দ্বিতীয় পর্ব

০৬.

বলাই কাকুর চায়ের স্টলে খুব ভিড়। মানুষগুলোর উশকু-খুশকো চেহারা, কাল রাতে মিলিটারি ঢাকা শহর আক্রমণ করেছে খবর পাবার পর কেউ আর ভালোমতো ঘুমাতে পারেনি। ঢাকা রেডিও স্টেশনে খুবই খারাপ উচ্চারণে একজন মাঝে মাঝে হুমকি-ধামকি দিয়ে কথা বলছে–কী অবাক লাগে যখন একটা রেডিও থেকে কেউ এই ভাষায় কথা বলে। চিটাগাং রেডিও স্টেশনটা ঠিক আছে, সেখানে জানা গেল সারা দেশে প্রচণ্ড যুদ্ধ হচ্ছে, পাকিস্তানি মিলিটারি যুদ্ধে প্রায় হেরেই যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সবার দুশ্চিন্তা, জানা গেল বঙ্গবন্ধু নিরাপদে আছেন। সেটা শুনে বলাই কাকুর চায়ের দোকানে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, বঙ্গবন্ধু ভালো থাকলেই কেউ কিছু করতে পারবে না।

আকাশবাণী কলকাতা থেকে শুধু আমার সোনার বাংলা গানটি গেয়ে শোনাচ্ছে, একবার বলে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, পাকিস্তান মিলিটারির সাথে বাঙালি পুলিশ, ইপিআর ছাত্র-জনতা যুদ্ধ করছে, তারপর আমার সোনার বাংলা গানটি শোনায়! আর অন্য কোনো অনুষ্ঠান নাই।

বিবিসি শুনে বোঝা গেল ঢাকায় সবচেয়ে ভয়ংকর অবস্থা। পুরো শহরটা মনে হয় ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে, কত লোক মারা গেছে তার কোনো হিসাব নাই। বাইরে থেকে কেউ কোনো খবর পাচ্ছে না, কারণ সব বিদেশি সাংবাদিকদের ধরে জোর করে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। তারা এয়ারপোর্টে যাবার সময় যেটুকু দেখেছে তাতেই পুরোপুরি স্তম্ভিত। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ।

আমি বেশ কিছুক্ষণ বলাই কাকুর চায়ের স্টলে বসে থাকলাম, রেডিওতে যা বলছে, লোকজন যেসব আলোচনা করছে সেগুলো শুনলাম। মাসুদ ভাই এক কোনায় বসে উত্তেজিতভাবে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে। যখন বিদেশি কোনো রেডিও স্টেশনে ইংরেজিতে কিছু বলে মাসুদ ভাই সেটা বাংলায় বুঝিয়ে দিচ্ছিল। সবাই মাসুদ ভাইয়ের কাছে জানতে চাইছিল এখন কী হবে, মাসুদ ভাই এই প্রশ্নটার উত্তর ভালো করে দিতে পারে না। মাথা চুলকে বলে, যদি পাকিস্তান মিলিটারিকে এখন হারিয়ে দিতে পারি তাহলে তো হয়েই গেল–

যদি না পারি?

তাহলে যুদ্ধ হবে। গেরিলা যুদ্ধ।

কত দিন?

মাসুদ ভাইয়ের মুখটা শক্ত হয়ে যায়, চাপা স্বরে বলেন নয়-দশ বছর।

সেটা শুনে সবাই অবিশ্বাসের শব্দ করে। একজন জিজ্ঞেস করে, এত দিন?

মাসুদ ভাই বলেন, আপনি জানেন ভিয়েতনাম কত দিন থেকে আমেরিকার সাথে যুদ্ধ করছে?

কেউই সেটা জানে না, তার পরেও সবাই এমনভাবে মাথা নাড়ল যেন সবকিছু জানে! আমাদের গ্রামের মানুষগুলো এ রকমই।

বলাই কাকুর চায়ের স্টলে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমি বের হলাম, বাড়ির কাছাকাছি আসার পর রাস্তায় মামুনের সাথে দেখা হলো। গাধাটা সারা রাত ঘুমিয়েছে, দেশে কী হচ্ছে কিছুই জানে না। সারা দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে সেটা শুনে এত অবাক হলো যে বলার মতো নয়। আমি যখন তাকে সবকিছু বলছি তখন সেটা শোনার জন্য আমার চারপাশে আরো কিছু মানুষ জড়ো হয়ে গেল। আমি একটু বাড়িয়ে-চাড়িয়ে বললাম। একজন জিজ্ঞেস করল, বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন?

আমি পরিষ্কার জানি না তার পরেও বলে দিলাম, নিরাপদে আছেন, গোপন জায়গা থেকে যুদ্ধের অর্ডার দিচ্ছেন।

যুদ্ধের কী অবস্থা?

ভাসা ভাসা যেটুকু শুনেছি সেটাই একটু বাড়িয়ে-চাড়িয়ে বললাম, চিটাগাং আমাদের দখলে। সেইখান থেকে আমাদের সৈন্য ঢাকার দিকে আগাচ্ছে। কালকের ভেতর ঢাকা দখল করে ফেলবে।

ঢাকার অবস্থা কী?

খুব খারাপ, ঢাকা শহরের একটা মানুষও বেঁচে নাই।

ইয়া মাবুদ।

আমি আর মামুন গ্রামের মাঝে ঘুরে বেড়ালাম। অনেকেই আমাদের কাছে দেশের খবর জানতে চাইল, আমি আমার মতো করে দেশের খবর দিতে লাগলাম, আমার দেখাদেখি একটু পরে মামুনও বানিয়ে বানিয়ে যুদ্ধের খবর বলতে লাগল। মোটামুটিভাবে বিকেলের মাঝে কাঁকনডুবি গ্রামের সবাই জেনে গেল, ঢাকা শহরে একজন মানুষও বেঁচে নাই কিন্তু এ ছাড়া পুরো বাংলাদেশ আমাদের দখলে। তুমুল যুদ্ধ করে পাকিস্তানি মিলিটারিদের হারিয়ে সবাই ঢাকার দিকে এগোচ্ছে। ঢাকা যেকোনো সময়ে দখল হয়ে যাবে। তখন সারা দেশ হবে বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু হবেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট।

.

পরের দিন দুইটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল, দুপুরের দিকে চিটাগাং রেডিও স্টেশন থেকে মেজর জিয়া নামে একজন বঙ্গবন্ধুর নামে একটা ঘোষণা দিয়ে বলল বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। শুনে আমরা আনন্দে লাফাতে লাগলাম, আমি আর মামুন সবচেয়ে বেশি খুশি হলাম, তার কারণ আমরা নিজে থেকেই এটা আগেই সবাইকে বলে রেখেছি, আমাদের কথাটাই সত্যি বের হয়েছে।

বিকেলের দিকে অবশি একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটল। ঢাকা থেকে সরাসরি একজন মানুষ আমাদের কাঁকনডুবিতে হাজির হলো। মানুষটার খালি পা, পরনে লুঙি, গায়ে একটা ছেড়া শার্ট সেই শার্টে শুকনো রক্তের দাগ। মানুষটার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখ দুটো টকটকে লাল। চেহারার মাঝে এক ধরনের ভয়ের ছাপ।

সবাই মানুষটাকে ঘিরে দাঁড়াল, একজন জিজ্ঞেস করল, ভাই ঢাকার কী অবস্থা?

খুবই সহজ একটা প্রশ্ন, উত্তর দেওয়া মোটেই কঠিন না কিন্তু মানুষটা উত্তর না দিয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল। যখন একজন বড় মানুষ কাঁদে সেই দৃশ্যটা কেন জানি খুবই খারাপ লাগে। আমার দেখার ইচ্ছা করছিল না, তবু দাঁড়িয়ে রইলাম।

আমাদের কাঁকনডুবির একজন মুরব্বি মানুষটার গায়ে হাত দিয়ে বলল, বাবা, কান্দো কেন? বলো কী হইছে?

মানুষটা শার্টের হাতায় চোখের পানি নাকের পানি মুছে বলল, আপনারা চিন্তাও করতে পারবেন না কী অবস্থা! আমাদের বাসায় একটা জয় বাংলার পতাকা টানানো ছিল, নামাতে মনে নাই, মিলিটারি এসে বাসায় আগুন দিল। আমরা আগুন থেকে বাঁচার জন্য বাসা থেকে বের হইছি তখন সাথে সাথে গুলি। গুলি আর গুলি–

মানুষটা আবার কাঁদতে লাগল। সবাই তাকে ঘিরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, কী করবে বুঝতে পারছিল না। একসময় মানুষটা কান্না একটু থামিয়ে বলল, আমি ভাবছিলাম আমার গুলি লাগছে, আমি বুঝি মরেই গেছি। যখন জ্ঞান হইছে দেখি আমি মরি নাই। আমার উপরে লাশ নিচে লাশ পাশে লাশ। কোনোভাবে লাশের ভেতর থেকে বের হইয়া দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। রাত নাই দিন নাই খালি হাঁটতে হাঁটতে দৌড়াইতে দৌড়াইতে এইখানে আসছি।

একজন জিজ্ঞেস করল, আপনি যাবেন কোনখানে।

কৈলাসপুর। আমার বাড়ি কৈলাসপুর।

সেটা তো মেলা দূরে। আপনি বিশ্রাম নেন। খান, তারপর কাল সকালে যাবেন।

মানুষটা জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, না না, আমার এখনই যেতে হবে। এখনই বাড়ি যেতে হবে। কথা শেষ না করে আবার কাঁদতে লাগল।

সবাই মিলে মানুষটাকে জোর করে খাইয়ে দিল। খাওয়ার পর পরই মানুষটা সড়ক ধরে হাঁটতে লাগল। একজন বলল, মাথাটা আউলে গেছে। পুরাপুরি আউলে গেছে।

আমি মাথা আউলে যাওয়া মানুষটার পিছু পিছু অনেক দূর হেঁটে গেলাম, গ্রাম শেষ হবার পর যখন ধানক্ষেত শুরু হয়ে গেছে তখন আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। দেখলাম মানুষটা ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বাড়িতে তার কে আছে কে জানে। বাড়িতে গিয়ে সে কাকে কী বলবে, সেইটাই বা কে জানে।

পরের দিন ভোরবেলা ঢাকা থেকে আরো দুইজন লোক এল। ঘণ্টা খানেক পর আরো কয়েকজন। তারপর একসাথে প্রায় পঞ্চাশ জন মানুষ হাজির হলো। সেখানে ছেলে-বুড়ো আর মহিলাও আছে। হঠাৎ করে ভটভট শব্দ করে একটা লঞ্চ এসে কালী গাংয়ের ঘাটে থামল, সেখান থেকে অনেক মানুষ নামল। তারপর হঠাৎ করে সড়ক ধরে শত শত মানুষ আসতে লাগল, আমি জীবনেও একসাথে এত মানুষ দেখি নাই।

মানুষগুলো একেবারে বিধ্বস্ত, তাদের হেঁটে অভ্যাস নাই তাই পাগুলো একেবারে কেটে কুটে ফুলে আছে। চোখের নিচে কালি, ঠোঁটগুলো শুকনো, মহিলারা ছোট ছোট বাচ্চাদের বুকে চেপে রেখেছে। বাচ্চাগুলো চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে এখন আর কাঁদতেই পারছে না। অনেক মানুষের জামাকাপড় রক্তমাখা কেউ কেউ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, কেউ কেউ অন্যের ঘাড় ধরে হাঁটছে। মানুষগুলো গত এক-দুই দিন মনে হয় কিছু খায়নি, চেহারা দেখলেই সেটা বোঝা যায়। সবগুলো মানুষের চেহারার মাঝে একটা মিল আছে, সেটা হচ্ছে ভয় আর আতঙ্কের ছাপ। ভয়ের চিহ্নটি এতই স্পষ্ট যে দেখলেই বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায়। সব সময়েই এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। তাদের দেখে মনে হয় হঠাৎ করে কেউ বুঝি তাদের ওপর লাফ দিয়ে পড়বে।

গ্রামের মানুষজন নিজেদের সাথে কথা বলে এই মানুষগুলোর থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে শুরু করল আমাদের গ্রামের মানুষগুলো মোটামুটি সহজ-সরল। একটু লোভী, একটু কিপটে, একটু স্বার্থপর কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখলাম এই শত শত মানুষকে দেখে হঠাৎ তাদের ভেতরকার সব খারাপ বিষয়গুলো যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। সবাই মিলে এই মানুষগুলোকে সাহায্য করতে শুরু করল। মাসুদ ভাই মনে হলো একটা মনের মতো কাজ পেল, সবার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে শুরু করে দিল। যাদের সাথে ছোট বাচ্চাকাচ্চা আছে তাদেরকে গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে লাগল। আমিও দুইটা ছোট ছোট বাচ্চা আর তাদের কমবয়সী বাবা-মাকে বাড়িতে নিয়ে এলাম। একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম নানি দেখে না আবার রেগে ওঠে কিন্ত নানি একটুও রাগল না। বউটার হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে জলচৌকিতে বসিয়ে বলল, মা, তুমি যত দিন খুশি আমার বাড়িতে থাকে। তোমার কোনো চিন্তা নাই।

নানির কথা শুনে বউটা কেঁদে ফেলল, আর মাকে কাঁদতে দেখে ছোট ছোট দুইটা বাচ্চা অবাক হয়ে তাদের মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। বাবাটা কেমন যেন বেখাপ্পাভাবে উঠানে দাঁড়িয়ে থেকে এদিক-সেদিক তাকাতে লাগল। ঠিক কী করবে বুঝতে পারছে না। চেহারা দেখে বোঝা যায় এরা শহরের বড়লোক মানুষ এখন এই গাঁওগেরামে এসে অন্যের বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। আমি নানিকে বললাম, নানি আমি যাই।

অন্য দিন হলে নানি জিজ্ঞেস করত, কই যাস? কখন আসবি? আজকে কিছুই জিজ্ঞেস করল না, বলল, যা।

আমি বললাম, নানি, অনেক মানুষ আছে স্কুলে তাদের জন্য সবাই ভাত রেন্ধে দিচ্ছে। তুমিও রেন্ধে দিয়ো।

নানি বলল, ঠিক আছে। তারপর বলল, তুই যাবার আগে মাচার ওপর থেকে বড় ডেগ দুইটা নামায়া দে।

আমি মাচার ওপর থেকে বড় দুইটা ডেকচি নামিয়ে দিলাম, অনেক মানুষের জন্য রাঁধতে হলে বড় ডেকচি লাগতেই পারে।

.

স্কুলে সব মানুষের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। অল্প কিছু থালা-বাসন আছে বাকি সবাই কলাপাতায়। মানুষগুলো হাভাতের মতো খায়, দেখে মনে হয় এরা বুঝি জন্মেও খেতে পায়নি। চেহারা দেখে বোঝা যায় এদের মাঝে অনেকেই বড়লোক, বাসায় নিশ্চয়ই পোলাও কোরমা খায়। এখানে তারা শুধু ডাল আর ভাত এত তৃপ্তি করে খাচ্ছে যে দেখে আমারই খেতে লোভ হচ্ছে।

মানুষগুলো খাওয়ার পর একটু একটু করে মুখ খুলতে শুরু করে, সেগুলো শুনে আমাদের মন খারাপ হয়ে যেতে লাগল। তারা বলল, রাজারবাগে পুলিশের সাথে আর পিলখানায় ইপিআরের সাথে যুদ্ধ হয়েছে। পিলখানায় ইপিআরের কাছে অস্ত্র ছিল না, পাকিস্তান মিলিটারি আগেই তাদের নিরস্ত্র করে রেখেছে, তাই যুদ্ধ হয়েছে একতরফা। রাজারবাগে পুলিশের কাছে অস্ত্র ছিল, থ্রি নট থ্রি রাইফেল, সেইটা দিয়েই ভয়ংকর যুদ্ধ করে মিলিটারিদের ঠেকিয়ে দিয়েছে। মিলিটারি তখন ভারী অস্ত্র এনে রাজারবাগ পুলিশ লাইনকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে।

ঢাকা ইউনিভার্সিটির হলগুলোকে মিলিটারি আক্রমণ করেছে। যত ছাত্র ছিল সবাইকে মেরে ফেলেছে। সবচেয়ে বেশি মেরেছে ইকবাল হল আর জগন্নাথ হলে। শাঁখারীপট্টি পুরোটা জ্বালিয়ে দিয়েছে, বস্তিগুলোও জ্বালিয়ে দিয়েছে। আগুন থেকে বাঁচার জন্য যখন মানুষগুলো বের হয়েছে, তখন সবাইকে পাখির মতো গুলি করে মেরেছে।

আমি ঢাকা শহরের কিছু চিনি না, কিন্তু মানুষগুলোর মুখে মুখে যুদ্ধের বর্ণনা শুনে আমার মনে হতে লাগল আমি বুঝি ঢাকা শহরটাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।

খেয়ে-দেয়ে মানুষগুলো যে যেখানে জায়গা পেয়েছে, সেখানেই শুয়ে পড়ল, দেখতে দেখতে তারা ঘুমিয়ে পড়ল। আমি তাদের মাঝে ঘুরে ঘুরে মানুষগুলোকে দেখতে লাগলাম। কয়েক দিন আগেও তাদের ঘরবাড়ি সবকিছু ছিল, এখন তারা পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কে কোনখানে যাবে কিছু জানে না। কে কী খাবে কোথায় ঘুমাবে, সেটাও জানে না, কী আশ্চর্য!

হাঁটতে হাঁটতে স্কুলের শেষ মাথায় এসে আমি থমকে দাঁড়ালাম। বারান্দায় একজন মহিলা সোজা হয়ে বসে আছে, তার পাশে আরেকজন একটা প্লেটে একটু ভাত আর ডাল নিয়ে তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। মহিলাটি খাচ্ছেন না কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন, তার চোখের দৃষ্টি দেখলে বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। এ রকম শূন্য দৃষ্টি আমি কখনো দেখিনি। শুধুমাত্র মানুষ মরে গেলেই বুঝি এ রকম দৃষ্টি হওয়া সম্ভব।

পাশে দাঁড়ানো মানুষটি বলল, আপা, একটু খাও। একটু–

মহিলাটি কোনো কথা না বলে সেই শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমি আগে কখনো এ রকম দীর্ঘশ্বাস শুনিনি, মনে হয় বুকের ভেতর থেকে একটা হাহাকার বের হয়ে এল।

কী হয়েছে জানার জন্য আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম ঠিক তখন আমার পিঠে কে যেন হাত রাখল, তাকিয়ে দেখি মাসুদ ভাই। মাসুদ ভাই পিঠে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে আমাকে সরিয়ে নিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মাসুদ ভাই, কী হয়েছে?

মাসুদ ভাই বলল, ওনাকে একটু একা থাকতে দাও।

কেন মাসুদ ভাই? ওনার কী হয়েছে?

মাসুদ ভাই একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, ঢাকা শহরে কারফিউ তোলার পর তারা সেখান থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। সারা দিন হেঁটে হেঁটে সন্ধ্যেবেলা এক জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছেন তখন আবার হঠাৎ সেখানে মিলিটারি হামলা করল। সবাই তখন পাগলের মতো ছুটতে আরম্ভ করেছেন।

মাসুদ ভাই একটু থামল, আমি জিজ্ঞেস করলাম, তখন কী হয়েছে?

ছোট মেয়েটার হাত ধরে ছুটছেন, তখন হাত থেকে মেয়েটা ছুটে গেল। আবার ধরে ফেলল, তারপর ছুটতে লাগলেন–অনেক দূর ছুটে গিয়ে দেখেন–

কী দেখেন?

মাসুদ ভাই আবার নিঃশ্বাস ফেলল, দেখেন অন্য একটা ছোট বাচ্চার হাত ধরে ছুটছেন! সেই বাচ্চাটা বেঁচে গেছে নিজের মেয়ে হারিয়ে গেছে–আর খুঁজে পাননি।

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। মাসুদ ভাই বলল, বুঝলে রঞ্জু, এটা হচ্ছে যুদ্ধ। পৃথিবীতে যুদ্ধ থেকে ভয়ংকর আর কিছু নেই। কখনো ছিল না, কখনো থাকবে না।

.

০৭.

পরের এক সপ্তাহ শুধু মানুষ আসতে লাগল, একটু বিশ্রাম নিয়ে, কিংবা এক রাত থেকে তারা আবার চলে যেতে লাগল। কাঁকনডুবি গ্রামের সব মানুষ মিলে এই মানুষগুলোর থাকা-খাওয়া আর বিশ্রাম নেবার ব্যবস্থা করতে লাগল। এই কাজগুলো মাসুদ ভাই খুব ভালো পারে, তার সাথে কাঁকনডুবি গ্রামের অনেক কমবয়সী মানুষ আছে, আমরাও আছি। প্রথম প্রথম সবাই আমাদের তাড়িয়ে দিত, বলত, যাও যাও! ছোট পোলাপান ঝামেলা করো না। আমরা তবু আশপাশে থাকতাম, কাজে সাহায্য করতাম, পানি এনে দিতাম, কলাপাতা ছিঁড়ে দিতাম, খাওয়ার পর কলাপাতা টুকিয়ে ফেলে আসতাম। কুকুরগুলোকে তাড়াতাম–আস্তে আস্তে বড়রা আমাদের মেনে নিল, নিজে থেকে আমাদের ছোটখাটো ফাই-ফরমাশ দিতে লাগল। আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে সেগুলো করতে লাগলাম।

মানুষজন যখন চলে যেত তখন আমরা তাদের বড় সড়কে তুলে, কোন দিক দিয়ে যেতে হবে সেটা দেখিয়ে দিতাম। তাদের কারো কাছে জিনিসপত্র বেশি কিছু থাকত না–যেটুকু থাকত সেটাই আমরা ঘাড়ে করে খানিক দূর নিয়ে দিতাম।

একজন মাঝবয়সী মানুষ তার বউ আর মোল-সতেরো বছরের মেয়েকে আমরা বড় সড়কে তুলে দিয়ে যখন চলে যাচ্ছি তখন মানুষটি দাঁড়িয়ে আমার মাথায় হাত রেখে বলল, খোকা, তোমার নাম কী?

আমি বললাম, রঞ্জু। ভালো নাম–

মানুষটি বলল, ভালো নাম লাগবে না। রঞ্জু দিয়েই হবে। বুঝেছ রঞ্জু, একদিন এই যুদ্ধ শেষ হবে। হবে না?

আমি বললাম, হবে। জয় বাংলা হবে।

হ্যাঁ। জয় বাংলা হবে। তখন তুমি আমার বাসায় আসবে। আমার অনেক বড় বাসা, বাসার সামনে মাঠ। সেখানে শীতকালে আমরা কোর্ট কেটে ব্যাডমিন্টন খেলব। ঠিক আছে?

আমি বললাম, ঠিক আছে।

মানুষটা বলল, আমার বাসায় একটা লাইব্রেরি আছে সেখানে অনেক বই। তুমি বই পড় তো?

আমি বই পড়ি না কিন্তু সেটা তো বলা যায় না, তাই বললাম, হ্যাঁ। পড়ি।

গুড, তাহলে আমরা লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ব। তখন আমার রেকর্ড প্লেয়ারে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা এলপি লাগিয়ে দেব। প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়–তুমি রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনো তো?

আলাউদ্দিন চাচা ছাড়া আর কারও গান আমি শুনি নাই কিন্তু আমি মাথা নেড়ে বললাম যে শুনি। মানুষটা তখন বলল, তখন আমরা সবাই বসে গান শুনতে শুনতে গল্পের বই পড়ব। ঠিক আছে?

আমি বললাম, ঠিক আছে।

তারপর মানুষটা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে তার স্ত্রী আর খোল সতেরো বছরের মেয়েটাকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গেল। যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে জয় বাংলা হবে তখন এই মানুষটাকে আমি কোথায় খুঁজে পাব, মানুষটা বলে গেল না। আমিও মানুষটাকে জিজ্ঞেস করলাম না। কিন্তু মানুষের কথাগুলো আমার মাথার মাঝে ঘুরঘুর করতে লাগল, আমি কল্পনা করতে লাগলাম একটা সুন্দর বাসার ভেতরে একটা বড় ঘর, দেয়ালে সারি সারি বই সেখানে হেলান দিয়ে বই পড়ছি, বই পড়তে পড়তে গান শুনছি। যতবার চিন্তা করি ততবার কেমন যেন ভেতরে একটা শান্তি শান্তি লাগে। কী আশ্চর্য।

.

আজকাল আমি রাত করে বাড়ি ফিরে আসি, নানি কিছু বলে না। আমার দিকে কেমন করে জানি তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে আমরা স্কুলে সবার সাথে কলাপাতা বিছিয়ে খেয়ে আসি, বাড়ি এসে নানিকে বলি, নানি আজকে খেতে হবে না। স্কুল থেকে খায়া আসছি।

নানি জিজ্ঞেস করে কী খাইছিস?

আমি বলি, ভাত আর ডাল।

আর কিছু না?

নাহ।

ডিমের সালুন রাঁধছি। খাবি আরেকটু?

আমি সাথে সাথে রাজি হয়ে যাই। কী কারণ জানি না আজকাল খেতে খুবই ভালো লাগে, খালি খেতে ইচ্ছে করে, দিন-রাত রাক্ষসের মতো খাই। আমি একা না অন্যদেরও দেখি এই অবস্থা। সবাই শুধু খায়। নানি আমাকে ভাত বেড়ে দিল, আমি আবার রাক্ষসের মতো খেলাম, কে বলবে আমি একটু আগে খেয়ে এসেছি। খাওয়ার সময় নানি সব সময় আমার পাশে বসে সূবাইকে গালমন্দ করে, আজকে দেখি কিছু করল না, আমার পাশে বসে বসে আমাকে খেতে দেখল। মাসুদ ভাইকে জিজ্ঞেস করতে হবে যুদ্ধ শুরু হবার পর হঠাৎ করে খিদে এত বেড়ে গেল কেন!

ভোরবেলা স্কুলে যাচ্ছি তখন ফালতু মতির সাথে দেখা হলো। মতি জানে আমি কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, তার পরও জিজ্ঞেস করল, কই যাস?

স্কুলে। ঢাকা শহর থেকে প্রত্যেক দিন শত শত মানুষ আসছে, কাঁকনডুবি গ্রামের সবাই মিলে তাদেরকে স্কুলে খেতে দিচ্ছে, শুতে দিচ্ছে কিন্তু এর মাঝে মতিকে কোনো দিন দেখি নাই। তাই আমি জানি আমি স্কুলে যাচ্ছি শুনেই মতি নিশ্চয়ই তার ঠোঁটটা বাঁকা করে টিটকারি দিয়ে একটা বাজে কথা বলবে। আমি সেটা শোনার জন্য অপেক্ষা করে থাকলাম কিন্তু কী আশ্চর্য মতি টিটকারি দিয়ে কিছু বলল না। বরং গম্ভীর মুখে বলল, গেরামের মানুষ খুবই ভালো একটা কাজ করতেছে। বিপদে পড়া মানুষদের সাহায্য করছে। খুবই সওয়াবের কাজ।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি যাবা মতি ভাই?

মতি মাথা নাড়ল, বলল, নাহ্। সব তো মালাউন, মালাউনদের খেদমত করে কী হবে?

আমি অবাক হয়ে বললাম, মালাউন?

হ্যাঁ। মালাউনরা কপালের সিঁদুর মুছে হাতের শাঁখা খুলে যাচ্ছে যেন বোঝা না যায়। মালাউনদের পিছলা বুদ্ধি!

মতির কথা শুনে আমি খুবই অবাক হলাম, হিন্দুরা কেন কপালের সিঁদুর মুছে ফেলবে? হাতের শাখা খুলবে? আমি কথা না বাড়িয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছিলাম, তখন পেছন থেকে মতি বলল, তা ছাড়া মালাউনদের সাহায্য করলে কোনো সওয়াব নাই। মুসলমানদের সাহায্য করলে সওয়াব আছে।

আমি কোনো কথা না বলে স্কুলের দিকে হাঁটতে লাগলাম। স্কুলে অনেক ভিড়। যারা গত রাতে এসেছে তাদের অনেকে আজকে চলে যাচ্ছে। যাবার সময় আমরা তাদেরকে বড় সড়কে তুলে দিই। আমরা কাজে লেগে গেলাম। আমি দেখলাম, মতি আসলে ভুল কথা বলে নাই। বেশ কয়েকজন মহিলার কথা শুনে বোঝা যায় তারা হিন্দু কিন্তু তারা কপালের সিঁদুর মুছে ফেলেছে। হাতে শাখা নাই। কী আশ্চর্য। কারণটা কী, কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

মাসুদ ভাই খুবই ব্যস্ত, তাকে জিজ্ঞেস করতে পারলাম না, তাই বিকালবেলা বলাই কাকুর চায়ের স্টলে বলাই কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম। বলাই কাকু প্রশ্নটা শুনে একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, ইয়াহিয়া খান বলছে এই সব হচ্ছে ইন্ডিয়ার কারসাজি। মুসলমানদের দেশ পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলার জন্য হিন্দুদের ষড়যন্ত্র।

তাই বলেছে?

হ্যাঁ। সেই জন্য মিলিটারির সবচেয়ে বেশি রাগ হিন্দুদের ওপর। হিন্দুদের ওপর আর আওয়ামী লীগের ওপর। পাকিস্তান মিলিটারি যেখানে আওয়ামী লীগ পাচ্ছে আর হিন্দু পাচ্ছে, সবাইকে মেরে ফেলছে। এই জন্য যারা হিন্দু তাদের কেউ কেউ নিজের পরিচয় গোপন রাখছে।

কিন্তু এইখানে তো পাকিস্তান মিলিটারি নাই, এইখানে ভয় কী?

এইখানে কোনো ভয় নাই। কিন্তু রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, রাস্তাঘাটে কত রকম মানুষ আছে, তাদের কেউ যদি–

আমি বললাম, কিন্তু, কিন্তু—

কিন্তু কী সেটা জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। একটু পরে জিজ্ঞেস করলাম, বলাই কাকু, বঙ্গবন্ধু সবাইকে ঠিকমতো অর্ডার দেয় না কেন?

বলাই কাকু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বঙ্গবন্ধুকে মিলিটারিরা তো অ্যারেস্ট করে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গেছে।

আমি চিৎকার করে বললাম, না! নেয় নাই। আমি নিজে শুনেছি–

বলাই কাকু মাথা নিচু করে তার ছোট ছোট চায়ের গ্লাসগুলো ধুতে ধুতে বলল, সব পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে। বিবিসি থেকে বলেছে।

আমি আবার বললাম, কিন্তু, কিন্তু–আমি আবার কিন্তু কী, সেটা জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। হঠাৎ করে আমার মনটা এত খারাপ হলো যে বলার না। আমাকে দেখে নিশ্চয়ই বলাই কাকুর মায়া হলো। তাই বলাই কাকু আমাকে বেশি করে দুধ-চিনি দিয়ে চা বানিয়ে দিল। সাথে একটা কুকি বিস্কুট। আজকাল খেতে আমার এত ভালো লাগে, যা কিছু পাই গপগপ করে খেয়ে ফেলি, তার পরও কুকি বিস্কুটটা চায়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেতে অনেকক্ষণ লেগে গেল।

লতিফা বুবুর বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখলাম, বাংলাঘরের পাশে লতিফা বুবু দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে হাত নেড়ে ডাকল, এই, রঞ্জু!

আমি এগিয়ে গেলাম। লতিফা বুবু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোর মুখ এত শুকনা কেন? কী হইছে?

বঙ্গবন্ধুরে পাঞ্জাবিরা অ্যারেস্ট করেছে।

লতিফা বুবু কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল। মনে হয় খবরটা লতিফা বুবু আগেই শুনেছে। আমি বললাম, আমি ভাবছিলাম ঢাকা দখল হবে। এখন তো মনে হয় হবে না।

লতিফা বুবু বলল, দেশের অবস্থা খুব খারাপ। কাজীবাড়ির বড় ছেলেটা অনেক বড় ইঞ্জিনিয়ার ছিল, তারে মেরে ফেলেছে।

আমি মাত্র সেইদিন কাজীবাড়ি থেকে ফুল চুরি করেছি, অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম সত্যি?

হ্যাঁ, সত্যি। খবর আসছে।

কাজীবাড়ি আমাদের কাঁকনডুবি গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত পরিবার। এই বাড়ির ছেলেমেয়ে সবাই শিক্ষিত। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এই বাড়ির যে বিড়ালটা আছে সেটাও মনে হয় অ আ ক খ পড়তে পারে। সবাই শিক্ষিত হওয়ার কারণে একটা সমস্যা, বাড়িতে কেউ থাকে না। দুই বুড়াবুড়ি বাবা-মা, দূর সম্পর্কের আত্মীয় একজন কাজের মানুষ, ঘরবাড়ি দেখার জন্য দুইজন বয়স্ক মহিলা ছাড়া আর কেউ নাই। সবাই ঢাকা-চিটাগাং-খুলনা থাকে। ছোট ছেলেটা নাকি জার্মানি চলে যাবে। মাঝে মাঝে কোনো ঈদে কাজীবাড়ির ছেলেমেয়েরা তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়িতে আসে। সবাই শিক্ষিত বড়লোক, তাদের ছেলেমেয়েরাও টিসটাস–তাই আমাদের সাথে কথাবার্তা বলে না। নিজেরা নিজেরা থাকে আমরা দূর থেকে তাদের দেখি।

কাজীবাড়ির ইঞ্জিনিয়ার ছেলেটার কথা আমার খুব ভালো মনে আছে, ইটের নিচে চাপা পড়ে থাকা ঘাসের মতো ফর্সা, মাথায় টাক, কালো চশমা, খুবই গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। তার দুটি মেয়ে, ছোট মেয়েটা আমাদের বয়সী, বড়জন লতিফা বুবুর বয়সী। কিন্তু তারা খুবই অহংকারী। আমাদের সাথে কোনো দিন কথা হয় নাই। মিলিটারি এখন এই দুইজন অহংকারী মেয়ের বাবাকে মেরে ফেলেছে। তাদের এখন কী হবে? কোথায় থাকবে, কী করবে?

লতিফা বুবুও জানে না কী হবে। লতিফা বুবুর মা কাজীবাড়িতে গিয়েছিল, বুড়িমা নাকি একটু পরে পরে ফিট হচ্ছে। ছেলেকে মেরে ফেলার পর দুই মেয়ে নিয়ে ছেলের বউ কোথায় আছে কেউ জানে না।

লতিফা বুবু দেশের আরও কিছু খবর দিল, তাদের বাড়িতেও একটা রেডিও আছে, সেই রেডিওতে খবর শুনে জেনেছে। যশোর-কুষ্টিয়া বগুড়া-খুলনা এইসব জেলায় পাকিস্তানি মিলিটারির সাথে বাঙালিদের ভয়ংকর যুদ্ধ হয়েছে। প্রথমে মিলিটারিরা হেরে গিয়েছিল, তারপর পাকিস্তানিরা প্লেন দিয়ে বোমা ফেলেছে তখন বাঙালিরা আর টিকতে পারে নাই। এখন আস্তে আস্তে সারাদেশই মিলিটারি দখল করে ফেলছে।

শুনে আমার খুবই মন খারাপ হলো। একদিনে তিনটা খারাপ খবর, প্রথমে বঙ্গবন্ধুকে অ্যারেস্ট করার খবর, তারপর কাজী বাড়ির ইঞ্জিনিয়ার ছেলেকে মেরে ফেলার খবর, এখন সারা দেশ মিলিটারি দখল করে ফেলছে সেই খবর।

আমি খুবই মন খারাপ করে বাড়ি এলাম। কী হবে কিছুই বুঝতে পারছি না।

প্রত্যেক দিন বাড়ি এসে আমি নানিকে সব খবর দিই। আজকেও দিলাম, কাজীবাড়ির বড় ছেলের খবরটা নানি আগেই পেয়ে গিয়েছিল–এই গ্রামের যেকোনো খবর নানি কীভাবে কীভাবে জানি সবার আগে পেয়ে যায়। তবে বঙ্গবন্ধুর অ্যারেস্টের খবর আর আস্তে আস্তে পাকিস্তানি মিলিটারি সারা দেশ দখল করে ফেলার খবরটা নানি পায় নাই। খবরটা শুনেও নানির খুব একটা দুশ্চিন্তা হলো বলে মনে হলো না। আমি বললাম, নানি, এটা খুবই দুশ্চিন্তার খবর।

নানি বলল, যাদের দুশ্চিন্তা করার দরকার তারা দুশ্চিন্তা করুক। আমাগো এত দুশ্চিন্তার কী আছে?

পাকিস্তানি মিলিটারি যদি আসে তখন কী হবে?

পাকিস্তানি মিলিটারির আর কাম নাই তারা এই গেরামে আসবে। এইখানে এসে তারা কী করবে? কী আছে এই গেরামে?

কথাটা সত্যি। আসলেই এই গ্রামে কিছুই নাই। কয়টা মানুষ, কয়টা গরু-ছাগল আর কী আছে?

নানি আমাকে ভাত বেড়ে দিল। বেগুন ভাজি, মাগুর মাছ আর ডাল। শেষে দুধ-ভাত। আমি খুবই তৃপ্তি করে খেলাম, নানি পাশে বসে বসে আমার খাওয়া দেখল, যেদিন থেকে আমার খিদে বেড়ে গেছে সেদিন থেকে নানি খুবই মনোযোগ দিয়ে আমার খাওয়া লক্ষ্য করে।

খেতে খেতে আমি নানিকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা নানি তুমি একটা কথা বলতে পারবা?

কী কথা?

ধর্মের কথা।

নানি বলল, আমি কি ধর্মের কথা জানি? ধর্মের কথা জানে মুন্সি মাওলানারা। তবু শুনি তোর কথা।

আমি বললাম, মতি বলে বিপদের সময় হিন্দু মানুষদের সাহায্য করলে কোনো সওয়াব হয় না। শুধুমাত্র মুসলমানদের সাহায্য করলে সওয়াব হয়। এই কথা কি সত্যি?

নানি হতাশভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, এই মইত্যা হারামজাদা হচ্ছে বেকুবের বেকুব! এইটা একটা কথা হলো? বিপদের কি হিন্দু-মুসলমান আছে? বিপদের সময় একটা কুত্তা-বিলাইকে সাহায্য করলেও আল্লাহপাক খুশি হন। আর হিন্দুরা হচ্ছে মানুষ।

আমি বললাম, আমিও তাই বলি।

নানি বলল, কেমন করে এই রকম কথা বলল মইত্যা হারামজাদা! তারপর নানি মতিকে গালাগাল করতে লাগল। কী অসাধারণ সেই গালাগাল। শুনতেই ভালো লাগে।

.

০৮.

এইবারে খুবই গরম পড়েছে। বৈশাখ মাস গরম পড়তেই পারে কিন্তু এই গরমটা কেমন জানি অন্য রকম। একটু বেলা না হতেই সূর্যটা চড় চড় করে মাথার ওপর উঠে কেমন যেন আগুন ছড়াতে থাকে। আকাশে মেঘের চিহ্ন নাই, সারা গ্রাম কেমন যেন ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকে। গরু-ছাগলগুলো ছায়ার মাঝে নির্জীবের মতো বসে থাকে। আমাদের ছনের ঘর তার ভেতরেই আগুনের গরম, গ্রামের মাঝে যারা বড়লোক, টিনের ঘরে থাকে, তাদের কী অবস্থা কে জানে।

দুপুরের পরে যখন গরমটা একেবারে অসহ্য হয়ে ওঠে তখন একদিন নানি আকাশের দিকে তাকিয়ে ভয় পাওয়া গলায় বলল, ইয়া মাবুদ।

আমিও আকাশের দিকে তাকালাম, এক কোনায় এক চিলতে মেঘ। এটা দেখে ভয় পাওয়ার কী আছে? আর মেঘ থেকে যদি বৃষ্টি হয় সেটা তো খারাপ না, গরমটা একটু কমবে। আমি নানিকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হইছে নানি?

ঈশান কোণে মেঘ। নিশানা ভালো না। ঝড় আসতাছে। কালবৈশাখী।

শুনে আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল। আমাদের বাড়ির অবস্থা খুবই খারাপ, বড় ঝড় হলে বাড়ি উড়িয়ে নিয়ে যাবে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দোয়া করতে লাগলাম যেন মেঘটা কেটে যায়। কিন্তু মেঘটা কেটে গেল না, দেখতে দেখতে সেটা একটা জীবন্ত প্রাণীর মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল, কুচকুচে কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল, একটু আগেই যেখানে তীব্র রোদে চারদিক ঝলসে যাচ্ছিল সবকিছু এখন অন্ধকারে ঢেকে যেতে থাকে, মেঘের মাঝে বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে।

নানি উঠানে মরিচ শুকাতে দিয়েছিল, তাড়াতাড়ি সেগুলো তুলে ফেলল। উঠানে দড়ির মাঝে কাপড় শুকাতে দিয়েছিল সেগুলো তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। মোরগ-মুরগিগুলো ভয় পাওয়া গলায় কঁক কঁক করে ডাকতে ডাকতে তাদের খোপের ভেতর ঢুকে যেতে লাগল। আমি বাইরে গরু-ছাগলের ডাক শুনতে পেলাম, মানুষ ছোটাছুটি করছে চিৎকার করে একে অন্যকে ডাকাডাকি করছে।

আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে একটু পরে পরে বিজলি চমকাচ্ছে কিন্তু কোথাও এতটুকু বাতাস নেই। মনে হচ্ছে সবকিছু বুঝি নিঃশ্বাস বন্ধ করে ভয়ংকর কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করে আছে।

প্রথমে একটু দমকা হাওয়ার মতো এল, শুকনো পাতা ধূলিবালি উড়িয়ে নিতে লাগল, তারপর ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হতে শুরু করল। দেখতে দেখতে বৃষ্টির ফোঁটা বাড়তে থাকে, তার সাথে সাথে প্রচণ্ড বাতাসে সবকিছু উড়িয়ে নেবার মতো অবস্থা হয়ে যায়। নানি চিৎকার করে বলল, র, ঘরের ভেতরে আয়।

আমি ঘরের ভেতরে ঢুকলাম, বাতাস আর বৃষ্টিতে তখন চারপাশ প্রায় লণ্ডভণ্ড হতে শুরু করেছে। গাছগুলো বাতাসের দমকে প্রায় নুয়ে পড়তে শুরু করেছে, গাছের ডালপালা আছড়ে পড়ছে। দেখে মনে হয় গাছগুলো বুঝি জীবন্ত প্রাণী, হাত-পা নেড়ে অনুনয়-বিনয় করে ঝড়ের হাত থেকে মুক্তি চাইছে।

আমাদের ছনের ঘর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল, মনে হলো যেকোনো মুহূর্তে বুঝি বাতাসে উড়ে যাবে। আমরা মানুষের চিৎকার শুনতে পেলাম, অনেকে আজান দিতে শুরু করেছে। ভোলা দরজা দিয়ে পানির ঝাঁপটা এসে আমাদের ভিজিয়ে দিতে লাগল। গাছের ডাল ভেঙে পড়তে লাগল। কাছাকাছি কোনো বাড়ি থেকে টিনের ছাদ উড়ে গেল, আমরা তার বিকট শব্দ শুনতে পেলাম।

ঝড় বাড়তেই লাগল, আমার মনে হতে লাগল আমাদের বাড়িটা বুঝি উড়িয়েই নেবে, কিংবা চারপাশে বড় বড় গাছ, তার কোনো একটা হয়তো আমাদের বাড়ির ওপর ভেঙে পড়বে।

কতক্ষণ ঝড় হচ্ছিল জানি না, মনে হচ্ছিল কখনো বুঝি আর এই ঝড় থামবে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঝড় কমে এল। এতক্ষণ ক্রমাগত বিজলি চমকে গেছে কিন্তু মেঘের ডাক শুনতে পাইনি। এখন হঠাৎ করে বিকট শব্দে বাজ পড়ার শব্দ শুনতে লাগলাম। নানি চিৎকার করে কিছু একটা বলল, মেঘ বৃষ্টি ঝড়ের শব্দে নানির কথা শুনতে পারলাম না। আমি চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম, কী বলতেছ, নানি?

নানি চিৎকার করে বলল, আর ভয় নাই। মেঘ ডাকতাছে।

মেঘ ডাকলে কী হয়?

ঝড় কমে যায়।

সত্যি সত্যি ঝড় কমে এল, কিন্তু বৃষ্টি থামল না। ঝরঝর করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হতেই লাগল। ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি দেখার জন্য আমি বৃষ্টির মাঝেই বের হয়ে গেলাম।

চারদিকে গাছপালা ভেঙে পড়ে আছে। মাস্টারবাড়ির টিনের ছাদ উড়ে একটা বড় তেঁতুলগাছে ঝুলে আছে। বাড়ির লোকজন চিৎকার করে দৌড়াদৌড়ি করছে। আমি হেঁটে হেঁটে হিন্দুপাড়ার দিকে এলাম, এখানে কয়েকটা বাড়ি পড়ে গেছে, একজন মহিলা ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছে। আমি যখন চলে আসছিলাম তখন নীলিমাকে দেখলাম, ভিজে চুপসে হয়ে সে একটা বাছুরের গলা ধরে টেনে আনছে। আমাকে দেখে সে দাঁড়িয়ে গেল। এমনিতে কখনো আমার সাথে কথা বলে না কিন্তু আজকে কথা বলল, রঞ্জু।

হ্যাঁ।

তুমি এইখানে?

হ্যাঁ। ঝড়ে কী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে দেখতে বের হয়েছি।

আমাদের গোয়ালঘরটা পড়ে গেছে।

সত্যি?

হ্যাঁ। ঐ দেখ– নীলিমা হাত তুলে দেখাল। সত্যি একটা ছনের ঘর উবু হয়ে পড়ে আছে।

গরুগুলি ঠিক আছে?

নীলিমা মাথা নাড়ল, বলল, বাবা সময়মতো গরুর দড়ি কেটে গরু ছেড়ে দিয়েছে।

বড় ঝড় হলে গোয়ালঘরের গরু ছেড়ে দিতে হয়, তা না হলে ঘরে চাপা পড়ে গরু মরে যায়। মুসলমান বাড়িতে গরু মারা গেলে শুধু ক্ষতি হয়। হিন্দুবাড়িতে গরু মারা গেলে শুধু ক্ষতি হয় না, অনেক পাপ হয়।

আমি যখন চলে আসছি তখন নীলিমা বলল, রঞ্জু, আমি একটা কথা বলি, তুমি কাউরে বলবা না।

আমি একটু অবাক হলাম, জিজ্ঞেস করলাম, কী কথা?

আগে বলো কাউরে বলবা না। ভগবানের কিরা।

ঠিক আছে বলব না। কী কথা?

নীলিমা নিচু গলায় বলল, আমরা ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছি।

ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছ?

হ্যাঁ। এই দেশে হিন্দুরা আর থাকতে পারবে না।

আগে হলে আমি বলতাম কেন থাকতে পারবে না? এখন আর বলি, বলাই কাকু আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে এই দেশে কেন হিন্দুরা থাকতে পারবে না। আমি কিছুক্ষণ নীলিমার দিকে তাকিয়ে থাকলাম, কেন জানি আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কবে যাবা?

এই তো কয়েক দিনের মাঝেই। বাবা সবকিছু বিক্রি করার চেষ্টা করছে।

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললাম, যখন জয় বাংলা হবে তখন আবার চলে আসবে না?

জয় বাংলা হবে?

আমি বললাম, একশ বার হবে।

তত দিনে মিলিটারি সবাইরে মেরে শেষ করে দেবে। আমার কাকু শহরে থাকে, তারে মেরে ফেলেছে।

সত্যি?

হ্যাঁ। কাকুর মেয়ে, ষোল-সতেরো বছর বয়স তাকে ধরে নিয়ে গেছে।

কে ধরে নিয়ে গেছে?

মিলিটারি।

কেন?

নীলিমা কোনো কথা না বলে আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকল যেন আমি একটা গাধা!

আমি আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম, তখন নীলিমা বলল, ঐ যে তুলসীগাছ দেখছ?

আমি মাথা নাড়লাম। নীলিমা বলল, আমি যদি আর কোনো দিন না আসি তাহলে তুমি ঐ গাছের তলাটা খুঁড়বা।

কেন?

খুঁড়লেই বুঝতে পারবা।

নীলিমা হাত দিয়ে তার চোখ মুছল, বৃষ্টির পানিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে, সেই বৃষ্টির পানি মুছল নাকি চোখের পানি মুছল, আমি বুঝতে পারলাম না।

.

সপ্তাহ খানেক পরে কোনো একদিন নীলিমা তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেল। খবরটা পেলাম ফালতু মতির কাছে। লতিফা বুবুর বাসার সামনে তার সাথে দেখা হলো, মতি আমাকে থামাল, থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই, তোদের সাথে একটা মালাউনের বেটি পড়ে না?

স্কুলের সাথে বহুদিন কোনো সম্পর্ক নাই, মতির কথাটা বুঝতে আমার একটু সময় লাগল। যখন বুঝতে পারলাম তখন বললাম, নীলিমা?

মতি হাত নেড়ে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, নীলিমা ধলিমা জানি না। আছে না একজন?

হ্যাঁ। আছে।

খুবই মজার একটা কাণ্ড ঘটেছে এ রকম একটা ভঙ্গি করে মতি বলল, পুরা ফ্যামিলি ইন্ডিয়া ভেগে গেছে।

আমি জানতাম নীলিমারা চলে যাবে, তাই ফালতু মতির কথা শুনে খুব অবাক হলাম না। আমি চুপ করে রইলাম। মতি বলল, সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। এই গেরামে কোনো সমস্যা ছিল? ভেগে গেল কেন?

আমি তখনও কিছু বললাম না। মতি বলল, রাস্তাঘাটে কত বিপদ আপদ, তার মাঝে পুরা ফ্যামিলি নিয়া ভেগে গেল, বিষয়টা কী?

এবারে আমি উত্তর দিলাম, বললাম, হিন্দুদের এখন খুব বিপদ। মিলিটারি আওয়ামী লীগ আর হিন্দু পেলেই মেরে ফেলে।

এইখানে মিলিটারি কই? আছে?

যদি আসে? তখন তো আর পালাতে পারবে না। এই জন্য মনে হয় আগেই চলে গেছে।

ফালতু মতি তার পকেট থেকে একটা বক সিগারেটের প্যাকেট বের করে সেখান থেকে একটা অর্ধেক সিগারেট বের করে সেটাতে আগুন দিয়ে লম্বা টান দিয়ে বলল, আসল ব্যাপারটা কী জানস?

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম জানি না। ফালতু মতি বলল, এই মালাউন হচ্ছে নিমকহারামের মতো। এই দেশে থাকে খায়-দায়-ঘুমায় কিন্তু তার আসল দেশ ইন্ডিয়া। বলে হিন্দুদের একটা কুৎসিত গালি দিল।

আমি কোনো কথা বললাম না। ফালতু মতির সাথে কথা বলার কোনো অর্থ নেই। এই রকম ফালতু মানুষের কথা শুনলেই গা ঘিন ঘিন করে।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে চলে আসছিলাম, মতি আমাকে থামাল, জিজ্ঞেস করল, তোদের চ্যাংড়া মাস্টারের খবর কী?

চ্যাংড়া মাস্টার মানে হচ্ছে মাসুদ ভাই। ফালতু মতি মাসুদ ভাইকে দেখতে পারে না তাই আমি বললাম, ভালো।

চ্যাংড়া মাস্টার নাকি থানা লুট করছে?

ফালতু মতির কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম, বলে কী মতি! থানা লুট?

গেরামের লোকজন নিয়া নাকি থানার সব রাইফেল লুট করে নিছে! হে নাকি মিলিটারির সাথে যুদ্ধ করব?

আমি এসব কিছুই জানি না, শুনে খুবই উত্তেজিত হয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, সত্যি?

মতি তার অর্ধেক সিগারেটে যত্ন করে একটা টান দিয়ে বলল, সত্যি-মিথ্যা জানি না। খবর পাইছি। আমি তখন আর দেরি করলাম না, পাকা খবর নেওয়ার জন্য তখন তখনই বলাই কাকুর চায়ের স্টলের দিকে ছুটলাম। শুধু বলাই কাকুই আমাকে পাকা খবর দিতে পারবে। আমি অবশ্যি বেশি দূর যেতে পারলাম না, তার আগেই শুনতে পেলাম কে যেন চিকন গলায় ডাকছে, র, এই রঞ্জু।

তাকিয়ে দেখি লতিফা বুবু। আমি ঘুরে লতিফা বুবুর কাছে গেলাম, লতিফা বুবু বলল, কী ব্যাপার রঞ্জু তোকে আজকাল দেখি না।

দেখবে না কেন, লতিফাবু? এই তো আমি।

গেরামের খবর কী?

ভালো না। আমাদের ক্লাসে পড়ত নীলিমা, মনে আছে?

লতিফা বুবু মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, মনে আছে। শ্যামলা মতন ছোটখাটো মেয়েটা।

পুরা ফ্যামিলি ইন্ডিয়া চলে গেছে।

লতিফা বুবু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আহারে। নিজের দেশ বাড়িঘর ছেড়ে কে যেতে চায়? না জানি এখন কোথায় আছে, কেমন আছে!

আমি কিছু বললাম না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। লতিফা বুবু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মানুষের কত কষ্ট। কাজীবাড়ির ছেলেটারে কীভাবে মেরে ফেলল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, বউ-বাচ্চারা এখন কোথায় আছে জানো লতিফাবু?

না। কেউ জানে না। কোনো খোঁজখবর নাই। চাচাজি খোঁজ নিতে গেছেন।

আমি অবাক হয়ে বললাম, চাচাজি এত বুড়া মানুষ কেমন করে খোঁজ নেবেন।

লতিফা বুবু মাথা নাড়ল, বলল জানি না। কিন্তু আর কে যাবে, জোয়ান মানুষ এখন রাস্তাঘাটে বের হয় না। জোয়ান মানুষ দেখলেই মিলিটারি গুল্লি করে দেয়। তাই শুধু বুড়ারা রাস্তাঘাটে বের হয়।

কথাটা মনে হয় সত্যি। জোয়ান মানুষেরা থানা লুট করে সব রাইফেল নিয়ে যায় যুদ্ধ করার জন্য– তাদেরকে মিলিটারিরা তো ভয় পেতেই পারে। আমি মাসুদ ভাইয়ের কথা ভাবছিলাম আর ঠিক তখন লতিফা বুবু বলল, তোদের স্যারের কাছ থেকে আমারে একটা বই এনে দিছিলি, বইটা শেষ হইছে। ফিরত নিয়া যাস।

আমি বললাম, পরে নেব লতিফা বুবু। এখন নিয়া লাভ নাই।

কেন লাভ নাই?

মাসুদ ভাই এখন অনেক ব্যস্ত। থানা লুট করে সব রাইফেল নিয়ে গেছে মিলিটারির সাথে যুদ্ধ করার জন্য।

আমি ভেবেছিলাম খবরটা শুনে লতিফা বুবু বুঝি চমকে উঠবে, কিন্তু লতিফা বুবু মোটেও চমকাল না, বরং কেমন যেন খুশি হয়ে উঠল, বলল, তোদের স্যার মুক্তিবাহিনী?

মুক্তিবাহিনী কথাটা আগে শুনি নাই। এই প্রথম শুনলাম। মিলিটারির সাথে যারা যুদ্ধ করে তারা মুক্তিবাহিনী? লতিফা বুবু খুশি খুশি গলায় বলল, রেডিওতে খবর দিচ্ছে। বাংলাদেশের সরকার তৈরি হইছে। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট। তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রী। দেশ মুক্ত করার যুদ্ধ সেই জন্যে এই যুদ্ধের নাম মুক্তিযুদ্ধ। যারা যুদ্ধ করে তারা মুক্তিবাহিনী।

তুমি এত কিছু কেমন করে জানো?

আমাদের বাড়িতে রেডিও আছে না। রাত্রিবেলা বিবিসি শুনি। সেইখানে সব খবর দেয়।

তুমি প্রত্যেক দিন খবর শোনো?

হ্যাঁ। তুই শুনবি? শুনলে চলে আসবি। বিবিসির খবর পাকা খবর।

লতিফা বুবুর বাসা থেকে আমি বলাই কাকুর চায়ের স্টলে গেলাম। সেখানে অনেক মানুষজন, সবাই খুব উত্তেজিত। উত্তেজনার কারণ মাসুদ ভাইয়ের থানা লুট। মানুষজন দুই ভাগে ভাগ হয়ে তর্ক করছে। এক ভাগের ধারণা কাজটা সঠিক হয়েছে, অন্য ভাগের ধারণা কাজটা ভুল হয়েছে। যারা মনে করছে কাজটা সঠিক হয়েছে তাদের একজন বলল, মাসুদ পোলাটা হচ্ছে বাঘের বাচ্চা। দেশে যুদ্ধ শুরু হইছে এখন কি বইসা বইসা আঙুল চুষব? থানা লুট কইরা অস্ত্রপাতি লইয়া গেছে। উচিত কাজ করছে।

যারা মনে করে কাজটা সঠিক হয়েছে তারা সবাই মাথা নাড়ল। যারা মনে করে কাজটা বেঠিক হয়েছে তাদের একজন বলল, যুদ্ধ কি গোল্লাছুট খেলা? যুদ্ধ করার জন্য ট্রেনিং লাগে না? এই পোলাপানের ট্রেনিং আছে?

ট্রেনিং নাই তো ট্রেনিং করব। সমিস্যা কী?

থানাওয়ালাদের অস্ত্রপাতির হিসাব রাখতি হয় একজন আইসা সেই অস্ত্রপাতি লুট করে নিতে পারে? থানাওয়ালা এখন কার কাছে কী হিসাব দেবে?

টেবিলে থাবা দিয়ে একজন বলল, দেশের নূতন সরকার হইছে সেই সরকারের কাছে হিসাব দেবে।

ঠিক-বেঠিক এই দুই দলের মাঝামাঝি একজন বলল, কিন্তু এখন এই অস্ত্র দিয়া করবটা কী?

বড় সড়ক দিয়া মিলিটারি আনাগোনা করে তাদের আক্রমণ করব শুনছি।

কামটা কি সহজ?

এখন কি সহজ আর কঠিন দেখার সময় আছে? নাই। যুদ্ধ শুরু হইছে এখন যুদ্ধ করতে হবে। বাচনের আর কুনো উপায় নাই।

তর্ক যখন খুব জমে উঠেছে তখন হঠাৎ আমি বহুদূর থেকে ভেসে আসা গুম গুম একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম মেঘের ডাকের মতো আওয়াজ কিন্তু আকাশে কোনো মেঘ নাই। অন্য কেউ তখনো কিছু শুনতে পায় নাই, সবাই তর্ক করে যাচ্ছে। আমি ছুটে বাইরে এলাম, তখন আরো স্পষ্ট শব্দটা শুনতে পেলাম গুমগুম আওয়াজের সাথে সাথে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমাকে ছুটে বের হতে দেখে আরো কয়েকজন চায়ের স্টল থেকে বের হয়ে এল এবং সবাই তখন বহুদূর থেকে ভেসে আসা গুম গুম শব্দ তার সাথে সাথে গুলির শব্দ শুনতে পেল।

একজন বলল, ইয়া মাবুদ। যুদ্ধ শুরু হইছে মনে লয়।

কেউ কোনো কথা বলল না, সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। আমরা বহুদূর থেকে গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসতে শুনতে লাগলাম। মাঝে মাঝে গুম গুম শব্দ হয় তারপর টানা গুলির শব্দ হতে থাকে। কিছুক্ষণের জন্য শব্দ কমে আসে তারপর আবার গুলির শব্দ হতে থাকে।

একটু পর আমরা দেখলাম বহুদূর থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া আকাশে উঠছে। কোথায় আগুন লেগেছে কে জানে।

ঠিক কোথায় কী হয়েছে কেউ জানে না, তাই সারা দিন ধরে হাজারো রকমের গুজব ভেসে আসতে থাকল। সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য গুজবটা এ রকম, বড় সড়কটা দিয়ে মিলিটারিরা আনাগোনা করে। মাসুদ ভাইয়েরা থানা লুট করে রাইফেল নিয়ে সেই সড়কের দুই পাশে অপেক্ষা করছিল। মিলিটারির কয়েকটা গাড়ি যখন সেই সড়ক ধরে যাচ্ছে তখন মাসুদ ভাইয়ের দল তাদের আক্রমণ করেছে। প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছে দুই পক্ষের কতজন মারা গেছে কেউ জানে না। কেউ কেউ বলছে শত শত মিলিটারি মারা গেছে, মাসুদ ভাই তার দল নিয়ে সরে গেছে। কেউ কেউ বলছে মিলিটারির পাল্টা আক্রমণে মাসুদ ভাইয়ের দলের সবাই মরে গেছে। মিলিটারি তখন সড়কের দুই ধারে সব গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে।

আমার পেটের ভেতরে কেমন যেন পাক দিতে লাগল। আমি বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম, হেই খোদা। তোমার কসম লাগে, তুমি মাসুদ ভাইরে বাঁচায়ে রাখো। মাসুদ ভাইয়ের দলের সবাইরে বাঁচায়ে রাখো। হেই খোদা—

.

০৯.

দুই-তিন দিন পরে আমরা খবর পেলাম মাসুদ ভাই বেঁচে আছে, তবে তার দলের দুইজন ছেলে মারা গেছে। ছেলে দুইজন আমাদের গ্রামের না, তাই আমরা তাদের চিনতে পারলাম না। একজনের নাম আলতাফ, আরেকজন জসীম। একজন কলেজে পড়ে, আরেকজন মানুষের বাড়ি কামলা খাটে। কলেজের ছাত্র আলতাফ গুলি খেয়েছিল তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে জসীম গুলি খেয়েছে। খবরগুলো সবই লোকজনের মুখে শোনা সত্য-মিথ্যা জানি না।

সপ্তাহ খানেক পরে আমাদের সাথে প্রথমবার মাসুদ ভাইয়ের দেখা হলো। এই দেখাটা হলো একেবারে অন্য রকম। বিকালবেলা আমি আর মামুন কালী গাংয়ের তীর ধরে হাঁটছি তখন হঠাৎ দেখলাম দূর থেকে অনেকগুলো মানুষ লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে আসছে। তাদের সবার হাতে বন্দুক, মানুষগুলোর কোনো পোশাক নেই, বেশির ভাগই লুঙি গেঞ্জি পরে আছে। বেশির ভাগ খালি পা, একজন-দুইজন মাথায় গামছা বেঁধে রেখেছে। আমরা কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলাম আর তখন দেখলাম এই দলটার মাঝে মাসুদ ভাইও আছে। মাসুদ ভাইয়ের হাতেও একটা রাইফেল।

আমি আর মামুন দৌড়ে গিয়ে মাসুদ ভাইয়ের হাত ধরে ফেললাম, চিৎকার করে বললাম, মাসুদ ভাই।

মাসুদ ভাই কোনো কথা না বলে একটু হাসার চেষ্টা করল, হাসিটা কেমন যেন অন্য রকম মনে হলো, এই হাসিতে কোনো আনন্দ নাই। মাসুদ ভাই এই কয় দিনে অনেক শুকিয়ে গেছে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখগুলো কেমন যেন গর্তে ঢুকে গেছে কিন্তু সেই গর্তের ভেতর থেকে কেমন যেন ধিকধিক করে জ্বলছে। মাসুদ ভাইয়ের কাপড়-জামা নোংরা, চুলগুলো উশকু-খুশকো।

আমি বললাম, মাসুদ ভাই আপনি কেমন আছেন?

 মাসুদ ভাই হাঁটতে হাঁটতে বলল, ভালো।

আপনি মুক্তিবাহিনী?

 মাসুদ ভাই বলল, আমরা সবাই মুক্তিবাহিনী।

আমি অন্যদের দিকে তাকালাম, বেশির ভাগকেই চিনি না। আমাদের গ্রামের দুই-তিনজন আছে। আবু বকর চাচা তার মাঝে একজন। আবু বকর চাচা শান্তশিষ্ট মানুষ, শহরে তার একটা মনোহারী দোকান আছে। সেই আবু বকর চাচা হাতে একটা রাইফেল নিয়ে হাঁটছেন–দেখতে কী অবাক লাগছে!

আমি মাসুদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, কই যান এখন?

মাসুদ ভাই বলল, এই তো এই দিকে। উত্তরটা শুনে বুঝতে পারলাম মাসুদ ভাই কোথায় যাচ্ছে, বলতে চাচ্ছে না।

আমি তাই আর জানতে চাইলাম না, জিজ্ঞেস করলাম, মাসুদ ভাই, আপনারা মিলিটারির সাথে যুদ্ধ করেছেন।

হ্যাঁ।

কীভাবে যুদ্ধ করেছেন মাসুদ ভাই।

মাসুদ ভাই অন্যমনস্কভাবে বলল, এই তো, তার মানে এইটাও বলতে চাইছে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মাসুদ ভাই, আপনার দলে দুইজন নাকি মারা গেছে? সত্যি?

মাসুদ ভাই কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল। আমি একটু অবাক হয়ে মাসুদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মাসুদ ভাই কেমন যেন অন্য রকম হয়ে গেছে। আগে একজন হাসিখুশি মানুষ ছিল, কত কথা বলত। এখন গম্ভীর, কথা বলতেই চায় না।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা বলাই কাকুর চায়ের স্টলের সামনে চলে এসেছি তখন স্টলের ভেতর থেকে অনেকে বের হয়ে এল। আশপাশের থেকেও মানুষেরা ভিড় করে এল। এমনকি বেড়ার ফাঁক দিয়েও অনেক মহিলা উঁকি দিয়ে তাকিয়ে রইল।

বলাই কাকু বললেন, মাসুদ ভাই। আসেন। একটু চা খান, কী হচ্ছে বলে যান।

মাসুদ ভাই বলল, না বলাই দা। সময় নাই। আমাদের যেতে হবে।

কোথায় যাবেন?

আমার সাথে যেভাবে বলেছিল, ঠিক সেভাবে মাসুদ ভাই বলল, এই তো এদিকে।

একটু বসে যান। এক কাপ চা খেতে আর কতক্ষণ লাগবে।

মাসুদ ভাই বলল, সময়টা ভালো না বলাই দা। সময়টা খুব খারাপ। আমাদের চা খাওয়ালে আপনার বিপদ হতে পারে।

বলাই দা অবাক হয়ে বললেন, কিসের বিপদ?

সব জায়গায় মিলিটারি আসবে। মিলিটারির কাছে খবর দেওয়ার লোক সব জায়গাতে আছে। এখন ঘাপটি মেরে আছে, এরা বের হবে।

এটা আপনি কী বলেন?

আমি ভুল বলি নাই। সাবধান থাকা ভালো।

বলাই কাকু বলল, ঠিক আছে আপনি চা না খেতে চান খাবেন না। কিন্তু একটু বসেন, একটু কথা বলি।

মাসুদ ভাই মাথা নাড়ল, বলল, এখন না। এখন কথা বলার সময় না।

যুদ্ধটা কেমন হলো একটু শুনি। কয়টা পাঞ্জাবিরে মারছেন?

মাসুদ ভাইয়ের মুখটা কেমন জানি শক্ত হয়ে গেল। বলল, না বলাই দা। মানুষ মারার গল্প করতে চাই না। এই গল্প ভালো না।

মাসুদ ভাইয়ের গলার স্বরে কিছু একটা ছিল যার জন্য কেউ আর কোনো কথা বলল না। মাসুদ ভাই তার রাইফেলটা ঘাড়ে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে। তার পিছু পিছু অন্য সবাই। সবাই লাইন ধরে সড়কটা ধরে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, কী অদ্ভুত লাগছে দেখতে। আমি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, তারপর দৌড়ে মাসুদ ভাইয়ের কাছে গেলাম, বললাম, মাসুদ ভাই, আমি আপনার সাথে একটু হাঁটি।

মাসুদ ভাই মাথা নেড়ে নিষেধ করতে গিয়ে থেমে জিজ্ঞেস করল, কেন?

এমনি।

মাসুদ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবল, তারপর বলল, ঠিক আছে একটু হাঁটো।

আমি কিছুক্ষণ নিঃশব্দে মাসুদ ভাইয়ের পাশাপাশি হাঁটলাম, তারপর বললাম, মাসুদ ভাই, আপনি লতিফা বুবুকে একটা বই পড়তে দিয়েছিলেন মনে আছে?

মাসুদ ভাই বলল, হ্যাঁ। মনে আছে। কী হয়েছে সেই বইয়ের?

লতিফা বুবুর বই পড়া শেষ হয়েছে। আমাকে বলেছে আপনাকে ফেরত দিতে।

মাসুদ ভাই হেসে ফেলল, এই প্রথমবার সেই আগের মতো হাসল, হেসে বলল, তোমার লতিফা বুবুকে বলো বইটা রেখে দিতে। এই বই আমি আর নিতে পারব না।

ঠিক আছে। বলে আমি আরও কিছুক্ষণ পাশাপাশি হাঁটলাম, তারপর বললাম, মাসুদ ভাই, আমাদের ক্লাসে নীলিমা নামে একটা মেয়ে ছিল মনে আছে?

হ্যাঁ। মনে আছে, কী হয়েছে তার?

পুরো ফ্যামিলি ইন্ডিয়া চলে গেছে।

মাসুদ ভাই কোনো কথা না বলে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। একটু পরে বলল, ঠিকই করেছে। এখন ভালোয় ভালোয় বর্ডার পার হতে পারলে হয়।

আমি বললাম, কাজীবাড়ি চিনেন মাসুদ ভাই?

না, চিনি না। কী হয়েছে কাজীবাড়ির?

কাজীবাড়ির বড় ছেলে বড় ইঞ্জিনিয়ার। চিটাগাং থাকত। পাকিস্তান মিলিটারি তারে মেরে ফেলছে।

মাসুদ ভাই বলল, আহা রে!

ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বউ আর দুই মেয়ে কোথায় আছে কেউ জানে না!

মাসুদ ভাই আবার বলল, আহা রে!

ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বাবা বুড়া মানুষ কাজী দাদা। তাদের খুঁজতে গিয়েছিল এখন তারও খোঁজ নাই।

আমি ভাবছিলাম মাসুদ ভাই আবার বলবে, আহা রে। কিন্তু মাসুদ ভাই কিছু বলল না, এবারে শুধু একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

আমি বললাম, ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের মা, কাজী দাদির অবস্থা খুবই খারাপ। শুধু ফিট হয়।

মাসুদ ভাই বলল, এই পাকিস্তানিরা মানুষ না। এরা জানোয়ার। পুরা দেশটাকে তছনছ করে দিয়েছে।

আমি আরও কিছুক্ষণ হাঁটলাম, তারপর যে কথাটা বলার জন্য মাসুদ ভাইয়ের সাথে সাথে এতক্ষণ হাঁটছি সেটা বলার চেষ্টা করলাম। কেশে গলা পরিষ্কার করে বললাম, মাসুদ ভাই, আপনারে একটা কথা বলি?

কী কথা।

আমারে আপনাদের সাথে নিবেন?

মাসুদ ভাই চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকাল, আমি ভাবলাম মাসুদ ভাই বুঝি শব্দ করে হেসে উঠবে, ছোট বাচ্চাদের অর্থহীন কথা শুনে বড়রা যেভাবে হাসে ঠিক সেভাবে। কিন্তু মাসুদ ভাই হাসল না। বলল, কেন?

আমি মুক্তিবাহিনী হতে চাই।

এই দেশে সবাই মুক্তিবাহিনী। তুমিও মুক্তিবাহিনী।

আমি আপনাদের মতো মুক্তিবাহিনী হতে চাই।

আমাদের মতো?

হ্যাঁ। আমারে আপনাদের সাথে নেন। খোদার কসম আমি আপনাদের কোনো সমস্যা করব না। আপনাদের সাহায্য করব। মনে নাই স্কুলে যখন হাজার হাজার মানুষ আসছিল, আমরা সাহায্য করছিলাম? আপনাদের সাথে সাথে থাকব। যখন যুদ্ধ করবেন আমি পেছন থেকে আপনাদের জন্য গুলি এনে দেব। যদি চান রাইফেলটা দিয়ে আমিও গুলি করতে পারি।

আমি আসলে গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। কোনো কথা বলতে হলে উল্টাপাল্টা করে ফেলি। কিন্তু এইবার আমি একটুও উল্টাপাল্টা করলাম না, খুবই গুছিয়ে বললাম, অনেকক্ষণ ধরে বললাম। মাসুদ ভাই পুরো সময়টা আমার কথা শুনল, তারপরে কনুইয়ের কাছে আমার হাতটা ধরল। হাত ধরে সবাইকে বলল, এই! তোমরা একটু থামো, দুই মিনিট বিশ্রাম নাও। আমি রঞ্জুর সাথে একটু কথা বলি।

আমরা একটা ধানক্ষেত পার হয়ে জঙ্গলের কাছে এসেছি। সবাই ধানক্ষেতের পাশে পা ঝুলিয়ে বসে গেল। মাসুদ ভাই আমার সামনে বসল। বসে, আমার মাথায় হাত রাখল। বলল, রঞ্জু, যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস। কত খারাপ সেইটা আমি আগে বুঝিনি, এখন বুঝেছি। গত সপ্তাহেই আমার বয়স ছিল বাইশ। এখন আমার বয়স কত জান? এখন আমার বয়স একশ বাইশ। এক সপ্তাহে আমার বয়স কেন একশ বছর বেড়েছে জানো?

আমি কিছু বললাম না। মাসুদ ভাই বলল, তার কারণ এই সপ্তাহে আমি প্রথম যুদ্ধ করেছি। কিছু তো জানতাম না। ভাবছিলাম যুদ্ধ করা খুব সোজা। রাইফেলে কেমন করে গুলি ভরতে হয়, কেমন করে ট্রিগার টানতে হয় গুলি করতে হয় ভাবছিলাম এইগুলো জানলেই যুদ্ধ করা যায়। আমি পুরা আহাম্মক ছিলাম। বড় রাস্তায় আমি ছেলেপিলেদের নিয়ে রাইফেল হাতে শুয়ে থাকলাম। মিলিটারির একটা জিপ আসছিল, কাছাকাছি আসতেই সবাই মিলে গুলি শুরু করলাম। আমরা ভাবলাম এইটাই যুদ্ধ। আমাদের খুবই কপাল ভালো রাস্তার ঐখানে একটা ব্রিজ ছিল, ড্রাইভারের শরীরে গুলি লেগেছে, ড্রাইভার কন্ট্রোল করতে না পেরে সবাইকে নিয়ে ব্রিজ থেকে নিচে খালের মাঝে পড়ে গেছে। আমরা ভাবলাম যুদ্ধে জিতে গেছি। জয় বাংলা জয় বাংলা চিৎকার করতে করতে যাচ্ছি। তখন–।

মাসুদ ভাই থামল, আমি জিজ্ঞেস করলাম, তখন?

তখন প্রথমে জিপ থেকে কয়টা মিলিটারি বের হয়ে মেশিনগান দিয়ে গুলি করতে শুরু করল। মেশিনগান কী জানো?

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, জানি না।

রাইফেলে ট্রিগার টানলে একটা গুলি বের হয়। মেশিনগানে ট্রিগার টানলে বৃষ্টির মতো গুলি বের হতে থাকে। আমি ভেবেছিলাম গুলি করে আমাদের সবাইকে ফেলে দিয়েছে। আমরা সবাই তাড়াতাড়ি মাটিতে শুয়ে পড়েছি–আর মাথার ওপর দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি যাচ্ছে। অনেক কষ্টে পিছিয়ে আসছি, দেখলাম আমাদের সাথে আলতাফ নাই। আলতাফ মাঠের মাঝখানে পড়ে কাতরাচ্ছে।

মাসুদ ভাইয়ের গলা ভেঙে এল, শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছল। আশপাশে বসে সবাই মাসুদ ভাইয়ের কথা শুনছিল, সবাই তখন মাটির দিকে তাকিয়ে থাকল। মাসুদ ভাই একটু পরে বলল, আমরা ভাবছিলাম আলতাফকে ঐখানে রেখেই আমাদের চলে যেতে হবে। তখন জসীম বলল সে গিয়ে আলতাফকে টেনে নিয়ে আসবে। আমরা যেন খালি তার ওপর দিয়ে গুলি করতে থাকি। আমরা তা-ই করতে থাকলাম, জসীম গিয়ে আলতাফকে ধরে টেনে আনতে থাকে। যখন একেবারে আমাদের কাছে চলে এসেছে তখন–তখন–

মাসুদ ভাই আবার থেমে গেল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তখন জসীম গুলি খেল। আমরা তখন একজনের জায়গায় দুজনের লাশ টেনে নিয়া এসেছি। একটা ধানক্ষেতের পাশে জানাজা পড়িয়ে কবর দিয়েছি। মিলিটারি তখন সড়কের পাশে দুই গ্রামে আগুন দিয়েছে যারে পেয়েছে তারে মেরেছে। বুঝেছ রঞ্জু?

আমি গল্পটা শুনলাম কিন্তু কী বুঝতে হবে সেটা বুঝিনি, তাই মাসুদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মাসুদ ভাই বলল, আমার কথা শুনে যুদ্ধ করতে গিয়ে দুইজন মারা গেছে। আমি নিজের হাতে তাদের কবর দিয়েছি। বুঝেছ?

আমি মাথা নাড়লাম। মাসুদ ভাই বলল, আমি কি কোনো দিন এই জন্য নিজেরে ক্ষমা করতে পারব? পারব না। আমার জন্য দুইজন মারা গেছে। দুইজন।

ক্ষেতের পাশে পা দুলিয়ে যারা বসেছিল তাদের একজন বলল, কী বলেন মাসুদ ভাই আপনার জন্য কেন মারা যাবে? সবাই গেছে নিজের মতো। হায়াত শেষ হয়েছে আল্লাহ নিয়ে গেছে।

মাসুদ ভাই তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এই কথাটা বলছ, আমি জানি। যাই হোক রঞ্জু তুমি বাচ্চা মানুষ তোমাকে কেন আমি এই সব বলছি, জানি না। তোমাকে খালি বোঝাতে চাচ্ছিলাম যে যুদ্ধটা খুবই ভয়ংকর একটা জিনিস! তোমার উপরে চাপায়ে দিলে তোমার সেটা করতে হয় কিন্তু কোনো দিন নিজের থেকে সেটা শুরু করতে হয় না। বুঝেছ?

আমি সবকিছু বুঝি নাই, শুধু বুঝলাম মাসুদ ভাই আমাকে মুক্তিবাহিনীতে নেবে না। আমার চোখে কেন জানি পানি চলে আসল।

মাসুদ ভাই আমার চোখের পানিটা দেখল কি না, বুঝতে পারলাম না। আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল, যাও বাড়ি যাও। অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, তোমার বাবা-মা চিন্তা করবেন।

আমি নিচু গলায় বললাম, আমার বাবা-মা নাই। খালি একজন নানি আছেন।

তাহলে তোমার নানি চিন্তা করবেন। যাও, বাড়ি যাও।

.

আমি যখন বাড়ি ফিরে এসেছি তখন অনেক রাত হয়েছে। নানি বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমাকে দেখে বুকে চেপে ধরে বড় বড় নিঃশ্বাস নিল, তারপরে বলল, ভাইডি তুই আসছস?

হ্যাঁ, নানি আসছি?

আমার মনে হচ্ছিল—

কী মনে হচ্ছিল?

মনে হচ্ছিল তুই বুঝি মুক্তিবাহিনীর সাথে চলে গেছস।

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, তুমি যে কী বলো নানি। আমি তোমাকে একলা রেখে মুক্তিবাহিনীর সাথে চলে যাব? আর মুক্তিবাহিনী আমারে নেবে?

নানি মাথা নাড়ল, বলল, এখন আর কোনো কিছুর ঠিক নাই। সবকিছু ওল্টাপাল্টা হয়া গেছে।

.

১০.

দুপুরবেলা খেতে বসেছি তখন মামুন এসে আমাকে খবর দিল, কাজীবাড়ির ইঞ্জিনিয়ার ছেলের বউ আর দুই মেয়েকে নিয়ে তার বাবা বুড়ো কাজী দাদা এই মাত্র বাড়ি পৌঁছেছেন।

ব্যাপারটা দেখার জন্য আমি তখন তখনই যেতে চাচ্ছিলাম, নানি তখন আমাকে জোর করে বসিয়ে থালার সব ভাত শেষ করাল। আমি তখন হাত ধুয়ে মামুনকে নিয়ে কাজীবাড়ির দিকে রওনা দিলাম। বাড়ির বাইরে গ্রামের কয়েকজন মুরব্বি ধরনের মানুষ বসে আছে, পুরুষ মানুষ বলে ভেতরে যেতে পারছে না। আমি আর মামুন সরাসরি ভেতরে ঢুকে গেলাম। উঠানে একটা জলচৌকিতে একজন মহিলা বসে আছেন, নিশ্চয়ই ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের স্ত্রী। গ্রাম সম্পর্কে আমাদের চাচি। তাঁকে ঘিরে গ্রামের অনেক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের মা, কাজী দাদি ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছেন। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বাবা কাজী দাদা কীভাবে তাঁর ছেলের বউ-বাচ্চাদের উদ্ধার করে এনেছেন সেটা সবাইকে বলছেন, সবাই সেটা খুব মন দিয়ে শুনছে।

আমি এদিক-সেদিক তাকিয়ে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের দুই মেয়েকে খুঁজলাম। আগের বার দেখেছিলাম খুবই অহংকারী ছিল, আমাদের সাথে কথাই বলত না। এখন তারা কি আমাদের সাথে কথা বলবে? যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের তো এখানেই থাকতে হবে। যুদ্ধ শেষ হবার পরও তারা কোথায় যাবে? মেয়ে দুটিকে দেখতে পেলাম না, মনে হয় ভেতরে আছে।

একজন মহিলা ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, ভাই সাহেবরে পাঞ্জাবিরা কেমন করে মারল?

ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের স্ত্রী, যিনি গ্রাম সম্পর্কে আমাদের চাচি শক্ত গলায় বললেন, আমি এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না।

বেশ কয়েকজন তখন মাথা নেড়ে বলল, না না, এই সব নিয়ে কেন কথা বলবে? এই সব নিয়ে কথা বলতে কি ভালো লাগে?

তখন আরেকজন জিজ্ঞেস করল, লাশকে কি দাফন-কাফন করা গেছে?

চাচি এবারেও বললেন, আমি এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না।

আবার কয়েকজন তখন মাথা নেড়ে বলল, কেন বলবে? এইটা কি বলার মতো কথা?

আমাদের গ্রামের পুরুষ মানুষদের যে রকম বুদ্ধিশুদ্ধি খুব বেশি না, গ্রামের মহিলাদেরও একই অবস্থা। তাদেরও বেশি বুদ্ধিশুদ্ধি নাই। আরেকজন মহিলা জিজ্ঞেস করে বসল, সাহেবকে তো মেরে ফেলেছে, এখন সংসার চলবে কেমন করে?

চাচি এবার বেশ জোরে বললেন, আমি বলেছি এখন আমি এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না।

যেসব মহিলা ছিল তারা এবারে গুনগুন করে নিজেরা নিজেরা কথা বলতে লাগল, তারপর একজন-দুইজন করে সরতে লাগল। আমি শুনলাম যাওয়ার সময় একজন কুটনি বুড়ি ধরনের মহিলা আরেকজন কুটনি বুড়ি ধরনের মহিলাকে নিচু গলায় বলছে, এত তেজ ভালো না। মাইয়া লোকের তেজ আল্লাহর গজব টেনে আনে।

ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের মা এতক্ষণ ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছিলেন, এবারে কান্না থামিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বউমা অনেক কষ্ট করে এসেছে, দুই দিন ধরে নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, বউমারে আপনারা বিশ্রাম করতে দেন।

কথার অর্থ খুবই পরিষ্কার, তোমরা সবাই বিদায় হও। কাজেই আমরাও বিদায় হলাম, মামুন তার বাড়িতে চলে গেল। আমি বলাই কাকুর চায়ের স্টলের দিকে রওনা দিলাম। নূতন কী কী খবর আছে, সেটা বলাই কাকুর চায়ের স্টলে সবচেয়ে আগে পাওয়া যায়।

বিকেলে যখন ফিরে আসছি তখন কাজীবাড়ির সামনে আমি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের একটা মেয়েকে দেখতে পেলাম। বাড়ির সামনে যে ফুলের বাগান আছে, একুশে ফেব্রুয়ারির সময় যেখান থেকে আমি ফুল চুরি করার চেষ্টা করছিলাম, সেখানে মেয়েটা হাঁটছে। মাঝে মাঝে নিচু হয়ে ফুলগাছের ভেতর কিছু একটা দেখছে। অপরিচিত মেয়েদের সাথে আমরা কথা বলি না, কেমন করে কথা বলতে হয় সেটাও জানি না। তাই চোখের কোনা দিয়ে মেয়েটাকে দেখতে দেখতে আমি হেঁটে চলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু যেতে যেতে আমি থমকে দাঁড়ালাম, স্পষ্ট দেখতে পেলাম মেয়েটার পায়ের গোড়ালির আধ হাত উপরে একটা সেঁক ধরেছে। নিশ্চয়ই বেশ খানিকক্ষণ আগেই ধরেছে কারণ রক্ত খেয়ে সেঁকটা ফুলে ঢোল হয়ে আছে। জোঁকের থেকে ধুরন্ধর আর কিছু নাই; যখন কাউকে কামড়ে ধরে সে টের পর্যন্ত পায় না। কোনো রকম ব্যথা না দিয়ে এক পেট রক্ত খেয়ে চলে যায়।

আমি দাঁড়ালাম, মেয়েটাকে বলা দরকার যে তাকে একটা জোঁকে ধরেছে, কিন্তু লতিফা বুবু জোঁককে যে রকম ভয় পায়, এই মেয়েটাও যদি সে রকম ভয় পায় তাহলে বিপদ আছে। জোঁক ধরেছে বলামাত্রই সে এমন লাফঝাঁপ চিৎকার দিতে থাকবে যে তখন জোকটা টেনে ছোটানোই অসম্ভব হয়ে যাবে। শহরের মেয়ে নিশ্চয়ই জীবনেও জোক দেখে নাই, এখন যদি জানে তার শরীরে একটা জোক নিশ্চিন্তে রক্ত খেয়ে যাচ্ছে তাহলে কেলেংকারি হয়ে যাবে। কিন্তু কিছু একটা করা দরকার তাই আমি থেমে গিয়ে মেয়েটাকে ডাকলাম, এই যে। শোনো।

মেয়েটা ঘুরে আমার দিকে তাকাল, বলল, আমাকে বলছ?

হ্যাঁ।

অহংকারী মেয়েরা যেভাবে ভুরু কুঁচকায়, মেয়েটা সেভাবে ভুরু কুঁচকিয়ে বলল, কী হয়েছে?

আমাদের গ্রাম দেশে গাছপালায় অনেক জোঁক থাকে।

মেয়েটা একটা ফুলগাছের কাছে ছিল সেখান থেকে ছিটকে সরে এল, মুখের মাঝে জোঁকের প্রতি ভয় আর ঘৃণার ভাবটা ফুটে উঠল, সে কারণে অহংকারের ভাবটা কমে গেল। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে জোঁককে ভয় পায়, এখন যদি বলি তাকে জোঁকে ধরেছে তাহলে কেলেংকারি ঘটতে পারে। একটু কায়দা করে বলতে হবে।

আমি বললাম, জোঁককে ভয়ের কিছু নাই। একটু লবণ না হলে তামাকের পানি দিলেই জোঁক শেষ। বারোটা বেজে যায়।

মেয়েটা কিছু বলল না। আমি বললাম, তুমি কি জোঁককে ভয় পাও?

না। জোঁককে ভয় পাওয়ার কী আছে?

তাহলে ভালো।

মেয়েটা সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তাহলে ভালো মানে কী?

আমি বললাম, আমি জোঁককে একটুও ভয় পাই না। কাউকে জোঁকে ধরলে আমি টেনে ছুটিয়ে দিই।

মেয়েটা একটু অন্যভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছে, মনে হয় টের পেয়েছে আমি কী বলতে যাচ্ছি। নিজের পায়ের দিকে তাকাল কিন্তু জোঁকটা পায়ের পেছনে ধরেছে তাই দেখতে পেল না।

আর দেরি করা ঠিক হবে না। আমি বললাম, তুমি যেভাবে দাঁড়িয়ে আছ ঠিক সেভাবে দাঁড়িয়ে থাকো! এক সেকেন্ড।

মেয়েটা একটা চিৎকার করল, কেন? কী হয়েছে?

কিছু হয় নাই। বলে আমি লাফ দিয়ে তার পেছনে গেলাম, এক হাতে শক্ত করে পায়ের গোড়ালিটা ধরে অন্য হাত দিয়ে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে জোঁকটাকে টেনে ছোটানোর চেষ্টা করলাম। প্রথমবার পিছলে ছুটে গেল, দ্বিতীয়বারে সেটা ছুটে এল। মেয়েটা তখন চিলের মতো চিৎকার করছে, মনে হচ্ছে তাকে বুঝি কেউ খুন করে ফেলেছে। আমি জোঁকটাকে নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেললাম, অনেকখানি রক্ত খেয়েছে জায়গাটা রক্তে লাল হয়ে গেল। মেয়েটার চিৎকার শুনে প্রথমে বাড়ির কুকুর, তারপর বড় বোন, তারপর অন্যরা ছুটে এল। এদের মাঝে বাড়ির কুকুরটা সবচেয়ে বুদ্ধিমান সে এসেই বুঝে ফেলল কী হয়েছে, থেতলে পিষে যাওয়া জোকটা শুঁকে মুখ তুলে অন্যদের বোঝানোর চেষ্টা করল, ভয়ের কিছু নাই। কিন্তু অন্যরা চিৎকার করতে লাগল, কী হয়েছে? কী হয়েছে?

আমি বললাম, কিছু না। জোঁক ধরেছিল। ছুটিয়ে দিয়েছি।

সবাই এমনভাবে চিৎকার করতে লাগল যে মনে হতে লাগল মেয়েটাকে জোঁক না, একটা আস্ত বাঘ ধরে ফেলেছিল।

মেয়েটা নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে ঘেন্নায় প্রায় বমি করে দিচ্ছিল, তাকে দেখে মনে হলো পারলে সে তার পুরো পাটা কেটে ফেলে দেবে। জোঁক ধরলে সেই জায়গায় রক্ত সহজে বন্ধ হয় না, তাই মেয়েটার পা থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত বের হতে লাগল।

মেয়েটার মা ভয় পাওয়া গলায় বললেন, ডাক্তার। একজন ডাক্তার পাওয়া যাবে?

কথা শুনে আমার হাসি পেল, কিন্তু আমি হাসলাম না, বললাম ডাক্তার লাগবে না। ভালো করে ধুয়ে একটু তেনা পুড়িয়ে লাগিয়ে দেন।

মেয়েটা বলল, তেনা পুড়িয়ে? তেনা পুড়িয়ে কেন?

বড় মেয়েটা বলল, ব্লিডিং বন্ধ করার জন্য।

ছোট মেয়েটা বলল, না, আমি তেনা পোড়া লাগাব না।

আমি বললাম, তাহলে কিছুই করতে হবে না, একটু পরে এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে।

মেয়েটা বলল, তুমি কেমন করে জানো? তুমি কি ডাক্তার নাকি?

আমি দাঁত বের করে হাসলাম, বললাম, না, আমি ডাক্তার না। কিন্তু আমারে অনেকবার অনেক জোঁক ধরেছে, আমি জানি।

দৃশ্যটা কল্পনা করে মেয়েটা মুখ বিকৃত করে কেমন জানি শিউরে উঠল। বাড়ির সবাই মিলে তখন মেয়েটাকে ভেতরে নিয়ে যেতে থাকে। তাদের হাবভাব দেখে মনে হতে থাকে সাংঘাতিক একটা ঘটনা ঘটেছে। এ রকম ঘটনা এর আগে কখনো ঘটে নাই, ভবিষ্যতেও ঘটবে না। আমি কী করব বুঝতে না পেরে বাড়ি চলে এলাম, নানিকে বলতে হবে, নানি নিশ্চয়ই শুনে হাসতে হাসতে মারা যাবে।

.

পরের দিন আবার আমার মেয়েটার সাথে দেখা হলো। কাজীবাড়ির বাংলাঘরের বারান্দায় একটা চেয়ারে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। কেমন যেন দুঃখী দুঃখী চেহারা। দেখে মনে হয় কিছু একটা ভাবছে। আমার মনে হলো মেয়েটার একটু খোঁজ নেওয়া দরকার, সড়কে দাঁড়িয়ে বললাম, তোমার পায়ের কী অবস্থা?

মেয়েটা আমাকে দেখে চিনতে পারল, বলল, এসে দেখে যাও। খুবই ঘেন্নার অবস্থা–কালকে অনেকক্ষণ রক্ত পড়েছে।

আমি বাংলাঘরের বারান্দায় উঠে গিয়ে তার পাটা পরীক্ষা করলাম। কালকে যেখানে সেঁক ধরেছিল, আজকে সেখানে ছোট লাল একটা দাগ–এর মাঝে ঘেন্নার কী আছে বুঝতে পারলাম না। মেয়েটা বলল, তুমি এই গ্রামে থাকো।

আমি মাথা নাড়লাম। মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, তোমার বাবা কী করেন?

আমি বললাম, বাবা নাই। মরে গেছেন।

মেয়েটা মনে হলো একটু ধাক্কা খেল, তারপর বলল, তোমার মা?

মাও নাই। দুইজনে একসাথে পানিতে ডুবে মরে গেছেন।

 এইবারে মেয়েটার মুখে দুঃখের ছাপ পড়ল, বলল, ও।

আমি খুব ছোট ছিলাম বাপ-মা কাউরে দেখি নাই। কিছু মনে নাই।

মেয়েটা বলল, আমার আব্বুকে মিলিটারি মেরে ফেলেছে।

আমি বললাম, জানি। আমরা সবাই জানি।

মেয়েটা হঠাৎ করে কাঁদতে শুরু করল, আমি একেবারে হকচকিয়ে গেলাম, কী করব বুঝতে পারলাম না।

মেয়েটা ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু কান্না থামাতে পারে না। অনেকক্ষণ পর কান্না থামিয়ে বলল, এত দিন রাস্তাঘাটে ছিলাম, মানুষের বাড়িতে ছিলাম, বিপদের মাঝে ছিলাম তাই আব্দুর জন্য কাঁদতেও পারি নাই। এইখানে এসে সারা দিন আর রাত খালি কাঁদি।

আমি কী করব কিংবা কী বলব, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, তাই চুপচাপ বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়েটা চোখ মুছতে মুছতে ফোঁপাতে ফোঁপাতে তার বাবার কথা বলতে থাকে। বাবাকে মেরে ফেলার বিষয়টা একেবারেই মেনে নিতে পারছে না, সেটা আমি বুঝতে পারলাম। আমার মনে হচ্ছিল সান্ত্বনা দিয়ে আমার কিছু বলা দরকার কিন্তু বলার মতো একটা কথাও মাথার মাঝে আনতে পারলাম না। তাই একটা কথাও বলতে পারলাম না, কিন্তু তাতে খুব একটা সমস্যা হলো না, মেয়েটা একাই কথা বলে যেতে লাগল, আমি শুনে যেতে লাগলাম। মনে হয় মেয়েটা কথা বলার জন্য একটা মানুষ খুঁজছিল, আমাকে পেয়ে গেছে। মনে হয় খুব দুঃখের সময় মানুষের কথা বলার জন্য একটা লোকের দরকার হয়।

আমি একটা কথাও না বলে অনেকক্ষণ মেয়েটার কথা শুনেছি বলেই মনে হয় মেয়েটার সাথে আমার খাতির হয়ে গেল। তার নাম ডোরা। ডোরা মানুষের নাম হতে পারে আমি জানতামই না। তার বড় বোনের নাম নোরা। বড় বোন কলেজে পড়ে, সে আমার সাথে পড়ে। তবে ডোরা আমার মতন ফাঁকিবাজ ছাত্র না, সে খুবই ভালো ছাত্রী। ডোরার সাথে প্রায় প্রত্যেক দিনই দেখা হতে লাগল, আর প্রত্যেক দিনই সে কথা বলে যেত আর আমি শুনে যেতাম। প্রথম প্রথম তার বাবাকে মিলিটারিরা কীভাবে মেরেছে সেটা নিয়ে একেবারেই কথা বলতে চাইত না, শেষে আস্তে আস্তে বলেছে। বাবা ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের ইঞ্জিনিয়ার ছিল, মিলিটারিরা এসে তাকে ডেকে নিয়েছে ইলেকট্রিক সাপ্লাই চালু করার জন্য। চালু করার পর সবাইকে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেছে। পুরো একদিন ইলেকট্রিক সাপ্লাই বিল্ডিংয়ের দেয়ালের পাশে বাবার লাশটা পড়ে ছিল, তারপর কয়েকজন মিলে চাটাই দিয়ে পেঁচিয়ে লাশটা তাদের বাসার সামনে রেখে গেছে। এরপর ডোরা আর কিছু বলতে পারে না, তারপর কী হয়েছে সে নাকি মনেও করতে পারে না। লাশের ওপর কয়টা মাছি ভনভন করছিল, এছাড়া নাকি তার আর কিছু মনে নাই। শুনে আমার খুবই অবাক লাগে কিন্তু আমি সেটা নিয়ে ডোরাকে কিছু বলি

একদিন ডোরা বলল, বুঝেছ রঞ্জু। আমাকে একটা কাজ করতে হবে। করতেই হবে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী কাজ?

আমাকে নিজের হাতে একটা পাকিস্তানি মিলিটারি মারতে হবে।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কী মারতে হবে?

পাকিস্তানি মিলিটারি।

 কীভাবে মারবে?

মুক্তিবাহিনী হয়ে।

মুক্তিবাহিনী?

 ডোরা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।

আমি নিশ্চয়ই অবাক হয়ে ডোরার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, ডোরা বলল, তুমি এত অবাক হচ্ছ কেন? মেয়েরা মুক্তিবাহিনী হতে পারে না?

আমি তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বললাম, পারে নিশ্চয়ই পারে। কিন্তু—

কিন্তু কী?

কিন্তু তুমি তো অনেক ছোট। ছোটদের মুক্তিবাহিনী নেয় না। আমি যেতে চেয়েছিলাম মাসুদ ভাই নেয় নাই।

ডোরা জিজ্ঞেস করল, মাসুদ ভাই কে?

আমি তখন ডোরাকে মাসুদ ভাইয়ের গল্প করলাম। মাসুদ ভাইয়ের যুদ্ধের গল্পটা করলাম খুবই বাড়িয়ে-চাড়িয়ে। শত শত মিলিটারি মারা গেছে, হেলিকপ্টারে করে সেই মিলিটারিদের লাশ নিতে হয়েছে, এই ভাবে বর্ণনা দিলাম। মাসুদ ভাইয়ের সাহস নিয়ে আজব-আজব অনেকগুলো গল্প বললাম। শুনে ডোরা খুবই উৎসাহিত হলো, বলল, চলো, তুমি আর আমি মাসুদ ভাইকে খোঁজ করি। দুইজন মিলে বললে না করতে পারবে না, আমাদের নিয়ে নেবে।

নেবে না। আমি হতাশভাবে মাথা নেড়ে বললাম, মাসুদ ভাই খালি বলে যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস, যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস। যুদ্ধ বড়দের জিনিস ছোটদের যুদ্ধে যাওয়া ঠিক না।

ডোরা হাল ছাড়ে না, বলে, আমরা দুইজনে খুঁজে খুঁজে তাদেরকে বের করে হাজির হব, তখন আমাদেরকে আর ফেলে দিতে পারবে না। পারবে?

আমি মাথা চুলকে বললাম, দশ-বিশ বছর যুদ্ধ হবে। তত দিনে আমরা বড় হয়ে যাব। তখন কেউ না করতে পারবে না।

ডোরা এত দিন অপেক্ষা করতে রাজি না। সে এখনই মুক্তিবাহিনীতে গিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারি মারতে চায়। এখনই–তার দেরি করার কোনো ইচ্ছা নাই।

নানি ছাড়া আমি এর আগে কোনো মেয়েকে কাছ থেকে দেখি নাই। নানি যথেষ্ট ভয়ংকর কিন্তু আমার মনে হতে থাকে ডোরা বুঝি নানি থেকেও ভয়ংকর। কিংবা কে জানে হয়তো সব মেয়েরাই এই রকম ভয়ংকর হয়।

.

১১.

আমাদের গ্রামের অনেক মেয়ের সাথেই ডোরার পরিচয় হলো, শহরের একটা মেয়ে যার বাবাকে পাকিস্তানের মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে তার সাথে অনেক মেয়েই বন্ধুত্ব করতে চাইছিল কিন্তু ডোরার সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব হলো আমার সাথে। তার কারণটা কী কে জানে! আমার কাজ হয়ে গেল সকাল বেলা ডোরাকে নিয়ে বের হয়ে গ্রামের সবকিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। প্রথমে তাকে নিয়ে গেলাম বলাই কাকুর চায়ের স্টলে, ডোরাকে আগেই বলে রেখেছিলাম বলাই কাকুর চায়ের স্টলে মানুষজন কম থাকলে আমাদের হাফ কাপ ফ্রি চা বানিয়ে খাওয়ান। আজকে স্টলে অনেক মানুষ ছিল তার পরও বলাই কাকু ডোরার খাতিরে আমাদের দুইজনকে ফ্রি চা খাওয়ালেন, সাথে কুকি বিস্কুট। বলাই কাকু আর অন্যরাও ডোরাকে নানান কিছু জিজ্ঞেস করল, ডোরা হুঁ হাঁ করে উত্তর দিল, তার হয়ে কথাবার্তা যা বলার আমিই বললাম।

স্টল থেকে বের হয়ে স্কুলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, তোমাকে বলেছিলাম না বলাই কাকুর চা পৃথিবীর মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ। দেখেছ এখন?

ডোরা বলল, সর্বশ্রেষ্ঠ না কচু। এক গাদা চিনি আর দুধ। এটা চা হলো? এটা তো পায়েস!

ডোরার কথা শুনে আমি রীতিমতো আঘাত পেলাম কিন্তু বুঝতে পারলাম না পায়েসের মতো চা হলে কেন সেটা সর্বশ্রেষ্ঠ হতে পারবে না।

স্কুলে গিয়ে সে আমাদের শহীদ মিনারটা দেখেও হি হি করে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেল, বলল, এইটা শহীদ মিনার! এইটা তো বাঁশের খাম্বা।

শুনে আমার একটু অপমান হলো কিন্তু কী বলব বুঝতে পারলাম না। তবে স্কুলটা তার পছন্দ হলো, বড় দালান, সামনে বিশাল মাঠ, পাশে পুকুর, পেছনে বড় বড় গাছ। আমি তাকে আমাদের ক্লাস রুমে নিয়ে গেলাম, এখন স্কুলে ক্লাস হচ্ছে না কিন্তু শুনছি কয় দিনের মাঝে ক্লাস শুরু হবে, তখন ডোরাকে মনে হয় এই স্কুলে আমাদের ক্লাসেই ভর্তি হতে হবে।

কালী গাংটাও তার খুব পছন্দ হলো, এখন পানি কম। আমি তাকে বললাম বর্ষা শুরু হলেই নদীটা ফুলে-ফেঁপে বিশাল নদী হয়ে যাবে।

কালী গাংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ডোরা জিজ্ঞেস করল, তুমি সাঁতার জানো?

জানব না কেন? আমি সাঁতরে এই গাং পার হই।

ডোরা চোখ বড় বড় করে বলল, সত্যি?

সত্যি। খোদার কসম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি সাঁতার জান?

 ডোরা মাথা নাড়ল, বলল, না।

আমি বললাম, কোনো সমস্যা নাই, আমি তোমাকে সাঁতার শিখিয়ে দেব।

ডোরা মনে হয় সেটা শুনে বেশ খুশিই হলো।

বড় সড়ক ধরে হেঁটে হেঁটে আমরা গ্রামের একেবারে শেষ মাথা পর্যন্ত গিয়ে তাকে বিশাল ধানক্ষেত দেখালাম। দূরের জঙ্গলটা দেখিয়ে বললাম, ঐ যে দূরের জঙ্গলটা দেখছ, এটার কোনো শেষ নাই।

শেষ নাই মানে?

শেষ নাই মানে এই জঙ্গলটার অন্য পাশে কী আছে কেউ জানে না।

সত্যি?

হ্যাঁ। মাসুদ ভাইয়ের দল যুদ্ধ শেষ করে হেঁটে হেঁটে এই জঙ্গলে ঢুকে গিয়েছিল।

সত্যি?

সত্যি।

ডোরা কিছুক্ষণ রহস্যময় জঙ্গলটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই জঙ্গলে কী কী আছে?

অনেক ভেতরে নাকি একটা পুরনো রাজবাড়ি আছে, এখন সেখানে কেউ যেতে পারে না। ভেঙেচুরে গেছে।

ডোরা আবার চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, সত্যি?

সত্যি।

এই জঙ্গলে কি বাঘ আছে?

আমি কখনো বাঘ বের হতে শুনি নাই কিন্তু অনেক বাঘডাশ বের হয়েছে। বাঘ আর বাঘডাশে পার্থক্য কী? তাই বললাম, নিশ্চয়ই আছে। আগে অনেক বেশি ছিল এখন কমে গেছে। বন্যার সময় নদীতে বাঘ ভেসে আসত, সব গরু-ছাগল খেয়ে ফেলত।

এখন আসে না?

আমি কোনো দিন বাঘ আসতে দেখিনি, তার পরেও বললাম, মাঝে মাঝে আসে।

ডোরা শুনে যথেষ্ট চমৎকৃত হলো। সড়ক ধরে হেঁটে ফিরে আসতে আসতে আমি তাকে গাছগাছালি চিনালাম। ধুতরাগাছ মারাত্মক বিষ, এর ফল খেলে মানুষ পাগল হয়ে যায়। শুনে সে খুবই অবাক হলো। অনেকক্ষণ সে দেখতে একেবারে নিরীহ ধুতরাগাছ আর ধুতরা ফুলের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি তাকে চুতরাগাছি আর বানরশলা গাছ চিনিয়ে দিলাম, শরীরে লাগলে সারা শরীর চুলকাতে থাকে, শুনে সে অবাক হয়ে চুতরাগাছ আর বানরশলার দিকে তাকিয়ে রইল। তাকে ভেদাল পাতা দেখালাম, এমনিতে কিছু নেই কিন্তু একটু কচলে দিলেই বিকট দুর্গন্ধ বের হতে দেখে সে খুবই মজা পেল।

আমি গ্রামের ভেতর এসে তাকে হিন্দুপাড়া নিয়ে গেলাম। আমাদের দেখে থুরথুরে বুড়ি একজন জিজ্ঞেস করল, কেডা?

আমি রঞ্জু।

রঞ্জু কেডা? সাথে কে?

সাথে কাজীবাড়ির নাতনি।

যার বাপরে পাঞ্জাবিরা মারছে?

হ্যাঁ।

বুড়ি হতাশ ভাবে মাথা নেড়ে বলল, হায় ভগবান! এইটা তোমার কী বিচার?

আমি ডোরাকে নিয়ে নীলিমাদের বাড়ির সামনে এলাম, বাড়িতে তালা মারা। গলা নামিয়ে বললাম, এই বাড়িতে নীলিমারা থাকত।

নীলিমা কে?

আমাদের ক্লাসে পড়ত একটা মেয়ে।

এখন কোথায়?

ইন্ডিয়া চলে গেছে।

নীলিমারা ইন্ডিয়া চলে গেছে শুনে ডোরা বেশি অবাক হলো না। সব হিন্দুরাই এখন ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে। আমি বাড়ির সামনে তুলসীগাছটা দেখিয়ে বললাম, এইটা হচ্ছে তুলসীগাছ। এইখানে হিন্দুরা পূজা দেয়। একদিন আমায় এই গাছটার নিচে খুঁড়তে হবে।

কেন?

নীলিমা এইখানে একটা জিনিস পুঁতে রেখেছে। আমাকে বলেছে সে যদি না আসে তাহলে এটা খুঁড়ে বের করতে।

নীলিমারা আসবে না?

যুদ্ধ শেষ না হলে কেমন করে আসবে? যুদ্ধ শেষ হতে দশ-বারো বছর লাগবে। মাসুদ ভাই বলেছে।

.

একদিন ডোরাকে আমার বাড়িতে নিতে হলো। ডোরারা বড়লোকের পরিবার, শহরে থাকে, তারা কত কী দেখে অভ্যস্ত, আমার বাড়িতে ভাঙাচোরা ছনের ঘর, পুরনো কাঁথা-বালিশ, ধানের মটকা এসব দেখে কী মনে করবে সেটা চিন্তা করে আমার লজ্জা লাগছিল। আমি ডোরাকে আনতে চাচ্ছিলাম না কিন্তু সে আসবেই–আমার নানিকে দেখবেই–তাই তাকে একদিন বাড়িতে আনতে হলো। নানিকে নিয়েও ভয়, ডোরার সামনে ক্যাট ক্যাট করে কাকে গালাগাল শুরু করে দেবে কে জানে! সেটা নিয়েও আমি একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম কিন্তু দেখা গেল ভয়ের কিছু নাই।

নানি ডোরাকে দেখে খুব খুশি হয়ে উঠল, তার শুকনো কাঠি কাঠি আঙুল দিয়ে ডোরার মাথায় শরীরে হাত বুলিয়ে বলল, বোনডি, তুমি এত বড় হইছ? তোমার বাপরে আমি এই এতটুকুন দেখছি, খালি অসুখ হইত! তারপরে কত বড় ইঞ্জিনিয়ার হইল। আমরা সবাই কত খুশি।

তারপর নানি হঠাৎ করে থেমে গিয়ে ডোরার মাথায় হাত রেখে বলল, বোনডি, তুমি মন খারাপ কইরো না। কাল রাত্রেই আমি তোমার বাপরে স্বপ্ন দেখছি, কী সুন্দর রাজপুত্রের মতন চেহারা, কী সুন্দর পোশাক, আমারে বলতেছে, চাচি আমার বউ-বাচ্চা আপনাদের গ্রামে আছে। দেইখা রাখবেন। আমি বলছি তুমি কোনো চিন্তা কইরো না বাবা, আমি দেইখা রাখমু। আর আজকেই তুমি আমার সাথে দেখা করতে আসছ।

ডোরা চোখ মুছে বলল, আমি কোনো দিন আল্লুকে স্বপ্ন দেখি না।

তোমার বাপের বেহেস্ত নসিব হইছে এই জন্য দেখো না। তোমার বাপের যদি অশান্তি থাকত তা হইলে প্রত্যেক রাত্রে তোমাদের সাথে কথা বলতে আসত। বুঝছ?

ডোরা মাথা নাড়ল। নানি বলল, হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। আল্লাহর কী ইচ্ছা আমরা জানি না, সেই জন্য মনে দুঃখ রাইখো না।

নানি অনেকক্ষণ ডোরার সাথে কথা বলল, তারপর তাকে উঠানের মাঝখানে একটা জলচৌকিতে বসিয়ে তাকে মুড়ি-গুড় আর গাছের আতাফল খেতে দিল।

ডোরা নানিকে কথা দিল সময় পেলেই সে নানির সাথে কথা বলতে চলে আসবে। নানি তখন ডোরার কাছে আমার সম্পর্কে অনেক রকম নালিশ করে দিল, আমি সময়মতো বাড়িতে আসি না, বাড়িতে থাকি না, লেখাপড়া করি না–এই রকম কথাবার্তা। তখন আমি তাড়াতাড়ি ডোরাকে নিয়ে বের হয়ে চলে এলাম, একবার নানি এটা শুরু করলে সহজে থামবে না। এ

নানি ছাড়াও ডোরাকে একদিন আমি লতিফা বুবুর কাছে নিয়ে গেলাম। লতিফা বুবু খুব আগ্রহ নিয়ে ডোরাকে দেখল, তার চুল হাত দিয়ে পরীক্ষা করল, জামাটা দেখল, পায়ের জুতো দেখল, তারপর দেশের অবস্থা নিয়ে গল্প করল। লতিফা বুবু প্রত্যেক দিন রাত্রে রেডিওতে খবর শোনে, তাই আমাদেরকে অনেক খবর দিল। বলল, আগে বিবিসি শুনতে হতো, আকাশবাণী শুনতে হতো এখন আর ওইগুলো শুনতে হয় না।

কেন?

ওমা! তোরা জানিস না? এখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হয়েছে। সব খবর পাওয়া যায়।

সত্যি?

হ্যাঁ। সব ভালো ভালো খবর, মুক্তিযোদ্ধাদের খবর। যুদ্ধের খবর।

আমাদের মাসুদ ভাইয়ের খবর কি দিয়েছে?

না, এখনো দেয় নাই। লতিফা বুবু ডোরার দিকে তাকিয়ে বলল, ঐ দিন তোমার বাবার কথা বলেছে।

ডোরা জিজ্ঞেস করল, কী বলেছে?

লতিফা বুবু ডোরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ঐ তো, কেমন করে মিলিটারিরা তাকে মেরেছে, এই সব।

ডোরা বলল, ও। তারপর চুপ করে গেল।

ডোরার সাথে একদিন মামুনের দেখা করিয়ে দিলাম। মামুন আমাদের মাঝে সবচেয়ে চালু কিন্তু দেখা গেল ডোরার সামনে এসে সে একেবারে চুপ মেরে গেল। সে সোজাসুজি ডোরার দিকে তাকাতেই পারল না, ডানে-বামে তাকাতে লাগল, পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল। তার নাকের মাঝে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমা হতে লাগল। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত বলল, তোমাকে জেঁকে ধরেছিল?

ডোরা বলল, হ্যাঁ। আমার পায়ে একটা জোঁক ধরেছিল। রঞ্জু টেনে ছুটিয়েছে! ছিঃ। ঘেন্না।

মামুন বলল, আমাকেও একদিন জোঁক ধরেছিল।

ডোরা বলল, সত্যি? কোথায়?

 মামুন লজ্জায় লাল নীল বেগুনি হয়ে বলল, এই তো ওইখানে

যে জায়গায় জোঁক ধরেছিল সেটা সবার সামনে বলার মতো না, মোটামুটি একটা লজ্জাজনক ঘটনা, তাহলে তুই গাধা এখন এই গল্পটা শুরু করলি কেন?

আমি জানি মামুনের কোনো কাজ নাই কিন্তু হঠাৎ করে সে ভান করল তার অনেক কাজ তাই তাড়াতাড়ি চলে গেল।

যে মানুষটার সাথে ডোরার দেখা না হলে কোনো ক্ষতি ছিল না একদিন তার সাথেও দেখা হয়ে গেল, মানুষটা হচ্ছে ফালতু মতি। আমি ডোরাকে নিয়ে লতিফা বুবুর বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছি, তখন দেখলাম উল্টো দিক দিয়ে মতি আসছে। আমি ডোরাকে বললাম, ডোরা, দেখছ, সামনে দিয়ে একটা লোক আসতাছে?

হ্যাঁ দেখেছি। কী হয়েছে?

এই মানুষটা হচ্ছে ফালতু মতি।

ফালতু মতি?

হ্যাঁ। দশ গ্রামের মাঝে সবচেয়ে ফালতু মানুষ। তোমার সাথে যদি উল্টাপাল্টা কথা বলে উত্তর দেওয়ার কোনো দরকার নাই।

উল্টাপাল্টা কথা কেন বলবে?

মানুষটা ফালতু সেই জন্য।

ততক্ষণে ফালতু মতি আমাদের কাছে চলে এসেছে, এমন ভান করল যেন ডোরাকে দেখেই নাই, শুধু আমাকে দেখেছে! আমার দিকে তাকিয়ে বলল, রঞ্জু নাকি, কই যাস?

এই তো। আমিও ফালতু মতির কথার উত্তর দিই তার মতো করে।

দেশের কোনো খোঁজখবর রাখস?

কোন খোঁজখবর?

এই তো মালাউনদের খবর?

না, রাখি না।

সদরে কী হইছে জানস?

না, জানি না।

মালাউনের পুরা গুষ্টি এখন মুসলমান হইয়া গেছে। মতি হা হা করে হাসল, তারপর পকেট থেকে সিগারেটের পকেট বের করে সেখান থেকে একটা পুরো সিগারেট মুখে দিল। খুব কায়দা করে সেটা ধরিয়ে বলল, মালাউনদের বড় ব্যবসা গঞ্জে। ইন্ডিয়া ভাগলে তো পুরা ব্যবসা লুট হইয়া যাইব, তাই কোনো ঝামেলায় যায় নাই। গরুর গোশত খাইয়া কলমা পইড়া মুসলমান। মতি আবার হা হা করে দুলে দুলে হাসতে লাগল, আগে লক্ষ্য করি নাই মতির মাড়ির রং কালো, যখন হাসে তখন মাড়ি বের হয়ে তাকে দেখতে খাটাশের মতো লাগে।

মালাউনদের ফিচলা বুদ্ধি দেখছস? নিরঞ্জন সাহার নাম এখন আব্দুল জব্বার! মাথার মাঝে টুপি, থুতনির মাঝে ছাগল দাড়ি। বউদের কপালে সিঁন্দুর নাই, হাতে শাঁখা নাই। গুষ্টির পর গুষ্টি এখন মুসলমান খালি খতনাটা এখনো বাকি আছে। বলে আবার খাটাশের মতো হাসতে থাকে।

আমি ডোরাকে বললাম, চল ডোরা আমরা যাই।

মতি মনে হলো এই প্রথম ডোরাকে দেখতে পেল। সে রকম ভান করে বলল, এই মাইয়া কার মাইয়া? আগে দেখি নাই?

আমি একবার ভাবলাম তার কথার উত্তর না দিয়ে হেঁটে চলে যাই কিন্তু শেষে উত্তর দিলাম, বললাম, কাজীবাড়ির নাতনি।

ও! বুঝছি! তোমার বাপরেই গুল্লি করছে না?

ডোরা কোনো উত্তর না দিয়ে মতির দিকে তাকিয়ে রইল। মতি একটু থতমত খেয়ে জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলল, ইশ রে! তোমার বাপ এই গ্রামের বড় ইঞ্জিনিয়ার ছিল, এইভাবে মারা গেল, খুবই দুঃখের কথা। দাফন-কাফন নাকি ঠিক করে হয় নাই?

আমি বললাম, মতি ভাই, এখন যাই।

তারপর ডোরাকে রীতিমতো হাত ধরে টেনে নিয়ে এলাম। আমার খালি মনে হচ্ছিল ডোরা হঠাৎ বিড়ালের মতো লাফ দিয়ে মতির মুখে খামচি মেরে দেবে।

যখন আমরা চলে আসছি, তখন মতি পেছন থেকে বলল, তোদের চ্যাংড়া মাস্টার কই গেল? আজকাল দেখি না। সে মালাউনদের সাথে ইন্ডিয়া ভাইগা গেল নাকি?

আমি কিছু বললাম না। মতি বলল, এখন ভাইগা থাকাই নিরাপদ। দিনকাল ভালো না। একটু থেমে বলল, কাঁকনডুবি মনে হয় আর আগের কাঁকনডুবি থাকব না।

মতি এই কথাটা দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছে সেটা এক সপ্তাহের ভেতরে আমরা টের পেলাম।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল