মধ্যরাতে যৌবন ফিরে পেল বিনোদকুমার। কালীচরণের ঠেক থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে সে যৌবনটাকে বেশ টের পাচ্ছিল। মনটা একেবারে চলকে চলকে যাচ্ছে, কানায় কানায় ভরা যে! আকাশের দিকে তর্জনী তুলে সে ভগবানকে বলল, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ…
আশপাশটা একটু দেখেও নিল বিনোদ। বুড়ো বয়সটা নেড়ি কুকুরের মতো পায়ে পায়ে লেগে আছে নাকি? না, নেই। বুড়ো বয়সটা তাড়া খেয়ে হাওয়া হয়েছে। বিনোদের মনটা বড় খারাপ ছিল আজ। ওই যে সফল শালা কী কতগুলো কথা নাহক শুনিয়ে দিল, কাজটা কি উচিত হয়েছে ওর? কত বড় কেউকেটা রে তুই? অ্যাঁ! বড়লোক আছিস থাক না। তোর টাকায় পেচ্ছাপ করে এই বিনোদ।
ভিতরটা বড্ড গরম হয়ে ছিল বলে আজ আর কোনও আঁটবাঁধ মানেনি সে। বউয়ের তোশকের তলা থেকে এক খাবলা টাকা তুলে নিয়ে সোজা চলে এল কালীর ঠেক-এ! সময়টা জলের মতো বয়ে গেল।
রাস্তাটা একটু দুলছে বলে হাঁটাটা তেমন সটান হচ্ছে না তার। ঝুলা পোলের মতো দুলবার দরকারটাই বা কী রে তোর? একটু থিতু হ’ না বাপু। আজ বাড়িঘরগুলোও মোটে স্থির হয়ে নেই, বড্ড পাশ ফিরছে। তা হোক, সবাই আনন্দে থাকুক বিনোদের মতো। বুড়ো বয়স ঝেড়ে ফেলে এই যে নতুন বিনোদ বেরিয়ে এল, এটা কি টের পাচ্ছে লোকে?
আচ্ছা, সে যাচ্ছে কোথায়? সেই বুড়ি বউ আর বদ্ধ ঘরের দমচাপা বাড়িটায়? ওই রকম থেকে থেকেই তো বয়সের উইপোকা তার শরীরে বাসা বেঁধেছিল। যুবক বিনোদ ওই বুড়িটার কাছে যাবে কেন? সেটা তো নিয়ম নয় হে বাপু! এখন যেতে হলে কাঁচা বয়সের মেয়ের কাছেই যাওয়া ভাল। কিন্তু কারও কথাই মনে পড়ে না যে!
কুয়াশা চেপে ধরেছে চরাচর। সাদা ভূতের মতো চার দিক গুলিয়ে দিচ্ছে। রাস্তাঘাট বেভুল, উল্টোপাল্টা। এ রকম গোলমাল হলে বড় মুশকিল হয়। ভেজা ধুতিটা ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে লাগছে গায়ে। ধুতিটা ভেজা কেন তা বুঝতে পারছে না সে। বৃষ্টি পড়ছে কি? না কি জলে নেমে পড়েছিল! কিন্তু এখন সে ডাঙা জমিতেই হাঁটছে বটে! ঘড়াৎ করে একটা ঢেঁকুর তুলে সে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলে, আজ বড় আনন্দ… থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ…
হাতে টর্চ নিয়ে বাবাকে খুঁজতে বেরিয়েছে সরস্বতী আর বিম্ববতী। মা বারণ করেছিল, যেতে হবে না। আমার তোশকের তলা থেকে টাকা চুরি করে নিয়ে গেছে, আজ মদ গিলে আসবে। সরস্বতী আপত্তি তুলেছিল, বাবা তো ছেড়ে দিয়েছে মা!
—শয়তান কি আর রং বদলায়? হাবভাব আমি ভাল বুঝছিলাম না। ঠিকই ফিরবে। যাবে কোথায়? মুরোদ জানা আছে।
তবু দু’বোন কিছু ক্ষণ দেখে বেরিয়েছে। রাত দশটার পর গঙ্গারামপুরে আর কবরস্থানে তফাত নেই। তার ওপর আজ বড় দিক-ভুল কুয়াশা। হিম পড়ছে একটু একটু। রাস্তায় উঠে দু’বোনে ভয়ে ভয়ে দেখল, দোকানপাট সব বন্ধ। আলো তেমন নেই, খাঁ খাঁ করছে। কাশীনাথের পাইস হোটেলটা খোলা, কিন্তু খদ্দের নেই তেমন। বাসন ধোয়ার শব্দ হচ্ছে।
—হ্যাঁ রে দিদি, বাবা যদি মদ খেয়ে থাকে, তা হলে কী করবি? আমার যে মাতালকে খুব ভয়!
—দূর! মাতালকে ভয়, তা বলে বাবাকে তো নয়।
—যদি আমাদের চিনতে না পারে?
—মদ খেলে কি আর নিজের ছেলেমেয়েকে চিনতে পারে না নাকি?
দু’জনে খুঁজল খানিক, তবে তেমন করে খুঁজতে সাহস হল না। রাতের দিকে মাতাল-বদমাশদেরই তো জো!
—চল, বাড়ি যাই। দাদা এলে ঠিক বাবাকে খুঁজে আনবে।
সাইকেল চালিয়ে ফেরার সময়ে হঠাৎ প্রীতমের মনে হল, সীতুর দিদির মুখখানাই দেখা হয়নি তার। শেফালি না কী যেন নাম! মেয়ে নিয়ে তার কোনও চিন্তাভাবনা নেই। বিয়ের কথা ভাবে না, সংসার করার কথাও ভাবে না। তার এখন মেলা কাজ। ক্যারি করে নিয়ে এল অথচ মুখ-চেনাই হল না, এ একটা মজার ব্যাপারই হয়ে থাকল। কোথাও দেখলে চিনতেই পারবে না। কথাও কয়নি তার সঙ্গে বিশেষ।
বাড়ির সামনে এসে যখন নামল প্রীতম, তখন এগারোটা বাজে। সাইকেলখানা সযত্নে দু’হাতে তুলে গ্রিলের বারান্দায় রাখার সময় সে গন্ধটা পেল। একটা মৃদু মেয়েলি গন্ধ সাইকেলখানার গায়ে লেগে আছে।
ঠক করে দরজা খুলে সরস্বতী বেরিয়ে এল, দাদা, বাবা এখনও ফেরেনি।
—সে কী? কোথায় গেল বাবা?
—আমরা খুঁজে এলাম।
প্রীতম দাঁড়াল না। সাইকেলটা নামিয়ে পাঁইপাঁই করে চালিয়ে দিল। খালের ওপর সাঁকোটায় বেভুল হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিনোদ। কোন দিকে যাবে ঠিক পাচ্ছিল না। এখানে শুয়ে থাকলেও হয়। আর সেই কথাটাই নিজেকে বোঝাচ্ছিল সে। বাড়িঘর আবার কী, বউ ছেলেপুলে আবার কী, সংসার আবার কী, আকাশে ভগবান আর নীচে এই তুমি, এ বই আর কিছু নেই। ঠেসে আনন্দ করো বাবা। যৌবন ফিরে পেয়েছ, আর চাই কী? একটা ভোজ দিয়ে দিও বরং। ব্যাপারটা সাব্যস্ত হওয়ার পর বিনোদ হেঁকে সবাইকে জানান দিল, অ্যাই সবাই শুনে রাখো, কাল সবার ভোজের নেমন্তন্ন। বুঝলে! এই আমি খাওয়াব সব্বাইকে। সব্বাইকে। সব্বাইকে। কেউ যেন বাদ না যায়।
বিনোদের এই হাঁকটা শুনতে পেল প্রীতম। সাইকেলখানা গড়িয়ে কাছে এল, মদ খেয়েছ নাকি?
—কে? কে রে?
—বাড়ি চলো।
একগাল হাসল বিনোদ, ও তুই? এই সব্বাইকে নেমন্তন্ন করে দিলাম, বুঝলি!
—বেশ করেছ, এ বার চলো।
আর গাঁইগুঁই করল না বিনোদ। সাইকেলখানায় হাত রেখে টাল সামলে সামলে হাঁটতে লাগল। কোথাও একটা যাচ্ছে সে। সেই বুড়ি বউ, সেই চেনা ছেলে-মেয়ে, সেই বদ্ধ ঘরের খাঁচা, সেই বুড়ো বয়স। ভাল লাগে না বিনোদের।
গভীর রাতে বারান্দায় রাখা সাইকেলখানার গা থেকে একটা মিষ্টি মেয়েলি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল বাতাসে। সাইকেলখানার বড় ধকল গেছে আজ। রোজই যায়। আজ এত ধকলের পরও মিষ্টি গন্ধ মেখে বড় ভাল লাগছে তার। নিথর ঘুমের মধ্যেও তাই সাইকেলটা মাঝে মাঝে ফিকফিক করে হেসে উঠছে।

[সমাপ্ত]
সৌজন্যে: আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২ পৌষ ১৪১৩ রবিবার ৭ জানুয়ারি ২০০৭ থেকে ২১ মাঘ ১৪১৩ রবিবার ৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৭

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়