আর্ট কম্পিটিশন

টুম্পা যখন তার নতুন বাবাকে বলেছিল যে তার খুব বাংলাদেশে যেতে ইচ্ছে। করে সে কিন্তু সেটা খুব ভেবেচিন্তে বলে নি–কিন্তু সেই কথাটি বলার কারণে বাসায় তার অবস্থাটা আগের থেকে খারাপ হয়ে গেল। বাবা এখন সময়ে অসময়ে সেটা দিয়ে তাকে খোটা দেন। যেমন সবাই মিলে খেতে বসেছে, তখন বাবা বলবেন, আমাদের টুম্পার বাংলাদেশে কী হয়েছে তোমরা শুনেছ?

বাধ্য হয়ে তখন কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয়, কী হয়েছে?

বাবা তখন হাত পা নেড়ে বলেন, একটা লঞ্চ বোঝাই করে মানুষ নিয়ে যাচ্ছে, কথা নাই বার্তা নাই মেঘনার মাঝখানে সেটা মার্বেলের মতো ডুবে গেল। পাঁচশ মানুষ শেষ।

আম্মু তখন বলেন, আহারে! আব্বু বিরক্ত হয়ে বলেন, রাখো তোমার আহারে! ঐ দেশে কোনো নিয়ম কানুন আছে নাকি? কোনো সেফটি রুল আছে নাকি? মানুষ মরবে না তো কী? কারো কোনো মাথ্য ব্যথা আছে?

আম্মু বলেন, তবুও তো। এতোগুলো মানুষ—

নতুন বাবার চোখ তখন উত্তেজনায় চক চক করতে থাকে, যড়যন্ত্রীর মতো বলেন, এতোগুলো মানুষ যে মরেছে সেটা এই দেশের কোনো নিউজে শুনেছ? পত্রিকায় দেখেছ? দেখ নাই।

এটা অবশ্যি সত্যি কথা এই দেশের কোথাও সেই খবর ছাপা হয় না। বাবা সেটা নিয়েও টিটকারি মারেন, বলেন, কেন নাই জান? কারণ বাইরের দুনিয়া বাংলাদেশের মানুষকে মানুষ বলেই গণ্য করে না। কেন করবে? তারা কী মানুষ হবার যোগ্য হয়েছে?

টুম্পার ইচ্ছে হয় সে বলে, বাবা এই সমস্যাটা তো বাংলাদেশের নয়। সমস্যাটা এই দেশের মানুষের। এতো বড় দুদর্শার খবর তারা শুনতে চাইবে না কেন? কিন্তু টুম্পা কিছু বলে না।

আবার কয়েকদিন পর নতুন বাবা মুখে এক গাল হাসি নিয়ে বলেন, টুম্পার বাংলাদেশে কী হয়েছে শুনেছ?

কেউ একজন জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে?

চারদিন ধরে টানা হরতাল। সারা দেশের মানুষ ঘরে বসে হিন্দি সিনেমা দেখছে। আর রাস্তায় রাস্তায় মারপিট–

আম্মু জানতে চান, কেন? কী হয়েছে?

বাবা হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, সেই খবর কে জানে! বাংলাদেশের কোনো মাথামুণ্ডু আছে নাকি? তারপর টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলেন, তুই যে সারাক্ষণ বাংলাদেশ বাংলাদেশ করিস তোকে আসলেই একবার বাংলাদেশ পাঠানো উচিৎ। এক সপ্তাহের মাঝে সিধে হয়ে যাবি।

টুম্পা তখন বলে, আমার মনে হয় ভালোই লাগবে। বাংলাদেশের সংসদ ভবন হচ্ছে সারা পৃথিবীর মাঝে বিখ্যাত। লুই কান ডিজাইন করেছেন, দূর দূর দেশ থেকে মানুষ সেটা দেখতে আসে–

আব্বু চোখ পাকিয়ে বলেন, কংক্রিটের একটা দালান এর মাঝে দেখার কী আছে? দেখার মতো জিনিস হচ্ছে তাজমহল, পুরোটা শ্বেতপাথরের তৈরি। কোথায় শ্বেত পাথর আর কোথায় কংক্রিট!

টুম্পা তার নতুন বাবার সাথে তর্ক করে না। বাবা তখন গজ গজ করে বলেন, প্লেনের ভাড়া অনেকগুলো টাকা তা না হলে আমি সত্যিই তোকে বাংলাদেশ পাঠাতাম।

টুম্পা তখন বলে, আমি টাকা জমাচ্ছি। যখন প্লেনের টিকেটের টাকা হবে। তখন আমি নিজেই যাব।

গিয়ে কী করবি শুনি?

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যাংগ্রোভ ফরেস্ট হচ্ছে বাংলাদেশে। সুন্দরবন। সেখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার থাকে। সেই বাঘ দেখব।

লিটন তখন বলে, আমিও যাব। আমিও বাঘ দেখব।

টুম্পা বলে, আমি যখন বড় হবো অনেক টাকা হবে, তখন তোকে নিয়ে। যাব। এখন পারব না।

কেন পারবে না, কেন নেবে না বলে লিটন এখন টুম্পার সাথে ঝগড়া শুরু করে দেয়। বাবা ভুরু কুঁচকে টুম্পার দিকে তাকিয়ে থাকেন, বিড় বিড় করে বলেন, পাগলামি রোগ বংশগত। জিনেটিক। আমি আগেই বলেছি না?

.

আমেরিকার ইতিহাস ক্লাশ শেষে পি.এ, সিস্টেমে অফিস থেকে টুম্পাকে ডেকে পাঠালো তার একটা চিঠি নিয়ে নেবার জন্যে। স্কুলের চিঠিপত্র সাধারণত লাইব্রেরির বই ফেরত দেওয়া, গার্জিয়ানদের মিটিং এই সব নিয়ে হয়, গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় কিন্তু তবুও টুম্পা তখন তখনই চিঠিটা নিয়ে এল। খামের উপর তার নামটি হাতে লেখা, খামটি খুলে দেখে একটা খবরের কাগজের ক্লিপিং সাথে এক টুকরো সাদা কাগজে একটা চিঠি। চিঠিটা লিখেছেন মিসেস হেনরিকসন। চিঠিতে লেখা :

প্রিয় টুম্পা

সামনের উইক এন্ডে আটলান্টিক সিটিতে একটা ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা হবে। তোমার সাথে কথা না বলেই আমি তোমাকে সেখানে রেজিস্ট্রেশন করে দিয়েছি। তোমার রেজিস্ট্রেশন নম্বর বি ৫২৫৩, তুমি অবশ্যিই সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যাবে।

তুমি হয়তো জান না, কিন্তু তুমি আসলে একজন অসাধারণ শিল্পী।

ক্রিস্টিনা হেনরিকসন

টুম্পা একটু অবাক হয়ে চিঠিটা আরেকবার পড়লো, তারপর খবরের কাগজের ক্লিপিংটা দেখলো। প্রতিযোগিতা তিন ক্যাটাগরিতে যাদের বয়স পাঁচ থেকে দশ তারা ক্যাটাগরি এ, যাদের বয়স দশ থেকে পনেরো তারা ক্যাটাগরি বি এবং যাদের বয়স পনেরো থেকে বিশ তারা ক্যাটাগরি সি। টুম্পার বয়স চৌদ্দ তাই সে ক্যাটাগরি বি। রেজিস্ট্রেশন ফী বিশ ডলার, মিসেস হেনরিকসন সেটা দিয়ে দিয়েছেন!

চিঠিটা হাতে নিয়ে ক্লাশে ফিরে আসতেই জেসিকা জিজ্ঞেস করলো, কিসের চিঠি? প্রিন্সিপালের? দাঁত বের করে হেসে বলল, মাতাল অবস্থায় স্কুলে আসার অপরাধে স্কুল থেকে বহিষ্কার?

টুম্পা হাসল, বলল, অনেকটা সেরকম!

তবু শুনি।

টুম্পা বলতে চাইছিল না, কারণ সে জানে তাকে বাসা থেকে কিছুতেই আটলান্টিক সিটি নিয়ে যাবে না। সে যে ছবি আঁকে বাসায় সেটাও ভালো চোখে দেখা হয় না। কিন্তু জেসিকা খুব কৌতূহলী মেয়ে সবারই সবকিছু তার জানা চাই। তাই টুম্পাকে চিঠিটা দেখাতে হলো! চিঠি পড়ে সে ক্লাশে হৈ চৈ শুরু করে দিল, এবং তখনই ডজন খানেক ছেলেমেয়ে টুম্পার সাথে আটলান্টিক সিটি যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল। টুম্পা যখন ছবি আঁকবে তখন তারা পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে নেচে কুদে তাকে উৎসাহ দেবে। টুম্পা এক ধরনের অস্বস্তি নিয়ে বসে থাকে, আসলে সে যেতে পারবে না এবং সেই কথাটি কীভাবে ক্লাশের সবাইকে বলবে সে জানে না।

সেদিন রাত্রি বেলা টুম্পা তবুও একবার চেষ্টা করল। খাবার টেবিলে বাবা বাংলাদেশের ফতোয়াবাজ একজনের গল্প শেষ করে হা হা করে হাসছেন তখন টুম্পা বলল, আটলান্টিক সিটিতে একটা আর্ট কম্পিটিশন হচ্ছে, আমি কী সেখানে যেতে পারি?

বাবা হাসি থামিয়ে বললেন, কোথায়?

আটলান্টিক সিটিতে।

বাবা পরিষ্কার শুনেছেন তবুও না শোনার ভান করে বললেন, কোথায়?

আটলান্টিক সিটিতে।

বাবা মুখ শক্ত করে বললেন, আটলান্টিক সিটি হচ্ছে জুয়াখেলার জায়গা। তুই আটলান্টিক সিটি যেতে চাচ্ছিস মানে?

সেখানে একটা আর্ট কম্পিটিশন হচ্ছে—

আব্বু বাধা দিয়ে বললেন, এই দেশে ঢেকুর তোলার কম্পিটিশন হয় হচি মারার কম্পিটিশন হয় তার মানে তুই তার সবগুলোতে যেতে থাকবি?

টুম্পার আর কথা বলার ইচ্ছে করল না, সে চুপ করে গেল। বাবা তখন আরেকটু রেগে গেলেন, বললেন, আর্ট–ফার্ট এগুলো মাথা থেকে দূর কর। দুনিয়াটা কঠিন জায়গা আর্ট–ফার্ট দিয়ে এখানে কিছু হয় না। মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা কর যেন কোনো একটা চাকরি বাকরি পাস। বুঝলি?

টুম্পা মাথা নেড়ে জানালো যে সে বুঝেছে। বাবা এখন গজগজ করতে লাগলেন, বললেন, আমি বুঝতে পারি না তোদের এতো সময় কেমন করে হয় যে যত অ–জায়গা কু–জায়গার খোঁজখবর নেওয়ার সময় হয়।

টুম্পা তখন না বলে পারল না, আমি এর খোঁজ নিই নাই।

তাহলে এর খোঁজ পেলি কেমন করে?

টুম্পা কোনো কথা না বলে তখন তার ঘর থেকে মিসেস হেনরিকসনের চিঠিটা এনে নতুন বাবাকে দিলো। বাবা চিঠিটা পড়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ক্রিস্টিনা হেনরিকসন কে?

আমাদের স্কুলের একজন সাবস্টিটিউট টিচার।

ও।

আম্মু তখন বাবার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়লেন, পড়ে বললেন, কোথাও তো যায় না। নিয়ে যাই না হয় কম্পিটিশনে। আমি ড্রাইভ করে নিয়ে যাব–

বাবা চোখ লাল করে বললেন, এই বাসায় আমি আর্ট ফার্ট ঢুকতে দেব না। বুঝেছ?

আম্মু চুপ করে গেলেন।

বিষয়টা এখানেই শেষ হবার কথা কিন্তু শেষ হলো না। পরদিন স্কুল থেকে বাসায় এসে তালা খুলে ভেতরে ঢুকেছে। বাসায় কেউ নেই, আম্মু মনে হয় লিটনকে নিয়ে গ্রোসারি সেন্টারে গিয়েছেন। টুম্পা ফ্রিজ খুলে একটা হট ডগ বের করে মাইক্রোওয়েভে গরম করছে তখন টেলিফোন বাজলো। ফোন ধরে দেখে অন্যপাশে মিসেস হেনরিকসন। মিসেস হেনরিকসন খুশি খুশি গলায় বললেন, টুম্পা! কী খবর তোমার?

ভালো মিসেস হেনরিকসন। থ্যাংক ইউ।

তুমি আসছ তো আটলান্টিক সিটিতে? এটা খুব প্রেস্টিজিয়াস কম্পিটিশান। তোমার খুব কপাল ভালো এই বছর এটা আটলান্টিক সিটিতে হচ্ছে। দিনে দিনে ঘুরে চলে আসতে পারবে। মায়ামী না হয় লাসভেগাসে হলে

কী করতে?

টুম্পা ইতস্তত করে বলল, তা ঠিক।

ঠিক আছে, তাহলে দেখা হবে– মিসেস হেনরিকসন টেলিফোন রেখে দিচ্ছিলেন, টুম্পা তাকে থামাল, বলল, মিসেস হেনরিকসন, মিসেস হেনরিকসন–

কী হলো?

আসলে, আসলে—

আসলে কী?

আসলে আমার যাওয়া হবে না।

ও! মিসেস হেনরিকসন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, অন্য কোনো প্রোগ্রাম আছে?

না, সেরকম কিছু না। টুম্পা ইতস্তত করে ঠিক কী বলবে বুঝতে পারে

না।

তাহলে?

আসলে আমার বাসা থেকে যেতে দেবে না।

কথাটা বুঝতেই মিসেস হেনরিকসনের একটু সময় লেগে গেল। বোঝার পর জিজ্ঞেস করলেন, কেন যেতে দেবে না?

টুম্পার মনে হলো ধানাই পানাই না করে সত্যি কথাটাই বলে দেয়া ভালো, বলল, আসলে আমার বাবা–মা আমাকে কোথাও যেতে দেয় না।

কোথাও যেতে দেয় না?

না। স্কুল আর বাসা ছাড়া আমি কোথাও যেতে পারি না।

কেন?

টুম্পা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল, বলল, আমি জানি না। তারা অন্য কালচারের মানুষ, এই কালচারকে ভয় পায়। আমার বাবা আর আম্মুর ধারণা আমি, আমি–

বুঝেছি। মিসেস হেনরিকসন বললেন, আমি দেখেছি এরকম আগেও।

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মিসেস হেনরিকসন, কিন্তু বুঝতেই পরিছ। আমার কিছু করার নেই।

মিসেস হেনরিকসন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, টুম্পা।

হ্যাঁ, মিসেস হেনরিকসন।

আমি কী তোমার বাবার সাথে কথা বলে দেখব?

কোনো লাভ হবে না। উল্টো—

উল্টো কী?

টুম্পা বলল, উল্টো হয়তো তোমাকে কিছু একটা বলে দেবেন। আমার খুব লজ্জা লাগবে তখন।

মিসেস হেনরিকসন শব্দ করে হাসলেন, বললেন, তুমি সেটা নিয়ে চিন্তা করো না। আমাকে কেউ কিছু বললে আমি কিছু মনে করি না। তোমার বাবার টেলিফোন নাম্বারটা দাও।

টেলিফোন নাম্বারটা দিয়ে টুম্পা ইতস্তত করে বলেই ফেলল, মিসেস হেনরিকসন, আমার বাবা আমার সম্পর্কে অনেক কিছু বলে ফেলতে পারেন, তুমি তার সবকিছু বিশ্বাস করো না।

কী বলবে?

আমার এই বাবা আসলে আমার মায়ের দ্বিতীয় হাজব্যান্ড। আমার আসল বাবা ছিলেন প্রথম হাজব্যান্ড। সেই বাবার কথা আমার কিছু মনে নেই, কিন্তু শুনেছি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন তাই আমার নতুন বাবা সবসময় আমাকে বলেন আমার শরীরে পাগলের রক্ত আছে–

মিসেস হেনরিকসন থামিয়ে দিয়ে বললেন, ননসেন্স! যত্তোসব বাজে কথা। তুমি এই সব কথা বিশ্বাস করো না তো?

আমি বিশ্বাস করতে চাই না।

গুড়। শোনো–তুমি আমার টেলিফোন নাম্বারটা লিখে রাখো, যদি কখনো দরকার হয় আমাকে ফোন করবে। যে কোনো দরকার–

থ্যাংক ইউ মিসেস হেনরিকসন। মিসেস হেনরিকসন তার ফোন নম্বরটা দিয়ে টেলিফোনটা রেখে দিলেন।

.

নতুন বাবা বিকেলে যখন অফিস থেকে এলেন তখন তার মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। রাগে থম থম করছে। কোনো কথা না বলে বসে বসে টেলিভিশনে হিস্ট্রি চ্যানেলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কাহিনী দেখতে লাগলেন, নতুন বাবা জন্মেও এই সব দেখেন না দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনো কিছু নিয়ে মেজাজ খারাপ। খাবার টেবিলেও কিছু না বলে খেতে লাগলেন, হাত ধুয়ে উঠে যাবার আগে আম্মুকে বললেন, টুম্পার একজন টিচার কালকে সকালে টুম্পাকে তুলে নিয়ে যাবে।

আম্মু বললেন, কোন টিচার?

নাম ভুলে গেছি।

কেন তুলে নেবে? কোথায় তুলে নেবে?

কী যেন একটা আর্ট কম্পিটিশনে।

আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, আটলান্টিক সিটিতে?

নতুন বাবা থমথমে মুখে বললেন, হ্যাঁ। তারপর উঠে বেডরুমে ঢুকে গেলেন। লিটন আম্মুর পিছনে ঘুরঘুর করে বলতে লাগলো, আমি যাব আম্মু। আমিও আটলান্টিক সিটি যাব।

.

খুব ভোর বেলা একটা বড় ভ্যানে করে মিসেস হেনরিকসন টুম্পাদের বাসায়। হাজির হলেন। দুবার চাপা স্বরে হর্ন দিতেই টুম্পা তার ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমে এল, মিসেস হেনরিকসন চোখ নাচিয়ে বললেন, কী খবর আমাদের আর্টিস্ট? কম্পিটিশনের জন্যে রেডি?

টুম্পা একটু হাসির ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল। মিসেস হেনরিকসন দরজা খুলে দিয়ে বললেন, নাও, ওঠো।

টুম্পা মিসেস হেনরিকসনের পাশে বসলো, সাথে সাথে মিসেস হেনরিকসন ভ্যান ছেড়ে দিলেন। টুম্পা সিট বেল্ট বেঁধে নিয়ে বললো, তুমি আমার বাবাকে কী বলেছিলে মিসেস হেনরিকসন?

আমাকে তোমার সাথে যেতে দিচ্ছেন–এটা অসম্ভব একটা ব্যাপার। তাছাড়া–

তাছাড়া কী?

তাছাড়া কাল রাতে আমার বাবার মেজাজ অসম্ভব খারাপ ছিল। মনে হচ্ছিল আমাকে ধরে কাঁচা খেয়ে ফেলবেন। তুমি কী বলেছিলে?

মিসেস হেনরিকসন হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বললেন, বিশেষ কিছু বলি নাই। শুধু একটু আইনের ভয় দেখিয়েছি।

আইনের ভয়?

হ্যাঁ।

সেটা কী রকম?

বলেছি যে একজন ছেলে বা মেয়েকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বাসায় আটকে রাখা আইনত দণ্ডণীয় অপরাধ। আমি একজন সার্টিফাইড টিচার যদি এডুকেশান বোর্ডের কাছে অভিযোগ করি তাহলে স্টেট একশন নিতে পারে–এইসব আগডুম বাগডুম!

টুম্পা হি হি করে হেসে বলল, এগুলো কী সত্যি কথা?

আরে ধেৎ? মিসেস হেনরিকসন হাসলেন, স্টেট যদি এতো কাজের হতো তাহলে তো দেশের চেহারাই পাল্টে যেতো!

টুম্পা বলল, তুমি আমার বাবাকে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছ।

মিসেস হেনরিকসন বললেন, আসলে আমি এমন কিছু ভয় দেখাই নি, তোমার বাবা মানুষটাই ভীতু!

মিসেস হেনরিকসন ছোট রাস্তা থেকে একটু বড় রাস্তায় উঠে বললেন, টুম্পা তোমাকে একটা জিনিস বলে রাখি আমি যে অনেক হৈ চৈ করে তোমাকে এই কম্পিটিশনে নিয়ে যাচ্ছি সেটা থেকে তোমার যেন কোনো ভুল ধারণা না হয়।

কী ভুল ধারণা?

ছবি আঁকা হচ্ছে একটা ক্রিয়েটিভ কাজ, গল্প কবিতা লেখাও হচ্ছে ক্রিয়েটিভ কাজ। ক্রিয়েটিভ কাজের মাঝে কোনো কম্পিটিশন হয় না। কম্পিটিশন ব্যাপারটাই হচ্ছে এক ধরনের ছেলেমানুষী। আমি কম্পিটিশন পছন্দ করি না, কারণ কম্পিটিশনে একজন আরেকজনকে হারাতে চেষ্টা করে। আসলে একজন কখনোই আরেকজনকে হারাতে চেষ্টা করবে না, সব সময় আরেকজনকে জিতিয়ে দেবার চেষ্টা করবে, তাহলে সবাই জিতবে। আমি তোমাকে কিন্তু কম্পিটিশনে জেতার জন্যে নিয়ে যাচ্ছি না।

তাহলে কীসের জন্যে নিয়ে যাচ্ছ?

আমি তোমাকে কম্পিটিশনে অংশ নেবার জন্যে নিয়ে যাচ্ছি। এখানে অংশ নিলেই তুমি ঠিক তোমার মতো আরো অনেক শিল্পীদের দেখা পাবে। তাদের সাথে সময় কাটাতে পারবে, কথা বলতে পারবে। বুঝেছ?

বুঝেছি।

যদি কম্পিটিশনে জেতার চেষ্টা করো আর যদি না জেতো তা হলে মন খারাপ হবে। আর যদি শুধু অংশ নাও জেতার চেষ্টা না করো তাহলে আনন্দ পাবে। বুঝেছ?

টুম্পা আবার মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি।

বড় রাস্তাটা ফ্রিওয়েতে উঠে যাচ্ছিল, মিসেস হেনরিকসন ফ্রিওয়েতে না উঠে তার পাশের বিশাল পার্কিং লটে ঢুকে গেলেন।

টুম্পা অবাক হয়ে বলল, এখানে ঢুকছ কেন?

অন্যেরা যারা যাবে তারা সবাই এখানে আসবে।

আর কারা যাবে?

তোমাদের ক্লাশের ছেলেমেয়েরা। আমি যখন বুঝতে পেরেছি তোমাকে তোমার বাবা মা বাসা থেকে বের হতে দেয় না তখন আমার মনে হয়েছে টিপিক্যাল আমেরিকান টিনএজাররা কীভাবে স্ফূর্তি করে তোমার সেটা দেখা দরকার। মিসেস হেনরিকসন চোখ মটকে বললেন, তুমি কী ভেবেছ শুধু তুমি আর আমি যাব বলে এতো বড় ভ্যান নিয়ে রওনা দিয়েছি?

কথা বলতে বলতে মিসেস হেনরিকসন তার ভ্যানটা একটা ছোট ঘরের সামনে দাঁড় করালেন এবং টুম্পা অবাক হয়ে দেখলো তার ক্লাশের অনেক ছেলে মেয়ে হৈ হৈ করতে এগিয়ে এল। মিসেস হেনরিকসন টুম্পার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, এতোগুলো টিন এজারকে আমি একা নিয়ে যেতে সাহস করি নি, তাই আমার সাথে জেসিকার মাও যাচ্ছেন! জেসিকার মা মিসেস রবাটসন আমার পাশে বসবেন–তুমি যাও, পিছনে তোমার বন্ধুদের সাথে বস!

টুম্পা দরজা খুলে বের হয়ে এল এবং সব ছেলেমেয়ে তাকে ঘিরে চেঁচামেচি করতে লাগলো। জেসিকার মা মিসেস রবার্টসন বললেন, আমরা যাচ্ছি একটা কম্পিটিশনে, তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে তোমরা যাচ্ছ ফুটবল খেলতে!

মাইকেল দাঁত বের করে হেসে বলল, আমরা তো আগে কখনো আর্ট কম্পিটিশনে যাই নাই তাই ফুটবল খেলার মতো করেই আর্ট কম্পিটিশন করে ফেলব।

জেসিকা বলল, টুম্পা যখন ছবি আঁকবে আমরা তখন চারপাশে ঘিরে লাফাব আর চিৎকার করব, সাবাশ টুম্পা সাবাশ!

জেসিকার কথা শুনে সবাই হি হি করে হাসতে থাকে।

.

আটলান্টিক সিটিতে পৌঁছাতে তিন ঘণ্টার মতো সময় লেগে গেল। মাঝখানে কিছু একটা খাওয়ার জন্যে খানিকক্ষণের জন্যে থামা হয়েছিল কিন্তু এতোগুলো টিনএজারকে নামানোর পর আবার সবাইকে একত্র করে ভ্যানে তুলতে অনেকক্ষণ সময় লেগে গেল, তা না হলে আরো কিছুক্ষণ আগে পৌঁছানো যেতো। আটলান্টিক সিটিতে যাবার সময় টুম্পা অবাক হয়ে আবিষ্কার করলো এই বয়সের ছেলেমেয়েরা যখন একসাথে থাকে তখন কোনো কারণ ছাড়াই তাদের লাগাম ছাড়া আনন্দ হতে থাকে। তারা যেটাই করে সেটাকেই মনে হয় মজার, সেটা নিয়েই তারা হাসাহাসি করে গড়াগড়ি খেতে থাকে। প্রথম প্রথম টুম্পার একটু জড়তা হচ্ছিল কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই সে তাদের সবার একজন হয়ে গেল।

আটলান্টিক সিটি পৌঁছে কনভেনশন সেন্টারটা খুঁজে বের করে ভ্যানটাকে পার্ক করে সবাই ছুটতে ছুটতে যখন কনভেনশন সেন্টারের গেটে এসে পৌচেছে তখন কম্পিটিশন প্রায় শুরু হয়ে গেছে। গেটে সবাই আবিষ্কার করল টুম্পা ছাড়া আর কেউ ভেতরে ঢুকতে পারবে না। ছবি আঁকার জন্যে সময় দেয়া হবে তিনঘণ্টা, তারপর সবাই ভেতরে ঢুকতে পারে। ছবিগুলো তখন টানিয়ে দেওয়া হবে বিচারকেরা ঘণ্টা দুয়েক সময় নেবেন, তারপর ফলাফল ঘোষণা করা হবে।

ভেতরে টুম্পা ছাড়া আর কেউ ঢুকতে পারবে না শুনে প্রথমে সবাই একটু চেঁচামেচি করল, মিসেস হেনরিকসন তখন তাদের শান্ত করলেন, কাছেই আটলান্টিক মহাসমুদ্র, তার বেলাভূমিতে গিয়ে সবাই সময় কাটাতে পারবে। বয়স কম বলে কেউ ক্যাসিনোতে ঢুকতে পারবে না, কিন্তু ক্যাসিনোর পাশেই আছে বিশাল বোর্ড ওয়াক সেখানে সবার জন্যে হাজারো রকমের স্ফূর্তির ব্যবস্থা আছে। তখন সবাই টুম্পাকে বিদায় জানিয়ে ছবি আঁকার জন্যে ভেতরে পাঠিয়ে দিল।

টুম্পা তার রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে খুঁজে খুঁজে তার জায়গাটা বের করলো, সবাই এর মাঝে চলে এসেছে। চারিদিকে নানাবয়সী ছেলেমেয়ে বোর্ডে কাগজ লাগিয়ে গম্ভীর মুখে বসে আছে। সামনে একটা পোডিয়াম সেখানে শুকনো চেহারার একজন বয়স্কা মহিলা মাইক্রোফোনে প্রতিযোগিতার নিয়ম কানুনগুলো বলে দিলেন। কমবয়সী একটা মেয়ে বড় পিতলের একটা ঘন্টা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেটাতে কাঠের একটা হাতুড়ি দিয়ে ঢং করে একটা ঘণ্টা বাজিয়ে দিতেই কনভেনশন সেন্টারের ছেলেমেয়েরা হাতে পেন্সিল তুলে নিয়ে স্কেচ করতে শুরু করে।

টুম্পা তার ডানে এবং বামে তাকালো, প্রায় তার বয়সী ছেলেমেয়েরা হাঁটু ছাড়িয়ে বসে কোলে বোর্ডটা নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। সামনে ছবি আঁকার সরঞ্জাম সাজানো। টুম্পা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো, মিসেস হেনরিকসন বলে দিয়েছেন তাকে এই প্রতিযোগিতায় জিততে হবে না, তাকে শুধু অংশ নিতে হবে। সে জেতার চেষ্টা করবে না, শুধু সুন্দর করে মমতা দিয়ে একটা ছবি আঁকবে। কী আঁকবে সে?

যশোর রোড! হ্যাঁ তার মাথায় এখনো মৌসুমী ভৌমিকের গাওয়া সেই গানটি গুনগুন করছে, সে সেই যশোর রোডেরই একটা ছবি আঁকবে। একটা মা তার শিশু সন্তানকে বুকে জড়িয়ে যশোর রোডে দাঁড়িয়ে আছে, শিশুটির মুখে ভয় এবং বিস্ময়, মায়ের চোখে মুখে একই সঙ্গে দুঃখ বেদনা হতাশা আর ক্রোধ। পিছনে আরো অসংখ্য মানুষ, বহু দূরে দেখা যাচ্ছে আগুনের লকলকে শিখা।

টুম্পা বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে বোর্ডের উপর ঝুঁকে পড়ে।

ঠিক কীভাবে তিন ঘণ্টা পার হয়েছে টুম্পা বলতে পারে না। যখন একজন এসে নরম গলায় বলল, মেয়ে, তোমার সময় শেষ তখন যেন সে চেতনা ফিরে পেলো! ছবিটি এখনো শেষ হয় নি–আহা, সে যদি আরো কিছুক্ষণ সময় পেতো!

টুম্পা যখন ছবি আঁকার সরঞ্জামগুলো তার ব্যাগের ভেতর ঢোকাচ্ছে তখন সে তাদের দলটিকে আবিষ্কার করলো। কয়েকজনের মাথায় বিচিত্র টুপি, মুখে রঙ মাখানো, কারো গলায় বিচিত্র মালা কিংবা হাতে কটকটে লালরঙের খেলনা। সবাই টুম্পার দিকে ছুটে এল, তাকে ঘিরে ধরে জিজ্ঞেস করল, কেমন হয়েছে? কেমন হয়েছে তোমার ছবি?

টুম্পা একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, শেষ করতে পারি নি।

জেসিকা চোখ কপালে তুলে বলল, তিন ঘণ্টাতেও শেষ করতে পার নি!

কী আঁকছিলে তুমি? পিকাসোর গুয়েনিকা?

টুম্পা হেসে ফেলল, বলল, না। গুয়েনিৰ্কা না! এমনিই একটা ছবি, আসলে সময়ের দিকে খেয়াল ছিল না।

জিম জানতে চাইলো, কেমন হয়েছে?

যেটুকু শেষ হয়েছে সেটুকু খারাপ হয় নাই।

মাইকেল জিজ্ঞেস করল, প্রাইজ পাবে?

টুম্পা মাথা নেড়ে বলল, মিসেস হেনরিকসন বলেছেন প্রাইজের জন্যে কখনো ছবি আঁকতে হয় না।

ড্যানিয়েল গলা নামিয়ে বলল, মাঝে মাঝে আঁকলে দোষ হবে না। ফাস্ট প্রাইজ দুই হাজার ডলার!

মাইকেল বলল, দু–ই–হা–জা–র! সর্বনাশ! এতো টাকা দিয়ে কী করবে? টুম্পা বলল,  যে সে টাকাটা পাবে, তাকে সেটা নিয়ে চিন্তা করতে দাও। আমার এখন খুব খিদে পেয়েছে। কিছু একটা খাব চল।

তখন সবাই একসাথে হৈ হৈ করে উঠল, বলল, চল যাই। চল। আমাদেরও খুব খিদে পেয়েছে। কাছেই একটা ম্যাকডোনাল্ড আছে।

খেয়ে দেয়ে তারা যখন ফিরে এসেছে তখন সব ছবিগুলো কনভেনশন সেন্টারের দেয়ালে টানিয়ে দেয়া হয়েছে, সবাই ঘুরে ঘুরে সেই ছবিগুলো দেখছে। বিচারকদের হাতে কাগজ নাকের ডগায় চশমা, তারা খুটিয়ে খুটিয়ে ছবিগুলো দেখছেন। তারা নিশ্চয়ই ছবির মাঝে অন্য কিছু একটা খোঁজে ন কারণ খুব সুন্দর করে আঁকা একটা ছবি পাশ কাটিয়ে সাদামাটা একটা ছবির সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বিড় বিড় করে নিজেদের মাঝে কথা বলেন। সবাই মিলে টুম্পার ছবিটা খুঁজে বের করল, জেসিকা চোখ বড় বড় করে বলল, বাহ্! কী চমৎকার।

জিম জিজ্ঞেস করল, তুমি যে বললে শেষ করো নি? কোথায়? এটা তো শেষ হয়েছে!

টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, না শেষ হয় নাই।

কোন জায়গাটা শেষ হয় নাই?

টুম্পা বলল, তুমি যদি দেখে বুঝতে না পার তাহলে আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না!

জিম ঘাড় ঝাঁকিয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে অন্য ছবিগুলো দেখতে চলে গেল।

ঠিক সময়মতো অনুষ্ঠানের শেষ পর্ব শুরু হয়েছে। আয়োজকদের একজন প্রথমে সবাইকে অভ্যর্থনা জানালেন। তারপর স্থানীয় একজন মহিলা শিল্পীকে একটা পদক দেওয়া হলো। পদকটি নিয়ে সেই মহিলা শিল্পী তার দুই একটি কথা বললেন, তারপরই পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়ে গেল। এ ক্যাটাগরিতে প্রথম হলো একটি কালো ছেলে, সে যখন পুরস্কার নিতে গেল তখন তাকে দেখে কারো সন্দেহ থাকে না যে সে বড় হয়ে একজন সত্যিকারের শিল্পী হবে মাথায় এলোমেলো চুল, ঢিলেঢালা বিবর্ণ টি সার্ট, ঢুলু ঢুলু চোখ! দ্বিতীয় হলো সোনালি চুলের ফুটফুটে একটি মেয়ে। তৃতীয় হলো দুজন, একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে, পুরস্কারটা কীভাবে দুজন ভাগ করে নেবে সেটা ঠিক করতে আয়োজকদের খানিকক্ষণ মাথা ঘামাতে হলো।

বি ক্যাটাগরির পুরস্কার ঘোষণার ঠিক আগে আগে টুম্পার বুকটা ধুকপুক করতে লাগলো। সে জানে এখানে যারা আজ ছবি আঁকতে এসেছে তারা সবাই খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পারে। কম্পিটিশন শেষ হবার পর টুম্পা ঘুরে ঘুরে ছবিগুলো দেখেছে, অনেকেই একেবারে অসাধারণ। মিসেস হেনরিকসন বলেছেন ছবি আঁকা হচ্ছে একটা সৃজনশীল কাজ, সৃজনশীল কাজে কোনো কম্পিটিশন হয় না। টুম্পা নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল, আজকেও কোনো কম্পিটিশন নেই, পুরস্কার পাওয়া বা না পাওয়াতে কিছু আসে যায় না। সবাই মিলে আনন্দ করেছে সেটাই সবচেয়ে বড় কথা। এতো সব কিছু জানার পরেও টুম্পার বুক ধুকপুক করতে লাগলো।

প্রথম পুরস্কারের নাম ঘোষণা করা হলো। একজন হিস্পানিক ছেলে, সে আনন্দে চিৎকার করতে করতে স্টেজে ছুটে যায়। মেডেলটা গলায় ঝুলিয়ে সে দুই হাজার ডলারের চেক ভরা খামটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে স্টেজে নাচতে থাকে তার আনন্দ প্রকাশের ভঙ্গীটা এতো আন্তরিক যে সবাই হাসতে হাসতে হাত তালি দিতে থাকে। এবারে দ্বিতীয় পুরস্কারের নাম ঘোষণা করা হবে। টুম্পার কাছে মনে হয় সবকিছু কেমন যেন থেমে গেছে। মানুষটি যেন খুব ধীরে ধীরে মাইক্রোফোনের সামনে এল, তার বাইরে ধীরে ধীরে হাতের কাগজটা খুলে নামটি দেখলো তারপর মাইক্রোফোনের সামনে মুখ এগিয়ে নিলো নামটি উচ্চারণ করার জন্যে। টুম্পার মনে হলো নামটি উচ্চারণ করতে গিয়ে মানুষটি যেন থেমে গিয়েছে, স্থির হয়ে গেছে অনন্তকালের মতো!

টুম্পা রায়হান! হঠাৎ করে টুম্পা তার নিজের নামটা শুনতে পায়, কয়েকমুহূর্ত লাগলো তার বুঝতে যে সত্যিই দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়ে গেছে। কোনোমতে সে উঠে দাঁড়ালো, তার চারপাশে যারা বসে আছে তারা লাফিয়ে চিৎকার করে কনভেনশন হলের ছাদ পর্যন্ত কাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

টুম্পা হেঁটে হেঁটে স্টেজে গেল, বয়স্ক একজন মানুষ তার গলায় মেডেল পরিয়ে দিলেন, দেড় হাজার ডলারের একটা চেক ধরিয়ে দিলেন আরেকজন। টুম্পা স্টেজ থেকে নিচে নেমে আসছিল, তখন কাগজপত্র হাতে একজন টুম্পার দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসলো, বলল, অসাধারণ ছবি! শেষ করার সময় পেলে না, আফসোস!

টুম্পা কী বলবে বুঝতে না পেরে একটু হাসার চেষ্টা করলো। মানুষটি আবার বলল, ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার হয়ে যেয়ো না যেন!

টুম্পা বলল, হব না!

মানুষটি হঠাৎ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ছবিটার নাম দিয়েছ যশোর রোড। যশোর রোড মানে কী?

উনিশশো একাত্তর সালে আমাদের দেশে যখন যুদ্ধ হচ্ছিল তখন যশোর রোড দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশ ছেড়ে গিয়েছিল। খুব সুন্দর একটা কবিতা আছে এর উপরে। এলেন গিনসবার্গের লেখা!

তাই নাকি! এলেন গিনসবার্গ আমারও খুব প্রিয় কবি। মানুষটি কাগজগুলো নিয়ে সরে যায়, টুম্পা তখন নিচে নিমে এল।

ক্লাশের সবাই তাকে ধরে জাপটাজাপটি করছে। জিম খামটা খুলে দেড় হাজার ডলারের চেকটা বের করে এনেছে! ড্যানিয়েল জিজ্ঞেস করল, ঠোম্পা!

তুমি কী করবে দেড় হাজার ডলার দিয়ে?

বাংলাদেশে যাবার জন্য প্লেনের টিকেট কিনব।কথাটা বলার আগের মুহূর্তেও টুম্পা জানতো না সে এই কথাটা বলবে। বলে ফেলার পর সে বুঝতে পারলো, অবশ্যই সে এই কথাটিই বলবে! তা না হলে কী বলবে সে?

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল