দীপু তারিককে সব খুলে বলেছে। সব শুনে তারিক একটু ঘাবড়ে গেল। ওরা গুপ্তধন বের করে ফেলার আগেই যদি বড় বড় লোকেরা তাদের কালাচিতা নিয়ে নেয়, তা হলে তো খুব দুঃখের কথা হবে। আবার এও সত্যি কথা যে, জায়গাটা যদি সত্যিই এত গুরুত্বপূর্ণ তা হলে তো ওদের জানিয়ে দেয়াই উচিত। কী করতে হবে বুঝতে না পেরে দু’জনেই খুব ছটফট করছিল।

সারাদিন ক্লাস করে বিকেলে স্কুল ছুটির পর ক্লাস থেকে বের হতেই ক্লাসের গোটা দশেক ছেলে ওকে ঘিরে দাঁড়াল। ছেলেদের ভেতর থেকে বাবু একটু গম্ভীর গলায় বলল, তোর সাথে কথা আছে।

কী নিয়ে কথা হতে পারে দীপু বুঝে গেল সাথে সাথে। তবু চোখেমুখে একটু কৌতূহল ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী কথা?

আমরা সবাই জানতে চাই তুই প্রত্যেক দিন বিকেলে তারিকের সাথে কোথায় যাস।

দীপু বুঝতে পারল ধরা পড়ে গেছে। ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর বলল, এখন সেটা বলতে পারব না।

কেন পারবি না? আমরা তোর বন্ধু না।

বন্ধু হবি না কেন?

তা হলে আমাদের বিশ্বাস করিস না?

বাজে কথা বলিস না, বিশ্বাস করব না কেন?

তা হলে বল, কোথায় যাস তোরা?

মঞ্জু চোখ ছোট ছোট করে বলল, আমি তোদের পিছু পিছু গিয়েছিলাম, একদিন দেখেছিও কোনদিকে যাচ্ছিস।

দীপু মঞ্জুর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল সত্যি কথাই বলছে।

মিঠু গোয়ারের মতো বলল, ঐ জঙ্গলের ভেতর কী করতে যাস বলতে হবে।

যদি আমাদের না বলিস, তোর সাথে আর কোনো সম্পর্ক নেই। তুই থাক তারিককে নিয়ে!

দীপু বলল, ঠিক আছে তোদের আমি বলব, কিন্তু তার আগে আমাকে তারিকের সাথে কথা বলে নিতে হবে।

ঠিক আছে, বলে নে, ঐ যে তারিক আসছে।

দেখা গেল তারিক উদ্বিগ্ন মুখে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। বলল, কী হয়েছে রে?

দীপু তারিককে ডেকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে গেল।

কী হয়েছে দীপু?

ক্লাসের সবাই জেনে গেছে কালাচিতার কথা।

সব্বোনাশ! তা হলে?

ওদের বলে দিতে হবে। এলে ভালই হবে, তা হলে সবাই মাটি কাটতে সাহায্য করতে পারবে, তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলতে পারব। আর আমাদের তো ব্যাপারটা জানাতেই হবে, আগে হোক পরে হোক।

তারিক চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। আস্তে আস্তে বলল, কিন্তু যদি এখনই জানাজানি হয়ে যায়, সবাই তা হলে খ্যাচম্যাচ শুরু করবে।

জানাজানি হবে না।

তুই কীভাবে জানিস? সবাই কি তোর মতো? কারও পেটে কথা থাকবে না।

সেটা তুই আমার উপরে ছেড়ে দে। কারো পেট থেকে যেন কথা বের না হয় সেটা আমি দেখব।

তারিক তবু উসখুস করতে থাকে। কী জন্যে সেটা দীপুর বুঝতে বাকি থাকে না। তারিককে নিশ্চিন্ত করার জন্য বলল, আর শোন, যদি কোনো গুপ্তধন পাওয়া যায়, সেটা তোরই থাকবে। আমি আগে সবাইকে বলে দেব।

তারিক একটু লজ্জা পেয়ে বলল, ধেৎ! গুপ্তধন কি আর সত্যি আছে?

যদি থাকে।

যদি থাকে তা হলে সবাই না হয় ভাগাভাগি করে নেব।

ঠিক আছে, তুই অর্ধেকটা নিবি, আমরা বাকি সবাই অর্ধেকটা ভাগ করে নেব।

তারিক খুশি হয়ে রাজি হয়ে গেল। একা একা মাটি কাটা আর ওর সহ্য হচ্ছিল না।

দীপুর জন্যে সবাই দাঁড়িয়ে ছিল মাঠের পাশে। দীপু এগিয়ে গিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, তোদের আমি সব বলব।

সবাই খুশি হয়ে উঠল। বাবু বলল, বল।

কিন্তু একটা শর্ত আছে।

কী শর্ত?

আজ রাত একটার সময় এখানে আসতে হবে।

রাত একটায়? এখানে? কী জন্যে?

শোনার জন্যে। আমি রাত একটার সময় বলব। যারা যারা শুনতে চাস, রাত একটার সময় আসিস। যারা যারা রাত একটার সময় আসবে তাদের আমরা দলে নিয়ে নেব।

রাত একটার সময় কেন? এখনই বল, এখনই দলে নিয়ে নে।

উঁহু! ব্যাপারটা একেবারে টপ সিক্রেট, শুনলেই বুঝতে পারবি। যারা রাত একটার সময় কষ্ট করে আসবে বুঝতে পারব শুধু তাদেরই খাঁটি ইচ্ছে আছে, তাদের বললে তারাও গোপন রাখবে পুরো ব্যাপারটা। শুধু তাদেরই বলা যাবে।

কিন্তু–

কোনো কিন্তু না। দীপু মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে রইল, এত গম্ভীর যে দেখে তারিক পর্যন্ত অবাক হয়ে গেল।

.

রাতে খাবার সময় দীপু তার আব্বাকে বলল, আব্বা আজ রাতে আমাকে একটু বের হতে হবে।

কত রাতে?

সাড়ে বারোটার দিকে।

আব্বা অবাক হয়ে তাকালেন, এত রাতে কী করবি!

দীপু একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, একটা কাজ ছিল।

চুরি করতে যাবি কোথাও?

যাও! দীপু একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলল, সেই চিতাবাঘের ব্যাপারটা। এখন আমরা আরও কয়েকজনকে দলে নেব, তাই সবাইকে বলেছি রাত একটায় আসতে। যারা আসতে পারবে বোঝা যাবে তারা সত্যি সত্যি আমাদের সাথে আসতে চায়; সবাইকে দলে নেব না।

হুঁ। আব্বা একটু হেসে বললেন, খামোকা ছেলেগুলোকে তাদের আব্বাদের দিয়ে পিটুনি খাওয়াবি?

কেন?

বাহ্। রাত একটার সময় ছেলে যদি ঘর থেকে বের হয় তা হলে আব্বারা ছেড়ে দেবে? এমনিতো হয়তো ওরা তোদের সিক্রেট বলে দিত না, কিন্তু কাল সকালে পিটুনি খেয়ে ঠিকই বলে দেবে।

দীপু চিন্তিত হয়ে উঠল, সে এদিকটা ভেবে দেখেনি। সত্যি সত্যি এটা হতে পারে। তা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। দুর্বল গলায় বলল, আব্বা।

কী?

কী করা যায় তা হলে?

আমি কী জানি! তোদের ঝামেলা তোরা মেটাবি।

বলো না কী করি।

উঁহু। আব্বা খাওয়ায় মন দিলেন। দীপু আব্বাকে চেনে, ওর ব্যাপারে কখনও কিছু বলেন না, নিজের ঝামেলা মেটাতে হয় ওর নিজেকে।

তোরা কি কোনো সভ্যতা-টভ্যতা খুঁজে পেয়েছিস? কয়দিন থেকে যেরকম মাটি মেখে ফিরে আসিস মনে হয় খোঁড়াখুঁড়ি পর্যন্ত শুরু হয়ে গেছে।

আর কয়দিন আব্বা, তারপর বলে দেব সবাইকে। এখন জিজ্ঞেস কোরো না।

ঠিক আছে—আমি শুধু বলছিলাম যে এসব জায়গা খোঁড়া কিন্তু খুব কঠিন। যারা এক্সপার্ট তারা যদি না থাকে সব নষ্ট হয়ে যায়।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আর বড় কথা যে, যদি কোনোরকম মূর্তি-টুর্তি পাওয়া যায় তা হলে খুব সাবধান!

কেন?

একটু চোট লেগে ভেঙে যদি যায় খুব খারাপ হবে সেটা। আর যদি স্মাগলাররা খোঁজ পায় তা হলেই হয়েছে!

কেন, কেন?

এদেশে এসব জিনিস বেচাকেনা করা যায় না, কিন্তু কোনোভাবে যদি দেশের বাইরে নিতে পারে তা হলে হাজার হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তাই স্মাগলাররা সবসময় ছোঁক ছোঁক করে ঘুরে বেড়ায়। পড়িসনি খবরের কাগজে, মিউজিয়াম থেকে মূর্তি চুরি হয় রোজ?

দীপু জানত না এতসব কিছু হতে পারে তাদের কালাচিতায়। ও ঠিক করল পরের বার জামশেদ চাচা আসা মাত্র তাকে বলে দেবে কালাচিতার কথা।

রাত সাড়ে বারোটার সময় দীপু ঘুম ঘুম চোখে বের হয়। আব্বাকে বলে ঘরের চাবিটা নিয়ে নিল। রাতে ফিরে এসে যেন আব্বাকে ডাকাডাকি করতে না হয় দরজা খুলে দেবার জন্যে।

এত রাতে একা একা যেতে ওর ভয় করছিল। কিসের ভয় এটা কে জানে! ও খুব ভাল করে জানে ভূত বলে কিছু নেই। আর শহরের উপর তো বাঘ-ভালুক আসতে পারে না, তা হলে ওর ভয়টা কিসের? নিজেকে সাহস দিয়ে ও রাস্তার একপাশ দিয়ে গুটিগুটি হেঁটে চলল।

স্কুলের মাঠটা নির্জন। গেট বন্ধ বলে ওকে দেয়াল টপকে ঢুকতে হল। যেখানে এসে ওদের দেখা করার কথা সেখানে গিয়ে দেখতে পেল একটু ছায়া জমাট বেঁধে আছে। সিগারেটের আগুন জ্বলছে নিভছে দেখে বুঝতে পারল ওটি তারিক। দীপুর বুকে তখন সাহস ফিরে এল।

তারিক চুপচাপ পা ঝুলিয়ে বসে আছে দেয়ালে। দীপুকে দেখে বলল একা একা বসে থেকে বিরক্ত হয়ে গেলাম, এতক্ষণে আসলেন লাটসাহেব।

একটার সময় না আসার কথা। এখনও তো একটা বাজেনি। তুই কখন এসেছিস?

বারটা থেকে বসে আছি।

এত আগে এসেছিস?

সেকেন্ড শো সিনেমা দেখে এলাম। এত রাতে আর বাসায় গিয়ে কী করব?

কী সিনেমা দেখলি?

অবুঝ হৃদয়। কী একটা বই—আহা! লাস্ট সিনে চোখে একেবারে পানি এসে যায়।

দীপু জানে তারিক সিনেমার এক নাম্বার ভক্ত। আর সব সিনেমাতেই সব শেষে সবার মিল হয়ে যায় তখন তারিকের চোখে পানি এসে যায়।

কেউ আসবে বলে তো মনে হয়?

তারিক ঠোঁট উল্টিয়ে বলল, কে জানে? না এলে নাই।

ঠিক এই সময়ে দেখা গেল গুটি গুটি কে যেন আসছে। কাছে আসতেই বোঝা গেল বাবু। একটু কাঁপছে শীতে।

আস্তে আস্তে বলল, তোরা আছিস তা হলে? আমি ভাবলাম গুলপট্টি মেরেছিস নাকি কে জানে?

গুলপট্টি মারব কেন! আসতে অসুবিধে হয়েছে নাকি?

হয়নি আবার! আম্মাকে বলেছি খালা যেতে বলেছে, রাতে না এলে বুঝবেন খালা আটকে রেখেছে। খালার বাসায় গিয়ে বলেছি রাতে ফিরে যেতেই হবে। এখন ধরা না পড়লে হয়।

ধরা পড়লে আর কী, মার খাবি আর কি একটু!

এই সময়ে দেখা গেল আরও দু’জন গুটিগুটি এগিয়ে আসছে। কাছে আসতেই দেখা গেল দীলু আর মঞ্জু।

তোরা আছিস তা হলে! আর কেউ আসেনি?

এই তো বাবু এসেছে। অসুবিধে হয়নি?

নাহ! আমি আম্মাকে বলেছি দীলুর বাসায় থাকব, দীলু বলেছে আমার বাসায় থাকবে। অঙ্ক করব রাতে!

গুড। এই তো বুদ্ধি।

ঠিক এই সময়ে শেয়ালের ডাক শোনা গেল। এক সেকেন্ডের জন্যে ভয় পেয়ে গিয়েছিল সবাই, তার পরেই বুঝতে পারল ওটা মিঠু। এত সুন্দর শেয়ালের ডাক দিতে পারে যে আসল শেয়াল লজ্জা পেয়ে যাবে। ক্লাসে যখনই কিছু দেখাতে হয় ওদের ক্লাস থেকে মিঠু শেয়ালের ডাক দিয়ে শোনায়। ছোট ক্লাসের ছেলেরা ওকে দেখলে চেঁচিয়ে গান গায় :

‘শেয়াল রে শেয়াল
এটা কি খেয়াল।’

মিঠু আসার পর সবার ভেতর একটু ফুর্তির ভাব এসে গেল। ধরা পড়লে কী বলা হবে সেটা তৈরি করে নেয়া হল। মিঠুর বুদ্ধি, বলা হবে যাত্রা দেখতে গিয়েছিল।

বাবু বলল, কী? ভেবেছিস যাত্রা দেখতে গিয়েছি বললে আব্বা কোলে নিয়ে আদর করবেন?

না, তা অবশ্যি ঠিক। দীপু বলল, তবু সত্যি কথাটা না বললি আর কি, পরে যখন সব জানাজানি হবে তখন বললেই হবে।

সত্যি কথাটি কী বল এবার।

দাঁড়া, দেখি আর কেউ আসে নাকি।

শেষ পর্যন্ত প্রায় দশজনের মতো এসে গেল। দীপু এতটা আশা করেনি। সবাই গোল হয়ে বসল মাঠে। দীপু তারিককে খোঁচা দিয়ে বলল, তারিক বল তোর কালাচিতার ঘটনা–

তারিক বলল, আমি কী বলব তুইই বল।

দীপু ওদের বলতে থাকে গোড়া থেকে। কীভাবে কালাচিতা আবিষ্কার করল তারিক, তারপর দু’জনে কীভাবে খোঁড়া শুরু করল আর কী সব আশ্চর্য আশ্চর্য জিনিস খুঁজে পেল। কীরকম রহস্যময় দালান মাটিতে বুজে আছে, কীভাবে একটার সাথে আরেকটার ভেতরে যোগাযোগ। কত কী যে আছে সেটা কে জানে। শেষে বলল, জামশেদ চাচা কীরকম পাগলের মতো হয়ে গেছেন জায়গাটা দেখার জন্যে। গুপ্তধন যদি খুঁড়ে ওরা নাও পায় জায়গাটা দেখার জন্যেই ওরা বিখ্যাত হয়ে যাবে রাতারাতি।

সব শুনে ওদের দম বন্ধ হয়ে গেল উত্তেজনায়।

সত্যি বলছিস তোরা?

সত্যি।

খোদার কসম।

খোদার কসম।

ঘর সুড়ঙ্গ, আর মূর্তি?

হুঁ।

মানুষের খুলি?

খুলি না হাড়, মানুষের না অন্য কিছুর কে জানে।

তোর কী মনে হয়, আছে গুপ্তধন?

কে জানে সেটা।

চল দেখে আসি।

মিঠুর সবসময়েই সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। তাই ও যখন রাতে একটার সময় কালাচিতা যেতে চাইল, দীপু বেশি অবাক হল না। কিন্তু যখন দেখল সবাই সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল তখন ও ভারি অবাক হয়ে গেল।

এখন যাবি? কালাচিতায়?

হ্যাঁ। অসুবিধে কী?

বাবু বলল, বাসা থেকে যখন পালিয়েছি একটু সকাল ফিরে গেলে কি আর কম মার খাব?

তাই বলে এখন? ইতস্তত করে বলল, রাত একটা দুটার সময়?

রাতই তো ভাল কেউ থাকবে না।

তারিক একটা বড় হাই তুলে বলল, আমার বাবা ঘুম পাচ্ছে, আমি যেতে পারব না।

যাবি না মানে? আমরা রাত একটার সময় কষ্ট করে এসেছি আর তুই ঘুমাবি মানে?

দীপু বুঝতে পারল, এত উৎসাহ নষ্ট করা উচিত না। কাজেই তারিককে ঠেলেঠুলে রাজি করিয়ে ওদের রওনা দিতে হল কালাচিতার দিকে।

রাতের বেলা গ্রামের রাস্তা ভারি অদ্ভুত। চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার, তার মাঝে উঁচু সড়ক এঁকেবেঁকে গেছে ধানখেতের মাঝে দিয়ে। সড়কে এক হাঁটু নরম ধুলো। দু’পাশে নাম-না-জানা বড় বড় গাছ বাতাসে শিরশির করছে। আকাশে ছোট একটা চাঁদ আর হাজার হাজার তারা মিটমিট করছে। দূরে বহু দূরে গ্রামগুলো অন্ধকারে মিশে আছে। চারদিকে এত নির্জন, এত নীরব যে একটু একটু ভয় লেগে যায়।

কালাচিতা বেশ দূরে। কিন্তু হেঁটে ওদের খুব বেশি সময় লাগল না। পথে খুব বেশি লোকজনের সাথে দেখা হয়নি। যাদের সাথে দেখা হয়েছে সবাইকে বলেছে যাত্রা দেখতে যাচ্ছে। কেউ অবিশ্বাস করেনি, সত্যি নাকি খুব ভাল যাত্রা হচ্ছে এবারে।

কালাচিতা পৌঁছানোর আগে দীপু মোমবাতিটি জ্বালাতে নিষেধ করেছিল, অনেক দূর থেকে আলো দেখা যায়। ওরা সবাই মিলে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে এসেছে। তারিকের ভীষণ সাপের ভয়। শীতকালে সপ বের হয় না শোনার পরও বাঁ হাতে শক্ত করে তাবিজটা ধরে রাখল।

কালাচিতায় ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। চারদিক এত নির্জন যে কেউ কথা বলে সেটা ভাঙবে সাহস পাচ্ছিল না। কেন জানি ফিসফিস করে কথা বলছিল সবাই। একটু একটু বাতাস। তারিক সাবধানে মোমবাতি জ্বালাতে যাচ্ছিল, হঠাৎ দীপু খপ করে তারিকের হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, সাবধান–

কী?

চুপ একেবারে চুপ সবাই, একটা কথাও না।

সবাই চমকে উঠে কাছাকাছি সরে আসে। অন্ধকারে নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ভয়-পাওয়া গলায় দীপু বলল, ঐদিকে তাকিয়ে দেখ।

সবাই তাকিয়ে দেখল, কালাচিতার ইটের ফাঁক দিয়ে খুব সরু একটা আলোর। ফলা বেরিয়ে আসছে। ভেতরে কে যেন আছে!

সবাই ভয়ে কুঁকড়ে গেল। বাবু কঁপা-কাঁপা গলায় বলল, চল ফিরে যাই। আমার ভয় করছে।

রতন প্রায় কেঁদে দিয়ে ভাঙা গলায় কী বলল কেউ বুঝতে পারল না।

তারিক ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, চুপ একটা কথাও না। তারপর আস্তে আস্তে বলল, আমার গুপ্তধন চুরি করতে এসেছে কেউ, হারামজাদার মাথা গুঁড়ো করে ফেলব না।

তার পরেই পকেট থেকে চাকু বের করে সে খুলে ফেলল।

মাথা গরম করিস না, তারিক। কতজন আছে তুই কেমন করে জানিস?

আমি দেখে আসি।

না-না-না—বাবু প্রায় কেঁদে দিল।

ফ্যাচফ্যাচ করিস না-তারিক সত্যি সত্যি রওনা দেয়।

দাঁড়া তারিক, দীপু ওকে থামানোর চেষ্টা করল। হঠাৎ করে কিছু করিস না। আজকেই আব্বা বলছিলেন এসব ব্যাপারে চুরি করার জন্যে অনেক বড় বড় দল থাকে। মানুষ টানুষ খুন করে ফেলে এরা।

তারিক ভয় পাবার ছেলে নয়। বলল, আমি খুব সাবধানে যাব, দেখে আসি ব্যাপারটা কী। তোরা এখানে দাঁড়া, আমি যাব আর আসব।

সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, তারিক অন্ধকারে মিশে গেল ওদের সামনে।

অপেক্ষা করা খুব খারাপ ব্যাপার, ওরা প্রায় অধৈর্য হয়ে উঠেছিল, ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ প্রচন্ড চিৎকার আর হুটোপুটি শুনতে পেল। এক সেকেন্ডের জন্যে একটা চলাইট জ্বলে উঠে নিভে গেল, আর তারা সবাই দেখতে পেল কালোমতো একটা লোক তারিককে জাপটে ধরে ফেলেছে।

উঠে দৌড় মারার প্রবল ইচ্ছেটাকে জোর করে চেপে রেখে দীপু সবাইকে নিয়ে ঘাপটি মেরে বসে রইল। বুক ধক্ করে এত জোরে শব্দ করতে লাগল যে মনে হল শব্দ শুনে বুঝি ওদেরও ধরতে লোকজন চলে আসবে।

মিনিট কয়েক লাগল ওদের ঠাণ্ডা হতে। দীপু ফিসফিস করে বলল, খুব সাবধানে একজন একজন করে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়। খবরদার, একটুও শব্দ করবি না।

সবাই মিলে জঙ্গলের অনেক ভেতরে গিয়ে একত্র হতে বেশিক্ষণ লাগল না। ভয়ে সবার মুখ শুকিয়ে গেছে। নান্টু ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে শুরু করল অভ্যাসমতো। বাবু ভাঙা গলায় বলল, তারিককে মেরে ফেলেনি তো?

ভয়টা দীপুরও হচ্ছিল, কিন্তু দূর করে দিল জোর করে। বলল, আরে ধেৎ!

তুইই না বললি, এরা মানুষ খুন করে ফেলে—

তাই বলে তারিককে কেন মারতে যাবে!

তা হলে ওরকম শব্দ হল কেন? নিশ্চয়ই চাকুটাকু মেরেছে।

দূর। হঠাৎ করে ধরেছে তাই চমকে উঠে ওরকম চিৎকার করেছে।

বলেছে তোকে! কী ঝামেলায় পড়লাম। তোর সাথে আসাই উচিত হয়নি।

রাগে দুপুর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আস্তে আস্তে খুব ঠাণ্ডা গলায় বলল, কার কার মনে হচ্ছে আমার সাথে আসা উচিত হয়নি।

সবাই চুপ করে রইল। নান্টু শুধু গজগজ করে কী জানি বলল, কেউ বুঝতে পারল না।

তারিক কী বিপদে পড়েছে কিছু জানি না। বেঁচে আছে না মেরে ফেলেছে সেটা পর্যন্ত জানি না, আর তুই তোর নিজের কথা ভাবছিস? লজ্জা করে না!

ঠিক আছে, দীপু ঠান্ডা গলায় নান্টুকে বলল, তারিককে কীভাবে ছুটিয়ে আনব সেটা আমরা ঠিক করব। তুই বাসায় চলে যা—গিয়ে তোর আম্মার সাথে লেপ গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখ গিয়ে। যা–

নান্টু লজ্জায় লাল হয়ে বলল, আমি কি তাই বললাম নাকি? আমি বলছিলাম…

দীপু বাধা দিয়ে বলল, ওসব আমি বুঝি না। তারিককে ছুটিয়ে আনার জন্যে এখানে থাকবি, না বাসায় যাবি?

এখানে থাকব।

গুড।

দীপু খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে বলল, কী হচ্ছে না হচ্ছে জানার আগে আমরা কিছুই করতে পারব না।

জানবি কেমন করে?

কারও যাওয়ার দরকার। তোরা তো চিনিস ন জায়গাটা আমি ভাল করে চিনি।

আমি যাই।

না-না-না-না–সবাই একসাথে বাধা দিল।

মিঠু বলল, তারিক তো তা-ই করতে গিয়ে বিপদে পড়ল।

কিন্তু কিছুই যদি না জানি তা হলে করব কী?

বোঝাই যাচ্ছে কেউ এসেছে মূর্তি চুরি করতে।

কতজন এসেছে তুই কেমন করে জানিস?

সাজ্জাদ বলল, পুলিশকে গিয়ে খবর দিলেই হয়।

কী বলবি তুই পুলিশকে?

দীপু বলল, সেটা জানার জন্যেই তো যাওয়া দরকার। কারা আছে কতজন আছে না জানলে পুলিশকে কী বলবি?

বাবু মাথা নেড়ে বলল, কী দরকার? তারিক বিপদে পড়েছে। এখন তাকে বাঁচানোর জন্যে আরেকজনের বিপদে পড়ার কোনো মানে নাই।

তার মানে তারিককে বাঁচানোর চেষ্টা করব না? আর বিপদে পড়ব সেটা কে বলল, তারিক জানত না বাইরে কেউ আছে। তাই সোজা হেঁটে গিয়েছিল, আমি সাবধানে যাব।

কিন্তু–

এর মাঝে আর কোনো কিন্তু নেই। দীপু গম্ভীর হয়ে আব্বার মুখে অনেকবার শোনা কথাটা বলল, যেটা করা দরকার সেটা করে ফেলতে হয়। আমি যাচ্ছি–ধরা পড়ব না, ভয় পাস না। খোদা না করুক যদি ধরা পড়ে যাই—দু’জন কিংবা সবাই চলে গিয়ে পুলিশকে খবর দিবি। আর যদি ধরা না পড়ি ফিরে এসে একটা কিছু করা যাবে।

দীপু তার সাদা শার্টটা পালটে নান্টুর গায়ের সবুজ রঙের শার্টটা পরে নিল, তা হলে দূর থেকে দেখা যাবে না। রওনা দেবার আগে বলল, আমার আসতে একটু দেরি হতে পারে, কেউ ভয় পাস নে।

সাজ্জাদ বলল, দাঁড়া একটু—দীপু দাঁড়াল। সাজ্জাদ তিনবার কুলহু আল্লাহ পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে দিল, যা, কোনো ভয় নেই!

বরাবরই সাজ্জাদ ধার্মিক ছেলে, দীপু একটু হাসল খুশি হয়ে, তারপর রওনা দিল। জঙ্গলের অনেক ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল, হাতড়ে হাতড়ে কালাচিতার কাছে আসতেই ওর অনেক সময় লেগে গেল। ওর তারিকের মতো সাপ নিয়ে বাড়াবাড়ি ভয় নেই। তবুও জেনেশুনে একটা সাপের ঘাড়ে পা দিতে চায় না। শীতকালে নাকি সাপ বের হয় না। দীপু সেটা জানে, কিন্তু কথা হল সাপেরা জানে তো যে শীতকালে বের হতে হয় না?

অন্ধকারে থেকে থেকে চোখ এখন সয়ে গেছে। কালাচিতার কাছাকাছি এসেও জায়গাটা ভাল করে দেখার চেষ্টা করল। ডান পাশ দিয়ে গেলে একটা ঢালুমতো জায়গা পাওয়া যায়, কাটা গাছ আর জঙ্গলে ভরা, তবে সেটা কালাচিতার খুব কাছে। তারিক আর সে ঠিক করেছিল কিছু ইট সরিয়ে এদিকে একটা দরজা তৈরি করবে। ওখানে হাজির হতে পারলে ভেতরে কী হচ্ছে শোনা যেতে পারে। দীপু কীভাবে যাবে ঠিক করে নিল। সোজা সামনের ঝোঁপটার দিকে গিয়ে ডান দিকে বেঁকে যাবে। বাইরে কেউ পাহাড়া দিচ্ছে নিশ্চয়ই, কিন্তু দীপু খুঁজে পেল না।

দীপুর প্রায় হার্টফেল করার মতো অবস্থা হল যখন সে আবিষ্কার করল যে সে যে-ঝোঁপটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেটি একটি মানুষ, মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে আছে। ঘাড়ে বন্দুক না লাঠি সে বুঝতে পারল না! একটুও শব্দ না করে ও আস্তে আস্তে পিছিয়ে আসতে থাকে। ভাগ্যিস ঠিক তক্ষুণি লোকটি একটি সিগারেট ধরিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে থাকে। ম্যাচ জুলতেই ও লোকটিকে দেখতে পেল, কালো এবং শুকনো। ঘাড়ে যে জিনিসটি সেটি বন্দুক তাও স্পষ্ট দেখতে পেল।

পিছিয়ে এসে সে অন্যদিকে দিয়ে ঢালটার কাছে হাজির হল। কান লাগিয়েও সে কিছু শুনতে পেল না, একটু টুকটাক শব্দ হচ্ছে, কিন্তু কিসের জন্যে? হঠাৎ ভেতরে কে কথা বলে উঠল, বল আর কে আছে তোর সাথে?

দীপু তারিকের গলার স্বর শুনতে পেল, আর কেউ নাই।

তোর সাথে যে আরেকটা ছেলে থাকে, ও কোথায়?

দীপু বুঝতে পারল তার কথা বলছে।

অনেকক্ষণ কোনো কথা শোনা গেল না, তারপর ভারী গলার একজন কী বলে উঠল। কথা শুনে মনে হয় বিদেশী। দীপু বেশি অবাক হল না, বিদেশীরা নাকি এসব চুরি করে বেড়াচ্ছে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সব জিনিস নাকি চুরি করা :

দীপু কান পেতে কতজন লোক, কী করছে শোনার চেষ্টা করল। কমপক্ষে চারজন লোক আছে ভেতরে। ওরা আর বেশিক্ষণ থাকবে না, কী-একটা খুঁড়ে বের করছে। ওটা করা মাত্রই প্যাকেট করে পালাবে। দীপু তারিকের সাথে থাকতে পারে তা-ই সন্দেহ করে এই তাড়াহুড়া। দীপু বুঝতে পারল, তাড়াতাড়ি ওদের কিছু করতে হবে, ওরা পালানোর আগে। তারিক ভাল আছে, কিছু হয়নি এটা চিন্তা করেই তার বুকের বোঝাটা চলে গেছে।

যত সাবধানে দীপু এসেছিল তার থেকে অনেক বেশি সাবধানে দীপু ফিরে এল। সবাই ওর জন্যে অস্থির হয়ে বসেছিল, দেরি দেখে অনেকে সন্দেহ করছিল হয়তো ও ধরা পড়ে গেছে। ফিরে আসতে দেখে ওদের খুশির সীমা থাকল না। তারিকের কিছু হয়নি শুনে উৎসাহ দশগুণ বেড়ে গেল সবার। দীপু খুব তাড়াতাড়ি অল্প কথায় সব বুঝিয়ে দিল। ওরা বেশিক্ষণ থাকবে না, যা-ই করতে হয় খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। একবার চলে গেলে আর ধরা যাবে না।

সাজ্জাদ বলল, কাউকে গিয়ে থানায় খবর দিয়ে আসতে হবে।

হ্যাঁ, কিন্তু থানা কতদূর জানিস? গিয়ে ফিরে আসতে আসতে ওরা সবাই হাওয়া হয়ে যাবে।

তা হলে?

দীপু সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা খুব ভাল উপায় আছে।

কী?

বাইরে যে লোকটা পাহারা দিচ্ছে ওকে ধরে ওর বন্দুকটা কেড়ে নিই, তা হলে সবাইকে ভেতরে আটকে ফেলা যাবে। কালাচিতা থেকে বের হবার রাস্তা মোটে একটা, ওখানে বন্দুক হাতে নিয়ে বসে থাকলে কেউ বের হতে পারবে না।

দীপুর কথা শুনে কারও কারও হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। বাবু দুর্বল গলায় বলল, যদি গুলি করে দেয়?

ওকে গুলি করার সুযোগ কে দেবে? আমরা পেছন থেকে একসাথে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। প্রথমেই বন্দুকটা কেড়ে নিতে হবে। তারপর ওকে বেঁধে ফেলতে কতক্ষণ!

যদি দেখে ফেলে।

সেটুকু রিস্ক তত নিতেই হবে, চেষ্টা করা হবে যেন না দেখে। সবাই খুব আস্তে আস্তে লোকটার কাছাকাছি চলে যাবে। তারপর যেই মিঠু শেয়ালের ডাক দেবে তক্ষুণি মনে মনে এক দুই তিন গুনে একসাথে লাফ দিতে হবে।

ঠিক। মিঠুর বুদ্ধিটা খুব পছন্দ হয়ে যায়। আমি সামনের দিকে থাকব, শেয়ালের ডাক শুনেই লোকটা একটু চমকে উঠে আমার দিকে তাকাবে, আর অমনিই সবাই একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়বি।

হ্যাঁ, দীপু আরও ছোটখাট ব্যাপার ঠিক করে নেয়, বন্দুকটা খুব সাবধানে, নলটা সবসময় উপরে দিকে রাখতে হবে যেন গুলি বেরিয়ে গেলেও কারও ক্ষতি

হয়। আর সবচেয়ে যেটা জরুরি সেটা হচ্ছে মিঠুর শেয়ালের ডাকের পর মনে মনে এক দুই তিন গুনে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সবাইকে। কারও যদি ভয় থাকে আগেই বলে দে। আছে কারও?

না।

গুড, কেউ যদি ঠিক সেই সময়ে ঝাঁপিয়ে না পড়িস তা হলে কিন্তু কী হবে কিছু বলা যাবে না।

যদি মনে কর কাউকে দেখে ফেলল?

তা হলে তুই পাথরের মতো চুপ করে শুয়ে থাকবি। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে না নেয়া পর্যন্ত নড়বি না। আর যদি লোকটা একেবারে ভাল করে দেখে ফেলে তা হলে ভাল মানুষের মতো দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করবি ও তারিককে দেখেছ কি না—এইসব। অন্যেরা ঠিকই ঝাঁপিয়ে পড়বে।

সবাই মাথা নাড়ল। বুদ্ধিটা খারাপ না।

লোকটাকে বাঁধার জন্যে দড়ি নেই, তাই শার্টগুলো খুলে পাকিয়ে দড়ির মতো করে নেয়া হল। শীতের রাত, কিন্তু উত্তেজনায় কেউ শীতটুকু টের পাচ্ছে না। রওনা দেবার আগে সাজ্জাদ সবার বুকে কুলহু আল্লাহ্ পড়ে ফু দিয়ে দিল।

জঙ্গল থেকে ওরা সাবধানে বের হয়ে এল। মিঠু চলে গেল লোকটার সামনে দিকে, অন্যেরা পেছনে। তারপর খুব আস্তে আস্তে লোকটাকে ঘিরে ওরা এগিয়ে আসতে থাকে। দীপুর শুধু ভয় হচ্ছিল মিঠু না আবার বেশি আগে শেয়ালের ডাক দিয়ে দেয়। ওকে অবশ্যি বলে দেয়া হয়েছে, একটু পরে হলেও ক্ষতি নেই, আগে যেন না দেয়।

সবাই লোকটার হাত দুয়েকের ভেতরে পৌঁছে যাবার পর থামল। দীপু মাথা তুলে দেখল সবাই এসে গেছে, গুঁড়ি মেরে বসে অপেক্ষা করছে শেয়ালের ডাকের জন্যে। উত্তেজনায় বুক ধক্ করছে এক একজনের। কখন দূরে শেয়ালের ডাক শুনবে।

ঠিক তক্ষুণি ওরা শুনল কোথায় জানি শেয়াল ডেকে উঠল। মিঠু তার জীবনের সবচেয়ে ভাল ডাকটি দিল এবার। সবাই দেখল। লোকটি চমকে উঠল তারপর আবার ঠান্ডা হয়ে বসে রইল। ওরা মনে মনে গুনল এক দুই তিন—তারপর একসাথে গুলির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল নয়টি ছেলে।

যত কঠিন হবে ভেবেছিল তার থেকে অনেক সহজ হল ব্যাপারটা। টান মেরে লোকটাকে মাটিতে ফেলে দিল সবাই, হ্যাচকা টানে বন্দুকটা কেড়ে নিল দীপু। মিঠু চিৎকার করে বলল, খবরদার একটু নড়লেই জবাই করে ফেলব!

লোকটি এত ভয় পেয়েছিল যে বলার নয়, এত জোরে চিৎকার করে উঠেছিল যে দীপুর মনে হল হয়তো মরেই গেছে! দীপু বন্দুকটা হাতে নিয়ে বলল, সাবধান! ওকে ভাল করে বেঁধে ফেল; আমি যাচ্ছি।

দীপু ছুটে গেল কালাচিতার গর্তের মুখে। ভেতরে কে কম করছে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু চিৎকার শুনে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ বের হয়ে আসবে, তা হলেই বিপদ হয়ে যাবে। দীপু সেজন্যেই তাড়াতাড়ি চলে এসেছে এখানে। গর্তের মুখে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, হ্যান্ডস আপ সবারই। বের হতে চেষ্টা করলে গুলি করে খুলি ফুটো করে দেব।

ভেতর থেকে তারিকের আনন্দধ্বনি শোনা গেল। শাবাশ দীপু কা বাচ্চা! জিন্দাবাদ!

ঘাবড়াস না তারিক। তোকে এক্ষুণি ছুটিয়ে আনব। পাহারাদারকে বেঁধে ফেলেছি লাটুর মত। ওদের দোনালা বন্দুকটা এখন আমার কাছে, কেউ বের হতে চাইলেই গুলি।

দীপু খুব ভুল বলেনি। লোকটাকে সবাই বেঁধে ফেলেছে তক্তার মত। ধরাধরি করে নিয়ে আসছিল সবাই। কিন্তু ক্রমাগত শাসিয়ে যাচ্ছে, যদি একটু নড়ার চেষ্টা করে তা হলেই নাকি জবাই করে ফেলবে। কী দিয়ে কে জানে?

দীপু চিৎকার করে বলল, নিয়ে আয় বান্দাকে এখানে। ভেতরে ফেলে দিই! সবই এক জায়গায় থাকুক।

সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল। কালাচিতার ভেতরে লোকটাকে এভাবে ফেলা খুব সহজ হবে না, কিন্তু সব দিক দিয়ে নিরাপদ। বাঁধন খুলে ফেললেও বের হতে পারবে না।

দীপু চিৎকার করে বলল, গর্তের মুখে থেকে সরে যা তারিক, ভেতরে লাট্টু ফেলব।

ঠিক হায়। ছোড় দো লাটটু কো।

বেশি খুশি হলে তারিক বরাবরই উর্দুতে কথা বলে। ওরা সবাই ধরাধরি করে লোকটাকে গর্তের মুখে এনে ছেড়ে দিল। কীভাবে পড়বে সে নিয়ে মাথা ঘামাল না, এমন কিছু উঁচু নয়, একটু ব্যথা পেতে পারে, হাত পা ভাঙবে না।

এবারে মইটা বের করে আনব, তা হলেই সব শেষ। দীপু হাসিমুখে মইটা। টেনে ধরতেই নিচে থেকে বিদেশীটা ইংরেজিতে কী যেন বলে চেঁচিয়ে উঠল, সাথে সাথে ক্লিক করে একটা শব্দ হল আর তারিকের ভয় পাওয়া চিৎকার শোনা গেল।

দীপু ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তারিক?

পিস্তল। কাছে আসিস না খবরদার, গুলি করে দেবে।

দীপু টের পেল ভয়ে তার মেরুদন্ড দিয়ে ঠান্ডা কী একটা যেন বয়ে গেল। এটা সে চিন্তা করেনি। ভয়ে ওর সব চিন্তা গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। জোর করে নিজেকে শান্ত রাখল। এখন মাথা ঠান্ডা না রাখলে বিপদ হয়ে যাবে। ওদের পক্ষে ব্যাপারটা সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে, বড় মানুষ দরকার, থানায় খবর দিতে হবে।

ফিসফিস করে বলল, বিলু, এক দৌড়ে তুই থানায় যা, সর্বনাশ হয়ে যাবে এছাড়া।

বিলু মাথা নেড়ে বলল, থানার লোকজন যদি আমার কথা না শোনে?

শুনবে না মানে? শুনতে হবে। না হয় আমার আব্বাকে ডেকে নিয়ে যাস।

আচ্ছা। দীপুর আব্বাকে ওদের ক্লাসের সবাই চেনে, অনেকের সাথে খুব ভাল খাতির পর্যন্ত আছে। তিন-চার বার ওর আব্বার সাথে ওরা মাছ ধরতে গিয়েছিল মংলা বিলে।

আর কে যাবে বিলুর সাথে?

আরও কারও যেতে হবে না, দেরি হয়ে যাবে তা হলে। ঘাবড়াস না তোরা, আমি যাব আর আসব, বলে বিলু চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সত্যি সত্যি বিলুর সাথে আর কেউ গেলে দেরি হয়ে যেত। বিলু এত দৌড়াতে পারে যে বিশ্বাস করা যায় না। গত স্বাধীনতা দিবসে কুড়ি মাইল ম্যারাথন দৌড়ে বিলু নাম দিয়েছিল কাউকে না বলে। স্টেডিয়ামে যখন ওরা দেখল ঘেমে টেমে লাল হয়ে খালি পায়ে কুড়ি মাইল দৌড়ে হাজির হয়ে গেছে বিলু, ওরা এত অবাক হয়েছিল যে বলার নয়। এসেছিল অবশ্যি সবার শেষে, কিন্তু কুড়ি মাইল তো আর ঠাট্টা নয়! ডেপুটি কমিশনার নিজে তাকে একটা গোল্ড মেডেল দিলেন।

নিচে খুব উত্তেজিত কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ওরা কিছু বুঝতে পারছিল না। তারিকও কিছু বলছে না, কী হচ্ছে না হচ্ছে কে জানে। দীপুর গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল ভয়ে।

নিচের হৈচৈ হঠাৎ থেমে গেল। পরিষ্কার বাংলায় একজন কথা বলে উঠল, উপরে যারা আছো শোনো। এই সাহেব খুব খেপে গেছে, দশ পর্যন্ত গোনার আগে বন্দুকটা নিচে ফেলে দাও, নইলে তোমাদের এই বন্ধুটিকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে।

মুহূর্তে সবার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। দীপু কিছু চিন্তা করতে পারছিল না, সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। শুধু মনে হচ্ছিল ওর জন্যেই বুঝি তারিক মারা পড়তে যাচ্ছে। নিজেকে নিজে বোঝাল, মাথা ঠান্ডা রাখো, মাথা ঠান্ডা রাখো।

ওয়ান–

নিচে থেকে সাহেবের ভারী গলা শুনে ওপরের ওরা সবাই চমকে উঠল। বাবু। ভাঙা গলায় বলল, দীপু বন্দুকটা ফেলে দে। তাড়াতাড়ি।

টু—

তাড়াতাড়ি ফেল দীপু-বাবু এবারে একেবারে কেঁদে দিল।

দীপু তাড়াতাড়ি চিন্তা করার চেষ্টা করল, বন্দুকটা ফেলে দিলেই ওদের সব ক্ষমতা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু দশ পর্যন্ত গোনার আগেই বন্দুকটা ফেলে দিতেই হবে। হয়তো তারিককে মারবে না, শুধু ভয় দেখাচ্ছে, কিন্তু জানের ঝুঁকি কখনও নেয়া যাবে না।

তবু একটা চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?

থ্রী!

দীপু গলা পরিষ্কার কর বলল, শোনো! তোমরা আসলে আমাদের ভয় দেখাচ্ছ। তারিককে মারলে পালাতে পারবে কোনোদিন এখান থেকে? পুলিশ এসে কাঁক করে ধরবে, তারপর একেবারে ফাঁসি।

সাহেবটি ইংরেজিতে কী বলল, বোধকরি জানতে চাইল দীপু কী বলছে। সাথের লোকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিতেই সাহেবটি আবার রেগেমেগে কি যেন বলল। লোকটি তখন বাংলায় বলল, সাহেব জিজ্ঞেস করছে, তোমরা কি দেখতে চাও খামোকা ভয় দেখাচ্ছে না সত্যি বলছে?

দীপু তাড়াতাড়ি বলল, না।

তা হলে বন্দুকটা ফেলে দাও।

ফেলছি, তার আগে আমাদের কথা শোনো।

কোনো কথা শুনব না, বন্দুকটা ফেলো।

শুনতে হবে।

শুনতে হবে, শুনতে হবে, শুনতে হবে, দীপু চিৎকার করে বলল, শুনতে হবে, এছাড়া বন্দুক ফেলব না।

নিচে থেকে লোকটি বলল, কী বলবে?

তোমরা জান তোমরা আটকা পড়ে গেছ। তোমরা এও জান যে তোমাদের। বের হবার আর কোনো রাস্তা নেই। তারিককে যদি মেরে ফেল আমরা কোনোদিন তোমাদের ছাড়ব না, পুলিশ ডেকে আনতে মোটে ঘন্টাখানেক লাগবে, তারপর সবার ফাঁসি হয়ে যাবে। তবে মুশকিল হল কী জান? তোমরা বুঝে গেছ তারিককে মেরে ফেলার ভয় দেখালে আমরা তোমাদের ছেড়ে দেবই, বন্ধুর জান নিয়ে তো আর খেলতে পারি না–

সাহেবটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেয়া পর্যন্ত দীপুর থামতে হল। সাহেবটি গর গর করে বলল, ও ভয়টয় দেখাচ্ছে না, একটু দেরি হলে ও সত্যি গুলি করে দেবে।

দীপু বলল, শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছ তোমরা। আসলে কোনোদিনও তোমরা গুলি করবে না, গুলি করলে উলটো তোমাদেরই ফাঁসি হয়ে যাবে। কিন্তু যদি আমাদের কথা শোন আমরা তোমাদের চলে যেতে দেব।

কী কথা?

শুনবে তা হলে?

বলো আগে।

দীপুর মুখে একগাল হাসি খেলে গেল। ওদের আটকে রাখার জন্যে এখন একটা বিশ্বাসযোগ্য গল্প বের করতে হবে। যদি সে বলে তারিককে ছেড়ে দিলে ওরা বন্দুক দিয়ে দেবে, তা হলে এরা রাজি হয়ে যাবে, কিন্তু ওদের বিশ্বাস নাও করতে পারে। বলবে ঠিক আছে বন্দুকটা আগে দাও! এমন একটা কিছু বলতে হবে যেন বিশ্বাস করে। কি বলতে পারে? কী? কী?

ঠিক তক্ষুনি ওর মাথায় বিদ্যুতের মতো খেলে গেল—টাকা, টাকা চাইতে হবে।

আমাদের দশ হাজার টাকা দাও, ছেড়ে দেব।

কী? দশ হাজার টাকা! লোকটা হাসির মতো শব্দ করল।

দীপুর নিজেরই একটু লজ্জা লাগছিল বলতে, কিন্তু ও জানে শুধু টাকার কথা বলেই ওদের আটকে রাখা যাবে। পৃথিবীতে অনেক মানুষই টাকাকে খুব ভাল করে চেনে।

ঠিক আছে, দীপু বলল, দশ হাজার দিতে না চাও পাঁচ হাজার দাও। তোমরা তো বিদেশে এই মূর্তি বিক্রি করে লাখ টাকা পাবে, আমাদের পাঁচ হাজার দাও।

ফাজলামি পেয়েছ? এক্ষুণি বন্দুকটা ফেলে দাও, না হয় সাহেব গুলি করে দেবে।

দীপু একটু আহত স্বরে বলল, তুমি একটু বলেই দ্যাখো না সাহেবকে সাহেব কী বলে।

অনেকক্ষণ কথা হল সাহেবের সাথে লোকটার। দীপুর একটু আশা হচ্ছিল। হয়তো তাদের বিশ্বাস করতেও পারে। সত্যি সত্যি ওদের বিশ্বাস করল, ভাবল সত্যিই টাকা পেলেই বুঝি ছেড়ে দেবে! লোকটা বলল, সহেব রাজি হয়েছে একশো। টাকা দেবে বলেছে।

দীপু হাসি আটকে রেখে বলল, একশো টাকা! এটা কি চিংড়ি মাছের বাজার, যে দরদাম করছ? পাঁচ হাজার টাকার এক পয়সা কম না।

দীপু বুঝতে পারছিল না কতক্ষণ সে এইভাবে দরদাম করে যাবে। বিরক্ত হয়ে যদি গুলি করে বসে? পুলিশ আসতে আর কত দেরি কে জানে।

দীপু খুব ঠান্ডা মাথায় আবার কথা শুরু করল, দেখ, একটু পরেই সূর্য উঠে যাবে, তখন তোমাদেরই পালাতে অসুবিধা হবে। রাজি হয়ে যাও, তোমাদের ভাল, আমাদেরও ভাল। আমরা কাউকে বলব না পর্যন্ত।

আমাদের কাছে এত টাকা নেই।

কত আছে?

দু-তিন শো।

আর কিছু নেই?

না।

ঘড়ি, ক্যামেরা? দীপুর নিজের উপরে ঘেন্না হচ্ছিল এভাবে কথা বলতে, কিন্তু না বলে করবে কী, ওদের বোঝাতেই হবে টাকা পেলেই ওরা খুশি!

না, আর কিছু নেই।

কী বলছ! নিশ্চয়ই সাহেবের হাতে ঘড়ি আছে।

দেয়া যাবে না। দিয়ে দাও না, সাহেব আরেকটা কিনে নেবে!

সবাই অবাক হয়ে দীপুকে দেখছিল। সে যে এরকম করে কথা বলতে পারে কে জানত! নেহায়েত দীপুকে খুব ভাল করে চেনে, নইলে বিশ্বাস করে ফেলত দীপু সত্যি টাকার জন্যে এরকম করছে!

লোকগুলো রাজি হোক দীপু চাচ্ছিল না, কিন্তু রাজি হয়ে গেল। বন্দুকটা ফেলে দিলেই ওরা তারিকের হাতে টাকা আর ঘড়ি দিয়ে উপরে পাঠিয়ে দেবে।

দীপু রাজি হল না, উঁহু বিশ্বাস করি না। বন্দুকটা ফেলে দিলে তোমরা শুধু তারিককে ছেড়ে দেবে, টাকা দেবে না।

বলছি দেব।

দেবে না। বললাম তো দেব।

বিশ্বাস করি না! আগে টাকা দিয়ে তারিককে পাঠাও আমরা বন্দুক ফেলে দেব, কথা দিলাম।

সাহেব রেগেমেগে কী যেন বলল, তখন দীপু আরেকটু নরম হল। বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, দু’জনের কথাই থাক। তারিক উঠে আসবে একপাশ দিয়ে, আরেক পাশ দিয়ে বন্দুকটা নামাব।

দীপুকে নিরাশ করে দিয়ে ওরা রাজি হয়ে গেল। এতেই ওর খুশ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তখনও সে চিন্তা করে যাচ্ছিল এর থেকে ভাল কিছু করা যায় কি না। তক্ষুণি তার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি খেলে গেল, কিন্তু একটু সময় দরকার। সময়টা কীভাবে পাবে? চিৎকার করে বলল, তারিক টাকা না গুনে নিস না, আর আসার সময় আমাদের শার্টগুলো নিয়ে আসিস, শীতে মারা যাচ্ছি।

তারিক বলল, আচ্ছা।

দীপু সবাইকে একপাশে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, কেউ একজন একটা ইট নিয়ে আয় বড় দেখে। আর রাশেদ, তুই ধর বন্দুকটা—আস্তে আস্তে নামাবি। কিন্তু খবরদার কেউ যেন ছুঁতে না পারে। আর সবাই শোন, আমি এই ইটটা লোকটার মাথায় ছেড়ে দেয়া মাত্র সবাই মিলে তারিককে ধরে হ্যাচকা টানে তুলে আনবি, আর রাশেদও বন্দুকটা টেনে নিবি। খবরদার তারিক আর বন্দুক দুইটাই যেন আসে।

অন্য সময় কখনও ওরা এ ধরনের ব্যাপারে রাজি হতো না। কিন্তু এতক্ষণ দীপু এত সব কাজকর্ম করেছে যে সবাই দীপুর উপর পুরোপুরি বিশ্বাস এনে ফেলেছে। কেউ আর আপত্তি করল না রাজি হয়ে গেল। 

তারিক নিচে থেকে বলল, তিন শো পুরা নেই। দুই শো আশি টাকা আছে।

দীপু বিরক্ত হবার ভান করে বলল, ঠিক আছে, তাই আন। কী আর করব।

নিচে থেকে লোকটা বলল, বন্দুকটা নামাও। 

রাশেদ সাবধানে বন্দুকের নলটা একটু নামাল, অমনি নিচে থেকে লোকটা চিৎকার করে উঠল, ওকি? গুলি করবে নাকি? উলটো করে নামাও। 

দীপু হাতে বড়সড় একটা ইট নিয়ে জিজ্ঞেস করল, তারিক উঠছিস? 

হ্যাঁ। এই উঠলাম এক পা। এই আরেক পা। 

রাশেদও বন্দুকটা নামাচ্ছে আস্তে আস্তে। তারিককে এখনও দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু উত্তেজনায় সবার বুক ধক ধক করছে, শেষ পর্যন্ত সব ঠিক ঠিক হয়ে যাবে তো? 

আস্তে আস্তে তারিকের মাথা দেখা গেল। বাবু ঠোটে আঙুল দিয়ে ওকে চুপ করে থাকতে বলল, তারিক বুঝে গেল কী হচ্ছে। সারা শরীর ওর টান টান হয়ে গেল সাথে সাথে। চোখ টিপে বলল, আমার পা ধরে রেখেছে, বন্দুকটা ছেড়ে দে এবারে। 

দিচ্ছি—বলে, দীপু আন্দাজ করে ইটটা ছেড়ে দিল। 

নিচে থেকে একটা প্রচন্ড চিৎকার শোনার সাথে সাথে রাশেদ বন্দুকটা আর অন্য সবাই তারিককে হ্যাচকা টান মেরে উপরে তুলে আনল।

দীপু চিৎকার করে বলল, খবরদার কেউ যদি বের হতে চেষ্টা কর গুলি করে ঘিলু বের করে ফেলব। 

নিচে থেকে গোঙানোর মতো একটা শব্দ শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু কেউ বের হবার চেষ্টা করল না। তারিকের পেটের ছাল ঘষা খেয়ে খানিকটা উঠে গেছে। কিন্তু সেরকম কিছু না, সে দীপুর পাশে বসে পড়ল, সাবধান দীপু, সাহেব কিন্তু সাংঘাতিক—ভয় লাগে দেখলে। তোরা সবাই হাতে ইট নিয়ে দাঁড়া, কেউ বের হতে চাইলেই–

নিচে থেকে সাহেবের প্রচন্ড চিৎকার শোনা গেল। রেগে কী যেন বলছে। হঠাৎ দুটি গুলির শব্দ বের হল ভেতর থেকে ছিটকে সরে গেল দূরে সবাই। নান্টু আবার কান্না কান্না হয়ে যাচ্ছিল, তারিকের ধমক খেয়ে সামলে নিল তাড়াতাড়ি। সবাই বেশ কয়টা করে ঢিল কুড়িয়ে নিয়ে তৈরি রাখল হাতের কাছে। 

দীপু যদিও ভয় দেখাচ্ছিল, যে, কেউ বের হতে চেষ্টা করলেই গুলি করে খুলি ফুটো করে দেবে কিন্তু ও খুব ভাল করে জানে যে কেউ যদি সত্যি বের হয়ে আসত ও কখনও গুলি করতে পারত না। ঢিল জমা করে তৈরি হবার পর ও অনেকটা নিশ্চিত হতে পারল, গুলি করার থেকে ঢিল মারা অনেক সোজা। 

তারিক ফিসফিক করে বলল, পুলিশকে খবর দিতে পাঠাবি না? আমি যাব? 

ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলল তারিককে, আস্তে আস্তে বলল, পাঠিয়েছি, এদের শুনিয়ে কাজ নেই, তা হলে বের হবার জন্যে অস্থির হয়ে পড়বে। 

তারিক একগাল হেসে তার পেটের ছাল ওঠা জায়গাটায় হাত বোলাল, বিড়বিড় করে বলল, ছাল উঠে গেছে শালার। 

ফেঁসে যে যাসনি–

ঠিক বলেছিস। শালার যা ভয় পেয়েছিলাম। বাসায় গিয়েই ফকিরকে পয়সা দেব। 

হঠাৎ করে ফুটো থেকে একটা মাথা অল্প একটু বের হল, অন্ধকারে বোঝা যায় দেশী না বিদেশী, কিন্তু কেউ একজন যে বের হতে চেষ্টা করছে তাতে সন্দেহ নেই। 

মার মার করে দশজনের অন্তত দু’শো ইট ছুটে গেল, আর লোকটা চিৎকার করে ভেতরে ঢুকে গেল। চিৎকার শুনে বোঝা গেল বিদেশিটা শেষ চেষ্টা করেছে। 

দীপু চিৎকার করে বলল, কেউ বের হতে চেষ্টা করলেই এই অবস্থা হবে। মিঠু সেটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে বলল, ট্রাই এগেন এন্ড উই উইল ব্রেক ইওর হেড উইথ ঢেলা। 

রাইট। সবাই খুশিতে চিৎকার করে উঠল, ব্রেক দ্যা হেড, ব্রেক দ্যা হেড, ব্রেক দ্যা হেড। 

ভেতর থেকে একটা গালির, আরেকটা গুলির শব্দ শোনা গেল। নিশ্চয়ই ওপর দিকে গুলি করছে, কিন্তু লাভ কী? 

দীপু স্ফুর্তিতে চুপ করে বসে থাকতে পারছিল না। বারবার তাকাচ্ছিল পুলিশ আসছে কি না দেখতে। পুলিশ এসে গেলেই নিশ্চিত হয়। বিলু বুদ্ধি করে, প্রথমেই ওর আব্বার কাছে গেলে হয়। 

ভাল করে চারদিকে তাকিয়ে দীপু বুঝতে পারল সকাল হয়ে আসছে। ওর সাহস বেড়ে গেল সাথে সাথে একশো গুণ। রাত শেষ হয়ে গেলেই বুঝি সাহস বেড়ে যায়। দীপুর মজা করার ইচ্ছে হল একটু। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, মূর্তি চোরারা তোমাদের বাড়ি কোথায়? 

ভেতর থেকে কোনো উত্তর এল না। তারিক বলল, ভয় করছে নাকি?

ভয় না ভয় না, লজ্জা।

সবাই হো হো করে হেসে উঠল। 

ভেতর থেকে হঠাৎ লোকটি ভাঙা গলায় কথা বলে উঠল, কী চাও তোমরা? কী জন্যে আটকে রেখেছ আমাদের? 

মিঠু বলল, কাবাব বানাব তোমাদের।

বাবু সাথে সাথে ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিল, থিফ ফ্রাই।

ইয়েস, উই উইল মেক থিফ ফ্রাই এন্ড ইট উইথ পটেটো। 

হো হো করে সবাই আবার হেসে উঠল। হাসি থামার সাথে সাথে শুনল, লোকটি বলছে, আমাদের বের হতে দাও, তোমরা যা চাইবে তা-ই দেব। 

সত্যি?

সত্যি।

বেশ তা হলে একজন একজন করে পা উপর দিকে তুলে বের হয়ে এসো। 

সবাই আবার হেসে ওঠে। অল্পতেই একেকজন কেন জানি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিল। 

দীপু চেঁচিয়ে বলল, শোনো মূর্তি চোরারা। তোমরা সাহেবকে বলে দাও, পুলিশ আসার পর তোমাদের টাকায় থুথু দিয়ে তোমাদের মুখে ছুঁড়ে দেব 

পুলিশ! ভিতর থেকে লোকটার কাতর গলার স্বর শোনা গেল, প্লীজ, পুলিশকে খবর দিও না। 

ঠিক তক্ষুণি দূরে একটা জীপের শব্দ শোনা গেল। এই গ্রামের রাস্তায় গাড়ি খুব একটা আসে না, কারও বুঝতে বাকি রইল না পুলিশ আসছে। আনন্দে চিৎকার করে উঠল দীপু, মূর্তি-চোরারা, শুনতে পাও? 

কী? 

পুলিশের গাড়ির শব্দ? আধ ঘণ্টা আগে তোক চলে গেছে পুলিশ ডাকতে, এতক্ষণ মশকরা করছিলাম তোমাদের সাথে। শালারা ভাবছে টাকার জন্যে! বেকুব কোথাকার-বলে তারিক টাকার বান্ডিল থেকে একটা দশ টাকার নোট সরিয়ে ফেলল। থুথু মেরে দশ টাকা কম ফেরত দিলে এমন আর কি ক্ষতি হবে? 

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল