বাবা অপরাধীর মতো মুখ করে বসে আছেন। বিরাজকাকুর আজ আর অফিস বেরোনো হল না। গোটা আষ্টেক খালি চায়ের কাপ সারা ঘরের এখানে-ওখানে ছড়ানো। কোনওটায় চায়ের তলানির সঙ্গে সিগারেটের টুকরো আর ছাই। কোনওটায় পোড়া দেশলাই কাঠি। কোনওটায় অ্যাসপিরিনের ফেলে দেওয়া সাদা কাগজ। বাবা সকাল থেকে কাপের-পর-কাপ চা খাচ্ছেন। সিগারেটের-পর সিগারেট। ধোঁয়ায়-ধোঁয়ায় ঘর ছেয়ে গেছে। আমার আর শিখার সঙ্গে একটাও কথা বলেননি।

আমার বাবা হলেন রাতের মানুষ। দিনের আলোর কেমন যেন অসহায়। রাতের প্রাণী দিনের আলোর যেমন অস্বস্তি বোধ করে, বাবার চোখে মুখে ঠিক সেই রকম এক ধরনের অস্বস্তি। বিরাজকাকু একবার সেই রাতের প্রসঙ্গ তুলতে চেয়েছিলেন, বাবা চোখের সামনে হাত আড়াল করে বললেন, আমাকে ভুলতে দাও, ভুলতে দাও।

বাবা যেন চোখের সামনে আমার রক্তাক্ত মাকে দেখে শিউরে উঠলেন।

বেলা তিনটের সময় বাবা বললেন, বিরাজ একটা ট্যাক্সি ডাক।

কোথায় যাবে?

হাসপাতালে।

খুব ভালো কথা।

বিরাজকাকু ট্যাক্সি ডাকতে গেলেন। আমরা তখন রাস্তার দিকের বারান্দায়। বাবাকে চিরকালই কেমন যেন অচেনা মনে হয়। সকাল থেকে আজ যেন আরও বেশি অচেনা মনে হচ্ছে। আমার মায়ের চেয়ে কত বেশি স্বাস্থ্যবান, বলিষ্ঠ। কত বেশি যুবক! চোখ-মুখ যেন বড় বেশি কঠোর আর নিষ্ঠুর।

বাবা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। কেন দিলেন? বোধহয় একটু একা থাকতে চান নির্জনে। বাইরে থেকে আমি শুধু একবার গেলাসের আওয়াজ পেলুম ঠুন করে। কি জানি, কোনও ওষুধ খাচ্ছেন হয়তো।

শিখা ফিশফিশ করে বলল, বাবা আমাদের সঙ্গে কোনও কথা বলছে না কেন রে দাদা?

আমি কী করে বলব! আমি বাবার মনের খবর কতটুকু জানি। সে জানেন আমার মা।

বারান্দা থেকেই দেখলাম ট্যাক্সি আসছে।

বিরাজকাকু ওপরে এসে দরজায় টোকা মারলেন। ভেতর থেকে গম্ভীর গলায় বাবা বললেন দাঁড়া খুলছি।

বেশ কিছুক্ষণ পরে বাবা বেরিয়ে এলেন। পরনে ধুতি, পাঞ্জাবি। চোখে সোনালি চশমা। চোখ দুটো গোলাপি লাল। পায়ে চকচকে জুতো। বাবাকে দেখে আমার ভীষণ হাসি পেল মনে মনে। বাবা যেন বিয়ে করতে যাচ্ছেন।

বিরাজকাকু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি তোরা রেডি তো!

বাবা যেন কেমন কুঁকড়ে গেলেন, ওরাও যাবে নাকি!

যাবে না? মাকে দেখতে যাবে না?

বাবা হঠাৎ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন। তোমরা কি পুলিশে ডায়েরি করিয়েছ?

বিরাজকাকু অবাক হয়ে বললেন, সে কী! ডায়েরি করব কেন? তোদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার। এ তো হতেই পারে।

বাবা বললেন, না, মারাও তো যেতে পারে।

তুই একটা পাগল! মাথায় সামান্য লেগেছে। তাতে মারা যাবে কেন?

বাবা মুখ নীচু করে কি যেন ভাবলেন, তারপর বললেন, আমি কী করেছিলুম, কেন করেছিলুম, কিছুই আর মনে নেই। আমাকে তোমরা ভুলতে দাও, আমাকে তোমরা শাস্তি দাও।

বিরাজকাকু এবার ধমকে উঠলেন, তুই খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলছিস ঋভু। এখন তুই আবার ওসব খেলি কেন?

বাবা চাবুক খাওয়া মানুষের মতো চমকে উঠলেন। মুখে রাগ। শক্ত রেখা।

কী বললি! খেয়েছি কেন? বিরাজ হু ইজ মাই ফ্রেন্ড? কে আছে আমার? রঙ্গমঞ্চ খালি হয়ে যাওয়ার পর আমার পাশে কে থাকে? শেষ দর্শক চলে যাওয়ার পর কে থাকে? আমার পাশে কে থাকে? আমি থাকি। আমি যখন নির্জন রাস্তায় পায়ে-পায়ে বাড়ির দিকে ফিরতে থাকি তখন কারা আসে আমার পেছনে-পেছনে? এক পাল নেড়ি কুকুর। তখন মুগ্ধ দর্শকের হাততালি, তাদের বাহবা নয়, কুকুরের ঘেউঘেউ আমার পেছনে ফেরে! কেন ঘেউঘেউ? আমি যে অপরিচিত। মধ্যরাতের মাতাল। দীপা কি সেই কুকুরের একটি?

একী, একী কথা তুমি বলছ ঋভু?

ঠিকই বলছি। দীপা সেদিন আমাকে মাতাল বলেছিল। লম্পট বলেছিল। আমি নাকি থিয়েটারের ওই মেয়েটার সঙ্গে, যে জাহানারা সাজে, তার সঙ্গে রাত কাটাই। ফুল, ফুল, মূর্খ। জাহানারা আমার মেয়ে। চরিত্রের সঙ্গে জীবন না মেলাতে পারলে অভিনয় হয় বিরাজ। হয় না। অভিনয়, অভিনয় নয়? জীবন, জীবন। কে বুঝবে, কাকে বোঝাব?

বাবার সারা শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে। বিরাজকাকু বাবার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ঋভু তোকে আমরা বুঝতে পারিনি রে। তুই যে কত বড় কালই তার বিচার করবে। চল, চল। গাড়িটা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে।

<

Sanjib Chattopadhyay ।। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়