দিশাহারা রেমি অবিশ্বাসের চোখে ধ্রুবর দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তার সন্দেহ, ধ্রুব স্বাভাবিক মানুষ নয়। হয় পাগল, না হয় পয়লা নম্বরের বদমাশ। তবু মাঝরাস্তায় এই লোকটির সঙ্গে গোলমাল বাঁধিয়ে লাভ নেই। রেমির চোখে তখন জল এসে গেছে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে বলল, চলো শিগগির। তোমার পায়ে পড়ি। ট্রেন ছেড়ে দেবে।

ধ্রুব ম্যাগাজিনটা বগলদাবা করে ধীরে সুস্থে দাম মেটাল। তারপর বলল, চলো। কিন্তু একটা কথা বলে দিচ্ছি। অবাধ্যতা কোরো না। আমার কিন্তু কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই।

তারা কামরায় ফেরার পর গার্ড সাহেব একবার হানা দিয়েছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণকান্তর ছেলে বলে পরিচয় পাওয়ায় জল আর বেশিদূর গড়ায়নি। এমনকী জরিমানা পর্যন্ত দিতে হয়নি তাদের।

শিলিগুড়ি পর্যন্ত বাকি রাস্তাটা ধ্রুব আর গোলমাল করেনি। কারণ প্রচুর মদ খেয়ে সে একদম অচেতন অবস্থায় গাড়ির মেঝেয় পড়ে থেকেছে। একবার টেনে হিচড়ে তাকে সিটে তুলে শুইয়েছিল রেমি। দশ মিনিটের মাথায় আবার সে দড়াম করে মেঝেয় পড়ে যায় এবং পড়েই থাকে। রেমি আর তাকে তোলার সাহস পায়নি। পড়ে গিয়ে যদি ঘাড় বা হাত-পা ভাঙে?

কৃষ্ণকান্তর বন্ধু সুদর্শন রায় শিলিগুড়ির মস্ত ধনী লোক। তার চা বাগান, কাঠের ব্যাবসা, নিউ মার্কেটে বাহারি দোকান, কী নেই? দার্জিলিং-এ তার একটা ভাল হোটেলও আছে। সেই সুদর্শনবাবু গাড়ি নিয়ে স্টেশনে হাজির ছিলেন। সোজা তাদের নিয়ে তুললেন হাকিমপাড়ায় নিজের

প্রকাণ্ড বাড়িতে। বললেন, দার্জিলিং তো যাবেই। একদিন এখানে রেস্ট নিয়ে যাও।

ধ্রুব একটু গাঁইগুঁই করেছিল বটে, কিন্তু থেকেও গেল।

ওই একটি দিন রেমির বড় চমৎকার কেটেছিল। সুদর্শনবাবুর দুটি যুবতী মেয়ের সঙ্গে তার ভীষণ ভাব হয়ে গেল। বড়লোকের মেয়ে বলে কোনও দেমাক-টেমাক নেই, কিংবা তা রেমিকে দেখায়নি। সেই সঙ্গে জুটে গেল সুদর্শনবাবুর ভাইপো সমীর। যেমন ঝকঝকে চেহারা তেমনি বুদ্ধিদীপ্ত তার চালচলন আর কথাবার্তা। তারা চারজনে মিলে চমৎকার একটা টিম হয়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি যে কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে পারে তা রেমির অভিজ্ঞতায় ছিল না। সম্ভবত দায়িত্ব ও কাণ্ডজ্ঞানহীন ধ্রুবর কাছ থেকে ধাক্কা খেয়েই রেমির মধ্যে একটা ভয় ও নিঃসঙ্গতার বোধ জন্ম নেয়। তাই এই তিনটি স্বাভাবিক, প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা যুবক-যুবতীকে পেয়ে সে আঁকড়ে ধরল। সেই টিমে ধ্রুব ছিল না। কারণ আগের দিনের অঢেল মদ তখন তার ওপর শোধ নিচ্ছে, দারুণ মাথা ধরা, বমির ভাব ও দুর্বলতায় আচ্ছন্ন হ্যাংওভার কাটাতে সে সারাদিনটাই প্রায় বিছান! আলিঙ্গন করে রইল।

নন্দা, ছন্দা আর সমীরের সঙ্গে রেমি বেরোল শহর দেখতে। কী সুন্দর শহরটি। খানিকটা কলকাতার সঙ্গে খানিকটা গ্রাম মেশালে যেমন হয় আর কী। শহর ঘেঁষে একটি পাহাড়ি নদী বয়ে যাচ্ছে। মহানন্দা। উত্তরে মহান হিমালয়।

সমীর বলল, শিলিগুড়ি এখন ওয়েস্ট বেঙ্গলের সেকেন্ড সিটি। কলকাতার পরই শিলিগুড়ি।

কলকাতা-গরবিনী রেমি বলল, আহা রে, কলকাতার সঙ্গে টক্কর দেওয়া অত সস্তা নয় মশাই। শিলিগুড়িকে সাত জন্ম তপস্যা করতে হবে।

সমীর ছ্যাবলা নয়। একথার জবাবে মৃদু একটু হাসল মাত্র। হুড খোলা জিপগাড়িটা চালাচ্ছিল সে-ই। চোখে গগলস। কিছুক্ষণ বাদে সেই গগলসের ভিতর দিয়ে রেমির দিকে চেয়ে বলল, কলকাতা শুধু আপনারই নয় কিন্তু, আমাদেরও।

তাই নাকি?

যে-কোনও বাঙালিকেই জিজ্ঞেস করুন। নোংরা হোক, ঘিঞ্জি হোক, কলকাতার নিন্দে করলে যে-কোনও বাঙালি চটে যায়। আমি আরও বেশি চটি। কারণ কলকাতাকে আমার মতো করে কেউ আবিষ্কার করেনি। আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে কলকাতা।

রেমি বলল, তবু ভাল। আমি ভাবলাম আপনি বুঝি শিলিগুড়িকে তোল্লাই দিতে গিয়ে কলকাতাকে ছোট করছেন।

মোটেই নয়।

নন্দা বলল, সমীরদা অসম্ভব কলকাত্তাই। ছুটি পেলেই পালাবে। আমাদের তো বাবা সল্টলেকে অত বড় বাড়ি পড়ে আছে। কিন্তু আমার গিয়ে বেশিদিন থাকতে ইচ্ছে করে না।

ছন্দার অবশ্য অন্য মত। সে বলে, না বাবা, আমার কলকাতাই ভাল লাগে।

সেদিন তারা রেস্টুরেন্টে খেল, চোরাই হংকং মার্কেটে ঘুরে ঘুরে বিদেশি শাড়ি আর কসমেটিকস কিনল, সেভক রোড ধরে চলে গেল কালিঝোড়া পর্যন্ত। আর তারই ফাঁকে চারজনের টিমটা আরও আঠালো হয়ে উঠল।

পরদিন সেই চারজন এবং ধ্রুব একটা জোঙ্গা জিপগাড়িতে গেল দার্জিলিং। সমীর পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছিল বলে বেশি কথা বলছিল না। তার পাশে বসা ধ্রুবও চুপচাপ। কলকল করছিল শুধু তিন যুবতী পিছনের দিকে বসে। একান্ন মাইল রাস্তা টেরই পাওয়া গেল না।

কিন্তু মুশকিল হল বিকেলবেলা, যখন রেমি আর ধ্রুবকে দার্জিলিং-এ রেখে ওরা ফিরে আসবে। কারণ ধ্রুব হোটেলে ঢুকেই বার-এ সেঁটে বসে গিয়েছিল। বিকেল নাগাদ সে চুরচুর মাতাল। সুতরাং নন্দা, ছন্দা আর সমীর যদি শিলিগুড়ি ফিরে আসে তাহলে রেমি একা পড়ে যায়। এই অনাত্মীয়

শহরে একা একটি যুবতী মেয়ের কেমন কাটবে?

ধ্রুবকে সুদর্শনবাবুর হোটেলে রেখে তারা চারজন একটু বেড়াতে বেরিয়েছিল। ধ্রুব যেতে চায়নি বলেই তাকে নেওয়া হয়নি। বেড়িয়ে ফেরার পর ধ্রুবর অবস্থা দেখে সমীর মুখে আফসোসের চুকচুক শব্দ করে বলল, ম্যাডাম তো খুব অসুবিধেয় পড়বেন দেখছি। ধ্রুববাবু তো আউট।

ভয়ে বুক ঢিবঢিব করছিল রেমির। শুষ্ক গলায় সে বলল, আপনারা প্লিজ যাবেন না। ওর যদি কিছু হয় তাহলে কে দেখবে?

সমীর তার দিকে চেয়ে একটু হেসে বলে, ওর কিছু হবে না। বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিলেই রাত কেটে যাবে। ভয় আপনাকে নিয়ে। আপনার রক্ষক তো কেউ থাকছে না।

নন্দা আর ছন্দাও অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। তারা বুঝতে পারছিল রেমিকে এই অবস্থায় ফেলে যাওয়াটা ঠিক নয়। কিন্তু তাদেরও ফেরা দরকার। ছন্দার কলেজ আছে। নন্দারও কী সব এনগেজমেন্ট। খানিকক্ষণ শলা-পরামর্শের পর ঠিক হল, সমীর থেকে যাবে। দুই বোন ফিরে যাবে শিলিগুড়ি। তাদের ফিরতে কোনও অসুবিধে নেই। সুদর্শনবাবুর হোটেলেরই নিজস্ব গাড়ি তাদের পৌঁছে দিয়ে আসবে।

কিন্তু রেমি আজ জানে, সমীরেরও থেকে যাওয়ার কোনও দরকার ছিল না। সেই সুন্দর ছিমছাম হোটেলটির মালিক স্বয়ং সুদর্শনবাবু। হোটেলের বশংবদ কর্মচারীরা তাদের ভালই দেখাশোনা করতে পারত। সুতরাং সমীরের ওই কথাটা আপনার রক্ষক তত কেউ থাকছে না ঠিক নয়।

কিন্তু বলতে নেই, সমীর থাকায় রেমির বুকের মধ্যে এক আনন্দের খামচাখামচি শুরু হয়েছিল। সেই অবোধ রহস্যময় অনুভূতির কোনও মানে হয় না। এত বেহায়া বেহেড রেমি বিয়ের আগেও ছিল না কোনওদিন। কিন্তু মাতাল ধ্রুবই কি তাকে ঠেলে দিয়েছিল ওই অসামাজিক এক সম্পর্ক শুরু করার রাস্তায়?

নন্দা আর ছন্দা চলে যাওয়ার পর ধ্রুবকে বিছানায় পৌঁছে দেওয়া হল। একজন বেয়ারা মজুত থাকল ঘরে। নিঃসাড়ে ঘুমোতে লাগল ধ্ৰুব।

সমীর বলল, চলুন সেকেন্ড রাউন্ড বেড়িয়ে আসি। ভাল করে ঢাকাটুকি দিয়ে নিন। দারুণ। শীত।

জোঙ্গা গাড়িটায় আবার দুজনে বেরোল। তখন সন্ধের পর রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা, ম্যাল প্রায় জনশূন্য, মেঘ করে হঠাৎ একটু বৃষ্টি পড়ছে। রেমির তবু খারাপ লাগছিল না। বুকটা একটু কেমন করছিল। বারবার মনে হচ্ছিল এবার একটা কিছু হবে, কিছু ঘটবে, জীবনে একটা মোড় ফিরবে।

আস্তে আস্তে গাড়িটা বিভিন্ন চড়াই-উতরাই ভেঙে চালাচ্ছিল সমীর। কোথাও যাচ্ছিল না। উদ্দেশ্যহীন চলা।

জিজ্ঞেস করল, ধ্রুববাবু সম্পর্কে আমি খুব বেশি কিছু জানি না। কিন্তু শুনেছি এক সময়ে উনি খুব ব্রাইট বয় ছিলেন। এরকম কবে থেকে হল? ইজ হি ফ্রাষ্ট্রেটেড?

রেমি তার কী জানে? সে মৃদুস্বরে বলল, আমি তো বিয়ের পর থেকেই এরকম দেখছি। আগে কীরকম ছিল জানি না।

আপনি নিশ্চয়ই খুব লোনলি ফিল করেন!

সেটা কি আর বলতে হবে!

উনি খুবই ইয়ং। বয়সে বোধহয় আমার চেয়েও ছোট। এই বয়সে এত ডিপ ফ্রাষ্ট্রেশন আমি দেখিনি কারও। এঁর সঙ্গে আপনি ঘর করবেন কী করে?

সেটাই তো ভাবছি।

ভাবছেন? যাক বাঁচালেন। প্রশ্নটা করেই আমি মনে মনে জিব কাটছিলাম, অনধিকার চর্চা হয় গেল ভেবে।

রেমি ম্লান একটু হেসে বলল, অত ফরমাল হওয়ার দরকার নেই। আমি ভীষণ প্রবলেমের মধ্যে আছি। এই সময়ে আমার একজন বন্ধু দরকার যে গাইডেনস দিতে পারবে। আমি আপনার পরামর্শ চাই। ওকে নিয়ে কী করব বলুন তো?

সমীর একটু ভেবে বলল, আপনি যদি অনুমতি দেন তবে কাল সকালে আমি ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলে দেখতে পারি। তবে উনি খুব গম্ভীর। কাল থেকে বহুবার কথা বলার চেষ্টা করেছি। উনি তেমন ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছেন না।

তবু আপনি একটু কথা বলে দেখবেন। তবে দয়া করে আমার রেফারেন্স দেবেন না। তাহলে চটে যাবে।

আরে না না, আমি অত বোকা নই। আপনাকে আড়াল করাই তো আমার উদ্দেশ্য।

রেমি মৃদুস্বরে বলল, আমার খুব ভয় করছে দার্জিলিং বেড়াতে এসে।

কীসের ভয়?

আমার মনে হচ্ছে কর্তাটি অ্যাবনরম্যাল। যে-কোনও সময়ে আমার কথা ভুলে গিয়ে হয়তো আমাকে ছেড়েই কোথাও চলে যাবে।

ধ্রুববাবু কি এতই ইরেসপনসিবল?

হ্যাঁ। আপনি ধারণা করতে পারবেন না। আসার সময় বর্ধমান স্টেশনে এমন একটা কাণ্ড করেছিল যে আমার ভিতরে একটা ভয় ঢুকে গেছে। আমি ওকে বিশ্বাস করি না।

সমীর খুব হালকা গলায় বলল, আপনার মতো মেয়েকে ভুলে গিয়ে বা ফেলে রেখে কি যাওয়া যায়?

সমীরের এই ভুতিটুকু তার ভালই লাগল। সে বলল, আমি এমন কিছু না।

সে আপনি জানেন না। আমরা জানি। কিন্তু ধ্রুববাবু অ্যাবনরম্যাল, এটা কি ঠিক জানেন?

জানি। ওর সবচেয়ে বেশি রাগ ওর বাবার ওপর।

কেন বলুন তো! কৃষ্ণকান্তবাবুকে আমি চিনি। দারুণ লোক।

শ্বশুরমশাইয়ের তুলনা হয় না। তবু ও ওর বাবাকে দেখতে পারে না। সেটাই অস্বাভাবিক।

জেলাসি নয় তো!

কে জানে কী। এ প্রসঙ্গটা বাদ দিন।

সরি। দার্জিলিং আপনার কেমন লাগছে?

ভাল।

ধ্রুববাবু নরম্যাল থাকলে আরও ভাল লাগত।

সেটা ঠিক। তবে যতটা খারাপ লাগার কথা ছিল এখন ততটা খারাপ লাগছে না।

এ হচ্ছে কথার পিঠে কথার খেলা। কিন্তু রেমি বাস্তবিক কথার খেলা জানে না। সে যা বলেছিল তা অকপট মন থেকে উঠে আসা কথা। সত্যিই তো তার খারাপ লাগছিল না।

তারা যখন হোটেলে ফিরল তখন দার্জিলিং-এর নিয়ম অনুযায়ি অনেক রাত। রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ জনশূন্য। হোটেলেও দু-চারজন মদ্যপায়ি ছাড়া বাকি সবাই ঘরে দোর দিয়েছে।

ফাঁকা ডাইনিং হল-এ বসে রেমি আর সমীর বাতের খাবার খেলা খেতে খেতে রাত গড়িয়ে দিল অনেকটা। কথা আর শেষ হতে চায় না। ধ্রুবর সঙ্গে সাতদিনে যত কথা না হয় তার চেয়ে ঢের বেশি সেই কয়েক ঘণ্টায় হল সমীরের সঙ্গে রেমির। খাওয়ার পর লাউজে ইলেকট্রিক হিটারের সামনে নরম সোফায় কম্বলমুড়ি দিয়ে বসেও অনেকক্ষণ সময় কাটাল তারা।

তারপর একসময়ে রেমির মনে হল, এবার ঘরে যাওয়া দরকার। হোটেলে কেউ আর জেগে নেই। ধ্রুবকেও অনেকক্ষণ একা রাখা হয়েছে।

সে অনিচ্ছার সঙ্গে বলল, এবার যাই।

আরে বসুন বসুন, সবে তো সন্ধে।

এইভাবে যাই-যাই করে কাটল আরও কিছু সময়। যখন বাস্তবিকই ঘরে এল রেমি তখন রাত পৌনে একটা।

ধ্রুব তখনও অচেতন। রেমির অনেকক্ষণ ঘুম এল না। কেমন একটা উদভ্রান্ত উত্তেজনায় বুক কাঁপছে। বারবার শিহরিত হচ্ছে সর্বাঙ্গ। এরকম তার আগে কখনও হয়নি। এমনকী ফুলশয্যার রাতেও নয়। নিজেকে বহুবার ধিক্কার দিল সে। তারপর ঠাকুর-দেবতার পায়ে মাথা কুটতে লাগল মনে মনে, আমাকে রক্ষা করো। এ আমার কী হল? কেন হল? ছিঃ ছিঃ।

পরদিন ধ্রুবর ঘুম ভাঙল বেলায়। গভীর হ্যাংওভার। ভাল করে তাকাতে পারছে না। মাথা ধরা, বমি-বমি ভাব।

রেমি তীব্র বিরাগের সঙ্গে বলল, এটা কী ধরনের হানিমুন হচ্ছে আমাদের?

ধ্রুব মাথা চেপে ধরে আধশোয়া অবস্থায় তার দিকে চেয়ে বলল, কে বলেছে হানিমুন? এটা হল একসাইল। কৃষ্ণকান্ত চৌধুরীর পলিটিক্যাল ফিলড থেকে ধ্রুব চৌধুরীকে সরিয়ে দেওয়া। শুধু দেখাশোনা করার জন্য সঙ্গে তুমি।

তাই নাকি?

একজ্যাক্টলি তাই। যাও একটা হেভি ব্রেকহার্স্ট অর্ডার দিয়ে এসো। আর আমাকে ধরে একটু বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে যাও।

স্নান এবং ছোট হাজরির পর কিন্তু ছিপছিপে তেজি চেহারার ধ্রুবকে আবার বেশ তরতাজা দেখাচ্ছিল। নিজেই পোশাক-টোশাক পরল। বলল, চলো, একটু ঘুরে আসি।

হঠাৎ ভূতের মুখে যে বড় রাম নাম!

ধ্রুব একটু হেসে বলে, চলল, দেখা যাক একসাইলটাকে হানিমুন করে তোলা যায় কি না।

সত্যি নাকি?

একটা দীর্ঘশ্বাসকে চাপা দিল রেমি। ভিতরকার উত্তেজনায় সারা রাত সে এপাশ ওপাশ করেছে। পাপবোধ তাকে ছিঁড়ে খেয়েছে। ধ্রুবর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার শারীরিক বা মানসিক শক্তিতে তখন টান ধরেছে।

সে বলল, আমি হাঁটতে পারব না।

হাঁটতে হবে না। হোটেল থেকে একটা গাড়ি ম্যানেজ করা যাবে।

রেমি একটু তটস্থ হয়ে বলে, হোটেলের গাড়ি দরকার নেই। কালকের সেই জিপগাড়িটাই তো আছে।

কোন জিপগাড়িটা?

যেটায় আমরা এলাম। সমীরবাবুও আছেন।

কে সমীরবাবু? সুদর্শনকাকার ভাইপো?

অকারণে লাল হয়ে এবং মুখ নামিয়ে রেমি বলল, হ্যাঁ। তোমার ওই অবস্থা দেখে উনি আর কাল ফিরে যাননি।

ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে বোধহয় সেকেন্ড দুই রেমির দিকে চেয়ে রইল। আর রেমির তখন মনে হল, ধ্রুব তার ভিতরকার সব দৃশ্য দেখে ফেলছে। কী যে অস্বস্তি! সে তাড়াতাড়ি উঠে সাজপোশাকে একটু সংশোধন শুরু করে দিল।

ধ্রুব বলল, সুদর্শনকাকার মেজো মেয়েটার নাম যেন কী!

ছন্দা। কেন বলো তো?

ওই ছন্দার সঙ্গে বোধহয় সমীরের একটা আনহেলদি রিলেশন আছে।

রেমি ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠে বলে, যাঃ, কী যে বলো না!

ধ্রুব একটু অপ্রতিভ হয়ে বলে, অবশ্য আমার ভুলও হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল।

ওরা আপন খুড়তুতো জ্যাঠতুতো ভাইবোন, সে কথাটা ভুলে যেয়ো না।

তা বটে। তাহলে লেট আস গো। সমীরকে রেডি হতে বলো।

বলাই আছে! উনি তৈরি। আমরা নামলেই হয়।

যখন দুজনে নীচে নেমে এল তখন ধ্রুবর ফিটফাট চেহারা দেখে সমীর কিছুটা অবাক। বলল, আপনি হানড্রেড পারসেনট ফিট দেখছি।

ধ্রুব খুব লাজুক মুখে হেসে বলল, কাল একটু বেসামাল হয়েছিলাম। কিছু মনে করবেন না। শুনলাম, আমার জনাই আপনি আটকে গেলেন।

ও কিছু নয়।

ধ্রুব খুব ভদ্র গলায় বলল, কাল আপনি প্রায় সারাদিন গাড়ি চালিয়েছেন। আজ পাশে বসে রেস্ট নিন। আমি চালাব।

পারবেন? পাহাড়ি রাস্তা কিন্তু।

পারব।

আশ্চর্য এই, ধ্রুব চমৎকার পারল। গাড়ি টাল খেল না, ঝাঁকুনি লাগল না, এতটুকু বেসামাল হল না কোথাও। অত্যন্ত দক্ষ পাহাড়ি ড্রাইভারের মতোই সে ঘুম মনাস্টারি, সিনচাল লেক হয়ে কারশিয়ং পর্যন্ত নেমে এল। তারপর নিরাপদে আবার গাড়ি ফিরিয়ে আনল হোটেলে। পিছনে বসে মুগ্ধ বিস্ময়ে দৃশ্যটা দেখছিল রেমি। বুকের মধ্যে যেন দুটো হৃৎপিণ্ড ধুক ধুক করছিল তার। ধ্রুব! ধ্রুব যদি স্বাভাবিক হয়ে ওঠে তবে রেমি ধ্রুব ছাড়া আর কাউকে পাত্তা দেবে কি?

দুপুরে ভাত খাওয়া অবধি তিনজনে চমৎকার সময় কাটিয়ে দিল।

সমীর বলল, আজ আমার ফিরে যাওয়ার কথা। যদি অনুমতি দেন তাহলে যাই।

ধ্রুব মৃদু হেসে বলল, আমাকে বিশ্বাস করবেন না। দার্জিলিং-এর ওয়েদারের মতোই আমার মেজাজ। এই ভাল আছি, চার ঘণ্টা পরে হয়তো দেখবেন মেঝেয় গড়াগড়ি খাচ্ছি। তার চেয়ে বরং সুদর্শনকাকাকে একটা ফোন করে দিই, আপনি কয়েকটা দিন আমাদের সঙ্গেই থাকুন। রেমিরও একটা কমপ্যানি হবে।

সমীর হঠাৎ সেই সময়ে বলল, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে ধ্রুববাবু। আজ আপনার মেজাজটা ভাল আছে বলেই বলতে চাইছি।

আরে বলুন না!কী কথা! রেমি বরং ঘরে গিয়ে রেস্ট নিক। আমরা দুটো বিয়ার নিয়ে লাউঞ্জে বসি। সেই ভাল।

রেমি কাঁপা-কাঁপা বুক নিয়ে ঘরে এল। সমীর কী বলবে সে জানে না। কিন্তু হে ঠাকুর, এমন কিছু যেন না হয় যাতে ও চটে যায় কিংবা রেমিকে সন্দেহ করে।

অস্থির রেমি বিছানায় শুয়ে বই পড়ার চেষ্টা করল অনেকক্ষণ। মন দিতে পারল না। ঘণ্টাতিনেক কেটে যাওয়ার পর সে ক্লান্ত হয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। যখন ঘুম ভাঙল তখন সন্ধে হয়ে গেছে। ঘর ফাঁকা।

তাড়াতাড়ি উঠে নীচে নেমে এসে দেখল সমীর গম্ভীরভাবে লন-এ পায়চারি করছে একা।

সে কী? আপনি একা! ও কোথায়?

সমীর একবার কপালে হাত দিয়ে হতাশার ভঙ্গি করে বলল, হি ইজ বিয়ন্ড এভরিথিং।

তার মানে?

কিছু করা গেল না রেমি। আমি ভাল করে কথা বলা শুরু করার আগেই উনি আসছি বলে কেটে পড়লেন। কোথায় গেলেন কে জানে। ঘণ্টা দুই বাদে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে শুরু করলাম। খবর পেলাম, বাজারের কাছে একটা বার-এ মদ খেয়ে প্রচণ্ড হাঙ্গামা বাঁধিয়েছেন।

সে কী!–রেমির চোখ কপালে উঠল।

ব্যাপারটা স্যাড। কয়েকটা নেপালি ছোকরার সঙ্গে মারপিট হয়েছে। খুব বেশিদূর গড়ায়নি অবশ্য। তাহলে পেটে কুকরি ঢুকে যেত। তবে একটু চোট হয়েছে।

রেমি আর্তনাদ করে উঠল, ও কোথায় বলুন।

ডাক্তারখানায়। এখুনি আসবেন। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

নিশ্চয়ই আছে। ও কি উন্ডেড?

না, সেরকম কিছু নয়। বরং দুটো ছোকরা ওর হাতেই বেশি ঠ্যাঙানি খেয়েছে। উনি ঠিক আছেন। কপালটা একটু কেটেছে। আপনি অস্থির হবেন না। আমাদের হোটেলের ম্যানেজার নিজে গেছেন স্পটে।

রেমি অবশ হয়ে লনের একটা বেঞ্চে বসে পড়ল। অত্যন্ত সেকেলে ভঙ্গিতে বলল, কী হবে?

হয়তো কিছু হবে না। কিন্তু লোক্যাল ছেলেদের সঙ্গে গণ্ডগোল করায় এখানে আপনাদের থাকাটা আর সেফ নয়। আপনি বরং ঘরে গিয়ে এসেনশিয়াল কিছু গুছিয়ে নিন। সুটকেসটুটকেসগুলো থাক, পরে পাঠিয়ে দেবে। ধ্রুববাবু এলেই আমি আপনাদের নিয়ে শিলিগুড়ি নেমে যাব।

রেমি ভয় পেয়ে বলল, কেন? লোকাল ছেলেরা কি গণ্ডগোল করবে?

করতে পারে। সেটাই স্বাভাবিক।

রেমির হাত পা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল। কোনওরকমে ঘরে এসে সে পাগলের মতো ভুলভাল জিনিস ভরে একটা কিট ব্যাগ গোছাচ্ছিল। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা ধ্রুব ঘরে ঢুকে বিরক্ত গলায় বলল, কী করছ? আমরা শিলিগুড়ি যাচ্ছি না।

রেমি দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ধ্রুবর বুকে, কী করেছ তুমি? কী সর্বনেশে কাণ্ড করেছ? জানো না, এখানে মারপিট করতে যাওয়া কী ভীষণ রিসকি? কেন মারপিট করেছ?

ধ্রুব তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আরে, অত তাড়াতাড়ি সব কথার জবাব কী করে দেব? মারপিট করিনি, নিজেকে বাঁচাতে মেরেছি। তা বলে পালাব কেন?

কিন্তু সমীর যে বলল—

হ্যাং সমীর। আমার গায়ে হাত পড়লে জল অনেক দূর গড়াবে রেমি। তুমি শ্বশুরের কথা ভুলে যাচ্ছ!

তখন স্থির হল রেমি। সত্যিই তো। ঘটনার আকস্মিকতায় সে বিস্মৃত হয়েছিল যে তার শ্বশুর কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী। শুধু দার্জিলিং কেন, সারা দেশের সর্বত্রই তার প্রভাব ছড়ানো। তবু সে বলল, কিছু হবে না তো?

কী হবে?–বলে ব্যঙ্গের হাসি হেসে ধ্রুব বলে, বাবার কাছে অলরেডি ট্রাংক কল-এ খবর চলে গেছে। পুলিশ হেভি অ্যাকশন নিচ্ছে। কিছু ভেবো না রেমি, লিডারের ছেলে হতে কপাল লাগে।

সকালটা সুন্দর কেটেছিল রেমির। কিন্তু সেই সন্ধেবেলাই আবার ধ্রুবর মেজাজ পালটাল।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়