চঞ্চল তার দুই হাত তুলে বলল, “আমার হাতে কিছু দেখছিস?”

আমি ভালো করে লক্ষ করে বললাম, “হাতে আংটি পরেছিস? দুই হাতে দুইটা?”

চঞ্চল বলল, “দেখে তোর তাই মনে হচ্ছে?”

“হ্যাঁ।”

“ঠিক আছে। কাছে আয়।”

আমি কাছে গেলাম, তখন সে তার দুই হাত দিয়ে আমাকে ধরল আর সাথে। সাথে কী হল কে জানে ভয়ংকর একটা ইলেকট্রিক শক খেয়ে আমি ছিটকে পড়লাম। আমার মাথা ঠুকে গেল দেয়ালে আর আমি ভয়ে আতঙ্কে যন্ত্রণায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলাম।

চঞ্চল আমার অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে, আর সেটা দেখে আমার রেগে আগুন হয়ে যাবার কথা কিন্তু ইলেকট্রিক শক খেয়ে এতো অবাক হয়েছি যে আমি রাগতেও পারছিলাম না। আমি উঠে বসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলাম, “কীভাবে করলি?”

“ইনডাকশন কয়েল।”

“সেটা আবার কী?”

“একটা লোহার উপর কয়েল পেঁচিয়ে তৈরি করতে হয়। একটা ব্যাটারি হচ্ছে মাত্র দেড় ভোল্টের, সেটাকে বাড়িয়ে কয়েক হাজার ভোল্ট করে ফেলা যায়।”

আমি শুকনো মুখে বললাম, “সর্বনাশ!”

“সর্বনাশের কিছু নাই! ভোল্টেজ বেশি কিন্তু কারেন্ট খুবই কম। কোনো ক্ষতি হবে না।”

“কী আজব। আমি ইলেকট্রিক শক খাচ্ছি কিন্তু তুই খাচ্ছিস না কেন?”

চঞ্চল হা হা করে হাসল, বলল, “এই দেখ। আমার দুই হাতে দুইটা আংটি আসলে দুইটা ইলেকট্রন্ড। এই দ্যাখ পিছন দিকে তার লাগানো আছে, সেটা গেছে আমার পকেটে। পকেটে ইনডাকশন কয়েলটা রেখেছি। আংটি দুটির ভিতরের দিকে প্লাস্টিক লাগানো, তাই সেটা আমার শরীরকে ছুঁচ্ছে না, তাই আমাকে শক দিচ্ছে না। যখন তোকে ধরছি তোকে শক দিচ্ছে।”

“কী আশ্চর্য!”

“এটা হচ্ছে আমাদের ব্ল্যাক ড্রাগনের একটা অস্ত্র। আমরা এরকম অস্ত্র তৈরি করে সবাই একটা করে নিয়ে ঘুরব। কেউ আমাদেরকে কিছু করতে এলেই আমরা জ্যাপ করে ইলেকট্রিক শক দিয়ে দিব!”

“একটা তৈরি করতে কত খরচ হবে?”

“খুব বেশি না। টেলিভিশন সারিয়ে দিয়েছি তাই আব্বু কিছু টাকা দিয়েছে। দরকার হলে ফ্রিজটা নষ্ট করে রাখব। তখন আরো কিছু টাকা হবে।”

আমি মাথা নাড়ালাম, চঞ্চল ঠিকই বলেছে। এটা হবে একটা অসাধারণ অস্ত্র! ইনডাকশন কয়েলটা কেমন করে তৈরি করে যখন সেটা নিয়ে চঞ্চলের সাথে কথা বলছি তখন টিটন এসে হাজির হল। কী কারণ কে জানে আজকে তার মুখে বিচিত্র একটা হাসি। আমি টিটনকে বললাম, “চঞ্চল কী তৈরি করেছে দেখ!”

টিটন জিনিসটা দেখার জন্যে এগিয়ে গেল, চঞ্চল তার দুই হাত বাড়িয়ে দেয় আর আমি দেখতে পেলাম পরের মুহূর্তে বিশাল একটা ইলেকট্রিক শক খেয়ে টিটন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ছিটকে পড়েছে।

এবারে আমি আর চঞ্চল হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকি। টিটন প্রথমে অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর রেগে উঠে চিৎকার করে বলল, “আমাকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে মেরে ফেলতে চাইছিস? সেটা দেখে আবার দাঁত কেলিয়ে হাসছিস? ঘুষি মেরে তোদের নাক ভেঙে দেব।”

সেটা অবশ্যি খুব অস্বাভাবিক কিছু না, টিটন রেগে গেলে ঘুষি মেরে নাক ভেঙেও দিতে পারে, তাই আমরা হাসি থামিয়ে ফেললাম। বিজ্ঞানের এতো বড় আবিষ্কার নিয়ে টিটন কোনো কৌতূহল দেখাল না, রাগে গজগজ করতে লাগল। চঞ্চল আর আমি তখন তাকে বিষয়টা বোঝালাম আর তখন আস্তে আস্তে তার রাগটা একটু কমে এলো। শেষে তার মুখে আবার আগের সেই বিচিত্র হাসিটা ফুটে ওঠে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুই এরকম করে হাসছিস কেন?”

“কে বলছে আমি হাসছি?” তার মুখের হাসিটা আরো বড় হয়ে যায়, বলে, “আমি মোটেও হাসছি না!”

“এই যে হাসছিস?”

টিটন হাসি হাসি মুখ করে তার শার্টের হাতাটা একটু তুলে বলল, “এই দেখ।”

আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, সেখানে বিশাল একটা তাবিজ কালো সুতা দিয়ে বাঁধা। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কীসের তাবিজ?”

টিটন বলল, “ভূতের।”

“ভূতের তাবিজ?”

“শুধু ভূত না–জিন, পরী, প্রেতাত্মা কেউ এখন আর আমার ধারেকাছে আসতে পারবে না। এখন আর আমার মিশকাত মঞ্জিলে যেতে কোনো ভয় করবে না।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। আমি চাইলে একা একা যেতে পারব।”

চঞ্চল জিজ্ঞেস করল, “তুই কেমন করে জানিস এই তাবিজটা কাজ করে?”

টিটন বলল, “আমি জানি।”

“কেমন করে জানিস?”

টিটন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাবিজটা খুলে চঞ্চলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “তুই এটা হাতের মুঠোয় ধরে রাখ, দেখবি আস্তে আস্তে তাবিজটা গরম হয়ে উঠছে।”

চঞ্চল হাতের মুঠোয় ধরে রাখল, টিটন একটু পরে জিজ্ঞেস করল, “গরম হয়েছে? হয়েছে গরম?”

“বুঝতে পারছি না।”

“অবশ্যই বুঝতে পারবি। ধরে রাখ।”

চঞ্চল হাতের মুঠো খুলে বলল, “আসলে একটা থার্মোমিটার ধরে দেখতে হবে গরম হচ্ছে না কী।”

চঞ্চল বলল, “দেখ।”

চঞ্চল বলল, “তুই তাবিজটা রেখে যা। আমি সত্যি সত্যি পরীক্ষা করে দেখব। আমার হাতের তালুর তাপমাত্রা মাপতে হবে, তাবিজের তাপমাত্রা মাপতে হবে। গ্রাফে প্লট করতে হবে।”

টিটন বলল, “ঠিক আছে প্লট কর। কিন্তু সাবধান”

“কী?”

“নাপাক অবস্থায় তাবিজটা ধরবি না।”

চঞ্চল বলল, “ঠিক আছে। ধরব না।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুই কোথায় পেয়েছিস এই তাবিজ?”

 টিটন চোখ বড় বড় করে বলল, “তোর লাগবে?”

“না, লাগবে না। আমি শুধু জানতে চাইছি কোথায় পেয়েছিস?”

“রাস্তার ধারে একজন তোক বিক্রি করছে। মহা কামেল মানুষ। সবকিছুর জন্যে তাবিজ আছে। ভূত, জিন থেকে শুরু করে বিয়ে-শাদি, বিছানায় পিশাব, ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি জিপিএ ফাইভের জন্যেও তাবিজ আছে।”

“কত করে দাম?”

“অষ্ট ধাতুর তাবিজটা সবচেয়ে ভালো, কিন্তু সেটার অনেক দাম। আমি সস্তারটা কিনেছি। ছোট বলে আমাকে অর্ধেক দামে দিয়েছে। মাত্র বিশ টাকা!”

আমি আর চঞ্চল একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম, শুধু টিটনের পক্ষেই এরকম জিনিস বিশ্বাস করা সম্ভব।

টিটন আমাদেরকে জিজ্ঞেস করল, “আমরা মিশকাত মঞ্জিল কখন যাব?”

“আয় সবাই মিলে ঠিক করি।”

“এখন?”

“উঁহু।” চঞ্চল মাথা নাড়ল, বলল, “এখন না। এইবার গেলে আমরা দেয়ালটা ভেঙে ভিতরে ঢুকব। সেই জন্যে আমাদের সবকিছু নিয়ে রেডি হয়ে যেতে হবে।”

“সবকিছু কী কী নিতে হবে?

“এই মনে কর শাবল, হাতুড়ি, টর্চ লাইট, দড়ি, ম্যাচ, মোমবাতি, ব্যাটারি, তার, ম্যাগনিফাইং গ্লাস, কম্পাস, কাগজ, কলম, মেজারিং টেপ, টুল বক্স, করাত, ক্যামেরা, মোবাইল ফোন–”

টিটন অবাক হয়ে বলল, “এতো কিছু কেন?”

“ভিতরে কী আছে তা তো আমরা জানি না। কখন কোনটা দরকার লাগবে কে বলতে পারে? সেই জন্যে সবকিছু নিয়ে যেতে হবে।”

“ও।” টিটন সবকিছু বুঝে ফেলেছে এরকম ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল।

আমি বললাম, “আয় আগে একটা বড় লিস্ট করি তারপর লিস্টটা ভাগাভাগি করে আমরা চারজনকে দিয়ে দিই। সবাই মিলে জিনিসগুলো রেডি করব।”

চঞ্চল মাথা নেড়ে লিস্ট তৈরি করতে লেগে গেল।

প্রথম লিস্টটা হল অনেক বড়। সেই লিস্টের সবকিছু নিতে হলে আমাদের আস্ত একটা ট্রাক লেগে যাবে। তাই প্রথম লিস্টটা কাটছাট করে দ্বিতীয় লিস্টটা করা হল। দেখা গেল তার সবকিছু নিতে হলে একটা টেম্পো লাগবে। তখন সেই লিস্টটা আরো কাটছাট করা হল আর তখন সেটা দেখে মনে হল এবারে সবকিছু আমরা মোটামুটি নিজেরাই আমাদের ব্যাকপেকে করে নিয়ে যেতে পারব। তখন আমরা লিস্টটা ভাগাভাগি করে ঠিক করে নিলাম কে কোনটা জোগাড় করবে। অনু এখনো আসেনি তাই সবচেয়ে কঠিন কঠিন জিনিসগুলো জোগাড় করার দায়িত্বটা দিলাম তার ঘাড়ে।

চঞ্চল তার বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত। মিশকাত মঞ্জিলের ভেতরে ঢোকার জন্যে আরো কী কী যন্ত্রপাতি তৈরি করতে হবে, সে সেগুলো তৈরি করছে। তাই আমি আর টিটন বের হলাম অনুর লিস্টটা নিয়ে, সেইটা অনুর কাছে পৌঁছে দেব।

টুনিদের বাসার সামনে দিয়ে যখন মাঠটা পার হচ্ছি তখন দেখতে পেলাম টুনি আর মিথিলা বাসার সামনে নাচ প্র্যাকটিস করছে, তবে এমনিতে মেয়েরা যে রকম করে নাচে সে রকম নাচ না–অন্য রকম নাচ। আমাদের দেখে তারা থেমে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী করছিস?”

টুনি বলল, “কিছু না।”

মিথিলা বলল, “আপু আমাকে কারাটে শিখাচ্ছে।”

টিটন চোখ কপালে তুলে বলল, “তুমি কারাটে জান না কি?”

“এই একটু একটু। ঢাকায় শিখতাম।”

আমি বললাম, “আমাদের দেখাবে?”

“এটা তো দেখানোর জিনিস না। কোনো একদিন যদি আমাকে পিটিয়ে তক্তা বানাতে চাও তা হলে হয়তো একটু ব্যবহার করা যাবে।”

আমার মনে পড়ল, প্রথম দিন টিটন টুনিকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ফেলবে বলে ভয় দেখিয়েছিল, মনে হচ্ছে টুনি সেটা ভোলেনি।

মিথিলা বলল, “টুনি আপু আসলে ব্ল্যাক–”

টুনি মিথিলাকে কথাটা শেষ করতে দিল না, থামিয়ে দিয়ে বলল, “ব্ল্যাক ড্রাগন।“

“হ্যাঁ, ব্ল্যাক ড্রাগন।” মিথিলা মাথা নাড়ল, “ব্ল্যাক ড্রাগন।”

টুনি বলল, “তোরা কী ঠিক করেছিস আমাদের দলে আসবি কি আসবি না?”

টিটন মুখ শক্ত করে বলল, “এর মাঝে ঠিক করার কিছু নাই। তোরা আমাদের ব্ল্যাক ড্রাগন দলটা হাইজ্যাক করে নেওয়ার চেষ্টা করছিস! তোদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করা দরকার। হাইকোর্টে কেস করা দরকার।”

টুনি বলল, “হাইকোর্টে কেস করতে হবে না। আয় অ্য একটা কাজ করি।”

“কী কাজ?”

“ব্ল্যাক ড্রাগন নামটা আমার আর মিথিলার। তোরা চারজন ব্ল্যাক ড্রাগনের বাংলা নামটা নে।”

আমি রেগে গিয়ে বললাম, “কী বললি? বাংলা নাম?”

“হ্যাঁ।” টুনি হাসি হাসি মুখ করে বলল, “ব্ল্যাক এর বাংলা হচ্ছে কালা আর ড্রাগনের বাংলা যেন কী হবে?”

টিটনটা গাধার মতো বলল, “গুইসাপ।”

আমি ধমক দিয়ে বললাম, “মোটেও গুইসাপ না।কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। মিথিলা হাততালি দিয়ে বলতে লাগল, “কালা গুইসাপ! কালা গুইসাপ!!”

টুনি হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, “তোদের জন্যে একেবারে ঠিক নাম। তোরা চারজন গুইসাপের মতো মুখ ভোঁতা করে মাটির সাথে গড়িয়ে গড়িয়ে আস্তে আস্তে যাবি। আর আমরা যাব ড্রাগনের মতো।”

আমি রেগে গিয়ে বললাম, “খবরদার, আমাদের কালা গুইসাপ বলবি না।”

টুনি বলল, “আমরা তো বলতে চাই না। আমরা তো সবাই মিলেই ব্ল্যাক ড্রাগন করতে চাই। তোরাই তো রাজি হচ্ছিস না।”

টিটন বলল, “কক্ষনো রাজি হব না।”

আমিও বললাম, “কক্ষনো রাজি হব না।”

টুনি বলল, “ঠিক আছে তা হলে।”

মিথিলা বলল, “কালা গুইসাপ! কালা গুইসাপ!!”

চোখ দিয়ে আগুন বের করে কাউকে পুড়িয়ে মারা সম্ভব হলে মিথিলা তখনই পুড়ে ছাই হয়ে যেতো।

.

অনুদের বাসায় পৌঁছানোর পরেও আমি আর টিটন রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলাম। অনুর আম্মু যখন আমাদের খাবার জন্যে কিছু ভালো ভালো নাস্তা দিলেন সেগুলো খেয়ে শেষ পর্যন্ত আমাদের মেজাজটা একটু ঠাণ্ডা হল। পৃথিবীর সব মেয়েরা যদি অনুর আম্মুর মতো এরকম ভালো হত তা হলেই তো পৃথিবীতে কোনো সমস্যা থাকত না। কেউ কেউ মিথিলার মতো, টুনির মতো বের হয়ে যায় সে জন্যেই তো এতো সমস্যা!

.

রাত্রিবেলা বাসায় আমরা খেতে বসেছি তখন মিথিলা আল্লুকে জিজ্ঞেস করল, “আব্বু ড্রাগন বাংলা কী?”

আব্বু বললেন, “ড্রাগন তো একটা কাল্পনিক প্রাণী, তার বাংলা নাম আছে। বলে মনে হয় না।”

“গুইসাপ ড্রাগনের বাংলা হয় না?”

“করলেই হয়। তবে গুইসাপ হচ্ছে এক ধরনের সরীসৃপ। রেপটাইল।” আব্বু খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন? হঠাৎ করে ড্রাগনের দরকার হল কেন?”

মিথিলা মুচকি মুচকি শয়তানী হাসি দিতে দিতে বলল, “এমনি।”

আব্বু তখন খেতে খেতে আম্মুর সাথে কথা বলতে লাগলেন, জিনিসপত্রের দাম নিয়ে কথা বললেন, রাজনীতি নিয়ে কথা বললেন, দুর্নীতি নিয়ে কথা বললেন, অসুখ-বিসুখ নিয়ে কথা বললেন, শুনতে শুনতে একটু পরেই আমি অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। হঠাৎ করে”মিশকাত মঞ্জিল” কথাটা শুনে আমি সোজা হয়ে বসি। শুনলাম, আবু বলছেন, “মিশকাত মঞ্জিল নিয়ে অনেক দিন ধরে মামলা চলছিল মনে আছে? মামলার রায় হয়েছে।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “মিশকাত মঞ্জিল নিয়ে কে মামলা করেছিল?”

“মিশকাত খানের নাতি-পুতিরা।”

“এখন কী হবে?”

“যারা মামলায় জিতেছে, তারা এসে দখল নেবে।”

“দখল নিয়ে কী করবে?”

“শুনেছি পুরোটা ভেঙে ফেলবে। ভেঙে সেখানে মার্কেট বানাবে।”

“কখন ভাঙবে?”

“সেটা তো জানি না।”

মিথিলা মুচকি মুচকি শয়তানী হাসি দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া, তুমি মিশকাত মঞ্জিল নিয়ে এতো কিছু জানতে চাও কেন?” “আমার ইচ্ছা। তোর কী?”

“আমার কিছু না। কিন্তু এই রকম একটা ভূতের বাড়ি সেই জন্যে জিজ্ঞেস করছি।”

“ভূতের বাড়ি হয়েছে তো কী হয়েছে?”

“না কিছু হয় নাই।” মিথিলা আবার মুচকি মুচকি শয়তানী হাসি হাসতে থাকে। আমার কেন জানি সন্দেহ হয় যে মিথিলা মনে হয় জেনে গেছে আমরা মিশকাত মঞ্জিলে ঢুকব। কিন্তু কেমন করে জানল?

আমি বুঝতে পারলাম আমাদের খুব তাড়াতাড়ি মিশকাত মঞ্জিলের অভিযানটা করে ফেলতে হবে তা না হলে বিশাল ঝামেলা হয়ে যাবে। অ্যাডভেঞ্চার করার আগেই যদি মিশকাত মঞ্জিলটা ভেঙে ফেলে তখন কী হবে?

.

০৬.

পরদিন খুব সকালবেলা পেয়ারা গাছের উপরে আমাদের একটা জরুরি সভা বসেছে। সবাই হাজির হওয়ার পর আমি গম্ভীর গলায় বললাম, “আব্বু বলেছেন মিশকাত মঞ্জিল নিয়ে মামলা চলছিল, এখন কোর্টের রায় হয়েছে।”

চঞ্চল জিজ্ঞেস করল, “কোর্টের রায় হলে কী হয়?”

“যারা মামলায় জিতেছে তারা এসে এখন মিশকাত মঞ্জিল ভেঙে ফেলবে। সেখানে মার্কেট বানাবে।”

অনু বলল, “মার্কেট? ছিঃ!”

চঞ্চল বলল, “মার্কেট বানালে আমাদের কী?”

“আমাদের কিছু না। কিন্তু মিশকাত মঞ্জিলটা ভেঙে ফেললে আমরা তো আর তার ভিতরে ঢুকতে পারব না! তাই আমাদের আগেই সেখানে ঢুকতে হবে।”

টিটন হাত নেড়ে বলল, “ইয়েস! তাবিজ লাগানোর পর আর আমার ভয় করছে না। চল আমরা এখনই যাই।”

চঞ্চল বলল, “যাওয়ার আগে আমাদের দেখতে হবে লিস্টের সবকিছু আছে কী না।”

আমি বললাম, “কালকে সবাইকে আমি লিস্ট দিয়েছি। সবাই কি তোদের লিস্টের জিনিসগুলো জোগাড় করেছিস?”

অনু মাথা চুলকে বলল, “আমার লিস্টটা খুবই কঠিন। এখনো সবকিছু জোগাড় হয়নি।”

“কী কী জোগাড় হয়নি?”

“যেমন মনে কর কবুতর—”

টিটন বলল, “আমরা কবুতর দিয়ে কী করব?”

চঞ্চল বলল, “বিজ্ঞানী হতে হলে প্রথমেই কী শিখতে হয় বল।”

টিটন বলল, “অঙ্ক মুখস্থ করা।”

চঞ্চল বলল, “না। প্রথমে শিখতে হয় সেফটি। যেন কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়। কেউ ব্যথা না পায়। ইলেকট্রিক শক না খায়। গ্যাস দিয়ে নিশ্বাস বন্ধ হয়।“

“মিথ্যা কথা বলবি না।” টিটন গর্জন করে বলল, “আমাকে তুই কাল ইলেকট্রিক শক দিয়েছিলি। আমি অনেক ব্যথা পেয়েছিলাম।”

“সেটা দিয়েছিলাম মজা করার জন্যে।”

“মজা করলে কি মানুষ ব্যথা পায় না?”

অনু বলল, “ঠিক আছে ঠিক আছে! যেটা জিজ্ঞেস করেছিস তার উত্তর আগে শুনি। কবুতর কেন?”

হলে আমি মাথা নাড়ল, বলল বুঝব অক্সিজেন আহত জ্বালিয়ে নামিয়ে রে

চঞ্চল বলল, “মিশকাত মঞ্জিলের গোপন কুঠুরির ভিতরে আমরা কী দেখেছিলাম মনে আছে? একটা সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে।”

আমরা মাথা নাড়লাম, “হ্যাঁ।”

“আমাদের সেই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে হবে। তার মানে বুঝতে পেরেছিস?”

“কী?”

“নিচে বছরের পর বছর কেউ যায় নাই। হয়তো সেখানে বিষাক্ত গ্যাস জমা হয়ে আছে। আমরা নামতেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাব। সেই জন্যে যদি খাঁচায় ভরে একটি কবুতর সেখানে নামিয়ে দিয়ে দেখি সেটা মারা যাচ্ছে না তা হলে বুঝতে পারব সেখানে বিষাক্ত গ্যাস নাই।”

আমরা চঞ্চলের বুদ্ধি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আমি একটু চিন্তা করে বললাম, “কিন্তু কবুতর না পাঠিয়ে যদি একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে নামিয়ে দেই, সেটা যদি জ্বলতে থাকে তা হলে বুঝব অক্সিজেন আছে, নিশ্বাস নিতে পারব।”

চঞ্চল মাথা নাড়ল, বলল, “না। অনেক সময় মিথেন গ্যাস জমা হয়। তা হলে আগুন জ্বালালেই ভয়ংকর বিস্ফোরণ হয়ে সারা মিশকাত মঞ্জিল উড়ে যাবে। সাথে সাথে আমরাও। কাজেই আগে কবুতর।”

টিটন বলল, “তোদের বাসায় তো কবুতর আছে। তুই একটা ধরিস না কেন?”

অনু বলল, “কবুতর রাত্রে ধরে রাখতে হয়। দিনের বেলায় সব উড়ে চলে যায়। এখন আর ধরা যাবে না।”

টিটন বলল, “ঠিক আছে। আজ রাত্রে ধরে রাখবি।”

অনু মাথা নাড়ল, “রাখব। ধরে রাখব।”

আমি বললাম, “তা হলে কাল ভোরে মিশকাত মঞ্জিল অভিযান।”

সবাই মাথা নাড়ল।

”আজকে সবাই লিস্ট ধরে সবকিছু জোগাড় করবি।”

সবাই আবার মাথা নাড়ল।

”কাউকে কেউ কিছু বলতে পারবি না।”

সবাই আবার আরো জোরে মাথা নাড়ল।

চঞ্চল বলল, “আয় আমরা এখন মিশকাত মঞ্জিলটা একটু দেখে আসি।”

টিটনের চোখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, “কী দেখবি?”

“বাইরে থেকে ঘুরে দেখে আসি বিল্ডিংটা কতো বড়, কোনদিকে কতটুকু। আমরা যখন ভিতরে ঢুকব তখন যেন আন্দাজ থাকে কোথায়, কোনদিকে আছি।”

আমরা তখন গাছ থেকে নেমে মিশকাত মঞ্জিলের দিকে হেঁটে যেতে থাকি। কাছাকাছি পৌঁছে এদিক-সেদিক তাকালাম, যখন দেখলাম আশেপাশে কেউ নেই, কেউ আমাদের দেখছে না, তখন আমরা শুট করে গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলাম। সকালবেলা বলেই হয়তো অনেক পাখি কিচিরমিচির করছে। আমরা মিশকাত মঞ্জিলটা ভালো করে দেখলাম, চঞ্চল একটু মাপজোক করল, টিটন বুক ফুলিয়ে বলতে লাগল সে আর ভূতকে ভয় পায় না। আমরা চাইলে সে এখন একাই ভিতরে ঢুকে যেতে পারে!

খানিকক্ষণ বিল্ডিংয়ের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে আমরা যখন বের হয়ে আসছি তখন দেখলাম গেটের কাছে একটা মোটর সাইকেল দাঁড় করানো সেখানে পাহাড়ের মতো বড় একজন মানুষ বসে আছে। মানুষটার ওজনে মোটর সাইকেলের চাকা যে ফেটে যাচ্ছে না, সেটাই আশ্চর্য। আরেকজন শুটকো মানুষ সেই একই মোটর সাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একটা কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছে। মানুষগুলোর চেহারার মাঝে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গির মাঝে এমন একটা কিছু আছে যেটা দেখে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। দেখেই বোঝা যায় মানুষগুলো ভালো না।

যে মানুষটা কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছিল সে দাঁত খোঁচানো বন্ধ করে আমাদের দিকে তাকালো, তারপর পিচিক করে রাস্তায় থুতু ফেলে বলল, “এই যে খোকারা।”

আমরা মোটেও খোকা না, আমাদেরকে কেউ খোকা বলবে সেটা মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু সেটা নিয়ে তর্ক করা যায় না, তাই তর্ক না করে আমরা দাঁড়ালাম। অনু বলল, “আমাদেরকে বলছেন?”

শুটকো মানুষটা হাসার ভঙ্গি করে বলল, “এইখানে তোমরা ছাড়া আর কে আছে? আর কাকে বলব?”

কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচানোর জন্যেই হোক আর অন্য কোনো কারণেই হোক মানুষটার দাঁতগুলোর মাঝে অনেক বড় ফাঁক। তার মাঝে দিয়ে জিবটাকে দেখা যায়–জিবের মাঝে কালো কালো ফুটকি, এরকম আমি আগে কখনো দেখিনি। মানুষটা তার ফুটকি ফুটকি জিব বের করে সেটা দিয়ে তার ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিয়ে বলল, “তোমরা এইখানে কেন ঢুকেছ?”

টিটন বলল, “ঢুকলে কী হয়?”

“এইখানে তো কেউ ঢুকে না, তাই জানতে চাচ্ছি। মানুষজন ভয় পায়। তোমরা তো পোলাপান মানুষ, তোমরা কেন ভয় পাও না?”

“মানুষজন কী ভয় পায়?”

“এই তো ভূত-প্রেত!”

টিটন তার শার্টের হাতা তুলে তার বিশাল তাবিজটা দেখিয়ে বলল, “এই যে আমার এই তাবিজটা আছে। ভূত আমার ধারেকাছে আসে না।”

“অ।” মানুষটা আবার কাঠি দিয়ে তার দাঁত খোঁচাতে শুরু করে, দেখে মনে হয় আমাদের সাথে তার কথা বুঝি ফুরিয়ে গেছে। আমরা যেই হাঁটতে শুরু করেছি তখন সে আবার থামাল, “কিন্তু তোমরা তো আমাকে বললে না কেন এইখানে ঢুকেছ।”

আমি একটু অস্বস্তি বোধ করতে থাকি। এই মানুষটি কেন বারবার আমাদের জিজ্ঞেস করছে আমরা কেন ভিতরে ঢুকেছি? মানুষটাকে বিশ্বাস করানোর মতো উত্তর পাওয়া কঠিন। আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই অনু মুখ খুলল, বলল, “ব্যাঙের ছাতা খুঁজতে।”

“কীসের ছাতা?”

“ব্যাঙের ছাতা।”

“ব্যাঙের ছাতা? কেন?”

“আমাদের বিজ্ঞান স্যার আমাদেরকে একটা সায়েন্স প্রজেক্ট দিয়েছেন। ব্যাঙের ছাতার উপর। সেই জন্যে আমাদের ব্যাঙের ছাতা দরকার। কয়দিন থেকে আমরা সব জায়গায় ব্যাঙের ছাতা খুঁজছি। শেষ পর্যন্ত এইখানে পেয়েছি।”

“অ।” মানুষটা আবার তার দাঁত খোঁচাতে থাকে।

“ব্যাঙের ছাতা আসলে এক ধরনের ফাংগাস!” এবারে চঞ্চল যোগ দিল, “আমাদের দেশে অনেক রকম ব্যাঙের ছাতা আছে। অনেক ব্যাঙের ছাতা খাওয়া যায়, যেরকম মাশরুম। সেগুলো চাষও করে। ব্যাঙের ছাতা হওয়ার জন্যে দরকার একটু অন্ধকার, একটু সঁাতসেঁতে জায়গা। অনেক ব্যাঙের ছাতা আছে। খুব বিষাক্ত, কেউ যদি একটু খায় তা হলেই মরে যাবে। অনেক ব্যাঙের ছাতা আছে যেগুলো খেলে মারা যাবে না, কিন্তু নেশা হবে। সেই জন্যে ব্যাঙের ছাতা চেনা দরকার। আমরা সেই জন্যে ব্যাঙের ছাতা নিয়ে গবেষণা করব…”

মোটর সাইকেলের সামনে পাহাড়ের মতোন যে মানুষটা বসে ছিল সে মনে . হয় চঞ্চলের বক্তৃতা শুনে বিরক্ত হয়ে গেল। সে বলল, “আবে মাইনকা। এই প্যাচাল শুনে লাভ নাই। আয় যাই।”

মানুষটি যে রকম মোটা তার গলার স্বর ঠিক সে রকম। শুধু মোটা না তার শরীরটা পাহাড়ের মতো, টাইট একটা টি-শার্ট পরেছে আর সেই টি-শার্টের ভিতর দিয়ে তার শরীরটা বোঝা যাচ্ছে। মনে হয় তার শরীরে মাংশপেশী জীবন্ত প্রাণীর মতো কিলবিল কিলবিল করছে। সে যদি হাত দিয়ে একটা ঝটকা দেয় তা হলে মনে হয় আমরা চারজন চারদিকে ছিটকে পড়ব।

মানুষটা তার গমগমে গলায় বলল, “এই মাইনকা, ওঠ, আয় যাই।”

“চল ওস্তাদ।” বলে মাইনকা, যার আসল নাম মনে হয় মানিক মোটর সাইকেলের পিছনে উঠল। পাহাড়ের মতো মানুষটা মোটর সাইকেল স্টার্ট করে চঞ্চলের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই ছেলে, শোন।”

চঞ্চল বলল, “কী হল?”

“কথা কম বলবা। বুঝেছ? কথা বেশি বললে মানুষ বিরক্ত হয়। আর মানুষ বিরক্ত হলে একদিন তোমারে ধরে পাটকান দিয়ে ফেলে দিবে। বুঝেছ?”

চঞ্চল বলল, “পাটকান মানে কী?”

“জিজ্ঞেস কর না। তা হলে যদি দেখায়া দেই তা হলে তোমার খবর হয়ে যাবে। যাও, বাড়ি যাও!” বলে মানুষটা একটা ধমকের ভঙ্গি করল।

লোক দুইজন মোটর সাইকেল চালিয়ে চলে যাবার পর চঞ্চল বলল, “দুইটা মানুষকে ইনডাকশন কয়েল দিয়ে ইলেকট্রিক শক দেওয়া দরকার। কত বড় বেয়াদপ।”

বেয়াদপ মানুষ দুইটা নিয়ে কথা বলতে বলতে আমরা ফিরে আসতে লাগলাম। বাসার কাছাকাছি এসে দেখি পেয়ারা গাছে টুনি আর মিথিলা পা ঝুলিয়ে বসে আছে। এর আগে মিথিলাকে কোনোদিন গাছে উঠতে দেখিনি, আজই প্রথম। টুনির সাথে থেকে থেকে তার অনেক উন্নতি হয়েছে মনে হয়। আমি বললাম, “মিথিলা, গাছে উঠেছিস?”

“হ্যাঁ।”

“পড়ে ঠ্যাং ভাঙলে বুঝবি মজা।”

“ভাঙলে ভাঙবে।”

টুনি বলল, “আসলে এখানে ব্ল্যাক ড্রাগনের জরুরি মিটিং হচ্ছে।”

আমরা বললাম”অ।”

শুধু যে আমাদের নাম ব্ল্যাক ড্রাগন দখল করে আছে তা না, আমাদের পেয়ারা গাছটাও দখল করে নিয়েছে। আমরা তাই হেঁটে হেঁটে চঞ্চলের বাসার দিকে যেতে থাকি। পিছন থেকে মিথিলা বলল, “কালা গুইসাপ! কালা গুইসাপ!!”

কথাটা শুনে চঞ্চলের কোনো ভাবান্তর হল না, অনু হেসে ফেলল, তার করা অনুবাদটা ব্যবহার হচ্ছে সেই আনন্দেই মনে হয়, টিটন একটা গর্জন করল আর আমার মনে হল মিথিলাকে আমি নিশ্চয়ই একদিন খুন করে ফেলব। পত্রিকায় খবর বের হবে, ‘মর্মান্তিক : বড় ভাইয়ের হাতে ছোট বোনের মৃত্যু।‘ শুধু আসল খবরটা কেউ জানতে পারবে না।

.

আমাদের বাকি দিনটা কেটে গেল পরের দিনের অভিযানের প্রস্তুতি নিতে নিতে। লিস্টটা বিশাল, সব মিলিয়ে তেপ্পান্নটা আইটেম। সবচেয়ে বড় আইটেম হচ্ছে শাবল আর সবচেয়ে ছোট হচ্ছে টুথপিক। চঞ্চল লিস্টের পাশে তারকা চিহ্ন দিয়েছে, কোনো কোনোটা তিন তারকা যার অর্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ–যেমন শাবল, হাতুড়ি, চাকু, দড়ি, টর্চ লাইট, ম্যাচ, মোমবাতি, কবুতর এইগুলো। কোনো কোনোটা তারকা চিহ্নবিহীন যার অর্থ কম গুরুত্বপূর্ণ। যেমন : কমিক বই, এফ এম রেডিও, এনার্জি সেভিং বাল্ব, আঠা আর রাবার ব্যান্ড। এগুলো কেন তালিকায় আছে আমরা সেটাই বুঝতে পারলাম না! চঞ্চলকে কিছু বলিনি কিন্তু শুরুতেই আমরা এগুলো বাদ দিয়ে দিয়েছি।

চঞ্চলের ল্যাবরেটরিতে বসে আমরা লিস্টটা দেখে একটা জিনিস আবিষ্কার করলাম, কাল ভোরে যখন আমরা এগুলো নিয়ে রওনা দিব তখন সবাই চোখ কপালে তুলে বলবে, তোরা এই বাক্স-প্যাটরা নিয়ে কোথায় রওনা দিয়েছিস? সবচেয়ে ঝামেলা হবে শাবলটা নিয়ে, ভারী একটা শাবল ঘাড়ে নিয়ে টেনে টেনে যাচ্ছি দৃশ্যটাই কাউকে বোঝানো যাবে না।

আমি বললাম, “কাল সকালের জন্যে না রেখে শাবলটা আজকেই মিশকাত মঞ্জিলে রেখে আসি।”

অনু মাথা নাড়ল, বলল, “গুড আইডিয়া।”

“যদি কেউ জিজ্ঞেস করে শাবল নিয়ে কই যাচ্ছি, আমরা কী বলব?”

টিটন বলল, “আমরা কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ ভেংচে দেব। আমাদের কী ঠ্যাকা পড়েছে যে সবার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে?”

আমাদের বাসা থেকে মরচেধরা শাবলটা নিয়ে যখন বের হয়েছি তখন মিথিলা জানতে চাইল, “ভাইয়া, শাবল নিয়ে কই যাও।”

আমি উত্তর না দিয়ে মুখ ভেংচে দিলাম, তখন মিথিলা নাকি সুরে আম্মুকে নালিশ করতে লাগল, “আম্মু ভাইয়া আমাকে মুখ ভাংচায়।”

আম্মু চলে আসার আগে আমি বের হয়ে গেলাম। ভারী শাবলটা নিয়ে যখন আমরা রাস্তা ধরে যাচ্ছি তখন অনেকেই সন্দেহের চোখে তাকাল কিন্তু কেউ কিছু প্রশ্ন করল না। মিশকাত মঞ্জিলের কাছে গিয়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ে যখন ভিতরে ঢুকে গেছি তখন চমকে উঠে আবিষ্কার করলাম সেখানে ফুটকি জিব মানিক আর তার পাহাড়ের মতো ওস্তাদ দাঁড়িয়ে আছে। শুধু যে আমরা চমকে উঠলাম তা নয়, তারাও আমাদের দেখে চমকে উঠল। ফুটকি জিব মানিক জিজ্ঞেস করল, “তোমরা এখানে কী কর?”

এক সেকেন্ড দেরি না করে চঞ্চল বলল, “ব্যাঙের ছাতা তুলে নিতে এসেছি।”

ছোট একটা ব্যাঙের ছাতা তুলতে এতো বড় একটা শাবল লাগে কী না তারা ইচ্ছা করলেই সেই প্রশ্নটা করতে পারত, কিন্তু করল না। এবারে আমি একটা সাহসের কাজ করে ফেললাম, জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারা এখানে কী করছেন?”

আমি ভেবেছিলাম লোকগুলো ধমক দিয়ে বলবে, “তোমার সেটা জানার দরকার কী?” কিন্তু তা না করে তারা কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল, ফুটকি জিব বলল, “না, মানে ইয়ে আমরা তো রিয়েল স্টেটে কাজ করি, সেই জন্যে মানেইয়ে”

পাহাড়ের মতো মানুষটা তখন ধমক দিয়ে বলল, “আবে মাইনকা। প্যাচাল পারিস না। আয় যাই।”

মানিক বলল, “চলেন।” তারপর দুইজন বের হয়ে গেল। অনু বলল, “খুবই সন্দেহের ব্যাপার।”

আমি বললাম, “মনে নাই, আব্বু বলেছিলেন মিশকাত মঞ্জিল নিয়ে মামলা হয়েছে। এরা মনে হয় হারু পার্টি। মামলায় হেরে গিয়ে এখন কেমন করে দখল করবে সেটা চিন্তা করছে।”

চঞ্চল মাথা নাড়ল, বলল, “মনে হয় তাই হবে।”

টিটন বলল, “যারা মামলা করতে চায় করুক, আমরা আমাদের কাজ করি।”

“হ্যাঁ। আমরা আমাদের কাজ করি।”

“এই শাবলটা কোথায় লুকিয়ে রেখে যাবি?”

“দোতলার সেই ঘরটাতে রেখে এলেই হয়।”

টিটন বলল, “দে। রেখে আসি। তোরা অপেক্ষা কর।”

“তোর ভয় করবে না তো?”

টিটন দাঁত বের করে হাসল, “ধুর! ভয় করবে কেন?” তার বিশাল তাবিজটা দেখিয়ে বলল, “এই তাবিজ আছে না আমার?”

ভারী শাবলটা ঘাড়ে নিয়ে টিটন মিশকাত মঞ্জিলের ভিতরে ঢুকে যায়। চঞ্চল আমাকে আর অনুকে ডেকে বলল, “একটা জিনিস তোদের বলি। কাউকে বলবি না তো?”

“বলব না।”

“খোদার কসম?”

“খোদার কসম।”

“মনে আছে, টিটন আমাকে তার তাবিজটা দিয়ে গিয়েছিল, ধরে রাখলে গরম হয় সেটা পরীক্ষা করার জন্যে?”

আমি মাথা নাড়লাম, “মনে আছে।”

চঞ্চল বলল, “তাবিজটা মোম দিয়ে বন্ধ করা। গরম করে মোম গলিয়ে আমি ভিতরের সবকিছু বের করেছিলাম।”

“তাই না কি? কী আছে ভিতরে?”

“ছোট একটা কাগজে হাবিজাবি লেখা। আমি কী করেছি জানিস?”

“কী করেছিস?”

“হাবিজাবি কাগজটা ফেলে নতুন একটা কাগজ ঢুকিয়ে মোম দিয়ে ভরাট করে দিয়েছি।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। কাগজটাতে কী লেখা জানিস?”

“কী?”

“আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র, ই ইকুয়েলস টু এম সি স্কয়ার।”

আমি আর অনু হি হি করে হাসলাম। অনু বলল, “তোর বৈজ্ঞানিক তাবিজ আগের থেকে ভালো কাজ করছে!”

“হ্যাঁ। টিটনটা যে কী বোকা।”

আমরা দেখলাম আমাদের টিটন শাবলটা রেখে মিশকাত মঞ্জিল থেকে বের হয়ে আসছে তাই তাবিজ নিয়ে আলোচনাটা থামিয়ে দিলাম। টিটন এসে বলল, “কী অসাধারণ তাবিজ! এখন আর একটুও ভয় করে না।”

আমরাও মাথা নাড়লাম, বললাম, “অসাধারণ!”

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল