দীপু নাম্বার টু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

সময় সংস্করণের ভূমিকা

আমি যখন পদার্থ বিজ্ঞানে পি.এইচ.ডি. করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছি তখন সেখানে আমি একেবারেই একা, বাংলায় কথা বলার একজন মানুষও নেই। পড়াশোনার প্রচণ্ড চাপ, সিয়াটলের মেঘে ঢাকা ধূসর আকাশ, গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টি, কনকনে শীত সব মিলিয়ে খুব মন খারাপ করা নিঃসঙ্গ একটা পরিবেশ। একাকীত্ব দূর করার জন্যে আমি তখন কল্পনায় একটা কিশোর তৈরি করে নিয়েছিলাম। তার নাম দিয়েছিলাম দীপু। যখন মন খারাপ হতো সেই কিশোরটি তখন আমাকে সঙ্গ দিতো, বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃষ্টিভেজা ক্যাম্পাসে পিঠে ব্যাকপেক নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই কাল্পনিক চরিত্রকে তার আপনজনদের প্রায় সত্যিকার মানুষদের মতো দেখতে পেতাম। এক সময় সেই কিশোর আর তার প্রিয় মানুষদের সুখ-দুঃখ আর অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনীটা লিখতে বসেছি, গভীর ভালোবাসা নিয়ে লিখে শেষ করেছি। লেখা শেষ হলে নাম দিয়েছি দীপু নাম্বার টু! দীপু নাম্বার টু এখনও আমার খুব প্রিয় উপন্যাস। আমার খুব সৌভাগ্য এই দেশের ছেলেমেয়েরা এই উপন্যাসটিকে ঠিক আমার মতোই গভীর ভালোবাসার সাথে গ্রহণ করেছিল। প্রায় তিন দশক আগে লেখা এই উপন্যাসটি আজ আবার নূতন আঙ্গিকে সময় প্রকাশন থেকে বের হতে যাচ্ছে, এই সময়টিতে আমি আমার শিশু কিশোর পাঠক পাঠিকাদের গভীর মমতার সাথে স্মরণ করছি।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১১.০৯.০৪
বনানী, ঢাকা

১.

ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে দীপুর হঠাৎ খুব খারাপ লাগল। প্রতি বছর ওর নতুন জায়গায় নতুন স্কুলে গিয়ে নতুন ক্লাসে ঢুকতে হয়। মোটামুটি ভাল ছাত্র সে–ফার্স্ট না হলেও পরীক্ষায় সেকেন্ড থার্ড হয় সহজেই। অথচ বরাবর ওর রোল নাম্বার হয় সাতচল্লিশ, না হয় আটান্ন। নতুন স্কুলে গেলে রোল নাম্বার তো পেছনে হবেই! রোল নাম্বারের জন্যে ওর তেমন দুঃখ নেই কিন্তু নিজের স্কুলে নিজের বন্ধুবান্ধবদের ছেড়ে নতুন জায়গায় অপরিচিত ছেলেদের মাঝে হাজির হতে ওর খুব বিচ্ছিরি লাগে। অথচ দীপুর প্রতি বছরই তা করতে হয়—ওর আব্বা শুধুমাত্র ওর জন্যেই নাকি এক বছর অপেক্ষা করেন, না হয় কোথাও নাকি তার তিন মাসের বেশি থাকতে ভাল লাগে না! পৃথিবীর সব কয়টা আব্বা একরকম, অথচ ওর আব্বা যে কেমন করে সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে গেলেন, দীপু এখনও বুঝে উঠতে পারে না।

ক্লাসটা বড়। দরজায় দাঁড়িয়ে সে দেখতে পায় হাজার হাজার মাথা-কুচকুচে কালো চুলের নিচে চকচকে চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দীপু লক্ষ করে দেখেছে, প্রথম দিন ওর বরাবরই মনে হয় ক্লাসে হাজার হাজার ছেলে, পরে কেমন করে জানি কমে আসে। ক্লাস টীচারকে দেখে ওর ভয় হল। বদরাগী চেহারা রেজিস্টার খাতা খুলছেন রোল কল করার জন্যে। দীপু দরজায় দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে বলল, আসতে পারি?

চোখ না তুলে বদরাগী ক্লাস-টীচার ভারী গলায় বললেন, না।

সারা ক্লাস হো-হো করে হেসে উঠল, আর দীপু থতমত খেয়ে দুর্বল গলায় বলল, তা হলে কি পরে আসব?

না-তোকে আর আসতেই হবে না।

সারা ক্লাস আবার উচ্চস্বরে হেসে ওঠে—দীপু লক্ষ করল বদরাগী স্যারটির চোখেও কেমন হাসি ফুটে উঠেছে। সাথে সাথে হঠাৎ করে দীপু বুঝতে পারল, স্যার ওর সাথে মজা করছেন। যে স্যার প্রথম দিনেই কারো সাথে মজা করতে পারেন তিনি আর যা-ই হোক বদরাগী হতে পারেন না—দীপুর বুকে সাহস ফিরে আসে সাথে সাথে। সে একটু হেসে বলল, কিন্তু স্যার, আমাকে আসতেই হবে।

আসতেই হবে? স্যার খানিকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, তা হলে

আয়

দীপু ভেতরে ঢুকল। স্যার কড় চোখে ওর দিকে তাকালেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এবারে বল, কেন তোকে আসতেই হবে।

আমি এই ক্লাসে ভর্তি হয়েছি।

গুল মারছিস?

না স্যার, সত্যি ভর্তি হয়েছি।

সত্যি? সত্যি।

ও! স্যার হতাশ হওয়ার ভান করে বললেন, তা হলে তো ওকে আসতে দিতেই হয়। কী বলিস তোরা?

পুরো ক্লাস মাথা নেড়ে সায় দিল! আর হঠাৎ করে দীপুর পুরো ক্লাস আর এই বদরাগী চেহারার মজার স্যার সবাইকে ভাল লেগে গেল। মাঝে মাঝে ওর এরকম হয়, হঠাৎ কাউকে ভাল লেগে যায়, কিন্তু পুরো ক্লাসকে একসাথে ভাল লেগে যাওয়া এই প্রথম।

এই স্কুলের নিয়ম-কানুন খুব কড়া জানিস তো?

দীপু মাথা নেড়ে বলল, সে জানে, যদিও ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না। স্যার মুখ গম্ভীর করে বললেন, নতুন কেউ আসার পর তাকে একটা লেকচার দিতে হয়।

দীপু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

এইখানে, ক্লাসের সামনে। তোকেও দিতে হবে।

দীপু মুখ কাচুমাচু করে বলল, আমি লেকচার দিতে পারি না স্যার—কোনদিন দেইনি।

সে আমি জানি না, তোকে দিতেই হবে। ঘড়ি ধরে পাঁচ মিনিট। স্যার হাত থেকে ঘড়ি খুলে চোখের সামনে ধরে বললেন, শুরু কর।

দীপুর মুখ শুকিয়ে গেল, শুকনো গলায় ঢোক গিলে আরেকবার স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যি স্যার, আমি এতজনের সামনে লেকচার দিতে পারব না। লেকচার দিতে হলে কী বলতে হয় আমি জানি না স্যার।

দশ সেকেন্ড পার হয়ে গেছে! বল, তাড়াতাড়ি বল।

কী বলব, স্যার?

এই—তুই কী করিস, কী করতে ভালবাসিস, কী খাস, কী পড়িস এইসব বলবি। নে, শুরু কর–

দীপু আরেকবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, সত্যি বলছি স্যার, আমি পারব না।

ঠিক আছে, যদি না পারিস এখানে দাঁড়িয়ে থাক পাঁচ মিনিট, আর তোরা সবাই চোখ বড় বড় করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাক।

বোঝাই যাচ্ছে, ছেলেগুলো এই স্যারের খুব বাধ্য। আদেশ পাওয়ামাত্র সবাই চুপচাপ চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল, দীপু যেদিকে তাকায় দেখতে পায় একজোড়া চোখ ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। পাঁচ মিনিট এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ভেবে ভয়ে ওর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। দুর্বল গলায় বলল, ঠিক আছে স্যার, আমি বলছি। সে গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করল, অ্যাঁ—আমার নাম মুহম্মদ আমিনুল আলম, আমি ক্লাস এইটে পড়ি।

ক্লাস এইটে পড়িস, সে তো সবাই জানে, না হয় এই ক্লাসে আসবি কেন? যেসব কেউ জানে না সেসব বল।

আমি এর আগে ক্লাস সেভেনে ছিলাম বগুড়া জিলা স্কুলে, ক্লাস সিক্সে ছিলাম। চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলে, ক্লাস ফাঁইভে থাকতে পড়তাম বান্দরবান হাই স্কুল, ক্লাস ফোরে পচাগড় প্রাইমারি স্কুলে, ক্লাস থ্রীতে কিশোরীমোহন পাঠশালা, সিলেটে, তার আগে—ক্লাস টুতে ছিলাম—অ্যাঁ-অ্যাঁ—দীপু মাথা চুলকাতে থাকে মনে করার জন্যে। মনে করতে না পেরে বলল, রাঙামাটিতে, স্কুলটার নাম মনে নেই, ক্লাস ওয়ানে ছিলাম শেখঘাট জুনিয়র স্কুলে—

সবাই হা করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল! স্যারও একটু অবাক হয়ে বললেন, তুই কি বছর বছর স্কুল বদলাস নাকি?

আমার বদলাতে ভাল লাগে না, কিন্তু আমার আব্বা প্রত্যেক বছর নতুন জায়গায় যান, তাই আমারও যেতে হয়।

হুঁ। স্যার আবার গম্ভীর হয়ে বললেন, লেকচার শেষ কর। মাত্র এক মিনিট হয়েছে।

মাত্র এক মিনিট! দীপুর গলা আবার শুকিয়ে যায়। করুণ মুখে সে স্যারের দিকে তাকাল, স্যার ওকে সাহস দিলেন, চমৎকার হচ্ছিল তো! শুরু কর আবার—কী করতে ভালবাসিস, কী পড়তে ভালবাসিস, কী খেলতে ভালবাসিস, এইসব বল।

দীপু আবার শুরু করল, আমি ডিটেকটিভ বই পড়তে খুব ভালবাসি। আমি অনেকগুলো ভিকেটটিভ বই পড়েছি। তার মাঝে সবচেয়ে ভাল হচ্ছে—দীপু হঠাৎ থেমে গেল, কারণ, ঠিক বুঝতে পারল না নামটা বলা উচিত হবে কি না। একটু ভেবে বলেই ফেলল—প্রেতপুরীর অট্টহাসি? বইটা আমার কাছে আছে, কেউ পড়তে চাইলে আমি তাকে দিতে পারি।

পড়েছি! আমি পড়েছি! ক্লাসের অর্ধেকের বেশি ছেলে চেঁচিয়ে উঠল, আর সাথে সাথে দীপু বুঝতে পারল ছেলেগুলোর সাথে বন্ধুত্ব হতে ওর দেরি হবে না।

এ ছাড়াও আমি অ্যাডভেঞ্চারের বই পড়ি। যেমন–যক্ষের ধন, আবার যক্ষের ধন, তারপর টম সয়ার, হাক ফিনের দুঃসাহসিক অভিযান।

স্যার দীপুকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তোরা কে কে মার্ক টোয়েনের টম সয়ার আর হাক ফিনের বই পড়েছিস?

মাত্র দুটি হাত উঠল। স্যার বললেন, খুব ভাল বই, সবার পড়া উচিত! আছে তোর কাছে বই দুটি?

আছে স্যার।

তোর বন্ধুদের পড়তে দিস।

দেব স্যার।

হুঁ, এবারে শেষ কর তোর লেকচার।

দীপু আবার শুরু করল, গল্পের বই ছাড়া আমার খেলতে ভাল লাগে। বগুড়া জিলা স্কুলে থাকতে ক্লাস এইটকে আমরা হারিয়ে দিয়েছিলাম।

মোটাসোটা একটা ছেলে পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল, কোন জায়গায় খেল? সেন্টার ফরোয়ার্ড?

না, আমি রাইট আউট ছিলাম। সেন্টার ফরোয়ার্ড খেলি মাঝে মাঝে মাঝে মাঝে ব্যাকেও খেলি।

স্যার সাবধানে হাসি গোপন করলেন। তিনি খুব ভাল করে জানেন শুধুমাত্র নামেই সেন্টার ফরোয়ার্ড আর রাইট আউট। এই বয়েসী ছেলেদের খেলা শুরু হলে দেখা যায়, বল যেখানে, গোল কীপার ছাড়া সবাই সেখানে দাপাদাপি করছে।

এ ছাড়া ব্যাডমিন্টনও খেলি, কিন্তু কর্কের দাম এত বেশি হয়ে গেছে যে, সবসময় খেলতে পারি না। কয় মিনিট হয়েছে, স্যার?

আড়াই মিনিট।

মাত্র আড়াই মিনিট?

হুঁ, শুরু কর আবার।

সব তো বলে ফেলেছি, আর কী বলব?

কী কী করতে পারিস এইসব বল।

কিছু করতে পারি না।

কিছু পারিস না? ছবি আঁকতে? গান গাইতে? সাইকেল চালাতে? সাঁতার কাটতে? মারামারি করতে?

দীপু মাথা নেড়ে বলল, আমি সীটে বসে সাইকেল চালাতে পারি, সাঁতারও দিতে পারি, ছবি আঁকতে পারি না, ড্রয়িং পরীক্ষায় আমি সবচেয়ে কম নাম্বার পাই। আর আমি গানও গাইতে পারি না।

মারামারি? সামনের বেঞ্চের একটা ছেলে ওকে মনে করিয়ে দিল।

ও হ্যাঁ, আমি অল্প অল্প মারামারিও করতে পারি।

অল্প অল্প মারামারি আবার কী জিনিস? স্যার একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলেন।

দীপু মাথা চুলকে বলল, মানে ঠিক-একে মারামারি না, তবে কেউ যদি আমার সাথে মারামারি করতে চায় শুধু তা হলেই একটু ইয়ে—মানে অল্প অল্প—একটু একটু–

ও! ও! বুঝেছি, তুই নিজে থেকে করিস না, তবে কেউ করতে চাইলে না করিস না, এই তো?

সারা ক্লাস হেসে উঠল এবং দীপু নিজেও হেসে ফেলল।

এখনও দেড় মিনিট বাকি। নে, শুরু কর আবার।

দীপু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাতে লাগল। আর কী সে করতে পারে মনে করার চেষ্টা করতে করতে হঠাৎ ওর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। একগাল হেসে বলল, আমি বই বাঁধাই করতে পারি, আর শর্ট সার্কিট হয়ে ফিউজ পুড়ে গেলে মেইন সুইচের ফিউজ বদলে ঠিক করে ফেলতে পারি।

কী বললি? শর্ট সার্কিট হয়ে–

হ্যাঁ, শর্ট সার্কিট হলে ফিউজ পুড়ে যায় তো, তখন মেইন সুইচ অফ করে ব্রিজটা খুলে নিয়ে একটা চিকন তার ওখানে লাগিয়ে দিলে আবার সব ঠিক হয়ে যায়।

তুই ঠিক করিস ওভাবে?

হ্যাঁ, যখন দরকার হয়। খুব সহজ, আমার আব্বা আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন।

স্যার চুপ করে রইলেন। ক্লাস এইটের ছেলেকে যে-আব্বা মেইন সুইচ খোলা শিখিয়েছেন তাঁকে একবার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল।

আর বই বাঁধাইয়ের কথা কী বললি?

হ্যাঁ, আমি বইও বাঁধাই করতে পারি। আমাদের বাসায় অনেক বই ছিঁড়ে গিয়েছিল, তাই আমার আব্বা আমাকে বলেছিলেন আমি যদি বই বাঁধাই করি, তা না হলে দুটো বই বাঁধাই করার জন্যে এক টাকা করে দেবেন। প্রথম প্রথম খুব, বিচ্ছিরি হতো, পরে আমি বুক বাইন্ডিংয়ের দোকানে বসে থেকে দেখে দেখে শিখেছি। সেলাই করার পর শুধু প্রেস থেকে কাটিয়ে আনতে হয়, এখন আমি দোকানের মতো করে করতে পারি।

ও! খুব ভাল। স্যার ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোরা আর কেউ বই বাঁধাই করতে পারিস?

একটি ছেলে হাত তুলল, ওর আব্বা বুক বাইন্ডার, কাজেই সে তো পারবেই। স্যার বললেন, সবারই কিছু কিছু সত্যিকারের কাজ জানা উচিত। এখন তোরা ছোট আছিস, বড়রা তোদের কিছু করতে দেবে না, কিন্তু সুযোগ পেলে শিখে নিবি। তারপর দীপুর দিকে তাকিয়ে বললেন, নে, তোর লেকচার শেষ, টাইম ওভার। ভালই বলেছিস। একটু থেমে বললেন, কয় ভাইবোন তোরা?

আমি একাই। আমাদের বাসায় শুধু আমি আর আমার আব্বা।

তোর আম্মা?

মুহূর্তের জন্যে দীপু থেমে গেল। ও জানে, যেই সে বলবে তার আম্মা মারা গেছেন, অমনি সবাই কেমন করে জানি তার দিকে তাকাবে ওর জন্যে সবার মায়া হবে। এটা ওর একটুও ভাল লাগে না। ওর আম্মার কথাও মনে নেই, কখনও দেখেওনিঃ আম্মার জন্যে ওর কখনও মন খারাপও হয়নি, কিন্তু সবাই মনে করবে ও বুঝি খুব দুঃখী। দীপু একটু দ্বিধা করে বলল, আমার আম্মার মারা গেছেন।

ও! স্যার খুব অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন, আর দীপু যা ভেবেছিল ঠিক তা-ই হল। সারা ক্লাস হঠাৎ করে একেবারে চুপ করে গেল। কয়েক মুহূর্ত কোনো শব্দ নেই, সমস্ত ক্লাস চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দীপু একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমার আব্বা খুব ভাল, আমার আম্মা নেই বলে আমার কোনো অসুবিধা হয় না।

ও! স্যার একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, কবে মারা গেছেন তোর আম্মা?

মনে নেই আমার, আমি কোনোদিন দেখিনি।

হুম! স্যার খানিকক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকে বললেন, এবার তোর নামটা আবার বল দেখি খাতায় লিখে নিই।

দীপু তার নাম বলল, মুহম্মদ আমিনুল আলম।

তোর আব্বা কি তোকে মুহম্মদ আমিনুল আলম বলে ডাকেন?

না, দীপু বলে ডাকেন।

কী বললি? স্যার চোখ কুঁচকে তাকালেন। দীপু।

অ্যাঁ? দীপু? আমাদের যে আরেকটা দীপু আছে! দুইটা দীপু হয়ে গেল যে, কী মুশকিল! কোথায় এক নাম্বার দীপু?

ক্লাসে কয়েকটা ছেলে মিলে একজনকে ঠেলে দাঁড় করিয়ে দিল এবং বলল, এই যে, এই যে দীপু।

স্যার মুখ গম্ভীর করে বললেন, তা হলে কী করা যায়? দুজনের এক নাম হয়ে গেলে তো মুশকিল! একজনের অঙ্ক ভুল হয়ে গেলে আরেকজন পিটুনি খাবে যে!

স্যারের মুখ দেখে মনে হল সত্যিই বুঝি এটি একটি বড় সমস্যা। একজন হালকা পাতলা ছেলে হাত তুলে বলল, নাম্বার দিয়ে দেন দুজনের। একজন এক নাম্বার, একজন দুই নাম্বার।

সারা ক্লাস মাথা নেড়ে সায় দিল। কাজেই দীপুর আর কিছু বলার থাকল না।

স্যার একটু হেসে বললেন, তা হলে তুই দীপু নাম্বার টু।

সেই থেকে দীপু আর দীপু রইল না, হয়ে গেল দীপু নাম্বার টু।

নতুন স্কুলে এসে এবারে দীপু খুব তাড়াতাড়ি সবার সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলল। সাধারণত এরকমটি হয় না, কিন্তু ওদের এই ক্লাসটি সত্যিই ভাল। বোধ হয় ক্লাস টীচারটি ভাল বলেই। শুধু একটি ছেলের সাথে তার গন্ডগোল বেধে গেল প্রথম দিন থেকেই। ছেলেটি বয়সে একটু বড়। স্বাস্থ্য খুব ভাল নয়, কিন্তু বোঝা যায় গায়ে খুব জোর। নাম তারিক, ছেলেরা আড়ালে তারিক গুন্ডা বলে ডাকে। সামনাসামনি ডেকে ফেললেও সে খুব একটা রাগ হয় না। বরং একটু খুশিই হয় বলে মনে হয়। প্রথম দিনেই তারিক এসে দীপুর পেছনে চাটি মেরে জিজ্ঞেস করল, এই, তুই বই বাঁধাই করতে পারিস?

দীপু চটে উঠলেও ঠাণ্ডা গলায় বলল, খুব বেশি খাতির না হলে আমি কাউকে তুই করে বলি না। তোমার সাথে আমার এখনও খুব বেশি খাতির হয়নি।

তারিক হলুদ দাঁত বের করে হেসে বলল, খাতির-ফাতির বুঝি না, আমি সবাইকে তুই করে বলি, তোকেও বলব।

ঠিক আছে বলো, আমিও বলব।

কী বলবি?

আমি তুই করে বলব।

আমাকে তুই করে বলবি?

একশবার।

দীপুর পাশে বসে থাকা ছেলেটি, বাবু নাম, দীপুকে একটা চিমটি কাটল। কিন্তু দীপু তেমন গা করল না। ও জানে, এখন সে যদি তারিককে জোর খাটাতে দেয়, সে বরাবর জোর খাঁটিয়ে যাবে। তারিক খানিকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু বলে চলে গেল।

পাশে বসে থাকা বাবু ফিসফিস করে বলল, সর্বনাশ! তারিকের সাথে ঝগড়া করতে চাইছ?

কে বলল আমি ঝগড়া করতে চাইছি?

ও যা বলে শুনে যাও, এ ছাড়া বাবা বারোটা বাজিয়ে দেবে।

কী করবে? পেটাবে?

ওকে চেন না তুমি, ও সব করতে পারে। একবার মিউনিসিপ্যাল স্কুলের খেলার পর ওদের হাফ ব্যাককে চাকু মেরেছিল, জান?

দীপু কিছু বলল না। সব স্কুলেই এরকম একটি-দুটি ছেলে থাকে, গায়ে বেশি জোর বলে নিরীহ ভাল ছেলেগুলোকে উৎপাত করে বেড়ায়। দীপু যদি একটু নরম হয়ে থাকে, তা হলেই তারিক বেশি কিছু বলবে না, কিন্তু কেন দীপু নরম হয়ে থাকবে?

এর পরের ক’দিন তারিক ওকে এড়িয়ে গেল, দীপুও আর নিজে থেকে কিছু বলল না। আবার তারিকের সাথে ওর গন্ডগোল লাগল ড্রিল ক্লাসে। প্রতি বুধবার বিকেলে ড্রিল ক্লাস, বরাবর সে দেখে এসেছে ড্রিল ক্লাস হয় সবচেয়ে মজার—লাফ ঝাঁপ হৈচৈ ফুর্তি, অথচ এখানে দেখল ড্রিল ক্লাসে যাবার আগে সবার চোখমুখ। শুকিয়ে গেছে। বাবুর কাছে শুনতে পেল ড্রিল-স্যারটি নাকি আগে মিলিটারিতে ছিলেন, আর ছেলেদের একবারে মিলিটারিদের মতো খাঁটিয়ে নেন, মারপিট করেন ইচ্ছেমতো। মার খেতে কখনও ভাল লাগে না, কিন্তু ড্রিল ক্লাসে মারপিট করার সুযোগটা হয় কীভাবে সেটা দীপু বুঝতে পারল না। এখানে তো আর বাড়ির কাজ বা পড়া মুখস্থ নেই।

ব্যাপারটা বুঝতে পারল একটু পরেই। ড্রিল-স্যার মাঠে রোদের মাঝে সবাইকে লাইন বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন, এক দৌড়ে ঐ দেয়াল ছুঁয়ে ফিরে আসবে। আজকে শেষ দশজন।

দীপু একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, শেষ দশজন মানে?

শেষ দশজন পিটুনি খাবে। অন্য সময় শেষ পাঁচজন খেত। তুমি দৌড়াতে পার তো?

দীপু মাথা নাড়ল।

হুঁ বাবা-দৌড়াতে না পারলে বেতের বাড়ি খেতে হবে।

ড্রিল-স্যার হুইসেল দিতেই সবাই প্রাণপণে ছুটতে লাগল। দেয়ালটি মাঠের আরেক মাথায়। ছুটতে ছুটতে দম বেরিয়ে যেতে চায়। দীপু মোটামুটি প্রথম দিকেই ছিল, কিন্তু হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পা বেঁধে পড়ে গেল। মাটিতে আছড়ে পড়ার আগের মুহূর্তে দেখল তারিক হলুদ দাঁত বের করে হাসতে হাসতে ওর ওপর দিয়ে ঝাঁপিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে পা বাধিয়ে সে-ই দীপুকে ফেলে দিয়েছে।

দীপু বুঝতে পারছিল ও যদি উঠে আবার দৌড়াতে শুরু না করে তা হলে বেত খেতে হবে, কিন্তু এমন লেগেছে পায়ে যে, ওঠার শক্তি নেই। চোখে পানি এসে যাচ্ছিল যন্ত্রণায়। কোনোমতে সামলে নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল, তারপর পা টেনে টেনে দৌড়াতে লাগল। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করেও সে পারল না, শেষ দশজনের ভেতর থেকে গেল।

প্রচণ্ড মারতে পারেন ড্রিল-স্যার। দীপু বেশ শক্ত ছেলে, তবু ওর চোখে পানি এসে গেল প্রায়। ওর নিজের থেকে বেশি খারাপ লাগল টিপু আর সাজ্জাদের জন্যে। টিপু ফার্স্ট বয়। খুব ভাল ছেলে, কিন্তু দৌড়াতে পারে না ভাল, কাজেই প্রতি বুধবারে স্যার ওকে পিটিয়ে সুখ করে নেন। সাজ্জাদের কথা আলাদা; এত দুর্বল যে, ওর দৌড়ানের কোনো প্রশ্নই আসে না, কিন্তু ড্রিল-স্যার কিছুই শুনবেন না।

পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ড্রিল ক্লাসটি মনে হল পঁয়তাল্লিশ ঘণ্টা লম্বা। ক্লাসের শেষে সবাই একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। ছুটির ঘণ্টা যখন পড়ল তখন সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আছাড় খেয়ে দীপুর পায়ে বেশ লেগেছে, ছুটির পর ও যখন বাসায় ফিরে যাচ্ছিল তখন সে অল্প অল্প খোঁড়াচ্ছে।

রাস্তার মোড়ে ওর তারিকের সাথে দেখা হল। হাতে একটা সিগারেট আড়াল করে ধরে রেখেছে। ওকে দেখে দাঁত বের করে হেসে বলল, কীরে বুক বাইন্ডার!

দীপু কথা না বলে হেঁটে যেতে লাগল। তারিক এদিক সেদিক তাকিয়ে সিগারেটে দুটি লম্বা টান দিয়ে সিগারেটটি ফেলে দিয়ে ওর পাশে পাশে হেঁটে যেতে থাকে। ইচ্ছে করে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, কীরে আমার কয়টা বই বাইন্ডিং করে দিবি?

দীপু অনেক কষ্ট করে সহ্য করে যাচ্ছিল। যদিও ভেতরে ভেতরে ও রাগে ফেটে পড়তে চাইছিল, তবুও ঠান্ডা গলায় বলল, দেব।

কত করে পয়সা নিবি?

পয়সা নেব না।

ফ্রী করে দিবি? কেন ফ্রী করে দিবি?

এমনি।

এমনি বুঝি কেউ বই বাইন্ডিং করে দেয়? আমি কি তোর ইয়ে নাকি যে ফ্রী করে দিবি?

দীপুর মুখ রাগে লাল হয়ে ওঠে। দাঁড়িয়ে পড়ে শার্টের হাতা গুটিয়ে তারিকের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, শোন তারিক, তুই কি আমার সাথে ঝগড়া করতে চাস?

তারিক একটু থতমত খেয়ে বলল, কেন? ঝগড়া করতে চাই কে বলল?

তা হলে এরকম করছিস কেন? তুই দৌড়ের মাঠে আমাকে ল্যাং মেরে ফেলে মার খাইয়েছিস। এখন আবার আজেবাজে কথা বলে আমাকে খ্যাপাতে চাইছিস? কেন? মারামারি করবি আমার সাথে?

খুব যে চোখ লাল করছিস আমার উপরে?

দ্যাখ তারিক; আমাকে টিপু, সাজ্জাদ বা বাবু পাসনি যে তুই যা ইচ্ছে বলবি, আর আমি চুপ করে থাকব। যদি আমার সাথে মারামারি করতে চাস, আয়, আমি কাউকে ভয় পাই না। আর যদি না চাস, সোজা তুই তোর বাসায় যা, আমি আমার বাসায় যাই।

দীপু খুব যে একটা মারপিট করে অভ্যস্ত তা নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে সে যেরকম জোর গলায় তারিককে সাবধান করে দিল যে, তারিক আর ওকে ঘটাতে সাহস করল না। মুখ বাঁকা করে হেসে বলল, খুব উঁট মারছিস? এমন ধোলাই দেব একদিন যে বাপের নাম ভুলে যাবি।

আজকেই দে-না, এখনই দে-না।

তারিক খানিকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে হেঁটে পাশের গলিতে ঢুকে গেল।

বাসায় ফিরে যেতে যেতে দীপু বুঝল, ব্যাপারটা ওর জন্যে বেশি ভাল হল না, কিন্তু ওর কিছু করার ছিল না।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল