দন দেখতে দেখতে হঠাৎ করে হেসে ফেললে বিপদ হয়ে যাবে। তা ছাড়া হাসি জলবসন্ত এবং হাম থেকেও বেশি সংক্রামক, একজন হেসে ফেললে অন্য সবাই হাসতে শুরু করব। এরকম একটা ব্যাপারে হাসি আটকে রাখা অসম্ভব ব্যাপার।

মিনিট দশেক তারা হোস্টেল সুপারের চিৎকার লাফঝাপ এবং হৈ চৈ শুনতে পেল। তারপর শব্দ কমে এল, যারা মজা দেখতে গিয়েছিল তাদের কাছে শুনতে পেল, হোস্টেল সুপার নাকি আর ঘুমুতে যাচ্ছে না। লাল রংয়ের একটা দোয়াদরূদের বই বুকে চেপে ধরে বিছানায় পা তুলে বসে আছে। নিতু একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল, ঘরের বাতি জ্বালানো থাকলে হঠাৎ করে যদি তার ইঁদুরের বাচ্চাকে দেখে ফেলে তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। তা ছাড়া ইঁদুরের বাচ্চাটা জানে না মানুষ থেকে দূরে দূরে থাকতে হয়।

নিতুর ভয় অবশ্য কিছুক্ষণেই কেটে গেল, হঠাৎ করে মনে হল কিছু একটা তার হাত বেয়ে তির তির করে উঠে আসছে। সে লাফ দিয়ে ওঠে ইঁদুরের বাচ্চাটাকে ধরে ফিস ফিস করে বলল, পাজী ছেলে! এখন আমাকে ভয় দেখাতে এসেছিস? এক রাতের জন্যে অনেক এডভেঞ্চার হয়েছে এখন ঘুমুতে দে আমাদের।

নিতু চকলেটের টিনে ইর্দুরের বাচ্চাটাকে আটকে রাখল, ভোর হওয়ার আগে আর তাকে ছাড়া হবে না।

পরদিন হোস্টেল সুপারকে দেখে সবাই শিউরে উঠল, একরাতে তার বয়স মনে হয় পঞ্চাশ বছর বেড়ে গেছে। চুল ময়লা পাটের মতো উশখু খুশকো চোখ গভীর গর্তে ঢুকে গেছে। মুখ তোবড়ানো, শুকনো চামড়া ঝুলে পড়েছে। মনে হয় সোজা হয়ে হাঁটতেও পারছে না, কেমন যেন কুঁজো হয়ে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে ঘটছে। গলার স্বর ভেঙ্গে গিয়ে সেখান থেকে ফ্যাসফ্যাসে একটা শব্দ বের হচ্ছে একটা ছোট ইঁদুরের বাচ্চা একজন বড় মানুষকে এভাবে কাবু করতে পারে নিজের চোখে না দেখলে নিতু কখনো বিশ্বাস করত না।

 

গভীর রাতে আবার নিতুর ঘুম ভেঙ্গে গেল, সারাদিন এডভেঞ্চার করে ইঁদুরের বাচ্চা ফিরে এলে আবার তাকে চকলেটের টিনে আটকে রাখা হয়েছে। নিতু শুনতে পেল সে কুট কুট করে শব্দ করছে, এখান থেকে বের হতে চায়।

একবার হোস্টেল সুপারের রুমে ছেড়ে দেবার পর কী অবস্থা হয়েছে সে দেখেছে, আবার ছেড়ে দিলে কী হবে কে জানে! নিতু ঘুমানোর চেষ্টা করল কিন্তু ঘুম এলো না, ইঁদুরের বাচ্চার এই শোনা যায় না এরকম কুট কুট শব্দকে যে এত বেশি শব্দ মনে হবে সেটা কে জানত। শেষে আর সহ্য করতে না পেরে নিতু নেংটি ইঁদুরের বাচ্চাকে টিন থেকে বের করে আনল, ইঁদুরটা এর মাঝেই একটু লায়েক হয়ে গেছে। বের করা মাত্রই তিড়িং বিড়িং করে কয়েকটা লাফ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, কোথায় গিয়েছে কে জানে। আজ রাতে না জানি কার সর্বনাশ করবে!

গভীর রাতে হঠাৎ বাইরে বিকট আর্তনাদ শুনে সবাই ধড়মড় করে জেগে উঠল। হোস্টেল সুপার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, নেংটি ইঁদুরের বাচ্চা আবার গিয়ে ঠিক একই জায়গায় হামলা করেছে।

আগের দিন ব্যাপারটি নিয়ে সবাই হেসে কুটি কুটি হয়েছে কিন্তু আজ আর হাসি পাচ্ছে না সবারই কেন যেন ভয় ভয় লাগছে। যদি হোস্টেল সুপারের কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে কী হবে? তানিয়া ভুরু কুচকে নিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, আবার হোস্টেল সুপারের রুমে ছেড়ে দিয়ে এসেছিস?

নিতু মাথা নাড়ল, বলল, উহুঁ। নিজেই লাফিয়ে গেছে।

মিতুল শুকনো গলায় বলল, এখন কী হবে?

রেবেকা উদাস গলায় বলল, কী আর হবে। যা হবার তাই হবে।

 

পরদিন সকালে ওঠে সবাই খবর পেল, যা হবার তাই হয়েছে। হোস্টেল সুপার বুতুরুন্নেসা আবাসিক বালিকা বিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। যে জায়গায় ভূতের ওৎপাত, বিশেষ করে ইঁদুরের ভূত সেখানে চাকরি করে জীবন খোয়াতে সে রাজি নয়।

মেয়েরা যদি আনন্দে গলা খুলে চিৎকার করার অনুমতি পেতো তাহলে তাদের সেই চিৎকার নিউ ইয়র্ক থেকে শোনা যেতো।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল