০৫.

চোখের ওই বিহ্বল দৃষ্টি, মুখের ওই সম্মোহিত ভাব এসবই চেনে বন্দনা। কী ভাবে চেনে তা সে বলতে পারতে না। হয়তো রমা মাসির মুখেও এরকম দেখে থাকবে দুপুরে যখন দীপ্তিকে নামিয়ে দিয়ে গেল। তীশ তখনও দোতলার বারান্দায় রেলিঙের পাশে শানের ওপর পাথরের মতো বসে ছিল বন্দনা। অতীশ একবার ঊর্ধ্বমুখ হয়ে বারান্দার দিকে তাকাল। তাকে দেখতে পায়নি। তারপর রিক্সার মুখ ঘুরিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেল। দীপ্তি সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ওপরে। রোদে ঘুরে মুখখানা লাল। কপালে একটু ঘাম। কিন্তু ক্লান্তি নয়, সারা শরীর যেন ডগমগ করছে আনন্দে। তখনই বন্দনা দীপ্তির চোখে সেই বিহ্বলতা দেখতে পেল।

বুকের ভিতরটা যেন নিবে গেল বন্দনার। বিকল হয়ে গেল হাত পা। স্থবির হয়ে গেল শরীর।

কী রে এখানে বসে আছিস যে!

 দীপ্তি যে হাসিটা হাসল সেই হাসিই অনেক খবর দিয়ে দিল বন্দনাকে। সে বলল, এমনিই।

আজ কত ঘুরলাম! তুই সঙ্গে গেলে বেশ হত!

 বন্দনা অবাক হয়ে বলল, আমি সঙ্গে গেলে…?

কথাটা শেষ করল না সে। একটা প্রশ্নের মতো ঝুলিয়ে রাখল। অতীশকে সামনে পেলে সে ওর জামা খিমচে ধরত এখন, বলত, তুমি একটা বিচ্ছিরি লোক! বিচ্ছিরি লোক। বিচ্ছিরি লোক।

দীপ্তি নিজের ঘরে পোশাক পাল্টাতে পাল্টাতে গুনগুন করে গান গাইছিল। আর বারান্দায় বসে অসহায়ের মতো কান্না সামলানোর চেষ্টা করছিল বন্দনা। পৃথিবীটা যে কেন এত খারাপ!

পিছনের বাগানে গাছতলায় তার পুতুলের সংসারে কতবার মিছে নেমন্তন্ন খেতে এসেছে একটি কিশোর। যার চোখ মুখ ছিল ভারী সহজ ও সরল, দুটো চোখে ছিল বিস্ময়ভরা লাজুক চাহনি। তখন কোঁচা দুলিয়ে খাটো ধুতি পরত অতীশ, গায়ে ছিল জামা। সংকোচ ছিল, লজ্জা ছিল। কত শাসন করেছে তাকে বন্দনা। বাগানে তখন অনেক বেশি গাছপালা, ঝোপঝাড় ছিল। অনেকে এসে জুটত তখন। রাজ্যের ছেলেমেয়ে মিলে চোর-চোর খেলত। তার মনে আছে অতীশকে একবার। ধরে এনে চোর সাজিয়েছিল তারা। অতীশের সে কী হাসি। কাউকেই সে ছুঁতে পারছিল না। দৌড়ে দৌড়ে হয়রান হল। বন্দনার তখন মায়া হয়েছিল। কামিনী ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে সে হাত বাড়িয়ে বলল, এই নাও, আমাকে ছুঁয়ে দাও তো অতীশদা। অতীশ চমকে উঠে বলে, তাই কি হয় খুকি? তুমি বড় বাড়ির মেয়ে, তুমি কেন চোর হবে? বন্দনা তখন দৌড়ে গিয়ে। অতীশকে ছুঁয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, এইবার? বন্দনা চোর সাজল, কিন্তু আর সবাই পালালেও অতীশ এসে সামনে দাঁড়াল বোকার মতো, এই নাও খুকি, আমাকে ছুঁয়ে দাও তো! এত দৌড়ঝাঁপ তোমার সহ্য হবে না। এত রাগ হয়েছিল তখন অতীশের ওপর।

আজ চোখে জল আসতে চায় কেন যে!

তার বাবার পিছু পিছু অতীশ টুকটুক করে শান্ত পায়ে হেঁটে আসত। বাবার পাশে চুপ করে বসে পুজো করা দেখত। কখনও ঘুরে ঘুরে তাদের এঘর ওঘরে সাজানো জিনিস দেখে বেড়াত। মা কখনও কিছু খাবার দিলে মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠত খুশিতে। কত যত্ন করে খেত! খিদে ছিল, কিন্তু লোভ ছিল না কখনও। বন্দনা যখন গান গাইতে শুরু করে তখন তো অতীশ বেশ বড়টি হয়েছে। চুপ করে বসে গান শুনত। একটু আধটু তবলা বাজাতে শিখেছিল, ঠেকা দিত।

তাদের কত ফাইফরমাশ যে খেটে দিত অতীশ তার ইয়ত্তা নেই। ওই উঁচু উঁচু নারকোল গাছে উঠে কাঁদি কাঁদি নারকোল পেড়ে দিত আর বন্দনার তখন কী ভয় করত। অত উঁচু থেকে যদি পড়ে যায়! সে চিৎকার করতে থাকত, ও অতীশদা! নেমে এসো না! পড়ে যাবে যে!

না না পড়ব না খুকি। আমি কত গাছ বেয়ে বেড়াই।

 একদিন বন্দনা জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কেন আমাদের এত ফাইফরমাশ খাটো?

অতীশ অবাক হয়ে বলেছিল, তাতে কী? তোমরা ব্রাহ্মণ জমিদার! আমাদের অন্নদাতা, মনিব।

এমন ভারিক্কি চালে বলেছিল যে বন্দনা হেসে বাঁচে না।

আজ হাসি পায় না বন্দনার। একটুও হাসি পায় না।

খাওয়ার পর নিজের ঘরে চুপ করে শুয়েছিল বন্দনা। শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগছে। মনটা অন্ধকার।

দীপ্তি এসে বলল, কী রে ঘুমোচ্ছিস?

না দীপ্তিদি, দুপুরে আমি ঘুমোত পারি না।

তা হলে বসে একটু গল্প করি।

মুখে জোর করে হাসি টেনে উঠে বসল বন্দনা।

ঘরে রোদের কয়েকটা চৌখুপি এসে মেয়ের ওপর পড়ে আছে। পায়রা ডাকছে। কাকের ডাকে খাঁ খাঁ হয়ে যাচ্ছে অপরাহু।

দীপ্তি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বলল, ছেলেটা এত ইন্টারেস্টিং যে আমি ঠিক করেছি ওকে কলকাতায় নিয়ে যাব।

বন্দনা অবাক হয়ে বলে, নিয়ে যাবে? নিয়ে কী করবে দীপ্তিদি?

কী করব তা এখনও ঠিক করিনি। ছেলেটার অনেক গুণ। আজ শুনলাম ও নাকি ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ, কল সারাইয়ের কাজ, মোটর মেকানিকের কাজ সবই একটু আধটু জানে। টাইপ-শর্টহ্যান্ডও শিখেছিল। এত শিখেও মফস্বলে ওর তো কিছু হল না। ভাবছি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ওকে একটা কোনও ট্রেনিং দেওয়া। এখানে তো কোনও স্কোপ নেই। খেটে মরবে, পেট ভরবে না।

শুধু পরোপকার? আর কিছু নয়? বন্দনা বড় বড় চোখ করে দীপ্তির মুখটা দেখছিল। সেই মুখে না-বলা অনেক ভাব খেলা করছে। বারবার যেন নিজের কাছেই নিজে লজ্জা পাচ্ছে। এ লক্ষণ সে চেনে।

দীপ্তি বলল, অমল তো আমার কোনও অভাব রেখে যায়নি। ভাবছি, যদি একটা ছেলেকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারি তবে টাকাটা সার্থক হবে।

আজ তোমরা কোথায় কোথায় গিয়েছিলে দীপ্তিদি?

ওঃ, আজ সারা শহরটা পাগলের মতো ঘুরেছি। নদীর ধারটা দারুণ ভাল। নৌকোতেও চড়লাম একটু।

বন্দনা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। সেই শ্বাসটা তার বুকের মধ্যে একটু ব্যথা হয়ে থর্ম ধরে রইল।

তুমি কি তোমার সঙ্গেই অতীশদাকে নিয়ে যাচ্ছ?

না। আমি কাল ফিরে যাব। অতীশ যাবে আরও এক মাস বাদে। একটু গুছিয়ে নিয়ে যাবে।

 খুব সরলভাবে বন্দনা জিজ্ঞেস করল, অতীশদা কোথায় থাকবে?

কাঁধটা একটু ঝাঁকিয়ে দীপ্তি বলল, এখনও ঠিক করিনি। বন্ডেল রোডে তো আমার আরও একটা ফ্ল্যাট পড়ে আছে। ভাড়া দিইনি। ওখানে অমলের কম্পিউটার আর আরও সব কী যেন আছে। তালাবন্ধ পড়ে থাকে। সেখানেই থাকতে পারবে।

তোমার অনেক টাকা, না দীপ্তিদি?

দীপ্তি একটু উদাস হয়ে বলল, টাকা! তা হয়তো আছে। অমলের তো টাকার নেশা ছিল। কিন্তু টাকা দিয়ে কী হবে বল, মানুষটাই তো থাকল না।

মানুষকে ধরে রাখা যে কত কঠিন তা বন্দনার মতো আর কে জানে? কেউ মরে যায়, কেউ চলে যায়। কী যে একা আর ফাঁকা লাগে তার! চোখ ভরে জল আসছিল তার।

গল্প করতে এসেছিল দীপ্তি। কিন্তু কেন যেন তাল কেটে গেল। জমল না। যাই রে, কাল সকালেই গাড়ি, গুছিয়ে নিই। বলে দীপ্তি হঠাৎ উঠে গেল।

বিকেলে তার মা গলদঘর্ম হয়ে একটা চিঠির মুসাবিদা করছিল। লেখা-টেখার অভ্যাস নেই। বন্দনাকে ডেকে বলল, ওরে দেখ তো, ভুলভাল লিখেছি কি না। কতকাল কিছু লিখিনি, বানানই ভুলে গেছি। একটু দেখে দে তো।

বন্দনা লজ্জা পেয়ে বলল, তুমি বাবাকে লিখছ, আমার কি সে চিঠি পড়া উচিত?

আহা, এ কি আর সেই চিঠি নাকি? এ চিঠির মধ্যে গোপন কথা আর কী থাকবে! পড়ে দেখ।

বন্দনা পড়ল। বেশি বড় চিঠি নয়। সম্বোধনে এখনও শ্রীচরণেষু লিখতে ভোলেনি মা। লিখেছে, তোমার বাড়িতে তুমি আসতে চাও আমি বারণ করার কে। বরং তোমার বাড়িতে আমিই তো অনধিকারীর মতো বাস করছি। আমি অন্য বাড়ি দেখছি, শিগগিরই ছেলে মেয়ে নিয়ে চলে যাব। তোমার পথে আর কোনও কাঁটা থাকবে না। শাওলরাম মাড়োয়ারি এ বাড়ি কিনতে চাইছে। যদি তাকে বাড়ি বিক্রি করে তা হলে তোমার বড় দুটি ছেলে-মেয়ের জন্য কিছু রেখো। ওদের তো ভবিষ্যৎ আছে।

চিঠিটা পড়তে পড়তে আবার চোখে জল এল বন্দনার। তার বাবা আর মায়ের মধ্যে কত ভালবাসার সম্পর্ক ছিল, এখন কত দূরের হয়ে গেছে দুজনে। কেন যে এমন হয়?

ভুলভাল নেই তো।

না মা।

পাঠাব এ চিঠি?

পাঠাও।

 পশ্চিমে দিগন্তে যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল আজ তখন ছাদের ওপর থেকে আকুল চোখে চেয়ে ছিল বন্দনা। তার মনে হচ্ছিল এই যে সূর্য অস্ত গেল আজ, আর উঠবে না কখনও। এর পর থেকে অনন্ত রাত্রি। শুধু অন্ধকার।

সন্ধের অন্ধকার যখন বিশাল পাখা মেলে অতিকায় এক কালো পাখির মতো নেমে আসছে, যখন গাছে গাছে পাখিদের তীব্র কলরব, পায়রারা ঝটপট করে নেমে আসছে ছাদে, ঠিক তখনই দু দুটো বোমা ফাটল পরপর।

আশ্চর্য এই-আজ ওই বিকট শব্দে একটুও চমকাল না বন্দনা। তার কোনও ভয় করল না। বরং ছাদ থেকে ঝুঁকে সে দেখার চেষ্টা করছিল, বোমা দুটো কোথায় ফাটল। বাগানের পিছন দিকে ধোঁয়া উঠছে নাকি?

পিছনের বাগানের একটা ঝোপ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এল অবু। ওপরের দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে বলল, এই বন্দনা।

কী রে?

 ঘরে যা। ল্যাংড়া অ্যাটাক করছে।

 তার মানে?

 ঘরে পালা।

বন্দনা একটু হাসল। বলল, এই তোর সাহস?

আমি যাচ্ছি খবর দিতে। ঘরে যা।

বন্দনা ঘরে গেল না। দাঁড়িয়ে রইল স্থির হয়ে। দেওয়ালের ওপাশে গলিতে একটা দৌড়োদৌড়ি হচ্ছে। কে যেন ঢিল মেরে ল্যাম্প পোস্টের বালব ভেঙে দিল। অবু দৌড়ে চলে গেল সদরের দিকে। বাইরে থেকে আরও দুটো বোমা এসে পড়ল পিছনের বাগানে। বাইরে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, এই শালা, জানে মেরে দেব..

ধীরে, ধীরে সন্ধ্যার ভারী বাতাসে বারুদের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। ছাদ থেকেই সে শুনতে পেল, তাদের দোতলায় দুড়দাড় করে জানালা দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মা চিৎকার করল, ওরে বাহাদুর! বিলু! বিলু কোথায়?

বিলু নীচের ঘরে আছে মা। পড়ছে।

আর বন্দনা?

 দেখতে পাইনি।

 সর্বনাশ! দেখ কোথায় গেল রোগা মেয়েটা!

দীপ্তিদি তার ঘর থেকে বেরোল বোধহয়। আতঙ্কিত গলায় বলল, এ জায়গায় তোমবা কেমন করে থাকো মামি! রোজ এরকম হয় নাকি?

আর বোলো না বাছা। কী যে ষন্ডামি-গুণ্ডামি শুরু হয়েছে আজকাল। ভয়ে মরি। বন্দনা কি তোমার ঘরে?

না তো মামি!

 তা হলে কোথায় গেল?

 ছাদে যায়নি তো?

বন্দনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এখন তাকে ঘরে যেতে হবে। ঘরে যেতে তার একটুও ইচ্ছে করছে না। জানালা দরজা বন্ধ করে দম চেপে থাকা তার পক্ষে এখন অসম্ভব। সে মরেই যাবে। আকাশে চাঁদ উঠেছে। আজ কী তিথি জানে না সে। মস্ত চাঁদ দেখে মনে হয়, পূর্ণিমার কাছাকাছি। এখন কি ঘরে যেতে ইচ্ছে করে?

বাহাদুরের পায়ের শব্দ উঠে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। বন্দনার আর ছেলেমানুষির বয়স নেই। তবু সে হঠাৎ ঘদের দক্ষিণ কোণে রাখা আলকাতরার পিপেটার পিছনে গিয়ে ঝুপ করে বসে পড়ল। বাহাদুর ছাদে এসে চারদিকটা দেখে নিয়ে ফের দৌড়ে নীচে চলে গেল।

না মা, ছাদে তো দিদিমণি নেই!

ওমা! কী সব্বোনেশে কথা! মেয়েটা তা হলে গেল কোথায়?

দীপ্তি বলল, অমন অস্থির হোয়ো না মামি, আমি দেখছি। কোনও বান্ধবীর বাড়িতে যায়নি তো!

 আমাকে না বলে তো কোথাও যায় না!

 পিপের আড়াল থেকে উঠে রেলিঙে ফের ভর দিয়ে দাঁড়ায় বন্দনা। শালটা আনেনি। তার শীত করছে। ঠাণ্ডা লাগবে কি? লাগুক! তার একটুও আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না।

শাওলরাম মাড়োয়ারি এ বাড়ির দাম দিতে চেয়েছে চৌদ্দ লাখ টাকা। চৌদ্দ লাখ শুনে মা সে কী খুশি! শাওলরামের সামনেই বলে ফেলল, আমি রাজি আছি শাওলরামজি। আপনি ব্যবস্থা করুন। উনি পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি আমাকে দিয়ে রেখেছেন।

কথাটা সত্যি। বাবা চলে যাওয়ার পর তার খোলা দেরাজে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নিটা পাওয়া গিয়েছিল। তার মায়ের বা তাদের যেন কষ্ট না হয় তার জন্য তার ভাল বাবা সর্বই প্রায় সঁপে দিয়ে গিয়েছিল মায়ের হাতে।

বাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা আগেই হয়ে যেত। কিন্তু মদনকাকা শাওলরামের দর শুনে মাকে এসে বলল, বউদি, আপনার কি মাথাটা খারাপ হল?

কেন মদন, দরটা তত খারাপ নয়। চৌদ্দ লাখ তো অনেক টাকা!

এ বাড়ির চৌহদ্দির মাপ চার বিঘার ওপর, পাঁচ বিঘার কাছাকাছি। এখন শহরের এ জায়গায় লাখ টাকা করে কাঠা যাচ্ছে। শুধু জমির দামই তো কোটি টাকার কাছাকাছি!

শুনে মার চোখ কপালে উঠল, বলো কি মদন? এক কোটি?

বাড়ির দামটা ধরলে আরও দশ লাখ উঠবে। বাড়ির দাম বেশিই হত। কিন্তু পুরনো বাড়ি শাওলরাম রাখবে না। ভেঙে মালপত্র বেচবে। তা বেচলেও কম হবে না। বার্মা সেগুনের কাঠ আর মার্বেলের দামই তো কত উঠবে।

মা একটু হতাশ হয়ে বলল, অত কি দেবে? তবু শাওলরাম একটা দর দিয়েছে। আর তো কেউ দরও দিচ্ছে না।

কেউ কিনতে আসছে না, কারণ শাওলরাম সবাইকে টিপে রেখেছে। আপনাকে চৌদ্দ লাখ দেবে, আরও পনেরো বিশ লাখ টাকা অন্যদের খাওয়াবে। ওসব চালাকি তো আমরা জানি। আপনি চেপে বসে থাকুন। শাওলরামই দর বাড়াবে।

কথাটা শুনে মায়ের ভরসা হল না। বলল, অত টাকা কেউ দেবে না মদন।

এক লপ্তে না হল, ভাগে ভাগে বিক্রি করবেন না হয়। তাতে অনেক বেশি টাকা পাবেন।

কে ওসব করবে? আমার কি কেউ আছে?

এই বলে মা একটু কান্নাকাটি করল। যাই হোক, এইসব কথাবাতার পর বাড়ি বিক্রি পিছিয়ে গিয়েছিল। দু মাস বাদে শাওলরাম এসে ফের তাগাদা দিতে লাগল। এ বার আরও দু লাখ বেশি দর দিতে রাজি হল, যেন খুব ঠকা হয়ে যাচ্ছে এমন মুখের ভাব করে। আরও দুমাস বাদে হীরেনবাবু আর অতুলবাবুর মধ্যস্থতায় শাওলরাম বিশ লাখ টাকা পর্যন্ত উঠল। বলে গেল, এ দর আর বাড়বে না।

এসব এক মাস আগেকার কথা। বন্দনার এত মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, সেই মন খারাপই যেন জ্বর হয়ে দেখা দিল।

এই বাড়িটার পরতে পরতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে সে যেন রেণু-রেণু হয়ে ছড়িয়ে আছে। এত মায়া যে, এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাওয়ার কথা সে ভাবতেই পারে না। কিন্তু বাবা যখন রমা মাসিকে নিয়ে আসবে তখন তো মা থাকবে না এ বাড়িতে। মাকে ছেড়ে সেও তো থাকতে পারবে না। কী যে হবে! তার চেয়ে এই তিনতলার ছাদ থেকে যদি আজ সে লাফিয়ে পড়ে মরে যায় তাও ভাল। শরীরে নয়, অশরীরী হয়ে এই বাড়িতেই হয়তো ঘুরে ঘুরে বেড়াবে সে।

বাগানে একটা টর্চের ঝিলিক দেখা গেল। দশ বারোটা ছেলেকে জ্যোৎস্নার মধ্যে ছুটতে দেখতে পেল বন্দনা। কে যেন চেঁচিয়ে বলল, দেয়ালের আড়ালে প্রোটেকশন নিয়ে চালাস।

দুটো ছেলেকে দেয়ালের ওপরে উঠে দাঁড়াতে দেখতে পেল বন্দনা। হাতে কিছু একটা অস্ত্রশস্ত্র আছে। বাইরের গলিটা এখন নিঃঝুম। ৫৩৮

ফট করে একটা শব্দ হল কোথায় যেন। বন্দনা শিহরিত হয়ে টের পেল ভ্রমরের মতো গুঞ্জন তুলে তার মাথার ওপর দিয়ে কী যেন একটা উড়ে গেল। দেয়াল থেকে দুটো ছেলেই লাফিয়ে নেমে পড়ল এদিকে। কে যেন বলল, গুলি চালাচ্ছে শালা। জোর বেঁচে গেছি।

তবু ভয় করল না বন্দনার। জ্যোৎস্নায় স্নান করতে করতে সে স্থির দাঁড়িয়ে রইল। রেলিঙের ওপর তার দুখানা আলগোছ হাত। সটান হয়ে স্পষ্ট হয়ে সে দাঁড়িয়ে।

হঠাৎ মায়ের গলা শুনতে পায় বন্দনা, ওরে আমার মেয়েটা…

বন্দনা নড়ল না। আজ রাতে তার খুব মরতে ইচ্ছে করছে।

তাদের বাগানে আরও কয়েকটা ছেলে ঢুকে পড়েছে। ধুতি আর শার্ট পরা বাবুদাকে সে এই ম্লান জ্যোৎস্নার আলোতেও চিনতে পারল। বাবুদা বলল, সবাই এখানে ঢুকলে হবে না। বড় রাস্তা দিয়ে গলির দুটো মুখ দিয়ে ঢুকতে হবে। কালকের মতো।

আদেশ পেয়েই কয়েকজন ফিরে দৌড়ে গেল সদরের দিকে।

 কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপরই বাইরের গলিতে প্রচণ্ড শব্দে চার-পাঁচটা বোমা ফাটল। সেই সঙ্গে গুলির আওয়াজ। আরও দুটো ভ্রমরের গুঞ্জন খুব কাছ দিয়েই উড়ে গেল বন্দনার।

তবু একটুও ভয় করল না তার। পাথরের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। পৃথিবীর কোনও ঘটনাই তাকে আজ আর স্পর্শ করছে না যেন। তার খুব হালকা লাগছে। তার ভেসে পড়তে ইচ্ছে করছে হাওয়ায়।

তাদের সদর দরজার কড়া ধরে কে যেন জোর নাড়া দিচ্ছিল। সেই সঙ্গে একটা তীব্র চিৎকার কামা! কর্তামা !

মা সভয়ে চিৎকার করে ওঠে, কে? কে রে? কী হয়েছে রে?

অতীশের আর্তস্বর শোনা গেল, তামা, ছাদে বন্দনা দাঁড়িয়ে আছে। ওকে নামিয়ে আনুন। বাইরে গুলি চলছে।

বন্দনা ছাদে? কে বলল তোকে?

আমি দেখেছি কর্তামা । ও পিছন দিকেই দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকেই গুলি চলছে। ওকে নামিয়ে আনুন।

বন্দনার সমস্ত শরীর জুড়ে একটা রাগের স্রোত বয়ে গেল। সে ছুটে উল্টো দিকের রেলিঙে এসে ঝুঁকে ক্রুদ্ধ গলায় বলল, বেশ করেছি দাঁড়িয়ে আছি। তাতে তোমার কী? তোমার কী?

উঠোনের দিকটায় সরে গেল অতীশ। ল্যাংচাচ্ছে। ওপর দিকে চেয়ে বলল কী করছ তুমি ওখানে?

আমি মরব। তোমার তাতে কী?

 অতীশ হতভম্ব হয়ে বলল, মরবে কেন? নেমে এসো। আমার মরতে ইচ্ছে হয়েছে। তুমি একটা বিচ্ছিরি লোক।

জ্যোৎস্নায় ঊর্ধ্বমুখ হয়ে অতীশ অসহায় গলায় বলল, ওসব বলতে নেই। বেঁচে থাকতে মানুষ কত কষ্ট করে জানো না? নেমে এসো।

নামব না। যাও, কী করবে? তুমি লোভী। টাকার জন্য সব করতে পারো তুমি। দীপ্তিদির সঙ্গে পর্যন্ত…।

সিঁড়ি দিয়ে মা আর বাহাদুর উঠে আসছিল দ্রুত। আর সময় নেই। ওরা ধরে নিয়ে যাবে। বন্দনা আরও ঝুঁকে পড়ল নীচের দিকে, তুমি একটা বিচ্ছিরি লোক। বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি লোক।

অতীশ খুব ভালমানুষের মতো গলায় বলল, হ্যাঁ, তা তো জানি। অনেকদিন ধরে জানি। আমি একটা বিচ্ছিরি লোক।

কী করছিস সর্বনাশী। কী করছিস? বলতে বলতে মা এসে ধরল তাকে।

 বাহাদুর মুখে আফশোসের শব্দ করে বলল, পড়েই যেতে যে আর একটু হলে।

বন্দনা নেমে এল। একটু ঘোর-ঘোর অবস্থা তার। যেন পুরো চৈতন্য নেই। যেন খানিকটা স্বপ্নাচ্ছন্ন। খানিকটা জাগা।

মা চাপা স্বরে বলল, গা যে বেশ গরম। ছাদে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলি রে অসভ্য মেয়ে

অনেকক্ষণ মা।

কেন?

 আমার মন ভাল নেই মা, আমার মন ভাল নেই।

 রাতে জ্বর বাড়ল বন্দনার। বুকে একটু ব্যথা, কাশি, সর্দি, হাঁচি, আর বাইরে তখন অবিশ্রান্ত বোমার শব্দ। গুলির শব্দ। যেমন দেওয়ালির দিন শোনা যায়, অবিকল তেমনি।

বন্দনার জ্বর উঠল একশো চারে। বিকারের ঘোরে সে দেখছে ফুটফুটে শীতের সকালে তাদের শান্ত বাগানে গাছের ছায়ায় বসে সে পুতুল খেলছে। আজ পুতুলের বিয়ে। পুরুতমশাই কখন আসেন তার জন্য অপেক্ষা করছে সে।

মধ্যরাতে পুলিশের গাড়ি ঢুকল পাড়ায়। প্রথম টিয়ার গ্যাস। তারপর গুলি। বাড়ি ঘর ভরে গেল বারুদের গন্ধে।

ভোররাতে পিছনের বস্তির টিউবওয়েলের ধারে গুলি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে মারা গেল ল্যাংড়া। পুলিশের শক্তিশালী রাইফেলের গুলি তার ঘাড় ভেঙে দিয়ে গেছে, বুকে মস্ত ফুটো দিয়ে রক্তের ফোয়ারা বেরিয়ে রাস্তা ভাসিয়ে দিল।

পরদিন নির্বিকার সূর্য ফের উঠল আকাশে। ততক্ষণে কোলাহল থেমে গেছে। মোট চারটে ডেডবডি তুলে নিয়ে গেল পুলিশ। সকাল আটটার ট্রেন ধরবে বলে রওনা হয়ে গেল দীপ্তি। বাহাদুর তাকে রিক্সা ডেকে তুলে দিয়ে এসে বলল, ল্যাংড়া সাফ হয়ে গেছে মা। বাঁচা গেল।

মদনকাকা তার হোমিওপ্যাথির বাক্স নিয়ে এসে বন্দনার নাড়ি ধরে অনেকক্ষণ দেখে বলল এ যে খুব জ্বর!

হ্যাঁ। একশো চার। মা বলল।

নাড়ির অবস্থাও ভাল বুঝছি না। জ্বর বিকারে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। নিউমোনিয়া হওয়াও আশ্চর্য নয়। অ্যালোপ্যাথিই ভাল বউঠান। টাইফয়েডের পর শরীর কাঁচা থাকে।

ঘোরের মধ্যেই চোখ মেলে বন্দনা জিজ্ঞেস করল, ও কি চলে গেছে?

মা ঝুঁকে বলল, কে? কার কথা বলছিস? দীপ্তি? সে এই তো গেল। গিয়ে নাকি কলেজ করবে।

ডাক্তার ডেকো না মা, আমি আর ভাল হতে চাই না।

 ও কী কথা? চুপ করে শুয়ে থাক।

কে মারা গেছে মা?

 ও ল্যাংড়া।

আর?

আর কে জানি না। মোট চারজন।

 উঃ।

কী হল?

খবর নাও কে মারা গেল আর।

ওসব ষণ্ডা-গুণ্ডাদের খবরে আমাদের কী দরকার? মরেছে বাঁচা গেছে।

উঃ মা, খবর নাও।

 নিচ্ছি মা নিচ্ছি। ও বাহাদুর খবর নে তো কে কে মারা গেছে।

একটু বাদে মা এসে বলল, ল্যাংড়া, কুচো, ভোলা আর বিশু। কারা এরা তাও জানি না বাবা। তবে ভোলার মা বছরটাক আগে আমাদের বাড়িতে ঠিকে কাজ করত। বেচারা।

বন্দনা অস্ফুট গলায় বলল, কত শুব্ধ ছিলে তুমি, কত পবিত্র ছিলে! এঁটোকাঁটা হয়ে গেলে? আমার তো মোটে সতেরো বছর বয়স….এখনও কত দিন বাঁচতে হবে বলো তো! একা! কী ভীষণ একা।

মা বলল, মনটা ভাল নেই মা, আমাদের অতীশটাকে নাকি পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে!

বন্দনা কথাটা শুনতে পেল না। এক ঘুমঘোর তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে তখন।

মা বলল, পুলিশ নিয়ে তো বড় মারে। বোকা ছেলেটা। পুলিশের হাত থেকে নাকি বন্দুক কেড়ে নিতে গিয়েছিল।

চার দিন বাদে জ্বর ছাড়ল বন্দনার। একগাদা অ্যান্টিব্যয়োটিক খেয়ে শরীর আরও দুর্বল। আরও দুদিন বাদে হঠাৎ তাদের উঠোনে একটা রিক্সা এসে থামল ঠিক দুপুরবেলায়। একজন রোগা বুড়ো মানুষ একখানা হোট ব্যাগ হাতে খুব ধীরে ধীরে উপরে উঠে এল। গায়ে একটা হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি, পরনে আধময়লা ধুতি, পায়ে হাওয়াই চটি। বারান্দায় তার চেয়ারে বসে ছিল বন্দনা। বুড়ো মানুষটিকে দোতলায় বিনা নোটিশে উঠে আসতে দেখে ভু কুঁচকে চেয়ে ছিল বন্দনা। কোনও আত্মীয় কি? চেনা?

মানুষটি তার দিকে কেমন এক বিমূঢ় চোখে চেয়ে ছিল। পলক পড়ছে না। একটাও কথা নেই। মুখে। পরাজিত বিধ্বস্ত একজন মানুষ।

বন্দনাও চেয়ে ছিল। গুড়গুড় গুড়গুড় করে পায়রা ডাকছে সিলিঙে। কেমন যেন করছে বুকের মধ্যে বন্দনার।

ঠিক এই সময়ে মা বেরিয়ে এসে বারান্দায় পা দিল। তারপর থমকে দাঁড়াল।

 বুড়ো মানুষটি কাঁপছিল থরথর করে। হাত থেকে স্বলিত ব্যাগটা পড়ে গেল শানে।

মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এলে তা হলে!

 বুড়ো মানুষটি কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। একবার হাঁ করল। তারপর মুখ বুজে ফেলল। চোখের কোলে জল।

রেণু! বলে লোকটা আর পারল না। উবু হয়ে বসে পড়ল হঠাৎ। তারপর দুই হাতে মুখ ঢাকল। কাঁদল বোধহয়।

লোকটা কে তা বুঝতে পারে বন্দনা, কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না। এই কি তার সেই বাবা, যে কিনা একজন কবির মতো মানুষ। শৌখিন আনমনা, কল্পনায় ডুবে থাকা। যে বাবা তাকে শিখিয়েছিল ঘোট ঘোট নানা জিনিসের মধ্যে রূপের সন্ধান। বাইরের দুনিয়া নরখাদক বাঘের মতো বাবাকে চিবিয়ে খেয়েছে। না, সবটা নয়। অর্ধেক ফেরত দিয়েছে বুঝি। প্রেতলোক থেকে যেন বাবার এই আগমন।

বন্দনা উঠল না, দৌড়ে গেল না, চিৎকার করল না আনন্দে, উদ্বেল হল না, শুধু চেয়ে রইল। দেখল, মা গিয়ে বাবাকে হাত ধরে তুলছে। বলল, এসো, বোসো। এ তোমারই বাড়িঘর। অত লজা পাচ্ছ কেন?

একটা ময়লা রুমাল পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে বাবা নাক আর চোখ মুছল। দ্বিতীয়বার বলল, রেণ।

বলো। কী বলবে?

বন্দনা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তারপর ঘরে চলে এল। এ কোন বাবাকে ফেরত দিল পৃথিবী? এ কেমন ফেরত পাওয়া? তার বুকের ভিতরে যে একটা পাথরের মতো স্তব্ধতা। মানুষ এত পাল্টে যায়।

ঘর থেকেই সে শুনতে পেল, মা বলছে, বোসো চেয়ারে। একটু জিরিয়ে নাও। কথা পরে হবে।

বাবা বসল। বলল, একটু জল দেবে?

মা জল নিতে ঘরে এসে বলল, বাবাকে প্রণাম করতে হয়। শত হলেও গুরুজন।

বন্দনা নড়ল না। চুপ করে বসে রইল। পাথর হয়ে।

জল খেয়ে বাবা আরও অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ওরকম চিঠি লিখলে কেন রেণ?

কেন, আমি কি খারাপ কিছু লিখেছি?

এ বাড়ি ছেড়ে তুমি কেন যাবে?

নইলে উপায় কী?

 আমি বলতে এসেছি, তুমি থাকো। আমি তো কাটিয়েই দিয়েছি আয়ু। বাকিটা কেটে যাবে।

 তা কেন? কষ্ট করার তো দরকার নেই। রমাকে নিয়ে আসোনি?

না। সে আসতে বড় ভয় পায়।

 ভয় কীসের? সে তো এখন সুয়োরানি। আমি দুয়ো।

বাবা একটা খুব বড়, বুক খালি করা শ্বাস ফেলে চুপ করে থাকল।

মা বলল, খাবে তো?

 খাব! বলে বাবা যেন খুব অবাক হয়ে গেল।

 মা বলল, ভাত খেয়ে এসেছ কি?

না।

 দুপুরে এখানেই তো খাবে। আর কোথায় যাবে?

 বাবা আর একটা খুব বড় শ্বাস ফেলে বলল, এ চেয়ারে বন্দনা বসে ছিল না?

হ্যাঁ।

আমাকে চিনতে পারেনি। না? কত তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে গেছি দেখ! অথচ এখন আমার চুয়ান্ন বছর বয়স! গত দু বছরে কী হয়ে গেল।

প্রেমের মাশুল দিতে হচ্ছে তো! বুড়ো বয়সের প্রেম তার হ্যাপা কি কম?

আমাকে তোমাদের বড্ড ঘেন্না হয়, না? আমার নিজেরই হয়, তোমাদের হবে না-ই বা কেন?

ঘেন্না পিত্তির কথা এখন থাক। চান করে ভাত খেয়ে একটু জিরোও। তারপর কথা হবে।

 বাবা কথাটা কানেই তুলল না। বলল, স্টেশনে নামলাম, রিক্সা করে এত দূর এলাম, এর মধ্যে একটা লোকও আমাকে চিনতে পারেনি, জানো? স্টেশনের রেলবাবু না, রিক্সাওলা না, রাস্তার কেউ না। এমন কী মদনের সঙ্গে দেখা হল নীচে, সেও পারল না। মেয়েটা পর্যন্ত পারেনি। শুধু তুমিই দেখলাম, একবারে চিনলে।

আমার না চিনে উপায় আছে!

বিলু কি বাড়িতে নেই?

স্কুলে গেছে।

 তবে বুঝি তার সঙ্গে দেখা হল না।

ওমা! কেন হবে না?

আমি চারটের গাড়িতে ফিরে যাব।

তা হলে এলে কেন?

 দীপ্তির মুখে শুনলাম তুমি বাসা ভাড়া করে চলে যাবে বলে তোড়জোড় করছ। তাই ছুটে আসতে হল। তুমি ও কাজ কোরো না। তোমরাই থাকবে এখানে। বড় কষ্টে ছিলাম বলে তোমাকে ওরকম একটা অদ্ভুত চিঠি লিখেছিলাম। চিঠিটা পাঠিয়ে মনে হল, কাজটা ঠিক করিনি। সত্যিই তো, ওরকম কি হয়? তোমার যে তাতে অপমান হয় তা আমার মাথায় খেলেনি।

শুধু এইটুকু বলতে এলে?

 হ্যাঁ। আর শেষবারের মতো তোমাদের একটু দেখে গেলাম। আর আসব না।

তোমার শরীরের যা অবস্থা দেখছি, ধকল সইবে তো! তেমন জরুরি কাজ না থাকলে আজ বরং থেকেই যাও। নিজের অধিকারেই থাকতে পারবে। এত বছর ঘর করলে আমার সঙ্গে একটা রাত এ বাড়িতে থাকলে আর কী ক্ষতি হবে?

থাকাটা কি ভাল দেখাবে রেণু?

 ভাল দেখাবে কি না তা জানি না। তোমার শরীর ভাল দেখছি না বলে বলছি।

মেয়েটা বোধহয় চিনতে চাইল না, না? যাক রেণু, আমি বরং ফিরে যাই। বিলুটাকে দেখে গেলে হত। ওরা সব ভাল আছে তো!

আছে। যেমন রেখে গেছ তেমনই আছে।

আর একটু জল দাও। খেয়ে উঠে পড়ি। আড়াইটেয় একটা গাড়ি আছে। ধরতে পারলে সন্ধেবেলায় কলকাতায় পৌঁছে যাব।

আবার জল নিতে মা ঘরে এল। বন্দনা তখনও খাটে বসে। একদম পাথরের মতো।

একবার দেখা করবি না? একটু চোখের দেখা দেখতে এসেছে। যা না কাছে। শরীরের যা অবস্থা দেখছি, লক্ষণ ভাল নয়।

বন্দনা তবু নড়ল না।

বাবা জল খেল। তারপর আরও কিছুক্ষণ বসে রইল। বোধহয় ক্লান্তি। বোধহয় প্রত্যাশা।

মা বলল, এ বাড়ির নাকি এখন অনেক দাম। মদন সেদিন হিসেব করে বলল, এক কোটি টাকার ওপর। শাওলরাম মাড়োয়ারি কুড়ি লাখ টাকা দিতে চাইছে। আর একটু বেশি দাম উঠলে বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়ারই ইচ্ছে আমার। তুমি কী বলে?

তোমাকে তো ওকালতনামা দিয়েই রেখেছি। তোমার ইচ্ছে হলে বেচে দিয়ো। বাড়ি দিয়ে কী হবে?

চাও তো তোমাকে কিছু দেব। কষ্টে আছ।

এই প্রথম বাবা একটু হাসল। বলল, না, আর দরকার নেই।

 দরকার নেই কেন? খুব নাকি অভাব!

বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, সে একটা দিনই গেছে। খুব কষ্টের দিন। কিন্তু সয়েও যায় রেণু। এখন দেখছি, আমার আর অভাবটা তেমন বোধ হয় না। খিদে সহ্য হয়, রোগভোগ সহ্য হয়, অপমানও বেশ হজম করতে পারি। টাকা পয়সার প্রয়োজন ফুরিয়ে আসছে। না রেণু, বাড়ি বেচে টাকা-পয়সা হাতে রেখো। তোমার লাগবে।

মত দিচ্ছ?

হ্যাঁ হ্যাঁ। মত দিয়েই রেখেছি। আসি গিয়ে?

 দুটো সন্দেশ মুখে দিয়ে যাও।

 বাবা উঠতে গিয়েও বসে পড়ল, দাও তা হলে।

সন্দেশ নিতে মা ঘরে এসে বন্দনার দিকে চেয়ে বলল, অন্তত সন্দেশটা নিজের হাতে দাও না বাবাকে। খুশি হবে।

ও লোকটা আমার বাবা নয় মা।

ও কী কথা? ছিঃ। ওরকম বলতে নেই।

আমার বাবা তো এরকম ছিল না মা।

মা ফ্রিজ থেকে সন্দেশ বের করে প্লেটে সাজাতে সাজাতে বলল, চিরদিন কি কারও সমান যায়? শুনেছিস তো অভাবে কষ্টে আছে। চেহারা ভেঙে গেছে, অকালবার্ধক্য এসেছে। তা বলে কি বাবা বলে স্বীকার করবি না?

বন্দনা গোঁ ধরে চুপ করে রইল।

বাবা সন্দেশ খেল। ফের জল খেল। বলল, কম খেলেই আজকাল ভাল থাকি। বুঝলে? এই যে দুটো সন্দেশ পেটে গেল এই-ই এক বেলার পক্ষে যথেষ্ট। উঠলাম, কী বলে?

কী আর বলব। বিলর তো ফিরতে দেরি আছে।

 থাক থাক। না দেখাও ভাল। দেখলে মায়া বাড়ে কিনা।

মেয়ে সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছে।

 থাক থাক। ওকে ওর মতো থাকতে দাও। বড় হচ্ছে, একটা মতামত আছে।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে বাবার খুব সময় লাগছিল। বন্দনা উঠে বারান্দায় এল। তারপর রেলিঙের ফাঁক দিয়ে চেয়ে রইল। একটু বাদেই বাবাকে দেখতে পেল সে, জীর্ণ শীর্ণ একজন মানুষ রোগা দুর্বল পায়ে ধীরে ধীরে উঠোনটা পেরোচ্ছে। পেরোতে পেরোতে একবার মুখ ফিরিয়ে ওপরের দিকে তাকাল। এই তাকানোটা ওই মুখ ফেরানোটাই যেন তীব্র মোচড়ে বুক ভেঙে দিল বন্দনার। বাবা শেষবারের মতো চলে যাচ্ছে। আর আসবে না। উঠোনটা পেরোলেই তাদের সঙ্গে সব বন্ধন ছিঁড়ে যাবে। কেন মুখ ফেরাল বাবা? কেন?

বন্দনা হঠাৎ নিজের অজান্তেই অনুচ্চ স্বরে ডাকল, বাবা! একটু দাঁড়াও।

বাবা ভাল শুনতে পায়নি। যেতে যেতেই আর একবার মুখটা ফেরাল, তাকাল। তারপর ভুল শুনেছে মনে করে চলে যাচ্ছিল।

বন্দনা দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল নীচে। তারপর ছুট-পায়ে গিয়ে দেউড়ির কাছে মানুষটার পথ আটকে দাঁড়াল। কোথায় যাচ্ছ তুমি এই রোদে? না খেয়ে? বলতে বলতে বহু কালের সমস্ত কান্না, জমে থাকা যত দুখ উথাল-পাথাল হয়ে উঠে এল তার বুক থেকে।

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়