০৭.

ধৃতি অফিসে এসেই শুনল, ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে তরুণ বুদ্ধিজীবীদের চা-চক্রের রিপোর্টিং তাকেই করতে হবে। সে নিজেও যে আমন্ত্রিত এ কথাটা জেনে চিফ সাব এডিটর বন্ধুবাবু বিশেষ খুশি হলেন না। বললেন, সবই কপাল রে ভাই। আমি পঁচিশ বছর এ চেয়ারে পশ্চাদ্দেশ ঘষে যাচ্ছি, কিছুই হয়নি।

ধৃতি জবাব দিল না। মনে মনে একটু দুঃখ রইল, কপাল যে তার ভাল এ কথা সে নিজেও অস্বীকার করে না। মাত্র কিছুদিন হল সে এ চাকরি পেয়েছে। সাব এডিটর হিসেবেই। তবু তাকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ফিচার লিখতে দেওয়া হয় এবং গুরুতর ঘটনার রিপোর্টিং-এ পাঠানো হয়। ধৃতিকে যে একটু বেশি প্রশ্রয় দিচ্ছে অফিস তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কারণ এ অফিসে ভাল ফিচার-লেখক এবং ঝানু রিপোর্টারের অভাব নেই।

প্রধানমন্ত্রী মদানে মিটিং সেরে রাজভবনে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে বসবেন সন্ধে সাড়ে-ছটায়। এখনও তিনটে বাজেনি। ধৃতি সুতরাং আড্ডা মারতে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগল।

সম্প্রতি কয়েকজন ট্রেনি জার্নালিস্ট নেওয়া হয়েছে অফিসে। মোট চারজন। তারা প্রত্যেকেই স্কুল কলেজে দুর্দান্ত ছাত্র ছিল। বুধাদিত্য হায়ার সেকেন্ডারিতে ফার্স্ট হয়েছিল হিউম্যানিটিজে। নকশাল আন্দোলনে নেমে পড়ায় পরবর্তী রেজাল্ট তেমন ভাল নয়। রমেন স্টার পাওয়া ছেলে। এম এ-তে ইকনমিকস-এ প্রথম শ্রেণি। তুষার হায়ার সেকেন্ডারির সায়েন্স স্ট্রিমে শতকরা আটাত্তর নম্বর পেয়ে স্ট্যান্ড করেছিল। বি এসসি ফিজিক্স অনার্সে সেকেন্ড ক্লাস। এম এসসি করছে। দেবাশিস দিল্লি বোর্ডের পরীক্ষায় শতকরা একাশি পেয়ে পাশ করেছিল। বি এ এম এ-তে তেমন কিছু করতে পারেনি। চারজনের গায়েই স্কুল কলেজের গন্ধ, কারও ভাল করে দাড়ি গোঁফ পোক্ত হয়নি।

এদের মধ্যে রমেনকে একটু বেশি পছন্দ করে ধৃতি। ছেলেটি যেমন চালাক তেমনি গভীর। কথা কম বলে এবং সবসময়ে ওর মুখে একটা আনন্দময় উজ্জ্বলতা থাকে।

ধৃতি আজ রমেনকে একা টেবিলে কাজ করতে দেখে সামনে গিয়ে বসল।

কী হে ব্রাদার, কী হচ্ছে?

একটা রিপোর্ট লিখছি। কৃষিমন্ত্রীর ব্রিফিং।

 ও বাবা, অতটা লিখছ কেন? অত বড় রিপোর্ট যাবে নাকি? ডেসকে গেলেই হয় ফেলে রাখবে, না হলে কেটে হেঁটে সাত লাইন ছাপবে।

রমেন করুণ মুখে বলে, তা হলে না লিখলেই তো ভাল হত।

মন্ত্রীদের ব্রিফিং মানেই তো কিছু খোঁড়া অজুহাত। ওসব ছেপে আজকাল কেউ কাগজের মূল্যবান স্পেস নষ্ট করে না। খুব ছোট করে লেখো, নইলে বাদ চলে যাবে।

এই অবধি আমার মোটে চারটে খবর বেরিয়েছে। অথচ পঞ্চাশ-ষাটটা লিখতে হয়েছে।

এরকমই হয়। তবু তো তোমরা ফুল টাইম রিপোর্টার। যারা মফসসলের নিজস্ব সংবাদদাতা তাদের অবস্থা কত করুণ ভেবে দেখো। কুচবিহার বা জলপাইগুড়ি থেকে কত খবর লিখে পাঠাচ্ছে, বছরে বেরোয় একটা কি দুটো।

তা হলে আমাদের কভারেজে পাঠানোই বা কেন?

নেট প্র্যাকটিসটা হয়ে যাচ্ছে। এর পরে যখন পাকাঁপোক্ত হবে, স্কু করতে শিখবে তখন তোমাকে নয়েই হবে টানাটানি। যদি মানসিকতা তৈরি করে নিতে পারে তা হলে জার্নালিজম দারুণ কেরিয়ার।

তা জানি। আর সেইজনই লেগে আছি। আপনি কি আজ পি এম-এর রাজভবনের মিটিং কভার করছেন?

হু। আমি অবশ্য আলাদা ইনভিটেশনও পেয়েছি।

 রমেন একটু হেসে বলে, আশ্চর্যের বিষয় হল, আমিও পেয়েছি।

 ধৃতি একটু অবাক হয়ে বলে, তুমিও পেয়েছ! বলোনি তো!

চান্স পাইনি। আজ সকালেই লালবাজার থেকে বাড়িতে এসে দিয়ে গেল। আসলে কী জানেন, আমি একসময়ে একটা লিটল ম্যাগাজিন বের করতাম, কবিতাও লিখতাম, সেই সূত্র ধরে আমাকেও ডেকেছে।

এখন লেখো না?

 লিখি। অল্প স্বল্প। গত মাসেই দেশ-এ আমার কবিতা ছিল।

বটে। ধৃতি খুশি হয়ে বলে, মনে পড়েছে। আমি দেশ খুলেই আগে কবিতার পাতা পড়ে ফেলি। রমেন সেন তুমিই তা হলে।

অত অবাক হবেন না। আমার মতো কবি বাংলাদেশে কয়েক হাজার আছে।

তা থাক না। কবি কয়েক হাজার আছে বলেই কি তোমার দাম কমে যাবে?

ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই-এর নিয়ম তো তাই বলে। কবিতার ডিমান্ড নেই, কিন্তু সাপ্লাই অঢেল। প্রাইস ফল করতে বাধ্য।

ইকনমিকসের নিয়ম কি আর্টে প্রযোজ্য?

 খানিকটা তো বটেই। কবিতা লিখি বলে কজন আমাকে চেনে?

ধৃতি একটু হেসে বলে, একটা মনের মতো কবিতা লিখে তুমি যে আনন্দ পাও তা অকবিরা কজন পায়?

রমেনের মুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হল। উষ্ণ কন্ঠে বলল, কবিতা লিখে আমি সত্যিই আনন্দ পাই। এত আনন্দ বুঝি আর কিছুতে নেই।

তবে! দামটা সেইদিক দিয়ে বিচার কোরো। খ্যাতি বা অর্থ দিয়ে তা মাপাই যায় না। যাক গে, যাচ্ছ তো রাজভবনে?

যাব। বড্ড ভয় করে। কী হবে গিয়ে?

 চলেই না। আর কিছু না হোক, রাজভবনের ইন্টিরিয়রটা তো দেখা হবে।

তা বটে। ঠিক আছে, যাব।

 কাগজ কলম নিয়ে যেয়ো। যা দেখবে বা শুনবে তার নোট নিয়ে।

আমি নোট নেব কেন? কী হবে? রিপোর্ট তো করবেন আপনি।

 তাতে কী? আমি যা মিস করব তুমি হয়তো তা করবে না। দুজনের রিপোর্ট মিলিয়ে নিয়ে করলে জিনিসটা ভাল দাঁড়াবে।

মাথা নেড়ে রমেন বলল, ঠিক আছে।

 ডেসক থেকে বিমান হাত উঁচু করে ডাকল, ধৃতি! এই ধৃতি! তোর টেলিফোন।

ধৃতি গিয়ে তাড়াতাড়ি ফোন ধরল, ধৃতি বলছি।

আমি বলছি।

 কে বলছেন?

 গলা শুনে চিনতে পারছেন না? আমি টুপুর মা।

ধৃতি একটু স্তব্ধ থেকে বলল, আপনি এখনও কলকাতায় আছেন?

 মাইথন থেকে ঘুরে এলাম।

সেখানে কোনও খবর পেলেন?

না। কেউ কিছু বলতে চায় না। তবে আমার মনে হয় ওরা সবাই জানে যে টুপু খুন হয়েছিল।

ওরা মানে কারা?

 ওখানকার লোকেরা।

 কী বলছে তারা?

 কিছুই বলছে না, আমি অনেককে টুপুর কথা জিজ্ঞেস করেছি।

শুনুন, আপনি এলাহাবাদে ফিরে যান। এভাবে ঘুরে ঘুরে আপনি কিছুই করতে পারবেন না।

একেবারে যে পারিনি তা নয়। একজন বুড়ো লোক স্বীকার করেছে যে সে টুপুকে বা টুপুর মতো একটি মেয়েকে দেখেছে।

টুপুর মতো মেয়ে কি আর নেই? ভুলও তো হতে পারে!

পারেই তো। সেইজন্য আমি ফিফটি পারসেন্ট ধরছি। টুপুর ঘাড়ের দিকে বাঁ ধারে একটা জরুল আছে। সেটাই ওর আইডেনটিটি মার্ক। বুড়োটাকে সেই জরুলের কথা বলেছিলাম। সে বলল, হ্যাঁ, ওরকম জরুন সেও মেয়েটির ঘাড়ে দেখেছে। এতটা মিলে যাওয়ার পরও ব্যাপারটা উড়িয়ে দিই কী করে বলুন!

তা বটে।

টুপুর সঙ্গে একজন লোককেও দেখেছে বুড়োটা। খুব দশাসই চেহারা। বিশাল লম্বা। লোকটা নাকি টুপুর সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলছিল।

বুড়োটা কে?

একজন ফুলওয়ালা। টুপু লোকটার কাছ থেকে ফুল কিনেছিল।

ধৃতি একটু ঘামছিল উত্তেজনায়, ভয়ে। কণ্ঠস্বর যতদূর সম্ভব নির্বিকার রেখে সে বলল, ঠিক আছে, শুনে রাখলাম। কিন্তু আমি একজন সামান্য সাব-এডিটর। টুপুর ব্যাপারে আমি আপনাকে কোনও সাহায্যই করতে পারছি না। যা করার পুলিশই করবে।

টেলিফোনে একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে এল। টুপুর মা বলল, এখন তো ইমার্জেন্সি চলছে, তাই পুলিশ খুব এলার্ট। কিন্তু কেন যেন টুপুর ব্যাপারে তারা তেমন ইন্টারেস্ট নিচ্ছে না। এমনকী খুনটা পর্যন্ত বিশ্বাস করছে না।

বিশ্বাস করাটা নির্ভর করে এভিডেন্সের ওপর। আপনি আপনার মেয়ের খুনের কোনও এভিডেন্সই যে দিতে পারছেন না।

মায়ের মন সব টের পায়।

 কিন্তু পুলিশ তো আর মা নয়?

ঠিক আছে, আপনাকে আজ আর বিরক্ত করব না। কিন্তু কখনও-সখনও দরকার হলে ফোন করব। বিরক্ত হবেন না তো!

না, বিরক্ত হব কেন?

 আমি খবরের কাগজের অফিস কখনও দেখিনি। খুব দেখতে ইচ্ছে করে। একদিন যদি আপনার অফিসে গিয়ে হাজির হই তো দেখাবেন? যদি অসুবিধে না থাকে?

নিশ্চয়ই। কবে আসবেন?

এ যাত্রায় হবে না। এলাহাবাদে আমার অনেক সম্পত্তি। সব পরের ভরসায় ফেলে এসেছি। শিগগিরই ফিরতে হচ্ছে। তবে আমি প্রায়ই কলকাতায় আসি।

বেশ তো, যখন সুবিধে হবে আসবেন।

বিরক্ত হবেন না তো!

 না, এতে বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই। আজ ছাড়ি তা হলে?

 আপনার বুঝি খুব কাজ অফিসে?

কাজ না করলে মাইনে দেবে কেন বলুন?

আজ আপনার কী কাজ?

 আজ প্রাইম মিনিস্টারের একটা মিটিং কভার করতে হবে।

ওমা! প্রাইম মিনিস্টার? আপনারা কত ভাগ্যবান! কোথায় মিটিং বলুন তো।

 রাজভবন।

 ইস, কী দারুণ! আপনি প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলবেন?

বলব হয়তো।

ভয় করবে না?

ভয় কীসের?  পিএম নিজেই তো মিটিং ডেকেছেন। আমাদের কথা শুনবার জন্যই।

কী বলবেন?

 ঠিক করিনি। কথা জুগিয়ে যাবে।

একটা কথা পি এমকে বলবেন?

কী কথা?

বলবেন এ দেশে মেয়েদের বড় কষ্ট।

উনি নিজেও তো মেয়ে। উনি কি আর ভারতবর্ষের মেয়েদের কথা জানেন না?

জানেন। উনি সব জানে। এ দেশের মেয়েরা ওর মুখ চেয়েই তো বেঁচে আছে। তবু আপনি তো পুরুষ মানুষ, আপনার মুখ থেকে মেয়েদের করে কথা শুনলে উনি খুশি হবেন।

ওঁকে খুশি করা তো আমার উদ্দেশ্য নয়।

 টুপুর মা একটু চুপ করে থেকে বলে, তা ঠিক। তবে কী জানেন, ওঁকে খুশি করতে কেউ চায় না, সবাই শুধু ওঁর দোষটাই দেখে। পিএম একজন মহিলা বলেই কি আপনারা পুরুষেরা ওঁকে সহ্য করতে পারেন না?

তা কেন? পি এম মহিলা না পুরুষ সেটা কোনও ফ্যাক্টরই নয়। আমরা দেখব ওঁর কাজ।

আমার মনে হয় পুরুষেরা ওঁকে হিংসে করে।

তা হলে পি এম পুরুষদের ভোটই পেতেন না। আপনি ভুল করছেন। এ দেশের লোকেরা ইন্দিরা গাঁধীকে মায়ের মতোই দেখে।

বলছেন! কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না।

অবিশ্বাসের কিছু নেই। দেশটা একটু দুরে এলেই বুঝতে পারবেন।

তা তবশ্য ঠিক। আমি দেশের কতটুকুই বা দেখেছি! কলকাতা আর এলাহাবাদ। আপনি খুব ঘুরে বেড়ান, না?

খুব না হলেও কিছু ঘুরেছি, আর লোকের সঙ্গেও মিশি। আমি তাদের মনোভাব বুঝতে পারি।

জানেন আমাদের এলাহাবাদের হাইকোর্টেই ওঁর মামলাটা হচ্ছিল, আমরা তখন প্রায়ই কোর্টে যেতাম। কী থ্রিলিং! তারপর উনি যখন হেরে গেলেন, কী মন খারাপ!

হতেই পারে। আপনি খুব ইন্দিরা-ভক্ত।

তা বলতে পারেন। আমি ওঁর ভীষণ ভক্ত। আপনি নন?

 আমি! আমার কারও ভক্ত হলে চলে না।

ইন্দিরা এলাহাবাদের মেয়ে জানেন তো! আমাদের বাড়ি থেকে ওঁদের আনন্দ ভবন বেশি দূরেও নয়। ছাদে উঠলে দেখা যায়। আপনি তো গেছেন এলাহাবাদে, তাই না?

হ্যাঁ, তবে খুব ভাল করে শহরা দেখিনি।

এবার গেলে দেখে আসনে। খুব সুন্দর শহর।

আচ্ছা দেখব।

আর একটা কথা।

বলুন।

আপনার বোধহয় দেরি হয়ে যাচ্ছে কাজের।

 তেমন কিছু নয়।

বলছিলাম কী, আমাকে দয়া করে পাগল ভাববেন না।

ভেবেছি নাকি?

হয়তো ভেবেছেন। ভাবলেও দোষ দেওয়া যায় না। সেই এলাহাবাদ থেকে মাঝরাতে ট্রাঙ্ককল করা, তারপর মাঝে মাঝেই এইভাবে টেলিফোনে উত্ত্যক্ত করা, তার ওপর টুপুর ঘটনা নিয়ে উটকো দায় গপানো, আমি জানি আমার আচরণ খুব অদ্ভুত হচ্ছে। তবু আমি কিন্তু পাগল নই।

আপনি যা করেছেন তা স্বাভাকি অবস্থায় তো করেননি।

ঠিক তাই। শোকে তাপে অস্থির হয়ে কী করব তা ভেবেই পাচ্ছিলাম না।

আমি আপনাকে পাগল ভাবিনি। কিন্তু আমার একটা কথা জানতে ইচ্ছে করে। টুপুর বাবা কোথায়?

ওমা! বলিনি আপনাকে?

বলেছিলেন। তবে বোধহয় ভুলে গেছি।

আমার স্বামী বেঁচে থেকেও নেই।

তার মানে?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টুপুর মা বলে, মানে বুঝে আর কাজ নেই। আমার স্বামী ভাল লোক নন। তবে বড়লোকের ছেলে, তাই তাকে সবই মানিয়ে যায়।

তিনি এখন কোথায়?

 যতদূর জানি বম্বেতে। একটি কচি মেয়ের সঙ্গে থাকেন।

তিনি বেঁচে থাকতে আপনি তার সম্পত্তি পেলেন কী করে?

তার সম্পত্তি পেলাম শাশুড়ি সেইরকম বন্দোবস্ত করে রেখে গিয়েছিলেন বলেই। তাছাড়া আমার বাপের বাড়িও খুব ফেলনা ছিল না। সেদিক থেকেও কিছু পেয়েছি।

মাপ করবেন, এসব প্রশ্ন করা বোধহয় ঠিক হল না।

টুপুর মা একটু হাসলেন, আমাকে যে-কোনও প্রশ্নই করতে পারেন। আমার আর অপ্রস্তুত হওয়ার কিছু নেই। শোকে তাপে জ্বালায় আমি এখন কেমন একরকম হয়ে গেছি। আচ্ছা, আজ আর আপনাকে বিরক্ত করব না। ছাড়ছি।

আচ্ছা।

 ধৃতি টেলিফোন রেখে দিল। তার ভ্রূ একটু কোঁচকানো। মুখ চিন্তান্বিত।

নিউজ এডিটর ডেসকের সামনে দিয়ে একপাক ঘুরে যাওয়ার সময় সামনে দাঁড়িয়ে বললেন ধৃতি, আজ তো তুমি পি এম-এর রাজভবন মিটিং কভার করবে।

হ্যাঁ।

কোনও পলিটিক্যাল ইস্যু তুলো না কিন্তু। মোটামুটি ইন্টেলেকচুয়ালদের প্রবলেমের ওপর প্রশ্ন করতে পারো। ইমার্জেন্সি নিয়েও কিছু বলতে যেয়ো না।

না, ওসব বলব না।

 আমাদের কাগজের ওপর রুলিং পাটি খুব সন্তুষ্ট নয়। টেক-ওভারের কথাও উঠেছিল। সাবধানে এগিয়ে।

ঠিক আছে।

ইয়ং রাইটারদের কাকে কাকে চেনো?

 কয়েকজনকে চিনি।

তা হলে তো ভালই। পি এমকে কী জিজ্ঞেস করবে বলে ঠিক করেছ?

ধৃতি মৃদু হেসে বলে, দেখি।

প্রধানমন্ত্রীকে ধৃতির অনেক কথা জিজ্ঞেস করার আছে। যেমন, আপনি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে ভালই করেছে বলে আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু সেটা এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে নির্বাচনী মামলায় হেরে যাওয়ার পর করলেন কেন? এতে আপনার ইমেজ নষ্ট হল না? কিংবা বিরোধীরা কোনও রাজ্যে সরকার গড়লেই কেন্দ্র তার পিছনে লাগে কেন? কেনই বা নানা উপায়ে সেই সরকারকে ফেলে দিতে চেষ্টা করে? আপনার কি মনে হয় না যে এতে সেই রাজ্যের ভোটাররা অপমানিত বোধ করতে থাকে এবং ফলে দ্বিগুণ সম্ভাবনা থেকে যায় ফের ওই রাজ্যে বিরোধীদের ক্ষমতায় ফিরে আসার? কিংবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর যখন আপনার ভাবমূর্তি অতি উজ্জ্বল, যখন স্বতসূর্ত ভোটের বন্যায় আপনি অনায়াসে ভেসে যেতে পারতেন তখন বাহাত্তরের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে যে ব্যাপক রিগিং হয় তার কোনও দরকার ছিল কি? আপনি এমনিতেই বিপুল ভোট পেতেন, তবু রিগিং করে এখানকার ভোটারদের অকারণে চটিয়ে দেওয়া কি অদূরদর্শিতার পরিচয় নয়? কিংব আপনি যেমন ব্যক্তিত্বে, ক্ষমতায়, বুদ্ধিতে অতীব উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত মানুষ, আপনার আশেপাশে বা কাছাকাছি তেমন একজনও নেই কেন? আপনার দলের সকলেই কেন আপনারই মুখাপেক্ষী, আপনারই করুণাভিক্ষু? কেন আপনার দলে তৈরি হচ্ছে না পরবর্তী নেতৃবৃন্দের সেকেন্ড লাইন অফ লিডারশিপ?

কিন্তু এসব প্রশ্ন করা যাবে না। ধৃতি জানে, এই জরুরি অবস্থায় এসব প্রশ্ন করা বিপজ্জনক। তাছাড়া এই চা-চক্রটি নিতান্তই বুদ্ধিজীবীদের। এখানে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক কথাই উঠতে পারে।

নিউজ এডিটর বললেন, একটু সাবধানে প্রশ্ন-টশ্ন কোরো। আর ওয়াচ কোরো কোন কবি সাহিত্যিক কী জিজ্ঞেস করেন।

ধৃতি একটু হেসে বলে, কবি সাহিত্যিকদের আমি জানি। তারা খুব সেয়ানা লোক। কোনও বিপজ্জনক প্রশ্ন তারা করবে না।

সে তো জানি। তবু ওয়াচ কোরো। আর দরকার হলে গাড়ি নিয়ে যেয়ো। মোটর ভেহিকেলসে তোমার নামে গাড়ি বুক করা আছে।

দরকার নেই।

 নেই? তা হলে ঠিক আছে।

মোটর ভেহিকিলসের গাড়ি নেওয়ার ঝক্তি অনেক। এই অফিসের সবচেয়ে কুখ্যাত বিভাগ হচ্ছে ওই মোটর ভেহিকলস, গাড়ি মানেই চুরি। পার্টস, পেট্রল, টায়ার। এই কারণে দেশের বড় বড় কোম্পানিগুলি তিতিবিরক্ত হয়ে নিজস্ব মোটর ভেহিকেলস ডিপার্টমেন্ট তুলেই দিচ্ছে। দিয়ে বাইরের গাড়ি ভাড়া করে দিব্যি কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ধৃতি কয়েকবারই অফিসের কাজে গাড়ি নিয়েছে। নিতে গিয়ে দেখেছে গাড়ির ইনচার্জ অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করে, দয়া করার মতো গাড়ি দেয়, গাড়ির ড্রাইভারও ভদ্র ব্যবহার করে না, সব জায়গায় যেতে চায় না। বলতে গেলে মহাভারত। তাই ধৃতি অফিসের গাড়ি পারতপক্ষে নেয় না। আজও নেবে না।

পাঁচটার পর ধৃতি আর রমেন বেরোল।

রাজভবনের ফটকে কড়া পাহারা। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ কার্ড দেখাতেই ফটকের পুলিশ অফিসার উলটেপালটে দেখে বলল, যান।

দুজনে ভিতরে ঢুকতেই আবার পুলিশ ধরল এবং আবার কার্ড দেখাতে হল। এবং আবার এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ মিলল।

রমেন নিচুস্বরে বলল, ধৃতিদা!

 বলো।

বেশ ভয় ভয় করছে।

কেন বলো তো!

 আপনার করছে না?

না। এক গণতান্ত্রিক দেশের প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, ভয় কীসের? আমিও গণ তিনিও গণ।

রমেন একটু হেসে বলে, পুলিশ তা মনে করে না।

তা অবশ্য ঠিক। তবে সিকিউরিটির ব্যবস্থা স্টেট গভর্নমেন্টই করেছে। পি এম-এর কিছু হলে সরকারের বদনাম।

রমেন মাথা নাড়ল। তারপর হঠাৎ বলল, আচ্ছা, রাজভবনের ভিতরের এই রাস্তায় নুড়ি পাথর ছড়ানো কেন তা জানেন?

এমনি। পেলের রাস্তা আরও কত জায়গায় আছে। বেশ লাগে।

 রমেন মাথা নেড়ে বলল, না। এর একটা অন্য কারণও আছে।

তাই নাকি?

আমার কাকা পুলিশে চাকরি করতেন। বিগ অফিসার ছিলেন। নাম বললেই হয়তো চিনে ফেলবেন, তাই আপাতত নাম বলছি না। যখন চৌ এন লাই কলকাতায় এসে রাজভবনে ছিলেন তখন কাকা ছিলেন তার সিকিউরিটি ইনচার্জ। তিনিই কাকাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমাদের রাজভবনের রাস্তায় নুড়ি পাথর ছড়ানো কেন।

তোমার কাকা কী বলেছিলেন?

আপনার মতোই সৌন্দর্যের কথা বলেছিলেন। চৌ এন লাই খুব মজার হাসি হেসে বলেছিলেন, মোটেই তা নয়। নুড়িপাথরের ওপর গাড়ি চললে শব্দ হচ্ছে। ব্রিটিশ আমলে লাটসাহেবদের সিকিউরিটির জন্যই ওই ব্যবস্থা। তারপর চৌ এন লাই কাকাকে একটা গাড়ির শব্দ শোনালেন। শুনিয়ে বললেন, নাউ ইউ সি দ্যাট অন এ পেবল রোড দি সাউন্ড অফ এ কার কামিং অর গোয়িং ক্যানট বি সাপ্রেসড!

ধৃতি হেসে বলল, তাই হবে। সাহেবদের খুব বৃদ্ধি ছিল।

চৌ এন লাইয়েরও কম ছিল না। আমার কাকা পুলিশ হয়েও যেটা বুঝতে পারেননি উনি ঠিক পেরেছিলেন।

সিঁড়ির মুখে আর এক দফা বাধা ডিঙিয়ে যখন লাউঞ্জে ঢুকল তারা, তখন সেখানে ভীরু ও সংকুচিত মুখে এবং সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে বেশ কয়েকজন কবি সাহিত্যিক ও আর্টিস্ট জড়ো হয়েছে। রাজভবনের কালো প্রাচীন লিফটের সামনে বেশ একখানা ছোটখাটো ভিড। এদের অনেককেই ধৃতি চেনে, রনেও।

কয়েক ব্যাচ লিফট বাহিত হয়ে ওপরে উঠে যাওয়ার পরই ধুতি আর রমেনের পালা এল। লিফটম্যান সাফ জানিয়ে দিল, দোতলায় মিটিং বটে কিন্তু লিফট খারাপ বলে দোতলায় থামছে না। তিনতলায় উঠে দোতলায় নামতে হবে।

ধৃতি লিফটের ব্যাপারটা মনে মনে নোট করল। খরচের ওপর এখন কড়া সেনসর। কাজেই রাজভবনের লিফট ত্রুটিযুক্ত এ খবরটা লেখা হলেও ছাপা যাবে কি না এতে ঘোর সন্দেহ।

তিনতলা থেকে দোতলায় সিঁড়ি ভেঙে নেমে এসে দুজনে কিছু আতান্তরে পড়ে গেল। লিফটের সামনে সংকীর্ণ করিডোরে নেমে কোনদিকে যেতে হবে বুঝতে না পেরে সকলেই গাদাগাদি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সিগারেট খেতেও কেউ সাহস করছে না। ফিসফাস কথা বলছে শুধু।

সেই ভিড়ে ধৃতি আর রমেনও দাঁড়িয়ে রইল।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যখন সকলেই খানিকটা উসখুস করছে তখনই অত্যন্ত সুপুরুষ এবং তরুণ এক মিলিটারি অফিসার করিডোরে ঢুকেই হাত নেড়ে সবাইকে প্রায় গোরু তাড়ানোর মতো করে নিয়ে তুলল দক্ষিণের প্রকাণ্ড বারান্দায়।

বারান্দার পরেই একখানা হলঘর। তাতে মস্ত মস্ত টেবিল পাতা। টেবিলে খাবার সাজানো থরে থরে। উর্দিপরা বেয়ারা ছাড়া সে ঘরে কেউ নেই। বোঝা গেল এই ঘরেই ইন্দিরার সঙ্গে তারা সবাই চা খাবে। তবে আপাতত প্রবেশাধিকার নেই। দরজায় গার্ড ডয়ে।

বারান্দায় কয়েকজন সিগারেট ধরাল। কে এসে চুপি চুপি খবর দিল। ময়দানের মিটিং শেষ হয়েছে। ইন্দিরা রাজভবনে রওনা হয়েছেন। সকলেই কেমন যেন উদ্বিগ্ন, অসহজ, অপ্রতিভ। যারা জড়ো হয়েছে তারা সবাই কবি সাহিত্যিক শিল্পী সাংবাদিক বটে, কিন্তু সকলেই সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের। রাজভবনে আসা বা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার তাদের জীবনে খুব একটা সাধারণ ঘটনা নয়। তার ওপর জরুরি অবস্থার একটা গা ছমছমে ব্যাপার তো আছেই।

খুবই আকস্মিকভাবে একটা চঞ্চলতা বয়ে গেল ভিড়ের ভিতর দিয়ে।

এলেব সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। স্মার্ট চেহারা, মূখে সপ্রতিভ হাসি, হাতজোড়। বললেন, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন তো! আসুন আসুন, এ ঘরে আসুন।

আবহাওয়াটা কিছু সহজ হয়ে গেল। হাত পায়ে সাড় এল যেন সকলের।

 হলঘরে ঢুকে ভাল করে থিতু হওয়ার আগেই ধৃতি অবিশ্বাসের চোখে দেখল, ইন্দিরা ঘরে ঢুকছেন।

সে কখনও ইন্দিরা গাঁধীকে এত কাছ থেকে দেখেনি। দেখে সে বেশ অবাক হয়ে গেল। ছবিতে যেরকম দেখায় মোটেই সেরকম নন ইন্দিরা। ছোটখাটো ছিপছিপে কিশোরীপ্রতিম তার শরীরের গঠন। গায়ের রং বিশুদ্ধ গোলাপি। মুখে সামান্য পথশ্রমের ছাপ আছে। কিন্তু হাসিটি অমলিন।

ইন্দিরা ঘরে ঢুকেই আবহাওয়াটা আরও সহজ করে দিলেন। ঘুরে ঘুরে অনেকের সঙ্গে কথা বললেন। সঙ্গে ঘুরছেন রাজ্যপাল ডায়াসের পত্নী।

ধৃতি প্রস্তুত ছিল না, হঠাৎ ইন্দিরা তার মুখোমুখি এসে গেলেন।

ধৃতি চিন্তা না করেই হঠাৎ ইংরিজিতে জিজ্ঞেস করল, ম্যাডাম, আপনি কবিতা গল্প উপন্যাস পড়েন?

স্নিগ্ধ হাসিতে মুখ ভরিয়ে ইন্দিরা বললেন, সময় তো আমার খুব কমই হতে থাকে। তবু পড়ি। আমি পড়তে ভালবাসি।

কীরকম লেখা আপনার ভাল লাগে?

একটু ভ্রূ কুঁচকে বললেন, হতাশাব্যঞ্জক কিছুই আমার পছন্দ নয়, জীবনের অস্তিবাচক দিক নিয়ে লেখা আমি পছন্দ করি।

মহান ট্র্যাজেডিগুলো আমার কেমন লাগে?

 যা মহান তা তো ভাল বলেই মহান।

আর সুযোগ হল না। আর একজন এসে মৃদু ঠেলায় সরিয়ে দিল ধৃতিকে।

ধৃতি সরে এল।

ইন্দিরা টেবিলের কাছে এগিয়ে গেলেন। থাক করা প্লেট থেকে একটা-দুটো তুলে দিলেন অভ্যাগতদের হাতে। ধৃতি সেই বিরল ভাগ্যবানদের একজন যে ইন্দিরার হাত থেকে প্লেট নিতে পারল। প্লেটটা নিয়েই সে মৃদু স্বরে বলল, ধন্যবাদ ম্যাডাম, আমি আপনার মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুন্দরী মহিলা জীবনে দেখিনি। সুন্দরীরা সাধারণত বোকা হয়।

ইন্দিরা তার এই দুঃসাহসিক মন্তব্যে রাগ করলেন না। শুধু মৃদু হেসে বললেন, জীবনে কোনও লক্ষ্য না থাকলে ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে না।

চমৎকার কথা। ধৃতি মনে মনে কথাটা টুকে রাখল।

রাজভবনের জলখাবার কেমন তা সাংবাদিক হিসেবেই লক্ষ করছিল ধৃতি। খুব যে উঁচুমানের তা নয়। মোটামুটি খেয়ে নেওয়া যায়। খারাপ নয়, এর চেয়ে বড় সার্টিফিকেট দেওয়া যায় না। তবে ইন্দিরা গাঁধীও এই খাবার মুখে দিচ্ছেন, এইটুকুই যা বলার কথা।

রমেন একটা প্যাষ্ট্রি কামড়ে ধভিকে নিচু স্বরে বলল, পি এম-কে আমার হয়ে একটা প্রশ্ন করবেন?

কী প্রশ্ন?

উনি কবিতা পড়ে কি না।

 ধৃতি মাথা নেড়ে বলল, আমি অলরেডি অনেক বাঁচালতা করে ফেলেছি। এবার তুমি করো।

ও বাবা, আমার ভয় করে।

ভয়! ইন্দিরাজিকে ভয়ের কী?

আপনার গাটস আছে, আমার নেই।

 গাটস নয়। আমি জানি ইন্দিরাজি সাধারণ মানুষের উর্ধ্বে। ওঁর একটা দারুণ কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, যা পলিটিক্যাল দলবাজিতে মার খায়নি। উনি হিউমার বোঝেন, আর্ট ভালবাসেন, সৌন্দর্যবোধ আছে, যা পলিটিক্সওয়ালাদের অধিকাংশেরই নেই। এই মানুষকে যদি ভয় পেতে হয় তো পাবে ওঁর প্রতিপক্ষরা, আমরা পাব কেন?

আপনি কি একটু ইন্দিরা-ভক্ত, ধৃতিদা?

আমি তো পলিটিক্স বুঝি না, কিন্তু মানুষ হিসেবে এই মহিলাকে আমার দারুণ ভাল লাগে। তবে তোমার প্রশ্নের জবাবে আমিই বলে দিতে পারি, ইন্দিরাজি কবিতা না ভালবেসেই পারেন না। ওঁকে দেখলেই সেটা বোঝা যায়।

আচমকাই মুখ্যমন্ত্রীর সামনে পড়ে গেল দুজন। মুখ্যমন্ত্রী রায় সকলকেই বদান্যভাবে স্মিতহাসি বিতরণ করছিলেন। ধৃতির দিকে চেয়ে সেই হাসিমাখা মুখেই বললেন, চা খেয়েই হলঘরে চলে যানে, কেমন?

ধৃতি মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।

.

হলঘরে অর্ধচন্দ্রাকৃতি গ্যালারির মতো। ডায়াসে পাঁচখানা চেয়ারে উপবিষ্ট ইন্দিরা, রাজ্যপাল ডায়াস ও তার স্ত্রী, সন্ত্ৰীক মুখ্যমন্ত্রী।

বুদ্ধিজীবীরা একে একে দাঁড়িয়ে সংক্ষিপ্ত আত্মপরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। নাম,কী লেখেন বা আঁকেন ইত্যাদি। ইংরিজি বা হিন্দিতে। ধৃতি দ্রুত নোট নিতে নিতেই নিজের পালা এলে দাঁড়িয়ে আত্মপরিচয় দিয়ে নিল।

ধৃতি স্পষ্টই বুঝতে পারছিল, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সহজ স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। প্রত্যেকেই আড়ষ্ট, নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত এবং কেউই আজকের আলোচনায় প্রাধান্য চায় না। সবকিছুরই মূলে রয়েছে ইমার্জেন্সি, ভারতবর্ষের সাম্প্রতিক ইতিহাসে যা একটি অভূতপূর্ব জুজুর ভয়। ইউ পি-তে নাসবন্দির কথা শোনা যাচ্ছে, দিল্লিতে বন্তি এবং বসত উচ্ছেদের কথা কানাকানি হচ্ছে, শোনা যাচ্ছে সংবিধানবহির্ভূত ক্ষমতার উৎস সয় গাধী ও তার অত্যুৎসাহী সাঙ্গোপাঙ্গদের কথা। প্রবীণ কংগ্রেস কর্মীরাও ভীত, বি বা উদ্বিগ্ন। সাধারণ মানুষ এবং বুদ্ধিজীবীরা ততোধিক। বিরোধী নেতাদের অনেকেই কারাগারে, ঠাটকাটা কতিপয় সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরাও অনুরূপ রাজরোষের শিকার। আর সবকিছুর মূলে যিনি, সেই অখণ্ড কর্তৃত্বময়ী নারী এখন ধৃতির চোখের সামনে ওই বসে আছেন। কিন্তু ধৃতি কিছুতেই মহিলাকে অপছন্দ করতে পারছিল না। একটু স্বস্তি তারও আছে ঠিকই, কিন্তু এই মহিলার মানবিক আকর্ষণটাও তত কম নয়। এঁকে সে ডাইনি ভাববে কী করে?

প্রাথমিক পরিচয়ের পালা শেষ হওয়ার পর দুচারজন উঠে একে একে ভয়ে ভয়ে দু-চার কথা বলল। তেমন কোনও প্রাসঙ্গিক ব্যাপার নয়। কেউ বলল, লেখক ও কবিদের জন্য একটা স্টুডিয়ো করে দেওয়া হোক। কারও প্রস্তাব, সরকার তাদের গ্রন্থ প্রকাশে কিছু সাহায্য করুক। এইরকম সব এলেবেলে কথা।

ইন্দিরা সাধ্যমতো জবাব দিলেন। কিছু জবাব দিলেন মুখ্যমন্ত্রী এবং তার স্ত্রীও। তবে কেউ কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছল না।

সবশেষে ইন্দিরা দু-চারটে কথা খুব শান্ত গলায় বললেন। প্রধান কথাটা হল, এখন নিরাশার সময় নয়। নৈরাশ্যকে প্রশ্রয় না দেওয়াই ভাল। শিল্পে বা সাহিত্যেও কিছু দায়বদ্ধতা থাকা উচিত এবং কিছু স্বতঃপ্রণোদিত দায়িত্ববোধও।

সবাই খুশি। তেমন কোনও ওপর-চাপান দেননি ইন্দিরা, শাসন করেননি, ভয় দেখাননি। স্বস্তির খাস ছাড়ল সবাই। জরুরি অবস্থায় শুধু একটু সামলে লিখতে বা আঁকতে হবে।

ধৃতি জানে, বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশেরই কোনও রাজনৈতিক বোধ বা দলগত পক্ষপাতিত্ব নেই। রাষ্ট্রনৈতিক সচেতনতার চাষ তারা বেশিরভাগই করেন না। একমাত্র বামপন্থী লেখক কবি বা শিল্পীরা এর ব্যতিক্রম। কিন্তু তারা সংখ্যায় তেমন বেশি নন।

তাছাড়া বামপন্থী বা মার্কসীয় সাহিত্য বাংলায় তেমন সফলও হয়নি। সুতরাং তাদের কথা না ধরলেও হয়। বাদবাকিরা রাজনীতিমুক্ত বুদ্ধিজীবী। রাজনীতির দলীয় কোন্দল থেকে তাদের বাস বহুদুরে। সেটা ভাল না মন্দ সে বিচার ভিন্ন। তবে এই জরুরি অবস্থার দরুন তারা কেউ আতঙ্কিত নন। কিন্তু অস্বস্তি একটা থাকেই। সেই অস্বস্তি ইন্দিরা আজ কাটিয়ে দিলেন।

অফিসে এসে রিপোর্ট লিখতে ধৃতির নটা বেজে গেল। কপিটা নিউজ এডিটরের টেবিলে গিয়ে রেখে সে বলল, শরীরটা ভাল লাগছে না। যাচ্ছি।

শরীর ভাল নেই তো অফিসের গাড়ি নিয়ে যাও। বলে দিচ্ছি।

না, চলে যেতে পারব।

 তা হলে সঙ্গে কাউকে নিয়ে যাও, বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

দেখছি। রিপোর্টটা আপনি যতক্ষণ পড়বেন ততক্ষণ অপেক্ষা করব কি?

না, তার দরকার নেই। কিছু অদলবদল দরকার হলে আমিই করে নিতে পারব। সেনসর থেকে আগে ঘুরে আসুক তো।

ধৃতি বেরিয়ে এল। কাউকে সঙ্গে নিল না। রাস্তায় একটা ট্যাকসি পেয়ে গেল ভাগ্যক্রমে। আর ট্যাকসিতে বসেই বুঝতে পারল তার প্রবল জ্বর আসছে। জ্বরের এই লক্ষণ ধৃতি খুব ভাল চেনে। ছাত্রাবস্থা থেকেই হোটেলে মেসে এবং রেস্তোরাঁয় আজেবাজে খেয়ে তার পেটে একটা বায়ুর উপসর্গ দেখা দিয়েছে। যখনই উপসর্গটা দেখা দেয় তখনই তার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠে যায় একশো তিন চার ডিগ্রি। এক ডাক্তার বন্ধু একবার বলেছিল, তোর জ্বর হলে পেটের চিকিৎসা করাবি, জ্বর সেরে যাবে।

এ জ্বরটা সেই জ্বর কি না বুঝতে পারছিল না সে। তবে যখন বাসার সামনে এসে নামল তখন সে টলছে এবং চোখে ঘোর দেখছে।

নিতান্তই ইচ্ছাশক্তির জোরে সে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে যেতে চেষ্টা করল। থেমে থেমে, দম, নিয়ে নিয়ে। পরমা বাসায় আছে তো! যদি না থাকে তবে একটু বিপাকে পড়তে হবে তাকে।

দোতলা অবধি উঠে তিনতলার সিঁড়িতে পা রেখে রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ধৃতি। মাথাটা বড় টলমল করছে।

কী হয়েছে আপনার?

ধৃতি আবছা দেখল, একটা মেয়ে, চেনা মুখ। এই ফ্ল্যাটবাড়িরই কোনও ফ্ল্যাটে থাকে। বেশ চেহারাখানা, বুদ্ধির ছাপ আছে।

ধৃতি ঘন এবং গাঢ় খাস ফেলছিল, শরীরটা বাস্তবিকই যে কতটা খারাপ তা এতক্ষণ সে টের পায়নি, এবার পাচ্ছে, তবু মর্যাদা বজায় রাখতে বলল, আমি পারব।

আপনার যে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।

পারব। ও কিছু নয়।

সত্যিই পারবেন? আমার দাদা আর বাবা ঘরে আছে, তাদের ডাকি? ধরে নিয়ে ওপরে দিয়ে আসবে।

ধৃতি মাথা নেড়ে বলল, পারব, একটু রেস্ট নিয়ে নিই তা হলেই হবে।

 তবে আমাদের ফ্ল্যাটে বসে রেস্ট নিন। আমি পরমাদিকে খবর পাঠাচ্ছি।

 সহৃদয় পুরুষ এবং সহৃদয়া মহিলার সংখ্যা আজকাল খুব কমে গেছে। আজকাল ফুটপাথে পড়ে-থাকা মানুষের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। দায়িত্ব নিতে সকলেই ভয় পায়। মেয়েটির আন্তরিকতা তাই বেশ লাগছিল ধৃতির। সে রাজি হয়ে গেল।

কিন্তু দু ধাপ সিঁড়ি নামতে গিয়েই মাথাটা একটা চক্কর দিয়ে ভোম হয়ে গেল। তারপরই চোখের সামনে হলুদ আলোর ফুলঝুরি। ধৃতি একবার হাত বাড়াল শেষ চেষ্টায় কিছু ধরে পতনটা সামলানোর জন্য। কিন্তু থাই। নিজের শরীরের ধমাস করে শানে আছড়ে পড়ার শব্দটা শুনতে পেল ধৃতি। তারপর আ জ্ঞান রইল না।

যখন চোখ চাইল তখন পরমা তার মুখের ওপর ঝুঁকে আছে। মুখে উদ্বেগ।

 ধৃতি চোখ মেলতেই পরমা মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে? একটু ভাল?

ধৃতি পূর্বাপর ঘটনাটা মনে করতে পারল না। শুধু মনে পড়ল, সিঁড়ির ধাপে সে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল। শরীরটা আগে থেকেই দুর্বল লাগছিল তার। শরীরে জ্বর। কিন্তু এই জ্বর তার হয় পেটের গোলমাল থেকে। দীর্ঘকাল মেসে হোটেলে খেয়ে তার একটা বিশ্রী রকমের অম্বলের অসুখ হয়। এখনও পুরোপুরি সারেনি। সেই চোরা অম্বল থেকে পেটে গ্যাস জমে মাঝে মাঝে জ্বর হয় তার। আর এই অবস্থায় শরীর তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে।

ধৃতি পরমার মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলল, খুব ভয় পেয়ে গেছ, না?

ভয় হবে না! কীভাবে পড়ে গিয়েছিলেন! ওরা সব ধরাধরি করে যখন নিয়ে এল তখন তো আমি সেই দৃশ্য দেখে কাঠ হয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার এসে বলে গেল, তেমন ভয়ের কিছু নেই।

ধৃতি একটা গভীর শ্বাস ফেলে বলল, ভয় পেয়ো না। এরকম জ্বর আমার মাঝে মাঝে হয়।

জ্বর হতেই পারে। কিন্তু মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন কেন?

ধৃতি ফের একটু মুখ টিপে হেসে বলল, ওই মেয়েটাকে দেখেই বোধহয় মাথা ঘুরে গিয়েছিল।

যাঃ! ইয়ারকি হচ্ছে?

কেন, মেয়েটা সুন্দর নয়?

সুন্দর নয় তো বলিনি। তবে মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো নয় মোটেই। পৃথাকে আপনি বহুবার দেখেছে।

ধৃতি, আর ইয়ারকি দেওয়ার মতো অবস্থা নয়। সে ক্লান্তিতে চোখ বুজল।

 শুনছেন? ডাক্তার আপনাকে গরম দুধবার্লি খাইয়ে দিতে বলে গেছেন।

দুধবার্লি আমি জীবনে খাইনি। ওয়াক।

অসুখ হলে লোকে তবে কী খায়?

 ও আমি পারব না।

না খেলে দুর্বল লাগবে না?

 পি এম-এর পার্টিতে খেয়েছি। খিদে নেই।

কী খাওয়াল ওখানে?

অনেক কিছু।

পি এম-কে দেখলেন?

দেখলাম।

আপনি ভাগ্যবান। আমাকে দেখালেন না তো? আচ্ছা আপনি ঘুমোন। একটু বাদে তুলে খাওয়াব।

ঘুমিয়ে পড়লে আমাকে আর ডেকো না পরমা। একটানা কিছুক্ষণ ঘুমোলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

তাই কি হয়? খেতে হবে।

হবেই?

না খেলে দুর্বল হয়ে পড়বেন।

 ধৃতি একটু চুপ করে থেকে বলল, ওরা আমাকে চ্যাংদোলা করে ওপরে এনেছিল, না?

প্রায় সেইরকম? কেন বলুন তো।

আমিও বুঝতে পারছি না হঠাৎ একটা সুন্দর মেয়ের সামনে গাড়লের মতো আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম কেন। বিশেষ করে মেয়েটা যখন ওদের ঘরে নিয়ে যাচ্ছিল আমাকে।

পরমা সামান্য হেসে বলে, অজ্ঞান কি কেউ ইচ্ছে করে হয়?

ইচ্ছাশক্তিও এক মস্ত শক্তি। ইচ্ছাশক্তি খাটাতে পারলে আমি কিছুতেই অজ্ঞান হতাম না।

এ নিয়ে এত ভাবছেন কেন? কেউ তো আর কিছু বলেনি।

 বলার দরকারও নেই। আমি শুধু ভাবছি আমার ইচ্ছাশক্তি এত কম কেন।

 মোটেই কম নয়। আজ আপনার খুব ধকল গেছে। সেইজন্য।

 ধৃতি একটু গুম হয়ে থেকে বলে, আচ্ছা কী খাওয়াবে খাইয়ে দাও। শোনো তোমাদের রাত্রে রুটি হয়নি?

হচ্ছে।

তাই দুখানা নিয়ে এসো। সঙ্গে ডাল-ফাল যা হোক কিছু।

শঙ্কিত গলায় পরমা বলে, রুটি খেলে খারাপ হবে না তো?

আরে না। বালিফার্লি আমি কখনও খাই না। দুধও চুমুক দিয়ে খেতে পারি না। রুটিই আনো।

 পরমা উঠে গেল।

ধৃতি চেয়ে রইল সিলিং-এর দিকে। বড় আলো নেভানো। ঘরে একটা কমজোরি বালবের টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে মাত্র। ধৃতি চেয়ে রইল। স্মরণকালের মধ্যে সে কখনও অজ্ঞান হয়নি। শরীর শত খারাপ হলেও না। তবে আজ তার এটা কী হল? ভিতরে ভিতরে ক্ষয় হচ্ছে না তো তার? জীবনীশক্তি কমে যাচ্ছে না তো?

নিজেকে নিয়ে ধৃতির চিন্তার শেষ নেই।

পরমা রুটি নিয়ে এল। দুখানার বদলে ছখানা। ডাল, তরকারি, আলুভাজা, মাংস অবধি।

 ও বাবা, এ যে ভোজের আয়োজন।

রুটিতে ঘি মাখিয়ে দিয়েছি।

 বেশ করেছ। আমার বারোটা তুমিই বাজারে।

ওমা, আমি বারোটা বাজাব কী করে?

 জ্বরো রুগিকে কেউ ঘি খাওয়ায়?

রুটি শুকনো কেউ খায়?

ধৃতি একটু হাসল। পরমাকে বুঝিয়ে কিছু লাভ নেই। গ্রে ম্যাটার ওর মাথায় খুবই কম। তবে পরমা মেয়েটা বড় ভাল মানুষ। ধৃতি তাই খেতে শুরু করে দিল। কিন্তু বিস্বাদ মুখে তেমন কিছুই খেয়ে উঠতে পারল না। পরমার অনেক তাগিদ সত্বেও না।

ওষুধ খেয়ে সে ক্লান্তিতে চোখ বুজল এবং ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু জ্বর-যন্ত্রণায় কাতর শরীরে নিপাট নিদ্রি ঘুম হয় না। রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ ঘুমের চটকা ভেঙে চোখ চেয়েই সে পিপাসায় ওঃ বলে শব্দ করল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কে যেন কাছে এল। একটা সুন্দর গন্ধ পেল ধৃতি। ঘুমজড়ানো চোখে অবাক হয়ে দেখল, পরম।

তুমি! তুমি জেগে আছ কেন?

 ওমা! আপনার এত জ্বর আর আমি পড়ে পড়ে ঘুমোব?

ধৃতি ম্লান একটু হেসে বলে, বন্ধুপত্নী, তুমি বড়ই সরলা।

 সরলা! হোয়াট ডু ইউ মিন? বোকা নয় তো!

বোকা ছাড়া আর কী বলা যায় বলো তো তোমাকে। একেই তো পর-পুরুষের সঙ্গে এক ফ্ল্যাটে বসবাস করছে। তার ওপর আবার এক ঘরে এবং এত রাতে।

তাতে কী হয়েছে বলুন তো!

এখনও কিছু হয়নি বটে, তবে হতে কতক্ষণ। কথাটা বাইরে জানাজানি হলে যা একখানা নিন্দে হবে দেখো।

ঠোঁট উলটে পরমা বলে, হোক গে। তা বলে একশো চার জ্বরের একজন রুগিকে একা ঘরে ফেলে রাখতে পারব না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধৃতি বলে, একটু জল দাও।

পরমা জল দেয় এবং ধৃতি শোয়ার পর তার কপালে জলে ভেজা ঠান্ডা করতলটি রেখে নরম স্বরে বলে, ঘুমোন, আমি আরও কিছুক্ষণ আপনার কাছে থাকব।

থাকার দরকার নেই। এবার গিয়ে ঘুমোও।

জ্বরটা আর একটু কমুক। তারপর যাব।

এত ভাবছ কেন বলো তো!

কী জানি কেন, তবে কারও অসুখ করলে আমি খুব নার্ভাস হয়ে পড়ি। আপনাকে তো দেখার কেউ নেই।

ধৃতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ক্কচিৎ কদাচিৎ তারও এ কথাটা মনে হয়। তার বাস্তবিকই কেউ নেই। দাদা দিদি এরা থেকেও অনাত্মীয়। তবে বয়সের গুণে এবং কাজকর্মের মধ্যে থাকার দরুন আত্মীয়হীনতা তাকে তেমন উদ্বিগ্ন করে না। বরং কেউ না থাকায় সে অনেকটাই স্বাধীন। তবু এইরকম অসুখ-বিসুখের সময় বা হঠাৎ ডিপ্রেশন এলে একাকিত্বটা সে বড় টের পায়।

পরমা কপালে একটা জলপটি লাগাল। বলল, মাথাটা একটু ধুয়ে দিতে পারলে হত।

এত রাতে আর ঝামেলায় যেয়ো না। আমি অনেকটা ভাল ফিল করছি।

একশো চার জ্বরে কেমন ভাল ফিল করে লোকে তা জানি।

তুমি সত্যিই জেগে থাকবে নাকি?

থাকব তো বলেছি।

ধৃতি পরমার দিকে তাকাল। আবছা আলোয় এক অদ্ভুত রহস্যময় সৌন্দর্য ভর করেছে পরমার শরীরে। এলো চুলে ঘেরা মুখখানা যে কী অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে। কিন্তু ধৃতি পরমার প্রতি কখনওই কোনও শারীরিক আকর্ষণ বোধ করেনি। আজও করল না। কিন্তু মেয়েটার প্রতি সে এক অদ্ভুত ব্যাখ্যাতীত মায়া আর ভালবাসা টের পাচ্ছিল। জ্বরতপ্ত দুখান্না হাতে পরমার হাতখানা নিজের কপালে চেপে ধরে ধৃতি বলল, তোমার মনটা যেন চিরকাল এরকমই থাকে পরমা। তুমি বড় ভাল।

হঠাৎ পরমার মুখখানা তার মুখের খুব কাছাকাছি সরে এল।

গাঢ়স্বরে পরমা বলল, আর কমপ্লিমেন্ট দিতে হবে না। এখন ঘুমোন।

 ধৃতি ঘুমোল। এক ঘুমে ভোর।

 জ্বরটা ছাড়লেও দিন দুই বেরোতে পারেনি ধৃতি। তিনদিনের দিন অফিসে গেল।

ফোনটা এল চারটে নাগাদ।

 এ কদিন অফিসে আসেননি কেন? আমি রোজ আপনাকে ফোন করেছি।

ধৃতি একটু শিহরিত হল গলাটা শুনে। বলল, আমার জ্বর ছিল।

আপনার গলার স্বরটা একটু উইক শোনাচ্ছে বটে। যাই হোক, সেদিন পি এম-এর সঙ্গে আপনার ইন্টারভিউয়ের রিপোর্ট কাগজে পড়েছি। বেশ লিখেছেন। কিন্তু আপনারা কেউই পি এম-কে তেমন অস্বস্তিতে ফেলতে পারেননি।

পি এম অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। তাকে রংফুটে ফেলা কি সহজ?

তা বটে।

আপনি এখনও এলাহাবাদে ফিরে যাননি?

না। রোজই যাব যাব করি। কিন্তু একটা না একটা বাধা এসে যায়। আবার ভাবি, গিয়েই বা কী হবে। টুপু নেই, ফাঁকা বাড়িতে একা একা সময়ও কাটে না ওখানে।

এখানে কীভাবে সময় কাটাচ্ছেন?

এখানে! ও বাবাঃ, কলকাতায় কি সময় কাটানোর অসুবিধে? ছবির একজিবিশনে যাই, ক্লাসিক্যাল মিউজিক শুনি, থিয়েটার দেখি, মাঝে মাঝে সিনেমাতেও যাই, আর ঘুরে বেড়ানো বা মার্কেটিং তো আছেই।

হ্যাঁ, কলকাতা বেশ ইন্টারেস্টিং শহর।

 আপনারও কি কলকাতা ভাল লাগে?

 লাগে বোধহয়, ঠিক বুঝতে পারি না।

 বাড়িতে আপনার কে কে আছে?

আমার! আমার প্রায় কেউই নেই। এক বন্ধুর বাড়িতে পেয়িং গেস্ট থাকি।

 ওমা। বলেননি তো কখনও?

এটা বলার মতো কোনও খবর তো নয়।

 আপনার মা বাবা নেই?

না।

 ভাই বোন?

আছে, তবে না থাকার মতোই।

আপনি তা হলে খুব একা?

 হ্যাঁ।

 ঠিক আমার মতোই।

আপনার একাকিত্ব অন্যরকম। আমার অন্যরকম।

 আচ্ছা, একটা প্রস্তাব দিলে কি রাগ করবেন?

রাগ করব কেন?

আমাদের বাড়িতে আজ বা কাল একবার আসুন না।

কী হবে এসে? টুপুর ব্যাপারে আমি তো কিছু করতে পারিনি।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভদ্রমহিলা বললেন, কারওরই কিছু করার নেই বোধহয়। কিন্তু তাতে কী? আমি আপনার একটু সঙ্গ চাই। রাজি হবেন না?

 না, রাজি হতে বাধা নেই। আচ্ছা যাবখুন।

ওরকম ভাসা-ভাসা বলা মানেই এড়িয়ে যাওয়া। আপনি কাল বিকেলে আসুন। আমি অপেক্ষা করব।

কখন?

 চারটে।

বিকেলে যে আমার অফিস।

কখন ছুটি হয় আপনার?

 রাত নটা।

তা হলে সকালে আসুন। এখানেই দুপুরে খেয়ে অফিসে যাবেন।

ধৃতি হেসে ফেলে বলে, চাক্ষুষ পরিচয়ের আগেই একেবারে ভাত খাওয়ার নেমন্তন্ন করে ফেলছেন। আমি কেমন লোক তাও তো জানেন না।

ওপাশে একটু হাসি শোনা গেল। টুপুর মা একটু বেশ তরল স্বরেই বলল,বরং বলুন না যে, আমি আপনার অচেনা বলেই ভয়টা বরং আপনার।

ধৃতি বলে, আমি ভবঘুরে লোক, আত্মীয়হীন, আমার বিশেষ ভয়ের কিছু নেই। পুরুষদের বেলায় বিপদ কম। মহিলাদের কথা আলাদা।

আপনার কিছুই তেমন জানি না বৃটে, চাক্ষুষও দেখিনি, কিন্তু পত্র-পত্রিকায় আপনার ফিচার পড়ে জানি যে আপনি খুব সৎ মানুষ।

ফিচার পড়ে? বাঃ, ফিচার থেকে কিছু বুঝি বোঝা যায়?

যায়। আপনি না বুঝলেও আমি বুঝি। ভুল আমার কমই হয়। আরও একটা কথা বলি। আপনার মতোই আমও কিন্তু একা। আমার কেউ নেই বলতে গেলে। একা থাকি বলেই আমার নিরাপত্তার ভার আমাকেই নিতে হয়েছে। সামান্য কারণে অহেতুক ভয় বা সংকোচ করলে আমার চলে না। এবার বলু আসবেন?

ঠিক আছে, যাব।

সকালেই তো?

 খুব সকালে নয়। এগারোটা নাগাদ।

ঠিক আছে। ঠিকানাটা বলছি, টুকে নিন।

ঠিকানা নিয়ে ফোনটা ছেড়ে দেওয়ার পর ধৃতি ভাবতে লাগল কাজটা ঠিক হল কি না, না, ঠিক হল না। তবে এই ভদ্রমহিলা আড়াল থেকে তাকে যৎপরোনাস্তি বিব্রত করে আসছেন কিছুদিন হল। টুপু নামে এক ছায়াময়ীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক পরোক্ষ রহস্য। হয়তো মুখোমুখি ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা হলে সেই রহস্যের কুয়াশা খানিকটা কাটবে। তাই ধৃতি এই ঝুঁকিটুকু নিল। বিপদে যদি বা পড়ে তার তেমন ভয়ের কিছু নেই। বিপদ তেমন আছে বলেও মনে হচ্ছে না তার।

একটু অন্যমনস্কতার ভিতর দিয়ে দিনটা কাটল ধৃতির। পত্রিকায় ফিচার লিখলে প্রচুর চিঠি আসে। ধৃতিরও এসেছে। মোট সাতখানা। সেগুলো অন্যদিন যেমন আগ্রহ নিয়ে পড়ে ধৃতি, আজ সেরকম আগ্রহ ছিল না। কয়েকটা খবর লিখল, আড্ডা মারল, চা খেল বারকয়েক, সবই অন্যমনস্কতার মধ্যে। শরীরটাও দুর্বল।

একটু আগেভাগেই অফিস থেকে বেরিয়ে এল ধৃতি। সাড়ে আটটায় ঘরে ফিরে এসে দেখে, পরমা দারুণ সেজে ডাইনিং টেবিলে খাবার গোছাচ্ছে।

কী পরমা? তোমার পতিদেবটি ফিরেছে নাকি?

না তো! হঠাৎ কী দেখে মনে হল?

তোমার সাজ আর ব্যস্ততা দেখে।

খুব ডিটেকশন শিখেছেন।

তবে আজ এত সাজের কী হল?

বাঃ, সাজটাই বা কী করেছি। মুগার শাড়িটা অনেককাল পরি না, একটু পরেছি, তাই আবার একজনের চোখ কটকট করছে।

আহা, অত ঝলমলে জিনিস চোখে একটু লাগবেই। ব্যাপারটা একটু খুলে বললেই তো হয়। কেসটা কী?

পরমা খোঁপার মাথাটা ঠিক করতে করতে বলল, ফ্ল্যাটবাড়ি হল একটা কমিউনিটি, জানেন তো!

জানব না কেন, বুদ্ধ নাকি? ছমাস আগেই কলকাতার এই ফ্ল্যাটবাড়ির নিয়ো কমিউনিটি নিয়ে ফিচার লিখেছিলাম।

জানি। পড়েওছি। ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকতে গেলে সকলের সঙ্গে বোঝাপড়া রেখে চলতে হয়। আজ দোতলায় দোলাদের ফ্ল্যাটে চায়ের নেমন্তন্ন ছিল। ওদের মেয়ের জন্মদিন।

খুব খাওয়াল?

প্রচুর। মুরগি, গলদা, ভেটকি ফ্রাই, ফিশ রোল, লুচি, ফ্রায়েড রাইস, পায়েস..

রোখকে ভাই। তুমি ক্যালোরি হিসেব করে খাও না নাকি?

তার মানে?

ওরকম গান্ডেপিন্ডে খেলে যে দুদিনেই হাতির মতো হয়ে যাবে।

আহা, আমার ফিগার নিয়ে ভেবে ভেবে তো চোখে ঘুম নেই। আমি অত বোকা নই মশাই, একখানা মুরগির ঠ্যাং দুঘণ্টা ধরে চিবিয়ে এসেছি মাত্র।

রোল খাওনি?

আধখানা।

 গলদা ছেড়ে দিলে? চল্লিশ টাকা কিলো যাচ্ছে।

 ওই একটু।

দইটা কেমন ছিল?

 দই। না, দই করেনি তো। আইসক্রিম।

কেমন ছিল?

 বাঃ, আইসক্রিম আবার কেমন হবে? ভালই।

 মিষ্টির আইটেম করেনি তা হলে। ছ্যাঁচড়া আছে।

 মোটেই না। তিনরকম সন্দেশ ছিল মশাই।

ধৃতি মাথা নেড়ে বলল, না। তোমার ফিগার কিছুতেই রাখতে পারবে না পরমা। এত যে কেন খাও।

নজর দেবেন না বলছি।

 দিচ্ছি না। কেউ আর দেবেও না।

খুব হয়েছে। দোলা আপনার জন্যও চর্বচোষ্য পাঠিয়েছে। এতক্ষণ ঘরে সেগুলো নিচু আঁচে রেখে বসে আছি। দয়া করে এবার গিলুন।

আমার জন্য। আমার জন্য পাঠাবে কেন? তারা কি আমাকে চেনে?

এমনিতে চেনে না। তবে প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে দহরম-মহরম আছে মনে করে হঠাৎ চিনতে শুরু করেছে। যান তো, তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে আসুন।

ধৃতি হাত-মুখ ধুয়ে এল বটে, কিন্তু মুখে এক বিচ্ছিরি অরুচি জ্বরের পর থেকেই তার খাওয়ার আনন্দকে মাটি করে দিয়েছে। টেবিলে বসে বিপুল আয়োজনের দিকে চেয়ে সে শিউরে উঠে বলল, এক কাজ করা পরমা, মুরগি আর লুচি বাদে সব সরিয়ে নাও। ফ্রিজে রেখে দাও, পরে খাওয়া যাবে।

অরুচি হচ্ছে, না?

 ভীষণ খাবার দেখলেই এলার্জি হয় যেন।

কী করি বলুন তো আপনাকে নিয়ে!

 আমাকে নিয়ে তোমার অনেক জ্বালা আছে ভবিষ্যতে। বুঝবে।

এখনই কি বুঝছি না নাকি?

বলে পরমা সযত্নে তাকে খাবার বেড়ে দিল। একটা বাটিতে খানিকটা চাটনি দিয়ে বলল, এটা মুখে দিয়ে দিয়ে খাবে, রুচি হবে।

খেতে খেতে ধৃতি বলল, একটা মুশকিল হয়েছে পরমা।

কী মুশকিল?

টুপুর মা নেমন্তন্ন করেছে কাল।

কে টুপুর মা?

ওই যে সেদিন সুন্দর মেয়েটার ফোটো দেখলে, মনে নেই?

ওঃ, তা সে তো মরে গেছে।

বটেই তো, কিন্তু তার মা তো মরেনি!

নেমন্তন্নটা কীসের?

বোধহয় একটু আলাপ করতে চান।

আলাপও নেই?

নাঃ, শুধু ফোনে কথা হত।

কী বলতে চায় মহিলা?

 তা কী করে বলব? হয়তো টুপুর কথা।

বেচারা।

যাব কি না ভাবছি।

যাবেন না কেন?

একটু ভয়-ভয় করছে। অচেনা বাড়ি, অচেনা ফ্যামিলি…

তাতে কী, আলাপ হলেই অচেনা কেটে গিয়ে চেনা হয়ে যাবে। আপনি অত ভিতু কেন?

আমি খুব ভিতু বুঝি?

ভিতু নন? আমার সঙ্গে এক ফ্ল্যাটে থাকতে হচ্ছে বলে ভয়ে কাঁটা হয়ে আছেন।

ধৃতি চোখদুটো একটু বুজে রেখে খুব নিরীহভাবে জিজ্ঞেস করল, তোমার কোচটি কে বলো তো?

কোচ। কীসের কোচ?

তোমাকে এইসব আধুনিক কথাবার্তার ট্রেনিং দিচ্ছে কে?

কেন? আমার বুঝি কথা আসে না?

খুব আসে, হাড়ে হাড়ে আসে, কিন্তু ভাই বন্ধুপত্নী, তুমি তো এত প্রগতিশীলা ছিলে না এতদিন।

 হচ্ছি। আপনার পাল্লায় পড়ে। সে যাক গে, সব সময়ে অত ইয়ারকি ভাল নয়। ভদ্রমহিলা ডাকল কেন সেটা ভেবে দেখা ভাল।

আমি বলি কী পরমা, মেয়েছেলের কেস যখন তুমিও সঙ্গে চল।

আমি! ওমা, আমাকে তো নেমন্তন্ন করেনি।

 গুলি মারা নেমন্তন্ন।

 তা হলে কী বলে গিয়ে দাঁড়াব? একটা কিছু পরিচয় তো চাই।

বউ বলেই চালিয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু আমি যে ব্যাচেলর তা ভদ্রমহিলা জানেন।

 ইস, ওঁর বউ সাজতে বয়ে গেছে।

একটা কাজ করা যাক পরমা, গিয়ে দুজনে আগে হাজির হই। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।

পরমা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, ইচ্ছে করছে না এমন নয়। কিন্তু আমার মনে হয় আপনার এত উদবেগের কোনও কারণ নেই। গিয়ে দেখেই আসুন না।

ধৃতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বলল, তাই হবে। বোধহয় তুমি ঠিকই বলছ।

পরমা কিছুক্ষণ ধৃতির দিকে চেয়ে রইল। তারপর মৃদুস্বরে বলল, রাত হয়েছে। রোগা শরীরে আর জেগে থাকতে হবে না। শুয়ে পড়ুন গে। শুয়ে শুয়ে ভাবুন।

ধৃতি উঠল।

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়