ট্রলারটা জাহাজের পাশে এসে থামল, তখন একজন একজন করে সবাই জাহাজে উঠতে থাকে। আলমগীর ভাই জিজ্ঞেস করলেন, “সবাই এসেছে?”

তৃষা বলল, “হ্যাঁ এসেছে। এটা লাস্ট ট্রিপ।”

ভোরবেলা সমুদ্রের মোহনায় জাহাজটা নোঙর করেছে। তখন ট্রলারে করে সবাইকে কাছাকাছি একটা দ্বীপে নামানো হয়েছে। এখানে চমৎকার একটা বালুবেলা আছে, বালুবেলার পাশে গহিন জঙ্গল। সবাই সেখানে সময় কাটিয়ে জাহাজে ফিরে এসেছে, সবাইকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তাড়াহুড়া ছিল। কারণ একটু পরেই ভাটা শুরু হবে। তারা যে পথ দিয়ে ফিরে যাবে সেটা সরু একটা চ্যানেল, ভাটার সময় সেখানে পানি কমতে থাকে। পানি বেশি কমে গেলে সেই পথ দিয়ে যাওয়া যায় না। যারা জাহাজে আছে তারা সবাই আবিষ্কার করেছে, নদী আর সমুদ্র যেখানে একে অন্যের সাথে মিলে একাকার হয়ে যায় সেখানে সবাইকে প্রতি মুহূর্তে এই জোয়ার-ভাটা নিয়ে সতর্ক থাকতে হয়। এখানকার মানুষের জীবন জোয়ার আর ভাটার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে চলে।

জাহাজের একজন মানুষ জিজ্ঞেস করল, “জাহাজটা তা হলে ছেড়ে দিই।”

আলমগীর ভাই মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ ছেড়ে দেন।”

তৃষা বলল, “এক সেকেন্ড। শেষবারের মতো নিশ্চিত হয়ে নিই, সবাই এসেছে কি না। কাউকে এই দ্বীপে ফেলে এলে সেটা ভালো হবে না।”

সে এদিক-সেদিক তাকায়, রাতুল কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল, তৃষা জিজ্ঞেস করল, “সব বাচ্চারা এসেছে?”

“এসেছে।”

“বড়রা?”

“জানি না, আমি খেয়াল করিনি। একটু খেয়াল করে সবাই সবাইকে দেখে নিলেই হয়।”

কাজেই সবাই সবাইকে দেখতে শুরু করল। হঠাৎ নাট্যকার বাতিউল্লাহ বললেন, “শাহরিয়ার মাজিদকে দেখছি না। তার কেবিনে আছেন?”

দেখা গেল কেবিনে নেই। কোনো বাথরুমে নেই। জাহাজের ছাদেও নেই। বাতিউল্লাহ বললেন, “শাহরিয়ার মাজিদ দ্বীপে গিয়েই কেমন যেন উড়া উড়া হয়ে গেল। আমাকে বলল, আমি এখানেই বসত করব।”

“এখানে বসত করবেন মানে?”

“কবি মানুষ, কখন মাথায় কী আসে কে বলবে?”

খানিকক্ষণ খোজাখুঁজি করে সবার সাথে কথা বলে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হল, জাহাজ থেকে দ্বীপে যাওয়ার সময় অনেকেই তাকে দেখেছে। আসার সময় কেউ দেখেনি। যার অর্থ, কবি শাহরিয়ার মাজিদ দ্বীপটাতে রয়ে গেছেন–কে জানে হয়তো বসত করে ফেলেছেন।

তৃষা বলল, “গিয়ে খুঁজে নিয়ে আসতে হবে। কে যাবি?”

রাতুল বলল, “ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি।”

রাতুলের সাথে একজন আনসার এবং আরও কয়েকজন দ্বীপটিতে শাহরিয়ার মাজিদকে খুঁজতে রাজি হয়ে গেল। তাকে শেষবার দ্বীপের কোন অংশে দেখা গেছে সেটা শুনে তারা ট্রলারে উঠে বসে। জাহাজের মানুষজন খুব বিরক্ত হয়ে বলল, “আমাদের কিন্তু খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। এক্ষুনি যদি রওনা না দিই, পৌঁছাতে পারব না। তখন সমুদ্র ঘুরে যেতে হবে।”

আলমগীর ভাই বললেন, “কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নাই। একজন মানুষকে তো ফেলে রেখে যেতে পারি না।”

“আপনি বুঝতে পারছেন, পুরা ব্যাপারটা বিপজ্জনক হয়ে যাবে।”

“কেন, বিপজ্জনক কেন?”

“সমুদ্রে ডুবোচর থাকে। যদি আটকে যাই তা হলে মহাবিপদ। এমনিতেও জায়গা ভালো না–”

“ভালো না মানে?”

“বলতে চাচ্ছিলাম না। খামোখা ভয় পাবেন। সুন্দরবনে ডাকাতের উৎপাত থাকে।”

“ডাকাত?”

“জে।”

আলমগীর ভাই দুশ্চিন্তিত মুখে গাল চুলকালেন।

তৃষা বলল, “আপনি চিন্তা করবেন না। রাতুল গিয়েছে তো, সে খুঁজে বের করে নিয়ে আসবে।”

.

রাতুল খুব সহজেই শাহরিয়ার মাজিদকে খুঁজে বের করে ফেলল। সমুদ্রের তীরে একটা ঝাউগাছের নিচে একটা নোট বই আর একটা বল পয়েন্ট কলম নিয়ে বসে আছেন। তারা সবাই মিলে তার নাম ধরে ডাকাডাকি করেছে। কিন্তু এই মানুষটি এত কাছে বসে থেকেও না শোনার ভান করে বসে আছে। রাতুল শাহরিয়ার মাজিদের কাছে গিয়ে তাকে ডাকল, “স্যার।”

শাহরিয়ার মাজিদ তার দিকে না তাকিয়ে বললেন, “উঁ।”

“আমরা আপনাকে খুঁজছি। আপনাকে ডাকছিলাম, আপনি শোনেননি?”

“শুনব না কেন? শুনেছি।”

“তা হলে উত্তর দিলেন না কেন? সবাই ভাবছে কিছু না কিছু হয়ে গেছে।”

শাহরিয়ার মাজিদ তার কথার উত্তর না দিয়ে বল পয়েন্ট কলমটার গোড়া কামড়াতে কামড়াতে নোট বইয়ের কাগজটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

রাতুল একটু অধৈর্য হয়ে বলল, “জাহাজের সবাই অপেক্ষা করছে। আপনি গেলে জাহাজ ছেড়ে দেবে। ভাটা শুরু হয়ে গেছে–এই মুহূর্তে রওনা না দিলে আমরা আটকে যাব।”

শাহরিয়ার মাজিদ বললেন, “উঁ।” তারপর তার নোট বইয়ে কয়েকটা শব্দ লিখলেন, দেখে মনে হল না জাহাজ ছাড়া নিয়ে তার কোনো চিন্তা আছে।

রাতুল আবার ডাকল, “স্যার।”

শাহরিয়ার মাজিদ এই প্রথমবার রাতুলের দিকে তাকালেন, অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, “কেন আমাকে বিরক্ত করছ। তুমি দেখছ না আমি একটা কবিতা লিখছি?”

রাতুল কী বলবে বুঝতে পারল না। একজন মানুষ যে এ রকম হতে পারে সে কল্পনাও করতে পারে না। মরিয়া হয়ে বলল, “আপনি জাহাজে গিয়ে লিখেন–”

শাহরিয়ার মাজিদ চোখ পাকিয়ে রাতুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ছেলে, আমি তোমার ঔদ্ধত্য দেখে হতবাক হয়ে যাচ্ছি। তুমি কবি শাহরিয়ার মাজিদকে বলছ সে কোথায় কবিতা লিখবে?”

রাতুল দুই হাত তুলে পিছিয়ে গেল, শাহরিয়ার মাজিদ আবার তার নোট বইয়ের ওপর ঝুঁকে একটা শব্দ লিখলেন, তার মুখে একটা সম্ভষ্টির ছাপ পড়ল।

আনসার মানুষটি রাতুলের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করে জানতে চাইল, “কী হচ্ছে?”

রাতুল ইঙ্গিতে জানাল–সে কিছু জানে না।

আনসার মানুষটি তখন রাতুলকে ডেকে এক পাশে নিয়ে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, “মাথায় গোলমাল আছে?”

রাতুল ফিসফিস করে বলল, “বিখ্যাত কবি। কবিতা লেখার ভাব এসেছে।”

“জাহাজে যাবে না?”

“মনে হয় না।”

“জোর করে ধরে নিয়ে যাই? আমি একদিকে ধরি, আপনি অন্যদিকে ধরেন।”

“মাথা খারাপ? এরা সেলিব্রেটি মানুষ, এদেরকে ঘাটাতে হয় না।”

“কিন্তু—কিন্তু–” আনসার মানুষটি কী বলবে বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে রাতুলের দিকে তাকিয়ে রইল।

রাতুলের সাথে আরও দুজন এসেছে। তারা রাতুলের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এখন কী করি?”

“আমি জানি না। এরা সেলিব্রেটি মানুষ, আমি এর মাঝে দুইজনকে ঘাঁটিয়ে বিপদের মাঝে আছি। তিন নম্বরকে ঘাঁটাতে পারব না।”

“তা হলে?”

“তোমরা গিয়ে বলে দেখো।”

“বলব?”

“আমাকে জিজ্ঞেস করো না। আমি এর মাঝে নেই।” বলে রাতুল অন্য একটা ঝাউগাছে হেলান দিয়ে বসে গেল। সামনে বালুবেলা, দূরে সমুদ্র, পরিষ্কার নীল আকাশ। সেখানে কয়েকটা গাঙচিল উড়ছে। এ রকম একটা জায়গায় এসে কবি শাহরিয়ার মাজিদের ভাব এসে যাবে তাতে অবাক হওয়ার কী আছে?

ছেলেটি শাহরিয়ার মাজিদকে ওঠার কথা বলে একটা রাম ধমক খেয়ে মুখ কালো করে ফিরে এসে বলল, “চলো ফিরে যাই।”

“ফিরে যাব?” রাতুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “না নিয়ে?”

“হ্যাঁ, যেতে না চাইলে তো আর জোর করে নিতে পারি না।”

“তোমাদের কারও কাছে মোবাইল আছে? থাকলে তৃষাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করো এখন কী করব? আমার মোবাইলে চার্জ নেই।”

একজনের মোবাইলে নেটওয়ার্কের হালকা একটা চিহ্ন দেখা গেল। কয়েকবার চেষ্টা করার পর তৃষা ফোন ধরল, ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, “হ্যালো, কী হয়েছে? পাওয়া যায় নাই?”

“পাওয়া গেছে। কিন্তু স্যার আসতে চাইছেন না।”

তৃষা অবাক হয়ে বলল, “আসতে চাইছেন না মানে?”

“আসতে চাইছেন না মানে আসতে চাইছেন না!”

“কেন?”

“স্যার কবিতা লিখছেন। মনে হয় কবিতা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসবেন।”

তৃষা অধৈর্য হয়ে বলল, “তোরা বুঝিয়ে বলিসনি?”

“বলা হয়েছে। রাতুল অনেক চেষ্টা করেছে–”

“রাতুল কোথায়? ফোনটা রাতুলকে দে।”

রাতুল ফোন ধরে বলল, “বল তুষা।”

“তুই টের পাচ্ছিস কী হচ্ছে? আমাদের ছাড়তে দেরি হলে ভেতরে ঢুকতে পারব না। সমুদ্রে আটকা পড়ব।”

“জানি।”

“তা হলে? ওনাকে নিয়ে আসছিস না কেন?”

“আমি চেষ্টা করেছি। লাভ হয় নাই। আমার সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু আমি যেহেতু ফালতু ভলান্টিয়ার সেটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না।”

“তা হলে?”

“এখন একটা উপায়।”

“কী?”

“জোর করে ধরে আনা। কিন্তু আমাকে লিখিতভাবে ইনস্ট্রাকশন দিতে হবে। পরে আমাকে বলবি ফালতু ভলান্টিয়ার হয়ে তোদের সেলিব্রেটি গেস্টদের অপমান করেছি।”

“বাজে কথা বলিস না।”

রাতুল গম্ভীর হয়ে বলল, “আমি একটাও বাজে কথা বলছি না।”

“আমি কি শাহরিয়ার মাজিদের সাথে কথা বলতে পারি?”

“যদি উনি রাজি হন। আমি চেষ্টা করতে পারি।” রাতুল টেলিফোনটা নিয়ে শাহরিয়ার মাজিদের কাছে গিয়ে বলল, “স্যার।”

শাহরিয়ার মাজিদ তার দিকে ঘুরে তাকালেন না। রাতুল আবার ডাকল, “স্যার।”

কোনো উত্তর নেই। রাতুল তখন টেলিফোনটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “তৃষা আপনার সাথে কথা বলতে চাইছে।”

শাহরিয়ার মাজিদ টেলিফোনটা হাতে নিয়ে সেটাকে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে খানিকটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে তার নোট বইয়ে আরও দুটো শব্দ লিখলেন।

এই প্রথম রাতুল পুরো ব্যাপারটার হাস্যকর দিকটা দেখতে পেল, সে টেলিফোনটা তুলে হাসতে হাসতে দূরে আরেকটা ঝাউগাছের নিচে গিয়ে বসল। টেলিফোনে তৃষা বলছে, “হ্যালো হ্যালো।”

রাতুল বলল, “বল।”

“কী হয়েছে?”

রাতুল হাসতে হাসতে বলল, “তোদের সেলিব্রেটি কবি শাহরিয়ার মাজিদ টেলিফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন।”

“তুই হাসছিস?”

“কী করব? কাঁদব? এ রকম কমিক দৃশ্য আমি খুব বেশি দেখি নাই।”

.

কবি শাহরিয়ার মাজিদের কারণে জাহাজটা ছাড়তে দুই ঘণ্টা দেরি হল। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কাজেই সরু চ্যানেলটা দিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা না। করে সমুদ্র দিয়ে ঘুরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। জাহাজে যারা আছে তাদের বেশির ভাগই অবশ্যি বিষয়টা জানতেও পারল না, যারা জানতে পারল তারা সে রকম গুরুত্ব দিল না। সবাই সারাক্ষণ জাহাজের ভেতর আছে, খিদে পেলে খেতে পাচ্ছে, ঘুমানোর সময় ঘুমাতে পারছে। কাজেই জাহাজটি কোন পথে যাচ্ছে সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতে রাজি না। ঘণ্টা দুয়েক পর সবাইকে অবশ্যি মাথা ঘামাতে হল এবং সেটা ঘটল খুবই নাটকীয়ভাবে।

জাহাজটা তার ইঞ্জিনের গুমগুম শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে। বামদিকে বহু দূরে সুন্দরবনের বনভূমি ডানদিকে সমুদ্র। সূর্যটা পিছন দিকে হেলে পড়েছে। শীতের বিকেলের একটা হিমেল হাওয়া। জাহাজের ছাদে বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে, মাঝামাঝি জায়গায় রাতুল বসেছে, তার কোলে একটা গিটার। কেউ একজন তার কাছে দিয়ে উধাও হয়ে গেছে। সে টুং টাং শব্দ করতে করতে চোখের কোনা দিয়ে বাচ্চাদের দিকে চোখ রাখছে। ছাদের বেশি কিনারে চলে গেলে সে হালকা হুংকার দিয়ে বলছে, “কেউ কিনারায় যাবে না, মাঝখানে, সবাই মাঝখানে।”

হুংকার শোনার পর কিছুক্ষণের জন্যে সবাই মাঝখানে আসছে, কিছুক্ষণের মাঝে ভুলে গিয়ে আবার কিনারায় চলে যাচ্ছে। মৌটুসি খানিকক্ষণ ছোটাছুটি করে রাতুলের পাশে এসে বসে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “স্পাইডার ভাইয়া।”

“বল।”

“তুমি কী গান গাইতে পার?”

“নাহ।”

“পার। পার নিশ্চয়ই পার।” মৌটুসি বলল, “আমি জানি।”

“তুমি কেমন করে জান?”

“তুমি বলেছ নাহ্! নাহ্ মানে একটু একটু পারি।”

“তাই না কি?”

“হ্যাঁ।”

“আর যারা আসলেই গাইতে পারে না তারা কী বলবে?”

“তারা বলবে,, পারি না!”

মৌটুসির কথা শুনে রাতুল একটু হাসল, বলল, “ভালোই বলেছ।”

“গাও না ভাইয়া। একটুখানি। এই এতটুকু।”

রাতুল গিটারে টোকা দিয়ে তার জানা গানের একটা লাইন নিচু গলায় গাইতে মাত্র শুরু করেছে, ঠিক তক্ষুনি ভয়ংকর একটা ব্যাপার ঘটল। হঠাৎ করে পুরো জাহাজটি দুলে উঠল, বিকট একটা শব্দ হল এবং পুরো জাহাজটি থেমে কাত হয়ে গেল। রাতুল শুধু দেখতে পেল জাহাজের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাগুলো ছিটকে উপরে উঠে জাহাজের ছাদে আছাড় খেয়ে পড়েছে। শুধু একজন–সেটি কে রাতুল জানে না, জাহাজের ছাদ থেকে প্রায় উড়ে গিয়ে সমুদ্রের পানিতে পড়েছে। রাতুল ছুটে গিয়ে দেখল বাচ্চাটি আতঙ্কে চিৎকার করতে করতে সমুদ্রের নীল পানিতে ডুবে গেল।

রাতুল চিন্তা করার জন্যে কোনো সময় নিল না। হাতের গিটারটি নিচে ফেলে জাহাজের ছাদ থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পানিতে পড়ে সে ডুবে যায়, হাত-পা নেড়ে তখন সে উপরে উঠতে থাকে, পায়ে জুতো থাকার জন্যে সাঁতার কাটতে সমস্যা হচ্ছিল, পা দিয়ে ধাক্কা মেরে সে জুতোজোড়া খুলে ফেলল। দুই হাত দিয়ে পানি কেটে সে উপরে উঠতে উঠতে বাচ্চাটিকে খুঁজতে থাকে, কাউকে খুঁজে পায় না। উপরে একবার মাথাটা বের করে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে চারদিকে তাকাল, জাহাজ থেকে অনেকে চিৎকার করছে কিন্তু তার সেগুলো শোনার সময় নেই। সামনে পানিতে একটুখানি আলোড়ন দেখতে পেয়ে সে আবার ডুব দিয়ে এগিয়ে যায়। স্বচ্ছ পানিতে অনেক দূরে দেখা যায়। কিন্তু কোথাও বাচ্চাটির চিহ্ন নেই। রাতুল বুকে সাঁতার কেটে আরও একটু এগিয়ে গেল আর তখন সে বাচ্চাটিকে দেখতে পেল, হাত-পা নাড়তে নাড়তে সে ডুবে যাচ্ছে। রাতুল ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরে ফেলল–বাচ্চাটির এখন বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়া দরকার, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তাকে টেনে সে উপরে নিয়ে যায়, ধাক্কা দিয়ে পানির উপরে তুলে আনে।

রাতুল শুনতে পেল জাহাজ থেকে সবাই চিৎকার করছে তবে এই চিৎকারটি আতঙ্কের নয়, উল্লাসের। রাতুল বাচ্চাটির দিকে তাকাল, সে এখনও বুঝতে পারছে না কী হয়েছে, খক খক করে কাশতে থাকে তারপর বুক ভরে কয়েকটি নিশ্বাস নেয়–তারপর রাতুলকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।

রাতুল এখন বাচ্চাটিকে চিনতে পারল, শান্ত নামের সবচেয়ে দুরন্ত ছেলেটি। এই মুহূর্তে তার মাঝে দুরন্তপনার কোনো চিহ্ন নেই, আর চোখে-মুখে অবর্ণনীয় আতঙ্ক। রাতুল বাচ্চাটিকে ধরে রেখে বলল, “কোনো ভয় নেই শান্ত, কোনো ভয় নেই। আমি আছি, আমি আছি।”

রাতুল শান্তকে এক হাতে ধরে রেখে সাঁতরে জাহাজের দিকে এগোতে থাকে। তখন সে টের পেল জাহাজটির ইঞ্জিন চলছে, প্রপেলার ঘুরছে কিন্তু জাহাজটি এগোচ্ছে না! সেটি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কোনো একটি ডুবোচরে ধাক্কা খেয়ে জাহাজটি আটকে গেছে।

জাহাজের কাছাকাছি আসার পর অনেকে মিলে প্রথমে শান্তকে তারপর রাতুলকে টেনে তুলল। রাতুল এই প্রথম টের পেল সমুদ্রের পানিটা কনকনে ঠাণ্ডা, সে হি হি করে কাঁপছে। কয়েকজন মিলে শান্তকে ধরে নিয়ে যায়, অন্যরা এগিয়ে এসে তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে কথা বলছে, সব কথা সে ভালো করে শুনতে পাচ্ছে।, যেটুকু শুনতে পাচ্ছে তার সবটুকু সে বুঝতে পারছে না। চোখের কোনা দিয়ে সে তৃষাকে খুঁজল, দেখতে পেল না। শামসকে দেখল, তার দামি ক্যামেরা নিয়ে এগিয়ে আসছে। উৎসাহে টগবগ করতে করতে বলল, “আমি তোমার রেসকু অপারেশনের ফ্যান্টাস্টিক কয়েকটি ছবি তুলেছি। তোমাকে কপি দেব। তুমি তোমার কাছে রাখতে পারবে।”

রাতুল কথার উত্তর দিল না, তার এখন ভেজা কাপড়গুলো বদলানো দরকার। সমস্যা হচ্ছে তাড়াহুড়ো করে এসেছে সঙ্গে পরিষ্কার দূরে থাকুক, যথেষ্ট পরিমাণ কাপড় নেই।

“জাহাজের ওপর থেকে ডাইভ দিয়েছ–” রাতুল শুনল শামস বলছে, “কত ফিট হবে মনে হয়? তিরিশ ফুট? আমার পারসোনাল রেকর্ড পঁয়ত্রিশ ফুট। আমার ইউনিভার্সিটিতে অলিম্পিক সাইজ সুইমিং পুল আছে সেখানে আমি ডাইভিং প্র্যাকটিস করি।”

রাতুল এবারেও কথা বলল না, সে টের পেতে শুরু করেছে এই মানুষটির কিছু মৌলিক সমস্যা আছে। সে শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে উপরে উঠতে থাকে। শামসও পিছন পিছন আসে, “তোমার ই-মেইল অ্যাড্রেস দিও, আমি মেল করে দেব। হাই রিজোলিউশন ছবি, বারো মেগা পিক্সেল।”

রাতুল এবারেও কোনো কথা বলল না। শামস হাসার ভঙ্গি করে বলল, “এই ছবিগুলো রেখে দিও। তোমার গার্লফ্রেন্ডকে ইমপ্রেসড করতে পারবে।”

রাতুল এবার ঘুরে শামসের দিকে তাকাল, শীতল গলায় বলল, “আমি আমার গার্লফ্রেন্ডকে ইমপ্রেস করার জন্যে ছাদ থেকে পানিতে লাফ দেই নাই। বাচ্চাটিকে বাঁচানোর জন্যে লাফ দিয়েছিলাম। এ ছবিগুলো আপনি আপনার কাছে রেখে দেন। আপনার গার্লফ্রেন্ডকে দেখাবেন আপনি কত সুন্দর ছবি তুলতে পারেন।”

রাতুল যখন শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে হেঁটে গেল তখন শামস দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে বলল, “বেয়াদপ ছেলে!” রাতুল অবশ্যি কথাটি শুনতে পেল না।

রাতুলকে সজল একটা ট্রাউজার দিল। গীতি দিল একটা টি-শার্ট। ভেজা কাপড়গুলো শুকোতে দিয়ে রাতুল তার বিছানার চাদরটা গায়ে দিয়ে নিচে গিয়ে দেখতে পেল সেখানে প্রচণ্ড উত্তেজনা। নাট্যকার বাতিউল্লাহ আর কবি শাহরিয়ার মাজিদ প্রচণ্ড ঝগড়া করছেন। ঝগড়াটা শুরু হয়েছে এভাবে : শাহরিয়ার মাজিদ বাতিউল্লাহকে বলেছেন, “অনেকদিন পর আজকে একটা ভালো কবিতা লিখেছি।”

বাতিউল্লাহ কোনো উত্তর দিলেন না। শাহরিয়ার মাজিদ বললেন, “প্রত্যেকটা শব্দ সুষম, একটার সাথে আরেকটা সুবিন্যস্ত।”

বাতিউল্লাহ তখনও কোনো কথা বলেননি। শাহরিয়ার মাজিদ বললেন, “এই জাহাজে আমার কবিতা অনুধাবন করার কেউ নেই। আপনি হয়তো একটু বুঝতে পারবেন। পড়ে শোনাব?”

বাতিউল্লাহ তখন বলেছেন, “আপনার কবিতা পাকিয়ে সরু পেন্সিলের মতো করে আপনার ইয়ে দিয়ে ঢুকিয়ে দেন।”

তারপরই ঝগড়ার সূত্রপাত। শাহরিয়ার মাজিদ বাতিউল্লাহকে ডেকেছেন অশ্লীল, ইতর, অভদ্র এবং বর্বর। বাতিউল্লাহ শাহরিয়ার মাজিদকে ডেকেছেন উম্মাদ, বালখিল্য, প্রতারক এবং ভুয়া, তার জন্যে পুরো জাহাজ ডুবোচরে বাঁকা হয়ে আটকে আছে এবং এখান থেকে কখন তারা ছুটতে পারবেন তার কোনো গ্যারান্টি নাই। বাতিউল্লাহ মনে করিয়ে দিলেন শুধু যে জাহাজ আটকা পড়েছে তা নয়, আরেকটু হলে একটা বাচ্চা পানিতে ডুবে ভেসে যেত। রাতুলকে দেখিয়ে বললেন, “এই ছেলেটা ছিল বলে বাচ্চাটি জানে বেঁচে গেছে।”

রাতুল ঝগড়াটা খুবই উপভোগ করছিল কিন্তু সবাই মিলে দুজনকে আলাদা করে দিল। রাতুল তখন শান্তকে খুঁজে বের করল, দোতলার ডেকে সে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছে। মৌটুসি, টুম্পা, টুবলু এবং অন্য সব বাচ্চা তাকে ঘিরে বসে আছে। তুষাও সেখানে আছে, শান্ত ফোঁস ফোঁস করে কাঁদছে, তৃষা তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

শান্ত ফাঁস ফাস করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বাসায় যাব। আম্মুর কাছে যাব।”

তৃষা বলল, “এই তো আর একদিন, তারপর বাসায় পৌঁছে যাব।”

শান্ত ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “জাহাজ আটকে গেছে। আমরা আর কোনোদিন বাসায় যেতে পারব না।”

তৃষা বলল, “কে বলেছে পারব না? শুনছ না জাহাজের ইঞ্জিন চলছে। চেষ্টা করছে ডুবোচর থেকে ছুটিয়ে আনতে?”

“পারবে না। কোনোদিন পারবে না।” শান্ত কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমাদের সারাজীবন এইখানে থাকতে হবে।”

তৃষা বলল, “না শান্ত। সারাজীবন থাকতে হবে না।”

রাতুল বলল, “জাহাজের ইঞ্জিন যদি ছোটাতে না পারে তা হলে আমাদের শুধু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। যখন জোয়ার আসবে তখন জাহাজ এমনিতেই ছুটে যাবে।”

শান্ত জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?”

রাতুল হাসল, বলল, “আমি কি কখনও তোমাদের মিথ্যা বলেছি?”

শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “না। বল নাই।”

“তা হলে?”

শান্তর মুখে এবারে একটু ক্ষীণ হাসি ফুটে ওঠে। টুম্পা রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্পাইডার ভাইয়া।”

“বল।”

“তুমি যখন জাহাজ থেকে ডাইভ দিয়েছ আমি সেটা দেখি নাই।”

অন্য সবাই আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, “আমরা দেখেছি! আমরা দেখেছি!”

টুম্পা বলল, “তুমি আরেকবার ডাইভ দেবে? প্লীজ! প্লীজ! মাত্র একবার।”

রাতুল হাসতে থাকে, “বলে, ধুর! এত উঁচু থেকে ডাইভ দেওয়া সোজা না কি? আর পানি কী ঠাণ্ডা, তাই না শান্ত?”

শান্ত মাথা নাড়ল। টুম্পা বলল, “শান্তকে তোলার জন্যে তো ডাইভ দিয়েছ।”

“তখন কী এতকিছু চিন্তা করেছি না কি?”

মৌটুসি টুম্পাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “তুই যদি পানিতে পড়ে যাস তা হলে স্পাইডার ভাইয়া আবার ডাইভ দেবে। তাই না ভাইয়া?”

রাতুল চোখ কপালে তুলে বলল, “রক্ষা কর। কারও পানিতে পড়ে যাওয়ার দরকার নেই, আমার ডাইভ দেওয়ারও দরকার নেই। পানিতে না পড়েও একশ রকম মজা করা যায়। বুঝেছ?”

তৃষা উঠে দাঁড়াল, রাতুল তখন হাঁটতে শুরু করে। তৃষা পিছন থেকে ডাকল”রাতুল।”

রাতুল দাঁড়াল, “কী?”

“থ্যাংকু রাতুল।”

“কেন?”

“শান্তকে পানি থেকে তুলে আনার জন্যে।”

রাতুল কোনো কথা বলল না। তৃষা বলল, “তুই না থাকলে কী হত?”

“অন্য কেউ তুলে আনত। এই জাহাজেই অনেক এক্সপার্ট সুইমার আছে তারা অলিম্পিক সাইজ সুইমিং পুলে অনেক উপর থেকে ডাইভ দিতে পারে।”

“কে?”

“তারা আমার মতো ফালতু মানুষ না। তারা সেলিব্রেটি।”

তৃষা কিছুক্ষণ স্থির চোখে রাতুলের দিকে তাকিয়ে থেকে শীতল গলায় বলল, “রাতুল তুই একটা জিনিস লক্ষ করেছিস? তুই আমাকে খোঁচা না দিয়ে কথা বলতে পারিস না।”

রাতুল একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আই অ্যাম সরি তৃষা। আই অ্যাম রিয়েলি সরি। আর কখনও তোকে খোঁচা দিব না। আসলে হয়েছে কী–”

“কী হয়েছে?”

রাতুল মাথা নাড়ল, বলল, “না কিছু না।”

“বল কী হয়েছে?”

“না। বলার মতো কিছু হয়নি। আমি তো একটু গাধা টাইপের মানুষ সেটাই হচ্ছে সমস্যা। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোকে কথা দিচ্ছি।”

রাতুল সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে যায়, তৃষা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিচে নেমে গেল।

.

ছাদের এক কোনায় আনসার দুজন দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মুখে এক ধরনের উদ্বেগের চিহ্ন। রাতুল কাছে গিয়ে বলল, “কী ব্যাপার? কিছু হয়েছে?”

কম বয়সী আনসারটি বলল, “ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না।”

আনসার মানুষটির গলার স্বর শুনে রাতুলের বুকটা কেমন জানি ধক করে ওঠে, জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে?”

মানুষটি হাত তুলে বহুদূরে দেখিয়ে বলল, “ওই দেখেন?”

“কী?” রাতুল কিছু দেখতে পেল না।”

একটা ট্রলার।”

রাতুল এবারে দেখতে পেল। বহুদূরে একটা ট্রলার কালো ধোঁয়া উড়িয়ে আসছে। জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে এই ট্রলারের?”

“এই দিকে আসছে।”

“এই দিকে আসলে কী হবে?”

“ট্রলারে কারা আছে জানি না।”

“কারা আছে মানে? কারা থাকবে?”

আনসার মানুষটি বলল, “বুঝতে পারছেন না? একটা জাহাজ ডুবোচরে আটকে আছে জাহাজভর্তি বড়লোক মানুষ, তাদের বউ-বাচ্চা! ডাকাতি করার জন্যে এর থেকে সোজা জিনিস কী আছে?”

রাতুল চমকে উঠল, “ডাকাত?”

“হতে পারে।”

“আপনারা আছেন না? আপনাদের রাইফেল আছে না?”

আনসার তার রাইফেলটা হাতে নিয়ে বলল, “এইটা আসলে রাইফেল না। এইটা হচ্ছে একটা ডাণ্ডা। এইটা দিয়ে মানুষের মাথায় বাড়ি দেওয়া যায়, গুলি করা যায় না।”

“মানে?”

“মানে আবার কী!” আনসার মানুষটা হাত নেড়ে বলল, “ডাকাতদের কাছে এখন অটোমেটিক রাইফেল থাকে! আমাদের এই রাইফেল দেখে ডাকাতেরা হাসাহাসি করে।”

বয়স্ক আনসারটা এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এবার সে মুখ খুলল, বলল, “তুমি খামোখা কেন ভয় দেখাচ্ছ? ডাকাত তো নাও হতে পারে। মাছ ধরা ট্রলার হতে পারে।”

“হতে পারে। আমিও তাই চাই। দোয়া করছি তাই যেন হয়। শুধু বলছি–”

“কী বলছ?”

“বলছি নিশানাটা ভালো লাগছে না। সোজা আমাদের দিকে আসছে।”

মধ্য বয়স্ক আনসারটা একটা নিশ্বাস ফেলে তার কাঁধ থেকে রাইফেলটা খুলে হাতে নেয়, ম্যাগাজিনটা খুলে ভেতরে দেখে তারপর ম্যাগাজিনটা রাইফেলে লাগিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রাতুল দেখল এই শীতের মাঝেও মানুষটা কুলকুল করে ঘামছে। রাতুল হঠাৎ করে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে, তার বুকের মাঝে হৃৎপিণ্ডটা ধক ধক করে শব্দ করতে থাকে, যদি সত্যিই এটি ডাকাতের ট্রলার হয় তা হলে কী হবে?

ট্রলারটি কাছাকাছি আসার পর হঠাৎ তার ইঞ্জিনটি বন্ধ করে দেয়, নিঃশব্দে সেটা তখন জাহাজের দিকে এগোতে থাকে। একজন মানুষ হাল ধরে আছে, ট্রলারের ছাদে একজন মানুষ কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

বয়স্ক আনসারটি দাঁতের ফাঁক দিয়ে চাপা স্বরে বলল, “সর্বনাশ! নসু ডাকাত!” তারপর হঠাৎ করে রাইফেল তাক করে চিৎকার করে বলল, “খবরদার জাহাজের কাছে আসবে না। চলে যাও। ইঞ্জিন চালু করে চলে যাও।”

ট্রলারের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি দাঁত বের করে হেসে বলল, “কী বলেন ওস্তাদ শুনতে পাই না।”

আনসারটি ধমক দিয়ে বলল, “খুব ভালো করে শুনতে পেয়েছ আমি কী বলেছি। যাও। যাও এখান থেকে। ভাগো। না হলে কিন্তু গুলি করে দেব।”

“গুলি করবেন? গুলি করবেন কেন? আমি কী করেছি?”

রাতুল দেখল ট্রলারটা ভাসতে ভাসতে একেবারে জাহাজের কাছে চলে এসেছে।

আনসারটা চিৎকার করে বলল, “খবরদার।” তারপর সত্যি সত্যি রাইফেল তুলে গুলি করল।

ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা বিদ্যুৎগতিতে লাফিয়ে সরে যায়, হঠাৎ করে হাত পিছনে নিয়ে কোথা থেকে টান দিয়ে একটা কাটা রাইফেল এনে গুলি করতে থাকে, রাতুলের কানের কাছ দিয়ে শিসের মতো শব্দ করে কিছু একটা ছুটে গেল, তখন সে এক লাফে ছাদে শুয়ে পড়ল। প্রচণ্ড আতঙ্কে সে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারছে না।

আনসার দুজন রাইফেল দিয়ে গুলি করছে। প্রচণ্ড শব্দে কানে তালা লেগে যায় এবং তার মাঝে বয়স্ক আনসারটি হঠাৎ একটা আর্তনাদ করে পেছন দিকে ছিটকে পড়ল। রাতুল দেখল সে ডান হাত দিয়ে কাঁধের কাছে ধরে রেখেছে এবং সেখান দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে।

রাতুল হঠাৎ ধুপ ধাপ শব্দ শুনল এবং পেছন দিকে তাকিয়ে দেখে ছয় সাতজন ভয়ংকর দর্শন মানুষ ছাদে লাফিয়ে উঠে এসেছে। মানুষগুলোর সারা শরীর ভেজা, শরীর থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে, তাদের হাতে নানা ধরনের অস্ত্র। বন্দুক হাতে একজন ছুটে এসে কম বয়সী আনসারটার মাথায় আঘাত করে, সঙ্গে সঙ্গে কাতর শব্দ করে মানুষটা নিচে পড়ে গেল। ট্রলার থেকে এরা আগেই পানিতে নেমে গেছে, সাঁতরে পিছন থেকে এসে উঠেছে।

রাতুল মাথা তুলে দেখল ট্রলারের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিও রেলিং বেয়ে ছাদে উঠে এসেছে, কাটা রাইফেলটা ধরে রেখে সে আনসারদের রাইফেল দুটি নিজের হাতে তুলে নিল। তারপর বয়স্ক আনসারের কাছে গিয়ে তার মাথায় কাটা রাইফেলটা ধরে বলল, “ওস্তাদ আমি আপনাকে বলেছিলাম গুলি করবেন না। বলেছিলাম কি না?”

বয়স্ক মানুষটা তার ক্ষতস্থানটা ধরে রেখে দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল এ ডাকাতটা বলল, “আপনি আমার কথা শুনেন নাই। শুনেছেন?”

বয়স্ক মানুষটা যন্ত্রণায় শব্দ করে মাথা নাড়ল। ডাকাতটা বলল, “এখন আমি আপনার মাথায় গুলি করি?” হঠাৎ সে ভয়ংকর গলায় চিৎকার করে উঠল, “করি গুলি?”

বয়স্ক মানুষটা এক ধরনের শূন্য দৃষ্টিতে ডাকাতটার দিকে তাকিয়ে রইল, রাতুলের মনে হল ডাকাতটা সত্যি সত্যি গুলি করে দেবে। সে নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে, ডাকাতটি শেষ পর্যন্ত গুলি করল না, উঠে দাঁড়িয়ে মনে হল। প্রথমবার রাতুলকে দেখতে পেল। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “তুই কে?”

রাতুল ঢোক গিলে বলল, “আমি কেউ না।”

“কেউ না আবার কী?”

“না মানে, আমি জাহাজের প্যাসেঞ্জার।”

“জাহাজের প্যাসেঞ্জার ছাদে কী করিস?”

“কিছু করি না।”

ডাকাতটা কিছুক্ষণ তার দিকে বিষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তারপর খপ করে তাকে ধরে টেনে দাঁড়া করিয়ে বলল, “যা নিচে যা। সবাইরে এক জায়গায় হাজির হতে বল। একজনও যদি অন্য জায়গায় থাকে তা হলে তোর জান শেষ।” কথা শেষ করে ডাকাতটা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।

এই লোকটা নিশ্চয়ই ডাকাতের সর্দার, সে অন্য ডাকাতগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “যা তোরা জাহাজ দখল নে। কেউ যদি কোনো উনিশ-বিশ করে তা হলে গুলি। ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে।”

“কেবিনের প্যাসেঞ্জারদেরও নিচে পাঠা, সেইখানে পাহারায় থাক দুজন।”

“ঠিক আছে।”

রাতুল যখন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো দেখল সবাই আতঙ্কিত হয়ে জাহাজের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে। রাতুলকে দেখে তৃষা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে রাতুল?”

“ডাকাত।”

“আনসার দুজন কী করছে?”

“একজন গুলি খেয়েছে, অন্যজনকে আটকে ফেলেছে। রাইফেল দুটি নিয়ে গেছে।”

“পুলিশ-কোস্টগার্ডকে কী খবর দেওয়া যায় না?”

কে একজন বলল, “আমরা সমুদ্রের অনেক ভেতরে। এখানে কোনো নেটওয়ার্ক নেই।”

“এখন কী হবে?”

রাতুল বলল, “আমি জানি না।”

ঠিক তখন ওরা শুনতে পেল ছাদে ধুপধাপ করে কারা দৌড়াচ্ছে, কয়েকটা গুলির শব্দ আর মানুষের চিৎকার শোনা গেল। তারপর দেখল সিঁড়ি দিয়ে আতঙ্কিত মুখে কেবিনের যাত্রীরা নেমে আসছে। শারমিন, তার মা, শামস, আজাদ, বাতিউল্লাহ, অন্যরা এবং সবার শেষে শাহরিয়ার মাজিদ। শাহরিয়ার মাজিদ একটা লুঙি পরে আছেন, লুঙিটা খুলে যাচ্ছিল। কোমরের কাছে হাত দিয়ে ধরে রেখে ভাঙা গলায় বললেন, “ডাকাইত! জাহাজের মইধ্যে ডাকাইত পড়ছে। ডাকাইত!”

এত বিপদের মাঝেও রাতুল লক্ষ করল এই মানুষটা সবসময় শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে, কিন্তু এখন এই প্রথমবার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে। এটা হচ্ছে। তার সত্যিকারের রূপ-অন্য সময় যেটা দেখে সেটা হচ্ছে ভান।

ঘরের মাঝখানে সবাই একত্র হয়েছে, কেউ একজন হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, হাসি এবং কান্না দুটিই মনে হয় সংক্রামক, কান্নার শব্দ শুনে একসাথে অনেকে কেঁদে ওঠে।

রাতুল হঠাৎ লক্ষ করল, কেউ তার শার্টের কোনা ধরে টানছে। তাকিয়ে দেখে রাজা। রাতুল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই রাজা গলা নামিয়ে বলল, “স্যার! আমি কী ডাকাতের দলের সাথে ভাব করার চেষ্টা করমু?”

“ডাকাত দলের সাথে?”

“জে।”

“কেমন করে?”

“আপনি যদি বলেন, তা হলে চেষ্টা করি।”

“তোমার কোনো বিপদ হবে না তো?”

“না স্যার। আমাগো কখনো কোনো বিপদ হয় না।”

রাতুল কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, “ঠিক আছে।”

রাজা অদৃশ্য হয়ে গেল আর ঠিক তখন বিভিন্ন সিঁড়ি দিয়ে ওপর থেকে ডাকাতগুলো নামতে থাকে। ভেতরে যারা ছিল তারা হঠাৎ করে চুপ করে গেল।

ডাকাতগুলো তাদের বন্দুক নিয়ে বিভিন্ন কোনায় দাঁড়িয়ে যায়, শুধু ডাকাতের সর্দারটি হেঁটে হেঁটে সবার খুব কাছাকাছি আসে। ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে থাকা মানুষগুলোর মুখ খুব কাছে থেকে দেখে, তারপর হেঁটে হেঁটে আবার একটু পিছিয়ে যায়। কাছাকাছি একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে আনে কিন্তু সেখানে না বসে সেখানে একটা পা তুলে দাঁড়ায়, তারপর পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট আর ম্যাচ বের করে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে ধোয়া ছেড়ে বলল, “আমার নাম নসু। যারা খারাপ লোক তারা আমারে ডাকে নসু ডাকাত! যারা ভদ্রলোক তারা আমারে ডাকে জলদস্যু নসু। আমি আসলে এর কোনোটাই না। আমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ, ন্যায্য কথার মানুষ, ন্যায্য কামের মানুষ, ন্যায্য বিচারের মানুষ!–”

নসু ডাকাত খুব একটা নাটকীয় ভাব করে সবাইকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, “এই যে, তোমাদের দিকে তাকিয়ে দেখ। তোমাদের চেহারায় কী চেকনাই। গায়ের রং কত সুন্দর, সবাই নাদুস-নুদুস গোলগাল। পোশাক কত সুন্দর। সবাই বড়লোকের বাচ্চা। বাড়িতে এয়ারকন্ডিশন, টেলিভিশন। ফ্রিজের ভিতরে কত রকম খাবার। ব্যাংকভর্তি টাকা। গাড়ি করে ঘুরে বেড়াও। হ্যাঁ। আর আমরা? লেখাপড়া করতে পারি নাই। রোদে পুড়ি, বৃষ্টিতে ভিজি। এক বেলা খাই তো আরেক বেলা না খেয়ে থাকি। আমাদের চেহারা দেখ। দেখ? বল এইটা কোন বিচার? কেন তোমাদের সবকিছু আছে, আমাদের কিছু নাই?”

নসু ডাকাতকে দেখে মনে হল সে আশা করে আছে কেউ তার এই প্রশ্নের উত্তর দিবে, কেউ কথা বলল না, তখন সে নিজেই বলল, “সেই জন্যে আমি একটা ন্যায্য বিচারের ব্যবস্থা করেছি। তোমাদের যে বেশি বেশি মালসামান আছে, গয়নাগাটি আছে, টাকা-পয়সা আছে আমি সেইগুলো নিব, নিয়ে একটু ন্যায্য বিচার করব। বুঝেছ?”

এবারেও কেউ কোনো কথা বলল না।

নসু ডাকাত এবারে একটা হুংকার দিল, “বুঝেছ?”

এবারে ভয় পেয়ে সবাই মাথা নাড়ে। নসু ডাকাত সন্তুষ্টির মতো একটা শব্দ করে বলল, “খবরদার কেউ তেড়িবেড়ি করবা না। এই জাহাজ আমার দখলে, সারেং খালাসি গার্ড মাস্টার যা আছে সবাইরে দড়ি দিয়ে বেন্ধে তালা মেরে রেখেছি। জাহাজের বাকি প্যাসেঞ্জার এইখানে। দুইজন আনসার ছিল, তাদের তেজ বেশি। আরে ব্যাটা-মিলিটারি পুলিশ কোস্টগার্ড আমার সাথে পারে না। তুই আনসারের বাচ্চা আনসার আমাকে গুলি করিস? সেই ব্যাটাদের উচিত শিক্ষা হয়েছে। গুলি খেয়ে পড়ে আছে। অচল।” নসু ডাকাত সুর পাল্টে বলল, “কাজেই তোমরা কোনো ধান্ধাবাজি করবা না। কোনো গোলমাল করবা না। বুঝেছ?”

কেউ কোনো কথা বলল না। নসু ডাকাত বলল, “সবাই বসে যাও। বস। বস।”

যারা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল এবার তারা বসে গেল। নসু ডাকাত সন্তুষ্টির একটা ভাব করে বলল, “চমৎকার। আমি যা বলি তোমরা যদি সেই রকম কাজ কর তা হলে তোমাদের জন্যে ভালো, আমার জন্যেও ভালো। খবরদার কোনো রকম উনিশ-বিশ করবা না, যদি করো আমি কিন্তু সাথে সাথে ধাক্কা মেরে সমুদ্রে ফেলে দিব। বুঝেছ?”

কেউ কোনো কথা বলল না। ঠিক সেই সময় রাজা একটা বেঞ্চের তলা থেকে বের হয়ে এলো, সে তার প্যান্ট টি-শার্ট পাল্টে তার শতচ্ছিন্ন পুরনো ময়লা কাপড় পরে ফেলেছে, মাথার চুল এলোমেলো, শরীরে কালিঝুলি ময়লা। নসু ডাকাত ধমক দিয়ে বলল, “কে? কে? বেঞ্চের তলা থেকে কে বের হয়?”

রাজা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি ওস্তাদ।”

“তুই কে?”

”আমার নাম রাজা।”

নসু ডাকাত হা হা করে হাসল, “চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে না তুই রাজা। দেখে তো মনে হচ্ছে তুই ফকিরনীর বাচ্চা।”

রাজা দাঁত বের করে হাসল। নসু ডাকাত জিজ্ঞেস করল, “তুই বেঞ্চের তলায় কী করিস?”

“ঘুমাই ওস্তাদ।” রাজা বসে থাকা সবাইকে দেখিয়ে বলল, “এই স্যারেরা আমাকে দেখলে খুবই রাগ হয়, বিরক্ত হয়। আমারে মারে। সেই জন্যে স্যার এই চিপার মাঝে শুয়ে থাকি।”

নসু ডাকাত মুখ শক্ত করে বলল, “বড়লোকের বাচ্চা হচ্ছে হারামির বাচ্চা।”

“জে স্যার। আমারে ঠিক করে খেতেও দেয় না।”

“খেতে দেয় না?”

“না স্যার। কোনো কিছু হারানো গেলেই আমারে দোষ দেয়। বলে আমি চুরি করেছি। আমারে মারে।”

এই প্রথম সে একটা কথা বলল, যেটা খানিকটা হলেও সত্যি। শারমিন অস্বস্তির সাথে নড়েচড়ে বসল। নসু ডাকাত চোখ লাল করে বলল, “কোন জন মারে? কোন হারামজাদা মারে? আমারে দেখা। লাথি মেরে সমুদ্রে ফেলে দেই।”

রাজা বসে থাকা সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বলল, “এখন ওস্তাদ চিনতে পারমু। বড়লোকের ছাওয়ালদের সবাইকে একরকম লাগে।”

নসু ডাকাত বলল, “সে কথা সত্যি। বড়লোকদের চেহারা একরকম, স্বভাবচরিত্র একরকম।”

রাজা বলল, “ওস্তাদ।”

“কী?”

“আপনার যদি কিছু লাগে আমারে বলবেন।”

“তোকে বলব? তুই কী করবি?”

“এই ধরেন যদি চা-নাস্তা খেতে চান। এইখানে চা-নাস্তার খুব ভালো বন্দোবস্ত আছে। কিন্তু আমারে খেতে দেয় না।”

“খা। খা। এখন তুই নিশ্চিন্ত মনে খা। কোনো কিছু চিন্তা নাই।”

“জে। খামু।”

নসু ডাকাত আবার অন্যদের দিকে মন দিল। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একটা ডাকাতের হাত থেকে একটা বস্তা আর দুইটা পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে বলল, “এখন আমার লোকজন মালসামান টাকা-পয়সা গয়নাপাতি নেওয়ার জন্যে তোমাদের কাছে যাবে। এই বস্তাটা হচ্ছে মালসামানের বস্তা। মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, ঘড়ি, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, বাজনাবাদ্য শোনার ছোটবড় ক্যাসেট প্লেয়ার, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি যা আছে সব এই বস্তার মাঝে দিবা। খবরদার কেউ কিছু লুকায়া রাখবা না। যদি আমি টের পাই কেউ কিছু লুকায়া রাখছ সাথে সাথে গুলি। মনে থাকব?”

সবাই মাথা নাড়ল, জানাল যে মনে থাকবে। নসু ডাকাত তখন পলিথিনের দুইটা ব্যাগ তুলে বলল, “এই দুইটা হচ্ছে সোনাদানা আর টাকা-পয়সার ব্যাগ। মা-বোন তোমরা তোমাদের গয়নাপাতি এখানে দিবা। হাতের চুড়ি, কানের দুল, গলার নেকলেস কিছুই বাদ দিবা না। আজকাল অবশ্যি পুরুষ মানুষেও গয়না পরে। গলায় মালা দেয়, কানে দুল পরে। তোমাদের মাঝে যারা পুরুষ মানুষ গয়না পরে আছ গয়না খুলে দিবা।” নসু ডাকাত তখন আরেকটা ব্যাগ দেখিয়ে বলল, “এইটা হচ্ছে ক্যাশ টাকার ব্যাগ। যার পকেটে মানি ব্যাগে যত টাকা আছে সব এই ব্যাগে। ঠিক আছে?”

কেউ কোনো কথা বলল না, নসু ডাকাত সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। তিনজন ডাকাত একটা বস্তা আর দুইটা পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে জিনিসপত্র, সোনা গহনা আর মানিব্যাগ থেকে টাকা-পয়সা নিতে শুরু করল। মহিলারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাদের কানের দুল, হাতের চুড়ি খুলে দিতে লাগলেন, ছোট একটা বাচ্চা মেয়ের গলা থেকে মালাটা খুলে নেওয়ার সময় সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। শামসের দামি ক্যামেরাটা নেবার সময় ডাকাতগুলো খুশি হয়ে উঠল, নসু ডাকাতকে দেখিয়ে বলল, “ওস্তাদ! মালদার পার্টি। দামি ক্যামেরা।”

নসু ডাকাত বলল, “ছবি ওঠে?”

শামস মাথা নাড়ল। নসু ডাকাত জিজ্ঞেস করল, “ছবি দেখা যায়?” শামস আবার মাথা নাড়ল। নসু ডাকাত তখন তার কাটা রাইফেলটা ঘাড়ে নিয়ে বীরত্বব্যঞ্জক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বলল, “তোল আমার ছবি, ভালো না হলে কিন্তু জবাই করে ফেলমু।”

শামস বেশ কয়েকটা ছবি তুলল, নসু ডাকাত ছবিগুলো দেখে বেশ খুশি হল। শামসের পিঠে থাবা দিয়ে সে ক্যামেরাটা নিয়ে নিজের ঘাড়ে ঝুলিয়ে ফেলল। দামি ক্যামেরাসহ নসু ডাকাতকে তখন অত্যন্ত বিচিত্র দেখাতে থাকে।

কবি শাহরিয়ার মাজিদের মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করার সময় আবার একটু ঝামেলা হল, সেখানে একটা ময়লা পঞ্চাশ টাকার নোট এবং দুইটা বিশ টাকার নোট। ডাকাতটা খেপে গিয়ে বলল, “আর কিছু নাই?”

শাহরিয়ার মাজিদ মাথা নাড়লেন, “জে না। নাই।”

“ফকিরনীর পুত! তোর পকেটে একশ টাকাও নাই?”

শাহরিয়ার মাজিদ মাথা নিচু করে বসে রইলেন। ডাকাতটা রাইফেলের গোড়া দিয়ে তাকে মারতে গেল, শাহরিয়ার মাজিদ হাত তুলে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে করতে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললেন, “আপনাগো আল্লাহর কসম লাগে আমারে মাইরেন না। আপনাগো পায়ে ধরি বাজান গো আমারে মাফ করেন। আমি নাদান মানুষ–”

শাহরিয়ার মাজিদের কান্নায় কাজ হল, ডাকাতটা তাকে ছেড়ে দিয়ে পরের জনের কাছে গেল।

কিছুক্ষণের মাঝেই সবার কাছ থেকে যা কিছু নেওয়ার মতো সব নিয়ে নেওয়া হল। ডাকাতগুলো পুঁটলি বেঁধে সেগুলো নিয়ে উপরে উঠে যায়। যাবার আগে চারিদিকের তেরপলের পর্দাগুলো টেনে দিল যেন বাইরে থেকে কেউ ভিতরে দেখতে না পারে।

নসু ডাকাত যাবার আগে উপরে ওঠার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একটা হুমকি দিল, “খবরদার কেউ কোনো রকম উল্টাপাল্টা কাজ করবা না। এইখানে সবাই চুপচাপ বসে থাকবা। কোনো কথাবার্তা নাই, কোনো গোলমাল নাই। আমরা উপরে আছি, যদি শুনি নিচে গোলমাল, কথাবার্তা তা হলে কিন্তু খুন করে ফেলব।”

সবাই চুপ করে রইল। নসু ডাকাত আবার বলল, “মনে থাকে যেন, আমি কোনো গোলমাল চাই না। ছোট পোলাপানরা যেন উঁ্যা ফুঁ না করে। আমি কিন্তু পোলাপানদের কান্নাকাটি সহ্য করি না।”

নসু ডাকাত সিঁড়ি দিয়ে আরও দুই পা উঠে আরও একবার দাঁড়াল, বলল, “এইখানে একজন বন্দুক নিয়ে পাহারায় থাকব। সাবধান।”

নসু ডাকাতের পিছু পিছু রাজাও উপরে উঠে যাবার চেষ্টা করছিল, অন্য ডাকাতগুলো তাকে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলেও নসু ডাকাত হাত নেড়ে তাকে আসতে অনুমতি দিল।

উপরে উঠে রাজা সাবধানে একবার চারদিক ঘুরে এলো। সারেং টিকেট মাস্টার খালাসি সবাইকে হাত-পা বেঁধে বিভিন্ন ঘরে তালা মেরে রেখেছে। কেবিনের প্রত্যেকটা রুম খোলা, ভিতরে সবকিছু তছনছ হয়ে আছে। ডাকাতের দল ডেকের মাঝামাঝি বসে নিচ থেকে কেড়ে নিয়ে আসা জিনিসপত্র, গয়নাগাটি, টাকা-পয়সার হিসাব করতে বসে।

নসু ডাকাত টাকাগুলো গুনল, গয়নাগুলো হাতে নিয়ে ওজন আন্দাজ করার চেষ্টা করল, বস্তার ভিতর হাত দিয়ে মোবাইল টেলিফোনগুলো দেখার চেষ্টা করে না-সূচকভাবে মাথা নেড়ে বলল, “এত বড় একটা জাহাজ দখল করে মাত্র এই অল্প কয়টা জিনিস? পোষালো না।”

নসু ডাকাতের পাশে বসে থাকা কম বয়সী একটা ডাকাত বলল, “মাছ ধরার ট্রলার লুট করেই তো এর থেকে বেশি পাওয়া যায়।”

“সমস্যাটি কী বুঝেছিস?”

“কী?”

“বড়লোকেরা আজকাল পকেটে ক্যাশ টাকা রাখে না। প্রাস্টিকের একরকম কার্ড আছে, সেইটা দিয়ে টাকা-পয়সার লেনদেন করে।”

কম বয়সী ডাকাত বলল, “ক্রেডিট কার্ড।“

“হ্যাঁ। ক্রেডিট কার্ড।” নসু ডাকাত গাল চুলকে বলল, “বড়লোকের বেটিরা রাস্তাঘাটে গয়নাগাটিও পরে না। যদি মনে কর একটা বিয়াবাড়িতে ডাকাতি করতে পারতাম দেখতি তা হলে কী হত!”

“কিন্তু এইটা তো বিয়াবাড়ি না। এইটা জাহাজ।”

“মালসামান বোঝাই জাহাজ হলে একটা কথা ছিল–খালি জাহাজ!”

ডাকাতগুলো বিরক্ত হয়ে তাদের লুট করা জিনিসগুলো দেখতে থাকে। একজন আনসার গুলি খেয়েছে সেটাও ঝামেলা। পরের কয়দিন পুলিশ-কোস্টগার্ড বিরক্ত করবে। যদি মানুষটা মরে যায় তা হলে তো অনেকদিন জঙ্গল থেকেই বের হতে পারবে না।

নসু ডাকাত আবার হতাশভাবে মাথা নাড়ল, না একেবারেই পোষালো না।

কম বয়সী ডাকাতটা বলল, “ওস্তাদ। বেয়াদপি না নিলে একটা কথা বলি?”

নসু ভুরু কুঁচকে তাকালো ”কী বলবি?”

“ধরেন এই জাহাজে মালসামান, টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি না থাকতে পারে কিন্তু ধরেন একটা জিনিসের তো অভাব নেই।”

“কী?”

“বড়লোকের সুন্দর সুন্দর বেটাবেটি! ধরেন যদি তার কয়েকটারে ধরে নিয়ে যাই, তারপর যদি বলি বিশ লাখ, পঁচিশ লাখ টাকা না দিলে ছাড়মু না। তা হলেই তো এক কোটি হয়ে যায়।”

নসু ডাকাত তীক্ষ্ণ চোখে কম বয়সী ডাকাতটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “বদি।”

“জে ওস্তাদ।”

“তোর মাথাটা সবার চাইতে পরিষ্কার।”

বদি খুশি হয়ে উঠল, দাঁত বের করে হেসে বলল, “আপনার দোয়া।”

“একেবারে ফার্স্ট ক্লাস বুদ্ধি।”

“জে।”

“আমাগো কোনো তাড়াহুড়া নাই, কোনো দৌড়াদৌড়ি নাই, খোঁজাখুঁজি নাই। সবগুলা আমাদের জন্যে নিচে অপেক্ষা করছে। আমরা শুধু নিচে যামু, তারপর বেছে বেছে কয়েকটারে তুলে নিয়ে আসমু।”

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কালো মতোন একজন ডাকাত বলল, “সুন্দর সুন্দর মেয়েলোক দেখে–”

নসু ধমক দিল, “চোপ থাক কাউলা। খালি সুন্দর সুন্দর মেয়ে! সুন্দর সুন্দর মেয়ে। টাকা দিলে আমার কাছে সবই সুন্দর।”

কম বয়সী ডাকাত বদি বলল, “জোয়ার শুরু হতে ধরেন এখনও এক ঘণ্টা। আমাদের হাতে অনেক সময়।”

নসু বলল, “কিন্তু বড়লোকের বেটাবেটি ধরে আনার জন্যে দেরি করে লাভ নাই। টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি ভয়ের চোটে দিয়ে দেয়, আপত্তি করে না। কিন্তু ছেলেপিলে কেড়ে নিতে হলে মনে হয় বাধা দিতে পারে।”

কালোমলতান ডাকাত কাউলা বলল, “আমাগো সবার হাতে বন্দুক। বাধা দিব মানে? গুলি করে দুইটা লাশ ফেলে দিলেই সব ঠাণ্ডা।”

নসু বলল, “মাথা ঠাণ্ডা রাখ কাউলা। লাশ যদি ফেলতে হয় দুইটা কেন আমি দুই ডজনও ফেলতে পারি। কিন্তু লাশ মানেই ঝামেলা। ভয় দেখা, মাইরপিট কর কিন্তু দরকার না হলে লাশ ফেলবি না।”

“ঠিক আছে।”

বদি জানতে চাইল, “তা হলে কী ঠিক হল ওস্তাদ?”

নসু ডাকাত বলল, “চল, এখন নিচে যাই। তারপর যে কটা দরকার ধরে আনি।”

“ধরে এনে রাখব কোথায়?”

“সোজা ট্রলারে। ট্রলারের ঝাঁপ ফেলে দে। নিচে বেঞ্চে ফেলে রাখবি। গামছা দিয়ে মুখ বেন্ধে রাখবি। চোখ বেন্ধে রাখবি।”

ডাকাতগুলো মাথা নাড়ল। বলল, “জে আচ্ছা।”

নসু বলল, “চল যাই।”

বদি বলল, “যাবার আগে এক কাপ চা খেয়ে শরীলটা গরম করে নিই ওস্তাদ।”

“চা। চা কোথায় পাবি?”

“নিচে ব্যবস্থা আছে। তাই না রে রাজা?”

রাজা একজন ডাকাতের ঘাড়, হাত-পা টিপে দিচ্ছিল। সে মাথা নাড়ল। বলল, “জে ওস্তাদ আছে।”

“যা নিচে যা, সাত কাপ চা নিয়ে আয়।”

“সাথে আর কিছু? বিস্কুট, কলা?”

“যা আছে নিয়ে আয়।”

রাজা উঠে দাঁড়াল। বলল, “ঠিক আছে ওস্তাদ।”

.

রাতুল চমকে উঠে বলল, “কী বলছ? জিম্মি নেবে?”

রাজা এদিক-সেদিক তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, “জে বাই। সুন্দর সুন্দর দেখে মেয়েছেলে ট্রলারে তুলে নিয়ে যাবে।”

“সর্বনাশ।”

“জে বাই। সর্বনাশ। আমারে চা আনতে বলেছে। চা খেয়েই নিচে নামবে।”

রাজা কোনো কথা বলল না। রাতুল বুকের ভেতর কেমন এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। যখন তাদের টাকা-পয়সা, জিনিসপত্র নিয়েছে তখন কেউ আপত্তি করেনি। যদি এখান থেকে মেয়েদের তুলে নেয় তখন তো চুপ করে বসে থাকা সম্ভব নয়-তাদের বাধা দিতে হবে। তখন কী হবে? তখন গোলাগুলি হবে? তাদের কেউ গুলি খাবে? মারা যাবে? রাতুল পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারছে না। সব মিলিয়ে সাতজন ডাকাত-সবার কাছেই এখন বন্দুক না হয় রাইফেল। মানুষগুলো ভয়ংকর, খালি হাতেই ভয়ংকর। হাতে অস্ত্র থাকলে এরা আরও একশ গুণ ভয়ংকর হতে পারে।

রাজা চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, “এখন কী করব, ভাই?” সে একটু আগে উপর থেকে নিচে নেমে এসেছে। নিচে সবার চুপচাপ বসে থাকার কথা। তারপরও সে সাবধানে রাজার সাথে কথা বলছে। আশেপাশে কেউ নেই কিন্তু সবাই তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই বুঝে গেছে কিছু একটা বিপদ আসছে।

রাতুল বলল, “তুমি চা বানাতে শুরু কর। আমি আসছি।”

রাতুল তখন খুব সাবধানে, প্রায় নিঃশব্দে নাট্যকার বাতিউল্লাহর কাছে গেল। পাশে বসে গলা নামিয়ে বলল, “স্যার। আপনার পকেটে ঘুমের ট্যাবলেটগুলো আছে না?”

“হ্যাঁ আছে। কেন?”

“আমাকে দেন।”

“কী করবে?”

“এখন প্রশ্ন করবেন না স্যার, আমাকে দেন।”

“তুমি কী করবে? পরে আমি বিপদে পড়ব।”

“আমরা সবাই বিপদের মাঝে আছি। এর থেকে বেশি বিপদের মাঝে পড়া সম্ভব না।”

বাতিউল্লাহ খুব অনিচ্ছার সঙ্গে ট্যাবলেটগুলো বের করলেন। রাতুল সাবধানে হাতে নিয়ে বলল, “কয়টা খেলে একজন খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে?”

“সেটা মানুষের সাইজের উপর নির্ভর করে।”

“সাধারণ সাইজ।”

“দুইটা। দশ মিনিটে আউট হয়ে যাবে।”

“ওষুধের কোনো গন্ধ আছে? স্বাদ?”

“থাকবে না কেন? যে কোনো ওষুধের গন্ধ থাকে, স্বাদ থাকে।”

“বেশি, না কম?”

“বেশি-কম এই শব্দগুলো খুবই আপেক্ষিক।”

“আহ্!” রাতুল বিরক্ত হয়ে বলল, “বাড়াবাড়ি কিছু আছে কি না–”

“মনে হয় নাই। কিন্তু লং টাইম রি-অ্যাকশান–”

রাতুল আর কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করল না। সাবধানে রাজার কাছে হাজির হল। রাজা সাত কাপ চা তৈরি করেছে। রাতুল বলল, “আট কাপ বানাও।”

“আরেকটা কেন?”

“তোমার জন্যে। তুমিও খাবে।”

“কেন?”

রাতুল দুটো দুটো ট্যাবলেট গুঁড়ো করে চায়ের কাপে দিয়ে বলল, “ওদের বিশ্বাস করানোর জন্যে। এগুলো ঘুমের ওষুধ, দশ মিনিটের মাঝে ঘুমিয়ে পড়বে।”

রাজার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ”সত্যি!”

“হ্যাঁ। যদি খাওয়াতে পার।”

“আমি খেলে আমিও ঘুমিয়ে পড়ব?”

“হ্যাঁ। কাজেই তুমি খাবার ভান করবে। এক-আধ চুমুক খাবে, বেশি না।”

“ঠিক আছে।”

রাতুল এদিক-সেদিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, “তারা যদি ওষুধের গন্ধের কথা বলে তা হলে বলবে, পানি বিশুদ্ধ করার ট্যাবলেট দিয়ে আমরা পানি খাই। সেই জন্যে পানিতে ক্লোরিনের গন্ধ। বুঝেছ?”

“বুঝেছি। ক্লোরিন?”

“হ্যাঁ, ক্লোরিন। মনে থাকবে?”

“জে। মনে থাকবে।”

রাতুল তখন বাক্স থেকে নতুন বিস্কুটের প্যাকেট বের করে দিল, কলা দিল, চানাচুরের প্যাকেট দিল। দিয়ে বলল, “যাও। এখন সবকিছু নির্ভর করছে তোমার উপর। যদি বুঝতে পারে ঘুমের ওষুধ দিয়ে চা এনেছ তা হলে তোমাকে কিন্তু খুন করে ফেলবে।”

“জানি।”

“ভয় করছে?”

“না। আমার ভয় করে না।” রাজা দাঁত বের করে হাসল, “আমার মা আমার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দিয়েছে, আমার কখনো বিপদ হবে না।”

রাতুল একটু হিংসা অনুভব করে, রাজার মতো সেও যদি বিশ্বাস করতে পারত যে তার কখনো কোনো বিপদ হবে না!

রাজা চায়ের কাপ, বিস্কুট, কলা, চানাচুর সবকিছু ডেকের ওপর রাখল। সাথে সাথে ডাকাতগুলো গোগ্রাসে খেতে শুরু করে। কয়েকজন চায়ের কাপ টেনে নিয়ে চুমুক দেয়। রাজা চোখের কোনা দিয়ে লক্ষ করে, একজন একবার ভুরু কুঁচকে চায়ের দিকে তাকাল। তারপর আবার চুমুক দিল। তারপর খেতে থাকল।

নসু ডাকাত চায়ে চুমুক দিয়েই ভুরু কুঁচকে বলল, “চায়ে ওষুধের গন্ধ কেন?”

“পানি।” রাজা হড়বড় করে বলল, “এরা পানির মাঝে ওষুধ দিয়ে খায়, সেই ওষুধের গন্ধ।”

“কীসের ওষুধ?”

“পানি বিশুদ্ধ করার ওষুধ। একজনের পেটের অসুখ হয়েছিল, তখন থেকে পানিতে এই ওষুধ দেয়। পানির মাঝে ওষুধের গন্ধ।”

নসু ডাকাত আবার চায়ের কাপটা শুকে মাথা নেড়ে রেখে দিল। রাজা জিজ্ঞেস করল, “খাবেন না ওস্তাদ?”

“নাহ।”

“আমি আপনারটা খাই?”

“খাবি? খা। ওষুধের গন্ধওয়ালা চা যদি খেতে চাস, তা হলে খাবি।”

“আমার অভ্যাস হয়ে গেছে” বলে রাজা চায়ের কাপ নিয়ে শব্দ করে চুমুক দিল। চা-টা খেলো না, মুখে রেখে দিয়ে পরের বার চুমুক দেওয়ার সময় বের করে দিল।

সাতজন ডাকাতের মাঝে শুধু চারজন চা খেলো। নসু ডাকাত গন্ধের জন্যে খেলো না। বদি আর কালোমলতান ডাকাতটা চা খাওয়ার চেষ্টা করল না। তারা না। কী চা খায় না।

চা-নাস্তা খেয়ে ডাকাতগুলো উঠে দাঁড়াল। কাটা রাইফেলটা একবার পরীক্ষা করে নসু ডাকাত বলল, “আয় যাই।”

সিঁড়ি দিয়ে যখন সাতজন ডাকাত নেমে এলো তখন নিচে আবার একটা ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যারা নিচু গলায় কথা বলছিল তারা সবই কথা বন্ধ করে থেমে গেল। রাতুল রাজার দিকে তাকাল, সে পিছনে পিছনে নেমে এসেছে। রাজা সাবধানে চারটা আঙুল দেখাল, রাতুল অনুমান করে নেয় রাজা বোঝানোর চেষ্টা করছে চারজন চা খেয়েছে। তার মানে তিনজন খায়নি। তার মানে তিনজন ভয়ংকর ডাকাত এখনও রয়ে গেছে। রাতুল বুকের ভিতরে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। সে ডাকাতদের মুখের দিকে তাকিয়ে অনুমান করার চেষ্টা করল কারা ঘুমিয়ে পড়বে, কিন্তু বুঝতে পারল না। ওষুধের কাজ হতে আরও সময় নেবে মনে হয়।

নসু ডাকাত ঘ্যাস ঘ্যাস করে তার গাল চুলকে না-সূচকভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “নাহ্। পোষালো না। এত বড় একটা জাহাজ, এতগুলো বড়লোক মানুষ-মালসামান, গয়নাগাটি, টাকা-পয়সা গুনে দেখি কিছুই না। মনে হয় সব ফকিরনীর পুত জাহাজে উঠে এসেছে।”

হঠাৎ করে তার মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। নসু ডাকাত দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “এত কম টাকায় আমি রাজি না। আমি তাই তোদের কয়টাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছি। বিশ লাখ করে টাকা দিলে আমি ছেড়ে দেব।”

বদি ডাকাত হুংকার দিয়ে বলল, “মাত্র বিশ লাখ!”

নিচে বসে থাকা সবাই আতঙ্কের একটা চিৎকার করল। নসু ডাকাত সাথে সাথে তার বন্দুকটা উঁচু করে বলল, “খবরদার। একটা কথা না।”

জাহাজের নিচে আবার নৈঃশব্দ্য নেমে আসে। নসু ডাকাত নিচে বসে থাকা আতঙ্কিত মানুষগুলোর দিকে তাকায়। তার প্রথম পছন্দ হল শারমিনকে। আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, “এইটা।”

শারমিন, তার সাথে অনেকে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। নসু ডাকাত চিৎকার করে বলল, “খবরদার, কোনো শব্দ না। খুন করে ফেলব।”

শারমিনের মা তবুও চিৎকার করে অনুনয়-বিনুনয় করতে থাকে। কিন্তু কোনো লাভ হল না। দুজন ডাকাত গিয়ে শারমিনের দুই হাত ধরে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে আসে। নসু ডাকাত এরপর পছন্দ করল গীতিকে-সবার শেষে তৃষাকে। দুজন দুজন করে ডাকাত এক-একজনকে ধরে টেনে হিঁচড়ে নিতে থাকে। রাতুল শেষ মুহূর্তে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল। নসু ডাকাত তখন তার কাটা রাইফেলের বাট দিয়ে রাতুলের মাথায় প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল। রাতুল হাত দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করল, পারল না। মাথা ঘুরে সে নিচে পড়ে গেল।

.

কিছুক্ষণের মাঝে সে টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের খুব বড় বিপদ। আমাদের তিনজনকে ধরে নিয়ে গেছে। এটা হতে পারে না।”

আলমগীর ভাই বললেন, “হতে পারে না মানে কী? হয়ে গেছে।”

“এখনো হয়নি।”

“তুমি কী বলতে চাইছ?”

“আমাদের হাতে এখনো একটু সময় আছে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে।”

শামস বলল, “তোমার মাথা খারাপ? ওদের কাছে কত রকম আর্মস দেখেছ? এখনো তো কেউ মারা যায়নি। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে কেউ না কেউ গুলি খাবে। কেউ না কেউ মারা যাবে।”

“তার মানে আমরা আমাদের তিনজন মেয়েকে ধরে নিয়ে যেতে দেব?”

“কী করবে তা না হলে। যত তাড়াতাড়ি আমরা ফিরে গিয়ে র‍্যানসামের টাকা দিতে পারব–”

রাতুল শামসের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাওয়ার কোনো উৎসাহ পেল না। সে অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার কয়েকজন ভলান্টিয়ার দরকার।”

সজল জিজ্ঞেস করল, “কেন? কী করতে হবে?”

“আমি আমার প্যানটা বলি। সব মিলিয়ে ডাকাত হচ্ছে সাতজন। এর মাঝে আমরা চারজনকে ডাবল ডোজ ঘুমের ওষুধ খাওয়াতে পেরেছি। তাই না রাজা?”

রাজা মাথা নাড়ল, “জে। চারজন।”

আলমগীর ভাই চমকে উঠে বললেন, “কী বললে? ঘুমের ওষুধ খাইয়েছ? কেমন করে?”

“চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে। আমাদের রাজা করেছে। তার মানে আর দশ মিনিটের মধ্যে চারজন ঘুমিয়ে পড়বে। বাকি থাকল তিনজন। এক সাথে তিনজনের সাথে ফাইট করা যাবে না। কিন্তু একজন একজন করে হলে সম্ভব।”

শামস আবার বলল, “তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে? তারা আর্মড।”

রাতুল শামসের কথা পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল, “রাজা উপর থেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে একজন করে নিচে আনবে, আমরা তাকে সবাই মিলে ধরব। আমাদের পক্ষে কাজ করবে দুটো জিনিস। এক, আমরা অনেকেই আছি। দুই. ওরা মোটেও জানে না যে আমরা এটা করব। সারপ্রাইজ ভ্যালু।”

শামস বলল, “আমি এসবের মাঝে নেই। তুমি তোমার নিজের লাইফকে রিস্কের মাঝে ফেলতে চাও সেটা তোমার ইচ্ছা। কিন্তু তুমি আমাদের লাইফকে বিপদে ফেলবে সেটা আমি হতে দেব না।”

সজল বলল, “রাতুল আমি রাজি।”

শান্ত বলল, “আমি রাজি স্পাইডার ভাইয়া।”

সাথে সাথে অন্য সব বাচ্চা হাত তুলে বলল, “আমরা রাজি। আমরা রাজি।”

রাতুল মুখে আঙুল দিয়ে বলল, “শ স স স… কোনো শব্দ না। ভেরি গুড। বাচ্চারা হলে আরো ভালো, সারপ্রাইজটা আরও বেশি হবে। এখন আমি বলি আমাদের কী করতে হবে।”

রাতুল গলা নামিয়ে ওদেরকে তার পরিকল্পনাটা বোঝাতে থাকে।

.

রাজা উপরে উঠে দেখল, যে চারজন ঘুমের ওষুধ খেয়েছে তারা কেমন যেন জবুথবু হয়ে বসে আছে। মেয়ে তিনজন ট্রলারের ভেতর বাঁধা। বদি বস্তার ভেতরে জিনিসগুলো বাঁধছে, রাজা তার কাছে গিয়ে ফিস ফিস করে বলল, “ওস্তাদ, আপনার সাথে একটা জরুরি পরামর্শ করতে পারি? গোপনে।”

বদি দাঁত বের করে হাসল। বলল, “আমার সাথে? গোপনে?”

“জে।” রাজা ষড়যন্ত্রীর মতো মুখ করে বলল, “কেউ যেন টের না পায়।”

“কী পরামর্শ? বল?”

“আপনি যদি কিরা কাটেন–কাউরে বলবেন না, তা হলে আপনারে বলব।”

বদি রাজার মাথায় চাটি মেরে বলল, “বদমাইশের বাচ্চা। তোর সাহস তো কম নয়! আমারে বলিস কিরা কাটতে!”

“আমি পুরা ব্যাপারটা বললেই আপনি বুঝবেন ওস্তাদ। শুধু বলেন, আমারে একটু ভাগ দিবেন।”

বদি এবারে চোখ সরু করে বলল, “কীসের ভাগ?”

“কাউরে বলবেন না তো? খালি আমি আর আপনে।”

“ঠিক আছে।”

“খোদার কসম?”

বদি বিরক্ত হয়ে রাজার মাথায় আরেকটা চাটি দিয়ে বলল, “বল কী বলবি? তোর জন্যে আমি কসম-কিরা কাটব? বেকুব কোথাকার!”

রাজা গলা নামিয়ে বলল, “নিচে একজন স্যারের কাছে এই রকম টাকার একটা বান্ডিল। মাদুরের তলায় লুকায়া রাখছে। সব পাঁচশ টাকার নোট।”

“সত্যি!” বদির চোখ লোভে চক চক করে ওঠে।

”জে ওস্তাদ। আপনি নিচে আসেন, আমি দেখায়া দেই।”

বদি এক মুহূর্ত চিন্তা করল, নসু ডাকাতকে কিছু না বলে এতগুলো টাকা নিজে নেওয়াটা বিপজ্জনক। কিন্তু এই রকম সুযোগ আর কখন পাবে? বদির যুক্তি-তর্ক লোভের কাছে হার মানল। সে রাজার দিকে তাকিয়ে বলল, “চল যাই।”

রাজা বদিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে একটু যেতেই দেখা গেল বাচ্চারা গায়ে গা লাগিয়ে বসে আছে। রাজা তাদের ভেতর দিয়ে জায়গা করে এগিয়ে যেতে যেতে গলা নামিয়ে বলল, “ঐ যে মোটা মতোন ফর্সা মানুষটা দেখছেন–”

রাজা তার কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই হঠাৎ করে একসাথে সব বাচ্চা বদির পা ধরে হ্যাঁচকা টান দেয় আর সে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। সাথে সাথে বিদ্যুৎ গতিতে সবাই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কেউ কিছু বোঝার আগে একজন টান দিয়ে তার বন্দুকটা কেড়ে নেয়। একজন মুখের মধ্যে একটা কাপড় গুঁজে দেয় যেন শব্দ করতে না পারে। অন্যরা তাকে চেপে ধরে রাখে।

কে কী করবে আগে থেকে ঠিক করে রাখা ছিল। সবাই নিখুঁতভাবে তার দায়িত্ব পালন করল। আর দুই মিনিটের মধ্যে দেখা গেল বদি ডাকাতকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা হয়েছে।

শান্ত জিজ্ঞেস করল, “এখন এই ডাকাতকে কী করব স্পাইডার ভাইয়া?”

রাজা বলল, “বাইরে পানির মাঝে ফালায়া দেন। মারবেলের মতো টুপ করে ডুবে যাবে! ফিনিশ।”

রাজার প্রস্তাব শুনে বদি ডাকাত চমকে ওঠে। তার কিছু করার নেই। একটু নড়াচড়া করেই প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল। রাতুল বন্দুকটা হাতে নিয়ে বলল, “খবরদার। যদি নড়াচড়া কর, আসলেই পানিতে ফেলে দিব।”

বদি ডাকাত নড়াচড়া বন্ধ করল। জাহাজের মাঝখানে একটা ডালার মতো আছে। সেটা খুললে জাহাজের খোলটা দেখা যায়। যখন অনেক মালপত্র আনতে হয় তখন সেটাতে ভর্তি করে আনা হয়। এখন সেটা খালি। কিছু তেলের ড্রাম, বাক্স এবং জঞ্জাল পড়ে আছে। সবাই মিলে ধরাধরি করে এনে বদি ডাকাতকে তার ভেতরে ফেলে দিয়ে ডালাটা বন্ধ করে দিল।

রাতুল রাজাকে বলল, “এখন যাও। আরেকজনকে নিয়ে এসো। পারবে না?”

রাজা দাঁত বের করে বলল, “পারুম স্যার।”

উপরে উঠে দেখা গেল চারজন ডাকাত ঘুমে ঢলে পড়ে গেছে। কালোমতোন ডাকাতটা, যাকে নসু ডাকাত কাউলা বলে ডেকেছে সে বেশ অবাক হয়ে ঘুমিয়ে থাকা ডাকাতগুলোকে জাগানোর চেষ্টা করছে। নসু ডাকাত নেই। মনে হয় ট্রলারে গেছে।

রাজা গিয়ে কাউলা ডাকাতকে ডাকল, “ওস্তাদ।”

কাউলা ঘুরে রাজাকে দেখে কেমন যেন ক্ষেপে উঠল। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলল, “দূর হ হারামজাদা।”

রাজা গালাগালি গায়ে মাখল না। বলল, “ওস্তাদ আপনার সাথে একটা গোপন কথা।”

“তোর সাহস তো কম না! আমার সাথে গোপন কথা!”

“শুনলে আপনি তাজ্জব হয়ে যাবেন ওস্তাদ।”

কাউলা মুখ খিঁচিয়ে ধমক দিয়ে বলল, “চুপ থাক।” তারপর একটা অশ্লীল গালি দিল।

রাজা বুঝতে পারল, কাউলাকে টাকার লোভ দেখিয়ে নেওয়া যাবে না। তার সাথে কথাই বলতে চাইছে না। রাজা তখন সরাসরি তার দুই নম্বর পরিকল্পনায় চলে গেল। কাউলার কাছাকাছি এসে সে থুঃ করে তার মুখে এক দলা থুথু ফেলে দিল।

ফল হল ভয়ংকর। কাউলা রাগে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে রাজাকে ধরার চেষ্টা করল। রাজা প্রস্তুত ছিল। সে জানে, যদি এখন কাউলা ডাকাত তাকে ধরতে পারে তা হলে তার মাথা টেনে ছিঁড়ে ফেলবে। তাই সে লাফ দিয়ে সরে গেল। শুধু যে সরে গেল তা-ই না, একটু দূরে সরে গিয়ে কাউলার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচে দিল। কাউলা তখন লাফিয়ে উঠে রাজাকে ধরতে চেষ্টা করে। রাজা প্রাণপণে ছুটতে থাকে। তার পিছু পিছু কাউলা ছুটে আসে।

সিঁড়ি দিয়ে রাজা নেমে যায়। কাউলা কোনো কিছু চিন্তা না করে তার পিছু পিছু ছুটে আসে। বাচ্চাদের গায়ের ওপর পা দিয়ে সে ছুটে যাচ্ছিল। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই সব বাচ্চা তার পা ধরে ফেলে। কাউলা তাল সামলাতে না পেরে ধড়াম করে পড়ে যায়। সাথে সাথে অন্যেরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

বদি ডাকাতকে যত সহজে আটকানো গিয়েছিল কাউলাকে এত সহজে আটকানো গেল না। তার শরীরে মোষের মতো জোর। একেকটা ঝটকা দিতেই একেকজন কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল। তার পরেও তারা তাকে ছাড়ল না। রাতুল বন্দুকের বাঁট দিয়ে তার মাথার পিছনে জোরে একটা আঘাত করার পর সে শেষ পর্যন্ত নিস্তেজ হয়ে হাল ছেড়ে দিল।

এবারে দ্রুত তার মুখে কাপড় গুঁজে শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হল। তারপর পাটাতনের ডালা খুলে তার ভেতরে তাকেও ফেলে দেওয়া হল।

রাতুল ঘুরে তাকিয়ে দেখল বাচ্চাদের অনেকেই ব্যথা পেয়েছে। মৌটুসির নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, শান্তর কপালের কাছে আলুর মতো ফুলে আছে। জামা কাপড় ঘেঁড়া, চুল এলোমেলো। কিন্তু সবাই উত্তেজিত।

রাতুল দুই হাতে দুইটা বন্দুক নিয়ে বলল, “সাতজনের ভেতর ছয়টাকেই আমরা কাবু করে ফেলেছি। এখন বাকি একটা। আমাদের কাছে বন্দুক দুইটা। ওপরে গেলে আরও পাব।” রাতুল রাজার দিকে তাকিয়ে বলল, “পাব না রাজা?”

“জে। চাইরটা। বন্দুক আর কাটা রাইফেল।”

“গুড। তার মানে আমাদের সব মিলিয়ে ছয়জন ওপরে যাব। ছয়জনের হাতে ছয়টা বন্দুক। সর্দারটাকে কাবু করা কঠিন কিছু হবে না। দরকার হলে গুলি করে দেব। ঠিক আছে?”

অবস্থা মোটামুটি আয়ত্তের মধ্যে চলে এসেছে দেখে এবারে অনেকেই উপরে যেতে রাজি। শুধু শামস বলল, “তোমরা কেউ কখনো বন্দুক দিয়ে গুলি কর নাই। দরকার হলেও গুলি করতে পারবে না। ঐ ডাকাতটা ঠিকই গুলি করতে পারে, সে সবাইকে শেষ করে দিবে।”

রাতুলের পরিকল্পনা এতক্ষণ নিখুঁতভাবে কাজ করেছে। তার উপরে এবারে সবার বিশ্বাস জন্মে গেছে। কাজেই শামসের কথা শুনে কেউ ভয় পেল না। আলমগীর ভাই পর্যন্ত একটা বন্দুক হাতে নিয়ে নসু ডাকাতকে ধরতে রাজি হয়ে গেলেন।

প্রথমে রাজা সাবধানে উঠে চারদিক দেখেশুনে বন্দুকগুলো টেনে সিঁড়ির কাছাকাছি এনে রাখে। নসু ডাকাত ট্রলারে কিছু একটা করছে। কাজেই এখনই সময়। প্রথমে রাতুল তারপর অন্য সবাই একজন একজন করে উপরে উঠে যায়। সবাই একটা করে বন্দুক নিয়ে একটু আড়ালে চলে গেল। নসু ডাকাত যখন উপরে উঠে আসবে তখন তাকে ঘেরাও করে ফেলা হবে। বন্দুক নিয়ে সবাই নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে থাকে।

নসু ডাকাত জাহাজে সবকিছু তুলে তার দলের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। জোয়ার এখনো শুরু হয়নি, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হয়ে যাবে। এখন রওনা দেওয়া যায়। সে সবার জন্যে অপেক্ষা করছে কিন্তু কেউ আসছে না দেখে একটুখানি অবাক এবং অনেকখানি বিরক্ত। সে কয়েকবার চিৎকার করে ডাকল। কেউ সাড়া দিল না। তখন সে হঠাৎ একটু দুশ্চিন্তিত হয়ে যায়। কাটা রাইফেলটা ধরে সে তখন সাবধানে জাহাজে উঠে আসে। আর হঠাৎ সে অবাক হয়ে দেখল ছয় জন তার দিকে বন্দুক তাক করে রেখেছে। রাতুল চিৎকার করে বলল, “হ্যান্ডস আপ।”

নসু ডাকাতের মুখটা দেখতে দেখতে ভয়ংকর হয়ে উঠল। বলল, “আমি মুখ্য-সুখ্য মানুষ। ইংরেজি বুঝি না। কী বলো?”

“বলেছি, হাতের রাইফেলটা নিচে ফেলে হাত তুলে দাঁড়াও।”

“যদি না দাঁড়াই তা হলে কী করবা?”

“গুলি করে দেব।”

“গুলি করবা? তুমি?” নসু ডাকাত হা হা করে হাসল এবং কিছু বোঝার আগে হঠাৎ সে বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে এসে রাজাকে ধরে তার মাথায় কাটা রাইফেলটা ধরে বলল, “তোমরা গুলি করবা না, আমি জানি। আমি কিন্তু গুলি করমু। সবার হাতের বন্দুক নিচে ফেল। তা না হলে এই হারামজাদা পোলার মাথার ঘিলু বের হয়ে যাবে।”

হঠাৎ পুরো পরিবেশটা পাল্টে যায়। নসু ডাকাত চিৎকার করে বলল, “বন্দুক নিচে ফেল, নইলে গুলি করমু।”

রাজার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে। সেখানে অবর্ণনীয় এক ধরনের আতঙ্ক। একজন একজন করে সবাই তাদের হাতের বন্দুক আর রাইফেল নিচে নামিয়ে রাখে। নসু ডাকাত তখন রাজার মাথায় কাটা রাইফেলটা ধরে রেখে আস্তে আস্তে পিছিয়ে গিয়ে ট্রলারটাতে ওঠে। ট্রলারের দড়িটা খুলে সেটাকে মুক্ত করে নেয়। ইঞ্জিনটাকে চালু করে তারপর ট্রলারটা চালিয়ে নিতে থাকে।

অন্য সবার সাথে রাতুল হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে দেখতে পেল নসু ডাকাত রাজার মাথায় রাইফেল ধরে রেখে শারমিন, গীতি আর তৃষাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। রাতুল পুরো ব্যাপারটা চিন্তাও করতে পারছে না। চিন্তা করার জন্যে সে অপেক্ষাও করল না। নসু ডাকাত যখন অন্যদিকে তাকিয়ে আছে সে তখন পানিতে ঝাঁপ দিল। পানিতে তলিয়ে গেল প্রথমে। সাঁতরে সে উপরে উঠতে উঠতে ট্রলারের দিকে এগিয়ে যায়। ট্রলারটা ঘুরছে। সেই জন্যে সে খানিকটা সময় পেয়ে গেল। একসময় সে ভালো সাতার কাটতে পারত। ঢাকা শহরে থেকে সে পানিতে নামেনি বহুদিন। সমুদ্রের কনকনে শীতল লোনা পানিতে আবার সে প্রাণপণে সাঁতার কেটে ট্রলারটাকে ধরে ফেলল।

ট্রলারটা এবার বেশ দ্রুত চলতে শুরু করেছে। রাতুল নিজেকে টেনে উপরে তুলল। মাথাটা একটু উপরে তুলতেই দেখতে পেল নসু ডাকাত শারমিন, গীতি আর তৃষাকে বেঁধে রেখেছে। তাদের চোখ কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা বলে তারা কিছু দেখতে পাচ্ছে না। রাতুল সাবধানে নিঃশব্দে পিছন দিয়ে ওপরে উঠল। নসু ডাকাত রাজাকে ট্রলারের ছাদে শুইয়ে রেখে পা দিয়ে তাকে চেপে ধরে রেখেছে। এক হাতে কাটা রাইফেল অন্য হাতে হাল ধরে সে ট্রলারটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নসু ডাকাত তাকে দেখছে না, রাজা তাকে দেখতে পেল আর সাথে সাথে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। রাতুল নিঃশব্দে রাজাকে ইঙ্গিত দিল তারপর দুজন একসাথে নসু ডাকাতকে আক্রমণ করল। রাজা হ্যাঁচকা টানে রাইফেলটা টেনে নিয়ে তার দু পা দিয়ে নসু ডাকাতের দুই পায়ের ফাঁকে প্রচণ্ড জোরে একটা লাথি মারে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাতুল তার সর্বশক্তি দিয়ে নসু ডাকাতের মুখে একটা ঘুষি মারল। নসু ডাকাত অবাক হয়ে পিছনে তাকাতেই রাতুল আবার সর্বশক্তি দিয়ে তার মুখে আরেকটা ঘুষি মারল। হাল থেকে নসু ডাকাতের হাতটা ছুটে যেতেই ট্রলারটা ঘুরে যায়, আর সাথে সাথে তাল হারিয়ে নসু ডাকাত ঝপাং করে পানিতে পড়ে যায়।

রাজা তখন আনন্দে একটা চিৎকার করে ওঠে। রাতুল হালটা ধরে পানির দিকে তাকাল। নসু ডাকাত পানিতে পড়ে ডুবে যাবার মানুষ নয়। সাঁতরে নিশ্চয়ই উঠে যাবে। কোথায় উঠবে সেটাই সে দেখতে চায়।

ট্রলারটা তখন জাহাজের কাছাকাছি চলে এসেছে। ঠিক তখন রাতুল এক ঝলকের জন্যে নসু ডাকাতকে দেখতে পেল। পানির ওপর মাথা তুলে একবার নিশ্বাস নিয়ে আবার ডুবে যায়, মনে হয় জাহাজের সামনের দিকে যাচ্ছে। নিচে বেঁধে রাখা তিনজনকে খুলে দেওয়া দরকার। কিন্তু রাতুল উদ্বিগ্ন মুখে পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। ট্রলারটা জাহাজকে স্পর্শ করার সাথে সাথে রাতুলের মনে হল নসু ডাকাতকে সে আরও একবার দেখতে পেয়েছে। জাহাজের নোঙর ধরে উপরে ওঠার চেষ্টা করছে। সে লাফ দিয়ে জাহাজে নেমে চিৎকার করে বলল, “ডাকাত! নসু ডাকাত!” তারপর সে সামনের দিকে ছুটে যেতে থাকে।

.

ঠিক তখন শামসকে দেখা গেল। সে জাহাজ থেকে লাফ দিয়ে ট্রলারে উঠে রাজার হাত থেকে নসু ডাকাতের কাটা রাইফেলটা নিয়ে একটা বীরত্বসূচক ভঙ্গি করে দাঁড়াল। তারপর ভিতরে ঢুকে চোখ বেঁধে রাখা তিনটি মেয়ের বাঁধন খুলে দিতে থাকে। গম্ভীর মুখে বলে, “মেয়েরা, তোমাদের আর কোনো ভয় নেই। আমি চলে এসেছি।”

তৃষা বড় বড় নিশ্বাস নিতে নিতে অবাক হয়ে কাঁপা গলায় বলল, “কী হয়েছে? কেমন করে আমাদের উদ্ধার করলেন?”

শামস কাটা রাইফেলটা ঘাড়ে নিয়ে ভঙ্গি করে হাসল, বলল, “সে অনেক বড় কাহিনী! আপাতত জেনে রাখো, তোমাদের কোনো ভয় নেই। আমি আছি।”

গীতি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। শামস তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কাঁদছ কেন বোকা মেয়ে! আমরা থাকতে তোমাদের নিয়ে যাবে-সেটা কি হতে পারে?”

শামস যখন তিনজনকে উদ্ধার করে নিয়ে আসছে এবং বস্তার ভেতর থেকে উদ্ধার করা দামি ক্যামেরাটি দিয়ে নিজেদের ছবি তুলছে, রাতুল তখন জাহাজের সামনে নসু ডাকাতকে খুঁজছে। তার সঙ্গে নসু ডাকাতকে খুঁজতে যারা এসেছে সবাই রেলিংয়ের উপর থেকে মুখ নিচে করে তাকিয়ে আছে। নসু ডাকাতকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু রাতুল জানে, সে আশেপাশে কোথাও আছে।

রাতুল হেঁটে হেঁটে একেবারে সামনে এসে যখন নিচের দিকে তাকিয়েছে ঠিক তখন সে পিছনে একটা শব্দ শুনতে পেল। মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই সে দেখে নসু ডাকাত হাতে একটা রড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাতুল ঘুরে তাকাননা মাত্রই প্রচণ্ড আক্রোশে সে রাতুলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

রাতুল বিদ্যুৎ বেগে পাশে সরে গিয়ে কোনোভাবে নিজেকে রক্ষা করল। নসু ডাকাতের সাথে মারামারি করার ক্ষমতা তার নেই। কিন্তু অন্যরা আসার আগে তার নিজেকে রক্ষা করতে হবে। কলেজে পড়ার সময় সে কিছুদিন তাইকোয়ান্ডো ক্লাস করেছিল। রেড বেল্ট পর্যন্ত গিয়ে থেমে যেতে হয়েছিল। মাসে মাসে অনেক টাকা লাগে। টিউশনির টাকা দিয়ে এই বিলাসিতা সে কুলাতে পারেনি। তার ইন্ট্রাক্টর অবশ্য রাতুলকে নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলেন। বলেছিলেন, ব্ল্যাক বেল্ট পর্যন্ত যেতে পারলে টুর্নামেন্টে সে নির্ঘাত কোনো একটা মেডেল পাবে। রাতুলের ধারণা ছিল, টুর্নামেন্টে মেডেল পাওয়াই হচ্ছে এ ধরনের মার্শাল আর্টের উদ্দেশ্য। নসু ডাকাতের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে এই প্রথম সে বুঝতে পারল, মেডেল নয় তার প্রাণটাই আসল উদ্দেশ্য। হয়তো তাইকোয়ান্ডোর অল্প কিছু ট্রেনিংই তাকে রক্ষা করবে। নসু ডাকাত যখন আবার তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তখন সে ঘুরে গিয়ে তার পা তুলে নসু ডাকাতের মুখে একটা লাথি মেরে দেয়। তাইকোয়ান্ডো ক্লাসে চেষ্টা থাকত কেউ যেন ব্যথা না পায়। এখন তার সব প্রচেষ্টা হচ্ছে মানুষটাকে যত জোরে সম্ভব আঘাত করা।

নসু ডাকাত লাথি খেয়ে নিচে পড়ে যায়। কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে সে রাতুলের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর হিংস্র পশুর মতো আবার রাতুলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নসু ডাকাত রাতুলকে নিচে ফেলে দিয়ে তার উপর বসে তাকে মারতে থাকে। রাতুলের মনে হল তাকে বুঝি খুনই করে ফেলবে। প্রাণ বাঁচানোর জন্যে কোনোমতে নিজেকে রক্ষা করে সে ছিটকে সরে আসে। একটু দূরে গিয়ে সে আবার পা তুলে নসু ডাকাতকে আঘাত করল। একবার দুইবার। তারপর অনেকবার।

নসু ডাকাত বুঝতে পারছে না, কেমন করে একজন শুকনো পাতলা মানুষ তাকে এভাবে মারতে পারে! সে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে করতে ধড়াম করে নিচে পড়ে গেল। দুর্বলভাবে একবার ওঠার চেষ্টা করল, পারল না। রাতুল রেলিং ধরে যখন বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে তখন দুজন ছুটে এসেছে। রাতুলকে দেখে বলল, “কী হয়েছে?”

রাতুল হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ থেকে রক্ত মুছে নসু ডাকাতকে দেখিয়ে বলল, “বেঁধে ফেল। এই ডাকাতটাকে কোনো বিশ্বাস নেই।”

.

রাতুল হাঁটতে গিয়ে অনুভব করল তার পায়ের কোনো একটা জায়গায় খুব ব্যথা পেয়েছে। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে নিচে একটা বেঞ্চে বসে পা-টাকে সামনে ছড়িয়ে দেয়। বুক থেকে একটা বড় নিশ্বাস বের করে দিয়ে সে চোখ বন্ধ করে। ঠিক তখন জাহাজে একটা আনন্দোৎসব শুরু হয়েছে। শামসের নেতৃত্বে সব ডাকাতকে শক্ত করে বাঁধা হয়েছে। শামস তাদের সামনে কাটা রাইফেল হাতে নাটকীয় একটা ভঙ্গি করে ছবি তুলল। জাহাজের বিভিন্ন ঘরে তালা মেরে আটকে রাখা খালাসি সারেং সবাইকে ছাড়ানো হল। গুলি খাওয়া আনসারকে একটু প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হল। জোয়ারের পানি বেড়ে গেছে বলে কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজটাকে ডুবোচর থেকে মুক্ত করে নেওয়া হল। জাহাজটা যখন সুন্দরবনের ভেতরে ঢুকে গেল এবং আবার টেলিফোন নেটওয়ার্কের ভেতর চলে এল তখন শামস তার নাটকীয় ছবিগুলো ফেসবুকে আপলোড করে সারা পৃথিবীতে প্রচার করে দিল।

বেঞ্চে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থেকে রাতুল টের পেল গা কেঁপে তার জ্বর আসছে। আসুক, এখন জ্বর এলে ক্ষতি নেই। সবাই বেঁচে গেছে, সবাই একসাথে আছে সেটাই বড় কথা।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল